শঙ্খচিল পর্বঃ-৩১

0
1399

#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya

পর্বঃ-৩১

শেহতাজ বেগম মানহার ঘরে প্রবেশ করলেন, মানহার দিকে তাকিয়ে ক্ষানিকটা চমকে উঠলেন, লাল সাদা শাড়ি পড়ে, মানহা পায়ে লালা টুকটুকে আলতা দিচ্ছে এবং জানালার বাইরে তাকিয়ে গান গাইছে। গান গাইতে গাইতেই হঠাৎ মানহা কেঁদে দিলো, চোখের পানি মুছে আবার আলতা পায়ের দিকে মনোযোগ দিলো।
শেহতাজ বেগম মানহার কান্নার কারন খুঁজে পাচ্ছে না, মনে মনে ভেবেই নিলো, দু দিন পরেই তার বিয়ে তাই হয়তো সবার কথা মনে করে কান্না করছে।

” এই যুগে আলতা বিলুপ্ত প্রায়। জানিস আমার বিয়েতে-ও আমি আলতা দিয়ে হাত পা রাঙ্গিয়ে ছিলাম। ”

হঠাৎ দাদীকে দেখে মানহা অবাক হলো, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ” দাদী তুমি? ”

” হু! একা একা আলতা দিচ্ছিস?”

মানহা বললো, ” তুমিও দেবে নাকি একটু ?”

” আমি সে কথা বলি নি? একা আলতা লাগাতে তোর কষ্ট হচ্ছে না? তানহাকে ডাক দিতি.. ”

” তানহা ব্যাস্ত তাই ডিস্টার্ব করি নি, তোমাকে একটু আলতা লাগিয়ে দেই। ”
বলেই মানহা দাদীর হাতে আলতার পড়িয়ে দিলো। শেহতাজ বেগম তাড়া দিয়ে বললেন,
” কি করলি এটা বিধবা মানুষের আলতা লাগাতে নেই। ”
মানিহা রাগ দেখিয়ে বললো,
” কোথায় লেখা আছে, যত্তসব কুসংস্কার। ”
শেহতাজ বেগম মানহার রাগ দেখে হাসলেন। মানহার চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন।

” দাদী?”

” হু?”

“এই খানে কোন শাড়িটা আমাকে বেশি সুন্দর লাগছে বলো তো? ”

বলেই তা মানহা শাড়ি গাঁয়ে জরিয়ে দেখালো। হঠাৎ মানহার এতো উৎসাহ, প্রফুল্লতা দেখে শেহতাজ বেগম অবাক হলেন। কিছুদিন আগেও তো মানহা দরজা আটকে কেঁদেছিলো, আজ মানহা নিজে থেকেই আলতা দিচ্ছে, শাড়ি দেখাচ্ছে। ব্যাপারটা ভীষণ ভাবাচ্ছে তাকে। মানহা আবারো বললো,
” কিছু বলছো না কেনো দাদী?'”

” দুটোই তোকে মানাবে। আচ্ছা একটা কথা বলতো..”

” কি কথা?”

শেহতাজ বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললো, ” বিয়েতে তুই সত্যি খুশি তো? নাকি সব কিছু নাটক করছিস? ”

হঠাৎ দাদীর কথায় চমকে উঠলো মানহা। কি ভাবে সে দাদীকে বলবে ‘হ্যা আমি নাটক করছি। কারো ওপর চরম অভিমান নিয়ে, তার ভাইয়ের সাথে বিয়ের পিরিতে বসছি। খুশী হবার ভান ধরছি। ভালো থাকার নাটক করে আমি প্রমাণ করতে চাই আমি ভালো আছি। কারো প্রত্যাখানে আমার কোন যায় আসে না৷ আমি একদম ঠিক আছি।’
মানহা স্থির দৃষ্টিতে দাদীর দিকে তাকিয়ে রইলো, মনে মনে হাজার কথা ফুটলেও, মুখে কিছু বললো না।

” কিছু বলছিস না যে..?”

” কি বলবো?”

” বিয়েতে তুই খুশি তো?”

” অখুশি কখন বললাম। অখুশি হলে বিয়েতে রাজি হতাম নাকি?”

দাদী ভাবুক হয়ে বললো, ” হুম। বুঝলাম। ”

” এতো বুঝে কাজ নেই৷ আগে বলো কোন শাড়িটা পড়বো। ”

” সবুজ শাড়িটা পড়। তোকে ভালো লাগবে। ”

মানহা হেসে বললো, ” আচ্ছা। ”

সেদিন মানহা ওয়াহাবের চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরার সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সে আর ওয়াহাবের কথা ভাবববে না। মন কে শক্ত করে নিজেই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলো, সে ভালো থাকার লড়াই করবে। ওয়াহাব কে ভুলে, নতুন করে সব কিছু শুরু করবে।
তবে সব কিছু কি ভুলা যায়? সেই বেহায়া মন টা যে বার বার তাকেই মনে করিয়ে দেয়। যাকে সে ভুলতে যায়।
ভালো থাকার চেষ্টার মাঝেও যে মনটা বার বার তার জন্যই পোড়ে। মানহা দৈর্ঘ্য শ্বাস ফেলে, শাড়িটার দিকে তাকালো…

————————————————-

রহিমাখালা একটু খানি সময় পেলেই টিভি দেখতে বসে পড়েন। আজকেও তার ব্যাতিক্রম না, সন্ধ্যা বেলা দাদী রুম যেতেই রিমোট নিয়ে টিভির সামনে বসে পড়েছেন তিনি, একটু দূরে খাবার টেবিলে তানহা পড়া গুলো নোট করছে। খুব ঘনিষ্ঠ আত্নীয় না থাকায়, এখনো বাসায় কোন মেহমান আসে নি। মানহা আপুর তিন-চার জন বান্ধবি ছাড়া। সন্ধ্যা বেলা এসে তারা মানহা আপুর রুমেই সময় কাটাচ্ছে..
আগামীকাল তার মানহার আপুর হলুদ তাই ফ্রি সময়টা তেই তানহা তার পড়া গুলো এগিয়ে নিচ্ছে। আর মাস দুইয়েক পড় তার এইচএসসি পরিক্ষা।

রহিমা খালা রিমোট দিয়ে টিভি অন করতেই তানহা টিভি থেকে কথা শুনতে পেলো, মহিলা কন্ঠে কেউ একজন বলছে, ” এই মূহুর্তে আমরা আছি কোর্টের চত্ত্বরে, শাহাবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ, এস আই ইলহামর স্যার আমাদের বলবেন কি ভাবে মাদক পাচারকারী কে ধরেছেন?”

ইলহাম অপ্রস্তুত হয়ে বললো, ধানমণ্ডি তিনে লেকের পাশেই আসামি কে আমরা আহত অবস্থায় পেয়েছি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এই ছেলেটা শুধু মাদক পাচারকারী নয় একজন রেপিস্ট। যাকে গত তিন মাস ধরে ধরার চেষ্টা করছি। আসামির বয়ানে জানা গেছে, এক অপরিচিত যুবক আসামি কে মারধর করেছিলো, সেই অপরিচিত যুবক কে আসামি চেনেন না। ধন্যবাদ। বলেই ইলহাম চলে গেলো। সেই কিশোর ছেলেটার হাতে হাত কড়া লাগিয়ে কোর্টের দিকে নিয়ে গেলো।

সিনটাও চলে গেলো৷
তার মানে সত্যি ইলহাম ওই খুনিকে চেনেনা। তাছাড়া ওই গুন্ডা লোকটা কেনো আহত করে চলে গেলো? পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিলো। এতে তার লাভই বা কি? বরং পুলিশের নেক্সট টার্গেট তো সে..

” আরে আরে এইডা মানহার দেওরা আছিলো না? ”

প্রফুল্ল স্বরে বললো রহিমা খালা। তানহার ধ্যান ভাংতেই সে বললো, ” হ্যাঁ। ”

” বাব্বাহ হেতি টিবিতেও আহে!” তানহা কোন উত্তর দিলো না। আগের মতোই ভাবনায় বিভোর হয়ে রইলো।
তার ভীষণ জানতে ইচ্ছা করে, এই খুনি লোকটার উদ্দেশ্য কি? কি চায় ইনি। প্রশ্নে প্রশ্নে তানহার মাথা গিজগিজ করছে।

—————————————————

আজ মানহার গাঁয়ে হলুদ। প্রতিবেশি সবাই এক জোট হয়ে বাসায় উপস্থিত হয়েছে৷ হলুদ বলে কথা। শেহতাজ বেগম প্রতিবেশী বয়জৈষ্ঠ দের সাথে গল্প করছে, তানহা সবাই কে নাস্তা পরিবেশন করছে। মানহার ঘরে তার মেডিকেল বান্ধবীরা আড্ডা দিচ্ছে, সবাই মেহেদী পড়ছে৷ কয়েকটা বান্ধবী জোর করে মানহার হাতে মেহেদী পড়িয়ে বসিয়ে রেখেছে৷
একেই সে শাড়ি পড়ে আনকম্ফর্টেবল তার মেহেদী পড়ে নড়তেও পাড়ছে না সে৷

মানহা খুব কষ্টে রুম থেকে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। সন্ধ্যা নেমেছে মাত্র চারিদিকে গোধূলির হাওয়া বইছে। ডালিম গাছের পাতলা ফিনফিনে ডাল টা বাতাসের তালে তালে দুলছে৷
হঠাৎ গাড়ির শব্দে পেয়ে নিচে তাকালো, সাদা একটা গাড়ি এসে থেমেছে তাদের বিল্ডিংয়ের সামনে৷ গাড়িটা ওয়াহাবের, তাহলে কি ওয়াহাব এসেছে?
মানহার ভাবনা ভুল করে দিয়ে ইলহাম, শিহাব, তানিয়া এবং আরো দু জন ছেলে মেয়ে গাড়ি থেকে নামলো। মানহা ভেবেছিলো হয়তো ওয়াহাব ও এসেছে।

ইলহাম হঠাৎ পাঁচ তলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। তিন মাস আগে এই পাঁচতলাতেই তানহাকে চিরকুট ছুঁড়ে মেরেছিলো।সময় কতো তাড়াতাড়ি চলে যায়। হঠাৎ ইলহাম তার নতুন ভাবি মানিহা কে দেখে আবারো মুচকি হাসি দিলো, ভাবি হয়তো ওয়াহাব ভাইয়ার জন্য বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।

মানহা ইলহামের হাসি দেখে ক্ষানিকটা অবাক হলো, ইলহামের হাসিটা অদ্ভুত রহস্যময়ী। কিন্তু ওয়াহাবের হাসিটা কি স্বচ্ছ কি সুন্দর পবিত্র মনে হয়।
আচ্ছা, যাকে ভালো লাগে তার সবকিছু তেই কি ভালোলাগা মিশে থাকে, ভেবেই পায় না মানহা। তার হবু স্বামী দাঁড়িয়ে আছে আর সে বোকার মতো অন্যপুরুষের কথা ভাবছে।

বিয়ের তত্ত্ব নিয়ে সবাই পাঁচতলায় এলো। বসার রুমের পাশেই ছোট্ট একটা দোলনা বসানো হয়েছে। হলুদ, কমলা গাঁধা ফুল দিয়ে দোলনাটা সাঁজানো হয়েছে। সামনের টেবিলে নানা রকম খাবার রাখা। মানহা দোলনায় বসে আছে, হলুদ শাড়ি তাজা ফুলে গহনা পড়ে। তানিয়া মানহার কানে, ফিস ফিস করে বললো, ” মানহা তোমাকে যা মিষ্টি লাগছে, আমার ভাই তো পুরো আহত হয়ে যাবে৷ ”

মানহা ইলহামের দিকে তাকালো, ইলহাম শিহাবের সাথে ফোন ঘাটছে। মানহার মনে হয় না সে আহত হয়েছে৷
তানিয়া স্মিথ হাসলো, তার ইচ্ছে করছে মানহা কে বলতে, বর ইলহাম নয় ওয়াহাব।

ফোন ঘাটতে ইলহামের হঠাৎ তানহার কথা মনে পড়লো। ইলহাম এক নজর চারপাশে চোখ বুলালো। তানহাকে দেখতে ……


চলবে

যারা গল্পটা পড়,তারা জানিয়েও গল্পটা কেমন হচ্ছে, আর মন্তব্যের অনুরোধ রইলো 🌹

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here