সুখের সন্ধানে পর্ব ১১

0
530

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_১১
আমার শাশুড়ির ভেতরের জড়তা আমি কিছুতেই কাটাতে পারছি না। উনি সবকিছুতেই কেমন যেন দূরে দূরে থাকতে চায়। আমার সাথে মন খুলে কোনো কথাই বলতে চায় না। আমি যত কাছে যেতে চাই সে আমার থেকে তত দূরে থাকতে চায়। উনি কিছুতেই আমাকে মন থেকে মানতে পারছে না। বিয়ের এতগুলি বছর পরেও শাশুড়ির এমন ব্যবহার মেনে নিতে খুব কষ্ট হয় আমার। ক’দিন বাদে আমি নিজেই শাশুড়ি হব অথচ আজ পর্যন্ত শাশুড়ির কাছে নিজের প্রাপ্য সম্মানটুকু পেলাম না।
একদিকে সেলিমকে নিয়ে টেনশান অন্যদিকে সকাল বেলা প্রিয় যাবার পর থেকে মনটা ভীষণ খারাপ । সেলিম অফিসে চলে গেছে। তাই শাশুড়ির রুমে এসে বসেছি । উনার কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করছি কিন্তু উনি কেমন করে যেন দায়সারাভাবে উত্তর দিচ্ছেন।
আমি যেচে পড়ে উনার সাথে আগ বাড়িয়ে নানান ধরণের কথা বলছি। উনি শুধু হু হা করেই উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। আমি তার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি যে আমি এখান থেকে চলে গেলেই উনি বেশি খুশি হবেন। বুঝতে পারছি কিন্তু তবুও ভাবলাম কিছুক্ষণ উনার পাশে না থাকলে অসৌজন্যতা দেখায়। যদিও আমি জানি উনি একা থাকতেই ভীষণ পছন্দ করেন । তারপরেও আমার কাছে উনাকে একা রাখাটা খুব খারাপ লাগছে। একজন সার্ভেন্টকে সারাক্ষণ তার সাথে থাকার জন্য বললাম। ্টুকটাক কিছু কথাবার্তা সেরে বাইরে বেরুলাম।
এদিকে আরেক টেনশান মাথার মধ্যে।
আজ সকালে সেলিম ফোনে খানিকসময় কথা বলে কথা শেষ করে ফোন আনলক অবস্থায় রেখেই ওয়াশরুমে যায়। আমি সাথে সাথেই তার ফোন হাতে নিয়ে মেসেঞ্জারে ঢুকি। আমি কখনোই সেলিমের ফোন ঘাটাঘাটি করি না। কখনো অবিশ্বাসের চোখে দেখিনি এতদিন। কিন্তু সে সেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তাই বাধ্য হয়েই এই গোয়েন্দাগিরি করছি। লিস্টের শুরুর দিকেই পেয়ে গেলাম হেলেন তাবাসসুম নামের আইডি। মেসেঞ্জারে কী মেসেজ আদান প্রদান হয়েছে সেটা দেখার সময় নেই। সেলিম যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। আমি তড়িঘড়ি করে একটা মেসেজ পাঠালাম সেলিমের আইডি থেকে।

“ আজ ঠিক সাতটার দিকে বনানীর ক্যাফে ইটালিয়ানোতে এসো। জরুরী কথা আছে। আর সারাদিন ফোন বা মেসেজ করো না। আজ সারাদিন বাসাতেই থাকছি। আম্মি এসেছেন আমার বাসায়। তাছাড়া রূম্পা আছে। “

আমি তাড়াতাড়ি করে মেসেজ আবার এ সাইড থেকে রিমুভ করে দিলাম। সাথেসাথে হেলেনের মেসেঞ্জার আইডি ইগনোর করে রাখলাম যাতে ওর মেসেজ সহজে চোখে না পড়ে সেলিমের। হেলেনের ফোন নাম্বার ব্লক লিস্টে রাখলাম।
সেলিম আসার আগেই ফোন রেখে দিলাম। অফিসে যাবার জন্য রওয়ানা হচ্ছিল ঠিক তখন টি টেবিলের উপর ফোনটা দেখে পানি খাওয়ার ভাণ করে ইচ্ছাকৃতভাবে ওর ফোনের উপর জগের সব পানি ঢেলে দিলাম। ফোনটাকে বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা করতে যেয়ে আরেকবার ইচ্ছা করে টেবিলের উপর দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলাম। এবার এত জোরে ছিটকে যেয়ে ফ্লোরের উপর পড়েছে যে ফোনের ডিসপ্লে পানিতে গোসল করার পরেও যদি ভালো থেকে থাকত এবার আর সেই উপায় নেই। একেবারে নিশ্চিত হলাম যে এই ফোনের অবস্থা চৌদ্দটা বাজা সারা। আজকের জন্য সেলিমকে ফোনের থেকে দূরে রাখতে হবে যে করে হোক। ল্যাপটপ থেকে হয়তো হেলেনের আইডি খোঁজাখুঁজি করতে যাবে না। বাকিটা আল্লাহর উপর ভরসা। কিছুটা রিস্ক তো নিতেই হবে। সেলিম বেশ মেজাজ দেখাল এমন বেখেয়ালি আচরণের জন্য। ফোনটার অবস্থা শোচনীয় খারাপ। কতক্ষণ রাগে গজগজ করে অফিসে চলে গেল। আরেকটা ফোন আছে। কিন্তু সেটাতে শুধুমাত্র অফিসিয়াল কাজ করে সে। এই ফোনটাতেই ফেইসবুক, ইমো। হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জার ইন্সটল করা। কতক্ষণ বকাঝকা হজম করেছি মুখ বন্ধ করে। বার কয়েক সরি বলে তবে মাথা ঠান্ডা করেছি।

খুব চিন্তা হচ্ছে ওই সিম দিয়ে আবার কথা না বলে হেলেনের সাথে। তবে ওই ফোনটা অফিসিয়াল কিছু মেইল চেক করা ছাড়া আর কোনো কাজে লাগায় না। কিছু দিন আগেই ফোনটা কিনেছে। হাতে গোণা কয়েকটা নাম্বার সেভ করা ওই নাম্বারে। যাক , আল্লাহর উপর ভরসা। কাদের আপাতত সেলিমের পিএসের দায়িত্ব পালন করছে। কাদেরকে বললাম একটু খেয়াল রাখতে। যদিও কাদেরের কিছুই করার নেই।

সন্ধ্যার অপেক্ষা করছি। টুম্পাকে সবকিছু বলে রেখেছি।

ক্যাফে ইটালিয়ানোতে আগে থেকেই বসে আছে টুম্পা। আজ বেশ চড়া মেকআপ নিয়েছে সে । চোখের নিচের কালি ভাব আর বয়সের ছাপ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শিফনের হালকা গোলাপি শাড়ি আর স্লিভলেস ব্লাউজে দারুণ আবেদনময়ী লাগছে তাকে। সে এককাপ কফির অর্ডার দিয়ে বসে আছে। এমন একটা প্লেসে বসেছে যেখান থেকে তাকালেই কে আসছে কে যাচ্ছে সহজেই বোঝা যায়। বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। ঠিক সাতটা পনেরোর দিকে হেলেন ভেতরে প্রবেশ করে। টুম্পাকে হেলেনের ছবি দেখানো হয়েছে আগেই। সে দেখেই চিনতে পেরেছে । তার উপর ভিডিও কলে আমিও আছি। ওকে বলেছি পুরোটা সময় ভিডিও অন করে রাখতে। আমি যাতে কী হচ্ছে তা ক্লিয়ার না দেখলেও সব শুনতে পারি। হেলেনের চেহারা ক্লিয়ার বোঝা না গেলেও অবয়ব দেখে আমি শিওর হলাম ওই হেলেন। একদম টুম্পার সামনের টেবিলেই বসেছে হেলেন। বারবার ঘড়ি দেখছে সে। টুম্পাও কারো জন্য অপেক্ষা করছে এমন ভাব করে কফি খাচ্ছে আর অধৈর্যভাবে ঘড়ি দেখছে। টুম্পা অপেক্ষা করছে কখন হেলেনের সাথে ওর চোখে চোখ পড়ে। মিনিট কয়েক পরেই হেলেনের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয়। টুম্পা চোখেমুখে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে হেলেনের দিকে এগিয়ে যায়।

– তুমি হেলেন না? অবশ্য মিস্টেকও হতে পারে।

– আপনি?

– আমাকে চিনলে না? আমি তোমাদের ডিপার্টমেন্টের বড় আপু, যুথী। তুমি ফারিহার ফ্রেন্ড না?

– আপনি ফারিহাকে চিনেন?

– ও মা চিনব না? ওতো আমার খুব ক্লোজ ছিল। তোমার সাথেও আমার পরিচয় হয়েছিল । কিন্তু তুমি হয়ত ভুলে গেছ।

– ওহ! সরি , আপু। হ্যা ফারিহা আমার খুব ক্লোজ ফ্রেণ্ড। বসুন না , প্লিজ!

– থ্যাংক ইউ! কারো জন্য অপেক্ষা করছ মনে হচ্ছে?

– জি না মানে!

– হুম , বুঝতে পেরেছি। বয় ফ্রেণ্ড?

– হুম। আমিও আমার ফিয়ান্সের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ জানিয়ে দিলো কী একটা কাজে ফেসে গেছে । তাই আর আসতে পারছে না আজ।

– ওহ, সো স্যাড!

– তোমার বয়ফ্রেন্ড আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। তোমার সাথে গল্প করি আর কফিটা শেষ করি।

– জি, অবশ্যই। ও অবশ্য এখনি এসে যাবার কথা । কখনো তো দেরী করে না। আমিই আজ দেরী করে ফেললাম।

– ফোন দাও।

– দিয়েছি। বাট কল যাচ্ছে না । কী হয়েছে বুঝতে পারছি না।

– আবার ট্রাই করো। অনেক সময় নেটওয়ার্ক প্রবলেমের কারণে কল যায় না।

টুম্পা এবার ইচ্ছে করেই ওর সামনের সিটটা থেকে সরে যেয়ে পাশের সিটটাতে বসল।

– সামনে একটা ছেলে কেমন বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে । তাই এপাশটায় এসে বসলাম। সরি। তোমার অসুবিধা হচ্ছে না তো!

– না ,না! ঠিক আছে, বসুন।

হেলেন ফোন বের করে সেলিমের নাম্বারে কল দিচ্ছে আবারো।

– এটা তো সেলিমের নাম্বার। তুমি পেলে কই? সেলিম তোমার বয়ফ্রেন্ড? ওহ মাই গড! তুমি তো শেষ!

– না , মানে। এসব বলছেন কেনো? আপনি এই নাম্বার চিনেন? আমি তো আমার বসকে কল দিচ্ছিলাম অফিসে যেতে দেরী হবে সেটা জানাতে।

– হেলেন, এই নাম্বার আমার স্মৃতিতে গাঁথা । মৃত্যুর আগদিন পর্যন্ত ভুলব না। তুমি বস নামে সেভ করেছ কারণ সে তোমার বস। তুমি আমাকে বোকা বানাতে পারো না। কারণ এমন সময় আমিও পার করে এসেছি। সে একসময় আমারো বস ছিল। ওহ মাই গড! ঘুরে ফিরে আবার সেই সেলিম!

– আপনি এভাবে বলছেন কেনো ? উনাকে কী করে চিনেন আপনি?

– উনি আমার বস ছিলেন। ছয় মাস ছিলাম উনার অফিসে। আল্লাহর রহমত যে জান নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।

– মানে?

– উনি যে ম্যারিড সেটা তো তুমি জানো , তাই না।

– জি।

– উনার স্বভাবই এমন । সুন্দরী মেয়েদেরকে পিএস হিসেবে রেখে এবিউজ করে। প্রেমের ফাঁদে ফেলে যা খুশি করা ওর অভ্যাস। আমিও সেই ফাঁদে পড়েছিলাম। থ্যাংকস গড যে আমি জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছিলাম।

– মানে? কী হয়েছিল?

– ওর বউ চরম ক্ষ্যাপা আর পাগলাটে। পারে না এমন কিছু নেই। সেলিম আবার ওর বউকে প্রচণ্ড ভয় পায়। তাছাড়া না পেয়েও উপায় নেই। সেলিমের বাবা ওর ভাগের সব সম্পত্তি সেলিমের বাজে স্বভাবের জন্য বউয়ের নামে করে রেখেছে। আমিও এ কথা পরে জেনেছি। সেলিম কাউকে জানায় না এ কথা। আমি অনেক পরে জেনেছিলাম। সেলিমের বউ যদি কোনোভাবে জেনে যায় যে সেলিমের কারো সাথে এফেয়ার চলছে তবে তো আর রক্ষা নেই। তাই সেলিমই নিজে বাঁচতে সত্যি যাতে ফাঁস হয় তাই মেয়েটিকে মেরে ফেলে যাতে তার বউয়ের কানে আর কিছু পৌঁছাতে না পারে। প্রেমিকার চাইতে তো আর সম্পত্তি বড় না , তাই না? ওদের কাছে আমাদের মতো মেয়েদের জীবন তেলাপোকার জীবনের চাইতেও নিকৃষ্ট আর মূল্যহীন । আমার আগে স্নিগ্ধা নামের এক মেয়েকে কার এক্সিডেন্টের নাম দিয়ে মেরে ফেলেছে। এ কথা তো তখন মিডিয়াতেও এসেছিল । তুমি হয়ত জানো না। আমি ছিলাম তার নেক্সট শিকার। আমি সবকিছু জানার পর প্রাণ নিয়ে সরে এসেছি। ছোটোখাটো একটা বুটিকস শপ দিয়েছি। খেয়ে পড়ে ভালোই আছি। সামনের মাসে আমার বিয়ে। আমি স্নিগ্ধার বড় বোনের সাথে নিজে যেয়ে কথা বলেছি। স্নিগ্ধার বড়বোন অনেক চেষ্টা করেছিল সেলিমকে শাস্তি দেবার কিন্তু টাকার কাছে উনাদের হাহাকারের কী দাম?

– আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি এসব গল্প আমাকে কেন শোনাচ্ছেন?

– কারণ তুমি জালে ফেঁসে যাচ্ছ তাই। আমি আরেকজন স্নিগ্ধাকে মরতে দিতে চাই না। বড়লোকের ফাঁদে পড়ে এভাবে আর কত অসহায় মেয়ে জান দিবে?

– আমি বিশ্বাস করি না। আপনি অন্য সেলিমের কথা বলছেন।

– আমি পাগল নই ,হেলেন। আচ্ছা, তোমার লাইফ তোমার লায়াবিলিটিস। আমি যা জানি তাই বললাম। দেখ, তোমার সেলিম আসে কি না! বললে তো সে খুব সময় সচেতন । আধঘণ্টা পেরিয়ে গেছে অথচ এখনো খোঁজ নেই। আবার ফোনটাও সুইচ অফ।

– জ্যামে পড়েছে হয়ত। আর ফোনেও হয়ত চার্জ নেই। এমন আগেও হয়েছে।

– ওকে!

টুম্পা উঠে যাবে ঠিক সেই সময় আতঙ্কিত হবার ভাণ করে বাইরের দিকে দুটো লোককে ইঙ্গিত করে বলল, ওই লোক দু’জন আশা করছি তোমার পরিচিত না?
হেলেন খানিকক্ষণ দেখে বলল, না তো! উনারা কারা? আমার দিকে কী ইশারা করছে আর ফাসুরফুসুর করছে?

– তা তো জানি না। অনেক সময় ধরে খেয়াল করছি ওরা আমাদের টেবিল দেখিয়ে দেখিয়ে কথা বলছে । আবার কাকে যেন ফোন করছে।

– আমার মনে হয় তুমি ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছ। আচ্ছা, তোমার কথা কী ওর বউ জানে?

– জানি না। তবে কিছুটা জানতে পারে।

– হুম, হয়েছে। মরেছ এবার। সেলিম তোমাকে এখানে ডেকেছে লোক দিয়ে ধরে অন্ধকার কোথাও নিয়ে গলা কেটে মাটিচাপা দেবার জন্য। এখনো সময় আছে।

– এসব কী বলছেন ? হেলেনের চোখেমুখে কিছুটা শঙ্কার ছাপ।

– ঠিকই বলছি। আজ বেঁচে ফিরবে কি না কে জানে?

– কীসব বলেই যাচ্ছেন? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি।

– অন্যায় করোনি আবার? তুমি এখনো বুঝতে পারছ না। তোমার মত হাজারটা হেলেন সেলিমের জীবনে আসে যায়। তুমি না থাকলে তার কিছু এসে যায় না তার। কিন্তু তোমার ওপারের টিকেট যে কেটে ফেলেছে নিশ্চিত থাকো। আজ না পারলে কাল। কিন্তু মিশন সাক্সেস করেই ছাড়বে সে। আমি আগেভাগেই টের পেয়ে এজন্য কেটে পড়েছি। দু’বছর তো ঢাকাতেই থাকিনি। আজ এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারলে ফোন বন্ধ করে ঢাকার বাইরে চলে যাও। বেঁচে থাকলে এমন কত সেলিম পাবে। এই যে দেখ আমার বিয়ে হচ্ছে সেলিমের চেয়েও ভালো অবস্থাসম্পন্ন একজনের সাথে।

– কিন্তু এসব আপনি আমাকে বলছেন কেনো?

– মেয়েটা দেখছি পাগল । আমি তোমাকে চিনি তাই বলছি। তোমাকে খারাপ বুদ্ধি নিশ্চয়ই দিব না। যেভাবে পারো পালাও। এখান থেকে বের হয়ে ওদের সামনে পড়লেই জীবন শেষ এটা আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিলাম।
আমি চলি ভাই। আমার এসব ঝামেলায় যাবার ইচ্ছা নেই। তোমাকে সাবধান করলাম। বিশ্বাস অবিশ্বাস তোমার ব্যাপার।
হেলেনের চোখমুখ দেখে মনে হলো সে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। টুম্পার ডোজে কাজ হয়েছে তবে।

টুম্পা উঠতে যাবে ঠিক তখনই তিনটা মোটাতাজা লোক এসে মোবাইলে হেলেনের ছবি দেখিয়ে বলল, এই মেয়েটাকে দেখেছেন? ওর এখানে থাকার কথা। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের একটা মিটিং হবার কথা ছিল। জরুরী দরকার।

হেলেন পাশেই বসা ছিল। সে ব্যাগ দিয়ে ফেস আড়াল করল। লোক তিনটা একটু সামনের দিকে আগাতেই টুম্পা হেলেনকে একটান দিয়ে তার শরীরের আড়াল দিয়ে ঢেকে নিয়ে বাইরে বেরুল। দরজার কাছে এসে আর পেছনের দিকে না তাকিয়ে টুম্পা তাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে গেল।

সামনেই আমার গাড়ি অপেক্ষা করছিল টুম্পাদের জন্য। গাড়িতে উঠে মিররে তাকিয়ে টুম্পা ড্রাইভারকে বলল, দ্রুত চালাতে। হেলেনও তাকিয়ে দেখল কয়েকজন লোক তাদের অনুসরণ করে এদিকে ছুটে আসছে। হেলেনের ততক্ষণে কলিজা শুকিয়ে অর্ধেক।

– অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আপু।

– আরে কীসের ধন্যবাদ? আমি কি তোমার পর?
তোমার বিপদ এখনো কাটেনি। ওরা তোমার বাসায় পৌঁছে যাবে শিওর থাকো। বাসা কোথায়? পরিবারের সাথে থাকো নাকি একা?

– আমার পরিবার রংপুরে। আমি এখানে একা থাকি।

– এক কাজ করো। এখনি রংপুর চলে যাবার ব্যবস্থা করো। পারলে সিমটা ফেলে দাও। যাতে সেলিম তোমাকে আর কল দিতে না পারে।
হেলেন তাড়াতাড়ি সিমটা বের করে ভেঙ্গে দু’টুকরো করে বাইরে ছুড়ে ফেলল।

– কিন্তু আপু, আমার কাছে যে এই মুহূর্তে কোনো হার্ড ক্যাশ নেই।

– সমস্যা নেই । আমার কাছে আছে। তোমাকে পাঁচ হাজার দিয়ে দিচ্ছি। তুমি সুযোগ হলে আমাকে দিয়ে দিও। আমি তোমাকে স্টেশানে নামিয়ে দিয়ে আসব। ভয় নেই। আপাতত বেশ কিছুদিন ঢাকাতেই এসো না। আর একদম ঘাবড়াবে না। তোমার ভাগ্য ভালো । হায়াত আছে। নইলে আমিই বা ওখানে কেন আসব আর তোমার সাথেই বা কেন পরিচয় হবে বলো!

– আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ দিবো আপু। সারাজীবন মনে থাকবে আপনার এই সাহায্যের কথা। ঋণী করে ফেললেন।

– ধুর বোকা! তবে একটা কথা মনে রাখবে। এমন বড় লোকের ট্রাপে আর পড়ো না। এরা শুধু ভোগ করতেই জানে। এদের কাছে আমাদের মত মেয়েদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। স্নিগ্ধার করুণ পরিণতির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে শুধু আজ। আর একটু দেরি হলেই তোমার একই হাল হতো আজ। আল্লাহ মেহেরবান।

– আপনাকে সারাজীবন মনে রাখব আপু। আমি কি আপনার একটা কার্ড পেতে পারি?

– আমার কাছে কার্ড নেই । এই পার্সে কার্ড নেই মে বি। সমস্যা নেই । তুমি আমার নাম্বার রাখো।

– আপনার টাকাটা আমি সুযোগ হলেই পাঠিয়ে দিবো আপু।

– আরে বোকা! বড় আপুর পক্ষ থেকে গিফট হিসেবে রেখে দিও। আর হ্যা, নিজের পায়ে দাঁড়াও । শিক্ষিতা মেয়ে তুমি। এভাবে শর্টকাটে বড়লোক হতে যেয়ে জীবনটাকে ঝুঁকির মুখে ফেলো না। সব সেলিমরাই একই রকম। বেকায়দায় পড়লে ভালোবাসা উবে যায় কর্পুরের মতো। আমি সময়মত বুঝেছিলাম বলেই আজ নিজের একটা পরিচয় বানাতে পেরেছি। কোনোদিন সুযোগ হলে আমার বুটিক শপে এসো। মিরপুর স্টেডিয়ামের বিপরীতে আমার শপ।

– অবশ্যই আপু। ভালো থাকবেন।

হেলেনকে নামিয়ে দিয়ে টুম্পা আমাকে কল দিলো।

– আপা, সবই তো শুনলি। হেলেনকে তুমুল সাইজ দিয়েছি। যে ভয় পেয়েছে। মনে হয় না আর দুলাভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করবে।

– আমারও তাই মনে হলো ওর কথার টোন শুনে। তোকে কী বলে যে ধন্যবাদ দিব? এত চমৎকার আর নিখুঁত এক্টিং করলি!

– আরে বাদ দে। ধন্যবাদ কাদের ভাইকে দে। তার পাঠানো চ্যালাপ্যালাগুলি একদম পার্ফেক্ট মাস্তানের এক্টিং করেছে। বেচারি যা ভয় পেয়েছে।

– বেচারি? ওকে তোর বেচারি মনে হয়? বল,ডাইনী!

– আপা, ওরা আসলেই বেচারি। গ্রাম থেকে এসে একা একা থাকে। বর্তমান চাকরী বাকরীর যে বেহাল দশা। ওরা তো টিকে থাকার জন্য , বড়লোক হবার জন্য সিঁড়ি খোঁজে । সেই সুযোগটাকে কাজে লাগায় দুলাভাইয়ের মত পয়সাওয়ালারা। ওদের এক তরফা দোষ দিয়ে কী লাভ?

– এক তরফা দোষ দিচ্ছি কই? আমি জানি এখানে তোর দুলাভাইয়েরই দোষ বেশি। কিন্তু কী করব বল! সংসার টেকাতে হলে ওর সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকাতো আমার ক্ষমতার বাইরে।

– এক হেলেনকে তাড়িয়েছিস। দেখবি আরেক হেলেন এসে নাক গজিয়েছে। তাই এই হেলেনদের পেছনে না ঘুরে নিজেদের সম্পর্ক ঠিক কর। আমার এই কষ্ট নেই রে। জামাল খুব লয়্যাল। এসব দিক দিয়ে অনেক ভালো আছে , আলহামদুলিল্লাহ! দোয়া করিস!

– আলহামদুলিল্লাহ! এভাবেই যেন থাকে। এই কষ্ট সহ্য করার মতো না রে বোন!

– জানি আপা। তুই দুলাভাইয়ের মাঝে সেই আগের মত তোর জন্য মায়া জাগিয়ে তোল। আগে দেখি কত্ত কাহিনী করত তোকে দেখার জন্য। কীসব কাহিনী করে ফ্যামিলির সবাইকে রাজী করিয়ে তোকে বিয়ে করল। আর এখন সব গায়েব ! আজব মানুষ!

– দেখি কী করা যায়। তুই যা করেছিস ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না।

– আরে গাধা। এসব কী বলিস। তোর জন্য করব না তো পর মানুষের জন্য করব। এখন রাখছি। বাসায় ওরা কী করছে আল্লাহ জানে। অনেক রাত হলো। আমি বাসায় পৌঁছেই তোর গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি। ভালো থাকিস। আর বাসায় আসিস। ওহ , শাশুড়ি আম্মার আর তার ছেলের খুব খাতিরদারি করিস কিন্তু। আল্লাহ হাফেজ।

– আল্লাহ হাফেজ।

চলবে….

পর্ব- ১০
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/342350000881009/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here