#উপন্যাস
#প্রিয়তমা (২৩তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
আনাসের বাবা মা এইমাত্র বেরিয়ে গেছে লামিয়াদের বাড়ি ছেড়ে। লামিয়াকে ছাড়াই তাদেরকে ফেরত যেতে হয়েছে। লামিয়া যায়নি ও যাবেনা যতদিন না আনাস পুরো সত্যিটা জেনে তাকে নিয়ে যাবে ততদিন ও ওই বাড়িতে যাবেনা। তবে লামিয়া উনাদের আজকেই যেতে দিতে চায়নি এতটা পথ জার্নি করে এসে আবার সেই দিনই ফিরে যাওয়া সেটা উনাদের জন্য কষ্টকর। কিন্তু রাশেদা চৌধুরীর এক কথা ছেলের বউ উনাদের সাথে ফিরে না গেলে এখানে উনাদের থাকার প্রশ্নই আসেনা। লামিয়া নিজেই অনেক কষ্ট পেয়েছে এই রকম ভালো আর স্নেহময়ী দুজন মা বাবার কথা রাখতে না পেরে। কিন্তু কি করবে যার এসে ওকে নিয়ে যাওয়ার সেই যখন আসেনি তখন কি করে ওখানে যাবেও। ভালোবাসি তাকে আর ভালোবাসবো তাকে সারাজীবন কিন্তু তার ভুল না ভাঙলে ফিরে যাবোনা কোনদিন তার জীবনে। ফিরে গেলে আবারো ফিরে আসতে হবেনা তার কি গ্যারান্টি?
রাশেদা চৌধুরী অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এ বাড়ি ছেড়েছে। উনি অনেক বড় আশা নিয়ে এসেছেন ভেবেছিলেন তার বউমা হয়তো তার কথা ফেলতে পারবেনা। কিন্তু তিনি ভুল ভেবেছিলেন এরা দুজন দুজনের জেদের মাঝে অনড় থাকবে কিন্তু কেউ হার স্বীকার করতে রাজি নয়। কিন্তু লামিয়া তো এতো জিদ্দি ছিলোনা তবে কি এমন হলো যে ও সহজ সরল মেয়েটা এতো কঠিন হয়ে গেলো। আর আমার ছেলেটা এতো কঠিন কখনো ছিলোনা তাহলে এমন কি হলো উনি ভেবে পায়না।
উনারা চলে যেতেই লামিয়া মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। মা আমার কেন এত কষ্ট হচ্ছে বলোনা????
আমার বুকের ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে মা!!
কেন এত কষ্ট মানুষের জীবনে???
কেন উনাদের ফিরিয়ে দিলাম আমি??? কেন উনাদের সাথে ফিরে যেতে পারলাম না?? মাকে ছেড়ে দিয়ে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো লামিয়া।
আনাস অফিস থেকে ফিরে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। বাসায় ফিরেছে সে অনেকক্ষণ হলো কিন্তু বাবা মা বাসায় ফিরেনি এখনো। সেই সকালে আনাস ঘুম থেকে উঠার আগেই উনারা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। আনাস ঘুম থেকে উঠে রিপাকে মা বাবা কোথায় গিয়েছে জানতে জিজ্ঞেস করতেই ও জানালো যে সে জানেনা কোথায় গিয়েছে। তবে উনারা বলেছে ফিরতে দেরি হবে।
কিন্তু এখন বাজে রাত সাড়ে আটটা এখনো ফিরছেনা দেখে আনাসের বুঝতে বাকি রইলোনা উনারা কোথায় গিয়েছে। এত করে নিষেধ করেছে যাতে কেউ ওর সাথে যোগাযোগ না করে তারপরও না কেউ শুনবেনা ওর কথা। আমার কথার কি কোন দাম নেই?? আজ আসুক আগে বাসায় উনারা কড়া করে কিছু কথা না শুনালে নয়।
রাত দশটার দিকে আনাসের বাবা মা ফিরে আসলো। আনাসের মন চাইলো একটু কথা শুনাবে কিন্তু উনাদের বিষন্ন চেহারা দেখে ওর বুকের মাঝে কোথাও ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো। মা এসে সোফায় ধপ করে বসে পড়লো।
আনাস মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,,, কেন গিয়েছো ওখানে মা??? আমার কথা যদি শুনে যদি না যেতে তাহলে আজ অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হতোনা।
-তোকে কে বলেছে আমরা অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছি??
-সেটা তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
-বাব্বাহ আমাকে দেখেই তুই বুঝতে পারলি আমি অপমানিত হয়েছি??? ওরা আমাকে অপমান করেনি। আমার কষ্ট হচ্ছে এইজন্য যে আমি আমার একটা মেয়েকে হারিয়ে ফেলেছি হয়তো তাকে আর কখনো ফিরে পাবোনা। একটা কথা মনে রাখিস কখনো কারো চেহারা দেখে তার মনের সম্পর্কে বিবেচনা করা যায়না।
-আনাস মনে মনে বললো,, আসলেই মা কারো চেহারা দেখে তার অন্তরের খবর জানা যায়না আমি সত্যি অনেক বোকা যে বোকামির জন্য আজ এত মাশুল দিতে হচ্ছে।
-ওর মা বললো,,, তোরা কি সত্যি আলাদা হয়ে যাবি??
-এছাড়া আর কি করবো মা??
-আরেকটু ভেবে সিদ্ধান্তটা নিস বাবা। বিয়ে এমন একটা সম্পর্ক যে আজ জেদের বশে একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস কিন্তু একদিন এটার জন্য অনেক অনুশোচনা করবি। বিয়ে নামক সম্পর্ক থেকে একবার আলাদা হয়ে গেলে আর কখনো জোড়া লাগাতে পারবিনা বাবা বলে চোখ মুছে রাশেদা চৌধুরী নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।
-আনাস বললো,,,, মা ওর সাথে সংসার আমার হবেনা। মা পুরো ব্যাপারটা তোমাকে বলতে পারলে আমার ও নিজেকে হালকা লাগতো। এত কষ্টের বোঝা বয়ে বেড়াতে যে আমি আর পারি না। কিন্তু ও ভুল করেছে বলে তো আমি ওকে সবার সামনে ছোট করতে পারিনা ভালোবাসিতো খুব তাই।
তবে এখন হয়তো সম্ভব হবেনা কিন্তু দেশে ফিরে আমি ওকে আমার কাছ থেকে মুক্ত করে দিবো।
আনাস চলে গেছে আজ তিনমাস হলো। আনাস যেদিন চলে গেছো সেদিন ওর মা ফোন করে লামিয়াকে জানিয়েছে নিউজটা। লামিয়ার শরীর দিন দিন ভারি হয়ে আসছে। তার উপর না পারছে ঠিকমতো খেতে আর না পারছে ঘুমাতে। কি কঠিন এক যন্ত্রণার মাঝে দিনগুলো কাটাচ্ছে লামিয়া। মেয়েদের এই সময়টাই হাজবেন্ড সাথে থাকাটা খুব জরুরী ডাক্তার বলে দিয়েছে।
কিন্তু লামিয়ার কি দুর্ভাগ্য আজ এই মুহুর্তে যে মানুষটির ওর পাশে থাকার কথা সেই আজ ওর থেকে যোজন যোজন দূরে শান্তিতে জীবন কাটাচ্ছে। ভুল করেও একবার ওর খোঁজ নেয়নি মানুষটা। এ সময় আমি কেমন আছি একবারো জানার প্রয়োজন করেনি যত যাই হোক তার সন্তান তো এখন আমার গর্ভে আছে।
অবশ্য নিবেইবা কেন আমার খবর??? আমার অসুস্থতার খবর তো আর সে জানেনা লামিয়া বারান্দায় বসে এসব কথা ভাবছে। দিন যত এগুচ্ছে ওর ভয় ততটাই বাড়ছে। রাত হলে নানা রকম দুঃস্বপ্ন চোখে এসে ভর করে।
লামিয়ার এখনো মন বলছে আনাসের ভুলটা ভাঙবে ও ফিরে আসবে আবারো লামিয়ার জীবনে। হয়তো বা কখনো আনাসের নাম্বারটা ফোনের স্কিনে ভেসে উঠবে।
লামিয়া বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,,, আপনি হয়তো জানেন না আমার প্রতিটা মুহুর্ত এখনো আপনাকে নিয়ে আবর্তিত। সারাক্ষণ আপনার সাথে কাটানো সময়গুলো আমার চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু আপনি হয়তো সব ভুলে দিব্যি সুখে আছেন। জানিনা আপনি এত অপমান করার পরও কেন আপনাকে এতটা ভালোবাসি। আপনি জানেন প্রতিটা পূর্নিমার রাতে আমার ইচ্ছে করে আপনার হাত ধরে ছাদে বসে বা রিকশায় চড়ে জোছনা বিলাস করতে সেই রাতের মত। বিয়ের পরে যে রাতে আপনি আমাকে সাথে নিয়ে রিকশায় ঘুরেছিলেন। আপনি হয়তো জানেন না সেই রাতটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা রাত হয়ে আছে। কিন্তু আজ আমার এই অদম্য ইচ্ছাটা হয়তো স্বপ্নকলিই থেকে যাবে কারণ আপনি এখন আমার স্পর্শের বাইরে। আপনার কাছে ভুল না করেও এখন আমি একজন ঘৃণিত মানুষ ছাড়া আর কিচ্ছু না। আপনার স্মৃতিগুলো নিয়ে হয়তো আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।
আচ্ছা আপনি কি আমাদের সন্তান কে আপনার পরিচয় দিবেন নাকি তাকেও আমার মত পর করে দিবেন???
মায়ের ডাকে লামিয়া ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলো।
-কিরে মা তোকে না বলেছি রাত জাগবিনা এত রাত জাগলে তো আরো অসুস্থ হয়ে যাবি।
-আসলে আম্মু ঘুম আসছিল না তো তাই একটু বসেছি।
-সারাক্ষণ এত টেনশন করলে ঘুম আসবে কি করে। তুই যে এতো এতো টেনশন করছিস এটা পরবর্তীতে তোর জন্য অনেক বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তোর গর্ভের বাচ্ছার উপর এগুলো এফেক্ট করবে।
-কি করবো মা ভুলতে ও পারছিনা। ভুলগে গেলেই বেশি করে মনে পড়ে।
-যা এখন ঘুমিয়ে পড় কাল সকালে আবার ডাক্তারের কাছে তোর চেকাপ করাতে যেতে হবে তো।
-যাচ্ছি বলে লামিয়া ধীর পায়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। আজকাল হাটতে চলতে ও অনেক কষ্ট হয় হাত পা সব ফুলে গেছে ব্যাথায় গো মাঝে মাঝে ফ্লোরেও পা রাখতে পারেনা।
আনাসের বাসার বাইরে এক ভদ্রলোক বসে আছে। আনাস সামনে আসতেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে গিয়ে সালাম দিলো। আনাস সালামের জবাব দিয়ে নিজেও সালাম দিলো। তারপর বললো,,,আপনাকে তো চিনতে পারলাম না??
-তুমি আমাকে চিনবে না কিন্তু আমি তোমাকে চিনি বাবা।
-আপনি আমাকে চিনেন?? কিন্তু আমি তো আজকের আগে আপনাকে কখনো দেখেছি বলে মনে হয়না। তা আমার কাছে আপনার কি দরকার??
-অনেক কথা আছে তোমার কি একটু সময় হবে??
-আনাস চিন্তায় পড়ে গেলো বিদেশের মাটিতে একজন অপরিচিত ভদ্রলোক বলছে আমাকে চিনে এখন আবার কি জরুরী কথা বলতে চায় কারণ কি??
-বাবা বেশিক্ষণ না শুধু দশটা মিনিট কথা বলে আমি চলে যাবো। কথা দিচ্ছি আমার দ্বারা তোমার কোন ক্ষতি হবেনা।
-আনাস খানিক ভেবে বললো,,,,আচ্ছা বলুন কি বলবেন?
-কোথাও একটু বসে বললে ভালো হতো। বাসায় বসবে নাকি বাহিরে কোথাও বসবে??
-না না আমার বাসায় আসুন বলে আনাস দরজা খুলে ভদ্রলোককে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো……….
চলবে…….