প্রিয়তমা পর্ব-২১ ২৩

0
2209

#উপন্যাস
#প্রিয়তমা (২১+২২তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
ফারিহার বাসায় একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। লামিয়ার মুখ থেকে সব শুনার পরে লাবিব আর ফারিহা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।
ফারিহা বললো,,, তুই ওর কথা শুনে কেন চলে আসবি??? ওকে সব কিছু কেন বুঝিয়ে বলিসনি???
-আপু তুই আমাকে বলছিস এসব??? তোর কি মনে হয় আমি উনাকে বুঝানোর চেষ্টা করিনি?? আমি এই দু,দিনে অনেকভাবে বুঝানোর চেষ্ট করেছি কিন্তু পারিনি।
কি করে পারবো বলতো?? যে মানুষ আমার এই অপবিত্র চেহারাটা দেখতে পর্যন্ত চায়না সে কি করে আমার কথা শুনবে??
-লাবিব বললো,,, কিন্তু আরিফ কি করে তোদের বাসার ঠিকানা পেয়েছে??
-আমি কি জানি!!
-ফারিহা বললো,,,, এই অপবাদ গুলো যদি আমার উপরে আরোপ হতো তাহলেও কথা ছিল। কারণ আমি ছিলাম উড়নচণ্ডী আমি অতি আধুনিক হয়ে চলাফেরা করতাম। কিন্তু তুই কেন?? তুই তো সারাজীবন নিজেকে আবৃত রেখেছিস,, তাহলে তোকে কেন মিথ্যা অপবাদের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে??
-কি করবো বলতো আপু,, এইসব আমার কপালে ছিল আজ যদি ওই মানুষটাকে বিয়ে করতাম তাহলে হয়তো এত বড় মিথ্যা অপবাদের বোঝা বয়ে বেড়াতে হতোনা আমাকে। খারাপ হতে হতোনা নিজের স্বামীর কাছে। আল্লাহ হয়তো আমার জীবনে সংসার জীবনে শান্তি নামক জিনিসটা লিখে রাখেনি।
-কি বলছিস কি তুই??? আমি নিজে আনাস ভাইয়ের সাথে কথা বলবো তারপর ও তোর জীবনটাকে এভাবে নষ্ট হতে দিবোনা ফারিহা বললো।
-না আপু তোরা কেউ উনাকে কিছু বলবিনা।
-লাবিব বললো,,, বোকার মত কথা বলিসনা এভাবে চুপ করে বসে থাকলে তো সমস্যার সমাধান হবেনা।
-না ভাইয়া তোরা কেউ কিছু বলবিনা। তুই পারলে আমাকে আজই বাড়ীতে পৌঁছে দিবি প্লিজ ভাইয়া।
-ফারিহা বললো,,, লামিয়া এবার কিন্তু তুই সত্যি সত্যি বোকামি করছিস। আজ যদি তোর জীবন বিপদে পড়তো তাহলেও কথা ছিল। কিন্তু তোর মাঝে উনার সন্তান আছে উনি তো এভাবে তোকে বের করে দিতে পারেনা।
-আপু উনি জানেনা আমার সন্তানের কথা।
-জানেনা তো জানবে!! এভাবে তো হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়না।
-আপু তোদের দোহাই লাগে তোরা কেউ উনাকে বা উনার বাড়ীর কাউকে আমাকে নেয়ার ব্যাপারে বা আমার সন্তানের ব্যাপারে কিছু বলবিনা। তোদের আমার কসম!!
তোরা হয়তো আমাকে নেয়ার জন্য উনাকে চাপ দিবি বা অনুনয় বিনয় করবি,,, তোদের মন রাখতে হয়তো বা সন্তানের কথা চিন্তা করে হয়তো উনি আমাকে মেনে নিবে আবারো। কিন্তু আমি চাইনা উনি তোদের চাপের মুখে পড়ে আমাকে আবার উনার ঘরে নিয়ে যাক। তাহলে যে আমি কখনো শান্তিতে থাকতে পারবোনা উনার সংসারে। সারাজীবন এই মিথ্যা অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়াতে হবে আমাকে।
আমি চাই উনি সত্যটা পুরোপুরি জেনে আমাকে নিয়ে যাবে আর নাহলে সারাজীবন এইভাবে কেটে যাক।
সারাজীবন অপবাদের বোঝা বয়ে বেড়ানোর চেয়ে একাকী জীবন কাটানো অনেক ভালো।
-তোর জীবন একাকী কাটাবি ঠিকআছে কিন্তু তোর পেটে যে একটু একটু করে তার সন্তান বেড়ে উঠছে তার দায়ভার কে নিবে??
-আমার সন্তানের দায়িত্ব আমি নিবো। আমি এতটা ও অসহায় হয়ে যায়নি।
-তুই আরো একটু ভাব এখনো সময় আছে। আমরা ভাইয়াকে বুঝালে হয়তো উনি বুঝবে।
-লামিয়া চিৎকার দিয়ে বললো,,, তোরা আমার কথা বুঝতে পারছিসনা নাকি আমি তোদের বাড়িতে থাকলে আমি তোদের বোঝা হয়ে যাবো তাই ভেবে এত কথা বলছিস।
-লাবিব বললো,,, থাপ্পড় দিবো বেয়াদব মেয়ে। এই চিনেছিস আমাদের। এভাবে কথাটা তুই বলতে পারলি। তুই আমাদের সবার আদরের। তোর জীবনটা এভাবে কষ্ট পেয়ে পেয়ে কাটবে সেটা আমরা মানতে পারছিনা বলে এগুলো বলছি। আর তুই এভাবে বলছিস,,,
তবে ওই জানোয়ারটাকে আমি ছাড়বোনা যে আমার বোনের জীবন নষ্ট করেছে। এতদিন তোর কথা ভেবে কিচ্ছু বলিনি কিন্তু আজ আর ছাড়ছিনা। ওকে আমি জেলের ভাত না খাইয়ে ছাড়বোনা।
-ভাইয়া আমার তোর জন্য কাউকে কিচ্ছু বলতে হবেনা। ওর বাবার পাওয়ার আছে ওর কিছু আমরা করতে পারবোনা। উল্টো পুলিশের কাছে আমাদের অযথা হয়রানির স্বীকার হতে হবে। মান সন্মান যা আছে তাও যাবে। আমহ নিজের কষ্ট সইতে পারবো কিন্তু আমার বাবা মায়ের মাথা আমার জন্য নিচু হবে সেটা আমি মানতে পারবোনা। কারো সাথে কোন বিরোধের দরকার নেই। আমার ভাগ্যে এটা লেখা ছিল তাই হয়েছে। যদি আমার ভাগ্যে সুখ লেখা থাকে তাহলে হবে আর থাকলে তো আমি উপরওয়ালার সাথে জোর করতে পারবোনা। হয়গো আল্লাহ আমার ঈমানের পরীক্ষা নিচ্ছেন । তাই আমি ধৈর্য্য হারাবোনা। আল্লাহ যা করেন মানুষের ভালোর জন্যই করেন।
-কিন্তু এটাতো একটা অমানুষ তোর সাথে ইচ্ছে করে করেছে এখানে আল্লাহর হাত থাকে কেমনে।
-আল্লাহ না চাইলে কেউ কিচ্ছু করতে পারেনা না আমি না তুমি। বাবা মাকে আমি বুঝিয়ে নিবো। ভাইয়া তুই আজকের মধ্যে আমাকে বাড়ীতে দিয়ে আসার ব্যবস্থা কর প্লিজ।
-কিন্তু বাড়ীতে গেলেও জানোয়ারটা কি তোর পিছু ছাড়বে??
-ও আর কিছু করবেনা ভাইয়া ওর চেয়েছিলো আমার সংসারে ভাঙন ধরাতে সেটা ও পেরেছে এর বেশি আর কিছু করবেনা।
-ফারিহা বললো,,, তুই আগে খেয়ে নে। ভাইয়া টিকেট করে আসুক। না খেয়ে খেয়ে কি হাল করেছিস দেখেছিস।
-আমি এখন কিচ্ছু খাবোনা আপু জোর করিসনা।
-সবকিছু তে কেন এমন করছিস?? নিজের জন্য না হলে তোর সন্তানের জন্য তোকে এখন সুস্থ থাকতে হবে।
একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারিহা বললো,,, কি দুর্ভাগ্য আমার!!! বোন হয়ে তুই আমার জীবনটাকে ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিয়েছিস আর বোন হয়ে তোর জন্য এতটুকু করতে পারছিনা আমি।
আনাস বাসায় ফিরে দরজার দিকে না তাকিয়ে অভ্যাসবশত কলিংবেলটা কয়েকবার বাজালো। ওর মনেই ছিলনা লামিয়ার সাথে ঝামেলার কথাটা। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে ছল দরজার বাহিরে। ভিতর থেকে দরজা খুলছেনা দেখে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো দরজা বাহির থেকে লক করা বুকের ভিতর কোথাও একটু চিন চিন ব্যথা করে উঠলো তার মানে ও সত্যি চলে গেছে৷ তখনি মনে পড়লো লামিয়াকে তো আমি নিজেই চলে যেতে বলেছি। চলে গেছে আমার তো খুশি হওয়ার কথা ওইরকম একটা খারাপ মানুষ জীবন থেকে চলে গেলো কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে কেন। আনাস রুমে ঢুকে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। পুরো রুমজুড়ে নিস্তব্ধতা । জীবনটা কি এমন হওয়ার কথা ছিল?? অতিরিক্ত বিশ্বাস করেছিলাম তাই আজ বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণা আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে। কেন আমার জীবনের সাথে এমন হলো???
আনাসের হাতের উপর চোখ থেকে একফোটা পানি গড়িয়ে পড়েছে। আনাস হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো আমি কাঁদছি কেন?? কার জন্য কাঁদছি?? ভালোই হয়েছে চলে গেছে। এরকম মানুষের সাথে সংসার করলে আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে যেত ।
আনাস চোখ বুলিয়ে পুরো রুমটা দেখলো লামিয়ার সব জিনিস জায়গায় জায়গায় পড়ে আছে। মোবাইলটা ড্রেসিং টেবিলের সামনে পড়ে আছে। আলমারি খুলতেই দেখলো জামা কাপড় গুলো ও ভাজ করে রাখা কিচ্ছু নিয়ে যায়নি মনে হয়। আনাসের একবার মনে হলো ওর কোনো জিনিস রুমে রাখবেনা সব ফেলে দিবে আবার মনে হলো না থাক এগুলো কি দোষ করেছে।
সারাটা রাত নির্ঘুম কাটালো আনাসের । ঘুম কি করে আসবে ঘুম নামক জিনিসটা তো চোখ ছেড়ে পালিয়েছে। আনাসের বার বার মনে হয় এই পৃথিবীর মানুষগুলো সত্যি অনেক স্বার্থপর। নিজের ভালো ছাড়া কারো ভালো এরা বুঝেনা।একজনের সাথে নোংরামি করে আবার আমার কাছে,, ছি…ছি… কি খারাপ মানুষ!!!
লামিয়া বাসায় এসেছে পরদিন দুপুর দুুইটায়। আগের দিন টিকেট পায়নি তাই আজ ভোরের গাড়ীতে রওনা দিয়েছে। বাসায় আসার পর খেয়ে ঘুমিয়েছে। আসার আগে লাবিবকে বলে দিয়েছে বাবা মাকে যেন কিচ্ছু না বলে ও পরে সব বলবে। লাবিব আবার রাতের বাসে চলে যাবে। কলেজ থেকে একদিনের ছুটি নিয়েছে কাল আবার জয়েন করতে হবে।
পরদিন রাতের বেলা লামিয়ার বাবা মা সব শুনার পর বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে উনাদের মেয়েটার জীবনে এতবড় ঝড় বয়ে গেছে। সোহান সাহেবের তো প্রেশার বেড়ে হাই হয়ে গেছে। এমনিতে হার্ট এটার্কের রোগী তারউপর এইরকম একটা ঘটনা ঘটে গেছে তার মেয়ের জিবনে এটা শুনলে কি মাথা ঠিক থাকে।
মেয়ের সুখের সংসার ভেঙে যাচ্ছে একটা বানোয়াট মিথ্যের জোরে এটা কি করে বাবা মা হয়ে উনারা সহ্য করবে। তার উপর মেয়ে আবার অন্তর্সত্ত্বা।
লামিয়ার মা বললো,,, জানিনা কতবড় পাপ করেছি জীবনে যার শাস্তি আজ আমার ফুলের মত নিষ্পাপ মেয়েটা পাচ্ছে। সারাজীবন যে ইসলামের পথে চলে এসেছে আজ তাকেই রাস্তার মেয়েদের কাতারে নিয়ে গেছে মানুষ নামের ওই জানোয়ারটা।
সোহান সাহেব বুকে হাত দিয়ে চিৎকার করে চেয়ার থেকে পড়ে গেলো। লামিয়া দৌঁড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।
সোহান সাহেবকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। আবারো হার্ট এটার্ক হয়েছে। লামিয়া ওর মাকে নিয়ে ওয়েটিং রুমে বসে আছে সাথে লামিয়ার ছোট চাচা ও আছে। মা মেয়ে দুজনে বসে বসে একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে। ডক্টর এসে জানালো রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। কেবিনে দেয়া হয়েছে। এখন একটু ভালো আছে তবে খেয়াল রাখতে বলেছে। দুইবার শেষ তাই বড় ধরনের কোন আঘাত যেনো না দেয়া হয় উনাকে এটার জন্য ভালো করে বলে দিয়েছে।
লামিয়া ফোন করে লাবিবকে আর ফারিহাকে বাবার অবস্থা জানিয়ে এখন আসতে নিষেধ করে দিয়েছে। ওরা খবর শুনেই রওনা দিয়েছিলো তবে এখনো বাস স্টপে আছে। লামিয়ার কথা শুনে কিছুটা ভরসা পেয়ে বাসার দিকে চলে গেলো।
লামিয়া বাবার পাশে গিয়ে বসলো। সোহান সাহেবের দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। লামিয়া বাবার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,,,আব্বু তুমি আমায় নিয়ে কেন টেনশন করছো??? তোমার মেয়ে অসহায় নয় বাবা। আমি তো ভেঙে পড়িনি তুমি দেখোনা আমি কেমন স্ট্রং আছি এখনো। আমি ধৈর্য্য ধরবো। আল্লাহ আমার সাথে আছেন। উনি জানেন আমি কতটা পবিত্র। তিনি আমাকে এর ফল অবশ্যই দিবেন। তুমি আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা করোনা আব্বু । আমি ভালো থাকবো অনেক ভালো। আব্বু দেখো এই কষ্টটা আমি সইতে পারবো আব্বু তোমাকে হারানোর কষ্ট সইতে পারবোনা বলেই কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে আসলো লামিয়া। ওর এখন কান্না আসছে প্রচন্ড কান্না কিন্তু বাবার সামনে ও কাঁদবেনা একদম না।
রাত ১২টা বাজে। পুরো হাসপাতাল জুড়ে নিস্তব্ধ পরিবেশ। মাঝে মাঝে দু একজন ডাক্তার নার্সের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে রোগীদের ব্যাথায় কাতরানোর শব্দ আসছে কিছুক্ষণ পরপর।
হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে লামিয়া নিঃশব্দে কাঁদছে। এমনটা কি হওয়ার ছিল আমার জীবনে???
পিছন থেকে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে লামিয়া ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলো মা দাঁড়িয়ে কাঁদছে। মাকে দেখেই চোখের পানিটা মুছে নিল হাত দিয়ে।
কেন করছিস নিজের কষ্টকে আড়াল? কেউ না বুঝলে ও আমি বুঝি তোর কষ্ট হচ্ছে অনেক কষ্ট কেন লুকোচ্ছিস??
লামিয়া মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। এতক্ষণ ধরে বুকের মাঝে আটকে রাখা কষ্টের পাথরটা আর ধরে রাখতে পারছেনা মাকে কাছে পেয়ে।
মা আমার এত কষ্ট কেন হচ্ছে??? বলতে পারো কেন আমার সাথে এত অন্যায় হলো??? আমি তো কোন অন্যায় করিনি তারপরও মিথ্যে অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে কেন আমায় আজ চলতে হচ্ছে?? বলতে পারো কিসের শাস্তি পাচ্ছি?? আমি কি করে জীবন কাটাবো বলতে পারো??
আমি পারছিনা আর পারছিনা……..
চলবে………

#উপন্যাস
#প্রিয়তমা (২২তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
আজ দুই মাস হলো লামিয়া বাবার বাড়ি আছে। আনাস এর মাঝে ভুল করেও একবারো লামিয়ার খোঁজ নেয়নি। তবে লামিয়ার শশুরশাশুড়ী কি করে জানি শুনেছে লামিয়া আনাসের সাথে রাগারাগি করে এ বাড়ি চলে এসেছে। উনারা বারবার ফোন করে বলছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। উনারা সম্ভবত লামিয়ার এইসব ব্যাপারে কিছু এখনো জানেন না তাই হয়তো এখনো এতটা স্বাভাবিক আছে। আর লামিয়া ও যেঁচে কিছু জানায়নি। লামিয়ার শাশুড়ি আজ ফোন করে জানিয়েছে উনারা আগামী পরশু ফিরে আসবে। লামিয়া জানে দেশে ফিরার পর তারা এখানে আসবে লামিয়াকে নিয়ে যেতে। কিন্তু লামিয়া যাবেনা ওই বাড়ীতে কোনভাবেই না।
সোহান সাহেব এখন কিছুটা সুস্থ তবে মেয়ের জন্য উনাদের স্বামি স্ত্রীর চিন্তার শেষ নাই । কি মেয়ে কি হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া প্রায় বলতে গেলে করেইনা যতক্ষণ ওর মা জোর করে একটু খাওয়ায়। কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে তার হাসিখুশি থাকা মেয়েটা। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা খুব একটা। তবে এখন আর কাঁদেনা কেমন যেন পাথর হয়ে গেছে। বাবা মা কে বুঝতে দেয়না নিজের কষ্ট কিন্তু প্রতিদিন রাতে তাহাজ্জুদের পার্টিতে বসে চোখের পানি ঝরায় জোবায়েদা বেগম নিজে দেখেছে এটা। এভাবে নিস্তেজ হয়ে থাকলে মেয়েটা মরে যাবে এই ভেবে আনাসের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছেন কয়েকবার। কিন্তু লামিয়া ওয়াদা করিয়ে রেখেছে বলে কিছু করতেও পারছেনা। পিয়াসটা দেশে থাকলেও কিছু একটা করা যেত। কিন্তু গত পাঁচমাস আগে ও আমেরিকাতে চলে গেছে তাই কিছু সম্ভব না।
সকালে লামিয়া কিচেনে নাস্তা রেডি করছিলো এমন সময় ওর বাবা বাহির থেকে আসলো। উনি জোরে জোরে বলতেছে কারো উপর বিনা দোষে অন্যায় করলে আল্লাহ ছাড়েনা। একদিন না একদিন শাস্তি পেতেই হয় নিজের করা পাপের।
জোবায়েদা রুম ছেড়ে বেরুতে বেরুতে বললো,,, কার কথা বলছো??? কে কি অন্যায় করেছে???
-যে অমানুষটা আমার মেয়ের সুখের সংসার ভেঙেছে তার কথাই বলছি।
-কে আরিফ??? কি হয়েছে তার???
-কাল রাতে কারা জানি ওকে মেরে বাজারের পাশের ডোবার মধ্যে লাশ ফেলে দিয়ে গেছে।
-কি বলছো??? কে করেছে এসব???
-কে করেছে জানিনা তবে এমন নৃশংসভাবে মেরেছে যে মুখটা পর্যন্ত চেনা যাচ্ছেনা।
-আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে। আল্লাহ কখনো অন্যায় সহ্য করেনা।
লামিয়া এ কথাটা শুনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলো। আল্লাহ জানোয়ারটাকে নিয়ে গেছে এতেই যেন ওর প্রশান্তি। আমার জীবনটাকে তো শেষ করেছো এখন কি নিজে ভালো থাকতে পেরেছো। আল্লাহ তো সব দেখে। আল্লাহ মা আয়েশা কে যখন মিথ্যা অপবাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে তার পবিত্র থাকার সত্যতা প্রমান করেছেন নিশ্চয় আমাকেও উনি বাঁচাবেন। তিনি যে মানুষের রক্ষাকর্তা।
আনাসের মা বাবা দেশে ফিরে এসেছে আজ সকালে। আনাস উনাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। পিছন থেকে ওর মা এসে বললো,,৷ কোথায় যাচ্ছিস??
-এটা কেমন প্রশ্ন মা??? তুমি জানোনা আমি এ সময় কোথায় যায়?
-জানি কিন্তু এখন তোর কোথাও যাওয়া হবেনা। তোর সাথে আমার কথা আছে।
-মা আসছো রেস্ট নাও কথা রাতেও বলা যাবে।
-রেস্ট লাগবেনা আমার।
-মা আমার এখন যেতেই হবে। তুমি জানোনা অফিস থেকে আমাকে দুই বছরের জন্য বাহিরে পাঠানো হবে আর এখন অফিস অফ করতে পারবোনা আমি বলে জবাবের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে গেলো। এখন মায়ের সামনে থাকা মানে হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া যেন পালাতে পারলেই বাঁচে।
আনাস সারাদিন অফিসে অনেক ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে আগামী সপ্তাহে ও অফিসের কাজে দেশের বাহিরে যাবে। আনাস যখন এ অফারটা পেলো তখন অনেক খুশি মনে গ্রহন করেছে। কারণ দেশে থাকলে লামিয়ার সাথে কাটানো সময়গুলো তাড়া করে বেড়াবে প্রতিনিয়ত। এভাবে ও পারবেনা। আজ অনেকদিন হলো ও চলে গেছে। জানিনা কেমন আছে??? মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একটু খোঁজ নিতে কিন্তু পারেনা নিজের ইগোর জন্য। লামিয়ার ওই ফটোশপ গুলো যখনি চোখের সামনে ভেসে উঠে তখনি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয় আনাস।
সন্ধ্যায় একটু লেট করে বাসায় ফিরলো আনাস তার কারন মায়ের সামনে ধরা পড়ার ভয়। কি জবাব দেবে সে মাকে??? কি করে লামিয়ার নোংরামির কথাগুলো মাকে বলবে??? এগুলো বললে লামিয়াকে সবার সামনে ছোট করা হবে যা আনাস কখনো হতে দিবেনা। একসময় তো লামিয়া ছিল ওর সবটা জুড়ে যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে নিয়েছে ভালোবেসেছে হয়তো এখনো বাসে কিন্তু তা প্রকাশ করার আর কোন অপশন নেই। তাই বলে তার এতটুকু অসন্মান ও কখনো করবেনা। ও নিজে যা জানে তা ঠিক কিন্তু বাবা মায়ের সামনে ওকে ছোট করবেনা কখনো।
আনাস কলিংবেল চাপতে রিপা দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলে আনাসকে দেখেই রিপা সালাম দিলো।
আনাস ভিতরে প্রবেশ করতে করতে সালামের জবাব দিয়ে বললো কিরে তুই কখন আসলি?
-বিকালে আসছি খালাম্মা ফোন করে আসতে কইছে।
-ওহ বলে আনাস রুমের দিকে গেলো। আনাস ফ্রেশ হয়ে টেবিলে আসতেই দেখলো ওর মা টেবিলে খাবার নিয়ে বসে আছে।
-কি ব্যাপার মা তুমি এখনো ঘুমাওনি কেন???
-তার আগে বল তুই এতো রাত করে বাসায় ফিরলি কেনো???
-অফিসে কাজ ছিল।
-কাজ ছিল নাকি আমার মুখোমুখি হতে চাইছিস না??
-মা এটা কেমন কথা??
-আমার সব কথা তোর কেমন কথা মনে হলে তুইই বল আসল কথা?
-কি বলবো??
-একদম ভালো মানুষ সাজবিনা আমার সামনে। লামিয়া কেন বাড়ি ছেড়ে গেলো??
-আমি চলে যেতে বলেছি তাই।
-সেটা তো আমিও জানি। কেন যেতে বলেছিস তা বল?
-এতো কিছু বলতে পারবোনা মা। ও আর এ বাড়ীতে আসবেনা মা।
-কিভাবে কথা বলছিস তুই?? কোন কারণ না দেখিয়ে তুই ওকে যেতে বলেছিস কেন??
-কারন আছে বলেই যেতে বলেছি বিনা কারণে নয়।
-কি কারণ খুলে তো বলবি??
-সব কথা সবাইকে বলা যায়না মা। ও আর এ বাড়িতে আসবেনা এটাই শেষ কথা।
-তা বলবি কেন তোরা এখন বড় হয়েছিস নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারছিস আমরা কে?? কত ভালো একটা মেয়েকে তুই হারিয়েছিস আজ না বুঝলেও একদিন ঠিক বুঝবি। কি জবাব দেবো বেয়াই বেয়াইনকে?? কতবড় মুখ করে উনাদের মেয়েকে ভালো রাখবো বলে নিয়ে আসলামআমার বাড়ীতে আর আজ কোন মুখে আমি উনাদের মুখোমুখি হবো?
-মা তোমাকে কেউ বলেছে উনাদের মুখোমুখি হতে। কেউ যাবেনা ওখানে।
-এখন কি তোকে জিজ্ঞেস করে আমাকে সব করতে হবে??
-আমি তা বলিনি। দেখ মা জীবনটা আমার তাই সিদ্ধান্তটা ও আমাকে নিতে দাও। আমার মনে হয়েছে ওর সাথে আমার সংসার জীবনটা ভালো যাবেনা তাই আমি এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।
-কি দোষ করলো মেয়েটা?
-মা একবার বলেছি সব কথা বলা যায়না। এখন তুমি কি আমাকে খেতে দিবে নাকি আমি উঠে যাবো??
-রাশেদা চৌধুরী খাবার গুলো ছেলের সামনে ঠেলে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেলো।
আনাস বিড়বিড় করে বললো,,, ক্ষমা করো মা তোমার সাথে এতো কঠিন আচরণ করার জন্য। কিন্তু মা তুমি যদি ওর ব্যাপারে সব জানতে তাহলে কখনো ওর হয়ে কথা বলতেনা। আমার কষ্ট হয় ওকে ছাড়া থাকতে অনেক কষ্ট হয় কিন্তু ওর করা অপরাধ গুলো আমি মেনে নিতে পারছিনা মা। এখানে থাকলে ওর স্মৃতিগুলো আমায় বড্ড বিরক্ত করবে তাইতো এগুলো বাঁচতে পালিয়ে যাচ্ছি দেশ ছেড়ে।
লামিয়া সোফাতে মাথা নিচু করে বসে আছ। ওর সামনে আনাসের বাবা মা বসে আছে। উনারা আসার পর উনাদের যত্ন আত্তির কোন ত্রুটি রাখেনি লামিয়া। উনারা তো ওর বাবা মায়ের থেকে কখনো কম ছিলনা। কিন্তু ভাগ্য তাকে এইরকম ভালো বাবা মায়ের আদর থেকে আলাদা করে দিয়েছে।
লামিয়ার শাশুড়ি ওকে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে কিন্তু ও নিশ্চুপ বসে আছে। কি বলবে?? কি জবাব দেবার আছে উনাদের কথাগুলোর?? কি করে নিজের ব্যাপারে এই কথা গুলো উনাদের জানাবে কোন মুখে জানাবে। জানালে যে উনারাও উনাদের ছেলের মত ভুল বুঝবেনা তার কি গ্যারান্টি আছে। লামিয়া ওর বাবা মাকে ও নিষেধ করে দিয়েছে উনাদের কিছু জানাতে যা বলার ও নিজে বলবে।
রাশেদা চৌধুরী বললো,,, তুই যখন কিছু বলবিনা বলিসনা। আমি ও জানতে চাইনা। তুই এখন রেডি হবি আমাদের সাথে তুই আজই ঢাকা ফিরে যাবি।
-না মা আমি আর আপনাদের বাড়িতে ফিরতে পারবোনা কোনদিনও না।
-কেন পারবিনা?
-আপনাদের ছেলে আমাকে ভুলে বুঝেছে। আপনার ছেলে চায়না আমি আর উনার সংসারে ফিরে যাই।
-তুই কি সত্যি কখনো ফিরতে চাসনা?
-উনি যদি কখনো আমার সত্যতার প্রমান পেয়ে আমাকে মেনে নেয় আমি সেদিন আবারো যাবো মা কিন্তু এখন না।
-তুই না ফিরলে কখনো কিচ্ছু ঠিক হবেনা। তুই হয়তো জানিস না আনাস আগামী পরশু দিন দেশের বাহিরে চলে যাচ্ছে দু,,বছরের জন্য।
-ওহ।
-তুই এখন আমার সাথে ফিরে যাবি এ কথায় আমার শেষ কথা।
-মা আমার কথাটা তো শুনবেন
-তোর কোন কথা আমি শুনছিনা। যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে…..
চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here