বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :২৬
নতুন এক দিনের সূচনা ।সোনালি রোদ গুলো জানালার মোটা কাঁচ ভেদ করে সুড়সুড় করে অন্ধকার ঘরে আলো ছড়াচ্ছে।দূর কোথাও ঘাসের উপর শিশির কণা ঝলঝল করছে। ঘুমন্ত শহর অলস ভঙ্গিতে আড়মোড়া ছাড়ছে।সেহেরের মাত্র ঘুম ভাঙল।পাশ ফিরে ঘুম ঘুম চোখে আরহামকে দেখল।বিছানার মাথার সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে ,এক হাত সেহেরের চুলের ভাঁজে।নিশ্চিত সারারাত জেগে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল!
সেহেরের জ্বর এখন পুরোপুরি ছেড়েছে।গতরাতে গা পোড়া জ্বর ছিল।আরহাম সারারাত সেহেরের পাশে ছিল।জল পট্টি থেকে শুরু করে গা মুছে দেওয়া অবধি সব করেছে।সেহের অজ্ঞান অবস্থায় বিছানায় পড়ে ছিলো ,এসব কিছুর কোনটাই তার স্বরণে নেই।
সেহের আরহামকে কোনরকম বিছানায় শুয়িয়ে দেয়।আরহামের দাড়িতে আদুরে হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে বিছানা ছাড়ে।আরহামের ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে।চোখ খুলতে সামনের সব কিছু ঘোলা হয়ে যায়।শুধু কারো প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভাসে।সেহের মাত্র শাওয়ার নিয়েছে।ভেজা চুলে পিঠ ভিজে।লাল কামিজে সাদা পিঠ স্পষ্ট ফুটে।সেহের তয়লা ঝেড়ে চুলের পানি ছাড়াতে ব্যস্ত।জানালার স্বর্ণে মোড়ানো সোনালি রোদটা ড্রেসিংটেবিল ছুঁয়ে সেহেরের মুখের উপর পড়ছে।ঠিক যেন স্নিগ্ধতায় জড়ানো শিশিরস্নাত রক্তিম গোলাপ । আরহাম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে।বিছানা ছেড়ে যন্ত্রের মত সেহেরের দিকে ধাবিত হচ্ছে।সে যেন নিজের বসে নেই।মনের কোণ থেকে গভীর এক আদেশ ,সেই আদেশে- ই যেন সে চলছে!
বেখেয়ালি সেহেরের তখনো চুলের পানি ঝাড়তে ব্যস্ত। আরহামের উপস্থিতি বিন্দু মাত্র টের পায়নি।হুট করে পেছন থেকে কেউ কোমড় চেপে ধরতে সেহেরের টনক নড়ে।চমকালেও বিন্দু মাত্র ভয় পেল না।মুচকি হাসল ,চোখ তুলে আয়নায় তাকাল।আরহাম সেহেরের ভেজা চুলে মিষ্টি ঘ্রাণে মজে।সেহের আয়নায় চোখে রেখে ,হালকা স্বরে বলল,
“ঘুম ভাঙল তবে! ”
পেছন থেকে কোন উত্তর এলো না।সেহের প্রশ্ন করল,”অফিসে যাবেন না? ”
এবারো কোন উত্তর মিলল না।সেহের কিছুটা সরে আরেকবার বলল,”আমি কিছু জিগ্যেস করছি”
এবার আরহাম মাথা তুলল।বিরক্তি ভরা পিটপিট চোখে আয়নায় সেহেরের দিকে তাকাল।যেন তার ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজে সেহের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। সেহের এক চিলতে হাসল।আরহাম ঘুমঘুম ক্লান্তি মাখা স্বরে বলল,”ভীষণ ক্লান্ত ,আজ নো অফিস ,আর তুমিও ক্লাসে যাচ্ছ না ।”
সেহের বলল,”আপনি অফিস যাবেন না তা না হয় বুঝলাম।কিন্তু আমি কেন ক্লাস মিস করবো? ”
” কারণ তুমি অসুস্থ ”
“আমি মোটেও অসুস্থ না,আমি একদম ফিট এন্ড ফাইন! ”
“তা যাই হোক তুমি ক্লাসে যাচ্ছ না ”
“কিন্তুইইই….”
“কোন কিন্তু না।আমি বলেছি তুমি যাচ্ছ না মানে তুমি যাচ্ছ নাহ! আন্ডারস্ট্যান্ড? ”
আরহাম ধমকের স্বরে বলল। সেহের ধীরগতিতে মাথা নাড়ল।আরহাম দ্বিতীয় কোন কথা না বাড়িয়ে ধপধপ পা ফেলে ওয়াশরুমের চলে গেল।সেহের থম মেরে রইল।আরহামের হুট করে এমন রেগে যাওয়ার কারণ সে খুঁজে পেল না।আরহামের রেগে যাওয়াটা তার কাছে ভীষণ অযৌক্তিক মনে হলো ।খানিক পূর্বেই তো সব ঠিক ছিল।মুহূর্তে এমন কি ঘটল?
কফি নিয়ে রুমে আসতেই আরহাম ওয়াশরুম থেকে বের হলো।সেহের আরহামের হাতে কফির মগ দিয়ে চলে যেতেই আরহাম পেছন থেকে হাত টানল।সেহের থামল।আরহাম লক্ষ করল সেহের মন মরা হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে।সেহেরের মুখ তুলে কপালে গাঢ় এক চুমু এঁকে কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে আলতো স্বরে বলল ,”আ’ম সরি,আমার ঐভাবে উঁচু গলায় কথা বলা উচিত হয়নি।”
সেহের চুপ।আরহাম ধপ করে সেহেরকে কোলে তুলে নিলো বিছানায় বসিয়ে । দুগালে হাত ছুঁয়ে বলল,”সম্পূর্ন বেড রেস্ট নিবে।বিছানা থেকে একপাও নিচে ফেলবে না ।কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে বলবে।তোমার সুস্থ থাকাটা মোস্ট ইম্পরট্যান্ট ”
সেহের “হ্যাঁ “সূচক মাথা নাড়ল।আরহাম মুচকি হেসে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,”গুড ,দ্যাটস মাই গার্ল! ”
সেহের গভীর চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে রইল।এই আরহাম খানিক পূর্বের আরহামের মাঝে আসমান জমিন তফাৎ । আরহামের চোখে অন্যরকম এক আসক্তি অন্যরকম এক মায়া।যার অর্থ সেহের ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
সময় গতিশীল।নদীর মত নিজ গতিতে চলে।নভেম্বরের মাঝামাঝি । শীতের প্রবণতা তিরতির করে বাড়ছে।চারদিকে ঠান্ডার আমেজ ছড়াচ্ছে।সময়ের সাথে পাল্লা ধরে আরহাম সেহেরের সম্পর্কের গভীরতাও বাড়ছে।আজকাল সেহেরের মনের উপর কোন জোর খাটে না।হুটহাট আরহামের কাছে আসাতে আর আগের মত খারাপ লাগাটা কাজ করে না।বন্দি মনের জানালায় প্রণয়ময় দমকা হাওয়া ঝড় তুলছে ।অদৃশ্য দেয়ালটা ধীরে ধীরে মাটিতে মিশছে। সেই প্রথম দিকের সেই আবেগটা আবারো নতুন আবেশ ছোঁয়াচ্ছে।আস্তে আস্তে আরহামের প্রেমের হাঁটু গেড়ে বস হচ্ছে। আরহামের বুকে মাথা রেখে রাতের পর রাত কাটাতেও মন্দ লাগেনা।বরং এক অজানা ভালো লাগা কাজ করে।অপ্রকাশিত ভালোবাসাটা সেহেরকে আঁকড়ে নিয়েছে।
শহরের নামকরা এক নেতার বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ এসেছে।ছেলের বিয়ে।ঘটা করে আয়োজন করা হয়েছে।শহরে নামিদামি সব লোকেদের সেখানে আগমন।সেহের বারবার মানা করার সত্বেও তাকে আসতে হয়েছে।প্রত্যেকবারের মত আরহামের জেদের কাছে তাকে হার মানতে হয়েছে। এতো মানুষের ভিড়ে সেহের ভীষণ অস্বস্তিকর অনুভব করছে।ভীতু মুখ করে এক কিনারায় দাড়িয়ে ।এসব পার্টিতে সে মোটেও অভ্যস্ত নয়।দূর থেকে আরহামকে দেখছে সবার সাথে কি সুন্দর ইজিলি কথা বলছে।এসব পার্টি অকেশন যেন তার জন্যই।সেহেরের এসবে কাজ কি? সেহেরের মাঝে মাঝে মনে হয় সে আরহামের যোগ্য নয়।যেমন সুন্দর সে দেখতে তেমন তার চলনবলন।প্রত্যেক কাজে বিশেষরকম এক এডিটিউড যা তাকে অন্যসবার চেয়ে বিশেষ বানায়। এই যে আজ চকলেট স্যুট পড়েছে কি দারুণ লাগছে। একদম চোখে লাগার মত । প্রত্যেকের চোখ ঘুরেফিরে আরহামে দিকে,এতো সুদর্শনের পাশে সেহেরকে কি মানায়? মনে এক কঠিন প্রশ্ন জাগল।এসব নিয়ে ভাবছে হঠাৎ পেছন থেকে কারো গলার আওয়াজ পেয়ে তাকায়।উল্লাসিত স্বরে বলে উঠে,”তফির ভাই তুমি? ”
তফির এক গাল হাসল।মাথা দুলিয়ে বলল ,”হ্যাঁ আমি,কেমন আছিস তুই ”
“ভালো । তুমি কেমন আছ? আর ফুপি,অর্থি কেমন আছে? ”
“সবাই ভালো আছে।এবার বল তুই ঢাকায় কি করে? নিশ্চয় মামার সাথে । ঢাকা এসেছিস এবার জানালি না! ”
সেহের কিঞ্চিৎ হাসলো।তফিরের উত্তরে বলল,”বাবার সাথে আসিনি। ”
“এখানে কার সাথে এসেছিস? মামীর সাথে? ”
“না, আমার হাসবেন্ডের সাথে ”
“হাসবেন্ড ” কথাটা শুনে তফিরের মুখ চুপসে গেল।হাসি উজ্জ্বল মুখটা বুজে গেল।বলল,”হাসবেন্ড? তুই মজা করছিস তাই না? ”
“মজা করবো কেন।সত্যি ,হাসবেন্ডের সাথে এসেছি”
তফির থতমত গলায় বলল,”তুই সত্যি বিয়ে করে নিয়েছিস? ”
সেহের আমতা আমতা গলায় বলল,”সে অনেক কাহিনী । কিছু মনমালিন্য কারণে কাউকে জানানো হয়নি। ”
তফির অন্যদিকে তাকিয়ে ছোট এক নিশ্বাস ফিলল।বুকের কোথাও চিনচিন ব্যথায় হাহাকার করছে।জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,”অভিনন্দন ”
সেহের মুচকি হেসে উত্তর দিলো ,”ধন্যবাদ! এবার বল তুমি এখানে কি করে? এতোদিন কোথায় ছিলে? ”
“পুলিশের চাকরি কখন কোথায় থাকি ঠিক নেই।এখানে ফ্রেন্ডের বিয়ে এটেন্ড করতে এসেছি। বর আমার স্কুল ফ্রেন্ড !”
“ওহ ,আচ্ছা তাই বলো”
সেহের তফির গল্প করছে যা আরহামের চোখ এড়ায়নি।দূর থেকে হিংস্র চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।তফিরের সাথে সেহেরের গল্প করাটা হয়তো আরহামের ভেতর সত্তার পছন্দ হয়নি।সেহেরের পাশে এসে দাড়িয়ে বাহু ধরে সেহেরকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।সেহের মাথা উঁচু করে এক চিলতে হেসে তফিরের সাথে আরহামের পরিচয় করিয়ে বলে,” ভাইয়া মিট মাই হাসবেন্ড আরহাম খাঁন , আরহাম উনি হচ্ছে তফির ভাইয়া আমার কাজিন”
আরহাম হ্যান্ড শেক করে।তফির মুখে কৃত্রিম হাসি রেখে বলে,”উনাকে কে না চেনেন,আরহাম খাঁন শহরের নামকরা পলিটিশিয়ানদের একজন ”
আরহাম কিঞ্চিৎ হাসলো।আরহাম সেহেরকে একত্রে দেখে তফিরের ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে।তফির তাড়া দিয়ে বলল,”অনেক রাত হয়েছে মা বাড়িতে একা আমার এখন বের হতে হবে ।আবার দেখা হবে আজ আসি ”
আরহাম বাঁকা হেসে গম্ভীর স্বরে বলল,”অবশ্যই,দেখা হবে! ”
ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চলছে।আরহাম ড্রাইভ করছে। সেহের আরহামের কাঁধে মাথা হেলিয়ে আছে।গাড়িতে পিনপতন নীরবতা।আরহামকে চুপচাপ দেখে নীরবতা ভেঙে সেহের বলল,”আজ আমাকে কেমন লাগছে? ”
আরহাম চুপ।সেহের আবার বলল,” কি হলো? ”
আরহামের টনক নড়ে।চিন্তাজগত থেকে ফিরে সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বলে,”কিছু বললে! ”
“এই ডিপ গ্রিন শাড়ীতে কেমন লাগছে? ”
আরহাম মুচকি হেসে বলল,”সবসময়ের মত , এঞ্জেল ।কিন্তু এই সৌন্দর্য শুধু আমার জন্য! আমি অবধি যেন সীমাবদ্ধ থাকে! ”
সেহের কথার গভীরতা না বুঝে এক চিলতে হেসে আরহামের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঝে নিল।আরহাম হিংস্র ভাবে সামনে তাকিয়ে হাসে হয়তো কারো মৃত্যুর ছককাটা শেষ!
দুদিন পর সেহের হুট করে একদিন অর্থিকে ফোন করে।অর্থি থেকে জানতে পারে তফির হসপিটালে ভর্তি।গত রাতে গুরুতর এক্সিডেন্ট হয়েছে।প্রাণ না গেলেও ভীষণরকম আহত! হাত পায়ে বেশ চোট লেগেছে।
চলবে….❣️
(ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভীষণরকম ব্যস্ত ছিলাম তাই গল্প দিতে পারিনি😑)
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊 ।