#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya
পর্বঃ০৮
চারিদিকে মাগরিবের আজান পড়েছে, মানহা ওরনা মাথায় টেনে, দ্রুত শিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠলো। দু বার দরজায় কড়া নাড়তেই রহিমা খালা এসে দরজা খুলে দিলো।
ফাল্গুন মাস খুব বেশি গরম পড়েছে, এমন নয়। তবে ভাবসা গরমে মানহা ফ্যানের সুইচ অন করে সোফায় বসে রইলো। ক্ষানিক বাদে রহিমা খালা কে বললো,
” খালা এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও।”
টিউশনির প্রথম দিন খুব একটা মন্দ ছিলো। বন্ধুর অনুরোধে টিউশনিটা করাতে রাজি হলেও শিহাবের মতো লক্ষি এক্টিভ স্টুডেন্ট পেয়ে মানহার ভালোই লাগছে।
রহিমা খালার ডাকে মানহার ধ্যান ভাংলো, এক গ্লাস পানি মানহার হাতে দিয়ে বললো, ” নাও মানহা। ছাত্র কেমন আছিলো তোমার?”
” ভালো ছিলো খালা। দাদী কে স্যুপ দিয়েছিলে? ”
” হয়! দিছি আর লগে কোমরে মালিশ ও কইরা দিছে। ”
” আচ্ছা। তানহা কোথায় গো?”
” তানহা তো বাড়ি ফিরে নাই। ”
মানিহা অবাক হয়ে বললো, ” বাড়ি ফিরে নাই মানে? ওর তো সন্ধ্যার আগে বাসায় বাসায় কথা।”
রহিমা খালা কিছু বললেন না। দাঁড়িয়ে মানহার দিকে তাকিয়ে রইলো। মানহা ফোনটা খুঁজে বের করলো, তানহার ফোনে দ্রুত কল দিলো, রিং হবার পর ও কল টা রিসিভ হলো না। হাতের ডানা দিয়ে, কপালের ঘাম মুছে আবারও কল দিলো মানহা….
—————————————————
পিট পিট করে তানহা চোখ মেলতেই দেখতে পেলো, ওপর ধূসর রংয়ের সিলিং ফ্যান চলছে, পরক্ষণেই তানহার খেয়াল করলো, ধূলোর কারণে ফ্যান ধূসর রঙ ধারণ করেছে। একটা পুরোনো স্টোর রুমের মতো লাগছে। চারি পাশে পরিত্যাক্ত আসবাব পত্র। ভ্যান্টিলেটারের ফাঁকা দিয়ে বাতাস ঢুকছে রুমে।
ক্ষানিক ধুলো তানহার নাকে আসতেই সে হাঁচি দিয়ে উঠে বসলো। তানহা উঠে বসতে যাবে ঠিক তখনি খেয়াল করলো, তার সামনে একজন যুবক বসে আছে। পড়নে আধো নোংরা শার্ট, পেন্ট। চুল গুলো এলো মেলো, গলায় ব্লেড আকৃতির লকেট পড়া, মুখে আগের মতোই হাসি। চোয়ালের সব দাঁত দেখা, যাচ্ছে। কালো চেহারায় সাদা দাঁতের হাসি বড্ড বেমানান লাগছে।
তানহার ভেতর টা ধক করে উঠলো, মনে হচ্ছে চোখের সামনে সে তার মৃত্যু কে দেখতে পারছে। তানহা শুকনো ঢোক গিললো, হাত পা কাঁপছে ভয়ে অবশ হয়ে যাচ্ছে সব। ছেলেটা পিস্তল তানহার দিকে তাক করে বললো,
” অচেনা জিনিস নিয়ে যতো না ঘাটবে ততই ভালো। ”
তানহা আমতা আমতা করে বললো, ” আ আমি কোন জিনিস নিয়ে ঘাটি নি। আমি সে দিনের ঘটনা কাউকে বলি নি।”
ছেলেটা ফিনিক হাসে বললো, ” গুড। ” সমুদ্রে শামুক খুঁজেতে, যেও না। চোরাবালিতে ডুবে মড়বে। ”
বলেই ভয়ংকর ভাবে হেসে দিলো। তানহা ভয়ে মাঝেও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, তার ধারণাই ঠিক ছিলো এমন থ্রেট মার্কা চিরকুট একজন অপরাধীই দিতে পারে।
” আমি কাউকে কিছু বলি নি। আমাকে ছেড়ে দিন। প্লিজ। ” বলেই তানহা কেঁদে দিলো। ছেলেটা ক্ষানিক চমকে তানহার দিকে তাকিয়ে, তানহার কান্না উপভোগ করতে লাগলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো , তানহা কে কি ছেড়ে দিবে নাকি….?
—————————————————
” বড়মামু বড়মামু! ”
” হুঁ?”
শিহাব মুখে টিপস ঠুসে বললো, ” আজকে কি হয়েছে জানো?”
ওয়াহাব ল্যাপটপের থেকে মুখ উঠিয়ে শিহাবের দিকে তাকিয়ে বললো, ” আস্তে খাও। তার পর বলো। ”
শিহাব তার বড় মামার কথা শুনলো না। চিপস চিবুতে চিবুতে বললো, ” আজকে নতুন মিস এসেছে ছিলো? ”
ওয়াহাব ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বললো, ” তার পর? ”
” মিস তোমার সাথে পড়ে! ”
ওয়াহাব চমকে গিয়ে বললো, ” আমি পড়ি না শিহাব। আমার লেখা পড়া শেষ। ”
ওয়াহাবের কথায় পাত্তা না দিয়ে শিহাব বললো, ” মিস বলেছে কালকে আমাকে নিয়ে বই কিনতে যাবে। কমিক বই ( কৌতুক বই)।”
ওয়াহাব থ মেরে ক্ষানিক বসে ভাবলো, এ কেমন মিস যে স্টুডেন্ট কে কৌতুকের বই কিনে দেয়?
” তোমার কপাল ভালো শিহাব। আমি যে কেনো এমন একটা মিস পেলাম না। ”
শিহাব মুচকি হাসলো, আসলেই সে ভাগ্যবান এমন একটা মিস পেয়েছে। খুশির চোটে শিহাব আরো কত গুলো চিপস মুখে দিয়ে কচ কচ শব্দ শুরু করলো। ওয়াহাব খেয়াল করলো না।
–
–
মানহা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পায় চারি করছে, দড় দড় করে ঘামছে সে। তানহার ফোনে লাগাতার কল দেওয়ার পড়ও তানহা ফোনটা রিসিভ করছিলো না। এ দিকে রাত বাড়ছে, যদি বাবা এসে দেখে তানহা বাসায় নেই কি যে ভয়ংকর রাগ হবে ভাবতেই মানহার গ্লাসে রাখা পানিতে শেষ বারের মতো চুমুক দিলো।
হঠাৎ দরজার বেল বাজতেই মানহা থমকে উঠলো। ঘড়ির দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখলো, রাত নয়টা বেজে সতেরো মিনিট।
বাবা সাধারণত নয় টা থেকে দশ টার মাঝেই বাড়ি ফিরে আসে। তাহলে কি বাবা চলে এসেছে? বাবা এসে যদি দেখেন তার মেয়ে সারা দিন পড়ে এখনো বাড়ি ফিরে নি, রেগে একাকার হয়ে যাবে৷ মেয়েদের রাতে দেরি করে বাড়ি ফেরা একদমই পছন্দ করে না। মানহা যে কখনো দেরি করে বাড়ি ফিরে নি এমনটা নয়, একবার এক বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষে রাত দশটায় বাড়ি ফিরেছিলো সে, বাবার কছে কতই না বকুনি খেয়ে ছিলো সে, অভিমান করে পরের দুই দিন কিছু খায় নি সে। অসুস্থ হয়ে পড়তেই, বাবা এসে তাকে তার প্রিয় খাবার ডিম ভাজা এবং ডাল চড়চড়ি দিয়ে ভাত খাইয়ে দিয়েছিলো। মানহার স্পষ্ট মনে আছে।
তৃতীয় বার বেল পড়তেই রহিমা খালা এসে, মানহা কে মৃদ্যু ধাক্কা দিয়ে বললো, ” মনে হয়, মুকুল ভাইজান আইছে। ”
মানহার ভয় টা মূহুর্তে বেড়ে গেলো। পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো, রহিমা খালা খট করে দরজার ছিট কিনি খুলতেই দেখলো বাইরে তানহা দাঁড়িয়ে আছে। রোরখার নিকাব নেই, অথচ মানহার স্পষ্ট মনে আছে তানহা গাড়ো মেরুন কালারের একটা নিকাব পরে ছিলো। চেহারায় ক্লান্তি, চোখ গুলো লাল হয়ে টল টল করছে। ভেতরে এসে চুপ করে নিজের রুমে চলে গেলো। মানহা অবাক হয়ে, তানহার যাবার পানে তাকিয়ে রইলো।
তানহার বাম হাতের কনুইয়ের পেছন টা ছিলে গেছে, লাল রক্তের আবরণ দেখা যাচ্ছে।
যা মানহার চোখ ফাঁকি দিতে পারলো না। মানহা দাদীর রুম থেকে ফার্স্ট এইড বক্স টা নিয়ে তানহার রুমের দিকে গেলো। তানহা চুপ করে, বসে কিছু একটা চিন্তা করছে।
মানহা পাশে বসে তানহার হাতের কনুইয়ে ঔষধ দিতে দিতে বললো,
” হঠাৎ এতো দেড়ি করলি কেনো? ”
তানহা অবাক কয়ে কোন উত্তর দিলো না। ক্ষানিকটা পড়ে জড়ানো কন্ঠে বললো,
” গাড়ি পাচ্ছিলাম না আপু। নীলক্ষেত থেকে হেটে এসেছি।”
মানহা অবাক হয়ে তাকালো, তানহা স্পষ্ট মিথ্যে কথা বলছে, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট থেকে তাদের বাসায় হেটে আসলে এক ঘন্টা কিংবা, এক ঘন্টার আরো বেশি সময় লাগবে। চার ঘন্টা সময় লাগার কথা না।
মানহা মলম লাগিয়ে দিতে দিতে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
” মিথ্যা কথা বলছিস কেনো? ”
তানহা চমকে গেলো। কিন্তু কিছু বললো না। কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেলো। মানহা আবারো বললো,” হাতে ব্যাথা পেয়েছিস কি ভাবে?”
” পরে গিয়ে, ছিলে গেছে। ”
মানিহা আরেক বার বোনের দিকে তাকিয়ে, বোনকে পর্য্যবেক্ষন করার চেষ্টা করলো, চোখের পানি শুকিয়ে গালে দাগ হয়ে গেছে, চোখের কনিকা এখনো আগের মতোই হাল্কা লাল।
তানহা যখন লোকটার কাছে, বাসায় ফেরার আকুতি করছিলো, ঠিক তখনি লোকটা…
।
।
চলবে