ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি
৭||
ব্যপারটা আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। রাত এগারোটা বাজতে চলেছে অথচ এখনও সায়রার কোন খবর নেই। নীলিমা বাস্তবিকই ঘাবড়ে গেলেন। মেয়েটা কী সত্যিই কোন অঘটন ঘটিয়ে বসল ? গতরাতেও মেয়েটার সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে তার। তখন বেশ বকেছিলেন মেয়েটাকে। সরাসরি বলে দিয়েছিলেন, এবার আর কোন ওজর আপত্তি চলবে না। ছেলে পছন্দ হলে বিয়ে করতে হবে। সেসব শুনে মেয়েটা তখনই ফোঁস করে উঠেছিল। রাগ করে বলেছিল , ” বেশী বাড়াবাড়ি করলে তোমার বাড়ী ছেড়েই চলে যাব আমি। দেখে নিও।” এই কথাটাই বুঝি শেষপর্যন্ত সত্যি হতে চলেছে। এবারের ছেলেটা মেয়ের চরম অপছন্দ। আরমানের সময় এত জেদ করেনি। কিন্তু এর নামও শুনতে চাচ্ছেনা মেয়েটা। সে কারণেই বুঝি তাকে ভয় দেখাচ্ছে। বাপের আদরে একেবারে মাথায় উঠেছে। যাবে আর কোন চুলোয়। নিশ্চয়ই কোন বন্ধু -বান্ধবীর বাড়ী গিয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। নীলিমা অস্থির চিত্তে মঈনকে ডাকলেন। মঈন ডাক পেয়েই চলে এল।
-” বল আপা।”
-” সায়রা তো এখনও এলো না রে মঈন। এমনকী একটা ফোনও দিলনা। আমার তো খুব ভয় লাগছে। কী করি বল তো ?”
-” আমার নিজেরো মাথা কাজ করছে না আপা। পরিচিত কারো বাসায় লুকিয়ে নেই তো? ”
-” জানিনা, জানিনা আমি কিচ্ছু জানিনা। তুই এক কাজ কর। ইয়াদ আলীকে তাড়াতাড়ি গাড়ী বের করতে বল। ওর সবগুলো বান্ধবীর বাসায় যাব আমি। নির্ঘাত কোথাও লুকিয়ে থেকে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে এই মেয়ে।”
-” কোথায় আর লুকাবে। ওর দুই বান্ধবীকেই তো আটকে রেখে জিজ্ঞেস করলে। ” ফের মিলি নামের মেয়েটার সাথে দেখা হবার সম্ভাবনায় একই সাথে পুলকিত আবার চিন্তিতও হচ্ছে মঈন। মেয়েটা এবার রেগেই না যায়।
-” আমার ধারণা, ওরা কিছু লুকাচ্ছে আমার কাছ থেকে। ওর বান্ধবী দুটোকে তেমন সুবিধার মনে হলো না। দুটোই বিশ্ব চালু। আমার সহজ সরল মেয়েটাকে ট্যাটন বানিয়ে ছেড়েছে। আমি ওদের বাড়ী গিয়ে চেক করতে চাই। ”
-” যদি না পাও তাহলে কী করবে ? পুলিশে জানাবে ? ”
-” পুলিশ…? ” নীলিমা আঁতকে উঠলেন। পুলিশকে জানালে কথাটা ছড়াবে আর তাতে তাদের মানসম্মান সব যাবে।
-” না, না। পুলিশ না।” দ্রুত বলে উঠলেন নীলিমা। আমি আগে ব্যক্তিগতভাবে খুঁজতে চাই। তারপর তোর দুলাভাইকে জানাব। ওর সাথে কথা না বলে আমি কোন থানা পুলিশ করব না।”
-” হম, এটা ঠিক।”
-” এই মেয়েটা আমার নাকে দম করে রেখেছে। একবার খালি ওরে পাই আমি। হাত পা বেঁধে সোজা দার্জিলিং রুৎবার কাছে না পাঠিয়েছি তো আমি নীলিমা না। এখানে এভাবে ওকে চোখে চোখে রাখতে পারব না আমি। তারচে খালার বাড়ী যাক। দরকার হলে ওখানে রেখেই বিয়ে দিব ওকে। প্রথম দুদিন কাঁদবে তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। ওখানে এরা থাকবেও না আর ঝামেলা বাজবেও না। মঈন সমর্থন জানিয়ে মাথা নাড়ল।
নীলিমা মঈনকে নিয়ে প্রথমেই সাবাদের বাড়ী গেলেন। সাবা তখন ভেতরের ঘরে পড়ছিল। ছোট ভাইটা ঘরে বসে ঘুড়ির সুতায় মাঞ্জা দিচ্ছে সামনের রুমটাতে। ওর বড় বোন মিলি রাতের রান্না নিয়ে ব্যস্ত। সাবার মা আজ কয়েকদিন ধরেই অসুস্থ। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। সামনের ঘর থেকেই তার কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এদিকে সাবার সবচে বড় বোন সুরমা গত কয়েকদিন ধরে এ বাড়ীতেই আছে। ওর একমাত্র ছেলেটা এখন সাবার ভাইয়ের সামনে বসে মামার সুতায় মাঞ্জা দেয়া দেখছে। সাবার তিন নম্বর বোন শিরি সোফার উপর পা তুলে বসে হিন্দী সিরিয়াল দেখছে আর একা একাই হি হি করে হাসছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে নীলিমা মঈনকে নিয়ে ওদের ড্রইংরুমে প্রবেশ করলেন। অবশ্য এজন্য তাকে বেশী দোষ দেয়া যাবেনা কারণ সদর দরজা খোলাই ছিল। বারকয়েক নক করার পরও ভেতর থেকে সাড়া না পেয়ে তিনি এক প্রকার বাধ্যই হয়েই ঘরে ঢুকেছেন। ঘরে ঢোকার পর তিনি নিজেও বুঝতে পারলেন এখানে হিন্দী সিরিয়াল আর ঘুড়ি নিয়ে যে বাজার বসেছে তাতে দরজার শব্দ না শোনারই কথা।
নীলিমা চেহারা বিকৃত করে পুরো ঘরটাকে একবার দেখে নিলেন। যেটাকে ড্রইংরুম না বলে গোয়াল ঘর বললেই ভাল। নীলিমাকে দেখে মাটিতে বসা মামা ভাগনের কোন প্রতিক্রিয়া না হলেও শিরি লাফিয়ে উঠল।
দ্রুত হাত তুলে সালাম দিয়ে বলল ” আপনি সায়রা আপার আম্মু না ? ”
-” তুমি চেনো আমাকে ? ” নীলিমার ভারী কণ্ঠ আরো ভারী শোনাল।
-” জি, সায়রা আপার মোবাইলে আপনার ছবি দেখেছি।”
-” বেশ ভাল। এখন সায়রাকে ডাক। ওকে বলো ওর আম্মি এসেছে। আর দয়া করে টিভিটা মিউট করো। কান ফেটে যাবার যোগাড়। এত সাউন্ড দিয়ে শোনে মানুষ ! ”
শিরি দারুণ লজ্জিত হয়ে রিমোট নিয়ে কয়েকবার চাপ দেবার পরও যখন বাটন কাজ করল না তখন রিমোটটাকে বাম হাতে দমাদম তিন চারটা বারি মারল। আর তারপরেই সুন্দর কাজ করল রিমোটটা।
শিরি টিভি অফ করে বিব্রত হেসে বলল, ” সায়রাপু তো রাতে কখনো এ বাড়ী আসেনা। ”
নীলিমা কিছু বলার আগেই মঈন বলল, ” আচ্ছা, তাহলে তোমার বড়আপুকে ডাক। বাসায় আর কেউ নেই ? ”
-” জি, আছে তো। ” বলেই শিরি দৌড় লাগাল ভেতরের দিকে। নীলিমা টিস্যু কপালে চেপে ঘরটা আরেকবার দেখলেন। মাটিতে বসা ছেলে দুটোর মধ্যে বড়টা সমানে বকবক করেই যাচ্ছে।
বিরক্তি চেপে ভাইয়ের দিকে তাকালেন তিনি, ” কাদের সাথে যে মেশে আমার মেয়েটা। ফ্যামিলির অবস্থা দেখেছিস ? ”
মঈন কোন জবাব দিল না। তার ব্যাকুল আঁখি দরজার দিকে। পর্দা বাতাসে নড়লেও তার কলিজা নড়ে যাচ্ছে। একটু পরেই তিনটা মেয়ে একসাথে ড্রইং রূমে ঢুকলে নীলিমা সেদিকে তাকিয়ে শিরিকে বললেন, ” কই সায়রাকে ডাকলেনা ? ”
-” সায়রা তো এখানে নেই আন্টি। ” শিরির হয়ে সাবাই জবাব দিল।
-” নেই মানে ? ও তো এখনও বাসায় ফেরেনি ? ” নীলিমা হতাশা চেপে বললেন। মঈন সতর্ক দৃষ্টিতে মিলিকে দেখছিল। মিলি তাকালেই চোখ সরিয়ে ফেলছিল সে।
সাবা হতভম্ব হয়ে বলল, ” সায়রা এখনও ফেরেনি ? ”
-” ফিরলে নিশ্চয়ই আমি এখানে আসতাম না। ” বহুকষ্টে বিরক্তি চাপলেন নীলিমা।
-” সায়রার কোন বিপদ হলো না তো আন্টি ? ও তো কারো বাসায় যায়নি। আমি জেনেই বলছি। আমার বাসায় তো আসেইনি এমনকি তোয়ার বাসায়ও না। থাকলে আমি অন্তত জানতাম। ”
-” আমি এখন কোথায় খুঁজি ওকে বলতো ! ” অসহায় ভঙ্গিতে মঈনের দিকে তাকালে মঈন মাথা নেড়ে বলল।
-” পুলিশেই কমপ্লেইন করতে হবে দেখা যায়। ” বলেই দ্রুত মিলির দিকে তাকিয়ে সংশোধনের সুরে বলল, ” স্যরি, আপনাদের অনেক কষ্ট দিলাম ।” একথায় নীলিমা কটমটিয়ে তাকালেন ভাইয়ের দিকে। তারপরেই ঘুরে বেরিয়ে গেলেন। বেরোনোর আগে মঈন আরেকবার তাকাল মিলির দিকে। ” ইয়ে, আমার ফোন নম্বরটা রাখুন। সায়রার খোঁজ পেলে জানাবেন প্লিজ। ” বলে মিলির হাতে একটা কার্ড গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে গেল মঈন। বেচারার চোখে অন্যরকম ঘোর।
গাড়ীতে বসে এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন নীলিমা। মঈন নিজেও চিন্তিত বোধ করছেন। এত রাত হয়ে এল অথচ মেয়েটার কোন খোঁজ নেই। হলো কী মেয়েটার।
ঠিক একই সময়ে সায়রা নিজের মোবাইলটা অন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। চার্জ একদম কম। লাল দাগ শো করছে। মোবাইলটা বদলাবে বলেও আলসেমি করে বদলানো হয়না। তাছাড়া মোবাইলটার ডিসপ্লে যাবার পর থেকে রোজই একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কিনে নিতে চেয়েছিল একটা কিন্তু রুৎবা খালামনি পাঠাবে বলে আর কেনা হয়নি।
মোবাইল ফের অফ করে পেছনের রাস্তায় হাঁটা ধরল সায়রা। রাস্তাটা এদিকে ঝোঁপঝাড়ের দিকে যাচ্ছে। আরমানকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। সায়রা অনুমান করতে পারছে আরমান এখানেই কোথাও আছে। আশেপাশেই। ছেলেটা ওর কারণেই এখান পর্যন্ত এসেছে। ওকে না নিয়ে যায় কীভাবে। হতাশ চোখে চারপাশে তাকাল সায়রা। এমন সময় ঝোঁপের অস্বাভাবিক নড়াচড়া ওর পিলে কাঁপিয়ে দিল। পড়িমরি করে রাস্তার দিকে ছুটল সায়রা। পেছন ফিরে দেখার প্রয়োজন বোধ করল না সে। অনেকটা পথ আসার পর মেইন রোডের লাল নীল বাতি দেখে বুকে সাহস ফিরে পেয়ে থামল। অসম্ভব হাঁপাচ্চে সে। একপাশে দাঁড়িয়ে সামান্য ঝুঁকে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হবার অপেক্ষা করল সায়রা। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে আবার অন করল। এবার অন হল মোবাইলটা। সায়রা এবার দেরী না করে দ্রুত মেসেজ লিখতে শুরু করল কারণ কল দিতে গেলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মোবাইলটা।
মেসেজ করতে করতেই আচমকা সশব্দে রিং বেজে উঠল। আর তারপরেই পাওয়ার অফ মিউজিক দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল মোবাইলটা । নির্জন এই পরিবেশে এতোটুকু শব্দই প্রকট হয়ে উঠল। আর তার প্রায় সাথে সাথেই বিকট এক চিৎকার।
-” ঐ যে, ওস্তাদ। ঐ যে….!!! ” ছেলেটার চিৎকারে সায়রার চেহারা থেকে রক্ত সরে গেল।
খিঁচে দৌড় দেবার ইচ্ছেটা বহুকষ্টে দমন করে সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে পড়ল সায়রা। অনেকটা সম্মোহিত হরিণের মত। যে বাঘের স্থির চোখের সামনে দাঁড়ালে নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে। সায়রার অবস্থা এখন অনেকটা তেমনই।
চলবে ইনশাআল্লাহ