প্রিয়তমা পর্ব-১০ ১১

0
2283

#উপন্যাস
#প্রিয়তমা ( ১০+১১)
লেখা- শারমিন মিশু
বিয়ে হয়েছে আজ সাতদিন হয়ে গেছে।আজ আনাসের বিয়ে উপলক্ষে নেয়া ছুটির শেষদিন। কাল থেকে আবার সেই চিরাচরিত নিয়মের অফিস শুরু। বিয়ে উপলক্ষে আসা বাড়ির সব অতিথিরা প্রায় চলে গেছে। আনাসের বড় বোন ও আজ চলে গেছে । আরিবাও কাল চলে যাবে কানাডায় তার বরের কাছে। শুধু ভাইয়ের বিয়ের জন্য ফ্লাইটের ডেট পিছিয়ে দিয়েছিলো। আরিবা চলে যাবে শুনে লামিয়ার অনেক খারাপ লাগছে। এই কয়দিনে আরিবার সাথে লামিয়ার অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মেয়েটা এতো এতো কথা বলতে পারে যে ওর সামনে কেউ মন খারাপ করে থাকতে পারেনা। লামিয়াকে প্রায় সব ব্যাপারে আরিবা নিজেই সাহায্য করছে। কখন কার কি লাগবে? কখন কোন কাজটা করতে হবে? বাড়ির সব নিয়ম কানুন আরিবা লামিয়াকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছে।ও চলে গেলে বাড়িটা পুরো শূন্য শূন্য হয়ে যাবে। একাকীত্ব একটা জীবন শুরু হয়ে যাবে। সেইজন্য লামিয়ার বেশি খারাপ লাগছে।
রাহেলা চৌধুরী সেই সকালে কিচেনে ডুকেছে। মেয়েটা কাল চলে যাবে। আবার কবে না কবে ফিরবে তার কোন ঠিক নেই। তাই মেয়ের জন্য নানারকম পিঠা বানাচ্ছেন কয়েক পদের রান্না করেও দিচ্ছেন ওখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। লামিয়াও শাশুড়িকে সাথে সাথে হেল্প করছে।
সব কাজ শেষ করার পর রাহেলা লামিয়াকে বললো,,, মা যা কাজ আছে আমি করে নিবো। আর রিপাতো আছেই(বাসার কাজের মেয়ের নাম রিপা)।
তুমি গিয়ে আরিবাকে সবকিছু গুছিয়ে নিতে একটু সাহায্য করো।
লামিয়া আচ্ছা বলেই আরিবার ঘরের দিকে গেলো। আরিবা বোধহয় ফোনে কথা বলছে। লামিয়া দরজায় দাঁড়িয়ে বললো,,, আপু আসবো?
-আরে ভাবি!! আসো অনুমতি নেয়ার কি আছে?
-লামিয়া রুমের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে বললো,,,আপু কারো রুমে প্রবেশের আগে অনুমতি নিতে হয় হাদীসে বলা আছে।
-আরিবা ফোন কান থেকে নামিয়ে,,,সেটা তো বাহিরের কারো বাসায় প্রবেশের আগে নিতে হয় আমি জানতাম। নিজের বাসার কারো রুমে আসতেও অনুমতি নিতে হয় নাকি?
-জী আপু সন্তান বাবা মায়ের রুমে আসতে,,, মা বাবা সন্তানের রুমে যেতে কিংবা বোন ভাইয়ের রুমে,,, ভাই বোনের রুমে আসতে ও অনুমতি নিতে হয়। কারণ আমরা নিজেদের রুমে বাহিরের মত পর্দায় আবৃত থাকিনা। কে কোন অবস্থায় রুমে থাকি বাহিরের কেউ জানেনা। তাই অনুমতি নেয়াটা প্রয়োজন। এতে আমাদের সবার জন্য কল্যাণ নিহিত।
-আচ্ছা!!!!অনেক ভালো কথা বলেছো তো ভাবি। আসলে কখনো এভাবে ভেবে দেখিনি বা মেনে ও চলিনা। এখন থপকে এ নিয়মটা মেন চলার চেষ্টা করবো।
– জাযাকাল্লাহ। আপু কি কি গুছাতে হবে আমাকে বলো আমি গুছিয়ে দিচ্ছি।
-না না আমি সব করে নিবো।তোমাকে কিচ্ছু করতে হবেনা।
-আপু না করোনা। এমনিতে চলে যাবে শুনে আমার কষ্ট হচ্ছে। তোমার সাথে কাজ করতে করতে একটু কথা ও বলা যাবে। কাল তো চলেই যাচ্ছো।
-ভাবি আমার ও যেতে ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু কি করবো বলো যেতেই হবে।
-হুম।
-আর সত্যি কথা কি জানো? বিয়ে হয়েছে আজ ৮বছর এখনো কোন বাচ্ছা নেই। ও থাকে বিদেশে পড়ে বছরে একবার দেশে আসে তাও কয়দিনের জন্য। আমি বাসায় একা একা থাকি। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু আজ অবদি একটা বাচ্ছার মুখ দেখলাম না। এটা নিয়ে ওর ও অনেক আফসোস। ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর ডাক্তার জানালো,,, দুজনকে একসাথে একজায়গায় থেকে ঔষধ চালিয়ে যেতে হবে তাহলে হয়তো কোন আশার মুখ দেখা যাবে। সেইজন্য যাওয়া যদি আল্লাহ আমার প্রতি একটু রহমত করে।
-আপু বিয়ের পর পর তখন তোমরা কোন চেষ্টা করোনি বাচ্ছার জন্য?
-সমস্যা তো ওখানেই৷ আমি বিয়ের পর পরই কোন বাচ্ছা নিতে চাইনি পড়াশুনার ক্ষতি হবে ভেবে। ভাবতাম সবে বিয়ে হয়েছে একটু স্বাধীনভাবে জীবন কাটাই। এতো তাড়াতাড়ি বাচ্ছা নিতে চাইনি।বাচ্ছাকাচ্ছা হলে তো জীবনটা পুরাই বদলে যাবে তাই তখন বাচ্ছা নিতে চাইনি।
আর একটা সত্যি কথা কি জানো? যে কথাটা আজ অবদি আমি কাউকে বলার সাহস পাইনি এমনকি আনানকেও বলতে পারিনি। আজ তোমার কাছেই বলছি। এ কয়দিনে আমার মনে হয়েছে তুমি আমার জন্য একটা ভরসার জায়গা বলে আরিবা কেঁদে দিলো।
-লামিয়া একটু ভয়ার্ত কন্ঠে বলে কি সত্যি কথা আপু? আর তুমি কাঁদছো কেন?
-আরিবা চোখের পানি মুছে ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,,,আমি আমার বিয়ের পর পরই কনসিভ করেছি। যেটা আনান আজ ও জানেনা। তার বা আমার পরিবারের কেউ ও জানেনা। কিন্তু আমি তখন বাচ্ছা চাইনি কোনভাবে। আমি প্র্যাগনেন্ট এ ব্যাপারটা আমি তখন কোনভাবে মেনে নিতে পারিনি। শুধুমাত্র নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে আনান চলে যাওয়ার পরে দুইমাসের গর্ভের বাচ্ছাটাকে এভোরশন করে ফেলেছি কাউকে না জানিয়ে।
-লামিয়া আশ্চর্যিত কন্ঠে মুখে হাত দিয়ে ,,, ইন্নালিল্লাহ্!!!! আপু কি বলছো এসব তুমি?
-আরিবা লামিয়ার হাত চেপে ধরে,,,যা সত্যি তাই বলছি ভাবি। আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্য যা আজ অবদিও আমি কাউকে বলার সাহস পাইনি। তখন বুঝিনি কতবড় অন্যায় আমি তখন করেছি। একজন মহাপাপী আমি। যে মা হয়ে নিজের অনাগত বাচ্ছাকে এ দুনিয়ার আলো দেখার আগে নিজ হাতে খুন করেছি আমি। একজন খুনী আমি। পৃথিবীতে মনে হয় এর চেয়ে বড় কোন পাপ নেই ভাবি। শুনেছি নারী হয় মমতাময়ী। প্রতিটি নারীর মাঝে নাকি একজন মা বাস করে। তাহলে আমি সেদিন এতো পাষান হলাম কি করে?
আজ বুঝতে পারছি আল্লাহ আমাকে এখন সন্তান না দিয়ে আমার করা সেই পাপের শাস্তি দিচ্ছে।
-লামিয়া কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো আপু অনেক বড় অন্যায় করেছো তুমি অনেক বড় অন্যায়। কি যানি আল্লাহ মাপ করবে কিনা।
-আরিবা কেঁদে কেঁদে বললো তখন চাইনি মা হতে কিন্তু এখন মা হওয়ার তীব্র আকাঙ্খা আমার। একজন নারী তখনই সার্থক দশ মাস গর্ভে ধরে যখন একটা শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাতে সক্ষম হয়। একজন নারীর সবচেয়ে বড় অর্জন সন্তানের মুখে মা ডাক শুনা।মাতৃত্বের যন্ত্রণা কত তীব্র আজ বুঝতে পারছি।
-আপু এটাই তো আমাদের সমস্যা,,, যখন আমরা কোনো অন্যায় করি তখন বুঝতে পারিনা যে এটা অন্যায়। আর যখন বুঝতে পারি তখন শুধরানোর কোন অবকাশ আর পাইনা।
-কিন্তু ভাবি,,,, অন্যায় তো আমি করেছি। কিন্তু ওই মানুষটাকে কেন আল্লাহ শাস্তি দিচ্ছে যার সন্তানের মুখে বাবা ডাক শোনার জন্য এতো হাহাকার? জানো ও যখন আমাকে বলে আরু,,, আমার একটা সন্তান চাই শুধু একটা সন্তান। তখন আমার বুক ফেটে যায় ইচ্ছে করে চিৎকার করে কাঁদি কিন্তু কাঁদতে পারিনা ওর সামনে। ও আমার চোখের পানি সহ্য করতে পারেনা। সন্তান না হওয়ার জন্য অনেকেই আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছি কিন্তু ও কখনো কিচ্ছু বলেনি আমাকে। আল্লাহর কাছে নামাজ পড়ে কত চাইছি একটা সন্তানের জন্য। আল্লাহ যেনো আমার জন্য ওকে কষ্ট না দেয় সবসময় এটাই নামজ পড়ে আল্লাহর কাছে চাই।
-আপু জানিনা কি হবে। তবে এতটুকু বলছি তুমি আল্লাহর দরবারে বেশি বেশি করে তাওবা করো। নিজের পাপের জন্য তার কাছে ক্ষমা চাও। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো। বান্দা যত বড় অপরাধ করুক না কেন খাচ দিলে আল্লাহর কাছে তওবা করলে আল্লাহ চরম পাপী বান্দাকে ও ক্ষমা করে দেয়। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করো। আল্লাহ সবচেয়ে বড় ক্ষমাশীল,,, দয়ার সাগর তিনি তার কাছে কোন কিছুর অভাব নেই।
-আমি সব করবো নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য। আল্লাহর কাছে দিনরাত তাওবা করবো। আমার জন্য একটু দোয়া করো। আল্লাহ জেনো তার রহমতের ভান্ডার থেকে আমার মত পাপী বান্দাকে একটু রহমত দান করে।
আরিবা লামিয়ার হাত ধরে,,, বোন আজ যে কথাটি তোমাকে বলেছি কথা দাও কাউকে বলবেনা।
-আপু নিশ্চিত থাকো আমি কাউকে বলবোনা। আর আল্লাহ নিশ্চয় তোমার ডাক শুনবে।
-একটা কথা বলি ভাবি,,, আমার মত ভুল করোনা কখনো। বিয়ের প্রথম প্রথম একটা বাচ্ছা নিয়ে নিও। আমার মত চরম ভুল যেন কখনো করোনা। প্লিজ ভাবি!!! আজ বুঝতে পারছি সংসারে একটা বাচ্ছা না থাকলে এইসব ক্যারিয়ার ট্যারিয়ার কিচ্ছুনা। সব বৃথা!!!!
-লামিয়া চুপ করে আছে এই মুহুর্তে ওর কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা। বসে বসে আরিবার সব প্যাকিং করে দিচ্ছে।
আনাস বাহিরে থেকে ফিরেছে ঘন্টাখানেক হয়েছে। কিন্তু লামিয়ার কোন দেখা নাই। মাকে দেখেছে কিচেনে কিন্তু লামিয়া ছিলনা। মাকে জিজ্ঞেস করতে ও পারেনি লামিয়ার কথা কি না কি বলে বসে। আর মায়ের কাছে বউয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাটা শোভনীয় ও নয়। রুমে এসে শুয়ে আছে এক ঘন্টার মত হয়েছে কিন্তু উনি মহারাণীর কোন দেখা নেই। আনাস কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রুম ছেড়ে বেরুলো লামিয়া কোথায় আছে দেখার জন্য। আরিবার রুমে আসতেই দেখলো ওখানে লামিয়া আরিবার সাথে বসে আছে। আনাস দরজায় দাঁড়িয়ে বললো,,, আরিবা কি করছিস?
লামিয়া আনাসের গলা পেয়ে পিছনে তাকলো। কি ব্যাপার উনি কখন আসলো? আবার মুখ ঘুরিয়ে সামনে কাজে মন দিলো
আরিবা বললো,,,কিছুনা ভাইয়া প্যাকিং করছি। ভেতরে আয়।
আনাস আরিবার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আবার চলে গেলো। যাওয়ার সময় ইশারায় লামিয়াকে রুমে আসতে বললো।
আরিবা না চাইতেও বিষয়টা নজরে পড়ে গেছে। লামিয়া আরিবার দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো।
আরিবা বললো,,, ভাবি ভাইয়া মনে হয় রেগে আছে যেভাবে তাকালো যাও রুমে যাও।
আরিবার কথায় লামিয়া একটু লজ্জা পেলো। আরো কিছুক্ষণ ওখানে বসে লামিয়া ধীর পায়ে রুমে গেলো। আনাস কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। লামিয়ার পায়ের শব্দ শুনে কপাল থেকে হাত সরিয়ে বললো,,, আপনার কথা শেষ হয়েছে ম্যাডাম?
-না মানে…..
-কি না মানে? আমি বাসায় কখন আসলাম আপনার কোন খবর আছে?
-আপু চলে যাবেতো তাই সব গুছাতে আপুকে একটু হেল্প করেছি। আর আমি কি জানতাম নাকি আপনি বাসায় আসছেন।
-ম্যাডাম আপনার ননদীনী চলে যাবে তাই তার হেল্প করছেন। আমিও তো কাল থেকে অফিসে চলে যাবো আপনার কি মনে হয়না আজ আমার ও একটু বেশি বেশি সেবাযত্ন করা দরকার?
-লামিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
-ওইভাবে তাকাতে হবেনা দরজাটা লাগিয়ে এসে মাথাটা একটু টিপে দিনতো!!! উফ!!! মাথাটা কি যন্ত্রণা করছে বলে মাথায় হাত দিলো আনাস।
-লামিয়া দরজা লাগিয়ে আনাসের পাশে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে মাথা ম্যাসাজ করছে।
-আনাস দুহাত দিয়ে লামিয়াকে জড়িয়ে ধরে,,, নিচের দিকে তাকিয়ে আছো কেন? একটু আমাকেও দেখ। কাল থেকে আর এভাবে সুযোগ পাবেনা আজ একটু স্বামির ভালো করে সেবাযত্ন করো।
-লামিয়া লজ্জা পেয়ে লজ্জাবতী লতার মত নিজেকে আরো গুটিয়ে নিলো। আর আনাসের হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে সরাতে এদিক সেদিক নড়াচড়া শুরু করলো।
-এমন নড়াচড়া করছো কেন চুপ করে থাকতে পারোনা। আর নিয়ের একসপ্তাহ হয়ে যাওয়ার পর ও তোমার লজ্জা কাটেনি? তোমার এতো লজ্জা কই থেকে আসে বুঝিনা আমি। নড়াচড়া না করে একটু চুপ করে বসোতো একটু ভালো করে দেখি। তুমি জানোনা স্বামী স্ত্রী দুজন দুজনকে দিকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে যতবার দেখবে ততবারই নেকি অর্জন করবে। নেকি অর্জনের এতবড় সুযোগ হাতছাড়া করি কিভাবে যদি তা ফ্রী তে পাওয়া যায় কি বলো? বলে লামিয়াকে আরো কাছে টেনে নিলো।
-আচ্ছা আপনি এই দিন দুপুরে শুরু করেছেন কি? আপনার না মাথা ব্যাথা করছে?
-কি করছি আমি?নিজের প্রিয়তমাকে ভালোবাসার মত মহান একটা কাজ করছি। তোমার কোন সমস্যা আছে?
আর মাথাব্যথা ছিলোতো কিন্তু (লামিয়ার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে)তোমার এই নরম হাতের ছোঁয়া পেয়ে এখন সেরে গেছে
-ছাড়ুনতো!!!! কেউ এসে পড়বে তো!!!
-এই বন্ধ রুমে তুমি আমি ছাড়া অন্য কেউ কিভাবে আসবে বলোতো?
-ছাড়ুন না!!! আমার কাজ আছে।
-সব কাজ শেষ হয়েছে আমি ভালো করে জানি।
-সবাই কি বলবে বলুনতো?
-আচ্ছা তুমি কি আমাকে বোকা বা ছোট বাচ্ছা মনে করেছো? এই মুহুর্তে মা আর আরিবা ছাড়া আছেটা কে? যে কেউ কিছু মনে করবে। আর কেউ কিছু মনে করলেই বা আমার কি? আমি আমার বউকে আদর করছি তাতে কার কি প্রবলেম? বলেই লামিয়াকে নিজের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে নিলো।
-আচ্ছা আপনার কি লাজ লজ্জা বলে কিছু নাই?
-আনাস দু্ষ্ট হাসি হেসে বলে,,,,না নেই আমি নির্লজ্জ মানুষ!! লজ্জা নারীর ভূষণ আমার না!!!! আর এমনিতেও সব লজ্জাতো আল্লাহ আপনাকে দিয়ে রেখেছে তাই আমি নির্লজ্জ। দুজনে লজ্জাবতী হলে ভালোবাসা বাসি হবে কেমনে?
-আপনি আসলেই চরম আকারের একজন অসভ্য লোক।
-আচ্ছা আমি অসভ্য?? আমি যখন অসভ্য তাহলে একটুখানি অসভ্যতামি তো দেখাতে হয় এখন। বলেই লামিয়ার ওষ্ঠদ্বয় নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে পুরো ডুবিয়ে নিলো।
চলবে……

#উপন্যাস
#প্রিয়তমা (১১তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
আরিবার ফ্লাইট সকাল ১০টায়। আটটায় বেরিয়ে গেছে। লামিয়ার শশুর আর আনাস আরিবার সাথেই বেরিয়ে গেছে আরিবাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে উনারা ওখান থেকে অফিসে চলে যাবে।
আরিবা যাওয়ার সময় লামিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,,,,ভাবি আমার জন্য একটু ভালো করে দোয়া আল্লাহ যেন তার এই পাপী বান্দীর প্রতি একটু মুখ তুলে তাকায়।
-আপু আল্লাহর উপর ভরসা হারিয়ো না। আল্লাহ এক সময় না একসময় তোমাদের ডাক শুনবে।
সবাই চলে যেতেই পুরো বাসাটা কেমন নিরব হয়ে গেছে। শাশুরিকে জিজ্ঞেস করে রিপাকে সাথে নিয়ে লামিয়া দুপুরের রান্নাটা সেরে নিয়েছে। আজ রাহেলা চৌধুরির মন অনেক খারাপ আদরের ছোট মেয়েটা চলে গেছে দেশ ছেড়ে। তাই তিনি রুমের দরজা আটকে শুয়ে আছেন।হয়তো কান্না করছে।
এর মাঝে অবশ্য মায়ের ফোনে আনাস একবার ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে লামিয়ার।
একা একা সময় যেন লামিয়ার কিছুতে কাটছেনা। শাশুড়ি মুরব্বী মানুষ তার সাথে আর কতক্ষণ কথা বলা যায়। তার উপর মেয়ে চলে যাওয়াতে আজ উনার মন খারাপ।
দুপুরের খাবারের পর কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর উঠে আসরের নামাজ পড়ে লামিয়া রিপাকে নিয়ে ছাদে গিয়েছে একটু হাটাহাটি করতে। কোন কিছুতেই আজ ভালো লাগছেনা।
নিচে এসে দেখে ওর শাশুড়ি ও উঠেছে। আর শশুর ও ততক্ষণে ফিরে এসেছে। লামিয়া চা বানিয়ে নিয়ে গিয়ে কতক্ষণ বসে তাদের সাথে গল্প করলো। সন্ধ্যা হতেই লামিয়া নামাজ পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করে শুয়ে রইলো। এই মুহূর্তে মনটা প্রচন্ড রকমের খারাপ হয়ে আছে। বাড়ির জন্যও মন কেমন করছে কতক্ষণ আর একাকী সময় কাটানো যায়। কাল পর্যন্ত পুরো বাড়ী মুখরিত ছিলো আর আজ পুরো নিস্তব্দ হয়ে আছে। লামিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল করেনি। লাইটের আলো চোখে পড়ায় ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। লামিয়া চোখ মেলে দেখলো আনাস রুমের সোফায় বসে ফোনে কথা বলছে। লামিয়াকে উঠতে দেখে আনাস ওখান থেকে সালাম দিলো।
লামিয়া সালামের জবাব দিয়ে নিজেও সালাম দিলো। তারপর বললো,,,, আপনি কখন এলেন??
-আনাস ফোন কেটে বললো,,,,এইতো ঘন্টাখানেক হলো।
-এতোক্ষন আগে এসেছেন,,, আমাকে জাগালেন না কেন?
-তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই আর উঠাইনি।
-না আসলে আমি এই টাইমে কখনো ঘুমায় না। আজ এমনিতে ভালো লাগছিলোনা তাই একটু…
-হুম বুঝতে পারছি। বিকালে কাঁদছিলে কেন??
-আপনাকে কে বললো???
-আম্মু বলেছে।
-আম্মু কখন দেখলো?
-তা জানিনা কাঁদছিলে কেন?
-না এমনি।
-আনাস সোফা ছেড়ে খাটে এসে লামিয়াকে পিছন থেকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে লামিয়ার কাঁধে মুখ রেখে বললো,,,মন খারাপ??
-উঁহু
-কেন?? আজ সারাদিন আমাকে কাছে পাওনি তাই জন্য??
-ইশ!!!!আমার বয়ে গেছে আপনার জন্য মন খারাপ করতে।
-বাব্বাহ!!! আমার জন্য মন খারাপ হয়নি?? তাহলে কি অন্য কেউ আছে নাকি যার জন্য মন খারাপ হবে??
-কি যা তা বলছেন? কেউ থাকলে তো আর আপনার কাছে আসতাম না।
-হুম তাও ঠিক। আর কেউ থাকলে ও তার হাত পা ভেঙ্গে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিবো আমার বউয়ের দিকে নজর দেওয়ার জন্য।
-হুম!!! আসছে আমার পালোয়ান স্বামী।
-হুম পালোয়ানই তো। পৃথিবীর সব স্বামী তার বউয়ের ইজ্জত রক্ষা করতে পালোয়ান হয়ে যায়।
-কি করছেন কি?
-কি করছি? প্রিয়তমার স্ত্রীর মোহনীয় রূপের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার ভালোবাসার সমুদ্রে ডুব দিচ্ছি এি মুহুর্তে বাঁধা দিওনা তো!!!
-সবসময় আপনার দুষ্টুমি করতে হবে??
-সবসময় কোথায় আজ সারাদিন তো কাছেই পাইনি। জানো সারাদিন তোমায় নিয়ে আমি কত টেনশনে ছিলাম৷ বারবার তোমার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো একা একা বাসায় কি করছো না করছো।
তারউপর বিকালে ফোন দিলাম মা বললো ঘুমাচ্ছো ।
-না ঘুমায়নি এমনি দরজা লাগিয়ে শুয় ছিলাম
-বেশি ঘুমাবেনা কিন্তু ??? বেশি ঘুমালে তো অনেক মোটা হয়ে যাবে তখন আমারই কষ্ট হবে?
-আমি মোটা হলে আপনার কি কষ্ট হবে শুনি?
-বলা যাবেনা।
ওহ বলতে ভুলে গেছি তোমার আম্মু ফোন করেছে বিকালে। তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো। লামিয়ার দিকে ফোন বাড়িয়ে বললো,,,, কথা বলো?
লামিয়া মায়ের সাথে কথা বলে বললো,,, চা খাবেন??
-চুমু খাবো।
– কি??? কি খাবেন??
-আবার শুনতে ইচ্ছে করছে? তো শুনো বলেছি চুমু খাবো।
আমি আপনার কাছে এই কথা জানতে চেয়েছি?
-না।
-তাহলে উল্টোপাল্টা কথা বলেন কেন? দেখি ছাড়েন আমি রান্না করতে যাবো?
-কোথাও যেতে হবেনা।
-কেন আজ কি না খেয়ে থাকবেন?
-আনাস দুষ্টু চোখে বললো,,, না খেয়ে থাকবো কেন? আমার খাবার তো সামনেই আছে।
-আপনার কাছে এই সব কথা ছাড়া আর কোন কথা নেই নাকি?
-আছেতো আরো কত কথা। বলবো?
-না আমি শুনতে চাইনা। ছাড়েন না!! রান্নার দেরি হয়ে যাবে।
-তোমার যেতে হবেনা আম্মু রান্না করতেছে।
-কি?? আপনি আমাকে আরো আগে বলবেন না?
-আম্মু নিষেধ করেছে বলতে ।
লামিয়া কিচেনে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই আনাস বললো,,, কিচেনে যেতে হবেনা।
শুনো আমি নামাজ পড়বো এখন। এর মাঝে তুমি রেডি হয়ে নাও তোমাকে নিয়ে একটু বাহিরে যাবো?
-কোথায় যাবেন?
-আম্মু বলছিলো তুমি নাকি কাপড় পড়ে হাটতে গিয়ে আজ পড়ে গেছো। তাই কিছু থ্রীপিচ কিনে দিতে বলেছে৷
আর তোমার জন্য একটা ফোন নিবো। তোমার খোঁজ নিতে পারিনা। আম্মুর ফোনে বারবার কল করাটা লজ্জাজনক।
আর তোমাদের বাড়ি থেকে কেউ ফোন দিলে ও আমি অফিসে থাকবো তুমি কথা বলতে পারবেনা তাই
-আমার ফোন লাগবেনা।
-তোমার কাছে জানতে চেয়েছি আমি তোমার ফোন লাগবে কিনা? তাড়াতাড়ি রেডি হও।
-তো সেগুলো তো আপনি নিয়ে আসতে পারেন আমার যাওয়ার কি দরকার?
-আমার ওসব মেয়েলী জিনিস কিনার অভ্যাস নাই। কি কিনতে কি কিনি? তাই তোমার জিনিস তোমার পছন্দমতো কেনাই ভালো আমি মনে করি।
-আপনি পছন্দ করে যা নিয়ে আসবেন আমি তাই নিবো?
-আচ্ছা তুমি কি বুঝনা আমার এখন তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে মন চাচ্ছে। রাতের বেলা রাস্তাঘাটে কোলাহল কম থাকে তাই বের হতে চেয়েছি এখন। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে বউ নিয়ে রাতের শহরে রিকশা করে ঘুরবো। তাই ভাবলাম এখন বেরুলো একসাথে ঘুরা ও হবে তোমার কাজগুলো ও সারা হবে।
-তো আপনি বলবেন না?
-তো আপনি বলবেন না!!” আপনি কি এখনো ছোট যে আকার ইঙ্গিতে কিছু বুঝতে পারেন না।
-এখন বেরুলে আম্মু আব্বু কিছু বলবেনা?
-উনারাই বলেছে যেতে।
আর তোমার যদি এত সমস্যা যেতে থাক যেতে হবেনা।
-রাগ করছেন কেন?? আমি কি বলেছি যাবোনা। আপনি নামাজ পড়ে নিন আমি রেডি হয়ে আসছি।
লামিয়া কালো বোরখার সাথে কালো হিজাবে নিজেকে পুরোপুরি আবৃত করে আনাসের সামনে এসে বললো,,, চলুন আমি রেডি।
আনাস লামিয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে,,, মাশাআল্লাহ!!!! হিজাবে যে লামিয়ার সৌন্দর্য্য আরো বেড়ে গেছে। বোরখা পড়লে নারীদের এতো সুন্দর লাগে আনাস তা আগে শুনেছে আজ নিজ চোখে এতো কাছ থেকে দেখছে। এ যেন জান্নাতের বাগানের এক সৌন্দর্য্যমন্ডিত ফুল তার সামনে ভিল করে চলে আসছে।
লামিয়া ওর সামনে হাত নাড়িয়ে বললো,,,, যাবেন না নাকি? দেরি হয়ে যাচ্ছেতো।
আনাস ভাবনার রাজ্য ছেড়ে বললো,,,হু.. হুম চলো চলো।
মার্কেটের কাজ সেরে আনাস একটা রিকশা ভাড়া করলো দুঘন্টার জন্য। লামিয়া বললো দুইঘন্টা আমরা রিকশায় বসে কি করবো?
-আনাস ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বললো,,,,দুজন মিলে ক্রিকেট খেলবো? খেলবে?
-বাঁকা কথা বলছেন কেন?
-বাঁকা প্রশ্ন করো কেন? রিকশায় বসে দুজন দুজনের কাঁধে মাথা রেখে এই রাতের ঢাকার সৌন্দর্য্য অবলোকন করবো আর একটুখানি প্রেমালাপ করবো এই সোজা কথাটা তোমার বুঝে আসেনা কেন?
-ভালো করে বুঝিয়ে বললেই তো হতো।
-লামিয়া তুমি এ যুগের মেয়ে। যথেষ্ট ম্যাচিউর একটা মেয়ে তুমি । সবকথা তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে কেন? আজকাল এমন বোকা মেয়েও আছে?
লামিয়া আনাসকে আর কিছু বলতে না দিয়ে দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরলো। দুজন মানব মানবী একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে গল্প করতে করতে এগিয়ে চললো সামনের দিকে।
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here