বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :১৪
সন্ধ্যার পর বাড়ীতে হৈচৈ পড়ল ,সেহের বাড়ী থেকে পালিয়েছে।আকাশ চুম্বী রাগ নিয়ে আরহাম মিনিট দশেকের ভেতর বাড়ী ফিরে ।সেহেরকে খুঁজতে পুরো শহরে গার্ড বিছিয়ে দিয়েছে ।তন্ন তন্ন করে খোঁজা হচ্ছে।উপরের রুম থেকে ভাঙচুরে বিকট শব্দে দেয়াল গুলো থর থর কাঁপছে ।বাড়ী সবাই জড়সড় ভাবে নিচতলায় দাড়িয়ে। আরহামের রাগ সম্পর্কে সবার ধারণা আছে ।এই মুহূর্তে আরহামের সামনে দাড়ান মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা ।
কে চায় যেচে যেয়ে ভয়ংকর রাগের সম্মখীন হতে?
দিশা ভীতু চোখে বারবার উপরের দিকে তাকাচ্ছে,ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে।সেহের কি করে বাড়ী ছেড়ে যেতে পারে? একবারো কি মায়ের কথা ভাবল না! আর এখান থেকে কি করে বের হলো? এই কড়া পাহারার চোখ ফাঁকি দেওয়া তো চারটে খানিক কথা না । কারো সাহায্য ছাড়া তো একদম অসম্ভব! তবে সেহেরের পালানোর পেছনে কি বাড়ীর কারো হাত আছে? দিশা সন্দিহান চোখে হল ঘরটায় চোখ বুলায়। সেহেরকে পালাতে কে সাহায্য করবে? লিয়া!
এমন সময়ই উপরের রুম থেকে ভারী কাঁচের কিছু ভাঙার বিকট শব্দ দিশার ধ্যান ভাঙল । ভয়ে কেঁপে উঠে ,নিশ্চিত রুমের টি- টেবিলটা ভেঙেছে।আরহামের সামনে যেতে সাহস হচ্ছে না। যা বেপরোয়া মেজাজের।
অনেকটা সময় কেটে গেছে।উপর ঘর থেকে কোন সাড়াশব্দ মিলছে না।আরহাম হয়তো কিছুটা ক্ষান্ত হয়েছে।দিশা ভীতু ভীতু পায়ে সিড়ির দিকে যায়।দোতলার শেষ সিড়িতে পা রেখে আতকে উঠে। এই কি হাল ? পুরো দোতলা চূর্ণবিচূর্ণ জিনিশপত্র ভরতি।কোন কিছু ঠিকঠাক অবশিষ্ট আছে কি না সন্দেহ।আরহামের রুমের দিকে পা বাড়াতে রাগে ফোঁসফোঁস শব্দ শুনতে পায়।জড়সড় ভাবে দরজার সামনে দাড়িয়ে দিশা ধীর স্বরে বলল,”আমি সত্যি কিছু জানিনা । সেহের বাড়ী থেকে পালাবে জানলে কোনদিন তাকে একা ছাড়তাম না।মেয়েটা কোথায় আছে…কি করছে কে জানে…আমার খুব চিন্তা …”
আরহামের রক্তিম চোখের চাহনি দেখে দিশা থেমে গেল। পুরো কথা শেষ করার আর সাহস হল না।আরহাম দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে কতটা চিন্তিত তা আমার জানা আছে।অন্তত আমার সামনে মমতাময়ী মা হবার অভিনয় করবেন না।নিউজ পেপারে ছবি থেকে শুরু করে ইন্টারনেটে ভিডিও ভাইরাল অবধি সবটার পেছনে যে আপনি আছেন ।আমি জানিনা?
শুধু সেহেরের কথা ভেবে ক্ষান্ত ছিলাম। তাছাড়া সেহেরকে আমার চাই ,একান্ত নিজের করে চাই।বিয়ের পর আপনাদের কারো সাথে সেহেরের কোনপ্রকার সম্পর্ক থাকবে না।….ফাস্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নিং আমার সেহের থেকে দূরে থাকবেন ।”
আরহামের কথায় দিশা মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেল।এই ছেলে কি চায়? সেহের তার মেয়ে ।মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে? দিশা ভুল করেনি । সে যা করেছে সেহেরের সোনালি ভবিষ্যৎ- এর কথা ভেবে করেছে।
আরহাম মাথা চেপে ধপ করে এলোমেলো বিছানায় বসে পরে ।সেহের কোথায় যেতে পারে? কার কাছে? কারো সাহায্য ছাড়া গার্ডদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সম্ভব বের হওয়া সম্ভব না।কে সাহায্য করেছে? কে?
উফফ! অসহ্য মাথা যন্ত্রণা করছে।সবকিছু কেমন জানো গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথাটা ভার ভার হয়ে যাচ্ছে।শরীর থেকে যেন সে আলাদা হয়ে যাচ্ছে।আরহাম নিচের দিকে ঝুকে মাথা চেপে বসে থাকে।
মালিহা খানম ভয়ে ছটফট করছে।সারারুম জুরে পায়চারি চলছে।মেয়েটাকে বাড়ী থেকে তো বের করল ,কিন্তু মেয়েটা কোথায় ,কিভাবে আছে ,কে জানে? ঠিকঠাক ট্রেনে উঠে সিলেটে পৌঁছাতে পারবে তো!
নানা চিন্তায় মাথা ভার হয়ে আছে। মালিহা খানম বোনের বাড়ীর ঠিকানা দিয়েছে।বোনকে ফোন করে আগেই জানিয়েছে ।স্টেশন থেকে রিসিভ করে বাড়ী অবধি নিয়ে যাবে । সেখানে মেয়েটার যত্নআত্তির কোন কমতি হবে না!
মায়ার জালে আটকে মেয়েটাকে বাড়ী থেকে তো বের করেছে। এখন বাড়ীতে কি করে সামাল দিবে? আরহামকে কি করে সামলাবে? সামান্য টের পেলেই পুরো বাড়ী তোলপাড় করে ফেলবে ।চিন্তামগ্ন হয়ে বিছানায় বসে পরে।আচমকা দরজা খোলার বিকট শব্দ হয়।মালিহা খানম ছিটকে দরজার দিকে তাকায়।এলোমেলো বেশভূষায় আরহাম দাড়িয়ে।কঠিন মুখখানায় হিংস্রতার চাপ ।বাদামী চোখের মণিটা রক্তিম হয়ে আছে।অগোছালো চুল গুলো চোখ ছুঁই ছুঁই।মালিহার বুঝতে বাকি রইল না আরহামের মাঝে অন্য স্বত্বাটা জেগে উঠেছে ।এটা আরহাম না অন্য কেউ।হিংস্রতা কঠোরতা যার পরিচয়।মালিহা ছোট ঢোক গিলল।নিজের ভয়কে সংযত রাখার চেষ্টা করল।আরহাম রক্তিম ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ,বলল “সেহের কে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ? ”
মালিহা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে।হাসার চেষ্টা করে বলল ,”কি বলছ? আমি কেন লুকাতে যাবো? ”
“তো সত্যিটা বলবে না? ”
মালিহা চুপ।আরহাম জেকেটের ভেতর থেকে গান বের করে মালিহার দিকে তাক করল।মালিহা ভয় পেল কিন্তু মুখে প্রকাশ করল না ।তাচ্ছল্য স্বরে বলল ,”এখন তুমি আমাকে মারবে? তোমার দাদীজান কে ? ”
” তুমি আরহামের দাদীজান ,আমার না! তাছাড়া আমি তোমাকে মারবো না।জানি তোমার মৃত্যু ভয় নেই।তোমার কলিজার খন্ড আরহামকে মারবো ।”
বলেই আরহাম নিজের মাথায় গান পয়েন্ট করে। মালিহা আর্তনাদ ভারী চিৎকার দিয়ে বলে,”নাহ! তুমি এমন করতে পারো না।আরহামকে মারলে ,তার সাথে তোমার অস্তিত্বও বিলীন হবে।”
আরহাম আনন্দহীন বাঁকা হাসল,”এমনিতেও সেহেরকে ছাড়া আমি অস্তিত্বহীন।আমি আমার সেহেরকে চাই! সেহের বিহীন আমার কিছু চাই না।”
মালিহা আকুতি ভরা স্বরে বলল,”নিষ্পাপ মেয়েটাকে যেতে দেও! ”
আরহাম শব্দ করে ভয়ানক ভাবে হাসল।কয়েক সেকেন্ড পর হাসি হুট করে থেমে গেল।মুখে কঠিন ভাব ফুটিয়ে বলল,”তুমি বলবে? নাকি আরহামকে শুট করবো? ”
“না না এমন করবে না ,প্লিজ “মালিহা আকুতি ভরা স্বরে কেঁদে উঠে।কান্নার সুর টেনে বলে,”সেহের রেলস্টেশনে ,সিলেটের উদ্দেশ্য রওনা দিবে! ”
মুহূর্তেই আরহামের মুখে অদ্ভুত এক হিংস্র হাসি ফুটে উঠে।চেহারায় কেমন জানো আতংক ভারী চমক।অদ্ভুত পাগলামো।আরহাম মুখে সেই অদ্ভুত হাসি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। যেন সে মহা খুশি!
মালিহা আরহামের যাওয়ার দিকে ভীতু চোখে তাকিয়ে থাকে না জানি মেয়েটার সাথে কি হবে! আর কত বছর এসব চলবে? আরহাম কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে? কবে? না এভাবে হাতে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। মালিহা চোখ মুখ মুছে ডক্টর রেজাকে ফোন করল।
ব্যস্ত রেলস্টেশনের খালি বেঞ্চটার এক কোণায় চোখ মুখ ডেকে মোটা কালো চাদরে জড়িয়ে সেহের গুটিসুটি মেরে বসে।চারপাশে শতশত মানুষ । যে যার যার মত ব্যস্ত।চায়ের দোকানের টিভির শব্দের সাথে লোকজনের কোলাহল মিশে বিশ্রী শব্দ হচ্ছে। প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে।শরীরটাও ভীষণ দুর্বল।তার উপর এই গাঁ জ্বালা গরম।ট্রেন ছাড়তে এখনো আরো অনেক সময়।ভীষণ খিদে পেয়েছে । সেই দুপুর থেকে কিছু মুখে তুলেনি।মনে হচ্ছে এখনি বুঝি দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাবে।সেহের একবার ছোট ছোট পা ফেলে সামনে হোটেলের দিকে এগিয়ে যায়,পরক্ষণেই আবার পিছুপা হয়ে যায় । যদি কেউ চিনে ফেলে?
বেঞ্চে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বেশকিছু ক্ষণ বসে থাকে।হুট করে কেউ গায়ের চাদরটা টেনে নেয়।সেহের বিস্মিত চোখে সামনে তাকাতে থতমত খেয়ে যায়।ভয়ে গাঁ থরথর কাঁপতে লাগে….
(জানি আজকের পর্ব সবার মাথার উপর দিয়ে গেছে🌚 )
চলবে..❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊 ।