#উপন্যাস
#প্রিয়তমা
১২+১৩
(১২তম পর্ব)
লেখা- শারমিন মিশু
আজ সকাল থেকে লামিয়া রান্নাবান্না নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে আছে। ওর শাশুড়ি রান্না করছে আর লামিয়া হেল্প করছে। শাশুড়িকে একরকম সব কাজ গুছিয়ে দিয়ে ও ঘর গুছানোতে মন দিলো। আনাস বাহিরে গেছে কিছু বাজার লাগবে তাই আনতে । বাসায় আজ স্পেশাল মেহমান আসবে। আর সেজন্যই লামিয়া এতো তাড়াহুড়ো আর আনন্দ নিয়ে কাজ করছে৷ আজ অনেকদিন পর নিজের প্রিয় কিছু মানুষকে দেখতে পাবে সেইজন্য। আজ ওর বোন,, বোন জামাই আর নিজের ভাই আসবে ওর বাসায়। সেজন্য এতো আনন্দ ওর মনে।
রাহাতের বদলি হওয়ার বদৌলতে ফারিহা শশুর শাশুড়িসহ ঢাকায় চলে এসেছে। আর ফারিহা এখন প্র্যাগনেন্ট ৪মাস চলছে। এ অবস্থায় রাহাত ওকে বাড়িতে একা রেখে ভরসা পাবেনা। ফারিহা এমনিতে একটু উড়ুউড়ু স্বভাবের। আগে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো এখন রাহাতকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে সবসময়। নিজের কোন খেয়াল নেই। তাই রাহাত বাবা মা সহ এখানে বাসা নিয়েছে।
আর লাবিবের ও ঢাকার একটি ভার্সিটিতে জব হয়েছে। এখন থেকে ও এখানে থাকবে।সেই সুবাদে লামিয়ার শশুর ওদের দাওয়াত করেছে বাসায়।
লামিয়ার আজ খুশিতে উড়তে ইচ্ছে করছে। কতদিন পর আপুটাকে কাছে পাবে। আপুকে বলার জন্য অনেক কথা জমে আছে।
কলিংবেলের শব্দে লামিয়ার ভাবনার ঘোর কাটে। লামিয়া উৎসুক মনে দরজার দিকে তাকাতে দেখলো আনাস রুমে প্রবেশ করছে। লামিয়া ওদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আবারো কাজে মন দিলো।
আনাস দাঁড়িয়ে থেকে লামিয়াকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বললো,,,, আজ বোধহয় কারো মনে রং লেগেছে?
-লামিয়া পুরোটা শুনেনি শুধু শেষেরটা শুনে বললো,,, কিসের রং?
-বলেছি আপনার মনে রং লেগেছে নাকি? একা একা হাসছো কেন?
-আমার মনে রং লাগবে কেন? আর আমি কখন হাসলাম?
-বাব্বাহ!!! এখনি তো হাসছিলে।
-মন চাইছে তাই হাসছি আপনার কোন সমস্যা?
-না কোন সমস্যা নেই। এতদিন যার মুখ দিয়ে পারতে কোন কথা বের করতে পারতাম না আজ তার মুখে কথার বুলি ফুটেছে ভালো তো ভালো না? আবার নিজে নিজে হাসেও।
-লামিয়া আনমনে আবারো হেসে দেয়।
-উফ!!! এমনভাবে হেসোনা প্রেয়সী পাগল হয়ে যাচ্ছি!!!!
-সরেন তো!!! সবসময় আপনার এইসব রোমান্টিকতা। আপনি এখন এখান থেকে যান আপনি থাকলেই আমার কাজে সমস্যা হবে।
-আমিও একটু তোমাকে হেল্প করি।
-কোন দরকার নেই আপনি আমার হেল্প করবেন না উল্টো আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাবেন। আপনাকে আমি চিনিনা মনে হয়???
-আরে কোন সমস্যা করবোনা। কাজ করবো আর তোমাকে দেখবো তার ফাঁকে ফাঁকে।
-এতোই যখন কাজ করার শখ তখন যান গিয়ে ড্রয়িংরুমটা গুছান।
– না আমি এখানে থাকবো।
-আপনি যাবেন???
-আল্লাহ!! কি বউ বিয়ে করলাম? বরের মন বুঝেনা। মনে হচ্ছে আরেকটা বিয়ে করা লাগবে।
-হুম মেয়েরা আপনার জন্য বউ সেজে বসে আছে তো। যান না গিয়ে করেন বিয়ে আমি নিষেধ করছি নাকি?
-এখন তো এসব বলছো যখন সত্যি সত্যি আরেকটা বউ নিয়ে আসবো তখন তো জ্বলবে।
-যাবেন নাকি আমি যাবে… এমন সময় কলিংবেলর আওয়াজ শুনা গেলো। আনাস গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই লাবিবকে দেখে সালাম দিয়ে মুসাফাহা করে ঘরে নিয়ে আসলো।
লামিয়া ভেতরের রুমে ছিল বাহিরে যেতে পারছেনা ওখানে ওর বোন জামাই ও আছে তাই। ফারিহা ভেতরে আসতেই লামিয়া সালাম দিয়ে আপুওওও বলে জাপটে ধরলো।
ফারিহা বললো,,,, আস্তে ধরনা বোন এখন তো আমি একা না।
-লামিয়া ওকে ছেড়ে দিয়ে,,,ও সরি সরি খেয়াল ছিলনা আনন্দের আতিসায্যে ধরে ফেলেছি।
-আরে কোন সমস্যা নেই। কেমন আছিস?
-আলহামদুলিল্লাহ,,,, তুমি কেমন আছো।
-আমিও ভালো।
তারপর লামিয়া তার শাশুড়ির সাথে ওদের আলাপ করিয়ে দিলো। দিনটা দুবোনের গল্প করে আনন্দের সাথে কেটে গেছে। সন্ধ্যায় ওরা বিদায় নিয়ে চলে আছে।
বিয়ের এতোদিনের মাঝে আনাস আজ লামিয়াকে এভাবে প্রানখুলে হাসতে দেখেছে। হাসলে মেয়েটাকে অনিন্দ্য সুন্দর লাগে। মেয়েটা সত্যি অনেক মায়াবতী।
বেশ এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো ওদের সুখের সংসার হাসি আর আনন্দের মধ্যে দিয়ে। আনাস সারাদিন অফিস করে ফিরে সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে লামিয়ার সাথে অফিসে কি কি হয় বা ছোটবেলার গল্প করে সময় কাটায়। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ওদের সংসার। যাচ্ছিলো সব ঠিকঠাক কিন্তু হঠাৎ একদিন…..
আনাস অফিস থেকে ফিরেছে আধাঘন্টা হলো। লামিয়া এখনো রুমে আসেনি। ও শাশুড়ির সাথে বসে কাজ করছিলো আর সাথে গল্প করছিলো আনাস যে চলে এসেছে সেদিকে তার কোন খেয়াল ছিলনা। লামিয়া কাজ শেষে রুমে আসতেই দেখলো খাটে আনাসের জামাকাপড় পড়ে আছে।
কি ব্যাপার উনি কখন আসলো? প্রতিদিন তো এসেই আমাকে ডাক দেয় আজ ডাকলোনা যে?
লামিয়া পুরো রুম চেক করলো আনাস কোওথাও নেই। তারপর বারান্দার দিকে এগুতে দেখলো বারান্দায় বসে আছে।
আপনি কখন আসলেন?
–
-কি ব্যাপার কথা বলছেন না কেন?কি হয়েছে বলবেন তো?
-আনাস কপট রাগ দেখিয়ে,, কি কথা বলবো?
-এভাবে বলছেন কেন?
-কিভাবে বলছি? লামিয়া আমি রুমে আসছি কতক্ষণ সে খেয়াল তোমার আছে?
-রাগ করছেন কেন? আমিতো মায়ের রুমে ছিলাম।
-লামিয়া মায়ের থেকে আমাকে একটু বেশি ইম্পর্টেন্ট দেয়া কি তোমার উচিত নয়? মায়ের সাথে তো তুমি সারাদিন গল্প করতে পারো আমি সারাদিন কাজ করে এসে বাসায় যদি তোমাকে চোখের সামনে না দেখতে পাই তখন কেমন লাগে বলোতো?
-আমি তো….
-আমি লক্ষ্য করেছি,গত কিছুদিন যাবত তুমি আমাকে কেমন এড়িয়ে যাচ্ছো সমস্যা কি তোমার?
-কি বলছেন আমি কখন এড়িয়ে গেলাম?
-আমি তো আপনার সব ব্যাপারে খেয়াল রাখার চেষ্টা করি তাহলে…
-সব ব্যাপারে খেয়াল রাখা মানে এই নয় যে তুমি আমার জামকাপড় ধুয়ে দিচ্ছো,,,আমার জন্য নিয়ম করে রান্না করছো,, আমি ডাকলেই বিছানায় আমার শয্যাসঙ্গী হচ্ছো এসব খেয়াল রাখা নিজের দায়িত্ব পালন করছো কিন্তু এটা ভালোবাসা নয় লামিয়া।
স্বামি স্ত্রীর মাঝে দায়িত্ব কর্তব্যের বাহিরে আরেকটা অন্য সম্পর্ক আছে যার নাম ভালোবাসা।
আমি তোমাকে ফোন না দিলে তুমি নিজে থেকে কখনোই আমাকে ফোন দাওনা ।
ভালোবাসার জন্য আমি আগ থেকে হাত বাড়িয়ে ইশারা না করলে তুমি আমার কাছে আসোনা নিজে থেকে।
আমি কোন কথা বললে শুধু তার জবাব দাও এছাড়া নিজের থেকে কোন কথা বলোনা আমার সাথে তোমার কি মনে হয় এটাকে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক বলে?
স্বামী স্ত্রীর মাঝে সাংসারিক কথাবার্তা ছাড়া ও ভালোবাসাপূর্ন কিছু কথা থাকা চাই তুমি সেরকম নয়। তোমার সবকিছুতে লজ্জ পায় স্বামী স্ত্রী মাঝে ভালোবাসা মান অভিমান থাকতে হয় কিন্তু লজ্জা নয়।
–
-আমি তোমাকে বিয়ের প্রথম রাতেই জানিয়ে দিয়েছি আমাকে সবচেয়ে আগে বন্ধু ভেবে সব কথা বলতে হবে। আর আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে কোন কৃপণতা করা যাবেনা। কিন্তু তুমি কি করছো?
-এই রকম একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে আপনি এরকম বিহেভ করবেন?
-এটা তোমার কাছে সামান্য মনে হয়? কিন্তু আমি সিরিয়াস?
-আমি সত্যি এতোটা গভীর থেকে ভাবিনি।
আমি জানিনা আপনার আজ কি হয়েছে? কেন কথাগুলো বলছেন?
আমি মনে করতাম আপনি তো ফোন করেন আমার আর কি দরকার ফোন করার তাই আর ফোন দিইনি।
আপনি ভালোবাসার জন্য আপনার দিকে ইশারা করতেন আর আমি আপনার ডাকে সাড়া দেবার অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকতাম।
কিন্তু আমার ডাকার কি দরকার ছিল একজন থেকে ইশারা আসলেই তো হয় আপনি এমনটা ভাববেন আমার ধারনাই ছিলনা।
আমার ধারনা ছিল ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা প্রকাশ হয়না কাজের দ্বারা প্রমান করাতে হয় ভালোবাসার গভীরতা কতটুকই। আপনি যে এতো কিছু মনে রেখেছেন আমার ধারনায় আসেনি।
ক্ষমা করবেন নিজের অজান্তে করা ভুলের জন্য বলে আনাসের হাত চেপে ধরে কান্না শুরু করলো।
– কথায় কথায় প্লিজ কাঁদবে না। অসহ্য লাগে।
-লামিয়া চোখের পানি মুছে,,,,কি হয়েছে আজ আপনার বলবেন কি?
-আমার কিছুই হয়নি?
– আচ্ছা আমার ভুল স্বীকার করছি আমি সরি। আজ থেকে নিজের ভুলগুলো শুধরে নিবো।এখন খেতে আসুন?
-খাবোনা আমি বলে আনাস রুমের দিকে যেতে উদ্যত হতেই লামিয়া পিছন থেকে আনাসের হাত টান দিয়ে বললো,,,
-রাগ তো আমার উপর খাবার কি দোষ করেছে? খেতে চলুন বলে আনাসের হাত টান দিলো।
-আনাস হাত ছাড়িয়ে বললো একবার নিষেধ করেছি কানে যায়নি নাকি? বলে আনাস রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
লামিয়া আর কিছু না বলে চুপচাপ গিয়ে আনাসের খাবার রুমে নিয়ে আসলো। খাবার টেবিলে রেখে কয়েকবার আনাসকে ডাক দিলো। কিন্তু আনাস কোন শব্দ করেনি।
লামিয়া নিজেও না খেয়ে নিঃশব্দে বিপরীত দিকে মুখ করে খাটের অন্যপাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আজ খুব বেশি কান্না পাচ্ছে। চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারছেনা। প্রিয় মানুষের রাগ,, অবহেলা অভিমান সত্যি অনেক বেশি কষ্টের। উনি কেন এমন করছে? শুধু কি এই ব্যাপারগুলো তার কারণ নাকি অন্যকিছু?
#উপন্যাস
#প্রিয়তমা (১৩তম পর্ব)
লেখা -শারমিন মিশু
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে আনাসের মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। কাল রাতের রাগটা খুব কাজে দিয়েছে। লজ্জাবতী কাল তার লজ্জাটাকে কিছুটা হলেও ছুটি দিয়েছে। লামিয়া কাল নিজে থেকে আনাসের কাছে ধরা দিয়েছে। রাত বারটায় নিজে অনেক জোরাজুরি করে কেঁদে কেটে আনাসকে তুলে ভাত খাইয়েছে। তারপর ভালোবাসার জন্য নিজে থেকে এগিয়ে এসেছে। আনাসের মনে হয়েছে মাঝে মাঝে এরকম একটু কঠিন হওয়ার দরকার আছে নাহলে এই মেয়ে কিছুতেই ধরা দিবেনা। আরে বাবা!!! স্বামীর কাছে লজ্জা কিসের??
আর এই মেয়ের এমন একটা বদঅভ্যাস সকালে নামাজ পড়তে উঠে আর ঘুমাবেনা নাস্তা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আনাস বারবার করে বলে দিয়েছে আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে তোমাকে চোখের সামনে দেখতে চায়। কিন্তু না এই মেয়ে কোন কথায় শুনবেনা। এই বাড়ীতে নামাজের পর সবাই ঘুমায় আবার। তাই সকালের নাস্তার জন্য অতো তাড়াহুড়োর দরকার নেই কিন্তু কথা কোন ভাবে ওর কানে যাবেনা।
কাল রাতে আনাসের ধমকের কারণে আজ নামাজ পড়ে আবারো ঘুমিয়েছে। আনাস ঘুম থেকে উঠে ঘুমন্ত লামিয়াকে দেখছে কি রকম মায়াবী একটা মুখ। ঘুমন্ত মানুষের সৌন্দর্য্য এতো বেড়ে যায় জানা ছিলনা।
লামিয়া আড়মোড়া ভেঙ্গে চোখ খুলতেই দেখলো আনাস ওর মুখের উপর ঝুঁকে আছে। লামিয়াকে চোখ খুলতে দেখে আনাস একটুখানি সরে গেলো।
লামিয়া তড়িগড়ি করে উঠে বসলো। আল্লাহ!!! উনি আমার আগে উঠে গেছে আর আমি এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছি???
আনাস লামিয়াকে পেছন থেকে টেনে আবারো শুইয়ে দিলো। লামিয়ার দিকে অনেকটা ঝুঁকে একহাতে লামিয়ার চুল গুলো সরাতে সরাতে বললো,,,, কোথায় যাচ্ছো?
-নাস্তা বানাতে হবেনা।
-আমি বলেছি উঠতে??? আর নাস্তা আরেকটু পরে বানালে ও সমস্যা নেই।
-আপনার অফিসের দেরি হয়ে যাবেতো,,, সরেন না প্লিজ।
-আচ্ছা তোমার কি কোন বোধশক্তি নাই??? কাল রাতে কি কবিতা শুনালাম তোমাকে? আর আজ ছুটির দিনে আমি অফিস যাবো কোন দুঃখে??
-ও সরি আমার মনে ছিলনা যে আজ আপনার অফ ডে।
-কত কিছুই তোমার মনে থাকেনা। এখন চুপচাপ এখানে শুয়ে থাকবে আমি না বলা অবদি একটু ও নড়বেনা।
লামিয়া মাথা নেড়ে সায় দিলো। এই মুহুর্তে কোন কথা বলা ঠিক হবেনা। এমনিতে কাল রাতে যা করলো লামিয়া ভয় পেয়ে গেছে তাই আজ আর কোন ঝামেলা চাইনা ও চুপচাপ শুয়ে রইলো আনাসের হাতের উপরে। আনাস একহাত লামিয়ার মাথার নিচে দিয়ে আরেক হাতে এমন ভাবে ওকে জড়িয়ে ধরে আছে যে নড়ার কোন উপায় নেই।
বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর সেদিন লামিয়া জানালো,,,, ও বাড়ি যেতে চায়। ওর অনার্স ৩য় বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা কয়দিন পর শুরু হবে। বিয়ের পর আর বাবার বাড়িতে একবারের জন্য ও যাওয়া হয়নি।
কথাটা শুনে আনাস বললো,,,কদিনের জন্য যেতে চাও
-এইতো পরীক্ষা শেষ হতে দেড়মাসের মত লাগবে।
-দেড় মাস??? অসম্ভব!!!
-কেন কি সমস্যা?
-দেখো!! তোমাকে ছেড়ে এখন একদিন কাটানো আমার পক্ষে অসম্ভব,, সেখানে দেড় মাস??? কোনভাবে সম্ভব না।
-আপনি কি চাচ্ছেন আমি পরীক্ষা না দিই??
-পরীক্ষা দিবেনা কেন??? কিন্তু তোমাকে ছাড়া থাকা কিভাবে সম্ভব।
-কেন বিয়ের আগে তখন বউ ছাড়া কিভাবে ছিলেন?
-লামিয়া তখনকার ব্যাপার আর এখনকার ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। তখন বউ ছিলনা তাই কোন চিন্তা ছিলনা। বউ থেকে ও এখন আলাদা থাকতে হবে কেন ???
-দেখেন আপনি নিষেধ করলে আমি যাবোনা।
-আনাস কিছুক্ষণ ভেবে বললো,,,,কবে যেতে চাও?
-এ সপ্তাহের মাঝে আপনি যখন ছুটি নিতে পারবেন তখন।
-আচ্ছা দেখি কি করা যায়।
জোবায়েদা আজ রান্নাবান্না নিয়ে ভীষন ব্যস্ত। এই প্রথম তার ছোটমেয়ের জামাই শশুড়বাড়ি আসছে৷ কোনকিছুর কমতি হওয়া যাবেনা। নতুন জামাই বলে কথা!!!!
কলিংবেলের শব্দে সোহান আহমেদ রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসলো। দরজা খুলতেই লামিয়া আব্বুওওওও বলে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। কতদিন পর প্রিয় মানুষটাকে দেখলো। বাঁধভাঙ্গা কান্নায় বাবার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই।
আনাস পিছন থেকে বললো,,, আবু পিছনে আরো কেউ আছে তার দিকে একটু নজর দিন।
সোহান আহমেদ মেয়েকে ছেড়ে জামাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলো। আনাস সালাম দিয়ে মুসাফাহা শেষে শশুরের সাথে মুয়ানাকা করার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলালো।
লামিয়া কিচেনে গিয়ে দেখলো তার মা এখনো রান্নায় ব্যস্ত। একা মানুষ সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারেননি এখনো। লামিয়া আস্তে আস্তে পিছন থেকে গিয়ে মায়ের চোখ চেপে ধরলো। জোবায়দা প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গেলেন তারপর হাত দিয়ে চোখের উপরের হাতটা স্পর্শ করতেই বললেন,, আমার মা এসে গেছে???
-লামিয়া হাত সরিয়ে সালাম দিয়ে বললো চিনলে কি করে?
-তোর স্পর্শ আমি না চিনলে কে চিনবে। দেখি একটু বুকে আয় কতদিন জড়িয়ে ধরতে পারি না তোকে। লামিয়া মাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় শেষে বললো,,, আম্মু যাও তোমাদের জামাইয়ের সাথে দেখা করে এসো আগে।
-দাঁড়া এদিকটা একটু সামলে নিই। আসলে উনি জামাইয়ের সামনে যেতে কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করছেন। জামাই আবার ইসলামিক মন মাইন্ডের।
-আম্মু তুমি আসোতো এগুলো পরেও করতে পারবে। এ এসেছে অনেক্ষণ দেখা না করলে কেমন দেখায়না???
-না জামাই আমার সাথে কথা বলবে তো?
-আম্মুউ তুমি ওর শাশুড়ি। শাশুড়ি মায়ের মত হয় কথা বলবেনা কেন? আসো বলে মাকে ধরে আনাসের সামনে নিয়ে গেলো।
আনাস শাশুড়ি কে দেখে উঠে সালাম দিয়ে নিজে থেকে জোবায়েদা বেগমকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,,, কেমন আছেন আম্মু?
-এইতো বাবা আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?
-জী আলহামদুলিল্লাহ।
-তোমার বাবা মা ভালো আছেতো??
-জী উনারা ও ভালো আছে।
আটো কিছুক্ষণ কথা বলে বললেন,,,আচ্ছা বাবা তোমরা বসো আমি একটু আসছি।
জোবায়েদা রুমে এসে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। না জামাই তো যথেষ্ট অমায়িক। কত সুন্দর করে কথা বলে। আর উনি কি সব ভাবছিলেন অযথা।
লামিয়া নাস্তা নিয়ে আসলো। আনাস বললো,,, আম্মুকে ও ডাকো। সবাই একসাথে নাস্তা করি।
দিনটা হাসিখুশি আর গল্প করতে করতে কেটে গেলো। জোবায়েদা জামাইকে খাওয়াতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। লামিয়ার কাছ থেকে আনাসের পছন্দ অপছন্দ জেনে নিয়ে সেভাবে রান্না করলো। শহরে মানুষ কিভাবে না কিভাবে খায়,??? উনার রান্না পছন্দ করে কিনা??? সেই ভেবে চিন্তা হচ্ছে উনার।
লামিয়া বললো আম্মু তুমি অযথা টেনশন করছো। তোমার রান্নার বদনাম কেউ করতে পারবে না। তোমার রান্না সবসময় ভালো হয়। আর উনি কিছু বলার মত সেরকম মানুষ ও না। রাতের খাবার সবাই একসাথে খেলো। আনাস খেতে বসে রান্নার প্রশংসা শুরু করে দিলো। রান্নাটা ওর মায়ের রান্নার মত হয়েছে।
লামিয়া ইশারায় মাকে বললো,,, দেখেছো বলিনি তুমি অযথা টেনশন করছো।
আনাস শশুরের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে রুমে আসলো।লামিয়া এখনো মায়ের সাথে গল্প করছে। কতদিন পর মা মেয়ের দেখা গল্পের কি আর শেষ আছে। কত জমানো কথা জমে আছে। আনাস ও কিছু ভাবছেনা এ নিয়ে করুক না একটু গল্প!!! নিজের প্রিয় মানুষদের সাথে কতদিন পর দেখা!!!
আনাস ঘুরে ঘুরে লামিয়ার রুমটা দেখছে। আজ প্রথম ও এ বাড়িতে পা রেখেছে। বিয়ের দিনতো ওভাবে কিছু দেখা হয়নি। লামিয়ার পুরো রুমের দেয়ালে নানারকম শিক্ষনীয় বানী আর সূরা লিখে ওয়ালমেট লাগিয়ে রাখা হয়েছে। আয়াতুল কুরসী লেখা একটা ওয়ালমেট অনেক সুন্দর। ইন্টেরিয়র ডিজাইনটা অসম্ভব সুন্দর হয়েছে। বইয়ের তাকে নানাধরনের ইসলামী বইয়ে সাজানো। একটা বই হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে লামিয়া পিছন থেকে বললো,,,, কি দেখছেন?
-আনাস ওই দিকে ফিরে বললো,, না এমনি দেখছিলাম।
অবশেষে আপনার দেখা পেলাম ম্যাডাম!!! আমি তো ভেবেছি আজ বাবা মা পেয়ে আমাকে ভুলে গেছেন। কেউ একজন যে আপনার সাথে এসেছিলো আপনি ভুলেই গেছেন।
-সরি আসলে অনেক দিন পর মাকে পেয়েছি তো তাই,,,
-আরে সমস্যা নেই আমি এমনি দুষ্টমি করছিলাম। আচ্ছা তোমার ঘরটা কে সাজিয়েছে বলো তো??
-কেন??? সুন্দর হয়নি সাজানো??
-আরে অসম্ভব সুন্দর হয়েছে। কে সাজিয়েছে বলো না?
-আমি নিজেই
-তুমি???? এতো সুন্দর করে কেমনে সম্ভব???? কখনো তো শুনিনি এতসব ও পারো।
-না ওই শখের বসে একটু,,,,
-আনাস লামিয়ার ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বললো,,,, এবার বাসায় গিয়ে আমার ঘরটা নতুন করে সাজানোর জন্য তোমাকে দায়িত্ব দিলাম। পেমেন্ট যাই দাবি করো না কেন আমি দিতে প্রস্তুত।
-বাব্বাহ!!! আমাকে টাকা দেবেন কাজের জন্য।
-কেন নয় তোমার প্রাপ্ত সন্মান দিতে হবে না???
আর ঘরে এরকম একটা বউ আছে আমার জেনে অনেক কৃতজ্ঞ হলাম আল্লাহর প্রতি,,,, সত্যি ভাগ্যবান আমি তোমাকে পেয়ে ।
-লামিয়া বললো,,, প্রশংসাটা একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছেনা,,,
-,মোটেও না যা সত্যি আমি তাই বলছি।
তিনদিনের ছুটি শেষে লামিয়াকে রেখে আনাস আজ ঢাকার পথ ধরলো। যাওয়ার আগে লামিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো,,, সত্যি অনেক কষ্ট হবে তোমাকে ছাড়া থাকতে।
-ছুটি পেলে চলে আসবেন সমস্যা কি???
-হুম তোমার আর সমস্যা কি? আমি না থাকলে তো ভালোই থাকো। যত জ্বালা তো আমার। এটা তো উত্তরা আর মিরপুর না,,, যে মন চাইলে চলে আসবো।
অবশেষে সব মন খারাপকে উপেক্ষা করে আসতেই হলো। চাকরীটা তো বাঁচাতে হবে।
সেদিন লামিয়া কলেজে গেলো এডমিট কার্ড আনতে। পরীক্ষার আর মাত্র তিনদিন বাকি। এডমিট নিয়ে ফেরার পথে বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে থাকতে লামিয়া সামনের দিকে দৃষ্টি দিতেই ওর মনে আবারো সেই ভয় এসে জমাট বাঁধলো। লামিয়া ওখানেই পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। সামনের দিকে আগানোর শক্তি ওর হচ্ছেনা। আজ এতোদিন পর আবারো সেই মুহূর্তটা ওর সামনে আসবে ওর ভাবনার বাহিরে ছিলো।
ইয়া আল্লাহ!!!”এটা কি করে সম্ভব? লামিয়া ভাবছে আবার কেন??? সেই মুসিবতটা আবারো আমার সামনে উপস্থিত হলো????
চলবে…….