বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :১৩

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :১৩

মালিহা খানম ঘরের একপাশ থেকে অন্যপাশে জুরে পায়চারী করছে।কোনভাবেই নিজেকে ক্ষান্ত করতে পারছে না।মাথা চিন্তায় ফেটে যাচ্ছে।আশরাফ খাঁন স্ত্রীকে উত্তেজিত দেখে বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারল না।ভারী শব্দ করে বলল,”কিছু করার নেই।বিয়েটা হবেই! ”
মালিহা খানম থামল । উত্তেজিত স্বরে বলল ,”জেনে শুনে মেয়েটাকে আগুনে ফেলবো? নিজেদের স্বার্থে নিষ্পাপ মেয়েটার বলি দিবো! ”
“আর কোন উপায় আছে কি? প্রথমত ফ্যামিলি রেপুটেশন দ্বিতীয়ত আরহাম আজ নয় কাল ঠিক মেয়েটাকে নিজের পিঞ্জিরায় বদ্ধ করবে।তাকে আটকানোর মত সাধ্যি কার? ”
মালিহা কোণঠাসা হয়ে ধপ করে বিছানায় বসল।
“মেয়েটার নিষ্পাপ মুখ দেখলে বড্ড মায়া হয়। জেনেশুনে এমন ফুলের মত ফুটফুটে মেয়েটার উপর কিভাবে এমন অন্যায় করি? বিবেকে বাঁধে যে! ”
মালিহা ভরা চোখে বলল।আশরাফ খাঁন ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলে,”এসব নিয়ে এতো ভেবো না। যা ঘটবার তা ঘটবে- ই ”
মালিহা শান্ত স্বামীর সামনে শান্ত হলেও ।ক্ষান্ত হলো না।

সকাল গড়িয়ে দুপুরে এসে ঠেকল।সারা বাড়ী জুরে পিনপতন নীরবতা।আরহাম জানালার পাশে রকিং চেয়ারে দুলছে ।বাহিরে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি চলছে।সূর্যিমামা ধীরেধীরে নিস্তেজ হয়ে পরছে। বারান্দার মেজে মাড়িয়ে আস্তে আস্তে পশ্চিমা আকাশের বুকে হেলে পড়ছে ।আরহামের নিদ্রাতুর চোখজোড়া বুঝে বুঝে আসছে।এমন সময়ই দরজার কড়া নড়ে ,ঘুম ঘুম নিদ্রালস চোখজোড়া খুলে দরজার দিকে তাকায়।জড়সড় ভাবে সেহের দাড়িয়ে। আরহাম আবারো চোখ বুঝে রকিং চেয়ারে গাঁ এলিয়ে দেয়। গম্ভীর স্বরে বলে ,”ভিতরে আসো ”
সেহের ছোট ছোট পা ফেলে কাচুমাচু ভঙ্গিতে আরহামের সামনে দাড়ায়।বেশ কিছুক্ষণ সেহেরের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আরহাম আগের মত গম্ভীর স্বর টেনে বলে,”কিছু বলবে? ”
“জি ,কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল”
আরহাম চুপ।সেহের থেমে আবার বলল,”এখানে না বাহিরে কোথাও।আপনার কাছে সময় হবে ? ”
্কথাটা বলে ভীতু ভীতু চোখে আরহামের দিকে তাকাল।দুলতে থাকা রকিং চেয়ার থামল।আরহাম পূর্ন চোখে সেহেরের দিকে তাকাল।কিছু একটা ভেবে বলল,”কোথায় যেতে চাও ”
সেহের নত মাথায় উত্তর দিলো ,”আপনার সুবিধা মত কোথাও ”
“রেডি থেকো,বিকালে বের হবো! ”
আরহাম গাঢ় স্বরে বলল।সেহের হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সেহের রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

লাল সূর্যটা পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।প্রকৃতি ধীরেধীরে উষ্ণ রূপ নিচ্ছে।নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা।নদীর জলরাশি থৈথৈ কাঁপছে । ঢেউ গুলো অদ্ভুত সুন্দর সুর তুলছে ।বেনামী হাওয়াগুলো কানেকানে কিছু একটা বলছে।নদীর পাড়ে গড়ে উঠা প্রকৃতির সৌন্দর্যে ভরা রেস্টুরেন্টটা ভীষণ মন মাতানো ।অন্য কোন সময় হলে সেহের নিজেকে এই প্রকৃতির মাঝে ডুবিয়ে দিতো ,কিন্তু এই মুহূর্তে সেই মেজাজে নেই।সামনে বসে থাকা মানুষটার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে।আসার পর থেকে ফোন নিয়ে ব্যস্ত ,সেহেরের কোন কথা আদৌ কি তার কান অবধি পৌঁছাচ্ছে? সেহেরের ধারণা ‘না’
মুখ দেখে মনে হচ্ছে উনাকে গলায় ছুড়ি ধরে নিয়ে আসা হয়েছে।পেঁচা মুখ করে রেখেছে । অবশ্য উনাকে দোষ দিয়ে কি লাভ? সেহেরের নিজেরও এই মানুষটাকে ভীষণ অপছন্দ । আজ বিপদে হাত পা বাঁধা বলেই উনার সাথে এখানে আসা। না হয় কোন দিন আসতো নাহ! বাড়ীতে কথা বলার কোন সুযোগ নেই।মা বুঝতে পারলে ঝামেলা করবে। আবারো ইমোশনাল ব্লাকমেইল শুরু করবে!
সেহের গলা ঝেড়ে বলল ,”সরি ,আমি এই বিয়েটা করতে পারবো না,আগামীকাল চিটাগাং ফিরে যাচ্ছি ”
কথাটা শোনা মাত্র আরহাম ফোন থেকে চোখ সরিয়ে সেহেরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। ধপ করে ফোনটা সাইডে রেখে সেহেরের দিকে ঝুকে কাঠকাঠ স্বরে বলল ,”তা কেন? ”
“আমার আপনাকে পছন্দ নাহ”
“কারণ? ”
“আপনার ব্যক্তিত্ব প্রফেশন আমার অপছন্দ ! ”
“আমার টাকাপয়সা অর্থসম্পদ ক্ষমতা কোন জিনিসটার অভাব? তোমার কি চাই?”
সেহের তাচ্ছল্য হেসে বলল,”আমার আপনার টাকাপয়সা অর্থসম্পদ ক্ষমতা কোনটাই চাই না ।আপনার কাছে বিয়েটা ছেলেখেলা হলেও আমার কাছে এই বন্ধনটার মূল্য অনেক । ”
“তো তোমার কি পছন্দ? শুনি! ”
সেহের নদীর জলরাশির দিকে এক পলক তাকাল। ছোট একটা শ্বাস নিয়ে আরহামের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল,”এমন ক্ষমতা বিলাসবহুল জীবন আমার চাই না। সাধারণ জীবন চাই।নিজের ছোট্ট একটা পরিবার । টানাপোড়নের ভালোবাসাপূর্ন সাজানো সংসার ।যেখানে টাকার কমতি হলেও ভালোবাসার কোন কমতি থাকবে না।যেখানে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যাবে। কারো বুকে মাথা রেখে দূর সন্ধ্যায় আকাশে জ্বলতে থাকা মিটিমিটি তারা গুনা যাবে।যার চোখে চোখ রেখে বুকের গভীরতা মাপা যাবে। এমন কাউকে আমার চাই! ”
সেহেরের কথা শেষ হতেই আরহাম হেসে উঠলো ।হাসিটায় কোন আনন্দ নেই, থমথমে আনন্দহীন হাসি! সেহের কিছুটা ঘাবড়ে যায়।আরহাম ঠোঁটের কোণায় হাসি রেখে বলল,”জীবন কোন রূপকথা নয়।তুমি যেভাবে বলছো তা কেবল রূপকথাতে সম্ভব।অবশ্য এতে তোমার কোন দোষ নেই ,দোষ তোমার বয়সের। বয়স অল্প অনুভূতি বেশি ।”
“অন্তত আমি যা ,তাই প্রকাশ করি আপনাদের মত তো নয়!,মুখে এক মনে আরেক! ”
আরহাম ক্ষেপল।ভীষণরকম ক্ষেপল। এতক্ষণ নিজের ক্রোধ সংযত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। কিন্তু মেয়েটা তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে । এতো অপছন্দ ,এতো ঘৃণা কেন? আরহাম সেহেরের হাত টেনে কাছে টানল । দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”শোন মেয়ে,তুমি রাজি থাকো আর না থাক বিয়ে তো তুমি আমাকেই করতে । কি ভেবেছ তুমি বিয়ের জন্য মানা করবে আর আমি খুশি খুশি মেনে নিবো? উহু। ”
সেহের ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,”কি করবেন আপনি? ”
“তোমার বাবার হোটেল প্রজেক্ট তাই না? বেশি কিছু না তোমার বাবাকে পথে নামাবো আর তোমার পরিচয় মিডিয়ার সামনে আসলে মায়ের ক্যারিয়ার এমনি এমনি শেষ হবে! সিদ্ধান্ত তোমার তুমি কি চাও! তোমার একটা ‘ হ্যা ‘ ‘না ‘সবকিছু গড়তে ভাঙতে যথেষ্ট ।জানি তোমার বাবা মায়ের তোমাকে নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই! কিন্তু উনাদেরকে নিয়ে তোমার তো আছে ।”
আরহামের দিকে কিছুক্ষণ ঘৃনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সেহের মুখ খুলল,”আপনার মত নিকৃষ্ট মানুষ আমি আমার পুরো জীবনে দেখিনি ।ঘৃণা করি আপনাকে! ”
“ডোন্ট ওয়ারী এখন থেকে রোজ দেখবে।খুব তাড়াতাড়ি আমার প্রেমেও পড়বে। ”
“ইন ইউর ড্রিম ”
আরহাম বাঁকা হাসল।

দিনের আলো কাটিয়ে ঘন কালো রাত নামছে। চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে। গাড়ী নিজ গতিতে চলছে । সেহের জানালার দিক ফিরে অশ্রুবিসর্জন দিচ্ছে।মাঝে মাঝে বুক চিড়ে কান্নার হুহু শব্দ বেরিয়ে আসছে।অন্ধকার রাস্তায় গাড়ী থামল।চারদিকে নিরিবিলি নির্জন পরিবেশ।মানুষজন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।দূর থেকে নদীর কলকল শব্দ ভেসে আসছে। ভয়ে সেহেরের কান্না থামল।গাড়ী এখানে থামল কেন? আরহাম তার খুন টুন করে পানিতে ভাসাবে কি?সেহের ভীতু ভীতু চোখে একবার আরহামে দিকে তাকায়।চেহারা দেখে মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে গিলে খাবে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিলো ।হুট করে আরহাম গাড়ীর লাইট বন্ধ করল।দূর আকাশের চাঁদের চাঁদনীতে ভুবন আলোকিত । গাড়ীটাও নিভু নিভু আলো ছড়িয়ে।সেহের কাচুমাচু হয়ে গাড়ীর জানালার সাথে লেগে বসে।আচমকা আরহাম সেহেরকে নিজের দিকে টানল। সেহের ভয়ে চোখমুখ আরো শক্ত করে চাপল।গাড়ী জুড়ে সেহেরের ভারী ভারী নিশ্বাসের আনাগোনা চলছে।আরহাম সেহেরের মুখখানা দু’হাতের তালুতে নিয়ে নিলো ।বেশ আলতো ভাবে ধরে।গভীর চোখে সেহেরের দিকে তাকিয়ে ।এই অল্পসময়ে কান্নাকাটি করে চোখ মুখের কি হাল করে ফেলেছে! চেহারা লাল হয়ে আছে।ফোলা ফোলা চোখজোড়া বুঝে।সেহের চোখ বুঝেও অনুভব করতে পারছে আরহাম তার দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে।খানিক বাদে টের পেল কপালের সাথে আরহামের কপাল মিশে।উষ্ণ ভারী ভারী নিশ্বাস গুলো আছড়ে মুখের উপর পড়ছে ।খানিকের জন্য সেহে্রের মাথা ভাবনা শূন্য হয়ে যায়। ভয় ঘৃণা কোনটাই অনুভব হলো না।

“এতো কান্নাকাটির কি আছে! বিয়ে করবে যুদ্ধ নয় ।এসব কান্নাকাটি ছেড়ে নিজেকে আমার জন্য প্রস্তুত করো।বিয়ের হাতে গুনা কয়েকটা দিন বাকি। আই নিড ইউ! কেন বুঝনা ?”

কঠিন কথা গুলো আরহাম খুব সহজভাবে বলল।অদ্ভুত এক অনুভূতিতে মন ছুঁয়ে গেল । কথার ভাজে কিছু একটা ছিল। কোন অজানা নেশা বা ঘোর!

সেই সন্ধ্যার পর সেহের নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে বন্ধী করে রাখে।চিটাগাং বাবার কাছে আর যাওয়া হলো না।আরহাম বাড়ী থেকে বের হওয়ার সম্পূর্ন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে । বিয়ের খবর সেহেরের বাবার কান অবধি পৌঁছালে , মেয়ের বিয়ে তাকে ছাড়াই ঠিক করল ? প্রথমদিকে এসব ভেবে ভীষণ রেগে যায়।পরে ধীরে ধীরে সব কিছু স্বাভাবিক হয়।বিয়ের আর মাত্র দু’দিন বাকি। সেহের ঘরকুনো হয়ে রুমের এক কোণে পরে থাকে। খাওয়া ,নাওয়া ঘুম সব ছেড়েছে । বিয়ে নিয়ে তার কোনরকম মাথা ব্যথা নেই।আরহামের প্রতি চরম ঘৃণার আগুনটা শীতল বরফ খন্ডে পরিণত হয়ে গেছে। এখন আর কোন কিছু অনুভব হয় না । কারো প্রতি কোন অভিযোগ হয় না।সেহের পাথরের পুতুল হয়ে গেছে।বিকালে সেহের বারান্দা ছিলো এমন সময় পিছনে কারো উপস্থিতি টের পায়।মাথা ঘুরাতে মালিহা খানমকে দেখতে পায়।চেহারা জুরে ভয় আর অস্থিরতা । সেহের কিছু জিগ্যেস করার পূর্বেই মালিহা খানম সেহেরের দিকে দু কদম এগিয়ে এসে।কাঁপা কাঁপা হাতে সেহেরের হাত ধরে।চাপা ভীতু থতমত স্বরে বলে,”এখান থেকে পালিয়ে যাও । বের হতে আমি তোমার সাহায্য করবো । তুমি এই বিয়ে করো না । পালিয়ে যাও! ”
সেহের মালিহা খানমের দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল।

চলবে….❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here