লামিয়া ভার্সিটি থেকে ফিরে নামাজ আদায় করে শুয়ে পড়েছে। অনেক ক্লান্ত লাগছে। পরীক্ষার ঝামেলায় ঠিক করে এতোদিন ঘুমাতে পারেনি। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বুঝতে পারছেনা ও। কানের কাছে কারো চিৎকারে ঘুম ছুটে গেছে। লামিয়া তড়িগড়ি করে উঠে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো বড় বোন ফারিহা হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
লামিয়া হালকা রাগ দেখিয়ে বললো আপু তোকে কতবার বলেছি ঘুমন্ত অবস্থায় কারো কানের কাছে এভাবে শব্দ করে ডাকবিনা। এতে ব্রেইনে আঘাত লাগে।
-জ্ঞান দিবিনা তো। আমি কি শখ করে তোকে ডেকেছি মহারাণী। আম্মু বলেছে আধাঘন্টার ভিতরে রেডি হতে।
-লামিয়া অবাক হয়ে রেডি হবো? কেন?
-সেকিরে তুই ভুলে গেলি নাকি কাল যে পলির বিয়ে। আজ হলুদ হবে তাই আমরা আজকে যাবো।
-ওহ মনে ছিলনা। কিন্তু আমি তো আম্মুকে বলে দিয়েছি আমি যাবোনা।
-কেন যাবিনা? আমরা সবাই যাবো।
-হ্যা যা। আমি কি তোদের যেতে নিষেধ করেছি?
-তা করবি কেন? তুই কেন যাবিনা সেটা বল?
-বোকার মত এক প্রশ্ন বারবার করবিনা আপু। ভালো করে জানিস আমি এসব অনুষ্ঠানে যাওয়া পছন্দ করিনা। আর ও বাড়িতে ছেলে মেয়ের মাঝে কোন ভেদাভেদ নাই যা প্রকাশ্য হারাম।
-তোর ঢং দেখে বাঁচিনা। খালি নীতিকথা শুনানো। আসছে পর্দাওয়ালী। এই বয়সে একটু ফুর্তি করবি তা না। কিভাবে থাকিস এভাবে? তোর সাথে থাকলে অল্প দিনে আমি পাগল হয়ে যাবো।
-আমার সাথে থাকবি কেন? তোর তো অনেক বন্ধু আছে তাদের সাথে থাকনা।
-হুম আছেতো
-তুই যা তো আপু । দিলি তো মাথাটা ধরিয়ে। প্লিজ ঘুমাতে দে আমায়।
হুম যাচ্ছি যাচ্ছি বলে ফারিহা হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি এরা হচ্ছে সোহান আহমেদ আর জুবাইদা আহমেদের দুই মেয়ে ফারিহা আহমেদ আর লামিয়া আহমেদ। আর দুইবোনের এক ভাই লাবিব আহমেদ। দুই বোনের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ।
ফারিহা যতটা উড়নচণ্ডী আর জেদী লামিয়া ততটাই শান্তশিষ্ট নম্রভাষী একটা মেয়ে।
ফারিহা অনার্স কমপ্লিট করেই বিয়ে করেছে নিজের পছন্দের মানুষকে। কিন্তু শশুড়বাড়ির লোকদের সাথে ওর একটু ও মিল নেই। সমস্যা ওর আধুনিক চলাফেরা। সেই জন্য বাবার বাড়িতে বছরের বেশির ভাগ সময় থাকা হয়। ওর বর পড়েছে বিপদে বেচারা পারছেনা বাবা মা কে কিছু বলতে না পারছে বউকে কিছু বলতে। সারাদিন পার্লার,, বন্ধু -বান্ধব আর আমোদ প্রমোদে ডুবে থাকে।
আর লামিয়া অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ছে ইসলামিক স্ট্যাডিজ নিয়ে। সেই ছোটবেলা থেকে ইসলামের কঠিন অনুরাগী হয়ে গেছে। অবশ্য বাবা ওর অনুপ্রেরণা। সে ছোট থেকে নামাজ রোযা আদায় করে। সাবলিকা হওয়ার পর থেকে পর্দা করা শুরু করেছে। কত ঝড় ঝাপটা তার উপর দিয়ে যাচ্ছে তারপরও তার মধ্যে এতটুকু শিথিলতা দেখা যায়নি।
আল্লাহ বলেছেন,,, হে ঈমানদারগন তোমরা পরিপূর্ণ ভাবে ইসলামে দাখিল হও। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করোনা। কেননা ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় জান্নাতে যাওয়ার সহজ সরল পথ। দুনিয়া ও আখেরাতের মুক্তির পরোয়ানা। তাই লামিয়া ইসলামের নিয়ম কানুন গুলো সঠিকভাবে মেনে চলার চেষ্টা করে।
কিছুক্ষণ পর আম্মু আসলো লামু এই লামু কি বলছিস কি তুই নাকি যাবিনা বিয়েতে?
-যা শুনেছো ঠিক শুনেছো আমি যাবোনা। আর আম্মু তোমাকে বলিনি আমার নামটা বিকৃত করে ডাকবেনা। নাম বিকৃত করে ডাকা কবিরা গুনাহ। এতো সুন্দর করে নাম রেখেছো না সেটাকেও তুমি ছোট করে দিচ্ছো পুরো নাম ধরে ডাকবে।
-আচ্ছা আমার ভুল হয়েছে। এখন যাবিনা কেন সেটা বল।
-মা আজকাল বিয়ে নামের একটা পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে হাসিতামাশা হচ্ছে বিধর্মীদের ধর্মের রীতিনীতি পালন হচ্ছে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা সেগুলো আমার মোটেও পছন্দ নয়। গান বাজনা হচ্ছে। এগুলো সব বিদ’য়াত।
বিয়েতে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হওয়ার কথা । কিন্তু সেখানে এসব নাজায়েজ রীতিনীতির কারণে আল্লাহর গজব পতিত হয়। আর যত মানুষ এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে সবাই গুনাহের ভাগিদার হবে। তাই আমি জেনেশুনে নিজের গুনাহ কামাতে পারবোনা। তোমরা যাও।
-দেখ মা যে যার মত চলছে আমরা তো সবাইকে পরিবর্তন করতে পারবোনা। তাছাড়া সামাজিকতা বলে একটা কথা আছে।
-সামাজিকতা!!! মা সমাজটা আমরা তৈরি করেছি। সামাজিকতার দোহাই দিয়ে সব বিজাতীয় কালচার আমরা আমাদের ধর্মে প্রবেশ করাচ্ছি । মা আমরা ঠিক হলে আমাদের পরিবেশ পাল্টাবে। তুমি নিজেকে দেখনা। আপুকে পেরেছো তুমি ভালো করতে। দিনরাত ওর সংসারে অশান্তি চলছে।কেন জানো তার এই আধুনিকা জীবন যাপনের কারনে। ভালোবেসে বিয়ে করার পরও জামাইর সাথে অশান্তি লেগেই আছে। প্লিজ আমাকে যাওয়ার ব্যাপারে চাপাচাপি করোনা। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।
-তুই ওখানে তোর মতো থাকবি।আর তুই না গেলে তোর খালামণি রাগ করবে।
-মা প্লিজ আমাকে আর বলোনা
-আমি আর পারছিনা তোদের নিয়ে একজন যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে আছে আরেকজন যাবেনা বলে গোঁ ধরে আছে।
-মা আমি তো তোমাদের নিষেধ করছিনা যেতে।
ওদের কথার মাঝে ফারিহা ফোন নিয়ে এসে লামিয়ার দিকে বাড়িয়ে বললো নে খালামণি কথা বলবে তোর সাথে।
লামিয়া ফোনটা কানে নিয়ে বললো আসসালামু আলাইকুম খালামণি। কেমন আছো?
-ওয়ালাইকুম আস সালাম। আমি ভালো আছি।এসব কি শুনছি আমি? আমার ছোট মা নাকি আসবেনা?
-ঠিকই শুনছো খালামণি। প্লিজ জোর করোনা?
-তুই না আসলে আমার কতটা কষ্ট হবে জানিস? আর পলি খুব মন খারাপ করবে।
-খালামণি আমি অন্য কোন সময় যাবো কিন্তু এখন না
-কোন কথা শুনছিনা তুই আসবি কথা ফাইনাল।
-আচ্ছা আজ না আমি কাল বাবা আর ভাইয়ার সাথে আসবো।
-দেখ তুই কেন আসতে চাইছিস না আমি বুঝতে পারছি। তুই তোর মতো থাকবি। আমি সবাইকে বলে দিবো কেউ তোকে কোন কিছুতে জোর করবেনা৷
-তুমি আমার কথাটা….
-কোন কথা শুনছিনা তুই আসবি এটাই আমার কথা। এ বলে খালামণি ফোন কেটে দিল।
লামিয়া ফোন কান থেকে নামিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,,,, হয়েছে তোমাদের শান্তি!!!! সবকিছুতে তোমরা আমাকে বাধ্য করো। আমার নিজের স্বাধীনতা বলতে কিচ্ছু নাই। আমার কবরে তো আমাকে জবাবদিহি করতে হবে তোমরা তখন আসবেনা বলে বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে গেলো।
বিকাল পাঁচটায় ওরা বিয়ে বাড়িতে গেলো। রঙ্গিন আলোকসজ্জায় সারা বাড়ি ভরে আছে। লামিয়া আসার পর থেকে সেই যে রুমে ঢুকেছে আর বেরোয়নি। খালাতো ভাইবোনেরা বারবার হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য জোর করেছে কিন্তু ও যায়নি।
সবাই যখন ছাদে হলুদের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত তখন লামিয়া ওড়না দিয়ে নিজেকে ভালো করে ঢেকে রুম থেকে বের হলো। রুমে একা একা ভালো লাগছিলনা। খালামণিদের বাড়ির পিছনে অনেক বড় ফুলের বাগান। নানা রকমের ফুলে ভরা বাগানটা। সন্ধ্যার পরে বেলি,গন্ধরাজ ফুল ফুটে । সব সাদা ফুল কেন রাতে ফোটে লামিয়া ভাবতে থাকে।তবে বেলি ফুলের ঘ্রাণটা অন্যরকম ভালো লাগে লামিয়ার। তাই লামিয়া সেদিকটায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কেননা বাড়িতে এ জায়গা ছাড়া কোথাও যাওয়ার মত এখন কোন পরিবেশ নাই। ছাদে জোরে জোরে গান বাজছে মানুষের হৈ হুল্লোড় তো আছে। লামিয়া নিজে নিজে বলছে,,, মানুষ কবে যে নিজের ভালো বুঝবে কি দরকার এতো টাকা খরচ করে পাপের বোঝা বাড়ানো। কবে যে আমাদের বোধোদয় হবে। হলুদ পরাবে ভালো কথা তাই বলে এভাবে? আল্লাহ তুমি হেদায়াত দাও আমাদের।
লামিয়া আনমনে হাটছিলো বাগানের মাঝে। কিছুদূর আগাতেই লক্ষ্য করলো সামনে কারো প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। ও জায়গাতে স্থির হয়ে গেলো। এখনতো সবার উপরে থাকার কথা তাহলে এখানে কে?
বোধহয় ফোনে কথা বলছে। আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগয়ে আসছে। লামিয়া যেই দেখলো ওই প্রতিচ্ছবিটা একজন পুরুষ মানুষ। লামিয়া সাথে সাথে ইন্নালিল্লাহ্ বলে মুখ ঢেকে দৌঁড়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো………
চলবে……
#প্রিয়তমা
লেখা:শারমিন মিশু
প্রথম পর্ব