বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৩২
ঘন কালো কুয়াশা ঘেরা রাত। আঁধার দৈত্য তার কালো আঁধারে চারদিক ঘিরে রেখেছে। চারদিকে পিনপতন নীরবতা।গেটের বাহিরে বেওয়ারিশ কুকুর গুলো ঘেউঘেউ করছে।ফিসফিস শীতল হাওয়া ঘর জুড়ে গুঞ্জন করছে।সেহের কাঁচুমাচু হয়ে বিছানায় শুয়ে। সন্ধ্যা রাতের পর ঘর থেকে বের হয়নি।আরহামের উপর একরাশ অভিমান বুকে চেপে ঘরে বসেবসে অশ্রুবিসর্জন দিয়েছে।রাত গভীর হতেই চোখে ঘুমের মোহ ভর করে।আস্তে আস্তে অজান্তে ঘুমন্তপুরীতে ঢুলে পড়ে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করতে আরহামের পায়ে কিছু একটা বিঁধে।উঠিয়ে দেখে ভাঙা চুড়ি।বুঝতে বাকি রইল না সেহেরের রাগ আকাশ চুম্বী । মোবাইলের ফ্লাশ অন করে সাবধানতা অবলম্বন করে ধীর পায়ে বিছানার দিকে অগ্রসর হয়।বিছানার পাশে দাড়াতে এলোমেলো অবস্থায় সেহেরকে পায়।গায়ের শাড়িটা এলোমেলো হয়ে আছে কপালের টিপটাও সরে গেছে ।অশ্রুকণায় এখনো গাল ভিজে।সামান্য ব্যাপারে মেয়ে নিজের এ কি হাল করেছে?
ভাবতেই আরহামের বেশ অনুশোচনা হয়।সেহেরকে কোলে তুলে ঠিক ভাবে বিছানায় শুয়িয়ে।গভীর চোখে সেহেরের পানে তাকিয়ে থাকে।সেহের তখন গভীর ঘুমে মগ্ন ।হ্ঠাৎ গালে কারো হিম শীতল স্পর্শ পেয়ে ধাঁ করে উঠে বসে । বড় বড় ভীতু শ্বাস ফেলতে লাগে।আরহাম তা দেখে বলে,”রিলাক্স ,ইট’স মি আরহাম! ”
সেহের নিশ্চিন্ত শ্বাস ফেলল। আরহাম আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,”আমি ছাড়া তোমাকে ছোঁয়ার সাধ্যি কার? ”
সেহেরের ঘোর কাটল । চোখ বুঝে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও থেমে গেলো। ছিটকে দূরে সরে গেলো ।আরহাম হতভম্ব চোখ করে তাকিয়ে। সেহের বাজখাঁই আওয়াজ করে বলল,”ছুঁবেন না আমাকে! দূরে যান ,একদম দূরে। “আরহাম দূরে সরলো না আগের দৃষ্টিতে ঠাই তাকিয়ে রইল।সেহের আগের স্বরেই বলল,”রাত দেড়টায় আপনার বাড়ি ফেরার সময় হলো? কোথায় ছিলেন মিহির সাথে? ”
আরহাম সেহেরের কাছে সবটা স্পষ্ট করতে চাইল।কিন্তু সেহের শোনতে নারাজ।বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।আরহামের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে অপর পাশের ঘরটায় বসে রইল।আরহাম বাহির থেকে বেশ কয়েকবার ডাকল ,সেহের ভেতর থেকে কোন প্রকার প্রত্যুত্তর করল না। আরহাম দরজায় জোরে জোরে বাড়ি দিচ্ছে । খুলতে বলছে।সেহের নাছোড়বান্দা খুলবে না। ভেতর থেকে আওয়াজ করে বলে “একদম বিরক্ত করবেন না । দরজার সামনে থেকে সরুন । যার সাথে এতোটা সময় ছিলেন তার কাছে যান! ”
আরহাম রাগি মুখ করে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে রইল।মনে মনে অটল প্রতিজ্ঞা করল।সে কোনভাবেই সরবে না।যে করেই হোক সেহেরকে নিজের রুমে নিয়ে যাবে!
অজানা ভোর পাখির কিচিরমিচির আওয়জে সেহেরের ঘুম ভাঙে।পাশ ফিরতে নিলে পেছন কাউকে অনুভব করে।বেশ শক্ত করে জড়িয়ে আছে।যাকে বলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরা। চোখ থেকে তড়াক করে ঘুম পালাল।নিভু নিভু ঘোলাটে চোখে রুমের দিকে চোখ বুলাল। এটা তো আরহামের রুম। সে এখানে কি করে? তিড়িং করে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে আরহামের দিকে ফিরল। ততক্ষণে সেহেরের জোরাজুরি আরহামের ঘুম কেটে গেছে।আরহাম ঘুম ঘুম স্বরে বলল,”সকাল সকাল শুরু করলে? আবার কি হলো? ”
সেহের অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”আমি এ রুমে কি করে? “আরহাম হাই তুলতে তুলতে বলল,”অবশ্যই ,আমি এনেছি! ”
“রুম তো লক ছিলো ভিতরে ঢুকলেন কি করে !”
“এক্সট্রা কী ছিলো ”
সেহের কোন উত্তর দিলো না। রেগে বিছানা ছেড়ে উঠতে নিলে আরহাম পেছন থেকে হাত আটকায়।সেহের প্রতিক্রিয়ায় ক্রুদ্ধ চাহনি নিক্ষেপ করল।আরহাম সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করল না।সেহেরকে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। কানের কাছে মুখ এসে ফিসফিসিয়ে বলল,”টেবিলের দিকে তাকাও”
সেহের তাকালো রেপিং করা বড় বক্স দেখতে পেল।ভ্রু কুঁচকে ঘাড় ফিরিয়ে আরহামের দিকে চাইল।আরহাম বলল,”তোমার জন্য! ”
সেহের সন্দিহান দৃষ্টিতে আরহামের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল।বক্স হাতে নিতে অপর পাশে দেখল পাতায় জড়ানো বেলি ফুলের গাজরা ।সেহের মুচকি হেসে মালাটা হাতে জড়িয়ে, নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ টেনে নিলো ।আরহাম তা দেখে মুচকি হাসলো।আরহামকে হাসতে দেখে সেহের আবারো মুখে গম্ভীর ভাব টানল ।র্যাপিং করা বক্স খুলতেই অনেক গুলো চকলেট বক্স পেল।সবগুলো সেহেরের পছন্দের ফ্লেভার।ভেতরে ইয়া বড় এক সরি কার্ড। সেহের অবাক হয়ে জিগ্যেস করল,”এগুলো কখন আনলেন? ”
“গতরাতে ”
“থ্যাংকস,তবে সরি আপনাত এসব ট্রিকস আমার উপর কাজ করবে না। আপনার গিফট আপনিই রাখেন।”
আরহামের হাতে বক্স ধরিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে নিলে।আরহাম আবারো আটকায়।সেহের হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে ।সেহেরকে শান্ত করতে আরহামকেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।এক পর্যায় সেহের ক্লান্ত হয়ে থেকে যায়।বড় বড় শ্বাস ফেলতে লাগে।আরহাম সেহেরের হাত পা আটকে দুষ্টু হেসে জিগ্যেস করে,”এতোটুকুতেই দম শেষ ”
সেহের গাল ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।হঠাৎ সেহেরের চোখ আটকায় আরহামের বাহুতে।ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো।লক্ষ করে দেখল হাতের জায়গা জায়গায় জখম । সেহের জখম গুলো ছুঁয়ে চিন্তিত স্বরে জিগ্যেস করল,”এসব জখম কিসের? ”
আরহাম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।চোখ সরিয়ে আমতা আমতা স্বরে বলল,”তেমন কিছুনা ,সামান্য লেগেছে! ”
সেহের সন্দিহান স্বরে বলল,”ব্যান্ডেজ দেখে মনে হচ্ছে ইঞ্জেকশন পুশ করেছে! ”
“হ্যাঁ ,ভাইরাসের টিকা দিয়েছিলাম । ”
সেহের কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করল না।ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইল। আরহাম কথা ঘুরিয়ে বলল,”আচ্ছা ,এসব ছাড়ো । তোমার মান ভাঙাতে কি করতে হবে? ”
“আপাতত আমার থেকে দূরে থাকুন।আপনাকে দেখলেই আমার রাগ হচ্ছে। ভীষণ রাগ! ”
“সরি তো ,আর এমন হবে না।কাল সত্যি ইম্পরট্যান্ট কাজে ফেঁসে গিয়েছিলাম! ”
“রাত দেড়টা পর্যন্ত মিহির সাথে কি এমন ইম্পরট্যান্ট কাজ ছিলো? শুনি? ”
“ট্রাস্ট মি সেহের ”
“ট্রাস্ট করি বলেই এখন অবধি এ বাড়িতে আছি । না হয় কাল রাতেই ট্রেনে চড়ে চিটাগাং রওনা হতাম! ”
সেহেরের কথায় আরহাম খানিক ক্ষেপল।হাত পেঁচিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”এমন কিছু করার কথা চিন্তাও করো না।ফল ভয়ংকর হবে।”
সেহের প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও পরবর্তীতে হেসে উড়িয়ে দেয়।আরহামও কিছুটা সহজ হলো।মুখের কঠিন ভাবটা এখন নেই।আরহাম থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। আরহাম কাঠকাঠ চোখে সেহেরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। বেখেয়ালি সেহের আরহামের কথার গভীরতা বুঝল না।ভবিষ্যৎ- এ এই কথা যে সম্পূর্ণরূপে মিলে যাবে তা কি সেদিন সেহের জানত? ……
বর্তমান …..
অতীত থেকে সেহের বাস্তবে ফিরল।দুর্বল ঘোলাটে চোখে সামনের দিকে চাইল । বিলাসবহুল রাজকীয় ঘরের বিছানায় বসে।তার হাত পা লোহার শিকল দিয়ে বিছানার সাথে বাঁধা।হুট করে বাহিরের দমকা হাওয়ায় সামনের চুল গুলো মুখের উপর থেকে সরে যায়। সেহেরের চোখ থেকে টপটপ পানি ঝোরছে। চোখের জলে গাল ভিজে ।মাথা তুলে সামনের বড় আয়নাটায় নিজেকে দেখল। চোখের নিচে গাঢ় ডার্ক সার্কেল পড়েছে। চেহারায় আগের মত সেই সতেজতা নেই।সেহেরের এই রূপটা কেও কি সে ভালোবাসবে? সৌন্দর্য যদি কারো অভিশাপ হয় তবে এই সৌন্দর্য তার চাইনা! এসব ভেবে সেহের ডুকরে কেঁদে উঠে।এমন সময় কারো পায়ের ভাজ সেহেরের কানে ভেসে আসে। সেহের কেঁপে উঠে।ভয়ে কান্নার আওয়াজ থেমে গেছে ।পায়ের আওয়াজটা আস্তে আস্তে সেহেরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।সেহের চোখ মুখ খিঁচে নেয়।ভয়ে বিছানার সাথে লেগে বসে।হ্ঠাৎ অনুভব করে কারো তপ্ত নিশ্বাস তার মুখের উপর পড়ছে। সেহেরের ভয় আরো বাড়ল।থরথর করে কাঁপছে।সামনের মানুষটা সেহেরের কানের কাছে মুখ এনে গম্ভীর স্বরে বলল,” হ্যালো লাভ! ”
( হ্যাঁ ,গল্পটা প্রথম পার্ট থেকে কল্পনা দিয়ে শুরু )
চলবে…..❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ।প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।