ভুলবশত পর্ব-১২

0
1518

#ভুলবশত♥
#PART_12
#FABIYAH_MOMO🍁

সাগ্রত হকচকিয়ে আমার দিকে তাকালো। ভূত দেখলে যেমন মুখের ভাব হয় তেমন করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। রাত বারোটায় আমি মরার মতো ঘুমিয়ে থাকবো ঠিক এমনটাই ভেবেছে হয়তো। সাগ্রত এখনো আমার দিকে ঝুকে স্থির পানে তাকিয়ে আছে, আমি সাগ্রতের দিকে কপালকুচকে তাকালাম। ও নড়েচড়ে মাথা হালকা ঝাকিয়ে বেডের পাশে রাখা স্টিলের টুলে মাথা নুয়ে বসলো। আমি বুঝলাম সাগ্রত আমার দিকে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছেনা। চড় দেওয়ার ঘোর অপরাধে আসামীর মতো বসে আছে। আমি দারোগা আর ও আসামী। শরীরের অবষাদ অনেকটা কেটেছে তাই আর দেরি না করে বেডে দুহাতের তালুতে ভর করে ধীরেসুস্থে উঠে বসার চেষ্টা করলেও বসতে ব্যর্থ হই। পা দুটো আড়াআড়ি করে আসন সিস্টেমে বসার ইচ্ছে ছিলো আমার। সাগ্রত আড়চোখে সম্পূর্ন কারনামা খেয়াল করছে জানি। একটু কেশে গলা ঝেরে বলে উঠি-

–আপনি আমায় চড় কেন দিয়েছেন? অধিকার কোত্থেকে পেলেন? কে দিয়েছে আপনাকে অধিকার? কিসের দাপট আপনার! আপনি আমায় চড় মারবেন! চুমু দিবেন! কেন এসব করছেন? কি চাই মিস্টার সাগ্রত পরিস্কার কন্ঠে বলা যাবে??
সাগ্রত স্নেহার কথায় চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো। হাতের তালুতে আঙ্গুলের তর্জমা করছে সাগ্রত, কথা গুছিয়ে বলতে চেষ্টা চালাচ্ছে শত। কিন্তু কথা গুছিয়ে বলা তো দূর! শব্দ তৈরি করে বাক্য গঠনেই গুলিয়ে ফেলছে সব। স্নেহা কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের জবাব না পেয়ে বিরক্ত হলো। আবারো গলার স্বর তীক্ষ্ণ করে সাগ্রতকে বলে উঠলো-

–আপনি কিছু বলবেন সাগ্রত সাহেব! কিছু কি বলার জন্য আছে!!

সাগ্রত তবুও কিছু বলছেনা। এতে স্নেহা ক্ষেপে উঠলো। রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো-

–আমায় কি মেরে ফেলতে এসেছেন তাশরীফ সাগ্রত! স্পেশাল টাস্ক হিসেবে আমার লাশের চার টুকরা করে নদীতে ভাসাতে চাচ্ছেন! কে পাঠিয়েছে আপনাকে? আমার নানাবাড়ির কেউ…তাইনা??? ছোট মামা পাঠিয়েছে না??

মাথা তুলে তাকালো সাগ্রত। স্নেহা কথার বুলেট আরেক ছবক দিতে যেয়ে সাগ্রতের অসহায়ভাবে চাহনির দিকে আটকে গেলো। স্নেহা মুখ দিয়ে বাকি কথাগুলো বলার জন্য ঠোট নড়ালেও সাগ্রতের চাহনির জন্যে অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো। কিচ্ছু বলতে পারলো না। ঘটনাচক্রে সাগ্রত হুড়মুড়িয়ে স্থান ত্যাগ করে স্নেহার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। স্নেহা সাগ্রতের হঠাৎ ঝাপিয়ে পড়ার উপর চমকে উঠলো। ঘাড়ে সামান্য ব্যাথাও পেলো, অস্ফুট সুরে ‘আহহ্’ করে উঠলো। ব্যাথার আওয়াজ সাগ্রতের কানে পৌছালো না, সাগ্রত স্নেহাকে শক্ত করে চেপে নিঃশব্দে ফুপিয়ে উঠলো। স্নেহা সাগ্রতের দিকে ঘাড় বেকিয়ে মাথা নিচু করে তাকাতে পারছেনা। রাত বারোটায় ঘড়ির টিকটিক শব্দ ছাড়াও রুমে আরেকটি শব্দ যোগ হয়েছে। সেটা হালকা স্বরের ফুপিয়ে কাদার আওয়াজ। স্নেহা সাগ্রতের মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলে উঠলো-

–আপনি কাদছেন? কাদার মতো কিছু কি আছে? আপনাকে ছোট মামা পাঠিয়েছে আমাকে মারার জন্য কথা তো ঠিক বললাম। মেরে দিয়ে চলে যান। এতিম মানুষ আমি। আমার কেউ নেই। কেউ কেস- মামলা করবেনা।

সাগ্রত স্নেহাকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত কেবিনের জানালার কাছে গেলো। মুখ লুকিয়ে জানালার বাইরের দিকে ঘুরে দাড়ালো। স্নেহা উৎকন্ঠাবোধ করলেও সাগ্রতের হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে মুখ লুকানো ব্যাপারটায় নজর কাড়লো। সাগ্রত সাবধানতার সাথে হাত দিয়ে চোখ মুছে ফেললো। স্নেহা সাগ্রতের দিকে ধ্যানমগ্নে তাকিয়ে আছে। স্নেহা তার প্রশ্নের জবাব স্ব স্ব ভঙ্গিমায় পায়নি। সাগ্রত বহু কথা লুকাচ্ছে আচঁ করতে পারছে স্নেহা। সে ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো-

–শুনুন? একটু এখানে আসবেন? কথা আছে।

সাগ্রত নাক টেনে মাথায় হাত দিয়ে পেছনের দিকে চুলগুলো ঠেলে দিলো। স্নেহার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো স্নেহা তাকে নরমভাবে কিছু প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আশায় কাছে আসতে আদেশ করছে। সাগ্রত আর মানা করলো না, স্নেহার কাছে যেয়ে টুলে হাত দিয়ে বসতে নিলো। স্নেহা চটপটে সুরে বলে উঠলো-

–এই টুলে বসছেন কেন? এখানে আসুন। বেডে বসুন।

সাগ্রত টুলে বসতে যেয়ে থমকে গেল…স্নেহার দিকে একপলক তাকালো। তারপর স্নেহার কথানুযায়ী বেডে বসলো। স্নেহা তাকে বসার জন্য বেডের একটু বাপাশে চেপে বসলো। ডানপাশে ঠিক করে বসতে ইশারা করলো। দুজনেই বেডে চুপচাপ বসে আছে। নিরবতার মূহুর্ত চলছে। কেউ আগ বারিয়ে একটি প্রশ্ন করছে না। উভয়ই চুপটি মেরে বসে আছে। যেন মনের মধ্যে জবাবের আদানপ্রদান ঘটছে। এরই মাঝে চুপচাপ পরিবেশ তৈরি করে দুজনে বসে আছে। স্নেহার চন্ঞ্চল মনে আকুপাকু করছে ঝট করে কথারমালা বুনে সাগ্রতকে পরিয়ে দেওয়ার জন্য! আর সাগ্রত সেই কথারমালা গলায় নিয়ে একের পর এক সব উত্তরেরমালা স্নেহার দিকে উপহার দিয়ে দিবে। স্নেহা খানিকটা সময় বাদে বলে উঠলো-

–কাদছিলেন কেন? দেহের সোডিয়াম ক্লোরাইডের পরিমান কি বেড়ে গিয়েছিলো? শুধুশুধু কাদার মানে হয়? আমাকে মারতে এসে নিজেই কেদেঁ দেন!! আরে চিল ম্যান! আমাকে মারলে কষ্ট পাওয়ার কেউ নেই। সব মরে গেছে। মা ছিলো তাও বাবার বন্ধুর হাত ধরে ভেগে গেছে। সো..খুন করে পাচঁ টুকরা করে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দিবেন। গেম ফিনিশ!!

সাগ্রত আমার দিকে হা মেরে চোয়াল ইয়া লম্বা ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে। আমার দিকে এমনে তাকানোর মানে কি ভাই? ডরাই মুই!! তবে সত্য এটাই আমাকে মেরে দিলে দুনিয়াবী সব বন্ধন আর চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে যাবো। এরপর মৃত্যুর পরবর্তী জগতে যেয়ে নানা কর্মের জবাবদিহি করবো, প্রায়শ্চিত্ত করবো। সাগ্রত এখনো হাবার মতো হা করে তাকিয়ে আছে। কেবিনে মশা মাছির উপদ্রব বেশি হলে এখনই তার মুখে দুতিনটা মশা মাছি যেয়ে বিশ্রাম করে আসতো। আমি সাগ্রতের থুতনিতে হাত দিয়ে চোয়াল বন্ধ করে দিলাম। সাগ্রত ধ্যান কাটিয়ে চমকে উঠলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাথা ঠিক করে বসলো। আবারো পিনপতন নিরবতা বিরাজ করতে লাগলো। কিছু সময় পরে সাগ্রত আহত সুরে বলে উঠলো-

–স্নেহময়ী আমি তোমাকে খুন করতে এসে নিজেই খুন হয়েছি। আমার দ্বারা খুন সম্ভব না। আমি খুন করতে পারবো না। আমি খুন করতে পারি না! ভুলে গিয়েছি!

ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা হাসি দিলাম। হাসির কারন শুধু সাগ্রতের কথা। পেটভর্তি অবস্থায় যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, ভাই পোলাও কোরমা দেই? খান? তখন সে পেটের জমজমাটে হাত দিয়ে স্মরন করে বলবে, না ভাই খাওয়া ভুলে গিয়েছি। উটকো জবাবে মানুষের মাথা কত ডিগ্রিতে গোলচক্কর দিবে বলতে পারছি। কেননা আমার মাথাটা এখন চক্করের কাছাকাছি পর্যায়ে গিয়েছে। সাগ্রতকে সহজ গলায় বলে উঠলাম-

–আমার ফিগার দেখে মন বদলে গেছে ঠিক না? সমস্যা নেই। আমাকে টুকরো করার আগে মনের ইচ্ছা পূর্ণ করে নিয়েন, মরার পর আমাকে খুবলে যদি জঙ্গলি কুকুরও খায় তাতেও ক্ষতি নেই। হয়তো আমার অভাগী কপালে এসবই লিখা ছিলো, নাকোচ করার অধিকার তো কারোরই নেই। আমি আর কি জিনিস….মনের সব খোরাক পূরন করে নিয়েন কেমন?

আমার কথাগুলো অনেকের কাছে পাগলের কথা বলে আখ্যায়িত হতে পারে। কিন্তু মৃত্যু যখন এতো কাছে এসে বসে বসে বলছে, তোকে আমরা নিতে এসেছি। তখন আর কি করার থাকে? আমারও ঠিক সেরূপ বিবেচনা মনের মধ্যে কাজ করছে। আমি ভেবেছিলাম সাগ্রত আমাকে ফের দুটো থাপ্পর বসিয়ে ছাড়বে। কিন্তু হলো বিপরীত। সাগ্রত চুপ করে বসে আছে। ব্যথিত হরিণের ন্যায় মনটা ছোট করে নুয়ে আছে। আমার মন সাগ্রতের মুখে কথা শোনার জন্য আকুলিবিকুল করছে। সাগ্রতের প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব হচ্ছে। নাটক, সিনেমার মতো এটাই কি সেই ‘মহব্বত’ নামক টানের অনুভূতি নাকি নিছক অন্যকিছু? আমার মতো অভিজ্ঞতাহীন মেয়ের পক্ষে ধারনা করা মুশকিল। সাগ্রতের টিশার্ট চেন্জ করা হয়নি। কাজেই ওর দিকে তাকালে যে কেউ বলবে, সাগ্রতের বুক চিড়ে রক্ত পড়েছে। অবশ্য রক্ত শুকিয়ে কালচে রঙ ধারন করেছে। আমি জানি টিশার্ট থেকে রক্তের নিশান শক্ত করে লেগে থাকবে। সাগ্রত আমার অপেক্ষার প্রহর কেটে দিয়ে মুখ নিঃসৃত করে কিছু বলে উঠলো-

–তুমি জানো তুমি উন্মাদের মতো কথা বলছো? আমি তোমাকে কেন খুন করতে পারছিনা সেটা এখনো বুঝতে পারছো না? আমি একজন সিরিয়াল কিলার। মানুষ খুন করি। ভালো মানুষ না। তোমাকে আমি খুন করতে পারছিনা। তবুও তুমি ক্লিয়ারলি বুঝতে পারছো না? চার মাস আগে, ১১ই ফেব্রুয়ারি তুমি সিএনজিতে সাফার সাথে ভার্সিটি যাচ্ছিলে। তোমাকে শাপলা চত্বরে গান দিয়ে শ্যূট করতে টার্গেট দিয়েছিলাম.. তুমি জানো?(বুকের বাপাশে হাতের তালু বসিয়ে)এই হার্টবিটের সার্ডেন ফাস্ট হওয়াটা আমাকে নাভার্স বানিয়ে ছেড়েছে! আমি টার্গেট মিস করি! লাইফে ফাস্ট টাইম তাশরীফ সাগ্রত তার কিলিং শট মিস করে!! ফর দ্যা ফাস্ট টাইম! কার জন্য বলো তো? কার জন্য? স্নেহময়ী তোমার জন্য!আমি আমার শুটিং গ্যাংয়ে সবচেয়ে প্রোফেশনাল এন্ড পাক্কা শ্যূটার! আমি আমার সকল ডিলে বাজিমাত করে এসেছি! কেউ আমাকে ধরতে পারেনি! পুলিশ র‍্যাব কেউ না! সবাইকে আমি ধূলো দিয়ে চলি! কিন্তু…তোমার কাছেই আমি হেরে বসি! জানো? সাগ্রত যে ডিলে হাত দেয় সেটা কমপ্লিট করে ছাড়ে! বাট তোমাকে বিগত দুমাস ধরে মারতে পারছিনা! আমি কেন তোমায় খুন করতে পারছিনা এখনো কি না বুঝার আছে বলো ?

-চলবে

-Fabiyah_Momo🍁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here