বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :২৭

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :২৭

সেই রাতের পর অনেক দিন কেটে গেলো।নভেম্বরের শেষদিক।শীতের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। সন্ধ্যা নামতেই চারদিক ঘন কুয়াশায় ঘিরে যায়।এমনি এক রক্তিম বিকালে সেহের বারান্দায় দাড়িয়ে। সন্ধ্যা নামতে এখনো অনেকটা সময়।নীল দিগন্তে রক্তিম সূর্যের উষ্ণ ছোঁয়া কমল আলো ছড়াচ্ছে।মৃদু ঠান্ডার আমেজ।সেহের মোটা শালটা আলতো ভাবে গায়ে জড়িয়ে রেখেছে।বারান্দা ফুল গাছ গুলো শীতল বাতাসে দুলছে।শীতের প্রবণতা গাছ গুলোকেও ছাড় দেয়নি । সোনালি খাঁচার বন্দি পায়রা গুলো কিচিরমিচির আওয়াজ তুলছে।সেহের মৃদু হেসে পায়রার সাথে খেলছে।এই কয়েকদিনে পায়রা দুটোর উপর ভীষণ মায়া জন্মেছে।এদের আহ্লাদী নামও দিয়েছে একটার নাম চন্দ্র, অন্যটা সূর্য।যা নিয়ে আরহাম সহ দাদীও বেশ হাসাহাসি করেছেন। আজকাল এদের সাথে সময় না কাটালে মন কেমন জানো অস্থির অস্থির থাকে।মনের অস্থিরতা মিটাতে দিনে অন্তত একবার হলেও এদের সাথে সময় কাটায়।পায়রা গুলোর নিষ্পাপ চোখ সেহেরকে কিছু একটা যেন বলতে চায়।তাইতো এতো বেশি ছটফটানি!
গতানুগতিক অন্যদিনের তুলনায় আজ বেশ ছটফট করছে। পিঞ্জিরা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে।হয়তো বোবা প্রাণী মনে গগনপ্রান্তে ডানা ঝাপটানোর স্বাদ জেগেছে । পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সেহের মুচকি হাসলো।আগের মত সামনের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ করে বলল,”এসেছেন? দিন কেমন কাটল! ”
আরহাম কিঞ্চিৎ হেসে পেছন থেকে সেহেরের কোমড় চেপে ধরে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো । সেহেরের মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,”ভীষণ ক্লান্ত ,রেস্ট করতে চাই ”
“হুম করুন ,ধরে রেখেছে কে? ”
“আমার সব রোগের ভেষজ যে তুমি,তোমাতেই আমার সব স্বস্তি! ”
সেহের আগের ভঙ্গিতে আরহামের বুকে গা হেলিয়ে মুচকি হাসে।আরহাম মাথায় চুমু দিয়ে শান্তস্বরে বলল,”মাথা ম্যাসেজ করে দিবে , রুমে চলো । ”
সেহের সোজাসুজি দাড়িয়ে যায়। আরহামের দিকে ফিরে ভেংচি কেটে বলে ,”উহু একদম না ,আমি জানি এখন রুমে গেলে আপনি দুষ্টুমি শুরু করবেন।তাছাড়া আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত।চন্দ্র সূর্যকে খাবার দিবো তাদের সাথে গল্প করবো! ”
আরহাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”পায়রা গুলো আমার থেকে বেশি ইম্পরট্যান্ট? ”
সেহের আরহামকে রাগাতে মজার ছলে বলল,”হুম ,একদম”
কথাটা শুনা মাত্র আরহাম ভীষণ তেতে গেল।সেহেরের বাহু টেনে নিজের সামনে আনল ধমকের স্বরে শক্ত গলায় বলল,”তোমার জীবনে আমার থেকে বেশি ইম্পরট্যান্ট কিছু থাকতে পারবে না! নেভার এভার । ”
আরহামের রক্তিম চোখের ক্রুদ্ধ চাহনিতে সেহের কেঁপে উঠে।শুকনো ঢোক গিলে ছলছল চোখে আরহাম দিকে তাকায়।সামনে দাড়িয়ে থাকা মানুষটা আরহাম নয় ।যেন আরহাম রূপে অন্যকেউ!

দুদিন পর।ঠিক দিনের মাঝামাঝি।সেহের মাত্র ক্লাস থেকে ফিরেছে।মন বেশ ফুরফুরে । লাস্ট এক্সামের রেজাল্ট দিয়েছে।ভীষণ ভালো রেজাল্ট হয়েছে। সবাই যার যার ঘরে। আরহাম সেহেরের সাথে বেরিয়েছে।অফিস থেকে এখনো ফিরেনি।জানিয়েছে বাড়ি ফিরতে দেরী হবে।সেহের রুমের দিকে অগ্রসর হয়।রুমের সামনে যেতে- ই উৎফুল্ল মনটা বুজে যায়।অজানা এক ভয় হানা দেয়।ভীতু পায়ে সেহের ভিতরের দিকে পা বাড়ায়।ঘরের জিনিসপত্র সব এলোমেলো । অগোছালো ঘরটায় থমথমে নীরবতা বিরাজ করছে।নীরবতা ভেঙে বারান্দার সামনে ঝুলন্ত স্টিলের ওয়াল হ্যাংগিং টুংটাং শব্দ করে উঠে।আচমকা শব্দে সেহের কেঁপে উঠে।বুকের কাছে হাত রেখে সামনের ছোট নিশ্বাস ছেড়ে সারা রুমে চোখ বুলায়।রুমের বেহাল দশা।দেখে মনে হচ্ছে রুমের উপর দিয়ে ছোট খাটো ঝড় গেছে।সেহের চিন্তিত মুখ করে আছে।বিছানায় ব্যাগ রাখতে গিয়ে সেহের থেমে যায়।বারান্দা দিকে কুঞ্চিত ভ্রু করে তাকিয়ে থাকে। পায়রার কিচিরমিচির শব্দ মিলছে না। মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ জাগে।সেহের তড়িঘড়ি করে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়। দরজার সীমানায় দাড়াতে সেহের আঁতকে উঠে। চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়ে। রক্ত ভেজা নিথর পায়রা জোড়া মাটিতে পড়ে আছে।পায়রার রক্তে সারা ফ্লোর মেখে ।সোনালি পিঞ্জিরাটার দ্বার খোলা ।সেহের মাটিতে বসে চিৎকার করে কান্না করছে।নিজেকে কোনভাবে ঠিক রাখতে পারছে না।সেহেরের চিৎকারে পুরো বাড়ীর লোক জড় হয়ে গেছে।সেহের এক সময় নিজের জ্ঞান হারায়।

বাগানের পাশে ছাইরঙা ঘরটায় মালিহা খানম প্রবেশ করে। কয়েক পা যেতেই একটা রুমের সামনে দাঁড়ায়।দরজা মেলতে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরটার মেঝেতে লম্বালম্বি আলোর রেখা পড়ে।ভেতর থেকে কারো ভারী আর্তনাদ ভেসে আসে।মালিহা খানম ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে। আলো জ্বালাতে আরহাম চিৎকার করে উঠে ।
“আলো বন্ধ করো,বন্ধ করো এই অসহ্য আলো !এই আলো আমাকে পীড়া দিচ্ছে।ভীষণরকম যন্ত্রণা! ”
আরহামের এলোমেলো কথা গুলো গুলিয়ে যাচ্ছে।অসহ্য চিৎকারে পুরো ঘর থমথম করছে।আরহামের ব্যথাতুর স্বরে মালিহা দ্রুত লাইট বন্ধ করে ড্রিম লাইট জ্বালায়।আরহামকে জড়িয়ে ধরে আরহাম চাপা চিৎকারে বলে,”বিশ্বাস করো দাদীমা আমি ইচ্ছে করে পায়রা গুলোকে খুন করিনি।কি থেকে কি হয়েছে আমি কিছু জানিনা! যখন আমার জ্ঞান ফিরে নিজেকে রক্তমাখা হাতে বিছানায় পাই।কি হয়েছে আমি কিছু জানিনা! আমার…..”
আরহাম আর বলতে পারছে না কথা গুলো আটকে আসছে। মালিহার কোলে মাথা রেখে আধো আধো স্বরে বলে,”আমি নিষ্পাপ জীবের প্রাণ কেড়েছি।বিশ্বাস করো আমি এমনটা চাই নি।আমি চাইনি সেহেরকে কষ্ট দিতে।নিজের আয়ত্বে আমি ছিলাম না। কি হয়েছে কোন কিছুই আমার স্মৃতিতে নেই।এ কেমন রোগ যা আমাকে দিয়ে নিষ্পাপ জীবের প্রাণ হরণ করে? সেহের আমার অসুস্থতার কথা জানতে পারলে ছেড়ে চলে যাবে।চলে যাবে আমাকে ছেড়ে! ”
আরহামের অসহায় আকুতি।মালিহা নাতির এমন অসহায়ত্ব সহ্য করতে পারছে না।চোখ জলে চিকচিক করছে। কোনরকম ঠোঁট চেপে কান্না আটকে বলে,”এমন কিছু হবে না।সেহের কোনদিন তোমাকে ছেড়ে যাবে না। সে ঠিক তোমাকে বুঝবে। ”
আরহাম জানে তার দাদীমা তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে।আরহাম খাটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে রক্তমাখা হাতের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,”তুমিও জানো আমিও জানি এটা শুধু মিথ্যা সান্ত্বনা । আমি কোনদিন সুস্থ হবো না। আর এমন অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের সাথে সেহের মোটেও থাকতে চাইবে না।আমার জীবন বরাবরই আমার কাছে এক অমীমাংসিয় রহস্য।জীবনের প্রতিটি পাতাই এলোমেলো।ছন্নছাড়া এক জীবন।স্মৃতি থেকে অনেকটা বছর পুরোপুরি মুছে গেছে। যা আছে তাতেও সব অগোছালো ।
ভালো হতো পাঁচ বছর আগে চিটাগাং সেই অনুষ্ঠানে তাকে না দেখতাম।তার প্রণয়ের আগুনে এভাবে না পোড়তাম।তার নিষ্পাপ সেই হাসি আমাকে মুগ্ধ না করতো তবে আজ হয়তো গল্পটা অন্য হতো।না এভাবে বিষাক্ত প্রণয় দহনে পুড়ে ছারখার হতাম।সেহের আমার নেশা ,আমার আসক্তি আমার আত্মার সাথে সে মিশে।প্রাণ থাকতে কোনদিন তাকে ছাড়তে পারবো না।তাকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব!
না সেহের কে পুরোপুরি নিজের করতে পারছি না তাকে ছাড়তে পারছি।ভয় হয় ভেতরের হিংস্রতা যদি কাবু করে সেহেরকে আঘাত করি?অজান্তে আমার সেহেরকে যদি চোট দিয়ে বসি? আজকাল সেহেরের আশেপাশে থাকতে আমার ভয় হয়।না জানি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে কখন কি করে বসি ।সে আমার তবুও তাকে ছুঁয়ে দেখতে ভীষণ ভয় হয়। এই অসহ্য যন্ত্রণায় ক্ষণে ক্ষণে পুড়চ্ছি।আমার মুক্তি চাই । মুক্তি চাই! ”
আরহাম অস্থির স্বরে শেষের কথা গুলো বলছে।মালিহা আরহামকে জড়িয়ে ধরে কোনরকম শান্ত করে ।আরহামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”কিছু হবে না।সেহের কোথাও যাবেনা ।সব ঠিক হবে। তুমি সুস্থ হবে। ”

খটখট আওয়াজে গভীর রাতে সেহেরের ঘুম ভাঙে।অন্ধকার রুম জুড়ে আবছা নীল আলো।ভারী মাথা নিয়ে সেহের উঠে বসে। নিভু নিভ্য চোখে সামনের তাকিয়ে দেখে কাবার্ডের পাশে কারো প্রতিচ্ছায়া।বিছানার পাশে ল্যাম্পটা জ্বালাতে উজ্জ্বল রশ্মিতে ঘরটা ফুটে উঠে।আরহামকে প্যাকিং করতে দেখে সেহের আলতো স্বরে প্রশ্ন করে,”
কোথাও যাচ্ছেন? ”
আরহাম ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ব্যস্ত স্বরে বলে,”হ্যাঁ কানাডা ।দুপুরে ফ্লাইট।সকালে বের হবো অফিসের কাজ সেরে সোজা এয়ারপোর্ট।”
আরহামের কথায় সেহেরের বুকে ভারী এক কষ্ট নাড়া দিয়ে উঠল।কেমন জানো এক অজানা ব্যথা। আজকে এতো বড় এক ঘটনা ঘটে গেলো আরহামের মাঝে এ নিয়ে কোন অনুভূতি নেই? সেহেরকে এমন অসুস্থ ফেলে আরহাম কি করে কানাডা যেতে পারে? সেহের গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল,”কত দিনের জন্য যাচ্ছেন? ”
“এখনো ঠিক হয়নি,কাজ শেষ হতে যতটা সময় লাগে । আরহামের আগের মত উত্তর ।
সেহের ছোট করে “ওহহ “বলল।আরহাম প্যাকিং শেষ করে ওয়াশরুমে চলে গেলো।সেহের ঠাই বিছানায় বসে।আরহামের এভাবে কানাডা যাওয়াটা সেহের কিছুতে মেনে নিতে পারছে না।বারবার চোখ ছলছল করে উঠছে।বেশ কিছুক্ষণ পর আরহাম ফিরে আসে।বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলে,”অনেক রাত হয়েছে তোমার ঘুমানো উচিত! ”
বলেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ বুজলো।সেহের আরহামের ব্যবহারে শকড ।বাড়ি ফেরার পর থেকে একবার ও সেহেরের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না।এড়িয়ে চলছে।কেন এমন করছে সে কি কোন ভুল করেছে? এসব ভাবতে ভাবতে আরহামকে পেছন থেকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে।পিঠের সাথে মাথা ঠেকিয়ে কান্না ভেজা স্বরে বলে,”কেন এমন করছেন? কানাডায় কয়েকদিন পর গেলে কি হয়না! আমার আপনাকে প্রয়োজন ।খুব করে প্রয়োজন।প্লিজ যাবেন না! ”
আরহাম সেহেরের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,” আমাকে কাল- ই যেতে হবে।অনেক রাত হয়েছে ,এখন ঘুমানোর প্রয়োজন ।নয়তো আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
আরহামের কথায় সেহের দূরে সরে আসে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাতভর অশ্রুবিসর্জন দেয়।

চলবে….❣️

প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন ।ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here