এবং_তুমি পর্ব ২১

0
909

গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ২১

অপারেশন থিয়েটারের সামনে এসে নতুন চমক দেখবো আশা ই করি নি। ইশান অস্থির হয়ে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলো। চারদিকে তখন চলছে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। নার্স, ডাক্তার আর দু-তিনজন রোগী ব্যাতীত আর কেউ নেই। অথচ অন্যন্যা দিন হাট-বাজারের মতো মানুষে পরিপূর্ণ থাকে। ইশানের কান্নামাখা মুখ দেখে ডাক্তার নিধি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে। ধবধবে সাদা গোল বর্ণের মেয়েটি যে ডক্টর নিধি সেটা তার এ্যাপ্রনের উপরের ব্যাজ দেখে চিনতে পেরেছিলাম আমি। ইশান ফোনে ডক্টর নিধিকে যা বলেছিলো তখন তা স্পষ্ট বাজতে লাগলো আমার কানে। ডক্টর নিধির অস্বাভাবিক চাহনী আমার ভেতর নাড়া দিয়ে উঠলো। আজেবাজে চিন্তা মাথায় ভর করলো। মেয়েটির চেহারা এত সুন্দর দেখে আমার মনে হলো আমি বোধহয় হাজারো মানুষের মধ্যে এক পলকে তাকে চিনে ফেলবো। ইশান কেঁদে কেঁদে বললেন,

—ন্ নিধি নিধি…ওকে ওকে বাঁচাও।

ইশান অস্বাভাবিক কাঁপছিলেন। তার কন্ঠনালি দিয়ে স্বর ই বের হচ্ছিলো না। বারবার আটকে যাচ্ছিলো। আমি তখন পেটে হাত রেখে ব্যাথা সহ্য করার চেষ্টায় ছিলাম। ডক্টর নিধি ইশানকে বললো,

—রিলেক্স, ইশান। রিলেক্স প্লিজ। তুমি এত অস্থির হচ্ছো কেনো? আর এভাবে কাঁদছো কেনো? হু ইজ সি? হোয়াই আর ইউ ক্রাইয়িং?

ইশান কোনোরকম নিঃশ্বাস টেনে বললেন,

— সি, সি ইজ মাই ওয়াইফ। প্লিজ, হেল্প মি। ডাক্তার ডাক্তার, ডাক্তার…

ইশান চিৎকার চেঁচামেচি করে ডাক্তার ডাকছিলেন। আমি তখন স্পষ্ট দেখেছিলাম নিধি মেয়েটা কেমন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। সে একফোঁটাও নড়ছিলো না। কেমন পাথর পাথর! ওর দৃষ্টি বলছিলো, ওর মাথায় বোধহয় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। সে শক্ত গলায় বলেছিলো,

—তুমি বিয়ে করেছো?

ইশান বললেন,

—এখন কথা বলার সময়? ডোন্ট ইউ সি সামওয়ান ইজ গেটিং ডাই….আর ইউ ম্যাড? ড্যাম ইট!

ইশান ভয়ংকরভাবে ধমক দিলেন। নিধি মেয়েটা কেঁপে উঠলো। ডাক্তার -নার্সরা ঝড়ের বেগে ছুটে আসলো। আমি অবাক হলাম। ওরা নিশ্চই পূর্ব পরিচিত। ওদের কি কোনো সম্পর্ক ছিলো? মরতে বসেছিলাম আমি। আমার সেদিকে খেয়াল ছিলো না। আমি নিধি আর ইশানকে সন্দেহ করছিলাম। ইশান খুব খারাপ শব্দে ডাক্তারদের গালি দিলেন। হাত দিয়ে খুব জোরে পাশের পানির ফিল্টার বারি দিয়ে ফেলে দিলেন। আমি বুঝতে পারলাম ইশান খুব রেগে গিয়েছেন।

—রোগী মরে গেলে আপনাদের খবর হবে? হ্যা? কোথায় থাকেন আপনারা? কোন বালের ডাক্তার?

—কাম ডাউন এন্ড বিহেভ ওয়েল উইথ আস। এটা হাসপাতাল, চিৎকার চেঁচামেচির জায়গা নয়।

— তাতে আমার বাল চেঁড়া গেছে। কিসের হাসপাতাল? ওই কিসের হাসপাতল?রোগী মরে যাচ্ছে ডাক্তার কেবিন আটকে নতুন জামাই সেজে বসে আছে। অ

ঠিক তখনই আমি ইশান বলে ডাক দিলাম। সে খুব বাজে বাজে কথা বলছিলো। উনাকে থামানো জরুরী হয়ে পড়েছিলো। ইশান সেখানেই থেমে গেলেন। দৌড়ে আমার কাছে আসলেন। আমি করুণ স্বরে বললাম, —প্লিজ। ইশান শান্ত হলেন।আমার কপালে চুমু দিয়ে ডাক্তারের কাছে ফিরে গেলো। সে এবার মাফ চেয়ে ডাক্তারকে বললো, আমার চেক আপ এর জন্য। আমি ফিঁকরে কান্না আটকাচ্ছিলাম। ব্যাথা টা কমছিলোই না। সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরছিলো। এত কষ্ট কেনো? কেনো এত কষ্ট? হৃদস্পন্দন বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। আমার মনে হচ্ছে আমি বোধহয় মরে যাবো।

ডাক্তার আমাকে দেখে উনাকে বললেন এখনই অপারেশন করাতে হবে।কিন্তু প্রথমে নাকি ৮০ হাজার টাকা সাবমিট করতে হবে। ইশান বললো সে দিয়ে দিবে, এই মুহূর্তে তার কাছে টাকা নেই। ডক্টর বললো, ‘বাট টাকা সাবমিট না হওয়া পর্যন্ত তো আমরা অপারেশন স্টার্ট করতে পারবো না।’

ইশান তেড়ে এসে কিছু বলতে নিচ্ছিলো তখনই ডক্টর নিধি তাকে থামিয়ে দিলো। বললো,

—-ডক্টর আপনি পেশেন্টের অপারেশনের ব্যবস্থা করুন। টাকার বিষয় চিন্তা করবেন না। আমি সাবমিট করে দিবো। আপনি প্রস্তুতি নিন আমি রেডী হয়েই আসছি।

ইশান দাঁত চেপে বললেন,— কেমন ইউজলেস ডক্টর? ঝড়-বৃষ্টি চোখে পড়ছে না,এদের টাকা চাই। টাকা চাই।

নিধি বললো,

— কাম ডাউন। এটা আমাদের রুলস। তুমি এখানে বসো। আমরা এক্ষুনি অপারেশন স্টার্ট করছি।

আমাকে কেবিনে শিফ্ট করা হলো। ইশান তখন রিসেপশনে ফর্ম ফিলাপ করছিলো। অপারেশন শুরু হওয়ার পাঁচমিনিট পূর্বে ইশানকে আমার সাথে কথা বলতে দেওয়া হলো। ইশান আমার কপালে কিস করে বললেন,

—ভয় পেয়ো না। একদম না। আমি এখানেই আছি তো।

আমি কেঁদে দিলাম। ইশান আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— প্লিজ, কেঁদো না পাখিটা। তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়। ইট’স হার্ট মি। রিয়েলি হার্টস মি। তোমার কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো। আমি আছি।

শোয়া অবস্থায় আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম তাকে জড়িয়ে ধরতে। বুকটা কেমন খা খা করছে। মনে হচ্ছিলো আর কোনোদিন বোধহয় তাকে দেখতে পারবো না। ইশান ঝুঁকে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তার চোখের জলে আমার চিবুক ভিজে যাচ্ছিলো। তখন প্রথমবার.. প্রথমবার সে আমায় বললো, –আই লাভ ইউ। আই রিয়েলি লাভ ইউ। আই কান্ট লিভ উইথআউট ইউ।

মুহূর্তের জন্য আমার শরীর থমকে গিয়েছিলো। অদ্ভুত শিহরণে কেঁপে উঠেছিলাম। আমার মনে হলো আমার ব্যাথা গায়েব হয়ে গিয়েছে। আমি সুস্থ -সবল মানুষ। কেউ যদি বলে আমাকে উড়ে দেখাতে, আমি বোধহয় স্বাচ্ছন্দ্যে উড়ে দেখাবো। সেই মুহূর্তে কীভাবে যেনো আমার নিধি মেয়েটার কথা মনে পড়লো। আমি বললাম,

—স্যার

—হু

—ডক্টর নিধিকে আপনি চিনেন? তাই না? উনি কে হয় আপনার? আপনাদের কোনো সম্পর্ক ছিলো তাই না?

আমি চোখ বন্ধ করে কথাটি শেষ করলাম। পরক্ষণেই জোরে জোরে শ্বাস ফেললাম। দাঁত চেপে ব্যাথাটা সহ্য করছিলাম। ইশান নিশ্চুপ ছিলো। তার বুক বোধ হয় কেঁপে উঠেছিলো। সে শান্তভঙ্গিতে আমাকে জড়িয়ে রেখে বললো,

— সি ইজ মাই এক্স।

ইশান থেমে গেলেন। তার কান্না তখনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমার বুক তখন হু হু করে কেঁদে উঠলো। কি হতো? মিথ্যা বললে? খুব বড় ক্ষতি তো হতো না। সে কেনো মিথ্যা বললো না? হোয়াই? তার উচিত ছিলো মিথ্যা বলা। সে কি বুঝে নি,আমার কষ্ট হবে। খুব কষ্ট হবে। পলকেই পৃথিবীটা নিঃশ্ব লাগতে শুরু করলো। ইশান অবশ্য তখন আমাকে জড়িয়ে নানান কথা বলছিলেন। আমি শুনছিলাম না। আমার মাথায় তখন ওদের কথাই চলছিলো। মুহূর্তেই আমার ব্যাথা থেকে ওদের বিষয়ের উপর ফোকাস চলে গেলো। আমি শান্ত হয়ে গেলাম। এত তীব্র ব্যাথায়ও উহ্ বলেও শব্দ করছিলাম না। ইশানের উপর অভিমান চলে আসলো। কঠিন অভিমান। সে তার এক্সকে দিয়ে আমার অপারেশন করাবে?তার থেকে তো ভালো আমার মরে যাওয়া।

ডক্টর নিধি পূর্ণাং প্রস্তুতি নিয়ে আমাকে ওটিতে নিলেন। কিন্তু আমি অপারেশন করতে চাইলাম না। কাঠ লাঠ গলায় বললাম,

—আমার হাসব্যান্ড আমার পাশে না থাকলে আমি অপারেশন করাবো না।

ডক্টরসরা বললেন,

–সরি,ডিয়ার! অপারেশনের সময় আমরা কাউকে এলাউ করি না।

আমি চেঁচিয়ে বললাম,

—কেনো করেন না? কেনো? বিদেশে তো হাসব্যান্ডকে পাশা রাখা হয়। আপনারা কেনো পারবেন না? আমি অপারেশন কারবো না। এক্ষুণি চলে যাবো। এক্ষুণি যাবো।

আমি ক্যানেলার খুলে ফেলার চেষ্টা করলাম। ডক্টররা আমাকে থামানোর পূর্ণ চেষ্টা করলেন। এমনকি ইনজেকশন ও দিতে চাইলেন। কিন্তু আমার জন্য হয়ে উঠলো না। শেষমেশ বাধ্য হয়েই ইশানকে নিয়ে আসতে হয়েছিলো। উহু,এত সহজে ডুকতে দেয় নি। যখন শুনলেন, আমার ডায়বেটিস ও রয়েছে এবং এর জন্য অজ্ঞান করে অপারেশন করতে পারবেন না। ঠিক তখন তারা ইশানকে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন।
ইশানকে আমার পাশে বসতে দেওয়া হলো। ছোট্ট একটি টুলে। ঠিক তখন আমি মেয়েটাকে দেখিয়ে ইশানের ঠোঁটে চুমু খেলাম। শব্দ করে চুমু! আশ্চর্যজনক হলেও আমার সেই মুহূর্তে একটুও লজ্জা লাগে নি বরং জেলাস ফিল হচ্ছিলো। নার্সরা বোধহয় লজ্জা পেয়েছিলো। তারা অন্য দিকে দৃষ্টি সরিয়ে রেখেছিলো। শুধুমাত্র নিধি মেয়েটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আমাদের দিকে। আমার এ কঠিন সময়ে ইশানের আর নিধি মেয়েটার উপর রাগ উঠলো। ভীষণ রাগ। দুনিয়ায় কি ছেলের অভাব পড়েছিলো যে আমার স্বামীর সাথেই সম্পর্ক রাখতে হবে? হিংসায় আমার সারা শরীর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলো। আমার মন-মষ্তিষ্ক তখন আমায় চেঁচিয়ে বলছিলো, ‘ তুই মরতে পারিস না প্রভাতি, মরতে পারিস না। তুই চলে গেলে এই চুড়েল তোর সংসার দখল করে নিবে। দেখে নিস।’ আমি কঠিন হয়ে গেলাম। যেভাবেই হোক বাঁচতেই হবে আমাকে। অতিরিক্ত হিংসা আর রাগে আমার শরীর বাঁচার সম্পূ্র্ণ ইচ্ছা পোষণ করছিলো। আমার ইচ্ছাশক্তি পুরো দমে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিলো। একবারের জন্যও হাল ছেড়ে দেই নি, সব চেষ্টা করছিলাম বেঁচে থাকার। মেয়েরা মরতে বসলেও স্বামীর পাশে অন্য মেয়ে চিন্তা করতে পারে না। কক্ষনো না। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার জন্য উঠেপড়ে লাগবে। চাইবে তার সাথে যেনো স্বামী ও মারা যাক তবুও অন্যকারো না হোক। ঠিক যেমনটা এই মুহূর্তে আমি চাইছি। আমি যদি না বাঁচি তাহলে যাতে ইশানও না বাঁচে। ডক্টর নিধি না থাকলে বোধহয় আমার চিন্তা অন্যরকম হতো। একদম অন্যরকম!

#চলবে….

®সোনালী আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here