ব্যবধান ( দ্বিতীয় পর্ব )
শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য্য
নার্সিংহোম থেকে ঘরে ফিরে, জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে, সারাদিনের কাজের মাসিকে জিজ্ঞেস করলো শিখা—–” টুলুমাসি, রণর রাতের রুটিটা দুধের সাথে মিশিয়ে দিয়েছো?
—–“হ্যাঁ দিদিভাই, আমি সন্ধ্যেবেলাই রুটি করে দুধে ভিজিয়ে রেখেছি। তুমি আর দেরি করোনা, বাবুকে খাইয়ে দাও। খিদে পেয়ে গেছে হয়তো।“
——” হ্যাঁ, আমি ছেলেকে খাওয়াতে বসছি। আর তুমি নিজে খেয়ে, এবার শুয়ে পড়ো। আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবেনা। নিজের শরীরের দিকেও একটু খেয়াল রাখো। আমার জন্য, রণর জন্য তোমায় সুস্থ থাকতে হবে টুলুমাসি। সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয় তোমার। তুমি না থাকলে, ছেলে মানুষ, ঘরে বাইরে এত কাজ সামলান, আমি যে কিভাবে পেরে উঠতাম, জানিনা। আর দেরি করোনা, খেয়ে নাও।“
টুলুমাসি অনিচ্ছা সত্বেও খেতে চলে গেল। ভালোভাবেই জানে প্রত্যেকদিন শিখা এইভাবেই ওকে জোর করে তাড়াতাড়ি খাইয়ে শুইয়ে দেয়। একটা আপত্তিও শোনেনা। সারাদিন যেভাবে টুলুমাসি অন্তরের সবটুকু ভালোবাসা নিঙড়ে পরিশ্রম ও সেবা দিয়ে আগলে রেখেছে মা আর ছেলেকে, শিখাও ঠিক ততটাই খেয়াল রাখে টুলুমাসির। নিজের আত্মীয় পরিজনহীন মানুষটা ছোট্ট রণের মধ্যেই নিজের বেঁচে থাকবার অবলম্বন খুঁজে নিয়েছে। তাই শিখাও ছেলের দায়িত্ব টুলুমাসির উপর সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত।
রণকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে শিখা রান্নাঘরে গেল নিজের খাওয়ারটা আনতে। ডাইনিং টেবিলের উপর টুলুমাসি যত্ন করে শিখার রুটি তরকারি ঢাকা দিয়ে রেখে দিয়েছে। চেয়ারে বসে প্লেট থেকে ঢাকনাটা সরিয়ে, হাতগুটিয়ে চুপ করে বসেই রয়েছে শিখা। রুটিটা কিছুতেই মুখে তুলতে পারছেনা। ভয়াবহ অ্যাকসিডেন্টের পর কৌস্তভকে যে অবস্থায় দেখে এসেছে, এখনও হৃৎপিন্ডের ধড়ফড়ানি বন্ধ হয়নি। এক সময় মনে হচ্ছিল হয়তো সারাজীবনের মত হারিয়েই ফেলল কৌস্তভকে। প্রায় একবছর হতে চলল দুজনে আলাদা। তবুও একবিন্দুও ভালোবাসা কমেনি কৌস্তভের জন্য। আজও কৌস্তভকে দেখলে শিখার হৃৎস্পন্দন ঠিক আগের মতই সাড়া দেয়। আর সেই মানুষটাকেই রাস্তায় এইভাবে পড়ে থাকতে দেখে শিখার মনের ভেতরটা যে কি হচ্ছিল, তা একমাত্র সে নিজেই জানে। সংজ্ঞাহীন কৌস্তভের রক্তাক্ত শরীরটার দিকে তাকাতে পারছিলোনা কিছুতেই। চোখের জলকে দুহাতে মুছে উঠে পড়ল শিখা। আজ আর কিছু গলা দিয়ে নামবেনা ওর।
খাওয়ার প্লেটটা যথাস্থানে রেখে, বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল ছেলের পাশে। অঘোরে ঘুমোচ্ছে রণ। কিন্তু শিখার চোখে ঘুম নেই। ক্ষুধার সাথে নিদ্রাও বুঝি আজ মুখ ফিরিয়েছে। কত ভাবনা মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। ঘুম না আসায়, ভাবনাদের আজ অবারিত দ্বার। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে শিখা অতীতের সেই সুখের দিনগুলিতে। বিয়ের পরের আনন্দের স্মৃতিগুলো, দমকা হাওয়ার মত আজও তার ঝাপটা দেয় মনের গহনস্থলে। মুহূর্তেই উদাস করে দেয় মনকে। কত সুখের ছিল সেই দিন। কতই না ভালোবাসা, তরঙ্গ হয়ে আছড়ে পড়ত দুটি হৃদয়ে। অথচ আজ জীবন থেকে সবকিছুই কেমন হারিয়ে গেল। আনন্দ, ভালোবাসা সবকিছুই। কী বিস্বাদ আজ জীবনটা। হতে পারতো না ওদের জীবনটাও সুখের? এই বিচ্ছেদের কি খুব প্রয়োজন ছিল? শিখার ভালোবাসা কী কৌস্তভের মনে কোনদিনও দাগ কাটতে পারেনি? নিজের স্ত্রী, সন্তানের প্রতি এত নির্লিপ্ত, উদাসীন কী করে হতে পারে একজন মানুষ? নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছে দিনের পর দিন এত অবহেলা সহ্য করে, এতদিনের পুঞ্জিত অভিমানে, দীপশিখার মনেও ক্রোধের আগ্নেয়গিরি প্রজ্জ্বলিত হতেই পারতো, কিন্তু কোনদিন একমুহূর্তের জন্যও রাগ বা অভিযোগ আনতে পারলো কই, ওই স্বার্থপর মানুষটার প্রতি? আজও নিঃশর্তে নির্লজ্জের মত মনটা যে সেই মানুষটাকেই ভালোবাসে, সেই মানুষটার জন্যই চিন্তা করে, যার কাছ থেকে পেয়েছে চরম অবহেলা।
সকাল সকাল উঠে রণকে খাইয়ে মাসির কাছে দিয়ে কোনমতে তৈরি হয়ে নার্সিংহোমের যাওয়ার জন্য বেরিয়ে গেল শিখা। ভিজিটিং আওয়ারের মধ্যে পৌঁছাতে হবে। হন্তদন্ত হয়ে নার্সিংহোমে কৌস্তভের কেবিনে পৌঁছে দেখে, দরজার দিকে উদাস ভাবে চেয়ে বসে রয়েছে কৌস্তভ। স্যালাইন খুলে দেওয়া হয়েছে। সামনে প্রাতরাশটা যেমন দেওয়া হয়েছে, তেমনই পড়ে রয়েছে।
—–” কী হলো, জলখাবারটা খাওনি?”
——-” ভালো লাগছেনা।“—- মৃদু হেসে উত্তর দিল কৌস্তভ।
—-” ভালো লাগছেনা বললে যে চলবেনা, খেতে তো হবে। নাহলে শরীরে জোর পাবে কী করে?“—- বলে চামচ দিয়ে খাবারটা মেখে, সযত্নে মুখে তুলে দিল শিখা। একটুও আপত্তি করলো না কৌস্তভ। বাধ্য ছেলের মতই খেয়ে নিল সবটা। কতদিন এই যত্ন, এই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত সে। আবার সেই ভালোবাসার স্পর্শে বুকের ভেতরটা যেন তোলপাড় করে উঠছে। খুব ইচ্ছে করছে শিখার কোলে মাথা রেখে ওর মনের, ওর শরীরের সব জ্বালা জুড়োতে। কিন্তু তাতো হবার নয়। আজ সবচেয়ে কাছের মানুষটাই যে সবথেকে দূরে, সবথেকে পর।
একটা ভিজে কাপড় দিয়ে শিখা কৌস্তভের মুখটা মুছিয়ে দিতে গিয়ে দেখে, কৌস্তভের চোখে জল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো—-” তুমি কাঁদছো? কিছু হয়েছে?”
—–” না না, ও কিছুনা। চোখে হয়তো কিছু পড়ে গেছে।“— নিজের মনের ভাব আড়াল করবার জন্য লজ্জিত হয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিল কৌস্তভ। কিভাবে বোঝাবে শিখাকে, যে আজ আত্মগ্লানিতে তিলে তিলে ও একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে। শিখাকে আবার ফিরে পাওয়ার জন্য ওর শরীর, মন কতটা আকুল হয়ে উঠেছে?
একজন নার্স কেবিনে ঢুকে শিখাকে উদ্দেশ্য করে বলল—-” ডাক্তারবাবু বলেছেন, আজ ওঁনাকে ওয়াকারে একটু হাঁটাতে। যতটুকু উনি পারবেন, একটু হাঁটাবার চেষ্টা করুন।“
প্রত্যুত্তরে শিখা হেসে সম্মতি জানালো।
তারপর কৌস্তভের দিকে ফিরে বলল—-” শুনলে তো, নার্স কি বলে গেল। একটু হাঁটতে হবে।“
—–” মনে হয় পারবোনা শিখা। পায়ে এখনও বেশ ব্যথা, মাথাটাও ঘুরছে।“
—-” একটু চেষ্টা কর কৌস্তভ। মনে জোর আনো। আমি তোমায় সাহায্য করছি।“—– বলে কৌস্তভকে ধরে আস্তে আস্তে বেড থেকে নামালো শিখা। আজ কতদিন বাদে নিজের শরীরে দীপশিখার কোমল হাতের সেই আকাঙ্খিত স্পর্শটা পেল কৌস্তভ। যে স্পর্শ ফিরে পাওয়ার জন্য ওর মন আজ কাতর হয়ে উঠেছে। পুরোন ভালোলাগার সেই ছোঁয়া, মননে অনুভব করলো দুজনেই। এক শিহড়ণ যেন তড়িৎবেগে ছড়িয়ে পড়ল, এক শরীর থেকে আরেক শরীরে। দুহাতের বেষ্টনীতে শিখাকে জড়িয়ে, একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে কৌস্তভ। অনেক কিছুই যেন বলতে চাইছে দুচোখের ভাষায়। হৃৎস্পন্দনের অবাধ্য ওঠানামায় মনে হচ্ছে, শিখার কাছে আর লুকোতে পারবেনা ওর মনের অবস্থা। ঘোর কাটলো শিখার ধমকে।
—–” কী হলো, দাঁড়িয়ে রইলে কেনো? হাঁটবার চেষ্টা করো।“
দীপশিখার কাঁধে ভর দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাল কৌস্তভ। কিন্তু ক্রমশ শরীরটা বেশ কাহিল হয়ে পড়ছে। কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে। শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করেছে। পায়ের ব্যথাটা বাড়ছে ক্রমশ, ঘামে সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে, নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। কৌস্তভের অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে শিখা বলল—-” কৌস্তভ শরীরটা খারাপ লাগছে তোমার? কষ্ট হচ্ছে? তবে আর হেঁটে কাজ নেই। চলো, শুয়ে পড়ো এবার।“
আস্তে করে কৌস্তভকে বেডে শুইয়ে দিল শিখা। শুয়ে ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে নিল কৌস্তভ। বুকের ওঠাপড়া তখনো থামেনি। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। ক্রমাগত মাথায় বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো শিখা।
চিন্তিতভাবে বলল-” একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর কৌস্তভ। আমি ডাক্তারবাবুর সাথে একটু কথা বলে আসি।“
তৎক্ষণাৎ শিখার দুটো হাত শক্ত করে চেপে ধরল কৌস্তভ। কাতরভাবে বলল —–” আমায় ছেড়ে যেওনা শিখা। একটু বসো প্লিজ।“
—–” যাবনা আমি কৌস্তভ। এতটা কেন অস্থির হয়ে পড়ছো তুমি? এই দেখ, তোমার পাশেই আমি বসে আছি। তুমি এবার একটু ঘুমোও। নাহলে শরীরটা খারাপ হবে যে।“
শিখার হাতদুটো নিজের বুকের ওপর নিজের দুহাতের মুষ্টিতে আবদ্ধ করে, আবার চোখ বুঝলো কৌস্তভ।
কৌস্তভের মুখের দিকে উদ্বিগ্নমুখে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে দীপশিখা। বহুদিন বাদে এত কাছ থেকে সে কৌস্তভকে দেখছে। ভীষণ চোখে পড়ছে কৌস্তভের চেহারার পরিবর্তনটা। মুখের চোখের চেহারায় কী আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। মুখের সেই সৌন্দর্য আর নেই বললেই চলে। সেই লাবণ্য যেন কোথায় উধাও। দুচোখের কোলে কালি। মুখের সবটা জুড়ে কেমন বিষন্নতার ছাপ। কিন্তু কেন কৌস্তভ? তুমি যে জীবন চেয়েছিলে, তোমায় তো সেই জীবনই উপহার দিয়েছি আমি। স্ত্রী, পুত্র, সংসারের দায়িত্ব থেকে তো তোমায় মুক্তি দিয়েছিলাম। তাহলে আজ এই অবস্থা কেন তোমার? কিসের অতৃপ্তি তোমার মনে?
তবে বেশ বুঝতে পারছে, কৌস্তভের শরীরের অবস্থা মোটেও ভালো নয়। ওর পুরোপুরি সুস্থ হতে এখনও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।
দীপশিখা নার্সিংহোম থেকে ঘরে ফিরে দেখে, পরিত্রাহি কাঁদছে ছেলে। আর টুলুমাসি সারা ঘর ঘুরে ঘুরে ওকে ভোলাবার চেষ্টা করছে।
—–” কি হয়েছে টুলুমাসি, কাঁদছে কেন রণ?
——” আর বোলোনা দিদিভাই। তোমার বীর ছেলে বড় কালো পিঁপড়ে দেখে তাকে মারতে গেছে। আর হারবজ্জাত পিঁপড়ে কচি ছেলের হাতটা কামড়ে দিলে। কচি হাতটা কেমন লাল হয়ে ফুলে উঠেছে, দেখ দেখি।“
শিখা হেসে রণকে কোলে নিতে নিতে বলল—-” পিঁপড়ের আর দোষ কি? সবারই আত্মরক্ষার অধিকার আছে। এই বীরপুরুষটি যদি তার ঠেলা সামলাতে না পারে, তাহলে ওই অসহায় পিঁপড়েই বা কী করবে? এবার তুমি আমায় যাহোক কিছু ক্ষেতে দিয়ে দাও টুলুমাসি। আর দেরি করোনা। আমার স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে একবার শাশুড়িমায়ের সাথেও দেখা করে যাব। কৌস্তভের ব্যাপারে কিছু কথা মায়ের সাথে আলোচনা করতে হবে।“ (ক্রমশ)