ভালবাসা বাকি আছে পর্ব-৬

0
404

#ভালবাসা_বাকি_আছে – ৬
Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা

“ও হ্যাঁ, আমি মিস না। মিসেস। মিসেস বুশরা শেখ। নাইস টু মিট ইউ, আরিশ।”

বুশরার অপ্রত্যাশিত উত্তরে কেন জানি খেই হারিয়ে ফেলে আরিশ। তবে তা বিচক্ষণ ছেলেটা তা এক মুহুর্তেই কাটিয়েও উঠলো।

মজা করে বললো, “মিঃ শেখের জন্যই তাহলে সকাল থেকে এই উচাটন? ভদ্রলোক তো ভারি ভাগ্যবান।“

কথা বলার ধরনে হেসে ফেললো বুশরা। সম্মতির হাসি উপচে পড়লো যেন বুশরার চেহারায়। তাতে কি ছেলেটার চেহারার রঙ একটু বদলালো? কি জানি!!

আরিশের আচরনে কোথাও না কোথাও যেন ওর মনে হচ্ছিল যে হঠাত পরিচিত ছেলেটা হয়ত ওর প্রতি অযাচিত আগ্রহ দেখাচ্ছে। আর তাই আগ্রহের মাত্রা বাড়ার আগেই নিজের বিবাহিত পরিচয়টা জানিয়ে দিল। ঝামেলামুক্ত থাকার একটা প্রচেষ্টা আর কি। তবে তাতে বিচলিত নয় আরিশ আহমেদ।

হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে বললো, “ক্যান উই বি ফ্রেন্ডস?”

একটু আগের অসস্তি কাটাতে বুশরা বললো, “ইয়াহ… হোয়াই নট।“

তবে হ্যান্ডশেক করলো না। শুন্য থেকে হাত ফিরিয়ে নিল আরিশ। একটু বিব্রতও হলো।

ডার্ক এন্ড হ্যন্ডসাম বলতে যা বোঝায় আরিশ তাই। হাইট ভালো। সিক্স প্যাক না হলেও সুঠাম দেহের অধিকারী। শ্যামসুন্দর চেহারা। কালচে চোখের মনি কাকচক্ষু দিঘীর জলের মত স্বচ্ছ। সুন্দরী মেয়েরাই সাধারনত যেচে পড়ে কথা বলে ওর সাথে। কোন রকম প্রত্যাখ্যান তার ডায়েরীতে নেই। সেখানে বুশরা নামের মেয়েটা ওকে সেরকম পাত্তাই দিচ্ছে না।

বিবাহিত তাতে কি হয়েছে, বন্ধু তো থাকতেই পারে। তাতেও এমন প্রত্যাখ্যান। ব্যাপারটা ইগোতে লাগে আরিশের। প্লাস্টিক হাসি চেহারায় ঝুলিয়ে তখনকার মত বিদায় নিল তাই। “এমন মেয়েকে বাগে আনার থিওরি ভালই জানা আছে আমার, যাস্ট ওয়েট এন্ড সী”, মনে মনে ভাবে আরিশ। তারপর হনহন করে চলে গেল।

আরিশের যাওয়ার পথে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল বুশরা। এই মুহুর্তে এসবে মনযোগ নেই ওর। ফোনটা বের করে রায়হানকে টেক্সট করলো, “ঠিক আছো তুমি?”

ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসলো না। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে পরের ক্লাসের শিডিউল চেক করলো বুশরা। ঘন্টাখানেকের একটা ব্রেক আছে দেখে ফোনটা ব্যাগে পুরে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাটতে লাগলো। মানুষটা কি করছে কে জানে। এমন সময় ফোনের বেসুরো রিংটোনটাও মধুর মনে হলো বুশরার কাছে। মন বলছে কাঙ্খিত মানুষটাই ফোন করেছে। তবে মস্তিস্ক বলছে শুধু শুধু আশা করে কষ্ট পাবে তো বুশরা। যাইহোক, মন আর মস্তিস্কের মধ্যে প্রথমজনই জয়ী হলো। তড়িঘড়ি ফোন ধরলো ও। তবে ওপাশ থেকে কোন কথা কানে এলো না কিছুক্ষণ। বুশরাও নিরব থেকে মানুষটাকে কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার কিছুটা সময় দিল। একসময় নিরবতা রায়হান নিজেই বললো,

“তোমার ক্লাস শেষ?”

“হুম। কোথায় তুমি?”

“হাসপাতাল থেকে বের হলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার ওখানে।“

“একটু শান্ত হও প্লিজ।“

“পারছি না কিছুতেই। মনের মধ্যে কি যে তোলপাড় হচ্ছে। কাউকে বোঝানো যাবে না।“

“চেষ্টা তো করে দেখো। আমি শুনছি। মনের কষ্টগুলো হালকা করে দাও। সব ভার একা বইতে হবে না আমি থাকতে।“

কিছুক্ষণ নিরবতার পর রায়হান নিজেই বলা শুরু করলো,
“আব্বা আর হায়দার চাচা এক প্লাটুনে যুদ্ধ করেছে। ছোটবেলা থেকে চাচার সাহসিকতার গল্প আব্বার কাছে শুনেছি। আর যখন নিজে রাজনীতিতে আসলাম এই মানুষটা আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছে। ছাত্র রাজনীতি করার সময় আমার লাগাম টেনে রেখেছে যাতে স্রোতে ভেসে না যাই। এমন ব্যক্তিত্ব, এমন আদর্শ চোখের সামনে দেখতে দেখতে আজকের আমি হয়েছি। একদম রুট লেভেলের রাজনীতি করেও যে আমি এলাকার চেহারা এতটা বদলাতে পেরেছি তার পেছনে কিন্তু এই মানুষটা বিশাল অবদান আছে। মানুষটা না থাকলে…”

বুশরা কিছু বললো না। শান্তনা দিল না। মাঝে মাঝে অপরপাশের মানুষের কথা মন দিয়ে শোনাটাই সবচেয়ে কাজে দেয়। ও এখন তাই করছে।

কিছুক্ষণ থেমে রায়হান কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “রাজনীতির কথা বাদ দিলেও এই মানুষটা মানুষ হিসাবেও আমার আদর্শ। অনেক অকারণ স্নেহ আমি পেয়েছি তাঁর কাছে। চাচা সম্ভবত বাঁচবে না বুশরা। ডাক্তাররা বলেছে লাইফ সাপোর্ট খুলে নিলেই…”

কথাটা শেষ করতে পারলো না রায়হান। কষ্টেরা দলা পাকিয়ে গলার কাছে বিঁধে আছে যেন।

“প্লিজ কাম ডাউন ডিয়ার। ডাক্তারদের কথাই কিন্তু শেষ কথা না। হায়াত মওত আল্লাহর হাতে। কাছে দুয়া করো আল্লাহ যেন উনাকে সুস্থ করে দেয়, অথবা কষ্টের জীবন না দিয়ে দ্রুত জান্নাতবাসী করে। প্রিয় মানুষটাকে অযাচিত অবস্থায় দেখতে নিশ্চয় চাইবা না তুমি। দুয়া করো। সন্তানের দুয়া বাবার জন্য কাজে দেয়। আর চাচা তোমাকে নিজের সন্তানের চেয়ে খুব কম ভালোবাসেননি তো রাখেননি। তাই না? অনেক দুয়া করো, একটু শক্ত হও।”

“থ্যাঙ্ক ইউ বউ।“

“ওয়ার্ড তিনটা একসাথে যাচ্ছেনা মিঃ চেয়ারম্যান।“

দুঃখের মধ্যেও হাসলো রায়হান। এই মেয়েটার মাঝে অন্যরকম একটা চার্ম আছে। কিভাবে যেন বহতা নদীর মত শান্ত করে দেয় মনের মধ্যে ভেঙ্গেচুরে আসা জলোচ্ছ্বাসের দামামা। কপালগুনে এমন জীবনসঙ্গী পাওয়া যায়। শুকরিয়া আদায় করে তাই মনে মনে।

“আচ্ছা ফিরিয়ে নিলাম। ঠিক আছে?“

হালকা হেসে বুশরা বলল, “হ্যাঁ। তবে চাইলে এক্সচেঞ্জে অন্য তিনটা ওয়ার্ড বলতে পারো।“

“কি?”

মানুষটার মন কিছুটা ডাইভার্ট করার জন্য একটু দুষ্টুমি করে বুশরা বলল, “দ্য থ্রি ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ডস।“

ইঙ্গিতটা খুব কঠিন না। টিনএইজের ছেলেমেয়েরাও জানে থ্রি ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ডস কি। তবে সে পথে গেলনা ত্রিশোর্ধ রায়হান।

বরং বিষন্নকন্ঠে বললো, “মিস ইউ ব্যাডলি।“

সংক্রামক বিষন্নতা ছড়িয়ে গেল হাজার হাজার মাইল দুরের মানুষটার কন্ঠেও।

কাঁপা গলায় সেও বললো, “মিস ইউ টু।“

টিনএইজ লাইফের পোলাপান থ্রি ম্যাজিকাল ওয়ার্ডস বলতে যা বোঝায় তার চেয়ে আলাদা হলেও দুজনের বলা শব্দত্রয়ীদুটোও কম ম্যাজিক্যাল না। এই ম্যাজিক দূরদুরান্তে থাকা দুই তৃষ্ণার্ত চাতকের বুকে মিষ্টি শীতলতা ছড়িয়ে দিল অজান্তেই।

কল কেটে যাওয়ার পরেও কিছুক্ষ্ণ ফোন কানে চেপে বসে রইলো রায়হান। কারন ফোনটা রেখে দিলেই আবার এক ঝটকায় বাস্তবের শক্ত পাথুরে জমিনে আছাড় খানে আবার। যেখানে তাঁর প্রিয় আলী চাচাকে নিয়ে জমে মানুষে টানাটানি চলছে। একই সাথে চলছে এক বিশেষ আলোচনাও। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন খুব বেশি সময় নেই তার হাতে। যেকোন সময় হয়ত ভবলীলা সাঙ্গ করবেন তিনি। আলী হায়দার সাহেবের মত এমন শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের শূন্যস্থান অপূরণীয়। তবে তাই বলে তো কিছু থেমে থাকবে না। তাই এমন একজন ক্যান্ডিডেট দরকার যে কিনা আলী হায়দার সাহেবের যোগ্য উত্তরসুরী হবে। তা না হলে এলাকায় ব্যাপক অরাজকতা নেমে আসবে খুব দ্রুত।

যে মানুষটা এখনো বেঁচে আছে তার রিপ্লেসমেন্ট খোঁজা নিয়ে পার্টির ব্যাপক উৎসাহ দেখে চরম গাত্রদাহ হচ্ছে রায়হানের। এত স্বার্থবাদী হয় মানুষ। অথচ কই, রায়হান তো পারছে না। কালকের মধ্যে নেক্সট টার্মের চেয়ারম্যান ইলেকশনের নমিনেশনের এপ্লাই করতে হবে। আজকের দিনটা তো শুরু হতে হতেই কোনদিন দিয়ে চলে গেল টেরই পেল না ও। কালও মানুষটাকে এই অবস্থায় হাসপাতালে ফেলে নিজের আখের গুছানোর কথা চিন্তা করতে পারছেনা ও। অথচ মানুষজন কি অবলীলায় আলোচনা, সমালোচনা, মিটিং, সেটিং শুরু করে দিয়েছে নেক্সট ক্যান্ডিডেট হওয়া নিয়ে। এই মানুষগুলোই কি সমীহ করে চলতো আইসিইউতে পড়ে থাকা মানুষটাকে।

রায়হান কিছুতেই ভাবতে পারছে না যে জলজ্যান্ত মানুষটাকে নিয়ে মানুষের চিন্তা নেই, চিন্তা তাঁর গদিকে নিয়ে। তাঁর পদ, তাঁর পাওয়ারই আজ মুখ্য। আহা মনুষ্য জীবন। আহা রাজনীতি।

চলবে…

#ডাক্তার_মিস – সিকুয়েল
#ভালবাসা_বাকি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here