ভালবাসা বাকি আছে পর্ব-৫

0
373

#ভালবাসা_বাকি_আছে – ৫
Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা

সকালে বুশরার সাথে কথা বলার পর থেকে চিন্তিত শিউলি বেগম। ছেলেটা না খেয়ে বেরিয়ে গেছে দেখে একটু রাগ হয়েছিলেন। কিন্তু বুশরার সাথে কথা বলার পরে রাগটা নেই, বরং চিন্তা হচ্ছে খুব। এমন তো করে না ছেলেটা। উনি ফোন করেছিলেন কয়েকবার। সাড়া পানিনি তাতে। রায়হানের পার্টির দুএকটা ছেলেকে ফোন করেছিলেন, বেশিরভাগ সময় রায়হানের সাথেই থাকে ওরা। কিন্তু সেই ছেলেগুলোও ফোন ধরছে না। চিন্তার উত্তোরোত্তর বৃদ্ধিতে প্রেশার হাই হয়ে গেছে বোধহয়। সমানে ঘামছেন তিনি। রুস্তম শেখ বারবার বুঝানোর চেষ্টা করছেন যে কিছু হয়নি, হয়ত জরুরি কোন মিটিং চলছে তাই ফোন ধরতে পারছে না। তাতে মায়ের মন কতটুকু শান্ত হয়বতা বলার অপেক্ষা রাখে না।

স্ত্রীকে বারবার ঘর বাহির করতে দেখে একসময় তিনি বললেন, “এমন করো না তো। শরীর খারাপ করবে তোমার।”

শিউলি বেগম ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন, “ছেলেটার কোন খোঁজ নাই আর তুমি আছো আমার শরীরের টেনশন নিয়ে।”

ভেতরে ভেতরে ভীষণ টেনশন হলেও মুখে বললেন, “আচ্ছা আমি কোন টেনশন নিয়ে নাই, তুমিও টেনশন করো না। তোমার ছেলে যথেষ্ট বড় হইছে, কি দায়িত্বশীলভাবে রাজনীতি করতেছে কয় বছর হলো। এখনো যদি একটু ফোনে না পাইলেই টেনশন করো তাহলে হবে? টিভিটা ছাড়ো তো। একটু খবর দেখি।”

“উনার ছেলের খবর নাই, উনি আছেন দেশ বিদেশের খবর নিয়ে। যত্তসব।”

টিভিটা অন করে দিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু সেই সময় টিভি থেকে কানে আসলো একটা অনাকাঙ্ক্ষিত খবর। ঘুরে এসে রুস্তম শেখের পাশে বসলেন তিনি।

“এজন্যই তাহলে আমার ছেলেটাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না!!”

“হুম।”, গম্ভীরমুখে স্ত্রীর কথায় সায় জানালেন বয়স্ক মানুষটা।

সেই কোন সকালে রায়হান বলেছিল এম মিনিট পরে ফোন করছি। তারপর কেটে গেছে কয়েক ঘন্টা। অভিমান গড়িয়ে অস্থিরতায় রূপ নিয়েছে, তবু মানুষটার খোঁজ নেই। তাইতো কাংখিত ফোনকলটা পাওয়া মাত্র স্থান কাল পাত্র ভুলে ব্যাকুলতা উপচে পড়ে বুশরার কন্ঠে।

“হ্যালো….. ”

“সরি তোমাকে অনেক অপেক্ষা করালাম। কলব্যাক করতে একদম ভুলে গেছিলাম। প্লিজ রাগ করো না।”

যে অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে এতক্ষণ বুশরা গেছে তাতে অন্য সময় হলে হয়ত ও সত্যিই রাগ দেখাতো। কিন্তু এত দুঃশ্চিতার পর রায়হানের কন্ঠ শুনে যে শীতলতা অনুভব করলো তাতে রাগের আগুন নিভে গেছে নিমেষেই। তবে রায়হানের কন্ঠে কিছু একটা আছে যাতে বুশরার মনে হলো কোন একটা সমস্যা হয়েছে। তাছাড়া ও কখনো এমন বেখেয়ালি আচরণ করে না।

“তুমি ঠিক আছো? কোন সমস্যা হয়নি তো?”, অস্থিরভাবে প্রশ্ন করলো বুশরা।

একটু সময় নিয়ে রায়হান বললো, “আমি ঠিক আছি। চিন্তা করো না। তোমার ক্লাস নাই?”

“হুম ক্লাস আছে একটু পর। তোমাকে খুব ক্লান্ত শোনাচ্ছে।”

“হায়দার চাচা সকালে হার্ট এটাক করেছে। আইসিইউ তে এখন। খুব ক্রিটিকাল কন্ডিশন।”

“আলী হায়দার চাচা? মানে এমপি সাহেব?”

“হ্যাঁ, তোমাকে কতবার বলেছিলাম হায়দার চাচা কি নিঃস্বার্থভাবে সারা জীবন এলাকার মানুষের জন্য করে গেলেন। আজকে দেখো, মানুষটা অসহায়ভাবে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে। কত ভালবাসতেন উনি আমাকে, কত সময় কতভাবে সাহায্য করেছেন, অথচ আজ কিচ্ছু করতে পারছি না উনার জন্য। সকালে খবরটা শোনার পর তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছি, তোমাকে যে অপেক্ষায় রেখেছি মনেই ছিল না।”

এতক্ষণে রায়হানের মানষিক অবস্থার কারণ টের পেলো। আলী হায়দার মানুষটার প্রশংসা বুশরা অনেকের কাছেই শুনেছে। কিন্তু রায়হানের কাছে এই মানুষটা দেবতুল্য। রাজনীতি জগতে আরো কয়েকজন আলী হায়দার থাকলে দেশটার চেহারা বদলে যেত বলে মনে করে রায়হান। আর ব্যাক্তিগতভাবেও বয়োবৃদ্ধ এই মানুষটাকে খুব পছন্দ করে রায়হান।

উনার একটাই ছেলে, পড়ালেখা শেষে বিদেশে সেটেল্ড, কয়েক বছর পরপর দেশে আসে, অল্প কয়েকদিনের জন্য। তা নিয়ে তার আক্ষেপের শেষ নেই। খুব চেয়েছিলেন ছেলে তার মত দেশ সেবায় নিয়োজিত হোক, তবে আর পাঁচটা বাবার মত জোর করতে চাননি। আর দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ এসব তো জোর করে আদায় করার জিনিস না। তাই হয়তোবা তার সাথে আদর্শিকভাবে মিল থাকা রায়হানকে সন্তানতুল্য ভালবাসা, দিকনির্দেশনা দিয়ে এসেছেন বিগত বছরগুলোতে। সেই মানুষটা আজ হঠাত গুরুতর অসুস্থ হওয়াটা রায়হানের জন্য বিশাল বড় ধাক্কা তা বুঝতে অসুবিধা হয়না বুশরার। তাই শব্দভান্ডার হাতড়ে শান্তনার ভাষা খুঁজে পায়না ও।

কিছু মুহুর্ত নিরবতার পরে বুশরা জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কি হাসপাতালে?”

“হ্যাঁ, উনাকে নিয়ে ছোটাছুটি করার মত কেউ তো নাই।”

“উনার ছেলে কি রওনা দিয়েছে?”

“ঘন্টাখানেক আগে প্লেনে উঠেছে। কাল সকালে ল্যান্ড করবে বোধহয়।”

একটু থেমে রায়হান বললো, “আমার খুব খারাপ লাগছে বুশরা। মানুষটা মারা যাওয়ার আগে বোধহয় ছেলের মুখটা দেখতে পাবে না আর।”

“এত নেগেটিভ ভাবছো কেন? উনি হয়ত সুস্থও হয়ে যেতে পারেন তাই না? দুয়া করো।”

“ইনশাআল্লাহ। তুমি ক্লাসে যাও। পরে কথা হবে। রাখছি কেমন?”

“আল্লাহ হাফেজ।”

ফোনে কথা বলতে বলতে এলোমেলোভাবে হাটছিল বুশরা। ফোন রাখার পরে খেয়াল করলো ক্লাস যে বিল্ডিংয়ে হবে তার থেকে অনেকটা উল্টো পথে চলে গেছে ও। অগত্যা হাটা শুরু করলো আবার। রায়হানের সাথে কথা বলে মন খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ওর। এসময় মানুষটার পাশে থাকতে পারলে খুব ভালো হতো। আবার চিন্তা করে পরিবারের কারো কিছু হলে আলী হায়দার সাহেবের ছেলের মতই অবস্থা হবে ওর। কুচিন্তায় মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয় বুশরার। নিজেকে বুঝায়, আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। দুয়া করলো সকলের সুস্থতার।

বুশরা ক্লাসের সামনে এসে বুঝলো টিচার চলে এসেছে ইতোমধ্যে। চুপচাপ পেছনের সারির একটা ফাঁকা ডেস্কে গিয়ে বসলো ও। খুব ইম্পর্ট্যান্ট আজকের ক্লাসটা, তাই খুব চেষ্টা করলো মনোযোগ দেওয়ার। তাতে কতটুকু সফল হলো সেটা বেশ প্রশ্নবিদ্ধ।

ক্লাশ শেষে উঠে যাবে এমন সময় পাশের সিটের স্টুডেন্ট বলে উঠলো, “হোয়াট এ কোয়েন্সিডেন্স! আমরা তার মানে ক্লাসমেট?”

স্বল্প সময়ের ব্যাবধানে আরিশকে আবার দেখে বিরক্ত হলো বুশরা। তবে সেটা প্রকাশ না করে মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে বললো, “স্ট্রেঞ্জ! ফলো করছেন নাকি?”

ভ্রু নাচিয়ে আরিশ বললো, “কে যে কাকে ফলো করছে বলা মুশকিল। আমি কিন্তু ক্লাসে লেইট করিনি। স্যার আসার আগেই মনযোগী স্টুন্টের মত ক্লাসে এসে বসেছি।”

ইংগিতটা ধরতে পেরে লজ্জিত হলো বুশরা। ইতস্তত করে বললো, “এক্সট্রেমলি সরি।”

আরিশ ছেলেটা সিরিয়াস টাইপের না। তাই এত অল্পেতে সরি হজম করা ওর ধাতে নেই।

“আহা সরি কেন মিস?”

“ক্যাফেটেরিয়ায় ওভাবে হুট করে ফেলে আসার জন্য, আর এখন আবার অযথা আপনাকে একিউজ করার জন্য।”

একটু থেমে ছেলেটার চোখে চোখ রেখে বুশরা বললো, “ও হ্যাঁ, আমি মিস না। মিসেস। মিসেস বুশরা শেখ। নাইস টু মিট ইউ, আরিশ।”

চলবে…

#ডাক্তার_মিস – সিকুয়েল
#ভালবাসা_বাকি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here