ভালবাসা বাকি আছে পর্ব-৪

0
466

#ভালবাসা_বাকি_আছে -৪
Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা

তানিয়া আর তার বন্ধুদের দৌড়ঝাঁপে এক সপ্তাহে মাথায়, বেশ সুন্দর ছিমছাম একটা এক রুমের ছোট্ট একটা এপার্টমেন্ট পেয়ে গেছে বুশরা। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে তানিয়াপু না থাকলে কি হতো ভেবে পায়না বুশরা। নতুন দেশ, নতুন ইউনিভার্সিটি, নতুন বাসা, নতুন জীবনযাত্রা সবকিছু সামলে নিতে নিতেই কেটে গেলো এক মাস।

অভ্যস্ততা অবশ্য এখনো যে খুব এসেছে তা না। ঘুমের ঘোরে যে স্বপ্ন দেখে তা এখনো খাঁটি বাংলাদেশী। স্বাধীনপুর গ্রাম, সেই ছোট্ট হসপিটাল, শেখ বাড়ি, শেখ বাড়ির মানুষজন, একজন বিশেষ মানুষ আর তাদের দুজনের ছোট্ট নীড়, ধলতা নদীর পাড়ে কাটানো বিকেলের টুকরো স্মৃতি ঘুরেফিরে জীবন্ত হয় রাতের কোন না কোন প্রহরে। আর তারপর চোখ মেলে নিজেকে আবিষ্কার করে একলা ঘরে।

আজকাল খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গে বুশরার। কারনটা অবশ্য সহজেই অনুমেয়। বুশরার ভোর মানে রায়হানের সকাল। দিনের এই সময়টাতে বেশিরভাগ সময় বাড়িতে থাকে রায়হান। বের হওয়ার আগে ফোন করে বুশরাকে। ফোনে না পেলে কিছু বলে না যদিও, তবে অভিমানটা টের পাওয়া যায়। আর বুশরা নিজেও অপেক্ষায় থাকে এই ফোনটার।

প্রতিটা নতুন ভোর বুশরার কাছে তাই খুব প্রিয়। ফজরের নামাজ পড়ে প্রিয় মানুষটার সাথে কথা বলতে বলতে বাসার পাশের পার্কে চলে যায়। কোনদিন কথা দীর্ঘ হয়, কোন কোনদিন আবার রায়হানের তাড়া থাকে। সেই দিনগুলোতে অভিমানী হয়ে ওঠে বুশরার মন। আজ তেমনই এক দিন।

টুকটাক কথাবার্তার মাঝেই রায়হান বলল, “একটা খুব জরুরী ফোন এসেছে, আমি একমিনিট পরে কলব্যাক করি তোমায়?”

বুশরা তখনো বাসার সামনের লনটাই পার হতে পারেনি। এই এক মিনিট যে দশ মিনিটে গড়াবে তা বুশরা খুব ভালই জানে। কারন অতীব জরুরী না হলে এসময়টাতে অন্য কারো ফোন ধরে না মানুষটা। আর সেরকম জরুরী কথা কখনোই এক মিনিটে শেষ হয়না।

মুখে “আচ্ছা” বললেও মনে মনে বুশরা বলল “দুনিয়ার সব জরুরী ফোন এই সকাল বেলাই আসা লাগে। ধুরররর…”

অভিমানী মন নিয়ে পার্কের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল। বিভিন্ন বয়সের মানুষজন আসে সেখানে। কেউ হাঁটাহাঁটি করে, কেউ জগিং করে, কেউবা আবার চুপচাপ বসে বসে প্রকৃতি দেখে।

আনমনে বসে ফিরতি ফোনের অপেক্ষা করে বুশরা। এক মিনিট গিয়ে দশ মিনিটে গড়াবে এটা বুশরার জানা, তাই দশ মিনিট ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করলো ও। কিন্তু পাক্কা ত্রিশ মিনিট পরেও যখন ফোন আসলোনা তখন অভিমান গিয়ে গড়ালো অসন্তোষে। নিজেই ফোন করবে নাকি করবেনা সেই দোলাচলে ডায়াল করেই ফেললো নম্বরটা। কিন্তু ওদিক থেকে কোন সাড়া নেই। ছোট্ট একটা টেক্সট করলো, “এভাবে অপেক্ষা করানোর কি মানে মিঃ শেখ?”

অনেক্ক্ষণ অপেক্ষার পরে টেক্সটেরও যখন কোন রিপ্লাই আসলো না অভিমানে, রাগে, চিন্তায় চোখ ফেটে অবাধ্য জলরাশিতে ভেসে গেলো দুইগাল। চোখদুটো আজকাল এত বেয়াড়া হয়েছে! কাঁদার মত কিছুই হয়নি কিন্তু, নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হয় বুশরা।

কিছুক্ষন চিন্তা করে থাকতে না পেরে ফোন করলো শিউলি বেগমকে। কুশল বিনিময় শেষে অন্যদিনের মত দীর্ঘ আলাপে না গিয়ে বরং পাড়লো আসল কথা।

“মা তোমার ছেলে কি বাড়িতে?”

সকাল সকাল বুশরার এমন প্রশ্নে চিন্তিত ভঙ্গিতে শিউলি বেগম বললেন, “কেন রে? কোন সমস্যা?”

অযথাই মাকে টেনশনে ফেলে দিচ্ছে ভেবে নিজেকে সামলে বুশরা বলল, “না না মা, কোন সমস্যা না। ফোনে পাচ্ছিনা তো তাই।“

তারপর লজ্জার মাথা খেয়ে বললো, ”একটু কলব্যাক করতে বলো তো।“

শিউলি বেগম জানালেন রায়হান বাড়িতেই ছিল তবে একটু আগে ফোনে কথা বলতে বলতে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেছে তাড়াহুড়া করে। নাশতাও করেনি।

কিছুক্ষণ হু হা করে ফোন রেখে দিল বুশরা। অভিমানের বেলুন ফুস করে চুপসে গিয়ে সেখানে ভর করেছে রাজ্যের চিন্তা। কি হলো আবার? সকালের সুন্দর প্রকৃতি আর সুন্দর লাগছে না ওর কাছে। আরো কিছুক্ষণ বসে ফোনটা নাড়াচাড়া করলো বুশরা। তারপর বাসায় ফিরে গেল।

এর মধ্যে রায়হানের আর কোন ফোন আসলো না। বুশরা নিজেও আর ফোন করলো না বাইকে আছে ভেবে। বাসায় গিয়ে চিন্তায় কোন কাজ ঠিকমত করতে পারলো না। নাশতা না করেই বেরিয়ে গেল ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

ক্লাস শুরু হতে এখনো অনেকটা দেরি। বুশরা গিয়ে বসলো লাইব্রেরিতে। জরুরী কিছু নোট করা দরকার। সময় করে উঠতে পারছে না কয়েকদিন ধরে। এসাইনমেন্ট সাবমিশান ডেডলাইন দুইদিন পরেই। আজ যখন তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে তখন সেই কাজটাই করে ফেলতে চাইলো ও।

অনেকগুলো ঢাউস বই নিয়ে এসে বসলো একপাশের একটা ফাঁকা টেবিলে। খুব চেষ্টা করলো মনযোগ দিতে। মেডিক্যালের খটরমটর টার্মস এই মুহুর্তে কিছুই মাথায় ঢুকছে না বুশরার, মন পড়ে আছে হাজার মাইল দূরে। আর তারই সূত্র ধরে কিছুক্ষণ পরপর ফোন চেক করছে ও।

আচমকা পাশের চেয়ার থেকে নিচু কন্ঠে কেউ একজন বলে উঠলো, “লাইব্রেরীতে কিন্তু ফোন ব্যাবহার সীমিত করার কথা মিস।“

চমকে ওঠে বুশরা। মানুষটার কথা শুনে না। বরং কথাটা খাঁটি বাংলা ভাষায় হওয়ায়।

অবিশ্বাসের সুরে বুশরা জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি বাঙালি?”

“জি আলবৎ। সন্দেহ আছে?”

“তা আপনি কি করে বুঝলেন যে আমিও বাঙালি?”

“এখানে এত কথা বললে কিন্তু নির্ঘাত ওয়ার্নিং খেতে হবে ম্যাম। তার চেয়ে বরং ক্যাফেটেরিয়াতে চলুন। খেতে খেতে কথা হবে।“

বুশরার মন বেজায় বিক্ষিপ্ত। লাইব্রেরিতে বসে আসলে কাজের কাজ কিছু হচ্ছেনা। আর পেটের মধ্যে ক্ষিধেরাও জানান দিচ্ছে বেশ। পাশের মানুষটা সদ্যপরিচিত হলেও দেশী। আর ক্যাফেটেরিয়াই তো, যাওয়াই যায়। তাই একটু যা দ্বিধা আছে সেটা ঝেড়ে ফেলে বইগুলো যথাস্থানে রেখে বেরিয়ে আসলো।

ছেলেটার নাম আরিশ। কিছুক্ষণ কথা বলেই বুশরা বুঝলো ছেলেটা খুবই বাচাল ধরনের। আসলে কথা যা বললো তা সব আরিশই বললো। ও শুধু হু হা করলো। আর কিছুক্ষণ পরপর ফোন চেক করা তো আছেই। এক পর্যায়ে আরিশ কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কোন বিশেষ ফোনের অপেক্ষা?”

“হুম।“

এই উত্তরে আরিশ মনেহয় কিছুটা দমে গেল। খাওয়ায় মনযোগ দিলো হঠাতই।

কিছুক্ষণ নিরবতার পরে বুশরা প্রশ্ন করলো, “আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি কিন্তু।“

“কোন প্রশ্নটা? আপনি তো গুনে গুনে কথা বলেন। প্রশ্ন করলেন কখন?”

“লাইব্রেরি থেকে বের হওয়ার আগে।“

খানিক্ষণ চিন্তা করে আরিশ বললো, ”ওওওও বাঙালি কি করে বুঝলাম ওইটা?”

“হুম।“

“আপনার নোটবুক দিন, উত্তর দিচ্ছি।“

বুশরা অবাক হয়ে ব্যাগ থেকে নোটবুক বের করে দিল। কলমটা নোটবুকের মধ্যেই রাখা ছিল। আরিশ কলমটা ধরে নোটবুক মেলে ধরলো। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে পুরো পাতা ভরে বাংলায় লেখা “ভাল্লাগেনা।“

এই মন খারাপের মাঝেও হেসে ফেললো বুশরা। ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। কাঙ্খিত নাম্বারটা স্ক্রিনে দেখে ব্যাস্ত স্বরে বললো,

“এক্সকিউজ মি প্লিজ।“

ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে যেতে যেতে ব্যাকুল কন্ঠে বলে উঠলো, “হ্যালো।“

চলবে…

#ডাক্তার_মিস – সিকুয়েল
#ভালবাসা_বাকি

আগেই দুঃখিত বলে নিচ্ছি অনাকাঙ্ক্ষিত দেরির জন্য। একটুখানি অসুস্থ। গল্প কেমন লাগছে জানাবেন প্লিজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here