ব্রোকেন হার্ট পর্ব-১৩

0
851

#ব্রোকেন_হার্ট
লেখা : মান্নাত মিম

|১৩|
“কথায় আছে, সব চাওয়ারই পাওয়া হয় না। সুখ কপালে লিখা থাকলেও অনুভব ব্যতিত তাকে জীবনে ধরে রাখা যায় না। এক প্রহরে সুখ থাকলেও আরেক দীর্ঘ রজনী কেবল দুঃখের ভাগের হয়।”

থেমে ফের আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো এন্ডারসন। তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার কম্পমান হাত-পা কি তার চোখে ধরা পড়ছে? কিংবা অসাড়ে হওয়া হৃদয়? হয়তো পড়ছে নাহলে কেন এখন আমার গা ঘেঁষে বসে হাঁটুর ওপর কাঁপতে থাকা হাত সে তার মুঠোয় পুরে নিবে। আমার চোখ দিয়ে অঝোর ধারা বৃষ্টি বর্ষণ তখন। আবেগি আবেশে সে তার বুকে লেপ্টে নিলো৷ বেশখানিক কাঁদলাম, সময় গড়ালে থামলাম একপর্যায়ে। ঝড়ো তুফানের পর পরিবেশটা যেমন হয়, ঠিক তেমন শান্ত, ক্লান্ত। সরে আসতে চাইলাম এন্ডারসনের বুক থেকে। কারণ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, হয়তো আমাকে খোঁজা শুরু করে দিয়েছে ক্রিশ্চান ও ভেরোনিকা।

“ছাড়ুন বলছি।”

“এই একটা মাস আমার কাছে এক বছরের সমান মনে হয়েছে, ইমোজিন।”

এন্ডারসনের কণ্ঠে আমার নামটা বড্ডো নেশালো শুধালো, হৃদকম্পন হলো ছলকে উঠলো রক্তকণিকারা; বেঈমানি করছে, বেঈমানি করছে আমার মন আমার’ই সাথে। কিন্তু তাতে নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয় নিহিত। তাই দ্রুত গুটিয়ে নেওয়ার ভঙ্গিমায় ছুটে আসতে চাইলাম তার থেকে। নাহ, শক্তিতে তো কখনোই পারব না৷ আর না বেশিক্ষণ নিজের অনুভূতি থেকে।

“আপনি ধোঁকাবাজ। ছাড়ুন নাহলে চিৎকার-চেঁচামেচি করব।”

মাথা উঁচিয়ে এবার চোখ মটকে বলেও ফেললাম। তবে কথা হলো, আশপাশ নির্জনতা ধরে রয়েছে, চিৎকার করে লাভ হবে বলে মনে হলো না। এদিকে আসলেও কি আমি চিৎকার করব? উত্তর, না। সেটা যেন জানত এন্ডারসন। তাই আমাকে ছেড়ে গা দুলিয়ে উচ্চস্বরে হাসতে লাগল। এত সুদর্শন দেখতে লাগল তাকে চোখ ফেরানো দায়, সাথে মন-ও। কিন্তু যে আমার হবার নয়, শুধু শুধু মায়া বাড়ানোতে লাভ কী? ফিরিয়ে নিলাম চোখের দৃষ্টি। চলে আসতে নিলে হাত ধরে আঁটকে দিয়ে বলল,

“ভালোবাসার দাবি নিয়ে দাঁড়ানোর সময় কি এখনো আছে?”

এতকিছুর পরেও কি আসলেই আছে? উত্তর আমি নিজেও জানি না৷
______

গাড়িতে সেই একই সিটে বসে ফিরে আসছি লোকালয়ে। একপ্রকার আসতে বাধ্য হয়েছে ক্রিশ্চান ও ভেরোনিকা আমার জোরাজুরির কারণে। কেমন গুমোট হাওয়া বইছে গাড়ির ভেতরে! অথচ ঘুরতে আসার সময়টাতেও কতটা আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠা উপভোগ্য সময় ছিল। কিন্তু এখন যাওয়ার সময় তার উলটো। সিটে মাথা হেলিয়ে বাইরে মুখ ঘুরিয়ে ছলছল করে আটকে রাখা চোখের জল ছেড়ে দিলাম। মনে পড়ে গেল এন্ডারসনের সাথে দেখা হওয়ার ক্ষণকাল।

ভেরোনিকাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করলাম। মেয়েটা ফিরে গেল পিকনিকের জায়গাটাতে। আমি ঠায় বসে আনমনে নানা কিছু ভাবনায় জর্জরিত লেকের জলের দিকে তাকিয়ে। তখন হঠাৎ করে নিজের পাশে কারো অস্তিত্বের আভাস মেলে। ঘাড় ঘুরিয়ে এন্ডারসনকে দেখতে পাই। নির্বাক চাহনিতে নিস্তেজ হয়ে আসা শরীর জড়বস্তুর মতো নিয়ে ওঠে দাঁড়াই। তার দিকে না এগিয়ে উলটো এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে শুরু করি। জানিও না কেন, আবার হয়তো জানি। আগের মতোই ছেড়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত হওয়ার কারণ হতেও পারে। যতোটা পিছিয়ে তার থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টারত আমি, সে ততোটা পথ এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে আমায় ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টায় রত। পিঠ ঠেকে গিয়ে গাছের সাথে। এন্ডারসন এগিয়ে এসে আমার চোখে চোখ রাখে। আমি মনে মনে প্রার্থনা করি ইশ্বরের কাছে, এ যেন ভ্রান্ত ধারণা হয়। মিথ্যে হয় তার ছায়া যেন কায়া হয়ে। কিন্তু নাহ, তার অস্তিত্বকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সে সন্তর্পণে আদুরে স্পর্শ দু’হাতের আঁজলা ভরে আমার মুখ তুলে ধরে। এন্ডারসন এর আগেও দু’বার আমার কাছে এসেছিল। প্রতিবারই আমাকে অনুভূতির চূড়ান্তে নিয়ে ছেড়ে গেছে এ-ও জানি। তবে সেখানে একটা বিষয় ছিল, সে কখনো আমার ওষ্ঠ চুম্বন করেনি আর না আমি। কিন্তু আজকের এই চুম্বন স্বর্গীয় অনুভূতির মতোন হলেও হতে পারতো। পারত বলার কারণ, আমার এতদিনের জমিয়ে রাখা অনুভূতি কঠিন পদার্থে রূপ নিয়েছে। সেটা এক লহমায় গলে যাওয়ার মতোন নয়। এন্ডারসনের স্মুথলি দীর্ঘায়ত চুম্বন দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। দু-হাতের শক্ত ও জোরালো ধাক্কায় সরিয়ে দিলাম। কারণবিহীন জল গড়াতে লাগল চোখ দিয়ে। আসলেই কি কোন কারণ ছিলো না? আমি সেসব ভাবনা ভাবার নিয়ন্ত্রণে নেই। এতক্ষণ ধরে রাখা অবশতা ভাব শরীর ছেড়ে দিলাম মাটিতে। আমার মুখ বরাবর এক হাঁটুর ওপর বসেই তখনকার কথাগুলো বলেছিল এন্ডারসন। অতঃপর এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে তার শরীরের গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছিল আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কিন্তু আমি নিরুপায়, বাস্তবতার কষাঘাতে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া শক্ত হৃদয়হীনা সরে আসি। সরে আসি, ফিরে আসি তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে।
________

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল ছিল না। গাড়িতে আমার অবশ্য ঘুমের অভ্যাস নেই। ক্লান্ত, কান্নারত শরীর কি না তাই ভাবনাতে বিভোর হয়ে ঘুম ঝেঁকে ধরেছিল। নিজের বাড়ির সামনে গাড়ি থামানো দেখতে পেয়ে সামনের সিটে চোখ গেল। ক্রিশ্চান একা, ভেরোনিকা নেই। দু’জনেরই বাড়ি আগে তারপর আমারটা আসে। হয়তো ভেরোনিকা নেমে পড়েছে বেচারা আমায় ঘুমে দেখে আর বাড়ি হাঁটা পথ দেখে আমাকে নামিয়ে দিয়ে ফিরতি পথে বাড়ি যাবে। হাহ্! ঋণের বোঝা আর কত?

“এন্ডারসনের সাথে তোমার এত কীসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক?”

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো কথাটা শুনালো আমার কর্ণকুহরে। এত কঠিন পদার্থে ঘেরা শীতল কণ্ঠ আমার অন্তরাত্মাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ ক্রিশ্চান গম্ভীরমুখে এন্ডারসনের কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? তাও এমনতর প্রশ্ন যাতে স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে, আজকে বোধহয় এন্ডারসনের আগমন এবং তার সাথে ঘনিষ্ঠাবস্থায় আমাকে ক্রিশ্চান দেখেছে। দলা পাকিয়ে গলায় শব্দরা জটলা বেঁধেছে। বহু কষ্টে জবাব এলো,

“কোন সম্পর্ক নেই।”

তিন শব্দের ছোটো উত্তর ক্রিশ্চানকে মনে হয় সন্তুষ্ট করতে পারল না। এতক্ষণ সমুখ পানে মুখ করে থাকা ক্রিশ্চান আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,

“আমার চোখকে অবিশ্বাস করতে বলছ?”

নিজের চক্ষুদ্বয় খিঁচে বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নিলাম। বহুকষ্টে এন্ডারসনের জন্য থাকা ভালোবাসা তালাবদ্ধ করেছি। তার আগমনে এখন সবকিছুই এলোমেলো হচ্ছে দেখি।

“সত্যি বলছি কোন সম্পর্ক নেই। আর না হতে পারে। তুমি-ই তো বলেছি একদিন, না?”

কথাগুলো বলে চোখ মেলে ক্রিশ্চানের চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললাম। ক্লাবে বসে আমাকে সে আমাকে এটাই বুঝিয়েছিল একসময়।

“তোমার চোখ কিন্তু অন্য কথা বলে, জানো?”

স্মিত হেসে ক্রিশ্চান কথাটা বলে থামল। আমি চোখ নামিয়ে ফেললাম। ধরা পরার ভয়ে। তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম।

“কাল দেখা হবে। সাবধানে বাড়ি যাও।”
__________

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here