বর্ষা দুপুর (পর্ব-৩) হালিমা রহমান

বর্ষা দুপুর (পর্ব-৩)
হালিমা রহমান

রেদোয়ানের কথায় অবাক হয়ে গেলেন নীরার সেজো চাচি সাহানা। হাতে থাকা চামচটাকে ভাতের হাঁড়িতে সজোরে ছুড়ে ফেললেন।মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,
—” কী কইলা তুমি?”
রেদোয়ান ঘরে ঢুকে ধপ করে ইরার পাশে বসে পরলো।মুখে বললঃ” মানে বললাম যে,আমি তো শুনেছি আপনাদের সময়ে মেয়েরা ফিসফিস করে কথা বলতো। আপনি তো সেদিন বললেন নীরাকে,এখনকার মেয়েরা নাকি চেচিয়ে কথা বলে।কিন্তু,আজ আপনার গলার আওয়াজে আমি ঘরেই টিকতে পারলাম না।দৌড়ে আসতে হলো।আপনিও কী ইদানিং এখনকার মেয়েদের মতো হয়ে যাচ্ছেন নাকি,কাকি?”
রেদোয়ানের কথার ধরনে কুসুম ও নীরা হেসে ফেললো। রুমাও মুখে শাড়ির আঁচল গুজে হাসলো।ইরা ও তোহা কথার মানে বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো সবার দিকে।সাহানা বেগম যেন আর কথাই খুঁজে পেলেন না।কেবল মাথায় আঁচল দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পা বাড়ালেন।রেদোয়ানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রেদোয়ানকে শুনিয়ে শুনিয়েই বললেন—” হতভাগা, মুখপোড়া, শয়তান। ”

রেদোয়ান সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।এমন সময় ঘরে ঢুকলেন নীরার মা জয়নব।বর্তমানে, এবাড়ির বড় বউ তিনি।বাড়ির কর্ত্রীও বটে।মাকে ঢুকতে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল নীরা।ইরাও শান্ত মেয়ের মতো ভাত গুছিয়ে খাওয়া শুরু করলো।রাশভারী এই মানুষটাকে সবাই যেমন ভয় পায়,তেমনি শ্রদ্ধাও করে।জয়নব বেগম, ধীরপায়ে যেয়ে ভাতের হাঁড়ির সামনে পিড়ি পেতে বসলেন।তিনটে প্লেট নিলেন ভাত বাড়ার জন্য।
—” নীরা, কুসুম ভাত খাইতে আসোছ
না কেন?”
—” আসতেসি মেজোমা।”
কুসুম মাদুরের এক অংশে বসলেও নীরা পিড়ি পেতে একটু দূরে বসলো।রেদোয়ানের সামনে বসলে কেমন যেন অস্বস্তি আসে শরীরে।তিনটি প্লেট তিনজনের দিকে এগিয়ে সরঞ্জামাদিও এগিয়ে দিলেন।রুমা তার মেয়েকে খাইয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।পিছন থেকে তাকে ডাক দিলেন জয়নব বেগম।
—” রুমা কই যাও? ভাত খাইবা না?”
—” আপনাগো সাথে খামু ভাবি।ওরা খায়া উঠুক, আমি ততোক্ষণে টুনিরে ঘুম পারায়া আসি।”
—” আচ্ছা, যাও।”
নিশ্চুপে ভাত খাচ্ছে তিনজন।ইরা, তোহা উঠে গেছে অনেক আগেই।রেদোয়ানের আজ খেতে একদম ইচ্ছা হচ্ছে না।জ্বিভ তিতে হয়ে আছে।একটু আগে মাথায় দু- তিন ফোটা বৃষ্টির পানি পরেছিল।রেদোয়ানের আবার বৃষ্টি সয় না।বৃষ্টির পানি শরীরে লাগলেই জ্বর আসে।রেদোয়ান বিরসমুখে দু- তিন লোকমা ভাত গিললো।নাহ, আর সহ্য হচ্ছে না।ভাতের প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়ালো রেদোয়ান।

—” কী হইলো রেদু বাবা? ভাত শেষ করলা না যে?”
—” ভালো লাগছে না খালামনি।মনে হয় জ্বর আসবে।”
ব্যস্ত হয়ে পরলেন জয়নব বেগম।
—” কী কও বাবা,এই সময়ে জ্বর কেন আইবো? শরীর কী বেশি খারাপ লাগতাসে?”
—” ব্যস্ত হবেন না খালামনি,আমি ঠিক আছি।আর জ্বর যদি আসেই, একটা নাপা খেয়ে নেব।
কুসুম, পিটুশকে কি দুপুরে খাবার দিয়েছ?”
কুসুম মাথা নাড়লো দু’দিকে। যার অর্থ, সে দেয়নি।
—” আচ্ছা, আমি দিয়ে দিচ্ছি।আর তোমরা আজকে একটু তাড়াতাড়ি পড়তে এসো।ঠিকাছে?”
কুসুম কিছু বলার আগেই জয়নব বেগম বললেনঃ” আজকে পড়ানো লাগবোনা। তুমি যায়া ঘুমায়া থাক।”
সন্তুষ্টির হাসি হাসলো রেদোয়ান। এই মানুষটা তাকে এতো ভালোবাসে কেন?
— ” তোমার ছেলে এতোটাও অসুস্থ হয়নি খালামনি।ওদেরকে আমি পড়াতে পারব।”

রেদোয়ান এবাড়ির আপন কেউ না।নীরার কেমন যেন লতায়- পাতায় ভাই হয় সে।খুব ছোট বেলায় রেদোয়ানের বাবা- মা মারা গেছে।তারপর থেকে সে চাচা- চাচির কাছে থাকতো সিলেটে।ভালোই ছিল সেখানে।বেশ কয়েকবছর পর তার চাচা-চাচি সিদ্ধান্ত নেয় তারা আর এই নোংরা দেশে থাকবে না।রেদোয়ানের চাচাতো ভাই ইতালিতে ও চাচাতো বোন আমেরিকায় থাকে।তার চাচা- চাচি মনস্থির করে ইতালিতেই সেটেল হবেন দু- জনে।যেই ভাবা সেই কাজ।রেদোয়ানের বয়স তখন বোধহয় সতেরো। তাকে হোস্টেলে রেখেই তার চাচা- চাচি পাড়ি জমায় ইতালিতে।মাসে মাসে রেদোয়ানের জন্য টাকা পাঠাতো তার চাচা।এইভাবেই চলে গেছে এতোগুলো বছর।রেদোয়ানের পড়ালেখা শেষ হয়েছে,চাকরির প্রস্তুতি নিয়েছে।যেই না চাকরি যুদ্ধে নামবে,তখনি দেশে আসলো করোনা।ঘরে ঘরে মৃত্যু, বাইরে লকডাউন।হাতে থাকা টিউশনিগুলো সব ছুটে গেল।বিশ্বে ইতালির অবস্থা তখন ভয়াবহ।প্রতিদিন মৃত্যু দেখতে দেখতে জমে গেছে তারা।ইতালি থেকে টাকা আসা বন্ধ হয়ে গেল।রেদোয়ানের তখন কঠিন অবস্থা।পকেটে টাকা নেই,হাতে কাজ নেই।সবশেষে উপায়ান্তর না পেয়ে গ্রামের জায়গাগুলো বেচার সিদ্ধান্ত নিলো।দলিলপত্র হাতে নিয়ে বহুকষ্টে চলে এলো গ্রামের বাড়ি।গ্রামে আপন বলতে নীরার পরিবার ছাড়া বিশেষ কেউ নেই।এখানেই এসে উঠে রেদোয়ান।বেশ যত্ন- আত্তি করে সবাই।একসময় জয়নব বেগম জানতে পারেন রেদোয়ানের গ্রামে আসার কারণ।তিনি নিষেধ করেন যাতে কিছুতেই জায়গাটুকু না বেচে রেদোয়ান।বাবা – মায়ের স্মৃতি বলতে রেদোয়ানের ঝুলিতে এতুটুকুই তো আছে।নীরার বাবাও নিষেধ করেন।রেদোয়ান নিজেও চিন্তা করে, সত্যিই তো এইটুকু ছাড়া তার আর কিইবা আছে।পরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। রেদোয়ান চলে যেতে চাইলেও তাকে কিছুতেই ছাড়েন নি জয়নব বেগম।মা- বাপ ছাড়া কোথায় কি খাবে ছেলেটা, কে জানে! রেদোয়ান আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পরে এ সংসারে।এবাড়ির সব মেয়েদের ওই পড়ায়।কয়েক জায়গায় অনলাইনে সিভি জমা দিয়েছে।যদি একটা চাকরি হয়।একটু- আকটু ফ্রিল্যান্সিংও করছে।অন্যের বাসায় থাকা সম্ভব কিন্তু অন্যের টাকায় পকেট চালানো তো আর সম্ভব নয়।

***

নীরা ব্যাগ কাঁধে যখন রেদোয়ানের ঘরে ঢুকেছে তখন রেদোয়ান চশমা চোখে দিয়ে ল্যাপটপে কি যেন করছে।নীরা ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নিলো।একটা বিছানা, একটা টেবিল,দুটো চেয়ার ও একটা সেগুন কাঠের আলনা।এই ঘরের আসবাব।ঘরের জিনিসগুলো এতো গোছানো, যা দেখে মাঝে মাঝে নীরা নিজেই অবাক হয়। পুরুষ মানুষ এতো গোছানো হয়! রেদোয়ান বাহাতি।খাওয়া বাদে বাকি সব কাজই সে বা হাত দিয়ে করে।
—” আজ কি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?”
লজ্জা পেলো নীরা।তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে সালাম দিলো রেদোয়ানকে।
সালামের উত্তর নিয়ে রেদোয়ান জিজ্ঞেস করলো কুসুমের কথা।
— ” ও দশ মিনিট পরে আসবে ভাইয়া।”
—” ঠিকাছে।তাহলে বসো তুমি। এই দশ মিনিট আমরা বইয়ের বাইরে কথা বলি।লাস্ট যেই বইটা দিয়েছিলাম,সেটা পড়েছ?
—” দেনা- পাওনা বইয়ের কথা বলছেন তো? পড়েছি।”
—” কেমন লাগলো?”
—” খুব ভালো একটা বই।দারুন লেগেছে।”
— “কোন চরিত্রটা বেশি ভালো লেগেছে?”
—” ষোড়শী। উফ! কী সুন্দর জীবানান্দের সব কথায় ঠাস ঠাস উত্তর দেয়।”
—” জীবানান্দকে ভালো লাগেনি?”
—” একটু একটু ভালো লেগেছে।ব্যাটা কী বজ্জাতিটাই না করলো প্রথমে।তবে ওর একটা কথা খুব ভালো লেগেছে।”
—” কোনটা?”
—” ওই যে, মাঝরাতে ষোরশীর ঘরে বসে যে বলে,
যত্ন জিনিসটায় মিষ্টি আছে সত্যি
কিন্তু তার ভান করায় না আছে মধু না আছে স্বাদ।”

***

সন্ধ্যা নামবে বোধহয় কিছুক্ষণের মাঝেই।আকাশ আবার কালো হয়ে এসেছে।বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা আছে।নীরা, ইরাকে বগলদাবা করে ছুঁটছে পুকুরের দিকে।সেদিকে একটা জাম গাছ আছে।হঠাৎ করেই জাম খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইরাতো কিছুতেই যাবে না। সে হাঁড়ি- পাতিল খেলতে বসেছিল।নীরা অনেক্ষণ তেল মেখে নিয়ে এসেছে তাকে।অবশ্য,সাথে করে লবন নিয়েছে সেই নাম পুরুষের কথামতো।বলাতো যায় না,বর্ষার দিন।যদি জোকে ধরে।নীরা বাইরে বেড়িয়ে দেখলো রেদোয়ান পিটুশকে কথা শিখাচ্ছে।বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢুকছে ইশরাক।তার সারা শার্ট- প্যান্টে কাদার ছড়াছড়ি। ইশরাককে সবার প্রথমে ইরাই দেখলো।সে দৌড়ে গেল বড় ভাইয়ের দিকে।
—” কী হইসে ভাইয়া তোমার?”
—” আর বলিস না বোন, আসার সময় পিচ্ছিল কাদায় পরে এই অবস্থা।”
ইশরাকের কথা শুনে এগিয়ে এলো রেদোয়ান ও নীরা।রেদোয়ান উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলোঃ” বেশি ব্যাথা পেয়েছেন নাকি ভাইয়া?”
—” নারে ভাই।আল্লাহ বাঁচাইসে।মনে হয় হাঁটুর দিকটা একটু ছিলে গেছে।”
ইশরাক নীরার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলোঃ” কোথাও যাচ্ছিস তুই?”
—” হ্যাঁ, ভাইয়া।পুকুর পাড়ে যাব একটু।তোমার শার্টটা দেও,ধুয়ে দেই।”
— “পারবি তুই?”
—” হুম,পারব।”
ইশরাক শার্ট খুলতে খুলতে বললো —” কুসুম কই?”
—” কোথায় থাকে এইসময়?”
—” আশ্চর্য! এই বৃষ্টির দিনে কী করতে গেছে সেখানে? তুই নিষেধ করিসনি?”
—” আমার নিষেধ ও শোনে নাকি? তুমি একটু ধমক দিয়ো ওরে।”
ইশরাক নীরার হাতে শার্ট ধরিয়ে দিয়ে বললঃ” সাবধানে পা ফেলিস।আর ধুতে না পারলে ধোয়ার দরকার নেই।”

নীরাদের পুকুর পাড়ের শেষ প্রান্তে অনেক সুপারি গাছ।সুপারি গাছের ওইপাশেই বড় রাস্তা।পুকুর পাড়ের উত্তরদিকে নীরাদের পারিবারিক কবরস্থান।পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়েই বড় রাস্তার পথচারী দেখা যায়।নীরা ঘাটের শেষ সিঁড়িতে বসে শার্ট ধোয়ার কাজে লেগে গেল।কিছুক্ষণ পরেই, কেমন অস্বস্তি লাগা শুরু করলো নীরার।তার মনে হচ্ছে কেউ তাকে দেখছে।নীরা কাজ থামিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখলো আশেপাশে।নাহ,কেউ নেই।মনের ভুল ভেবে আবারো কাজে হাত দিলো নীরা।
নীরা যদি ভালোভাবে খেয়াল করতো তবে দেখতে পেত, কেউ একজন দু- চোখ ভরে দেখছে তাকে।শেষ বিকেলের নরম আলোয় সেই চোখজোড়ায় জড়িয়ে আছে,অসাধারণ মুগ্ধতা।।
( চলবে)

(বি.দ্রঃ ভুল- ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। ” দেনা-পাওনা ” উপন্যাসটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের।)
আগের পর্বের লিংকঃ
https://m.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/1037271620411667/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here