শেষ বিকেলের আদর❤️পর্ব : ২০

0
3958

#শেষ বিকেলের আদর❤️
#রিত্তিকা ইসলাম
পর্ব : ২০

🌼
ছাঁয়া আশ্রমের সেই চিরচেনা শক্ত লোহার গেটটার সামনে দাড়িয়ে আছে তিনটা ছেলে মেয়ে।গেটের বাইরে চেয়ার পেতে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ লোক।বয়সের সাথে সাথে তার চেহারা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। চুলগুলোতেও পাক ধরেছে।শরিরের তামাটে চামড়াটা কুচকে এসেছে অনেকটাই।তবে চোখ দুটো এখনো সেই যৌবনের মত স্নিগ্ধ।ছেলেদের চোখ খুব বেশি টানা টানা হতে নেই।ছেলেদের চোখ ছোট ছোট হবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম।টানা টানা চোখ এই কথাটা ছেলেদের সাথে মানানসই নয়।এটা কেবল মেয়েদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মেয়েদের চোখ হবে হরিনের মত টানা টানা।তাতে শুভ্র আবেগ থাকবে।থাকবে এক মুঠো মায়া।আর থাকবে এক আকাশ অভিমানের মেঘ।অকারনেই যা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে।ভাসিয়ে দেবে সকল ক্লান্তি আর না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস।

তবে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে লোকটার চোখে মুখে ভর করেছে একরাশ স্নিগ্ধ মায়া। লোকটার চোখটা মারাত্বক। মারাত্বক তার দৃষ্টি।রোশনির হঠাৎই মনে হলো এই চোখ জোড়ার সাথে আরো একজনের চোখের মিল আছে।তার চোখের দৃষ্টিও মারাত্বক। সেই সাথে ভয়ংকর।শরিরের কাপন ধরানোর মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সেই চোখ জোড়ার। রোশনির ভাবনার মাঝেই পাশ থেকে গুতা দিলো পিয়া।চোখ দিয়ে ইশারা করতেই সরু চোখে তাকালো রোশনি।সামনে দাড়ানো তিন জন যুবক যুবতীকে দেখে নড়ে চড়ে বসলেন বৃদ্ধ।চোখের সাদা গ্লাসের চশমাটা নাকের ডগা থেকে ঠেলে দিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন,

_কে তোমরা? কাকে চাই?

বৃদ্ধের কথায় রোশনি বুঝলো উনি আবারো চিনতে পারে নি তাকে।রোশনি হাতের প্যাকেটগুলো জয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিচু হলো খানিক।গলার স্বরে চাপা রাগ তুলে বলে উঠলো,

_তুমি আমায় আজও চিনতে পারো নি মাষ্টার দাদু? আজ আমি এমনিতেই ভিষন রেগে আছি।সবাই আমাকে ভিষন বিরক্ত করছে আজ।এখন তুমিও আমায় চিনতে পারছো না?

রোশনির কথায় বৃদ্ধ লোকটার ঠোটের কোনে হাসি ফুটলো।তবে সে হাসি বেশিক্ষণ টিকলো না।
চোখ মুখ শক্ত করে উঠে দাড়ালেন উনি,

_একে তো আমাকে তুমি সালাম দাও নি।তার উপর আমার সামনে দাড়িয়ে উঁচু গলায় কথা বলছো? আমার সামনে আওয়াজ নিচু করে কথা বলবে। নয়তো জবান কেটে দেবো।

কথাটা বলেই উনি সাদা পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট্ট একটা চাকু বের করে সামনে ধরলেন।বৃদ্ধের এমন কান্ডে জয় চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকালো।এই সামান্য কারনে এতো রেগে যাওয়ার কোনো মানে হয় বলে জয়ের মনে হলো না।লোকটা যদি সত্যি সত্যি চাকু মেরে দেয়।লোকটাকে বদ্ধ পাগল মনে হচ্ছে জয়ের কাছে।বদ্ধ পাগল না হলেও মোটামুটি রকম পাগল।মাথায় কিছুটা সমস্যা অবশ্যই আছে।এমন লোককে গেট পাহাড়াতে দেওয়ার বিশেষ কোনো কারনই খুজে পেল না জয়।এতো বড় একটা আশ্রমের দারোয়ান এক পাগল বৃদ্ধ কথাটা ভাবতেই চোখ মুখ কুচকে এলো তার।তার এই আশ্রমের মালিকের সাথে কথা বলতেই হবে।দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে দেশের মানুষকে রক্ষা করা তার কর্তব্য।এই লোক তো যখন তখন মানুষকে চাকু মেরে দিতে পারে।

_আমাকে মাফ করে দাও মাষ্টার দাদু।আমি একেবারেই ভুলে গেছি।আমি দোয়া করবো যেন আজকের দিনটা তোমার ভিষন ভালো কাটে।

রোশনি বৃদ্ধের গালে আলতো চুমু দিতেই মুচকি হাসলেন উনি।পরোক্ষনেই চোখ মুখ শক্ত করে বলে উঠলেন,

_আমায় বলো কে তোমায় বিরক্ত করেছে? তুমি শুধু তার নামটা বলো।আমি তার জবান কেটে নেবো।

বৃদ্ধের কথায় নিজের মুখ চেপে দাড়িয়ে রইলো জয়।আজ সে সকাল থেকেই রোশনিকে বিরক্ত করে চলেছে।এখন এই লোকটা যদি সত্যি সত্যি জিব্বাটা কেটে নেয় তাহলে? জয় মুখে হাত রেখেই শুকনো ঢোক গিললো।জয়ের অবস্থা দেখে পেট ফেটে হাসি আসছে পিয়ার।কিন্তু সে এখন হাসছে না।কারন জোরে হাসা তার বারন।এখন যদি শব্দ করে হেসে ওঠে তবে বৃদ্ধ লোকটা তার জগৎ বিখ্যাত চকচকে চাকুটা সামনে ধরে বলে উঠবে,,,,শব্দ করে হাসবে না।নয়তো জবান কেটে দেবো।…..কথায় কথায় জবান কেটে নেওয়াটা ওনার অভ্যেসে পরিনত হয়েছে।তবে আফসোস,,,, আজ পর্যন্ত একটা জবানও তিনি কাটতে পারেন নি।

_থাক তোমায় আর কারো জবান কাটতে হবে না।তুমি আমায় চিনতে পেরেছো এটায় অনেক।এতেই আমি তীতার্থ।

রোশনির কথা শেষ হতেই কয়েক পা এগিয়ে এলো পিয়া।বামহাতে শার্টের কলারটা ঠিক করে বলে উঠলো,

_না চিনলে ছেড়ে দিতাম নাকি। বুড়োর জবান কেটে নিতাম।

পিয়ার কথায় লোকটা আবারো চাকু তুলে ধরে বলে উঠলো,

_ কার এতো বড় সাহস আমার জবান কাটতে চায়? সাহস থাকলে সামনে আসো। তোমার জবান কেটে নেবো আমি।

পিয়া লোকটার হাত থেকে ছো মেরে চাকুটা কেড়ে নিতেই হাফ ছেড়ে বাচলো জয়।কথায় কথায় জবান কেটে নেবো জবান কেটে নেবো শুনে সত্যি সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেছিলো সে।তবে এখন কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করছে।পিয়া চাকুটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো।চাকুর দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন ছুড়লো পিয়া,

_এই যে বুড়ো মাষ্টার,,,,এই চাকুতে কোন ব্র্যান্ডের তেল লাগাও বলো তো? এতো চকচকে কিভাবে?আর এতো জবান কেটে নেবো জবান কেটে নেবো করো কেন? শরিরে তো শক্তির “শ”টাও নেই।তোমার বউয়ের কি এই চাকু দিয়ে জবান কাটতে নাকি সেই তোমার জবান কাটতো এটা দিয়ে?

ঘড়িতে তখন দুটো বাজে।খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে সবাই হাজির হয়েছে আশ্রমের বাগানের দিকটায়।খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে তাতে আরাম করে বসেছে সবাই।এখানে আসা নতুন কিছু মুখের দেখা পেয়েছে রোশনি।আগের বার যখন এসেছিল তখন এদের দেখে নি। হয়তো নতুন এসেছে।এখানে শুধু অসহায় বৃদ্ধ মানুষই থাকেন না।ছোট ছোট এতিম শিশুরও আশ্রয় কেন্দ্র এটা।রোশনি সারা মাসে অল্প অল্প করে কিছু টাকা জমায়। সেটা দিয়েই বাচ্চা আর বৃদ্ধাদের জন্যে টুকটাক কিছু কিনে এখানে আসে।সারাদিন ওদের সাথে কাটিয়ে তারপর বাড়ি ফেরে।এর আগে পিয়াকে সাথে আনলেও জয়কে নিয়ে আসা হয়ে ওঠেনি।আর আজ জয়কে হাতের নাগালে পেয়ে তাকেও বগলদাবা করে নিয়ে এসেছে এখানে।এদিকে ছোট ছোট বাচ্চারা জিদ করছে তারা গান শুনতে চায়।রোশনি বা পিয়া কারো গলায় খুব বেশি সুন্দর না।তবে জয়ের গানের গলা মাশআল্লাহ। রোশনি জয়ের দিকে ইশারা করতেই বাচ্চাগুলো জয়কে ঘিরে বসলো।তারা গান না শুনে থামবে না।এমন চেপে ধরায় অবশেষে গান গাইতে রাজি হলো জয়।জয় রাজি হতেই বাচ্চারা হৈ হৈ করে চিৎকার করে উঠলো।জয় ওদেরকে থামিয়ে বলে উঠলো,

_গান তো গাইবো। কিন্তু গিটার আছে কি?

জয়ের কথায় মনি মা নড়ে চড়ে বসলেন।

_আকাশ যাও গিয়ে লাইব্রেরি রুম থেকে গিটার নিয়ে এসো।

মনি মার কথায় বাধ্য ছেলের মত উঠে গেল আকাশ।কিছুক্ষনের মাঝে গিটার হাতে ফিরেও এলো।জয় হাত বাড়িয়ে নিয়ে গিটারে টুংটাং সুর তুলতে লাগলো।রোশনি মনিমার এক হাত জড়িয়ে কাধে মাথা রেখে বসলো।উনিও রোশনির মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।জয় গলা ঝেড়ে গাইতে লাগলো,

ছেলে আমার মস্ত মানুষ,মস্ত অফিসার
মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার
ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার
মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার

নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী
সব চেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি
ছেলের আবার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম

আমার ব্যবহারের সেই আলমারি আর আয়না
ওসব নাকি বেশ পুরোনো ফ্ল্যাটে রাখা যায় না
আমার ব্যবহারের সেই আলমারি আর আয়না
ওসব নাকি বেশ পুরোনো ফ্ল্যাটে রাখা যায় না

ওর বাবার ছবি,ঘড়ি,ছড়ি বিদেয় হলো তাড়াতাড়ি
ছেড়ে দিলো,কাকে খেলো পোষা বুড়ো ময়না
স্বামী স্ত্রী আর অ্যালসেশিয়ান জায়গা বড়ই কম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম

নিজ হাতে ভাত খেতে পারতো না কো খোকা
বলতাম,”আমি না থাকলে রে কি করবি বোকা?”
ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতো খোকা আমার কথা শুনে
খোকা বোধহয় আর কাঁদেনা, নেই বুঝি আর মনে

ছোট্ট বেলায় স্বপ্ন দেখে উঠতো খোকা কেঁদে
দু’হাত দিয়ে বুকের কাছে রেখে দিতাম বেঁধে
দু’হাত আজও খোঁজে, ভুলে যায় যে একদম
আমার ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম

খোকারও হয়েছে ছেলে দু’বছর হলো
আর তো মাত্র বছর পঁচিশ, ঠাকুরও মুখ তুলো
একশো’ বছর বাঁচতে চায়, এখন আমার ষাট
পঁচিশ বছর পরে খোকার হবে ঊনষাট

আশ্রমের এই ঘরটা ছোট,জায়গা অনেক বেশি
খোকা-আমি দু’জনেতে থাকবো পাশাপাশি
সেই দিনটার স্বপ্ন দেখি ভীষন রকম
মুখোমুখি আমি খোকা আর বৃদ্ধাশ্রম
মুখোমুখি আমি খোকা আর বৃদ্ধাশ্রম
মুখোমুখি আমি খোকা আর বৃদ্ধাশ্রম…..

ধরে আসা গলায় গানটা শেষ করতেই চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়লো একফোটা পানি।বামহাতে তা মুছে নিয়ে চোখ বন্ধ করলো জয়।চোখ বন্ধ করতেই মায়ের সেই মায়াবি মুখটা ভেসে উঠলো।মা মানেই একেকটা জান্নাত।সেই জান্নাতকেই মানুষ ছুড়ে ফেলে রাস্তায়।কই জয় তো পারে না।জয়ের মতো ওরাও তো রক্তে মাংসে তৈরি মানুষ তাহলে তারা কেন এমন জঘন্য কাজটা করতে পারে?পিয়ার চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়লো নোনা পানি।মাকে আজ ভিষন মনে পড়ছে।এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা করে সে চলে গেছে।একটা বারের জন্যেও কি তার মেয়েটার কথা মনে পড়েনি? স্বার্থপরের মত একা রেখে চলে গেল? তবুও তো তার বাবা আছে। কিন্তু রোশনি? ওর তো এই পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ নেই।ওর কষ্টের পাল্লা কি পিয়ার থেকে বেশি নয়? পিয়া চটজলদি চোখ মুছে রোশনির দিকে তাকালো।চোখের মধ্যে টলমল করছে পানি।এখনি হয়তো ঝড়ে পড়বে বর্ষা হয়ে।পিয়া রোশনির হাতের উপর হাত রাখতেই অসহায় চোখে তাকালো রোশনি।রোশনির সেই আকুতি ভরা চোখ দেখে ভেতরটা কেপে উঠলো পিয়ার।কত মায়া এই চোখে,না পাওয়ার কত কষ্ট,হাজারো অভিমান।সবার চোখেই পানি।গানের কথাগুলোর প্রমান হয়তো এখানে বসে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা।সবার জিবনের সাথেই হয়তো মিল আছে কথা গুলোর।বড়দের সাথে সাথে বাচ্চাদের চোখেও পানি।অন্য বাচ্চারা হয়তো এই বয়সে এই গানের কথা গুলো বুঝবে না।কিন্তু এখানে থাকা বাচ্চাগুলো সব বুঝেছে।শুধু বুঝেই নি,অনুভবও করেছে।এই বাচ্চাগুলো সময়ের আগেই বুঝতে শিখে যায়।শিখতে হয়।সময় তাদের ম্যাচিউরড করে তোলে।মনিমা নিজের চোখের পানিটুকু মুছে নিয়ে রোশনির মাথায় হাত রাখলো।

বাচ্চাদের সাথে ফুটবল নিয়ে খেলছে জয় আর পিয়া। সেই চিরপরিচত ছোট্ট ঘরের ছোট্ট চৌকিটাতে বসে আছে রোশনি।পাশেই বসে আছেন মনি মা।

_ছেলেটা কে রোশনি?

_ও জয় মনিমা।আমার বন্ধু।

রোশনির কথায় মুচকি হাসলেন উনি।মুখে হাসির রেখা টেনেই বলে উঠলেন,

_শুধুই বন্ধু? আমি ছেলেটার চোখে তোর জন্যে ভালোবাসা দেখেছি মা।তুই যখন কাদছিলি তখন ছেলেটার মুখ আমি দেখেছি।আমি এটুকু বুঝে গেছি ছেলেটা তোকে ভালবাসে।তুইও কি ওকে ভালোবাসিস?

মনিমার কথায় হাসার চেষ্টা করলো রোশনি।খোলা দরজা দিয়ে জয়কে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।বাচ্চাদের সাথে বাচ্চাদের মতো করে খেলছে।ঘামে গায়ের টি-শার্টটা ভিজে গেছে অনেকটাই।ঘন কালো চুলগুলো দৌড়ানোর তালে তালে নড়ে উঠছে।রোশনি জয়ের থেকে নজর সরিয়ে মনিমার দিকে ফিরে তাকালো,

_জানি না মনি মা।ভালোবাসা কাকে বলে, এর সঙ্গা কি কিছুই জানি না আমি।ওকে ভালবাসি কিনা সেটাও জানি না।তবে ওকে আমি বিশ্বাস করতে পারি।চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি।যদি এই বিশ্বাসকেই ভালবাসা বলে তবে আমি ভালবাসি।ওর মুখের দিকে তাকালে নিজের সব কষ্ট ভুলে যায়,,,,এটাই যদি ভালবাসা হয় তবে আমি ভালবাসি।ওর শুকনো মুখের দিকে তাকালে আমার দমবন্ধ লাগে, যদি এটাই ভালবাসা হয় তবে আমি ভালবাসি।ভিষন ভালবাসি।জানো মনিমা,,,,আমার কিছু হলেই ছেলেটা পাগল হয়ে যায়।মনে হয় আমার কষ্টটা ও অনুভব করছে।আমি ওর চোখে আমার জন্যে ভালবাসা দেখতে পায় মনি মা।ওই ভালোবাসাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার নেই।

রোশনির কথায় মৃদু হাসলেন উনি।

_বলেছিস ওকে এসব?

_এখনো বলি নি মনিমা।তবে খুব তাড়াতাড়ি বলবো।

মনিমা রোশনির কপালে ঠোট ছোঁয়ালেন।প্রথম দেখাতেই জয়কে তার পছন্দ হয়েছে।রোশনির সাথে মানাবেও ভালো।মেয়েটা অনেক কষ্ট করেছে।এবার যদি একটু সুখের দেখা পায়।

ড্রয়িংরুমে বসে ভিডিও গেইম খেলছে আদি।হঠাৎ করেই কোথা থেকে ছুটে এলো রিয়া।হাতে কাচের ছোট্ট গোলাকার পাত্র।আদি আড় চোখে তাকাতেই দেখলো রিয়া মুখ শুকিয়ে দাড়িয়ে আছে।তবে আদি সেদিকে খুব একটা পাত্তা দিলো না।পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজনই নেই।সকালের ঘটনা তার স্পষ্ট মনে আছে।তার থেকে পিজ্জা কেড়ে নিয়ে দিব্যি খেয়ে নিলো মেয়েটা।এর শোধ তো সে নিয়েই ছাড়বে।আদিকে আগের মতোই গেইম খেলতে দেখে ধপ করে বসে পড়লো রিয়া।গোটা সোফা নড়ে উঠতেই চোখ মুখ কুচকে তাকালো আদি।

_ওই ফাজিল মাইয়া,,,, কোলা ব্যাঙের মত এমন লাফাস কেন?ঠিকমত বসতে পারোস না?

আদির কথার কোনো জবাব দিলো না রিয়া।ঠোট উলটে কাচের পাত্রটা তুলে ধরলো আদির সামন।পাত্রে হলুদ রঙের একটা গোল্ড বেটা ফিস পানিতে আস্তে আস্তে ভেসে বেড়াচ্ছে।মাছের সাথে সাথে সেখানে কিছু নুড়ি পাথর আর ছোট্ট একটা গাছও আছে। গাছটার নাম জানা নেই আদির।তবে গাছটা কৃত্রিম এটুকু সে জানে।আদি ভ্রু কুচকে তাকাতেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে মুখ খুললো রিয়া,

_ভাইয়া দেখ না। আমার চিচির কি হয়েছে।ওকি অসুস্থ্য?

রিয়ার কথায় বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে এলো আদির।মেয়েটার চুলগুলো টেনে ছিড়ে দিতে ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে।

_তা তোর মাছ অসুস্থ্য কি না সেটা আমি কি করে জানবো? ডক্টরের কাছে নিয়ে যা।আমাকে কেন বলতে আসছিস? আর এখন এতো সুন্দর করে ভাইয়া ডাকিস কেন?সকালে তো খুব আদি আদি করে হামলাতে ছিলিস।

_সরি ভাইয়া,সকালের জন্যে আমি সত্যিই সরি।আর কখনো তোর নাম ধরে ডাকবো না।সম্মান দিয়ে কথা বলবো।আচ্ছা যা তোকে আমি দুটো পিজ্জা খাওয়াবো।প্লিজ একটু দেখনা চিচির কি হয়েছে?

_সত্যি তো? পরে আবার পাল্টি খাবি না তো?

_না না।একদম সত্যি…

আদি মাছটার দিকে কিছুক্ষন গভির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।রিয়া হাতের নখ কামড়াতে কামড়াতে বলে উঠলো,

_ও কি বেশি অসুস্থ্? কি হলো বলনা?

_একদম ঢং দেখাবি না।আমি অসুস্থ্ হলে তো একবারও খোঁজ নিস না।আর মাছের বেলায় এতো পিরিত কইত্তে আসে? আর আমার কাছে মনে হচ্ছে ওর কিছু হয় নি।

_কিছু হয় নি মানে? দেখ কেমন কুকড়ে যাওয়া কাঁকড়ার মত দেখতে লাগছে।ঠিকমত সাঁতারও কাটছে না।আর ওর লেজ দেখ?লেজের রঙ কি এমন ছিলো নাকি?আচ্ছা দাড়া তোকে দেখাচ্ছি,,,,,

পিয়া ট্যাবে ফটো ওপেন করে আদির সামনে ধরলো,

_এই দেখ,,কালই আমি এই ছবিগুলো তুলেছিলাম।ছবিতে ওর লেজের রঙ দেখ আর এখনকার রঙ দেখ।দুটো আলাদা লাগছে না তোর কাছে?

_তোর মাছের কিছুই হয় নি।আমার কাছে তো একই মনে হচ্ছে।

_তোর মনে হয় ঘুম পেয়েছে তাই কিছু দেখতে পারছিস না ঠিকমত।তুই বরং এক কাপ কফি খা।আচ্ছা দাড়া আমিই নিয়ে আসছি।

রিয়া উঠে দাড়াতেই বিরক্ত চোখে তাকালো আদি।

_ওই ফাজিল মাইয়া,,,বললাম না তোর মাছ ঠিক আছে।আর যদি কিছু হয়েও থাকে তাহলে খাবারের জন্যে হয়েছে হয়তো।

রিয়া কপালে হাত দিয়ে বসে পড়লো।

_আমি ভিষন টেনশনে আছি।ভিষন টেনশনে।তুই বুঝতে পারছিস? আজ ওর লেজের রঙ পাল্টেছে,কাল ওর চোখের রঙ পাল্টাবে,পরশু অন্যকিছুর।তখন কি হবে? হায় আল্লাহ,,,,এখন আমি কি করবো?

_ঢং কম করে কর।তোর এই মাছের চক্করে বাড়িতে একটা বিড়াল পালতে পারি না।চিচিকে খেয়ে নেবে চিচিকে খেয়ে নেবে করে কোলা ব্যাঙের মত করে লাফাতে থাকিস।আর সামান্য একটু লেজের রঙ পাল্টেছে দেখে যেন টেনশনে একেবারে মরে যাচ্ছে।নটাঙ্কি কোথাকার।

আদির কথায় ফুসে উঠলো রিয়া।চোখ মুখ শক্ত করে বলে উঠলো,

_একদম বাজে কথা বলবি না।দেখছিস আমার চিচি অসুস্থ। কি করে ওকে সুস্থ করবো সেটা না বলে বাজে কথা বলে যাচ্ছিস।যা তোকে পিজ্জা খাওয়ানোর ডিল ক্যানসেল। আমার চিচিকে আমিই সুস্থ করে তুলবো।দরকার নেই তোর সাহায্যের।চল চিচি,,এসব খারাপ মানুষের সাথে থাকবো না আমরা।

রিয়া টেবিল থেকে পাত্রটা তুলে রুমের দিকে হাটা দিতে নিলেই পেছন থেকে আদি চিল্লিয়ে বলে ওঠে,

-তুই পিজ্জা না খাওয়ালে কি আমি না খেয়ে মরে যাবো নাকি ডায়নি বুড়ি।আর শোন,,, তোর চিচিকে সাবধানে রাখিস।নয়তো কবে দেখবি তোর চিচিকে টয়লেটে ফেলে ফ্লাশ করে দিয়ে সারা জিবনের মত খতম করে দেবো।

আদির কথায় তেড়ে এলো রিয়া।চোখ রাঙিয়ে আদির দিকে তাকালো,

_আমার চিচির দিকে তাকালে তোর চোখ তুলে নেবো কুত্তা।ভুলেও ওর দিকে নজর দিবি না বলে দিলাম।নয়তো ভিষন খারাপ হয়ে যাবে।

ঘড়িতে তখন আটটা বাজে।বিছানা ঠিক করতে করতেই ফোনটা বেজে উঠলো রোশনির।আননোন নাম্বার।রোশনি রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,

_হ্যালো,,,,আপনি কি খাঁটি গরুর খাঁটি দুধ নিতে চান? তাহলে এখনি চলে আসুন,,,

_মাফ করবেন ভাই সাহেব।আমার প্রয়োজন নেই।আপনি রাখতে পারেন এবার।

রোশনি ফোন কেটে বিছানায় রাখতেই আবারো ওই নাম্বার থেকে ফোন আসলো। রোশনি কপাল কুচকে ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই আবারো একই কথা বলে উঠলো লোকটা।

_দেখুন ভাই আমার দুধের প্রয়োজন নেই।আপনি বরং অন্য কোথাও ফোন করুন।

_একদম খাঁটি দুধ।আপনি একবার এসে তো দেখুন।

_আরে বললাম না আমার লাগবে না।কথা বুঝেন না?

রোশনি ফোন কাটতেই আবারো ফোন বেজে উঠলো।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একই কথা বলে উঠলো লোকটা,

_আপনি একবার আসুন তো আগে

_ বললাম না যেতে পারবো না।দুধের প্রয়োজন নেই।বার বার বিরক্ত করছেন কেন হ্যা?অসহ্য লোক,,,কোথা থেকে যে আসে এসব?

রোশনি বিরক্ত নিয়ে ফোন কেটে বিছানায় ছুড়ে মারে।আবারো তুমুল গতিতে বেজে ওঠে ফোন।সাথে সাথেই চোখ মুখ শক্ত করে ফোন রিসিভ করে কানে ধরে রোশনি,

_ওই মিয়া,,,বললাম না যেতে পারবো না।ফোন দিছোস ক্যান? আর একবার ফোন দিলে তোর খবর আছে বলে দিলাম।ফাজিল ব্যাটা।

কথাগুলো বলেই ফোন কাটলো রোশনি।এদিকে রোশনির এমন কথা শুনে হকচকিয়ে দাড়িয়ে আছে অধির।মেয়েটা কি বললো কিছুই বুঝতে পারলো না সে।অধিরকে এমন হ্যাং মেরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মিসেস আনোয়ারা চৌধুরি বলে উঠলেন,

_এমন করে দাড়িয়ে আছিস কেন? কি বললো মেয়েটা?

অধির ওনার দিকে ফিরে দাড়ালো।একটা ঢোক গিলে বলে উঠলো,

_নেটওয়ার্ক ইস্যু দাদি।তুমিই ফোন দাও।

_নেটওয়ার্ক সমস্যা হলে আমি কিভাবে ফোন দেবো? তুইই পরে ফোন দিয়ে বলে দিস।

অধির মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমের বেলকোনিতে এসে দাড়ালো।গায়ের পাতলা গ্রে রঙের টি-শার্টটা বাতাসে হালকা উড়ছে।অধির ফোন হাতে আবারো রোশনির নাম্বারে ডায়াল করলো।এদিকে রোশনি ফোন রিসিভ করে অধিরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলতে শুরু করলো,

_ওই খবিশ ব্যাটা।আবারো ফোন দিছোস ক্যান? তোরে তো আমি….

রোশনির কথার মাঝেই ধমকে উঠলো অধির।

_ইউ স্টুপিড,,,,,কিভাবে কথা বলছো?আর একটা বাজে কথাও বলবে না তুমি।

চিরপরিচত সেই পুরুষালী গলা শুনতেই নিজের গলা শুকিয়ে এলো প্রায়।কাপা কাপা গলায় প্রশ্ন ছুড়লো রোশনি,

_কে বলছেন?

_আমি অধির চোধুরি স্টুপিড।

অধিরের নাম শুনেই অন্তরাত্মা কেপে উঠলো রোশনির।

_সরি স্যার।আমি ঠিক চিনে উঠতে পারি নি।আসলে একটা লোক আমায় বারবার ফোন করে বিরক্ত করছিলো তাই আমি মনে করেছি এটা বোধহয় ওই লোকটা।সরি স্যার।কি জন্যে ফোন করেছেন স্যার?

_কাল সকাল আটটায় চৌধুরি ম্যানশনে চলে আসবে।ডোন্ট বি লেইট।

রোশনিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কাটলো অধির।ফোনের দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজের মাথায় চাটি মারলো রোশনি।নিশ্চয় কালকের ঘটনার জন্যে শাস্তি দেবে।সেজন্যেই এতো ঘটা করে ফোন করে ডাকছে।কাল না জানি কি করবে লোকটা?সেদিনের বাকি থাকা চড়গুলো নিশ্চয় ফেরত দেবে।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here