সংগোপনে’ পর্ব-৫৩

0
1108

 

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৫৩
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

কুহেলি ধীর পায়ে স্টাডি রুমটার সামনে এসে দাড়াল, বন্ধ দরজায় একটা হাত দিয়ে সেটা খুলতে গিয়েও থেমে গেল। আলেখ এই ঘরটায় একেবারেই আসে না, বিয়ের পর কুহেলি একদিনের জন্যও আলেখকে এই ঘরে আসতে দেখেনি। এই ঘরটা শুধুই নভতেজ বাবুর, উনি একটু অবসর পেলেই এই ঘরটায় চলে আসেন। আলেখের এই ঘরে না আসা আর নভতেজ বাবুর আসার কারণ একটাই… মিসেস নন্দিনী নভতেজ শর্মা। বিয়ের আগে একদিন নভতেজ বাবু কুহেলিকে এই ঘরটায় নিয়ে এসেছিলেন, সেদিন প্রথম কুহেলি পরিচিত হয়েছিল তার আরেকজন মায়ের সঙ্গে কিন্তু শুধুই কয়েকটা নিষ্প্রাণ ছবির মাধ্যমে। আলেখ যে তার মাকে কতটা ভালোবাসে তার প্রমাণ কুহেলি পেয়েছে, আর ঠিক সেই কারণেই আলেখ তার মায়ের সব স্মৃতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ব্যাপারটা অনেকের কাছেই খুব অদ্ভুত মনে হতে পারে, সাধারণত অধিকাংশ মানুষই নিজের প্রিয়জনের স্মৃতি টাকেই আঁকড়ে ধরে কিন্তু আলেখ অন্য সবার থেকে ভিন্ন। ওর মনের গভীরে লুকানো বেদনা গুলো যতক্ষণ আড়ালে থাকে ততক্ষণ আলেখও ঠিক থাকে। যখনই সেই বেদনা গুলো পুরনো স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে তখন আলেখ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সূক্ষ কাচের মত চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় ওর মনটা। কুহেলি আবারও ভাবল এই ঘরে ঢোকা টা কি ঠিক হবে! আলেখ যদিও কোনোদিনই তাকে বাধা দেয়নি এই ঘরে আসতে। শুধু সে নিজে এড়িয়ে চলে, কারণ এই ঘরটা একসময়ে নন্দিনী দেবীর প্রিয় ঘর ছিল, তার হাজারো স্মৃতি গোটা ঘরময় ছড়িয়ে আছে। কুহেলি একটু ইতস্তত করে দরজাটা খুলেই ফেলল। আজ প্রায় দুমাস নভতেজ বাবু এখানে নেই তাই এই ঘরটায় আর কেউ আসেওনি। তবে তাতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কোনও ত্রুটি হয়নি, অন্যান্য ঘর গুলোর মতই এই ঘরটা কেও নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়। ঘরটায় ঢুকেই কুহেলির মনটা অন্যরকম একটা খুশিতে ভরে গেল, চারিদিকে সাজানো এত বইয়ের সম্ভার আর তার মাঝে মাঝে সাজিয়ে রাখা আছে নন্দিনী দেবী আর নভতেজ বাবুর কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি। কুহেলি দেওয়ালে টাঙানো একটা বড় বাঁধানো ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ছবিটায় নভতেজ বাবু আর নন্দিনী দেবী দাড়িয়ে আছেন সমুদ্রের তীরে, নন্দিনী দেবীর হাস্যময়ী মুখে ফুটে উঠেছে অনন্য খুশির আভা আর নভতেজ বাবু পিছন থেকে দুহাতে জড়িয়ে রেখেছেন ওনাকে। ছবি দেখেই বুঝে নিতে কোনও অসুবিধা হয় না, ওরা দুজন কত সুখী ছিলেন কতটা ভালোবাসতেন একে অন্যকে। কুহেলির মনটা খারাপ হয়ে গেল, আলেখ কে ছাড়া নিজেকে এক মুহুর্তও কল্পনা করতে পারে না কুহেলি। সেখানে নভতেজ বাবু কীকরে আছেন এত গুলো বছর! কতটা কষ্টে আছেন তিনি! সবসময় হাসিখুশি থাকা মানুষটা কি সত্যিই সুখী? হয়তো তার মনের কোনেও নিহিত আছে কিছু লুকোনো বেদনা, যেটা একান্তই তার। পুত্র পুত্রবধূ নিয়ে তিনি তো সুখেই আছেন তবুও দিনের শেষে নিজের ভালোবাসার মানুষটার, নিজের জীবনসঙ্গিনীর অভাব তিনি নিশ্চয়ই বোধ করেন। কারোর জায়গা কেউ নিতে পারে না, আর নিজের প্রিয়জনের স্থানটা তো শূন্য হলেও শুধুই তারই থেকে যায় সেই শেষ পর্যন্ত। কুহেলি সরে এলো ছবিটার সামনে থেকে, কেন যেন ছবিটার সামনে আর দাড়াতে পারছে না। নিয়তির কি নিষ্ঠুর নিয়ম! দুটো মানুষ যারা একে অপরের পরিপূরক, যাদের শরীর দুটো ভিন্ন হলেও মনটা একসূত্রে গাঁথা, তাদের একজনের ভাগ্যে লেখা থাকে অবধারিত বিরহ যন্ত্রণা। আর নভতেজ বাবুর মত কিছু মানুষদের ক্ষেত্রে বিরহ টা অসময়ে নেমে আসে অকস্মাৎ বজ্রপাতের মত। কুহেলির মনটা বিষন্নতায় ভরে উঠল, অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অন্তর থেকে। জীবনের এই নির্মম সত্য গুলো না থাকলে কি খুব ক্ষতি হত? কুহেলি আর বেশি ভাবতে চাইল না, যেটা নিয়ে ভেবে কোনও লাভ নেই যেটা বদলানো সম্ভবপর নয় সেটা নিয়ে ভেবে কি লাভ? কুহেলি এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল, কত রকম বই যে থরে থরে সাজানো রয়েছে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না। কুহেলি একটা পছন্দ মত বই নিয়ে স্টাডিরুমের একটা দিকে রাখা টেবিল টায় গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসল। বই পড়ার একটা আলাদা নেশা আছে, একবার পড়া শুরু করলে অন্য কোনদিকে আর মন থাকে না। কুহেলির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না, প্রায় একটা ঘন্টা হতে গেল কিন্তু তার কোনও হুশ নেই, বিভোর হয়ে যেন ডুবে গেছে কাহিনীর মধ্যে, তবে ঘোর কাটল। কুহেলি একমনে সব ভুলে বইয়ের মধ্যে যেন হারিয়েই গিয়েছিল হঠাৎ মুঠোফোনটা যান্ত্রিক শব্দ করে বেজে ওঠায় চমকে যেন কাহিনীর জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলো। ফোনের স্ক্রীনে ভাসছে আলেখের নাম, এই নামটাই যথেষ্ট কুহেলির মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। হাসি মুখে ফোনটা রিসিভ করল কুহেলি, সে জানে আলেখ শুধু মাত্র ওর খোজ নেওয়ার জন্যই ফোনটা করেছে। সাধারণ কিছু কথা আর ফোনের মধ্যেও আলেখের কিঞ্চিৎ দুষ্টুমির পর কুহেলি কলটা ডিসকানেক্ট করে আবার বইয়ে মন দেবে স্থির করল। কিন্তু তার আগে একবার একটু ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করল কুহেলি। বইটা বন্ধ করে রেখে উঠতে গিয়ে ওর হাত লেগে কি যেন একটা নীচে পড়ে গেল। তাকিয়ে দেখল একটা ডায়েরি, কালো চামড়ায় বাঁধানো একটা বেশ মোটা ডায়েরি। নীচু হয়ে ডায়েরি টা হাতে নিয়ে দেখল বেশ পুরনো ডায়েরিটা, এবাড়িতে কারো ডায়েরি লেখার অভ্যাস আছে বলে কুহেলি জানে না। আলেখ তো লেখেই না, তবে নভতেজ বাবু লেখেন কিনা ঠিক জানা নেই, এই ঘরটায় উনিই তো একমাত্র আসেন। কুহেলি অন্যের ব্যক্তিগত জিনিষে না বলে হাত দেওয়া পছন্দ করে না, ডায়েরিটাও রেখেই দিত কিন্তু একটা বিশেষ কারণে আর রাখতে পারল না। ডায়েরিটা নীচে পড়ার সময় খুলে গিয়েছিল, কুহেলি সেইভাবেই সেটা তুলে নেওয়ায় প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা উজ্জ্বল দুটি শব্দ দেখে তার চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল।
“আমার নিন্নি”
কুহেলি আপন মনেই বলে উঠল, নিন্নি! এই নিন্নি কে? যাকে উদ্দেশ্য করে ডায়েরি লেখেন নভতেজ বাবু। হ্যা, হাতের লেখা দেখে বুঝতে আর অসুবিধা হয়নি। কুহেলি একটা অদম্য কৌতূহল অনুভব করল, অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে উকি দেওয়া অনুচিৎ জেনেও নিজেকে সংযত করতে পারল না। ডায়েরি টা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে, নিজের ঘরে এসে ডায়েরিটা বিছানায় রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল। বেরিয়ে সোজা এগিয়ে গেল খাটের দিকে বলা ভালো ডায়েরির দিকে, অজানাকে জানার আকর্ষণ টাই বোধহয় এমনই। কুহেলি খাটে উঠে হেলান দিয়ে বসে সবে ডায়েরিটা খুলতে যাবে এমন সময় রাত্রির আগমন ঘটল। আর রাত্রির আগমন মানেই কথার অনর্গল স্রোত, স্বভাবতই সে এসেই তার কথার ঝুড়ি নিয়ে বসে গেল আর সাময়িক ভাবে কুহেলিও ডায়েরির কথা ভুলে গেল। দুজনে গল্পে মশগুল হয়ে উঠল, অধিকাংশ কথাই যিনি আসতে চলেছেন তাকে কেন্দ্র করে। একসময় রাত্রি বলল,

কুহেলি জানো তো, আমার না এবার আর ফিরে যেতে ইচ্ছেই করছে না।

কেন?

কেন আবার? এখানে তোমাদের সাথে এইরকম টাইম স্পেন্ড করার সুযোগ টা কি আর ওখানে পাব বলো? আবার তো সেই ওই এক নিয়ম মাফিক লাইফে গিয়ে আটকে পড়তে হবে।

রাত্রি, তোমার ঐ নিয়ম মাফিক লাইফটার জন্যই কিন্তু তুমি আজ রাত্রি অহুজা হয়ে উঠতে পেরেছ।

ইয়া ইয়া আই নো দ্যাট। আমিও নিজের কাজ টাকে খুব ভালোবাসি অ্যান্ড রেসপেক্টও করি। দ্যাট ওয়াজ মাই ড্রিম ইউ নো, আমার ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল একজন প্রতিষ্ঠিত মডেল হিসেবে নিজেকে দেখার। সো, আই নো ভেরি ওয়েল দ্যাট আমার কাজটাই আমাকে এই পজিশনে এনে দিয়েছে। বাট স্টিল… ইউ নো… মানে…..

থাক আর মানে মানে করতে হবে না, কবে যাচ্ছ সেটা বলো।

রাত্রি একটু মনখারাপ করে বলল,

আজ রাতে।

হোয়াট? এত তাড়াতড়ি?

হুম, ভেবেছিলাম আরও কিছুদিন থাকব কিন্তু সেদিন বললাম না একটা নতুন অ্যাসাইনমেন্ট এসেছে। ওটাই ফাইনাল হয়ে গেছে আর সেই জন্যই কালকের মধ্যেই পৌঁছাতে হবে। আজকে সকালেই সবটা ফাইনাল হল তাই তো তোমার কাছে আসতেও লেট হলো। ভিডিও কনফারেন্স চলছিল ওনাদের সঙ্গে, ওনারা অ্যাস সুন অ্যাস পসিবল কাজ শুরু করতে চান।

এবার কুহেলিরও একটু খারাপ লাগল, রাত্রির সঙ্গ ওর বেশ ভালোলাগে কিন্তু কাজকে যে মেয়ে সবার উপরে রাখে তার কাছে এইটুকু খারাপ লাগা সামলে নেওয়া তেমন কোনও ব্যাপার নয়। কুহেলি হাসি মুখে বলল,

তাতে এরকম মন খারাপ করার কি আছে? সময় পেলে আবার চলে আসবে।

হুম, সে তো ঠিকই।

আরও কিছু টুকটাক কথার পর কুহেলি বলল,

তোমার নতুন বন্ধুটিকে জানিয়েছ তুমি আজ চলে যাচ্ছ?

রাত্রি নিজেও সকাল থেকে এই কথাটাই ভাবছিল, জানাবে তো ঠিকই কিন্তু কিভাবে জানবে সেটাই বুঝতে পারছে না। একবার ভাবছে দেখা করে বাই বলবে আবার ভাবছে সেটা হয়তো একটু বেশিই হয়ে যাবে। যতই হোক ওদের বন্ধুত্ব হলেও এমন কোনও গভীরতায় ওদের সম্পর্ক পৌঁছায়নি যেখানে দাড়িয়ে যখন ইচ্ছে তখন দেখা করা যায়। তারপর ভেবেছে একটা ছোট্ট মেসেজ করবে, কিন্তু সেটাও ঠিক মনঃপূত হচ্ছে না। মেসেজ টা আবার বড্ড বেশি সামান্য হয়ে যাচ্ছে, ফোন করার কথা যে মাথায় আসেনি তা নয় কিন্তু কেন যেন একটু সংকোচ বোধ হচ্ছে। কুহেলি রাত্রিকে ভাবনার সাগরে ডুবে যেতে দেখে একটা আলতো ঠেলা দিয়ে বলল,

এই যে ম্যাডাম, কি এত ভাবছেন?

হ্যাঁ? কি?

বলছি কি এত ভাবছ? দেখা করবে না ফোন করবে না মেসেজ করবে সেটাই ভাবছ তো?

রাত্রি অবাক হয়ে বলল,

তুমি কীকরে জানলে?

আমিও বোকা নই বুঝলেন তো ম্যাডাম? বুঝি বুঝি, সবই বুঝি। আচ্ছা রাত্রি তুমি তো নিজেই বলেছ, তুমি সব কিছু সরিয়ে রেখে শুধু একজন বন্ধু হতে চাও। কি তাই তো?

অফকোর্স।

তাহলে এত হেজিটেট করছ কেন? ফ্রেন্ডের সঙ্গে তুমি ইচ্ছে হলেই দেখা করতে পার, ফোন করতে পার, মেসেজ করতে পার। এখন যেহেতু তোমাদের ফ্রেন্ডশিপ টা একেবারেই নিউ আর অন্যদের মত সাধারণ সর্কমস্ট্যানসে তোমাদের ফ্রেন্ডশিপ টা যেহেতু হয়নি তাই আই থিঙ্ক একটা ফোন কলই বেস্ট এক্ষেত্রে।

তাই না?

হুম, আমার অন্তত তাই মনে হয়।

রাত্রি হাসি মুখে বলে উঠল,

ফাইন, তাহলে এটাই ফাইনাল রইল। ওহ কুহু, ইউ আর ব্রিলিয়ান্ট।

তোমার থেকে কম।

দুজনেই হেসে উঠল, আরও কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর রাত্রি চলে গেল, অবশ্য ওঙ্কার ভিলা থেকে বেরিয়েই আগে নিশীথ কে কল করল। একটু রিং হওয়ার পরেই ওপাশ থেকে নিশীথের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,

বলুন মিস রাত্রি।

মিস টা বাদ দেওয়া যায় না?

হ্যা? মানে?

মানে, এই রাত্রির আগে মিস টাকে বাদ দেওয়া যায় না? কেমন যেন লাগছে শুনতে। এখন তো আমরা ফ্রেন্ড সো ইউ শুড কল মি রাত্রি।

হুম, সে তো বলাই যায় বাট তাহলে আপনাকেও তো এই মিস্টার আগরওয়াল টা চেঞ্জ করতে হয়।

রাত্রির বুকে যেন হঠাৎ কেউ হাতুড়ি পিটাতে শুরু করল। নিশীথ এমন হট করে এরকম কিছু বলবে আশা করেনি, উল্টে ভেবেছিল মিস রাত্রি টাই হয়তো বজায় রাখবে। রাত্রি একটু থেমে বলল,

মানে, আমি তো…

আমি রাত্রি বললে আপনিও নিশীথ বলতেই পারেন তাই না?

হুম।

ফাইন, তাহলে আজ থেকে এটাই ঠিক হল কিন্তু।

হুম।

ওকে, তাহলে এবার কেন ফোন করেছেন বলুন।

ওহ, দেখেছেন ভুলেই গিয়েছিলাম। আসলে আমি আজকে লন্ডন ফিরে যাচ্ছি, তাই ভাবলাম আপনাকে একবার বাই বলা উচিৎ।

ওহ, আজই ফিরছেন?

হুম।

ওকে, হ্যাভ এ সেফ জার্নি।

থ্যাঙ্কস।

এটা না বললেও হত। ওকে, আমার একটা মিটিং আছে, আই হ্যাভ টু গো। বাই…রাত্রি।

নিশীথের মুখে রাত্রি শুনে রাত্রির মনটা খুশিতে যেন ভরে গেল। আলতো হাসির ছোয়া নিয়ে বলল,

বাই… নিশীথ।

নিশীথ সামান্য হাসল, তবে সেটা তো আর রাত্রি দেখতে পেল না। কিন্তু তাতে অবশ্য কোনও অসুবিধা নেই, রাত্রি এমনিই খুব খুশি। এদিকে কুহেলি একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল পৌনে একটা বাজে। অল্প একটু হাসল কুহেলি, হাসির কারণ আর কিছুই না, আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আলেখের কল আসবে ওকে সময় মত লাঞ্চ করার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। আর হলোও ঠিক তাই, পাঁচ মিনিট কেন ঠিক দুমিনিটের মধ্যে আলেখের ফোন এলো আর বক্তব্য হুবহু সেই একই যা কুহেলি আন্দাজ করেছিল। আলেখের সঙ্গে কথা বলার পর কুহেলি উঠে লাঞ্চ করতে চলে গেল, অদ্ভুত ভাবে সত্যিই কুহেলি ডায়েরি টার কথা ভুলেই গেল। লাঞ্চ সেরে কুহেলি নিজের ঘরে এসে ওর ওষুধটা খেয়ে আবার বিছানায় উঠে বসল। দুপুরে ঘুমানোর অভ্যেস নেই তার, নেহাৎ শরীর খারাপ নাহলে বা খুব ক্লান্ত না হলে দুপুরে তার ঘুম আসে না। এটা আলেখও জানে তাই বারবার বলে দিয়েছে না ঘুমালেও চুপচাপ শুয়ে থাকতে হবে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো চলবে না। কুহেলি তাই একটু চুপচাপ শোবে বলেই মনস্থির করল, বালিশটা নিয়ে শুতে যাওয়ার মুহুর্তেই চোখে পড়ল ডায়েরিটা। ওটার কথা ভুলেই গিয়েছিল, এখন ওটা দেখে আবার সব মনে পড়ল। কৌতূহল টা আবারও ফিরে এলো, আর না শুয়ে বালিশটায় হেলান দিয়ে বসে ডায়েরিটা হাতে নিল কুহেলি। ডায়েরিটা খুলতে গিয়ে একবার মনে হল সে ঠিক করছে না, এভাবে কারো ব্যক্তিগত জীবনে অনধিকার প্রবেশ করা উচিৎ নয়। কিন্তু অন্তরের অদম্য কৌতূহল টাও কিছুতেই নিরস্ত করতে পারছে না, অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্বের পর শেষ পর্যন্ত কৌতূহল জয়ী হল। একটু ইতস্তত করে কুহেলি পাড়ি দিল এক অজানা জগতে।

নিন্নি….. ভালো আছ? আমিও কেমন বোকার মত প্রশ্ন করছি, ভালো তো থাকবেই তুমি। তোমার সব কষ্ট যে মিলিয়ে গেছে, মুক্তি পেয়ে গেছ তুমি। তুমি তো ভালো থাকবেই…. কিন্তু আমি যে ভালো নেই নিন্নি, তোমাকে ছেড়ে আমি একটুও ভালো নেই। আজ এক মাস হয়ে গেল তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেছ, এই একটা মাস আমি কীকরে কাটিয়েছি শুধুমাত্র আমি জানি। তুমি একবারও আমার কথা ভাবলে না নিন্নি? আমার কথা ছাড়ো, আমাদের আলেখ… ওর কথাটাও কি একবারও ভাবনি তুমি? কিকরে এত স্বার্থপর হয়ে গেলে তুমি? আমাদের এভাবে শূন্য করে দিয়ে চলে যেতে এতটুকুও কষ্ট হলো না তোমার?

প্রথম পৃষ্ঠার লেখা এখানেই শেষ, কোনও তারিখ উল্লিখিত নেই। বোঝাই যায়, এটা অন্য সাধারণ দিনলিপির মত ডায়েরি নয়। এটা খোলা মনের চিঠি, যে চিঠির কোনও ঠিকানা নেই। মনের যে কথা গুলো ভাষা হয়ে প্রকাশিত হতে পারেনি তারাই সংঘবদ্ধ অক্ষরের রূপে নিজেদের মেলে ধরেছে এই নিষ্প্রাণ ডায়েরির সাদা পাতা গুলোয়। নিন্নি.. মানে নন্দিতা দেবী চলে যাওয়ার পর হয়তো নভতেজ বাবু তুলে নিয়েছিলেন কলম। উজাড় করে দিয়েছিলেন নিজের মনের কথা গুলো, চেপে রাখা কষ্ট গুলো। কুহেলি পড়তে লাগল আর বুঝতে পারল, যখনই নভতেজ বাবু দুর্বল হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন তখনই ছুটে এসেছেন এই ডায়েরি টার কাছে। এটাই যে তার এক মাত্র সঙ্গী, তার অব্যক্ত বেদনার সাক্ষী। তার নিন্নির কাছে নিজের মনের কথা গুলো পৌঁছে দেওয়ার একমাত্র সাধন। আবার যখন খুব খুশি হয়েছেন তখনও নিজের খুশি ভাগ করে নিয়েছেন তার নিন্নির সঙ্গে। প্রতিটা শব্দে তখন ধ্বনিত হয়েছে খুশির ঝঙ্কার, এমন ভাবে কথা গুলো লিখেছেন যেন তার নিন্নি তার পাশেই বসে রয়েছেন আর তিনি নিজে মুখে সবটা তাকে বলে শোনাচ্ছেন।

জানো নিন্নি, আজ আলেখ লন্ডন থেকে ফিরেছে। আমাদের আলেখ অনেক বড় হয়ে গেছে, এমবিএ করে ফিরেছে সে আজ। আমি আগেই ঠিক করেছি জানো তো, ও ফিরলেই ওকে সব দায়িত্ত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ছুটি নেব।

পড়তে পড়তে কুহেলি কখনও হেসে উঠছে কখনও নোনা জলে ভিজে যাচ্ছে চোখের কোন দুটো। এত গুলো বছর ধরে মানুষটা প্রতিনিয়ত তার সবথেকে কাছের মানুষটার অভাব উপলব্ধি করেছেন কিন্তু কখনও কাউকে কিছুই বুঝতে দেননি। কত খানি চাপা কষ্ট বুকের মাঝে লুকিয়ে রেখেছেন তিনি এত গুলো বছর ধরে, কিন্তু তার ওই সদা হাস্যময় রূপের আড়ালে থাকা এই বেদনার হদিস তিনি কাউকে জানতে দেননি। কুহেলি পড়ে চলল, এক জায়গায় এসে আবার তার চোখ জোড়া স্থির হল।

আজ আমি আলেখকে বিয়ের কথা বলেছি, তোমার ছেলে যে বিয়ে করতেই চাইছে না। কিন্তু…… বিয়ে তাকে করতেই হবে, করতেই হবে। আমিও দেখব সে কেমন করে বিয়ে না করে পারে, আমি আমার সব ইচ্ছে গুলো অপূর্ণ থাকতে দিতে পারি না। তুমি তো আমায় ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে, কত স্বপ্ন ছিল আমার জানো। আমাদের ঘিরে কত স্বপ্নের জাল বুনে রেখেছিলাম, তুমি সব কিছু মিথ্যে করে দিয়ে চলে গেলে। কিন্তু আর না…. বিয়ে আলেখকে করতেই হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

কুহেলি এতটুকু পড়ে থামল, কিছুটা বিস্ময় ঘিরে ধরছে ওকে। আলেখের বিয়ে নিয়ে উনি এত কেন চিন্তিত ছিলেন? আর তাড়াতাড়ি কেন? এমন নয় যে আলেখের বিয়ের বয়স অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছিল বা এমনও নয় যে……. কুহেলির ভাবনা গুলোও আচমকাই থেমে গেল। একটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর আশঙ্কা উকি দিচ্ছে কুহেলির মনে, মনে প্রাণে চাইছে যেন তার আশঙ্কা সম্পূর্ণ অমূলক হয় অহেতুক হয়। কুহেলি দ্রুত হাতে ওল্টাতে লাগল পাতা, পরবর্তী কত গুলো পৃষ্ঠা জুড়ে নভতেজ বাবু শুধুই তার আনন্দ ভাগ করে নিয়েছেন। কুহেলি কে প্রথম দেখার কথা, ওদের বিবাহ নির্ধারণ, এনগেজমেন্ট, বিয়ে সবকিছুই ভাগ করে নিয়েছেন তিনি তার নিন্নির সঙ্গে। কুহেলি আরও দ্রুত হাতে পাতা গুলো ওল্টাতে লাগল, যেন মরিয়া খুঁজে চলেছে কিছু। সন্ধান করছে এমন কিছুর যেটা খুঁজে না পেলেই সে খুশি হবে। কিন্তু খুশি চাইলেই পাওয়া যায় না, কুহেলির আশঙ্কা শেষে সত্য প্রমাণিত হল। একটা পাতায় এসে কুহেলির চোখ দুটো যেন স্তব্ধ হয়ে গেল, যত পড়তে লাগল ততই ওর মনে হতে লাগল যেন কেউ ধারালো ছুরির আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে ওকে। চোখের কোল বেয়ে অঝোর ধারায় ঝরছে নোনা জল গুলো।

আজ শেষবারের মত কলম ধরছি নিন্নি…. কারণ…. এরপর আর তোমার সাথে এইভাবে কথা বলার প্রয়োজন হবে না। জানো নিন্নি তুমি যখন চলে গেলে আমাকে ছেড়ে, আমার মনে হয়েছিল কেন তুমি আমাকেও নিজের মারণ রোগটার একটু ভাগ দিয়ে যাওনি। কেন একা রেখে চলে গিয়েছিলে আমাকে এই কষ্টের মধ্যে রেখে। কিন্তু আলেখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম, আমি ভেঙে পড়লে ওকে কে সামলাত? ছেলেটা যে বড্ড নরম, তোমাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তোমার স্মৃতি গুলো ওকে দুর্বল করে দেয় বলে নিজেকে তোমার সব স্মৃতি থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। আকড়ে ধরেছিল আমাকে, ওর সমগ্র জগৎ জুড়ে আমি ছাড়া কেউ নেই। এখন অবশ্য আছে জানো, তোমাকে বলেছি তো আমাদের মিষ্টি মেয়ে কুহেলি। আলেখের যোগ্য স্ত্রী, ওরা দুজনেই দুজনকে ভীষণ ভালোবাসে। আলেখের জীবনে এখন আমি ছাড়াও অন্য কেউ আছে যাকে নিয়ে সে বাকি জীবন টা সুখে কাটাতে পারবে। আমার অবর্তমানে ওকে দেখে রাখার কেউ আছে এখন, এই জন্যই তো ওর বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি দিতে চেয়েছিলাম। ওকে একা রেখে কীকরে যেতাম বলতো? এখন আমি নিশ্চিন্ত হয়ে তোমার কাছে যেতে পারব, তবে ওই যে বলে না মানুষ যত পায় ততই লোভী হয়ে ওঠে। আমি প্রথমে শুধুই আমাদের ছেলেটার জন্য একটা যোগ্য জীবনসঙ্গিনী খুঁজছিলাম যার হাতে ওকে নিশ্চিন্তে তুলে দিয়ে আমি তোমার কাছে যেতে পারব। কিন্তু ধীরে ধীরে লোভ বাড়ল, একটা ছোট্ট আলেখ বা ছোট্ট কুহেলিকে দেখার খুব লোভ হচ্ছিল। ওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র কয়েক মাস হলো কিন্তু তাও একটু স্বার্থপর হয়েই ওদের নিজের ইচ্ছের কথাটা বলেই দিয়েছি জানো তো। তবে জোর করিনি, ওদের জীবন টা না হয় ওরা ওদের মত করেই গুছিয়ে নিক। আমার হাতে তো আর বেশি সময় নেই, কিন্তু তাই বলে আমার ইচ্ছে পূরণের জন্য ওদের কে তো জোর করতে পারি না। সব ইচ্ছে কি আর পূরণ হয় বলো? একটা ইচ্ছে না হয় অপূর্ণই থাক। ওদের আমি বলিনি জানো তো, তোমাকেও তো বলিনি যে আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমার কাছে আসছি। জানতাম তো তুমি রাগ করবে, কষ্ট পাবে তাই বলিনি কিন্তু আজ বললাম কারণ এটাই তো শেষ লেখা আমার। আর তোমার কাছে যাওয়ার আগে তোমাকে তো জানানো দরকার তাই না? কিন্তু ওদের জানাইনি, ওরা জানলে বিশেষ করে আলেখ জানলে খুব কষ্ট পাবে। একেবারে সময়মত না হয় জানবে, আগে থেকে জানলে ভেঙে পড়বে, চোখের সামনে আমাকে চলে যেতে দেখতে পারবে না। তাই সময় হলে একেবারেই জানবে, তখনও কষ্ট পাবে ভেঙে পড়বে কিন্তু কষ্টটা কিছুটা হলেও কম হবে। আর কুহেলি তো রইল, ও ঠিক সামলে নেবে আলেখকে, তবে কুহেলির জন্যও বড্ড খারাপ লাগছে জানো তো। মেয়েটা ছোট থেকে কখনও বাবার ভালোবাসা পায়নি, আমাকে পেয়ে সেই অভাব টা পূরণ হয়েছিল। আমিও নিজের মেয়ের জায়গায় বসিয়েছি ওকে, খুব ভালোবাসি ওকে। তাই তো এত বেশি কষ্ট পাচ্ছি, মেয়েটা আবারও পিতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে। আমি খুব চেষ্টা করছি জানো তো নিন্নি, যেদিন থেকে জানতে পেরেছি আমার শরীরেও বাসা বেঁধেছে মারণ রোগ সেদিন থেকেই চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখিনি। দেশ বিদেশ ঘুরেছি ওদের কাছে আরও কয়েকটা দিন বেশি থাকার জন্য কিন্তু আর সময় নেই। এই শেষ, তাও আমি শেষ চেষ্টা করছি যদি আরও কিছুদিন পাই কিন্তু জানি সেটা আর হবে না। তাও চললাম শেষ চেষ্টা করতে, ওদের বলেছি বিশ্ব ভ্রমণ করতে যাচ্ছি। হয়তো আর ফেরাই হবে না….. আর লিখতে পারছি না নিন্নি, খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমার কাছে যাব, আমার তো খুশি হওয়ারই কথা কিন্তু ওদের ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবলেই কষ্ট হচ্ছে নিন্নি…খুব কষ্ট হচ্ছে।

লেখা এখানেই শেষ, নভতেজ বাবু যেন নিজের মনটা উজাড় করে দিয়েছেন। কুহেলির চোখের জল বাঁধ মানছে না, এটা কি হল? যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না, কালকেই ওদের জীবনে এত বড় একটা খুশি এলো আর আজ….. কেন? কুহেলি চিৎকার করে কাদতে চাইল কিন্তু পারল না। সে নভতেজ বাবুকে কতটা ভালোবাসে সেটা বলে বোঝানো সম্ভব না, ওর জীবনের পিতার শূন্য স্থানটা তিনি নিজের স্নেহ ভালবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছিলেন। কেন? এইরকম কেন হল? এক নিমেষে যেন সব খুশি সব আনন্দ ধুলোয় মিশে গেল। ডায়েরির খোলা পাতাটা ক্রমশ আর্দ্র হয়ে উঠছে, কুহেলির চোখ বেয়ে নেমে আসা উষ্ণ জলধারা যেন মিশে যাচ্ছে নভতেজ বাবুর কষ্ট গুলোর সঙ্গে।

ক্রমশ____________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

আজকের পর্ব কেমন লাগল জানাতে ভুলবেন না যেন, অপেক্ষা করে থাকব কিন্তু। আজ তবে আসি দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here