ভুলবশত পর্ব-১৩

0
1315

#ভুলবশত♥
#PART_13
#FABIYAH_MOMO🍁

রাত দুইটার ঘরে ঘড়ির কাটা ছুয়ে বসেছে। আমার চোখে ঘুমের তলব নেই। ঘুম যেন উড়াল দিয়ে অতল সাগরে উবে গেছে। বেডে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। চোখ দুটো আটকে গেছে জানালার বাইরে কালো চাদরে ঢাকা সামাহীন আকাশের দিকে। আকাশে আজ চাদের জোৎস্না নেই। রুমের অন্ধকার বাইরের অন্ধকারের সাথে মিশে রয়েছে। মানুষ হত্যা করা পাক্কা হাতের সিরিয়াল কিলার আমার ঠিক সামনের সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। অন্ধকারের ঘণত্ব বেশি বিধায় রুমের মধ্যে কিছুই দৃশ্যমান নয়। সাগ্রতকে স্পষ্ট চোখে দেখাও সম্ভব নয়। ঘুটঘুটে অন্ধকারের দোটানায় দুইজন মানুষ রুমের দুদিকটায় শুয়ে-বসে আছে। আমার মামা জাকারিয়া মাসুদ। বয়সে মায়ের বড় এবং ছোট্ট ব্যবসায় নিজের দুইছেলে এবং পরিবারের সব অনটন সামলায়। মা ছিলো নানাভাইয়ের সবচেয়ে আদরের মুখ্যমণি। নানাভাইয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চরিত্রহীনা সাত বাজার হাতিয়ে চলা এক মেয়েকে বিয়ে করেন আমার মামা। মামার করা এই সামান্য ভুলেই নানাভাই তার সবচেয়ে আলোচিত সম্পত্তির ভাগীদার মায়ের নামে দিয়ে দেয়। শুরু হয় রেষারেষি। আমি তখন পাচ বছরে পর্দাপন করেছি, বাবা হার্ট স্ট্রোক করে মারা যান। বাবা যাওয়ার পর আমি নানার সাথে থাকলে মা এদিক দিয়ে বাবার বন্ধু জামিল আঙ্কেলের সাথে সম্পর্ক বাধান। একদিন স্কুল থেকে এসে শুনি মা একটা চিঠি ছেড়ে তার সব কাপড় নিয়ে পালিয়ে গেছে। নানাভাই কতটা মর্মাহত হন আমি জানি। নানাভাই অবষাদে ঢলে পড়েন। খাওয়া-দাওয়া ভুলেই যান। জীবনের সব কিছু এলোমেলো করে ঘটনার ঠিক ষষ্ঠদিনে অজস্র যন্ত্রণা এবং সমাজের কটু কথা শুনে শেষ দম ছাড়েন। নানী মারা যাওয়ার পর থেকেই মৃত্যুর দিন গুণতেন, কিন্তু শেষমেশ মায়ের কান্ডনামায় নানাভাই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া স্থায়ীভাবে বন্ধ করেন। বড় মামা বিদেশ থাকেন। বছরে একবার খোঁজ খবর রাখতেন। নানা মারা যাওয়ার পর খোঁজ নেওয়া তো দূর! আমরা দেশের মাটিতে কেউ আছি নাকি বিগত দশ বছরের মধ্যে আলাপন নেই। বাবা আমার ভবিষ্যত চিন্তায় যে উইল রেখে গিয়েছিলো তার খবর পেয়ে ছুটে আসেন ফুপি। ফুপির কাছেই বড় হতে থাকি। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় টাকা চাইলেই টাকা দিতে থাকি।কখনো এক মুঠে পাচ হাজার টাকা কখনো বা আড়াই হাজার। গেল বছরের ঘটনা। ক্যাম্পাসের বাস থেকে নেমে বাসায় ফিরার জন্য রিকশা করে আসছিলাম। পথে কোত্থেকে একটা মাইক্রোবাস আসলো পেছন থেকে ধুম করে ধাক্কা দিয়ে রিকশা উল্টে ফেলে দিলো। ঘটনাস্থলে আমি ছিটকে আরেক রিকশায় নিচে পড়ি, জমজমাট রাস্তায় রিকশা আমার পায়ের উপর দিয়ে তুলে দেয়। রিকশাওয়ালা মামার তৎক্ষণাৎ রাস্তার পাথরে আঘাত পেয়ে মাথা ফেটে গিয়েছিলো। হাতের কবজিতে হাড় ভেঙ্গেছিলো। আমি পায়ের ব্যথায় কাতরাতে থাকলে আশপাশের মানুষ ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রায় তিন সপ্তাহের কাছাকাছি হাসপাতালে থেকেছি। বাসায় ফিরে ছ’মাস পা উঠিয়ে বেড রেস্টে কাটিয়েছি। সাফা আপু আমাকে সেবা শুশ্রূষা দিতে থাকেন, আমি বহুদিন পর পা দিয়ে হাটতে শুরু করি।

ঘড়িতে আরো একঘন্টা পেরুলো। সাগ্রত ঘুমিয়েছে কিনা জানি না। আমি রাতটুকু ঘুমানোর জন্য এপাশ-ওপাশ করে ফিরতেই পারছিনা ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করছি। কাথাটা টেনে গলা পযর্ন্ত আনতেই কেউ নিচু স্বরে নরম করে বলে উঠলো-

–লাইফে কষ্ট আসতে হয়। কষ্ট না আসলে দুঃখ ভোগ করিনা। দুঃখ ভোগ না করলে শক্ত হয়ে উঠিনা। ঠিক না স্নেহময়ী? স্নেহময়ী জানো? আমি ছোট থেকে কারোর আদর পাইনি। আদর কি জিনিস এখনো বুঝি না। বুঝার ইচ্ছাশক্তি নিয়ে প্রতিদিন গভীর রাতে একবাক্য করে ডায়েরি লিখি। আমার একটা ডায়েরি আছে। তাতে দেখবে প্রচুর লিখা। আমি তো তোমাকে মারতে পারবো না স্নেহময়ী। আমার দ্বারা তো আদৌ হবে না। তুমি আমার মতো একটা খুনি ছেলেকে কখনো ভালোবাসতে পারবে না। আমি তোমাকে জোরপূর্বক কিছুই করতে বলবো না। কেননা, আমি তো সত্য জানি। আমি তো জানি, মেয়েরা খুনি ছেলেদের ভয় পায়। ভয় পেলে ভালোবাসা কখনোই হবেনা। আমি তোমার সাথে আছি মেবি তিনমাস হলো বাট তোমাকে চিনি সাত মাস আগে থেকে। বুঝতে পারছো স্নেহময়ী… শুধু তোমার জন্য আমি নিজের চেহারা দেখালাম, নিজের একচুয়েল পরিচয় দিলাম। আমি তাশরীফ সাগ্রত আজ পযর্ন্ত কাউকে নিজের আসল নাম, পরিচয় কিচ্ছু বলি নি। এমনকি আমার বস পযর্ন্ত আমার নাম জানে না। জানে আমার নাম তাওহিদ ইবনাত। আমি তোমার কাছ থেকে দূরে যাবো যাবো করেও যেতে পারছি না। যখন তোমার দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকাই মনটা চায় তোমাকে আজীবনের জন্য শত যুগের জন্য নিজের ডোরে বাধি। কিন্তু আমার কর্মের জন্য আমার মা বেচে থাকলে নাক ছিটকিয়ে ছি ছি করতো!! আর সেই জায়গায় তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করাটা.. ব্যর্থতা! তবুও অপেক্ষা আছি। দিনের একেকটা মূহুর্ত তোমাকে পাওয়ার জন্য আঙ্গুলে টুকে গুণছি। আশা করছি স্নেহময়ী একদিন আসবে!! আমি অবহেলা সহ্য করতে পারি না স্নেহময়ী। খুব যন্ত্রনা হয়। কাদতে চাইলেও কাদতে পারি না। লাইফে লাভ করার সাহস আমার ছিলো না। তোমার জন্য অদম্য সাহস জুগিয়েছি। কি করি স্নেহময়ী? কি করলে আমি অন্য দশটা ছেলের মতো তোমার কাছেও একটুখানি আদর, ভালোবাসার এক্সপেক্ট করতে পারবো? জুয়েলের কাজের জন্য আমি নিজেকে দোষী ভাবি স্নেহময়ী!! কেন্ জুয়েল তোমার মতো মেয়েকে কাছে পেয়েও কাছ করে রাখতে পারলো না!! কাছ করে রাখার জন্য কি তোমার ফিগার ইর্ম্পট্যান্ট? কই? আমি তো তোমার ফিগার দেখে প্রেমে পড়িনি!! তুমি একদিন বাজার থেকে সাফার সাথে সিএনজি করে বাসায় ফিরছিলে। গ্রীষ্মের গরমে তুমি ঘেমে এলোমেলো চুলে ছিলে…আর সাফা! সাফা পরিপাটি পোশাকে, এসির মধ্যে শপিং করতে ব্যস্ত ছিলো, তুমি মাছ মাংসের ভ্যাপসা গরমে হাত বোঝাই বাজার নিয়ে সবজির দোকানে যাচ্ছিলে। চুলের খোপা আধখোলা ছিলো, ফ্যাকাশে ঠোট লিপস্টিক ছাড়া! ভ্রু যুগলের নিচে ক্লান্তিকর দুটো চোখ! গালভরা ঘামের বিন্দুর ছোপ! সাদামাটা সালোয়ার- কামিজ! আমি তো আর্কষনীয় কিছুই তোমাতে খুটিয়ে বের করতে পারিনি!! তবুও তোমাতেই চোখ-মন-প্রাণ সমস্ত শরীর শিহরিত হচ্ছিলো!!জানো, সেদিনের স্নেহাকে দেখে যে ধাক্কা খেয়েছি! ডিরেক্ট প্রেম নামক আক্রমণে আক্রান্ত হয়ে গেছি!! হাতে গান নিয়ে কতবার টার্গেট করার স্কোপ গুলিয়ে ফেলেছি কাউন্ট করা মুশকিল। শাপলা চত্বরে আমি ঠিক করেই ফেলেছি বুলেটটা তোমার কপালের মাঝ বরাবর নিশানা দিবো! সেই বুলেটটা যদি টার্গেট মিস করে দেয়ালে বিদ্ধ হয়!!! তাহলে বুঝো আমার মনে তুমি কতটা সংক্রামন ছড়িয়েছো!! আমি কি তোমার পা ছুয়ে নিজের ভালোবাসার জিকির করবো? তুমি কি আমায় বিশ্বাস করবে? কসম! মিথ্যা বলছি না স্নেহময়ী! তুমি একবার বললে আমি তোমার সব কথা মানবো! চলে যেতে বললে চলে যাবো! নিজের মুখটা কক্ষনো আর সামনে আনবো না! আই প্রমিস! তাশরীফ সাগ্রত তার ওয়ার্ডস ভুলেনা!

বামহাতটা নিজের বুকের উপর রাখতেই বুঝলাম… হৃদস্পন্দনে বেতালে ধুকপুক ধুকপুক করছে!! সাগ্রতের কথায় আমার কেন হার্টবিট বাড়ছে!! আমি উপেক্ষা করতে পারছিনা! চোখ বন্ধ করলাম! খিচে চোখ বন্ধ করলাম। কাথাটা টেনে মাথার শীর্ষ পযর্ন্ত ঢেকে চোখ বন্ধ করে আছি। হৃদপিন্ড কেমন উপর-নিচ করছে!! শ্বাস বেড়িয়ে আসছে বুঝি! আমাকে করা প্রশ্নের জবাবে সাগ্রত আর বসে রইলো না! ঝট করে অল্প শব্দ করে সোফা থেকে দাড়িয়ে পড়লো!! শব্দটা শুনেই বুঝছি সাগ্রত পা বারিয়ে দিচ্ছে! ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে আসছে! ও কি আমার সাথে আবার কিছু করবে??? না!!! কাথার নিচে জবুথবু শুয়ে চুপসে আছি!!আমার কানে একদর কথা ছুড়ে আসলো-

–আমি আর ফিরে আসবো না স্নেহময়ী! আন্সার আমি পেয়ে গেছি! ছোট করে শেষবার বলি ‘ভালোবাসি’।

কি আশ্চর্য! কথা কেন এভাবে বললো?? আমি কি ওর চাকর!! দাসী ভেবেছে!! টাকা দিয়ে কিনা দাসীর মতো পেয়েছে!! যত্তসব! আমি ওকে ভালোবাসি না! না! না! না! না! ভালোবাসি না! শেষ ! উফ! চলে যাক! পারলে জাহাজডুবিতে মরে যাক! তাও যাক!

পাচঁ মিনিটের মতো হলো! রুমে এক্সট্রা একটা সাড়াশব্দ পেলাম না! সাগ্রত কি সত্যি সত্যি চলে গেলো?? কাথা সরিয়ে দেখলাম! সিক্সথ্ সেন্স বলছে রুমে আমি ছাড়া আর কেউ নেই! রুম খালি! কেবিন পুরো অন্ধকার! আমি লাইট জ্বালানোর জন্য পায়ের উপর থেকে বামহাতে কাথা সরিয়ে ফ্লোরে পা রাখলাম। সুইচ সোফার ওইদিকটায় দেখেছিলাম। অন্ধকারে সেদিকে পা বারিয়ে এগিয়ে চললাম। লাইট জ্বালাতেই দেখি কেউ নেই! রুমে কেউ নেই! সাগ্রত চলে গিয়েছে! হৃদ স্পন্দন আবারো সংখ্যা বাড়িয়ে হাতুড়ি পেটালো! ধুপধাপ করে হাতুড়ি চলছে বুকে! অসম্ভব ব্যথা অনুভূত হচ্ছিলো! খারাপ লাগছিলো! দুমড়ে চুড়ে মন ভেঙ্গে আসছিলো! হাহাকার করছিলো! আমি কেবিনের দরজা খুলে বাইরেও কিছুক্ষণ খোজাখুজি করলাম! নার্সকে ডেকে খুজতে পাঠালাম! ওয়ার্ড বয়কে বলে ওয়াচ ম্যানকে জিজ্ঞেস করতে বললাম। সবাই আশাভঙ্গ সূচক উত্তর দিলো।

লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে ফিরে গেলাম কেবিনে। বেডে পা তুলে কাথা টেনে শুয়ে পড়লাম। যে চলে যাওয়ার তাকে চলে যাওয়াই উচিত। কিছু মানুষ আসে চলে যাওয়ার জন্য! যাওয়ার আগে রেখে যায় কিছু স্মরণীয় মূহুর্ত! সাগ্রত এসেছিলো….কিছু আবদার নিয়ে এসেছিলো! পূর্ণ করতে যেহেতু করতে পারবো না! তার চলে যাওয়াই উচিত!! চলে যাও তুমি তাশরীফ সাগ্রত…চাই না কোনো প্রেম নামের স্বাগত….

-চলবে🍁

-Fabiyah_Momo♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here