ধ্রুবতারা
পর্ব_২
পুষ্পিতা_প্রিমা
চারদিকে সাজ সাজ রব। মানুষে মানুষে সমাগম। কি আলোকিত, ঝলমলে চারপাশটা? কি সুন্দর! কি মনোমুগ্ধকর!
সবার মুখে মুখে হাসি! দুই বাড়ির বড় মেয়ের মেহেদী সন্ধ্যা। দুই বাড়ির একটা প্রাণের মেহেদী সন্ধ্যা। আহম্মেদ বাড়ির ছাদে দাঁড়ানো ছেলেটির গায়ে খয়েরী পান্জাবী। তার মাথার একঝাঁক চুলগুলো প্রতিদিনের মতো গোছালো। পেছনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সে দেখতে লাগল তালুকদার বাড়ির উঠোনে মেহেদী সন্ধ্যার আয়োজন। কত আয়োজন!
গায়ে লাল হলুদ শাড়ি গায়ের মেয়েটিকে দেখা গেল। মুননা চলে এল তালুকদার বাড়িতে। গায়ে হলুদের শাড়ি গায়ে মেয়েটি ভাইকে দেখে দৌড়ে এল৷ ভাইয়ের বুকে ঝাপটে পড়ল। দুহাত দিয়ে শক্ত বেষ্টনী দিয়ে ধরল ভাই বোনকে। বলল
‘ তাননা তোকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে বোনু।
তাননা পড়ে থাকলো ভাইয়ের বুকে। আর ও শক্ত করে ধরে বলল
‘ ভাই আরেকটু শক্ত করে ধর। ছাড়িস না।
মুননা হেসে ফেলল৷ বোনের মাথায় চিবুক রেখে বলল
‘ তাননা যাস না।
তাননা হু হু করে কেঁদে উঠল। দৌড়ে এল সোরা। তাননাকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুননাকে বলল
‘ কি হচ্ছে আব্বু, আজকে ও বোনকে কাঁদাবে?
মুননা বলল
‘ মামুনি আমি ।
সোরা বলল
‘ এখুনি অনুষ্ঠান শুরু হবে। বোনকে রাখি পড়াবে, চলে এসো।
মুননা তাননার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল৷ যাহ বুনু।
তাননা ছলছলে চোখে ভাইকে দেখে হাঁটা ধরল।
রাহা আর নোহা জায়িদকে দেখে আর এগোলো না। জায়িদ দুজনকে ভালোভাবে দেখে বলল
‘ বাহ, শাড়ি পড়েছেন আপনারা!
নোহা বলল
‘ আব্বা কেমন লাগছে বলো।
জায়িদ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল
‘ বেশ লাগছে। রাহা কি লজ্জা পাচ্ছ?
‘ একদম না আন্কেল। লজ্জা কেন পাব?
জায়িদ বলল
‘ তোমাদের ও বিয়ে দিয়ে দেব।
দুজনেই মাথা নামিয়ে ফেলল। কি লজ্জা!
জায়িদ হেসে ফেলল৷ আনহাকে ডেকে বলল
‘ আনহা এদের কান্ড দেখো।
আনহা হেসে বলল
‘ আপনি ওদের লজ্জা দিচ্ছেন কেন?
জায়িদ হেসে উঠল। রাহা আর নোহা দৌড়ে চলে গেল। জায়িদ আনহার দিকে তাকিয়ে কপালের ভাঁজ গাঢ় করল।
‘ এভাবে সেজেছ কেন?
‘ কোথায় সেজেছি? অন্য দিনের চাইতে একটু ডিফারেন্ট, সহ্য হয়না তার।
রাগে আনহা চলে যেতে চাইলো। জায়িদ আটকে নিল তাকে।
‘ আরেহ রাগ করো কেন? আমার তো মনে হচ্ছে আমাদের এদিনই দেখা হলো, এদিনই বিয়ে হলো। এদিনই বাচ্চা হলো।
আনহা হেসে ফেলল। নিজের চুলের উপর থেকে জায়িদের মুখ ঠেলে দিতে দিতে বলল
‘ এটা বিয়ে বাড়ি ইশতিয়াক সাহেব।
জায়িদ যেতে যেতে বলল
‘ তো? আমি কি তোমাকে ধরে বসে আছি?
আনহা মুখ মোচড়ালো।
‘ ভাব ধরতে সময় লাগেনা তার। অসভ্য লোক৷
অনুষ্ঠানে বাড়িভর্তি হলো পুলিশ, ডাক্তারের সমাবেশে। জিনিয়ার কয়েকজন উকিল বন্ধুবান্ধব ও এলো। তাননার ও এল। দুই ভাইবোন চোখ বুলালো বাড়ির আনাচে কানাচে। কত কত মানুষ! কত আপনজন! কিন্তু তারা কোথায়? এত মানুষগুলোর ভীড়ে তারা হঠাৎ করে ও দেখা দেয় না কেন? মলিন হয়ে আসা মুখখানি দেখল সালেহা। নাতাশা বেগম হাত ধরে ধরে নিয়ে আসলো সালেহাকে। তাননার পাশে মুননা বসা ছিল। সালেহা আসতেই উঠে দাঁড়ালো মুননা ।
‘ দাদু এখানে বসো।
সালেহা মুননাকে ও বসতে বলে। দুইভাইবোনের মুখে হাত বুলায় সালেহা। আদর করে। কপালে মমতার স্পর্শ আঁকে। কত ভালোবাসার আদুরে মুখগুলো। সেই ছোট্ট ছোট্ট তুননু আর মুননু। মুননার মুখখানা আর চোখের কোণায় জল দেখে বুক মোচড় দিয়ে উঠে সালেহার। তার গুড্ডু পুরোটা। পুরোটা গুড্ডু। গুড্ডু নেই কে বলে? সালেহা হাত বুলালো মুননার মুখে। বিড়বিড় করে ডাকলো।
‘ আমার গুড্ডু!
সাথেসাথে মাথা নামিয়ে নিল তাননা। ডুকরে আওয়াজ করে কেঁদে উঠল। মুননা মুখ ফিরিয়ে নিল। উঠে তাড়াতাড়ি প্রস্থান নিল। বাড়িভর্তি মেহমান দেখল গায়ে হলুদের শাড়ি পড়া মেয়েটির কান্না। অনুষ্ঠান শেষ হলো শেষরাতে। নরম পায়ে হেঁটে তাননা চলে এল ছাদে। আজ আকাশের তারা না উঠলেই অনেক বড় অন্যায় হতো। আকাশের এককোণায় দুটো আলাদা হয়ে থাকা তারা আবিষ্কার করে তাননা। চেয়ে থাকে নিষ্পলক। আম্মা আব্বা কি খুশি হয়েছে তাকে এই সাজে দেখে? খুব খুশি হয়েছে? আব্বা নিশ্চয়ই আম্মাকে বলছে,
‘ জিনি দেখোনো আমাদের তুননু কত্ত বড় হয়ে গিয়েছে। তার নাকি বিয়ে!
আব্বার কথায় আম্মা নিশ্চয়ই হাসছে। দুজন একসাথে কত্ত ভালো আছে, তারা আমাদের দেখে কিন্তু আমরা দেখিনা কেন? কেন দেখিনা।
আহম্মেদ বাড়িতে বিয়ের আয়োজন হলো। বড় উঠোনটাতে খাবারের বিশাল আয়োজন। একদম লাল টুকটুকে বেনারসি পড়া বধূটিকে দেখে বুক ধুকপুক করে উঠল জায়িদের। সাথে তারপাশে দাঁড়ানো জাহেদার। দুজনই বাকহারা হয়ে পড়ল। লাল শাড়ি, সোজা সিঁথির মাঝখানে পড়ে থাকা বড় টিকলি আর নাকের নথ, গলায় ভারী গহনা পড়া বউটিকে দেখে চোখে ভাসলো চব্বিশ বছর আগের সেই মেয়েটিকে। যেদিন জায়িদ নিজ হাতে বোনের মাথায় ঘোমটাটা আর ও টেনে পড়িয়ে দিয়ে বলেছিল,
‘ জুননু সুখী হ ৷ ভালো থাক আমার বোন। ভালো থাক জুননু। ভালো থাক কলিজাটা ।
জায়িদ সরে গেল তাড়াতাড়ি। তাননা অবাক। মামা আসলো না কেন?
জাহেদা চোখের চশমা খুলে রেখে দিল। এতগুলো মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে তাননাকে ডাকল
‘ আমার মা। আমার জুনু। আমার বাচ্চা। আমার জুনু এভাবে বউ সেজে এসেছিল এই বাড়িতে। এভাবেই সেজেছিল। ঠিক এভাবেই।
তাননা সিঁড়ি আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। জাহেদার কান্না থামেনা। তাননা শাড়ি দু’হাতে ধরে দৌড়ে আসে। ঝাপটে জড়িয়ে ধরে জাহেদাকে। বুকের মধ্যিখান থেকে উঠে আসে হিঁচকি।
‘ নানু তাদের কেন মনে করিয়ে দাও? কেন?
বর এল এল আওয়াজে ভরপুর হলো চারপাশ। ফিতা কাটার সময় জুনিত আর রিহান দাবি করল দশহাজার টাকা। এত ঝামেলা বাঁধিয়ে দিল দুজন। পাঁচ হাজার টাকা খোয়াতে হলো ঈশানকে। কিন্তু তারপরও ছাড় নেই। মুননা এসে কাটতে দিল ফিতা। জুনিত আর রিহান রাগ করে গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। মুননাকে না বকতে পারছে না কিছু বলতে পারছে।। ঈশান মুননার পিঠ চাপড়ে বলল
‘ উফ রোয়েন বাঁচালে।
মুননা বলল
‘ মালা পড়ানোর সময় আবার খোয়াতে হবে জামাইবাবু।
হাসলো ঈশান।
‘ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি।
হাসল মুননা ও।
মালা পড়ানোর সময় রাহা নোহা আর ও অনেকে জটলা পাকালো। তারা দশহাজার নিয়ে ছাড়বেই। মুননা দূরে দাঁড়িয়ে থাকলো। কান্ড দেখতে লাগলো। ঈশানের বন্ধুরা ফ্লার্ট করা শুরু করল। রাহা চুপিসারে একজনকে নোহাকে দেখিয়ে বলল
‘ আমার পাশেরটাকে পটানোর চেষ্টা করেন৷ আমাকে পটানোর চেষ্টা করবেন না। আমাকে ওই দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পান্জাবি পড়া ডাক্তারবাবু পটিয়ে নিয়েছে।
ঈশানের বন্ধু রূপক কেশে উঠল খুকখুক করে। ঈশান বলল
‘ দুইটা শালিকা আছে। পটিয়ে নে যাকে ইচ্ছে।
রূপক বলল
‘ দরকার নেই ভাই। একজন ডাক্তারের বউ আর একজন পুলিশের মেয়ে। এসবে আমি নেই।
হেসে ফেলল ঈশান।
‘ ডাক্তারের বউটা আবার কে?
রূপক মুননাকে দেখালো একবার, রাহাকে দেখালো একবার।
ঈশান বলল,
‘ ওররে শালাবাবু এত ভাব ধরে মনেই হয়না তলে তলে টেম্পু চালায়। হাতেনাতে ধরব শালাবাবুকে।
ঈশানকে দশহাজার টাকা ছাড়তে হলো। সেই খুশি রাহা আর নোহা। দুইজনই লেহেঙ্গা পড়েছে। লাফাতে লাফাতে পড়ে গেল রাহা। নাহিল চেঁচিয়ে উঠল। সোরা আনহা ফিরে তাকালো। মুননার ভ্রু কুঞ্চন হলো। স্টুপিড!
রাহাকে গিয়ে তুললো নাহিল। বলল
‘ এরকম কেউ করে? বড় হয়েছ রাহা।
রাহা কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল
‘ সব এই লেহেঙ্গার দোষ।
হাসলো নাহিল। নোহা বলল
‘ রাহা আপুর কি পা বাঁকা? এত ধুপধাপ পড়ে যাও কেন? রোয়েন ভাইয়াকে পা টা দেখিও তো।
রাহা বিড়বিড় করল
‘ নো। ডক্টর রোয়েন আমার অসুখ ধরে ফেলবে।
মুননা চলে গেল।
বধূবিদায়ের পালা। ঈশানের মা বাবা বেশ খুশি। তাননাকে দেখে মন জুড়িয়ে গেল৷ তাননা পিটপিট করে দেখল। আজ থেকে এদের মা বাবা ডাকতে হবে। জুননু আর গুড্ডুর মতো এরা কি ভালোবাসবে অত?
কবুল বলার সময় তাননা, মুননাকে কত খুঁজল চোখ দিয়ে। দেখল না। তার বিদায়ের সময় ও ছেলেটা আসছেনা। কোথায় গেল?
সবাই খোঁজ লাগালো। রাহা দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রোয়েন ভাইয়া তো নিজের ঘরেই আছে। আমি দেখলাম দরজা বন্ধ। নাহিল ছুটল। পেছন পেছন জায়িদ ও। মুননাকে ডাকাডাকি স্বত্বেও সে দরজা খুলল না। জায়িদ ভাবলো থাক।
তাননাকে তুলে দিবে। কিন্তু তাননা নাকচ করে দিল। কেঁদে উঠে বলল
‘ মুননা না এলে যাব না আমি।
সবাই পড়ল মহাবিপদে। জায়িদ ঘনঘন দরজা ধাক্কা দিয়ে বলল
‘ মুননা! মামা কি হচ্ছে এসব? তাননা কাঁদছে।
মুননার গলার আওয়াজ ভেসে এল।
‘ মুননাকে ছাড়া থাকতে শিখতে বলো। মায়া ছাড়তে বলো মামা।
‘ কেমন স্বার্থপরের মতো কথা মুননা।
মুননা বসে থাকল ইজি চেয়ারে মাথা এলিয়ে।
‘ সে স্বার্থপর? মুননা? কখনোই না। স্বার্থপর তো জুননু। স্বার্থপর গুড্ডু। স্বার্থপর তাননা। চলে যাক সবাই। কি দরকার? মুননা ভালো আছে একা।
জায়িদ দরজা ধাক্কালো।
‘ এত ভালোবাসা, আদর, মায়া মমতা স্নেহ দিয়ে বড় করেছি। তারপর ও আপন হতে পারলাম না তোমাদের। এখনো সাহিল আর জুননুর অভাব রয়ে গেছে। আমরা কি কম ভালোবাসি মুননা?
মুননা উঠে দাঁড়ালো চট করে। বলল
‘ ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করবে না মামা। যাও। তাননাকে তুলে দাও।
জায়িদ গেলনা। তাননা চলে এল। দরজার কাছে এসে দরজা ধাক্কালো। ডাকল
‘ ভাই?
মুননা পারেনা এই ডাককে উপেক্ষা করতে। পারেনা। তাননা কাঁদতে কাঁদতে দরজায় মাথা ফেলে রাখল। নরম হাতে একটুখানি দরজায় চাপড় মেরে বলল
‘ মুননু তুই বের না হলে আমি যাব না ভাই। যাব না আমি। বলে রাখলাম।
মুননা চুপ হয়ে থাকলো। নাহিল তাননার হাত ধরল। রেগে বলল
‘ দরকার নেই মুননাকে। নিজের বোনের কান্না যাকে ছুঁতে পারেনা তাকে আর দরকার নেই। এসো।
তাননা ডাকল
‘ ভাই। দরজা খোল। মুননা দরজা খুলল না। নাহিল টেনে নিয়ে গেল তাকে। মুননা চোখ বুলালো পুরো ঘরে। পুরো ঘরের দেয়ালে দেয়ালে দেয়ালে জুননু আর গুড্ডুর ছবি। তাননা আর মুননার ছোট্টবেলার ছবি। জুননুর গলা জড়িয়ে ধরার ছবি। গুড্ডুর গালে গাল লাগিয়ে আদর করার ছবি। জুননুর কোলে শুয়ে থেকে বুকে গুজে থাকার ছবি। মায়ের বুকের উপর মাথা রেখে ঘুমানোর ছবি। গুড্ডুর পিঠের উপর উঠে চড়ার ছবি। মায়ের হাতে খাওয়ার ছবি। মায়ের মাথায় উকিলের ক্যাপ পড়িয়ে দেওয়ার ছবি। মুননা দরজা খুলে দৌড় লাগালো।
সিঁড়ি ধরতেই তাননা তাকালো তার দিকে। দৌড়ে এল। মুননা দৌড়ে গেল। পুরো বিয়ে বাড়ির মানুষ দেখল দুই ভাই বোনের একে অপরের প্রতি ভালোবাসা। তাদের রাখিবন্ধনের কত জোর!
কত মজবুত!
উপস্থিত সকলের চোখে নামলো বর্ষণ। সন্তান হারা দুই মা সেই কান্না দেখে আর ও কাঁদল। এক ভাই হারা বোন আজ ভাইকে খুব করে মিস করল। এক বোন হারা ভাইয়ের বুকে হলো রক্তক্ষরণ। এক ভাই হারা ভাইয়ের উঠল পুরোনো ব্যাথা। পুরোনো সেই ব্যাথা বেদনা জেগে উঠল। পুরোনো ক্ষতে ব্যাথা উঠল ভীষণ।
নাহিল মাথা চেপে ফিরে গেল। ড্রয়িং রুমের দেয়ালে বড় করে টাঙানো হাসিমুখের মানুষটির দিকে বলল সে
‘ এমনটা না হলে ও হতো ভাই। কেন কাঁদিয়ে গেলে? কেন হারিয়ে গেলে?
জায়িদ ছাড়াতে চাইলো তাননা মুননাকে। ছাড়াতে না পেরে অসহায় দুর্বল কন্ঠে জাহেদাকে বলল সে
‘ জুননু বড়ই স্বার্থপর আম্মা। কেন ফেলে গেল এই দুজনকে? এদের ও নিয়ে যেতে পারল না? কেন রেখে গেল? এদের কি আমরা ভালো রাখতে পেরেছি আদৌ? দেখোনা আম্মা এরা আজ ও ভালোবেসেই গেল ওই দুজনকে। আজ ও।
মুননা তাননার হাতে দিল একটি ছবি। শুধু একটি। তাদের চারজনের ছবি। দিয়ে বলল
‘ জুননুর লাল শাড়ি তোকে দেবনা, গুড্ডুর পাঞ্জাবী তোকে দেবনা। তাদের আর কোনো ছবিই তোকে দেবনা। শুধু এটা দিলাম। আর বাকি সব আমার। আমি এসব নিয়ে থাকবো। তুই যাহ তুননু। ভালো থাকিস। ভালো রাখিস।
কথা বলতে পারলনা মুননা। আটকে আটকে এল কথা। তাননা ছবিটা নিল। আম্মা আব্বার ছবিটার দিকে তাকিয়ে কেঁদে উঠে ডাকল
‘ আম্মারে, কেন চলে গেল আম্মা? কেন আমাদের রেখে আকাশের তারা গেলে আব্বা?কেন আমাদের এভাবে রেখে হারিয়ে গেলে?
ঈশান দাঁড়িয়ে রইল এককোণে। তার মা বাবা চেয়ে রইল ভাই-বোনকে। জায়িদ আর নাহিল ঈশানের হাতে তুলে দিল তাননাকে। তার মা বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলল
‘ ওকে খুব ভালো রাখবেন। এদের লোভ বেশি। ভালোবাসার লোভ। এরা বেশি ভালোবাসা পেতে চায়, আদর চায়, স্নেহ মমতা চায়। এদের ক্ষুধা বেশি। এত আদর খায় এরা তারপরেও পেট ভরেনা।
নাহিল কিছু বলতে ও পারলনা। শুধু ঈশানের হাতের উপর শক্ত করে চেপে ধরে রাখল তাননার হাত। কিছু বলতে পারলোনা। এরা তাননা মুননার আর ও দুই বাবা। সোরা আর আনহা এসে জড়িয়ে ধরল তাননাকে। তাননা আর ও ভেঙে পড়ল। এরা মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি, কিন্তু তারপর ও মায়ের অভাব পূরণ হলোনা। হলোনা। বিদায়ের সমাপ্তিক্ষণ চলে এল। তাননা যেতে যেতে ফিরে তাকালো বাড়িটার দিকে। আপনজনদের দিকে। কলিজার ভাইয়ের দিকে। সে চিৎকার করে কেঁদে ছুটে আসলো ভাইয়ের দিকে। ভাইয়ের বুকে ঝাপটে পড়ে কাঁদল শেষকান্না। সবাইকে বলল
‘ ভালো রেখো আমার ভাইকে। দেখে রেখো। আগলে রেখো। ভাই তুই ভালো থাক। ভালো রাখ। তোমরা আমার মুননুকে বেঁধে রেখো ভালোবাসার বন্ধনে।
জাহেদা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইল। বাড়িটা যেন অন্ধকারে তলিয়ে গেল মুহূর্তেই। বাড়িটার একটা প্রাণ চলে গেল। তাকে যে যেতেই হতো। নতুন জীবনের সূচনা করতে। মুননা নিজেকে বন্দী করল ঘরে। চেয়ে থাকলো মা বাবা বোনের ছবির দিকে। যা দেখে দেখে তার বেশিরভাগ সময় কাটে। ভালো লাগে সময় কাটাতে। আজ বোনটা পরের বাড়ি চলে গেল। আজ থেকে বোনের গলার আওয়াজ হুটহাট ভেসে আসবেনা। যখন মন চাই তখন বুকের মধ্যিখানে জড়িয়ে ধরে রাখা যাবেনা। খুব কাছে থেকে ও বোনটা দূরে। কেন এমন হয়? আপন মানুষগুলোকে হাজার চেষ্টা করে কাছে রাখা যায় না কেন? ধরে রাখা যায় না কেন? ভালোবাসা যায় না কেন? পৃথিবীর এই কঠোর নিয়ম কেন? কেন নিষ্ঠুর এই পৃথিবী?
গাড়ি কাচ উঠতে উঠতে রাহা দৌড়ে গেল গাড়ির কাছাকাছি। ঈশানকে বলল
‘ ভাইয়া বউয়ের সাথে সাথে আপনি ও কি কাঁদছেন নাকি?
একটুখানি হাসলো ঈশান। তাননার দিকে তাকালো। গাড়ির কাচ তুলে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল
‘ জিন্নাত আপনার কান্না সহ্য হয়না আমার। আপনি কাঁদবেন না। আমার রাগ লাগে ভীষণ। কাঁদবেন না।
রাহা দেখল মুননা এসে দাঁড়ালো বারান্দায়। রাহা চোখ তুলে দেখল মুননাকে। মুননার মলিন, বিষাদে ঘেরা মুখখানা দেখে খারাপ লাগলো রাহার।
‘ আপনার মন খারাপ হলে আমার ও মন খারাপ হয় রোয়েন ভাইয়া। আপনি প্লিজ হাসুন।
পার হলো কয়েক মাস। মুননা যেতে চায়না আহম্মেদ বাড়ি ছেড়ে। মা বাবার স্মৃতি ঘেরা এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনা তার। ডাক্তারি পড়া শেষে পিএইচডি করতে বাইরের দেশে যাওয়ার ইচ্ছে তার। কিন্তু এই বাড়ি ছেড়ে থাকার কথা ভাবলেই বুকে মোচড় দেয়। এমন কেন হয়? নিজের এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতেই সে বুঝতে পারল তাকে দিয়ে হবেনা। সে যেতে এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও।
এভাবে যেতে যেতে অনেকটা সময় পার হলো। এইচএসসি পরীক্ষা দিল রাহা। নোহা কলেজে নাম লিখালো। জুনিত আর রিহান ক্লাস নাইনে।
এইচএসসি পরীক্ষার যেদিন রেজাল্ট এল সেদিন বাইরে থেকে পাত্রপক্ষে সম্বন্ধ এল রাহার জন্য। ছেলের বাবার কলেজে যাওয়ার সময় দেখেছিল রাহাকে। ছেলের এখনো পড়ালেখা কমপ্লিট হয়নি । নাহিল সরাসরি না করে দিল এই প্রস্তাব। রাহা অনেক পড়বে। ছেলের বাবা বললেন রাহাকে এখন নিয়ে যাবেন না তবে তার পড়ালেখা শেষ হলে নিয়ে যাবেন। ততদিনে ছেলের ও কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। রাহাকে বেশ মনে ধরেছে। এ খবর রাহার কানে পৌঁছাতে দেরী হলোনা। রাগের বশে সে এক আছাড় মারল টিভির রিমোট। মুননা তখন নিজের রুম থেকে বের হয়ে মেডিক্যালের উদ্দেশ্য বের হয়েছিল। রাহার অগ্নিমূর্তি দেখে ভড়কালো সে। নাহিল ধরল রাহাকে। বলল
‘ আরেহ মেয়ে যখন হয়েছ সম্বন্ধ তো আসবে। দেখোনি তাননা আপুর জন্য এসেছিল।
মুননাকে দেখে রাহার কান্নার জোর আর ও বাড়ল। মুননা খোঁজখবর নিয়ে দেখল ছেলে ভালো। তাননার আর ঈশানের বিয়ে ও তো তিনবছর আগে ঠিক করা ছিল। রাহার বিয়ে ও ঠিক করে রাখা যায়। এতে পথভ্রষ্ট না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যখন দুজনই স্যাটেল হয়ে যাবে তখন না হয় বিয়েটা হবে। ছেলে এবং ছেলের পরিবার ভালো দেখে নাতাশা ও সায় দিল। সালেহা ও বলল দেখতে। মুননার কথা ফেলার নয়। নাহিল হতভম্ব। সে বুঝতে পারল রাহার জন্য মুননার পাথর মনে বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই। সে শুধু রাহাকে নিজের বোনের মতে মনে করে। সোরা রাহার কান্না দেখে বলল
‘ বিয়ে ঠিক করে রাখতে হবেনা। এমনি ওদের বলুন মেয়ে পড়াশোনা শেষ হওয়া পর্যন্ত দেখতে। পরেরটা পরে দেখা যাবে।
নাহিল সেটায় করল। ছেলের বাবা বলল
‘ সমস্যা নেই। আমরা অপেক্ষা করব।
রাহার আবেগী মন সে কথা ও মানতে নারাজ। সে মানতে পারেনা। তার রোয়েন ভাইয়াকেই চায়। এই কথা মুননার কানে উঠতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। নাহিল ভেবেছে মুননা রাগ করবে, চেঁচামেচি করবে৷ না তেমন কিছুই করল না মুননা। সিদ্ধান্ত নিল বাকি পড়ালেখা বিদেশেই কমপ্লিট করবে। কিছু বছর ওখানেই কাটিয়ে দেবে। মুননার এই সিদ্ধান্তে সবচাইতে বেশি আহত হলো নাহিল। মুননাকে কিছু জিজ্ঞেস করতেই মুননা জানাল
‘ সরি বাবাই, রাহা আমার বোনের মতো। আমি ওকে অন্য চোখে দেখতে পারবনা। এটা পসিবল নয়। আমি ফরেনে চলে যাব, ফিরতে ফিরতে রাহাকে বিয়ে দিয়ে দিও ভালো ছেলে দেখে। ওর বয়সটা খারাপ তাই উল্টাপাল্টা কথা বলে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আমরা যদি এটাকে স্বাভাবিক ধরে নিই তাতেই ওর ক্ষতি। আমাদের ক্ষতি। ভালোবাসা বলতে কিচ্ছু নেই। সব ইমোশন, ইনফেচুয়েশন।
রাহা নিজেকে আড়াল করে রাখলো মুননার কাছ থেকে। এমনভাবে করল ভুলেও পড়ল না মুননার সামনে। তবে মুননা নিজেই আসলো ওর সাথে দেখা করতে ফরেনে চলে যাওয়ার আগের দিন। রাহা ভয়ে, অস্বস্তিতে হাত পা কুড়িয়ে ছিল। মুননা তার মাথায় হাত দিয়ে চাপড়ে বলল
‘ আসছি রাহা, ভালো থেকো। ভালো করে মন দিয়ে পড়াশোনা করো। এখন শুধুই পড়ার সময় অন্যকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। ঠিক আছে?
রাহা সেদিন শুধু মাথা নাড়িয়েছিল।
এয়ারপোর্টে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল তাননা। মুননা হেসে শুধু বলল
‘ তুননু তোর কোলে জুননু আর গুড্ডু দেখতে চাই।
কান্না থামলো না তাননার। মুননা গেল ঠিক কিন্তু, মা বাবার সেই ঘরটাতে যেটাতে সে থাকতো। সেটাতে কাউকে না ডুকতে বলে গেছে। সেখানে সব ছবি আর স্মৃতি। সে যেন ফিরে এসে রুমটা একইভাবে ফিরে পায়।
তাননার পাগলামি শুরু হলো যখন দেখল ভাই ও চলে গেল তাকে ছেড়ে ওই ভিনদেশে। আবার কবে ফিরবে?
ঈশান থামাতে না পেরে বলল
‘ উকিল ম্যাডাম আপনার কান্না আমার সহ্য হয়না একদম। কাঁদবেন না। আমার রাগ লাগে। ভীষণ রাগ উঠে।
চলবে