#উপন্যাস
#প্রিয়তমা (১৮ ১৯ ২০তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
জীবনটা যে এতটা অসহায় আর কঠিন হয়ে পড়বে লামিয়া কখনো ভাবতে পারেনি৷ সারাজীবন চলে এসেছে আল্লাহ ও তার রাসূলের দেখানো পথে আর আজ তাকে এতোটা অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। মানুষ কতটা নির্লজ্জ আর ছোটমনের হলে একটা নিরপরাধ মেয়েমানুষকে এভাবে হেয়নস্ত আর ছোট করতে পারে লামিয়া ভেবে পাইনা।
দুইটা চিরকুট আর কয়েকটা ফটোশপ নিয়ে লামিয়া বসে আছে। এ নিয়ে পাঁচবার চিরকুট গুলো পড়েছে লামিয়া।
তাতে লেখা,,,
আমি বিদেশ চলে গেছি মনে করে আমার থেকে মুক্তি পেয়েছো এটা ভেবে নিয়ে খুব বড় ভুল করেছো। আমি যদি তোমাকে না পাই অন্য কেউ তোমাকে নিয়ে সুখী হবে এটা আমি কখনো হতে দিবোনা। নিজে থেকে যদি ঐ লোকটাকে ছেড়ে না আসো তবে আমি ভেঙ্গে দিবো তোমার সুখের ঘর। এখনো সময় আছে ভেবে নাও আজই শেষ এরপর কিন্তু ছবিগুলো আসল জায়গায় চলে যাবে। সময় নষ্ট করোনা।
লামিয়া খাটের উপর পড়ে থাকা ছবিগুলো আবারো হাতে নিলো। এতো খারাপভাবে ছবিগুলো ইডিটিং করা হয়েছে দেখলেই আর তাকাতে মন চাইবেনা ঘৃনায়। আর অন্য কেউ দেখলেই বিশ্বাস করে নিবে এগুলো সত্য বলে। লামিয়া না পারতে কখনো ছবি তুলতোনা। কিন্তু এ ছবিগুলো!!!! লামিয়া জানে এ ছবিগুলো ওর না। অন্য কারো বডির সাথে লামিয়ার ফেসটা এমনভাবে এডজাস্ট করা হয়েছে কিন্তু অন্য অপরিচিত কেউ দেখলে নিশ্চিত ভেবে নিবে এটা লামিয়া।
লামিয়া এ মুহূর্তে কি করবে কিছুই ভাবতে পারছেনা।
আনাস এগুলো দেখলে কি রিয়াকশন করবে?? ঐ লোকটা যদি উনার কাছে ও এগুলো পাঠায় তখন কি হবে?? সত্যের পরাজয় হবে নাকি মিথ্যার জয় হবে?? লামিয়া আর ভাবতে পারছেনা মাথা প্রচন্ডভাবে ঘুরছে। কি করবে না করবে বুঝতে পারছেনা?? উনাকে বলে দিলে যদি হিতে বিপরীত হয়??? উফ!!!! সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
বিজ্ঞান আর প্রযক্তির প্রসারতা মানুষের স্বাবাবিক জীবন যাত্রা কে এমনভাবেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রযুক্তি যে মানুষের ভালোর চেয়ে ক্ষতি বেশি করেছে এটা লামিয়া হাড়ে হাড়ে আজ টের পাচ্ছে। কিন্তু ওর ছবি আরিফ কই পেলো??? জেনেশুনে ও তো কখনো ছবি তুলতোনা তাহলে??
লামিয়ার মনে পড়লো চার বছর আগে ওদের পাশের বাড়ির এক মেয়েকে ঠিক এইভাবে ব্ল্যাকমেইলের স্বীকার হতে হয়েছে । মেয়েটাকে এভাবে ছবি দিয়ে হেয়নস্ত করার কারণে মেয়েটা সমাজে টিকতে না পেরে শেষমেশ আত্মহত্যা করেছে।
কিন্তু না লামিয়া এতবড় পাপ করবেনা। যে পাপের কারণে না এ জীবনে মুক্তি পাবে না পরবর্তী জীবনে। এই পরিস্থিতির মোকাবেলা ওকে করতে হবে যেভাবেই হোক। তবে উনাকে জানানোর আগে আপুর সাথে কিছু পরামর্শ করতে হবে লামিয়া ভাবছে। এইভাবে হুট করে জানানো যাবেনা। যত যাই হোক উনি ও তো একজন মানুষ। হঠাৎ করে জানালে কিনা কি হয়????
লামিয়া তড়িগড়ি করে হাতের ফটোশপ আর চিরকুট গুলো ছিড়ে ওয়াশরুমে ফেলে দিলো।
লামিয়া সেজদায় পড়ে আছে অনেকক্ষণ। এই মুহুর্তে এইরকম কঠিন পরিস্থিতিতে একজনই আছে যে ওকে রক্ষা করতে পারবে এই কঠিন বিপদ থেকে। আর তিনি হলেন আমাদের রব মহান আল্লাহ। লামিয়া তার কাছেই নিজের জন্য সাহায্য চাইছে। নিজের সব অনুযোগ অভিযোগ তার কাছেই প্রকাশ করছে।
আনাস দুপুরে আজ আসতে পারেনি অফিসের কাজের চাপে তাই লামিয়াকে এই অবস্থায় ওর মুখোমুখি হতে হয়নি। ওর সামনে পড়লে একশটা জবাবদিহি করতে হবে যেটা লামিয়া এখন মোটেও চাচ্ছেনা। লামিয়া সেই যে সকালে রুমে ডুকেছে আর বের হয়নি। রিপা এসে খাবার খেতে ডেকে গেছে লামিয়া খাবেনা বলে জানিয়ে দিয়ে ওকে খেয়ে নিতে বলেছে।
রাতে আনাস বাসায় আসলে লামিয়ার দিকে তাকিয়ে একবার জানতে চেয়েছে মুখ এরকম শুকনো শুকনো লাগছে কেনো?? কিছু হয়েছে কিনা???
লামিয়া বলেছে কিছু হয়নি সব ঠিক আছে এমনিতে একা একা সময় কাটাতে কষ্ট হয় সারাক্ষণ কেমন বিষন্ন বিষন্ন লাগে।
কিছু মুহুর্ত সময় পরে লামিয়া বললো ,,, একটা কথা বলবো???
-আনাস চা খেতে খেতে বললো,,, হুম বলোনা।
-বলছিলাম কি,,, বাসায় একা একা ভালো লাগছেনা যদি অনুমতি দেন তো আমি আপুর বাসায় গিয়ে দুদিন থেকে আসতে চায়???
-যাবে????
-আপনি নিষেধ করলে জোর করছিনা।
-না না নিষেধ করছিনা। ঠিকইতো বলছো একা একা আর কত সময় কাটাতে পারো। কবে যেতে চাও??
-কাল বা পরশু???
-হুম,,কাল তো আমি তোমাকে নিতে পারছিনা অফিসে কাজের চাপ আছে একটু আরলি যেতে হবে। পরশু গেলে হবেনা???
-আচ্ছা।
-কিন্তু তুমি চলে গেলে রিপা একা বাসায় কি করে???
-ওকে আমি নিয়ে যাবো আমার সাথে।
-আচ্ছা ঠিক আছে। এখন তাড়াতাড়ি খাবার দাও অনেক ক্ষিধে পেয়েছে।
-লামিয়া আচ্ছা বলে খাবার রেডি করতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
আনাস কিছুক্ষণ আগে লামিয়াকে ফারিহার বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেছে। লামিয়া ফারিহাকে আগেই জানিয়েছে আনাস ওকে নিয়ে আসবে। তাই ফারিহা নাস্তা রেডি করে রেখেছিলো। সময় নেই বলে আনাস শুধু একটু নুডলস আর চা খেয়েই চলে গেছে।
লামিয়া রাহীকে কোলে নিয়ে বসে আছে। রাহী ফারিহার মেয়ে। ফারিহা সবকিছু গুছিয়ে এসে লামিয়াকে বললো,,,, কিরে তুই এতো শুকিয়ে গেছিস কেন???
-কই ঠিকইতো আছি আমি।
-কি ঠিক আছিস???চেহারার কি হাল করেছিস দেখতো??? একটু নিজের যত্ন নিতে পারিসনা?
-লামিয়া চাঁপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো আর নিজের যত্ন??? যেখানে জীবনের কোন বিশ্বাস নেই সেখানে আবার যত্ন??
-ফারিহা কিছুটা ভয় নিয়ে লামিয়াকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,,,কি হয়েছে বলতো??? এভাবে কথা বলছিস কেন???
লামিয়া এই মুহুর্তে বোনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে চোখের পানি ফেলে দিলো। মনে হলো কান্না করার মত একটা ভরসার জায়গা খুঁজে পেলো।
-দেখ তুই এভাবে কান্না করছিন কেন??? আমার কিন্তু কোন কিছু ঠিক লাগছেনা??? কি হয়েছে আমাকে খুলে বল??
লামিয়া একে একে সব খুলে বললো।
ফারিহা সব শুনে বললো,,,, মানুষ এতো নিচ কি করে হতে পারে???
তবে তুই কিন্তু আনাস ভাইকে ব্যাপারটা না জানিয়ে অনেকবড় ভুল করেছিস। তোর আগেই উনাকে সব ইনফর্ম করা উচিত ছিল??? অনেক দেরি করে ফেলেছিস রে বোন।
-আমি তো ভয়ে উনাকে জানাতে পারিনি।
-এখানেই তোর সবচেয়ে বড় ভুল। উনি শিক্ষিত মানুষ ব্যাপারটা বুঝতে পারতো। বাসায় গিয়ে সব কিছুর আগে উনাকে কথাটা জানাবি। যা হয় হবে!!! আল্লাহর হুকুমের উপর তো আমাদের কারো হাত নেই। কিন্তু আরো দেরি করলে সব হাতের বাহিরে চলে যাবে।
লামিয়া সিদ্ধান্ত নিলো ও বাসায় গিয়ে আনাসকে সব জানিয়ে দিবে। আর না এভাবে!!!
দুপুরে খাওয়ার খেতে বসতে নিলেই লামিয়ার গা গুলিয়ে আসলো কেমন করে। মনে হচ্ছে বমি হবে। লামিয়া দৌড়ে ওয়াশরুমের দরজায় যেতেই হড়হড় করে বমি করে দিলো। ফারিহা এসে মাথায় পানি দিয়ে খাটে নিয়ে শুইয়ে দিলো ওকে।
তারপর লামিয়াকে বললো,,, তোর কি আর কখনো এভাবে বমি হয়েছে এই কয়দিনে।
-না তবে রান্না করতে গেলে বা খেতে বসলে গা কেমন গুলিয়ে আসতো। মাথাটা ও কেমন ভনভন করে।
-ডাক্তার দেখিয়েছিস???
-না ভেবেছি এই কয়দিনের পেরেশানি তে হয়তো এমন হচ্ছে।
-আমার মনে হয় তোর প্র্যাগনেন্সি টেস্ট টা করে নেয়া দরকার।
-কি??? প্র্যাগনেন্সি টেস্ট ??
-হুম কাল সকালে তোকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো। এখন একটু খেয়ে রেস্ট নে।
আজ লামিয়া বাসায় ফিরে যাবে। লাবিব ওকে নিয়ে বাসায় দিয়ে আসবে। আনাসকে ফোন করেছিলো ও বললো কাজ আছে আসতে পারবেনা। তবে গতকাল থেকে আনাস ওর ফোন ধরছেনা। হয়তো রাগ করেছে দুদিনের জায়গায় চারদিন থেকেছে বলে হয়তো। কিন্তু আজ লামিয়া ফিরে যাবেই। অনেক বড় একটা খুশির খবর আনাসকে আজ দিবে সে। জানিনা উনি করবে কথাটা শুনার পর এ খবরটা শুনার জন্য উনি অনেক উৎসুক ছিল এতোদিন লামিয়া ভাবছে আর মনে মনে হাসছে। লামিয়া আজ খুশির খবরটার সাথে আরিফের ব্যাপারে ও আনাসকে সব জানিয়ে দিবে। যা হয় হবে!!! তবে এ মুহুর্তেই লামিয়ার মনে ভয়ের চেয়ে আনন্দটায় বেশি জায়গা দখল করে নিয়েছে। কখন তাকে খবরটা জানাবে এ নিয়ে অনেক এক্সাইটেড লামিয়া। আজকের পর হয়তো ওর জীবনটাই পাল্টে যাবে…….
চলবে…….
#উপন্যাস
#প্রিয়তমা (১৯তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
লামিয়া বাসায় এসে দেখলো আনাস এখনো অফিস থেকে ফিরেনি। অবশ্য লামিয়া তো আজ আসার কথা বলেনি ওকে তাই হয়তো। আসার সময় ফারিহা রাতের রান্না করে দিয়েছে। রিপাকে নিয়ে সেগুলো গরম করে নিলো। রাত ৯টা বেজে গেছে আনাস এখনো ফিরেনি। লামিয়া এতক্ষন অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু যে মানুষ সাতটার মধ্যে বাসায় চলে আসে সে আজ নয়টার পরও আসছেনা দেখে লামিয়ার দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেলো। কি হয়েছে উনার??? খারাপ কিছু হয়নিতো আবার??? লামিয়া ভয়ে আঁৎকে উঠলো।
রাত দশটার পরে লামিয়া আনাসের নাম্বারে ফোন দিলো। কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে বারবার লামিয়ার এবার প্রচন্ড আকারে চিন্তা হচ্ছে। আসার পর থেকে আর ফোন দেওয়া হয়নি। কিন্তু এখন তো!!!! ও আল্লাহ তুমি কেন আমায় এতো টেনশন দিচ্ছো???
প্রায় ঘন্টাখানিক পরে আনাসের ফোনে কল গেলো। দুতিনবার রিং হতে ওপাশ থেকে রিসিভ হলো।
লামিয়া সালাম দিয়ে বললো,,, কি ব্যাপার আপনি কোথায়???
-কিছুটা রাগত স্বরে,,,কেন?
-কেন মানে কি? কত রাত হলো এখনো বাসায় আসছেন না কেন?
-বাসায় আসাটা কি খুব জরুরী??
-এটা কেমন কথা!!! আমি অপেক্ষা করে আছি আর আপনি বলছেন খুব জরুরী কিনা।
-আনাস গম্ভীর কন্ঠে বললো,,,তুমি কোথায়??
-বাসায়।
-ওহ
-আপনি কোথায় এখন??? আর কখন আসবেন??
-আমি আজ ফিরছিনা।
-ফিরছিনা মানে কি?? আপনি কোথায় থাকবেন??
-আমি চিটাগাং আছি।
-চিটাগাং!!! আপনি চিটাগাং গেলেন কবে?? আর আমাকে তো বলেন নি??
-বলার প্রয়োজন মনে করিনি তাই!!
-এভাবে বলছেন কেন? আমি তো এমনি বললাম!!
কবে ফিরবেন???
-জানিনা হয়তো তিন চারদিন লাগবে। রাখছি আমি বলেই লামিয়ার জবাবের অপেক্ষা না করে ফোনটা কেটে দিলো।
লামিয়া আনাসের এমন অদ্ভুত আচরণে অবাক হয়ে গেলো। কি হলো হঠাৎ করে উনার?? উনি তো এমন না বা কখনো এতো রাগতস্বরে আমার সাথে কথা ও বলেনি আজ তাহলে আবার কি হলো???
লামিয়া আল্লাহর কাছে সমস্ত বিপদ আপদ থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করে ঘুমিয়ে গেলো।
এভাবে তিনদিন কেটে গেলো। এ তিনদিনে আনাস লামিয়াকে একবারও ফোন দেয়নি। লামিয়া নিজে থেকে কয়েকবার দিয়েছে তাও দু, তিন মিনিট কথা বলে রেখে দিয়েছে আনাস। এতদিন যে ভয়টা পাচ্ছিলো তাই কি সত্যি হলো?? না হলে তো উনি এতটা কঠিন হতোনা। প্র্যাগনেন্সির রিপোর্টটা পাওয়ার পর থেকে লামিয়া আরিফের ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গেছে। আনাসের এমন ব্যবহারে তাই আবারো মনে তোলপাড় শুরু করছে। সত্যি সত্যি কি জীবনের মানেটা পাল্টে যাবে???
চারদিনের দিন আনাস বাসায় আসলো। আসার পর ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়েছে আর উঠেনি। লামিয়ার সাথে একটা কথা ও বলেনি। বিকালের দিকে রিপার বাবা এসে রিপাকে নিয়ে গেছে আনাস নাকি ফোন করে বলেছে ওকে কয়দিনের জন্য নিয়ে যেতে।
আনাস ঘুম থেকে উঠেই বেরিয়ে গেছে। লামিয়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছেনা। এতোটা অবহেলা কেন করছে মানুষটা?? ভুল করলে তো বলতে পারতো কিন্তু এভাবে এড়িয়ে যাওয়ার কোন মানে হয়না!! কতটা উৎসুক হয়ে ছিলো লামিয়া,, আনাস ফিরে আসলেই ওকে প্র্যাগনেন্সির কথাটা জানাবে কিন্তু কি হলো!!! আসলে মানুষ ভাবে এক হয় আরেক!!! এটাই উপরওয়ালার খেল যা আমরা বুঝতে পারিনা।
সন্ধ্যার পর আনাস বাসায় আসলো। লামিয়া আনাসের পিছু পিছু রুমে আসলো। আনাস ফোনটা রেখে বারান্দার দিকে যাচ্ছিলো লামিয়া পিছন থেকে বললো,,,, আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো??
–
-আসলে আপনাকে একটা খুশির খবর দেয়ার আছে।
-আনাস ওখান থেকে ফিরে আসলো লামিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,,, তাই নাকি!!! তারপর লাগেজ খুলে তিনটা খাম লামিয়ার দিকে ছুড়ে মেরে বললো,,, এই আপনার খুশির খবর?
-লামিয়া মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। নিজের ফটোশপ গুলো সব মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। লামিয়া পাথরের মত ওখানে বসে পড়লো। শেষ পর্যন্ত যে ভয়টা ছিলো তাই সত্যি হয়ে গেলো। আনাসের পরিবর্তনের কারণটা লামিয়ার সামনে খোলাসা হলো। এই জন্য উনি এমন করেছে?? একবার তো আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতো কতটা সত্যি এ ফটোশপ গুলো।
-আনাস বললো,,, কি হলো?? কথা বলছোনা যে?? কথা ফুরিয়ে গেছে নাকি?? ধরা পড়ে গেছো তাইনা??
-লামিয়ার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কথা বলার শক্তি যেনো ওর নেই। তারপরও বললো,,,এ,,এ,,এগুলো আ,,আপনাকে কে দিলো?
-যে দিয়েছে মিথ্যা তো না!!
-লামিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,,,আপনি এগুলো দেখেই বিশ্বাস করে নিয়েছেন একবারো আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতেন না??
-কি জিজ্ঞেস করবো তোমাকে?? আজ বুঝেছি তোমার এতদিনের লুকোচুরির কারণ কি,,, এতো খারাফ তুমি অথচ সবার সামনে কত ভালো মানুষি।
-আপনি আমাকে এতদিনে এই চিনেছেন???একটা কথা কি জানেন,,, সব সময় আমরা আমাদের চোখে যা দেখি তা সত্যি হয়না অনেকটা মিথ্যা তাতে জড়িয়ে থাকে।
-আবার তাতে সব তো মিথ্যা থাকেনা কিছু না কিছু সত্যি থাকে। যা রটে তার কিছুনা কিছু তো ঘটে তাইনা??
-আপনি আমার কথাটা তো শুনবেন??
-কি শুনবো হ্যা কি শুনবো? ওইদিন যখন জিজ্ঞেস করলাম এই লোকটা কে কি সুন্দরভাবে এড়িয়ে গেলে এই না হলো মেয়ে!! ভালো মানুষের আড়ালে লুকিয়ে আছে নোংরামি।
-আল্লাহর দোহাই লাগে আপনি আমাকে প্লিজ এতবড় মিথ্যা অপবাদ দিবেন না কোনকিছু না জেনে। আপনি আগে আমার কথাটা শুনুন তারপর যাই খুশি বলবেন।
-এর পর ও কি শুনার আছে??
-আরো অনেক কিছু শুনার আছে আপনার।
-প্লিজ এইমুহুর্তে আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাইনা। কাল সকালে তুমি তোমার বাড়ি চলে যাবে তোমার এই মুখটা দেখতে ও এখন আমার ঘৃনা লাগছে। কি নির্লজ্জ আর ব্যভিচারী মেয়ে নিয়ে আমি এতদিন সংসার করেছি ভাবতেও ঘৃনা লাগছে।
-আনাসের পা জড়িয়ে ধরে লামিয়া বললো,,,আপনার পায়ে পড়ি আপনি আমাকে এতবড় মিথ্যা অপবাদ দিবেন না।
-ওই লোকটা কি মিথ্যা বলেছে আমাকে?? ও আমাকে সব বলেছে সামনা সামনি বসে।
-ওই লোকের মিথ্যা বানোয়াট কথা আর এই ছবিগুলো আপনি বিশ্বাস করে নিলেন আমার মুখের কথা কিচ্ছুনা।
-এই প্লিজ নাটক করোনা?? কাল সকালে আমার বাসা ছেড়ে চলে যাবে তুমি বলে দিলাম!!! পা ছাড়ো আমার বলে লামিয়াকে ধাক্বা দিয়ে আনাস রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
লামিয়াকে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো……
চলবে……
#উপন্যাস
#প্রিয়তমা (২০তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
লামিয়া খাটের পাশে হেলান দিয়ে বসে আছে। কতক্ষণ মেঝেতে ওভাবে পড়ে ছিলো নিজেও জানেনা। একটু আগে জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফিরলে চোখ খুলতে পারছেনা। অনেকক্ষণ ওভাবেই মেঝেতে শুয়ে ছিলো। তারপরও আস্তে আস্তে উঠে বসলো। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে পড়লো। জ্ঞান হারানোর সময় বোধহয় মাথাটা দেয়ালে বাড়ি খেয়েছে। মাথার ভিতরে কেমন ভন ভন শব্দ করছে৷ তবে এই মুহুর্তে এই আঘাতের চেয়ে আনাসের কাছ থেকে পাওয়া আঘাতটাই বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। এখন রাত তিনটা বাজে সেই থেকে এখনো অনবরত কেঁদে যাচ্ছে লামিয়া।
আনাস লামিয়া পড়ে গেছে দেখে ও পিছু ফিরে তাকায়নি। সেই যে গেস্টরুমে ঢুকে দরজা লক করেছে আর বেরুয়নি। ওর ভিতরে বাইরে তোলপাড় হচ্ছে। না জানি আল্লাহর কতবড় নাফরমানি করেছি যার শাস্তি আল্লাহ এমন ভাবে আমাকে দিয়েছে আনাস ভাবছে। এমন চরিত্রহীন মেয়েকে কেন আমার জীবনের সাথে জুড়ে দিয়েছে আল্লাহ?? অতিরিক্ত বিশ্বাসের আজ সঠিক জবাব দিয়েছে ওই মেয়ে। মানুষের জীবন কেন এতো কঠিন????
লামিয়া মহান রবের দরবারে সেজদায় পড়ে আছে অনেকক্ষণ যাবত। আল্লাহ কেন তার ঈমানদারীতার মূল্য এভাবে দিয়েছে। একদিন যে মানুষটাকে বিশ্বাস করে জীবনের সবচেয়ে আপনজন ভেবে নিয়ে যার হাত ধরে সংসার নামক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে আজ সেই মানুষ কত পর হয়ে গেছে। এভাবে সত্য মিথ্যা বাছাই না করে একট বানোয়াট কথা সত্য বলে মেনে নিয়েছে এ কেমন বিশ্বাস!!!! যে বিশ্বাসের কোন অস্তিত্ব নেই। আল্লাহ এ কেমন কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছো আমাকে??? কেন জীবনটাকে এতো জটিল করে দিয়েছো???
হে আল্লাহ ধৈর্য্য দাও আমায়!!!! আমাকে ধৈর্য্যহারা করোনা!!! আমায় সব কষ্ট সইবার ক্ষমতা দাও!!!!
আমি যেনো তাকে বুঝিয়ে নিতে পারি সেই ক্ষমতাটা আমায় দিও তুমি!!!
সারারাত দুই রুমের দুই জন মানুষ নির্ঘুম কাটিয়েছে। কেউ বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রনায় আর কেউ মিথ্যা অপবাদ পাওয়ার যন্ত্রনায়। জীবন কখন মানুষকে কোন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করায় এটা কেউ বলতে পারেনা। দুজন ভালোবাসার মানুষ যাদের একে অপরকে ছাড়া কাটানোর কথা ও ভাবতে পারতোনা আজ দুজন কত চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে আলাদা আলাদা রুমে কাটিয়েছে।
সকালে লামিয়া নাস্তা রেডি করে টেবিলে বসে আনাসের অপেক্ষা করছে। আনাস রেডি হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো,,,লামিয়া গিয়ে হাত ধরে বললো,,, নাস্তা করে কোথাও যাবেন না।
-ওই নোংরা হাত দিয়ে বানানো নাস্তা আমার মুখে যাবেনা। লামিয়ার হাতটাকে ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে বললো,,,আমি বাসায় এসে যেনো কাউকে না দেখি বলে গেলাম বলেই বেরিয়ে গেলো।
লামিয়া দরজা লাগিয়ে দৌড়ে গিয়ে খাটে পড়লো বাঁধভাঙা চোখের পানির ঢল নেমেছে। কেন??কেন??কেন আমার সাথে এতবড় অন্যায় হচ্ছে??
লামিয়া এখন কাউকে কিচ্ছু জানাবেনা। কাউকে ওর জন্য টেনশন করতে দিবেনা। বাবাটা একবার হার্ট এটার্ক করেছে ফারিহাকে নিয়ে টেনশন করতে করতে লামিয়া আর কোন টেনশন দিতে চায়না কাউকে। নিজেই সব সামলাবে না হলে উপরওয়ালা যা লিখে রেখেছে তাই হবে।
লামিয়া দুপুরে রান্না ও করেনি খায়ওনি। এতো টেনশনে না কোন কাজ হাতে উঠছে রান্না তে দূরের কথা। তাও রাতের রান্নাটা করেছে শরীর সায় দিচ্ছেনা তারপরও অনেক কষ্টে। রান্না করার সময় মাথা ঘুরছিলো অনেক আজ কয়দিনের টেনশন আর ঠিকমতো না খেয়ে খেয়ে শরীর অনেক দুর্বল হয়ে গেছে সেই জন্য আর এমনিতে এখন তো লামিয়া একা না শরীরের ভিতরে আরেকটা প্রাণ ও বেড়ে উঠছে একটু একটু করে ।
লামিয়া রান্না করে গিয়ে শুয়ে পড়েছে আর মানছেনা শরীরের দুর্বলতা থেকে মানসিক দুর্বলতাটাই বেশি ঝেঁকে আছে।
আনাস ফিরলো ৯টায়। বাসায় আর ফিরতে ইচ্ছে করেনা এখন বাসায় আসলেই তো সেই অপ্রিয় মুখটা দেখতে হবে যা একসময় অনেক প্রিয় ছিলো। বাসায় সামনে এসে দেখলো দরজাটা ভিতর থেকে আটকানো। তার মানে এখনো যায়নি। অনেক ভেবে চিন্তে মনের সাথে কিছু সময় যুদ্ধ করে কলিংবেলে চাপ দিবেনা দিবেনা করে ও পরে চাপ দিলো।
লামিয়া মাথার যন্ত্রণায় চোখ খুলতে পারছেনা। এদিকে কলিংবেলটা অনবরত বেজে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দরজার দিকে ধীর পায়ে এগুলো। এদিকে আনাস কলিংবেলে চাপ দিতে দিতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলো। বাসায় বসে করছেটা কি???? শেষবার বেল দিবে না খুললে এবার দরজা ভেঙে ফেলবে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। কলিংবেলে চাপ দেয়ার আগেই দরজা খুলে গেলো। লামিয়া দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়ালো। আনাস ওর দিকে না তাকিয়েই হনহন করে ভেতরে চলে গেলো।
লামিয়া টেবিলে গিয়ে খাবার সাজিয়ে রুমের দিকে গেলো। আনাস ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই লামিয়া বললো,,,, টেবিলে খাবার দিয়েছি খেতে চলুন।
আনাস কোন জবাব না দিয়ে রুম ছেড়ে বিরুতে গেলো। লামিয়া পিছন থেকে হাত চেপে ধরে বললো,,, রাগ তো আমার উপর খাবার কি দোষ করেছে। যে খাবারের সাথে রাগ দেখাচ্ছেন।
– আনাস অনেক রেগে বললো,,, হাত ছাড়ো আমার।
-আপনি আমার কথাগুলো একবার শুনেন।
-তোমার মত মেয়ের কোন কথা শুনার রুচি আমার নেই।
– এতটাই অরুচি ধরে গেছে আমার উপর??
–
-থাক শুনতে হবেনা আমার কথা। এখন খেতে চলুন।
-একবার বলেছি তোমার ওই নোংরা হাতের রান্না করা খাবার আমার গলা দিয়ে নামবেনা বুঝতে পারছো???
-এখন বুঝি আমার হাত ও নোংরা হয়ে গেছে।
-তোমার পুরো শরীরটাই তো নোংরা হয়ে গেছে।
-আনাসের হাত ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,,, আপনার দোহাই লাগে আর বলবেন না প্লিজ।
-সত্য কথা শুনতে তো খারাপ লাগবে। আমার মুখ দিয়ে অন্য কোন কঠিন কথা বেরুবার আগেই তুমি আমার সামনে থেকে যাও। আর কাল সকালেই আমার বাসা ছেড়ে দিবে তুমি আমার বাসায় থাকার কোন যোগ্যতাই রাখোনা এ বলে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে রুম ছেড়ে যেতে উদ্যত হতেই,,
লামিয়া বললো,, দাঁড়ান!!! আপনি রুম ছাড়বেন কেন আমিই চলে যাচ্ছি এ রুম থেকে। আপনার রুম আপনার বাড়ী আপনি কেন ছাড়বেন।চিন্তা করবেন কাল সকালেই আমি আপনার বাড়ী ছেড়ে চলে যাবো। যে বুঝবেনা তাকে জোর করে বুঝানোর কোন মানে হয়না। বেঁচে থাকতে আপনার সামনে আর দাঁড়াবোনা। ক্ষমা করে দিবেন আমার জন্য আপনাকে অনেক নীচু হতে হয়েছে আর হতে হবেনা। আপনার জীবনে লামিয়া নামের অভিশাপ থেকে আপনি মুক্ত হয়ে যাবেন অচিরেই বলেই লামিয়া রুম ছেড়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো।
সকালে আনাস বেরিয়ে যেতেই লামিয়া রুম ছেড়ে বেরুলো। লাবিবকে কাল রাতেই ফোন করে নলেছিলো ওকে একটু নিয়ে যেতে ও এখনো আসেনি। তাই লামিয়া বাড়ীটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। একনিন এ বাড়ীতে এসেছিলো অনেক আশা আর চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে। আর আজ একরাশ রাগ,, ঘৃনা আর অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে। কি হতভাগা মেয়ে আমি!! যে নিজের বাচ্ছা হওয়ার কথাটা স্বামীকে শুনানোর আগে স্বামীর ঘর ছাড়তে হচ্ছে। ও ঘর এ সংসার কাল পর্যন্ত আমার নিজের আপন ঘর ছিল আর আজ আমি সবকিছু থেকে উপর থেকে অধিকার হারালাম। মা বাবা শুনলেও হয়তো এই এতবড় মিথ্যাটাকে সত্য বলেই মেনে নিবে। যার বুঝার কথা সেই যখন বুঝেনি অন্য মানুষ আর কি বুঝবে??
লাবিব এসেছে প্রায় আধাঘন্টা হলো। আসার পর থেকে লামিয়াকে এক নাগাড়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। কিন্তু লামিয়া কোন জবাব দিচ্ছেনা ও সেই থেকে কেঁদে যাচ্ছে।
লাবিব বললো তুই না বললে আমি বুঝবো কি করে কি হয়েছে?? কেন এতো ইমার্জেন্সি ডেকেছিস আর এখন বলছিস চলে যাবি? আমাকে খুলে বলনা কি হয়েছে??
ভাইয়া আগে বাসায় চলো পরে সব বলবো বলেই লামিয়া উঠে দাঁড়ালো। লাবিব জানে ও কোন কথার জবাব এখন দিবেনা অযথা কথা বাড়িয়ে লাভ নেই পরে আস্তে ধীরে সব শুনা যাবে।
লামিয়া বোরখাটা পড়ে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে বাড়ীটাকে ভালো করে আরো একবার দেখে নিলো। লামিয়া জানেনা আর কখনো এ বাড়ীতে ফিরতে পারবে কিনা??
হয়তো এ যাওয়াই শেষ যাওয়া। কেননা যে সম্পর্কেসন্দেহ একবার ঢুকে পড়ে সে সম্পর্ক আর কখনো আগের মত ঠিক হয়না। একরাশ স্বপ্নকে বালি চাপা দিয়ে বেরিয়ে পড়লো…..
হয়তো এরপর শুরু হবে লামিয়ার জীবনযুদ্ধ!!!
চলবে…..