সুখের_সন্ধানে পর্ব_৩৩

0
441

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৩৩

পুরো বাড়িতে সাজ সাজ রব। আজ মিথিলার বিয়ে। একটু পরেই মিথিলাকে বিউটি পার্লারে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে সরাসরি কমিউনিটি হলে। এ বাড়ি থেকে বিদায় নেয়ার মুহূর্ত যত কাছে আসছে ততই আমার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়েই চলছে। জানিনা মেয়েটার ভালো করতে যেয়ে মন্দ করছি কি না। মেয়েদের ভাগ্য এমন কেন? এক খাঁচাতে বড় হয়ে অন্য খাঁচায় যেয়ে আবার পোষ মানতে হয়। সব আপন সম্পর্কগুলি কলমের এক খোঁচায় পর করে নতুন একটা সম্পর্কে জড়িয়ে সব পর মানুষগুলিকে আপন করে নিতে হয়। আর সেই আপন করার প্রক্রিয়ার মাঝে তাকে যে কতটা কাঠখড় পুড়াতে হয় সেটা কোনো পুরুষ মানুষের কোনোদিনই বুঝে আসেনি আর আসবেও না।

মেয়েটা আমার বুকের ভেতর কতটা অংশ জুড়ে ছিল সে আমি এখন অনুভব করছি। নিজের পেটে মেয়ে না থাকার যন্ত্রণা আমি মিটিয়েছি মিথিলাকে পেয়ে। শুধু মেয়েই না ও আমার মাও। মাকে হারিয়েছি বহুবছর। মায়ের আদর শাসন খুব মিস করি প্রতিটি মুহূর্তে। কিন্তু সেই ক্ষতটাকে অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছিলাম এই লক্ষী মেয়েটাকে পেয়ে।

সকাল থেকে কোনো কাজেই মন বসাতে পারছি না। যেটাই করতে যাচ্ছি কোনো না কোনো ভুল হচ্ছে। আমার শাশুড়ি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমাকে খানিকক্ষণ বোঝলেন।

আমার মেয়ের বিয়ে । কত কত দায়িত্ব অথচ আমার হাত পা যেন চলছেই না। মন চাচ্ছে ওকে বুকের মাঝে কোথাও লুকিয়ে রাখি। চোখের পানি কিছুতেই বাঁধ মানছে না। আমার মতো একই অবস্থা মিথিলারও । সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছে । কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলেছে “ আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে চাই না মা, আমি যেতে চাইনিও। ভেবেছিলাম সারাজীবন তোমার কাছে থেকে যাব। কেন এমন হলো, মা ? আমি তো এক মাকে হারিয়ে নতুন করে তোমার মাঝে আমার মাকে খুঁজে পেয়েছিলাম। সেই তোমার থেকেও আমাকে দূরে থাকতে হবে কখনো ভাবিনি। চলে যাচ্ছি , মা। আমাকে তুমি ভুলে যেও না। আমার কষ্টটা তোমাকে যদি দেখাতে পারতাম! ”

মা মেয়ে মিলে কত যে কেঁদেছি ! আমার মা যেদিন চলে গিয়েছিল সেদিনের মতো আজো আমার গলার কাছে কান্নারা দলা পাকিয়ে আমার দম বন্ধ করে দিচ্ছিল। নিজেই ভেবে পাচ্ছি না মায়েরা কী করে তার মেয়ের চলে যাওয়াকে সহ্য করে? আদরের ধনকে পর করে দিয়ে অন্যের হাতে তুলে দিতে কতটা কষ্ট সে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
সেলিমও হয়ত আমার মনের খবর টের পেয়েছিল তাইতো পাষাণ দিলের মানুষটাও এসে আমাকে সান্ত্বনা দিতে বাধ্য হয়েছিল। কারো সান্ত্বনাই আমার মনটাকে শান্ত করতে পারছে না। ভোর থেকে প্রিয়কে দেখছি না কোথাও। ওর তো আজ তাড়াতাড়ি ওঠার কথা ছিল। কমিউনিটি হলে যাবে দেখভালের জন্য। ছেলেটার ইদানিং কি যে হলো! মিথিলার বড় ভাই হিসেবে ওরও কি কম দায়িত্ব? গতকাল হলুদের প্রোগ্রামেও কেমন গা ছাড়া ভাব করে কাজকর্ম দেখছিল। মেজাজ খুব গরম হয়ে গিয়েছিল কাল। তাই ইচ্ছেমত খানিকক্ষণ বকাও দিয়েছি। মিথিলা না হোক ওর নিজের মায়ের পেটের বোন তাতে কি ? মিথিলা ওর ফার্স্ট কাজিন। মায়ের পেটের বোনের চেয়ে কম কীসে? তাছাড়া মিথিলার আমরা ছাড়া আছেই বা কে? শহরের কত কত বড় মানুষেরা আসছে বিয়েতে। প্রায় দু’হাজার মানুষের এরেঞ্জমেন্ট। মুখের কথা তো না। ওর বাপের না হয় মিথিলা কিছু হয় না তাই বলে তোরও কি কিছু দায়িত্ব নেই।

মিথিলার ছোট মা তো মেহমান। সে সেজেগুজে অনুষ্ঠানে হাজির হয়েই দায়িত্ব শেষ করে। আসাদ অবশ্য অনেক দৌড়ঝাঁপ মেয়ের জন্য করছে। আসাদেরও আমার মতো ভীষণ মন খারাপ। গতকাল হলুদের প্রোগ্রামের শেষে আমার সামনে এসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছে মেয়েটার জন্য । এতদিন আমার কাছে ছিল সে নিশ্চিন্তে ছিল কিন্তু এখন পরের ঘরে যাচ্ছে। সেখানে কেমন না কেমন ঘর হয় মা মরা মেয়েটার তা নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই তার। ভাইয়া ভাবি কিছু দায়িত্ব নিয়েছে তাই একটু হলেও উপকার হচ্ছে। মেহরাব ছোট মানুষ হলেও অনেকটাই করছে বোনের জন্য। অনেক দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছে সে ।

পার্লারে মিথিলার এপয়েন্টমেন্ট সাড়ে দশটায়। আমিই নিয়ে যাব ভেবে রেখেছি। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে প্রেসার আপ ডাউন করছে খুব । একদিকে মানসিক চাপ, আরেকদিকে শারিরীক অবস্থাও ভালো মনে হচ্ছে না। মানসিক আর শারীরিক দুইয়ে মিলে এত বাজে অবস্থা মনে হচ্ছে । বিশ্রাম না নিলে এক পাও সামনে ফেলতে পারব কি না সন্দেহ।

গতরাতে হলুদ পার্টিতে কিছু খেতে পারিনি। আর সকালে তো মুখে দিতে যেয়েই বমি আসছে। বয়স তো কম হলো না। এত স্ট্রেস আর লোড শরীর আর নিতে পারছে না। ভয় পেয়ে গেলাম। এখনো কত কাজ বাকী! অথচ আমি এভাবে যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি তবে কীভাবে কী হবে? এ ক’দিনের দৌড়াদৌড়িতে আমার শরীরের বেহাল দশা। কিছুতেই পা টেনে আর সামনে নিতে পারছি না। এখন বিশ্রাম নিতে না পারলে মনে হয় না যে বিয়েতে এটেন্ড করতে পারব।

কিন্তু বিশ্রাম নিলে মিথিলাকে কে নিয়ে যাবে? মনে মনে প্রিয়কে খুঁজছি । যদিও আমার ভাইয়ের মেয়েটা যাবে সাথে। কিন্তু ও একা বুঝবে কী? এ সময়ে আমার থাকাটা জরুরী। প্রিয় গেলেও হয়ত তবু মিথিলার ভালো লাগত। ওর মনেরও যে বেহাল দশা সেটা ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারছি। ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করছে অথচ চেহারায় খুশির ছিটেফোঁটাও দেখছি না।
রুমে না পেয়ে কোনোরকম টলতে টলতে ছাদের দিকে গেলাম। যা ভেবেছি তাই। চিলেকোঠার রুমটাতে রোদ্দুরে ভরে গেছে। অথচ এখনও প্রিয় সেখানে ঘুমাচ্ছে। ওকে ডেকে তোলার জন্য কাছাকাছি যেয়ে কী এক উৎকট গন্ধে বমি চলে আসল। দেখলাম খাটের পাশেই হুইস্কির বোতল। মাথায় কিছুই কাজ করছে না আমার। প্রিয় তবে এসবও শুরু করেছে? এত অধঃপতন ? সেদিন রাতে ওর মনের খোঁজ নিতে যেয়ে যেটুকু বুঝতে পেরেছি ছেলে আমার বিরহের অনলে পুড়ছে। বিন্দু নামের ওই মেয়ে ওকে ধোঁকা দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে নিজেকে এভাবে কষ্ট দিবি? মিথিলার ঝামেলা শেষ হলেই ওর বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে। এতবড় ছেলে এখন যদি এমন টিনেজদের মত বিহেভ করে চলবে কী করে? সেলিমের সাথে কথা বলতে হবে। আহারে! কী কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা।

পাশে থাকা পানির বোতলটা নিয়ে ওর নাকমুখে পানির ঝাপটা দিলাম। ও চোখ খুলে আমাকে দেখে ভীষণ অবাক হলো। যাক, ওর নেশা তবে কেটেছে। আমার চিন্তা কমলো।

– কীরে বাবা! খুব মন খারাপ? কী হয়েছে তোমার?

– কিছু না, আম্মু। তুমি এখানে? চোর ধরা পড়ার মতো উঠে বসল সে।

– রুমে না পেয়ে ভাবলাম এখানে আছ, তাই ! কথাগুলি বেশ কষ্ট করে টেনে টেনে বললাম আমি।

– আম্মু, তোমার কী হয়েছে? খুব সিক লাগছে তোমাকে! ব্যস্ত হয়ে উঠল প্রিয়।

– তেমন কিছু না। ক’দিনের দৌড়ঝাঁপে একটু ক্লান্ত রেস্ট নিলে বোধ হয় ঠিক হয়ে যাব। বাবা, মিথিলাকে একটু পার্লারে নিয়ে যাবে? আমি পারছি না। আমি একটু রেস্ট নিয়ে সরাসরি হলে আসব। প্লিজ, বাবা।

– আমি? আমি এসবের কী বুঝি?

– তোমাকে বুঝতে হবে না। ওরাই সব করবে। তুমি সাথে গেলে মিথিলা সাহস পাবে। সকাল থেকে খুব কান্নাকাটি করছে। বোঝই তো! আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

– প্রিয় খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, ঠিক আছে। তুমি আগে রুমে চলো। আমি ডাক্তার ডাকছি। তোমার চেক আপের দরকার সবকিছুর আগে।

– তোমার বাবাকে বলেছি সে অলরেডি কল করেছে ডাক্তারকে। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না। মিথিলার যাবার সময় হয়ে গেছে।

– ঠিক আছে।

– আর বাবা, একটা কথা না বলে পারছি না। তোমার কষ্টটা কি এতই গভীর যে এসবে সে কষ্টের ক্ষত মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করে নিজের ক্ষতি করে যাচ্ছ?

কথাটা আমি বলতে চাইনি। ভেবেছি আজকে এসব কথা তুলব না। আমি যে ওর এসব বুঝতে পেরেছি সেটাও ওকে বুঝতে দিব না। আজকে মিথিলার বিয়েটা ভালোয় ভালোয় শেষ হোক তারপরে না হয় ওকে ধরব। কিন্তু মায়ের মন তো! নিজের অসুস্থতার কথা যেন ভুলে গেলাম। ছেলেটার এমন দশা দেখে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে কষ্টে।

প্রিয় ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলল, আম্মু সরি! গতরাতে পার্টি শেষে বন্ধুরা মিলে একটু …। এমন আর হবে না। তুমি আমাকে নিয়ে ভেব না। আমি রেডি হচ্ছি।

প্রিয়কে দায়িত্ব দিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে আমি রুমে যেয়ে রেস্ট নিচ্ছি। ডাক্তার এসে কিছু মেডিসিন দিয়ে গেল যাতে দ্রুত রিকভার করতে পারি। প্রিয়কে নিষেধ করলাম মিথিলাকে এসব জানাতে। তাহলে মেয়েটা কিছুতেই পার্লারে যাবে না। এখানে আমার পাশে বসে থাকবে। কাজের মেয়েটাকে দিয়ে মিথিলাকে খবর পাঠালাম মিথিলাকে এটা বলতে যে আমি একটা এমারজেন্সী কাজে কমিউনিটি হলে গিয়েছি। সেখানেই দেখা হবে তার সাথে আমার। প্রিয়র সাথে তাকে যেতে বলেছি। হয়ত ওর মন খারাপ হবে। তাও এর থেকে ভালো কোনো সমাধান আপাতত পেলাম না।

গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে মিথিলা। পাশেই প্রিয় ড্রাইভ করছে। মিথিলার বুকের মাঝে কে যেন হাতুড়িপেটা করছে। সে কিছুতেই প্রিয়র মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে সে এখনই কেঁদে ফেলবে ।

– কি রে আম্মু আসেনি দেখে তোর মন খারাপ?

– হুম!

– মন খারাপের কি আছে? ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাবার তোর স্বপ্ন সফলতার পথে। আর তো কয়েক ঘন্টা মাত্র। খুব ভালো করে সাজিস যাতে সাজিদ তোকে দেখেই অজ্ঞান হয়ে যায়। সাজিদ শালাটা বড় ভাগ্যবান রে! ওর ভাগ্য দেখে খুব হিংসে হয়। ভালোবাসার এমন সফল পরিণতি ক’জনের কপালে জোটে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, প্রিয়।

– বিন্দুকে খুব মিস করছ , ভাইয়া? আস্তে করে বলল মিথিলা।

– উহু। মোটেই না । বিন্দু ছিল আমার চলতি পথে পাওয়া দমকা হাওয়ার মতো। ভালোলাগা হয়ে আমাকে শিহরিত করেছে আবার একরাশ বিরক্তি হয়ে চলেও গিয়েছে। এখন আর ওসব মানুষের জন্য মন খারাপ হয় না। আসল নকলের ফারাকটা বুঝতে পেরেছি । হয়ত দেরি করেই বুঝেছি। কী আর করা । ভাগ্য যেদিকে নিতে চায় সেদিকেই যেতে হবে।

আর কোনো কথা বলল না প্রিয়। মিথিলা খানিকসময় চুপচাপ থেকে প্রসঙ্গ বদলাতে বলল, আচ্ছা তুমি ওভাবে নাবিলাকে রেখে এলে কেন? মামা মামি জানলে খুব মন খারাপ করবে।

– আই ডোন্ট কেয়ার! আমার যাকে পছন্দ না তাকে আমার গাড়িতে তুলি না। আর রেখে এলাম কোথায় ? অন্য গাড়িতে ড্রাইভার নিয়ে আসবে ওকে।

– ওকে পছন্দ না হবার কারণ জানতে পারি?

– কারণ সিম্পল! মামাতো বোন হলেও ওর সাথে আমার খুব বেশি পরিচয় নেই। জাস্ট দেখা হলে হাই হ্যালো রিলেশান। অথচ আমার সাথে এমন গায়ে পড়ে ঢলে ঢলে কথা বলে যেন আমাকে কত বছর ধরে চিনে । আর ওর চোখের নজরও আমার পছন্দ না। কেমন আনকম্ফোর্টেবল।

– হা হা হা! ভয় পেয়েছ যদি গলায় ঝুলে পড়ে?

– ভয় পাবো কেন? বোরিং লেগেছে আমার কাছে। ও তোর সমবয়সী তাই না?

– হুম। ও একটু এমনই। যাকে দেখে তার প্রেমে পড়ে যায়। আর তোমার মত হ্যান্ডসামের প্রেমে না পড়ে এমন সাধ্য কোন মেয়ের আছে বলো!

মিথিলা কথা শেষ করতে করতেই প্রিয় ঘ্যাচাং করে জোরে ব্রেক কষল। সীট বেল্ট পড়া না থাকলে মিথিলার মাথা কপাল যে নিশ্চিত ফাটতো সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সে খুব ঘাবড়ে যেয়ে বলল, কী হয়েছে ? তুমি ঠিক আছ, ভাইয়া?

– গম্ভীর গলায় বলল, ঠিক আছি । তুই ব্যাক সীটে যাতো!

– মিথিলা অবাক হয়ে বলল, ব্যাক সীটে কেন?

– যা বলেছি তাই কর।

মিথিলা কথা না বাড়িয়ে ব্যাক সীটে যেয়ে বসল। কী এমন অন্যায় করে ফেলল সে বুঝতে পারছে না। প্রিয়কে মাঝে মাঝে সে বোঝে না। কেমন যেন আনপ্রেডিক্টাবেল মানুষটা। কখন যে কী করে বোঝার উপায় নেই।
প্রিয় খানিকটা সামনে যেয়ে একটু নিরিবিলি জায়গায় সাইড করল। নিজে গাড়ি থেকে নেমে ব্যাক সীটে চলে আসলো। মিথিলা কিছুই বুঝতে পারছে না। প্রিয় আসলে করতেটা চাচ্ছে কী?

– ভাইয়া , তুমি এখানে? কিছু বলবে? গাড়ি থামালে কেন?

– হুম, বলব। কী বললি তখন তুই?

– কখন? ভয়ার্ত গলায় বলল মিথিলা। মিথিলা কিছুই বুঝতে পারছে না। ব্যাক সীটের গ্লাস থেকে বাইরের কেউ কিছু দেখতে পায় না । এজন্য প্রিয় তাকে এখানে পাঠায়নি তো! নাবিলাকে নিয়ে না আসা, তাকে ব্যাক সীটে পাঠানো, গাড়ি এমন নির্জন জায়গায় পার্ক করানো, প্রিয়র পেছনে আসা ! কিছুই ভাবতে পারছে না মিথিলা। খুব ভয়ে হাত পা হিম হয়ে এল। কীসব আজেবাজে ভাবছে সে। প্রিয়কে সে অবিশ্বাস করছে ভাবতেই নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হলো তার।

– ওই যে বললি আমাকে কোনো মেয়ে ভালো না বেসে পারবেই না।

– ও তাই ? হ্যা ঠিকই তো বলেছি। আমাকে তুমি যে মাঝেমাঝে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে আসতে আমার কয়েক ফ্রেন্ড তো আমার কাছে কতবার তোমার নাম্বার চেয়েছে। ফেইসবুক আইডি চেয়েছে। তাই বললাম। কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, মিথিলা।

– এত মেয়ের খোঁজখবর জেনে লাভ নেই। একটা সত্যি কথা বলবি। তুই আমাকে পছন্দ করিস না?

– মিথিলার তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার যোগাড় । কোনোরকম ঢোক গিলে ছলছল চোখে কাঁপা ঠোটে বলল, করি তো! খুব করি।

– সত্যি ! তাহলে এতদিন বলিসনি কেন রে পাগলী !

প্রিয়র ততক্ষণে আর কিছু জানাবোঝার মতো অবস্থা নেই। সে এমন ভাবে মিথিলাকে বুকের সাথে চেপে ধরল যেন মিথিলার পাজরের সাথে নিজের পাজর মিশিয়ে ফেলে। মিথিলাও যেন মিশে যেতে চায় প্রিয়র বুকের মাঝে। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় নোনা পানি ঝড়ছে তার। প্রিয়ও নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল মিথিলার মাঝে। সে কান্না চাপিয়ে রাখতে পারছে না। এই মুহূর্তে সে যেন ভুলে গেছে মিথিলা সাজিদের বাগদত্তা । একটু বাদেই তাদের বিয়ে। মিথিলা সাজিদকে পছন্দ করে। সে নিজে এটার স্বাক্ষী। আবেগে সে ছোট বাচ্চাদের মতো হয়ে গেল। মিথিলাকে কিছুতেই সে আর ছাড়বে না। মিথিলাকে সারাজীবনের জন্য বুকের খাঁচায় শেকল পরিয়ে রাখবে সে। কাউকে নিয়ে যেতে দিবে না। কাউকে না। কাউকে পরোয়া করে না সে। যে করেই হোক এতদিনের না বলা কথাগুলি আজ সে বলবে। কাল সারারাত পাগলের মতো কেঁদেছে মিথিলার জন্য।

“আমি তোকে অনেক ভালোবাসিরে, পাগলী। বলতে সাহস পাইনি। যদি ফিরিয়ে দিস! যদি ভুল বুঝিস! আমি তোকে আমার ভাবনার চাইতেও বেশি ভালোবাসি। কাউকে নিয়ে যেতে দিব না তোকে , কাউকে না। তুই আমার ছিলি , আমারই থাকবি। ”

কান্নার দমকে যেন প্রিয় আর কিছু বলতে পারছে না।
মিথিলা এতক্ষণ দিকভ্রান্ত হয়ে হারিয়ে গিয়েছিল অন্য জগতে। নিজেকে সমর্পণ করেছিল প্রিয়র মাঝে। হঠাৎ তার হুশ ফিরল। নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল। খুব অবাক হলো এটা ভেবে যে প্রিয়ও তবে তাকে তার মত করে ভালোবাসে। অথচ সে কত না ভয়ে ছিল। কখনো বলতে পারেনি নিজেদের মনের কথা একে অন্যকে। কিন্তু আজ কোন প্রান্তে এসে তারা ভালোবাসা জাহির করছে। ছিঃ ছিঃ! এটা সে কী করছে? প্রিয়র পিঠ খামচে ধরা হাতদুটির বন্ধন শীতল হলো তার। প্রিয়র টি শার্টে নিজের চোখের পানি মুছল। কত বড় ভুল সে করতে যাচ্ছে ভেবে নিজেকে মনে মনে ভর্তসনা করতে লাগল। রূম্পা মায়ের মুখখানা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। সাজিদের মুখখানা জ্বলজ্বল করছে । এই মানুষটা তাকে কত ভালোবাসে, বিশ্বাস করে আর সে কি না! ছিহ! আর একটু পরেই সে তার বউ হবে অথচ সে এসব ভাবছে? অন্য পুরুষের বুকে আছড়ে পড়ে সুখ খুঁজছে ? লজ্জায় যেন মাথা তুলতে পারছে না মিথিলা। তাও নিজেকে সামলাল প্রাণপণ চেষ্টা করে।

– ভাইয়া, এসব কী বলছ? মাথা ঠিক আছে তোমার? প্লিজ, শান্ত হও। আমার পার্লারে দেরি হয়ে যাবে।
সাজিদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

সাজিদের নাম প্রিয়র কানে যাবার সাথে সাথে সে সতর্ক হলো। এতক্ষণে হুশে এল সে। মিথিলাকে বুক থেকে টেনে তুলে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই যে বললি তবে?

– তোমাকে পছন্দ করি এখনও বলছি। তোমাকে পছন্দ করি , ভালোবাসি। দৃঢ় কণ্ঠে বলল, মিথিলা।

– তবে সেখানে সাজিদের নাম কেন? তেজের সাথে বলল প্রিয়।

– সাজিদের প্রতি ভালোবাসা আর তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাকে তুমি গুলিয়ে ফেলছ মনে হয়। তুমি আমার বড় ভাই। তোমাকে আমি ভালোবাসি। আজীবন বাসব। তোমার সব বিপদে আপদে আমি ছুটে আসব কারণ তুমি আমার বড় ভাই।
বারবার বড়ভাই কথাটা বলে মিথিলা প্রিয়কে মনে করিয়ে দিচ্ছে তাদের যে আরেকটি সম্পর্ক আছে সেটির কথা। প্রিয় এই মুহূর্তে ট্রমার মধ্যে আছে এটা ভালো করেই বুঝতে পারছে মিথিলা। সেও ছিল খানিকক্ষণ আগে। সে চাচ্ছে প্রিয়কে বাস্তব অনুধাবন করাতে।

প্রিয়র বিশ্বাস হচ্ছে না মিথিলার কথা। তার কাছে মনে হচ্ছে মিথিলার চোখের ভাষা আর মনের ভাষা এক না। মিথিলা মুখে বলছে এক কথা আর তার চোখ বলছে অন্য কথা। মিথিলার চোখের মাঝে বেদনার ছাপ স্পষ্ট । নাকি সে মিথিলাকে পড়তে ভুল করে ফেলছে?

– আমি তোকে কিছুতেই ছাড়ছি না। সাজিদের সাথে তোর বিয়ে অসম্ভব। আমি তোর চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তুই আমাকেই পছন্দ করিস। একদম মিথ্যে বলবি না। একবার সত্যি বলে দেখ। আমি তোকে এমন করে আমার বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখব কেউ তোকে খুঁজে পাবে না। কোনো কিছুর পরোয়া নেই আমার।
মিথিলাকে কিছুতেই ছাড়ছে না সে। দু’হাতে আরো শক্ত করে চেপে ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

মিথিলা ভীষণ ঘাবড়ে গেল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে ধীরে ধীরে সে। ভয় হচ্ছে সে না আবার প্রিয়র মতো পাগলামী শুরু করে। কোনোমতেই সে প্রিয়র কাছে ধরা দিতে চায় না। পালিয়ে বেঁচেছে এতটা দিন। এখন তীরে এসে সে তরী ডোবাতে চায় না। নিজের আত্মসম্মানের চেয়ে বড় তার কাছে কিছুই না। ও ঘরের বউ সে কোনোদিনই হতে চায় না। রূম্পা মায়ের জীবনটাকে নরক যন্ত্রণায় ডোবাতে চায় না সে। সে যদি কোনোভাবেই স্বীকার করে সেও প্রিয়কে ভালোবাসে তবে কেউই প্রিয়কে থামাতে পারবে না আর। এই বিয়ে সে কোনোদিনই হতে দিবে না।প্রিয়র পাগলামী যে কোন লেভেলের সে জানে। খুব বেশি আবেগী প্রিয়। তাকে এখনই থামাতে হবে না হলে আরো বড় বিপদ আছে সামনে।

নিজেকে নিজেই শাসন করল মিথিলা। নিজের বোকামীর খেসারত দিচ্ছে এখন । খুব সাহস করে কিছুটা ধমকের সুরে বলল,

– ভাইয়া , তুমি কি আমার হাত ছাড়বে নাকি আমি চিৎকার দিব। এসব পাগলামীর কোনো মানে হয়? আমি তোমাকে একজন বড় ভাইয়ের জায়গায় বসিয়ে সম্মান করেছি , ভালোবেসেছি। আর তুমি কি না । ছিহ! রূম্পা মা জানলে আমি মুখ দেখাতে পারব না তার সামনে। সাজিদকেই বা কী জবাব দিব? পাগলের মতো ভালোবাসে সে আমাকে। আর আমিও ।

– হঠাৎ হাতের বাঁধন যেন ঢিলে হলো। প্রিয় মিথিলাকে ছেড়ে নিজের চোখের পানি মুছল। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে তার। এটা সে কী করল? এই ভয়েই সে এতদিন মিথিলার সামনে ধরা দেয়নি। শেষ পর্যন্ত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না ? কি যে হয়েছে তার? সকালে তার মা বলার সাথেই মাথায় এসেছে আজ মিথিলাকে সে জানাবেই তার অনুভূতির কথা। কিন্তু সাহস হচ্ছিল না একদম। হঠাৎ নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে না পেরে কীসব করে বসল?

আর একটা কথাও না বাড়িয়ে ব্যাক সীট থেকে সামনে চলে আসলো। এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছে যে মিথিলার নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। শুক্রবার তাই রাস্তাঘাট ফাঁকা বলে কথা। মিথিলা পেছনের সীটে বসে অঝোরে চোখের পানি ফেলছে। সে বুঝতে পারছে কত ঝড় বয়ে যাচ্ছে প্রিয়র বুকে।

কারো মুখে কোনো কথা নেই। প্রিয় পার্লারের সামনে এসে হার্ড ব্রেক কষল। মিথিলা সবই বুঝতে পারছে । পেছনের ডোর খুলে প্রিয় মিথিলাকে বলল, পৌঁছে গেছি। নেমে পড়।
মিথিলা নামতে যাবে কিন্তু পারছে না। প্রিয় নামতে বলেছে ঠিকই কিন্তু নিজে মাথা নিচু করে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে।

– কিছুটা ইতস্তত করে মিথিলা বলল, আমি নামব ,ভাইয়া।

– ও হ্যা । সরি! ভুলেই গিয়েছিলাম । তোর তো আবার যাবার অনেক তাড়া। সরি ফর এভ্রিথিং। নতুন জীবনের জন্য অনেক শুভকামনা। ভালো থাকিস সবসময়।

– এভাবে বিদায় জানাচ্ছে দেখে মিথিলা বলল, তুমি কি চলে যাচ্ছ? অপেক্ষা করবে না?

– অপেক্ষার প্রহর অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। হা হা হা। ডোন্ট টেইক ইট আদারওয়াইজ, ডিয়ার। ফান করলাম। নাবিলা এসে পড়বে এখনি। আমি ড্রাইভারকে কল দিচ্ছি। ওই তোকে হলে নিয়ে যাবে।

মিথিলা গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে প্রিয় ড্রাইভিং সিটে বসে একটানে গাড়ি নিয়ে নিমিষেই মিথিলার চোখের সামনে থেকে উধাও হলো। মিথিলার দিকে একবার ফিরলও না। মিথিলাকে একবার বাই বলারও সুযোগ দিলো না।

মিথিলা বুঝতে পারছে তার ভেতরের যন্ত্রণা। সেও যে এমন যন্ত্রণায় পুড়ছে। এখন যন্ত্রণা বুঝি আগের থেকে আরো বেড়েছে। আগে তো সে জানত সে একাই ভালোবাসে প্রিয়কে। কিন্তু এখন যখন সে জানল প্রিয়ও তাকে ভালোবাসে সে কিছুতেই নিজেকে বোঝাতে পারছে না। মন যেন মানছেই না। এটুকু সে ভালো করেই বুঝে গেছে প্রিয় হলে আসছে না। প্রিয়কে এতটুকু তো সে চিনেছে এ ক’বছরে।

চোখের পানি টিস্যুতে মুছতে মুছতে লিফটে উঠল তখনই সাজিদের ফোন।
একবার ভাবল রিসিভ করবে না । কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল সাজিদ তো কোনো অন্যায় করেনি ।

– হ্যালো, পার্লারে পৌঁছেছ ?

– হুম।

– খুব মন খারাপ?

– হুম!

– বুঝতে পারছি। আপন জনকে ছেড়ে আসার সময় যত ঘনিয়ে আসছে তোমার কষ্টও ততো বাড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। এটাই নিয়তির বিধান। নিজেকে কন্ট্রোল করো। রূম্পা আন্টি যেতে পারেন নি শুনলাম।

– হুম।
– প্রিয় তোমাকে নিয়ে গেছে । আন্টিকে কল দিয়েছিল আম্মা।

– হুম।

– কী হুম হুম শুরু করছ। মন কী বেশি খারাপ? ভয় পেও না । একবার আমার বউ হয়ে আসোই না। দেখবে এত এত আদর করব যে সব ব্যাথাকে জয় করার জন্য টাইগার বামের মত তোমার কাজে আসব। হা হা হা।

– মিথিলা জোর করেই হাসির অভিনয় করে বলল, তাই! অপেক্ষায় থাকব। আচ্ছা , রাখি । আমি এসে গেছি।

– আর শোনো ! তোমাদের ওই আটা , ময়দা , বেসন এসব একটু কম মাখবে। তুমি এমনিতেই আমার চোখে অপ্সরি। তাই আর্টিফিসিয়াল লুক এনে নিজেকে হারিয়ে ফেল না যেন। নয়ত দেখা যাবে তোমার আটা ময়দা তুলতে তুলতে আমি বাসর ঘরেই ঘুমিয়ে গেছি । ময়দার নিচের তোমাকে আর ছুঁয়ে দেখা হবে না।

– যাহ, বাজে বকো না। মুখে কিছুই আটকায় না। রাখলাম। বলেই কল কেটে দিলো মিথিলা।

পর্ব- ৩২
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/374189987697010/
চলবে…
[ প্রিয় পাঠক , আজ কিন্তু একটু বড় করেই দিলাম । আজ কিন্তু অভিযোগ শুনব না। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here