সুখের_সন্ধানে পর্ব_৩৫

0
486

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৩৫

উদ্বিগ্ন হয়ে থানার বারান্দায় পায়চারি করছি আমি। সেই কখন থেকে সেলিম শুধু আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ছেলেটা হাজতের ভেতর গরমে হাঁসফাঁস করছে দেখে এলাম। ওর মনের ভেতর কী চলছে সে আমি ভালো করেই টের পাচ্ছি। ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছি না। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। মা হয়ে ছেলের মনের খবর টের পেলাম না। চোখের সামনে ছেলেটার সুখের পায়রা আমি উড়িয়ে দিলাম নিজের হাতে? মা হয়ে দু’দুটো সন্তানের চোখের ভাষা আর মনের আকুতি আমি বুঝলাম না। কেমন মা আমি? কিছুতেই মনকে স্থির করতে পারছি না।

ছেলেটা বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে এক সবজি বিক্রেতার সবজির ভ্যানের উপর গাড়ি উঠিয়ে দিয়েছে। লোকটার অবস্থা খারাপ। একটা পা মনে হয় কাটা পড়বে। ভাগ্য ভালো যে উনাকে জানে মারেনি। বেচারার অবস্থা দেখে আমারও খারাপ লেগেছে। দোষ আসলে ভাগ্যের। প্রিয় তো ইচ্ছা করে ওনার এমন হাল করেনি। আমি হাসপাতালে যেয়ে ওনার খোঁজখবর নিয়ে এসেছি। একটা পায়ের অবস্থা আসলেই খুব খারাপ । ডাক্তার বলেছে ওই পা দিয়ে আর হাঁটতে পারবে বলে ভরসা নেই। ওনার মা আর বউ আমাকে দেখে কত যে শাপ শাপান্ত শুরু করল সে আর বলতে পারছি না। ওনারা ওনাদের জায়গায় ঠিক আছে। ছোট ছোট দু’ তিনটা বাচ্চা লোকটার। নিজেদের ঘরের একমাত্র উপার্জনক্ষম আর প্রিয় মানুষটির এমন অবস্থা দেখলে কারোরই মাথা ঠিক থাকবার কথা না। আমি দু’ হাত জোর করে ক্ষমা চেয়েছি। ওনার সুস্থতার জন্য যা কিছু করতে হয় করব বলে আশস্ত করে এসেছি।

প্রিয়র মানসিক অবস্থা সেলিম হয়ত বুঝতে পারছে না। কিন্তু আমি এখন বুঝতে পারছি। মিথিলাকে পার্লারে নামিয়ে দিয়ে সেখান থেকে মাত্র কিছুদূর এগুতেই এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। নিজেই ওই আহত সবজি বিক্রেতাকে ঢাকা মেডিকেলে এডমিট করেছে। ওখানে যাবার সাথে সাথেই এরেস্ট করেছে প্রিয়কে। প্রথমে নিজের মতো করে সলভ করার চেষ্টা করছিল । কাউকে জানাতে চায়নি। পরে যখন সম্ভব হয়নি তখন বাধ্য হয়ে সেলিমকে ফোন দেয়। আর মিথিলার বিয়েতে যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে তাই আমাকে বা অন্য কাউকে কিছু জানাতে নিষেধ করে প্রিয়। ওর ফোন থানায় জব্দ হয়েছে। তাই আমার এতবার ফোন দেবার পরেও ও রিসিভ করতে পারেনি। ফোন তো ওর কাছে ছিলই না। আর আমি কিনা ওকে নিয়ে কিসব উল্টাপাল্টা ভেবে বসেছিলাম। সেলিমকে নিয়েও কত ভালোমন্দ ভেবেছি। খুব লজ্জা হচ্ছে নিজের উপর।
আমার শাশুড়িকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম এতক্ষণে মিথিলার বিদায় শেষ। আমি না থাকায় খুব কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। যদিও আমি আসার আগে ওকে বলে এসেছি অফিসে বেশ বড়সড় একটা ঝামেলা বেঁধেছে যেখানে না গেলেই না। সেলিম একা সামাল দিতে পারছে না। আমার যাওয়াটা খুব জরুরী । না হলে কী মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান রেখে আসতে হয়! সাজিদের মা খুব আফসোস করলেও উনি আমার সমস্যা বুঝেছিলেন। মিথিলা শুধু ফ্যালফ্যাল করে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে ছিল। আমি ওর দিকে একবার তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারিনি। সেখান থেকে বিদ্যুত্বেগে ছুটে এসেছি থানায়।

সেলিমকে ফোন দিতেই সবকথা বলে দেয় আমাকে। ছেলের এমন বেহাল দশ দেখে সেও ঘাবড়ে যায়। তাই আমি ফোন করতেই আর কিছু গোপণ করতে পারেনি আমার কাছে। আমি তখনই অনিকেতকে নিয়ে ছুটে আসি এখানে। প্রিয় সারাদিন কিছু খায়নি। সেলিমেরও একই হাল। ছেলের এমন অবস্থায় খাওয়া দাওয়া কী করে হবে। ঘণ্টা দেড়েক বাদেই অফিস আওয়ার শেষ হয়ে যাবে। আজ যদি প্রিয়কে কোনোভাবে বের করা না যায় তবে রাতটা এখানেই পার করতে হবে । সকালে ওর কোর্টে চালান হয়ে যাবে। আমি ভাবতেও পারছি না। আর কোর্ট থেকে জামিন পাওয়া যে কী ঝামেলা! দীর্ঘ একটা প্রসেসের ভেতর দিয়ে যেতে হবে!

সেলিম উপর মহলের কাউকে দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফোন করেছে। এখন উত্তরের অপেক্ষায়! হাত পা অবশ হয়ে আসছে। প্রিয়র মনের কথা ভেবেই আমি আরো অস্থির হচ্ছি। পাগল ছেলেটা আমার। একদিকে মিথিলাকে হারানোর কষ্ট আরেকদিকে নিজের এমন বেহাল দশা। এত সমস্যার মধ্যেও সে অনিকেতের কাছে মিথিলার বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কিনা জানতে চেয়েছে। অনিকেতই জানাল আমাকে । অনিকেত আছে তাই কিছুটা সাহস পাচ্ছি। আমাকে আর সেলিমকে মানসিকভাবে খুব সাপোর্ট করছে। আর প্রিয়র জন্যও খুব ভালো হয়েছে ও থাকাতে। আমাদের কাছে কোনো মনের কথা শেয়ার করতে না পারলেও অনিকেতের সাথে মন খুলে কথা বলছে। অবশ্য ও নিজে থেকে কিছুই বলছে না। অনিকেত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নানান কথা জিজ্ঞেস করে ওর মন হালকা করার চেষ্টা করছে। আমি ওর সামনে যেতেই ভয় পাচ্ছি।

মনে হচ্ছে নিজের হাতে ছেলের জীবনটাকে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিলাম। কেন যে মিথিলার বিয়েতে এত তড়িঘড়ি করলাম? এমনটা তো আমার সাথে যায় না। আমি সবকিছু ধীর স্থিরভাবে করতে পছন্দ করি অথচ সাজিদের পরিবারের আবদার রক্ষা করতে যেয়ে এতটা তড়িঘড়ি না করলেই পারতাম। কী যে হয়েছিল নিজের সাথে বুঝতে পারছি না। নাকি সবই বিধির বিধান! ছোটবেলা থেকে শুনেছি জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ে এই তিন আল্লাহর হাতে! আল্লাহ কী তবে এটাই চেয়েছিলেন? মিথিলার জন্য সাজিদই লেখা ছিল তাই হয়ত সবকিছু এমন করে হয়েছে। নয়ত আমিই বা কেন আমার ছেলেটার মনের খবর ঘুণাক্ষরেও টের পেলাম না। প্রিয়ও তো আমার সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করতে পারত! ওর সাথে আমি সব বিষয়ে খুব ফ্রী। অথচ!

যাক সব বিধির বিধান! যা হয়ে গিয়েছে সে তো আর খণ্ডাতে পারব না। এখন মিথিলা সুখে থাকলেই আমার শান্তি কিছুটা । আর ছেলেটাকে যে করে হোক স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে!

সারাদিন আমার পেটেও আজ দানাপানি পড়েনি। শরীরটাও খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু সেদিকে মন দেয়ার সময় আমার নেই। মাথা ফেটে যেন ঘিলু বেরিয়ে যাবে এত পেইন হচ্ছে । কিন্তু চিন্তার বেড়াজালে আমি বন্দি । আমি হাজার চিন্তায় বুঁদ হয়ে ডান হাতে কপাল চেপে ধরে বারান্দার একটা টুলের উপর মাথা নিচু করে বসে আছি। তখনই অনিকেত হাসিমুখে দৌড়ে এসে আমাকে ডাক দিলো।

– আন্টি, সুখবর আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কল দিয়ে কাজে এসেছে। গ্রীণ সিগনাল পেয়েছি। আঙ্কেলের অপরিচিত লোক বুদ্ধি দিয়েছেন যে ওই পরিবারের সাথে কথা বলে যেভাবে হোক মামলা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে। ওই লোকের পরিবারের সাথেও কথা বলেছে আংকেল। তারা মামলা তুলে নিতে রাজিও হয়েছে।

বিনিময়ে আংকেল কথা দিয়েছেন উনার সমস্ত চিকিৎসা ব্যয় বহন করবেন। দেশের চিকিৎসায় কাজ না হলে প্রয়োজনে ইন্ডিয়া বা অন্য কোনো দেশে নিয়ে ওনার কৃত্রিম পা সংযোজনের ব্যবস্থা করে হবে। সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত উনার চিকিৎসার পাশাপাশি পরিবারের সমস্ত ভরণপোষণও করবেন। আর সুস্থ হবার পর উনার কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। উনারা প্রথমে বিশ্বাস করতে না চাইলে পরে স্টাম্প পেপারে এগুলো উল্লেখ করে একটা দলিলের মতো করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওসি সাহেবই দায়িত্ব নিয়ে সব করছেন।
ড্রাইভার আজাদ অলরেডি মামলার বাদী মানে ওনার স্ত্রীকে নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে। ঈশ্বরের কৃপায় প্রিয় মুক্ত হয়ে যাবে। চিন্তা করেন না , প্লিজ।

অনিকেতের মুখে সবকিছু শুনে আমার হাউমাউ করে কান্না আসছে। সেলিমের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নতজানু হয়ে যাচ্ছি আমি। ছেলেকে মুক্ত করার জন্য সে কি না করেছে!

সাজিদরা বাসায় পৌঁছেছে ঘণ্টাখানেক হলো। মিথিলার যদিও এ বাসা আগে থেকেই পরিচিত। তারপরেও কেন যেন আজ খুব অপরিচিত লাগছে তার। সাজিদকে আসার পর আর এখন পর্যন্ত একবারের জন্যও দেখেনি সে। নানান ধরণের ফর্মালিটিতে ব্যস্ত সবাই। মিথিলা মুখ ভার করে বসে আছে। একটু পরপরই কেউ না কেউ এসে ঘোমটা খুলে তাকে দেখছে। এতবড় ঘোমটা টেনে বসে আছে বলে সবাই হাসাহাসি করছে। সবার একই কথা এমন ঘোমটা টেনে বসে থাকার যুগ কি আর এখন আছে?
মিথিলা ইচ্ছে করেই নিজেকে আড়াল করে ওড়নাটা টেনে মুখ ঢেকে বসে আছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন তার। মনের মধ্যে কত কথা ঘুরপাক খাচ্ছে । প্রিয়কে ভীষণ মনে পড়ছে। সেই যে সকাল বেলা গেল এখনো পর্যন্ত তার খবর জানে না। আর রূম্পা মাই বা অমন করে হাওয়া হয়ে গেল কেন? ছুটির দিনে কী এমন এমার্জেন্সী কাজ হতে পারে অফিসে? এমন তো আগে কোনোদিন হয়নি। নানা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছে তার মনের কোণে।

মিথিলাকে সন্ধ্যার দিকে নিজের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ফুল দিয়ে ভীষণ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চারপাশটা ভালো করে দেখল মিথিলা। তার পছন্দের গন্ধরাজ আর কামিনিও আছে। এটা যে সাজিদের প্লান সে বুঝতে পারল কারণ সেই বলেছিল গন্ধরাজ আর কামিনীর খান তার খুব প্রিয়। পুরো রুমে ফুলের গন্ধে এক ধরণের মাদকতা সৃষ্টিকারী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মিথিলা ফুলের গন্ধে যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য হারিয়ে যাচ্ছিল।

সাজিদের বোন শান্তা আর আরো কয়েকজন মেয়ে মে বি ওরা সাজিদদের কাজিন হবে ওরা এসেছে ওর সাথে। ওরা নানা ধরণের মজার মজার কথা বলে মিথিলাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। মিথিলাও হাসিমুখে ওদের সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলছে। শান্তা মিথিলার লাগেজ বের করে নিজের হাতে মিথিলার কাপড়চোপড় আলমারীতে গুছিয়ে রাখছে। সাথে অন্য কাজিনরাও হাত লাগাচ্ছে। ওদের আন্তরিকতা দেখে মিথিলা মুগ্ধ।

বিশেষ করে শান্তা! শান্তা বয়সে বা একাডেমিক ক্যারিয়ারে সবদিক থেকেই মিথিলার থেকে বড় হয়েও মিথিলার সাথে খুব সম্মান দিয়ে কথা বলছে। আর ওর ব্যবহার এতটা আন্তরিক যে মিথিলার মনেই হলো না শান্তার সাথে মাত্র দু একদিনের পরিচয়। যদিও এর আগে একদিন বাসায় এসে কিছু সময়ের জন্য কথা হয়েছি ওর সাথে।

মিথিলার চোখ চারপাশে শুধু সাজিদকে খুঁজছে । না জানি সে তাকে ভুল বুঝে কী না কী ভেবে বসে আছে! খুব কান্না আসছে তার। এক সমস্যার হাত থেকে বাঁচতে না জানি কোন নতুন সমস্যার জালে আবার জড়িয়ে যাচ্ছে সে । সৎ মায়ের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে এসেছিল খালার বাসায় আবার সেখান থেকে নতুন সমস্যার হাত থেকে বাঁচতে এসেছে স্বামীর ঘরে। নিজের জীবনটাকে তার কচুরিপনার মতো মনে হচ্ছে। ভাসতে ভাসতে একবার এ ঘাটে তো আরেকবার ও ঘাটে। কেন যে অন্য মেয়েদের মতো সাহসী না সে?

মিথিলার বিচলিত মুখখানা শান্তার দৃষ্টিগোচর হতেই পাশে বসে বলল,

– কী ভাবি! ভাইয়াকে খুঁজছ ?

– না মানে?

– লুকোচুরি করার কিছু নেই। তোমার চোখে স্পষ্ট আমি দেখতে পাচ্ছি।

– আসলে আপু!

– আপু? হা হা হা! আমাকে তুমি নাম ধরে ডাকলেই খুশি হব। আমি তোমার ননদ হলেও বয়সে বড় তাই আপু ডাকছ বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা কিন্তু বেশ বেমানান দেখাচ্ছে। আমাকে ননদ ভাবারই দরকার নেই । তুমি বন্ধু মনে করে নাম ধরে মিষ্টি করে ডাক দিলেই বেশি খুশি হই এই অধম। এতদিন আমার কোনো বোন ছিল না। আজ একটা বোন পেয়েছি। আর বোন মানেই তো বন্ধু। তাই প্লিজ! শুধু শান্তা, ওকে?

– মিথিলার চোখ ভিজে এল শান্তার আন্তরিকতায়। সে মাথা নাড়িয়ে বলল, হুম।

– এ বাসাতে তোমার যেকোনো সমস্যা তুমি আমাকে নির্দ্বিধায় শেয়ার করো ভাবি। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব তোমার পাশে থাকার। কখনো মনে করবে না আপন জন ছেড়ে এসেছ। আমাদের আম্মাও খুব ভালো মানুষ। তোমার মনেই হবে না তুমি নিজের বাড়ি ছেড়ে এসেছ। কিছুদিন গেলেই বুঝবে এক মায়ের বুক খালি করে আরেক মায়ের বুকে এসেছ।

– আমিও একজন মা’ই যে চাই। শাশুড়ি চাই না। আবেগের সাথে ভেজাকণ্ঠে বলল, মিথিলা।

– তোমার আশা পূর্ণ হয়েছে ভাবি! আচ্ছা, এসব আবেগি কথাবার্তা ছাড়ো। এখন বলো কি করবে ভাইয়া আসা পর্যন্ত এই আধামণ ওজন পড়ে বসে থাকবে নাকি হালকা কিছু দিব, চেঞ্জ করবে? তুমি তো বহু সময় ওয়াশ রুমেও যাওনি। ওই পাশে তোমার ওয়াশ রুম। একটু ফ্রেশ হয়ে এসো। ভালো লাগবে। আমি হলে সব এতক্ষণে খুলে রিলাক্স হতাম আগে। মাই গড ! সারাদিন কী করে থেকেছ তুমি? আমারই কষ্ট হচ্ছে তোমাকে দেখে। মেয়ে হয়ে জন্মালে কত যে যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়! ছেলেদের শান্তির অভাব নেই। ভাইয়াকে দেখো! এসেই সব খুলেটুলে নর্মাল ড্রেস পরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে সাব্বিরের রুমে।

মিথিলা বুঝতে পারল সাজিদ তাহলে ঘুমাচ্ছে এজন্যই তার সাথে এতক্ষণ দেখা নেই।
সে কী করবে বুঝতে পারছে না। তার কি শাড়ি পরেই সাজিদের অপেক্ষায় বসে থাকা উচিত নাকি চেঞ্জ করবে সে কনফিউজড।

– শান্তা বুঝতে পেরে বলল, ভাইয়া সারাদিন বহু দেখেছে তোমাকে এই সাজে। তার জন্য অপেক্ষায় বসে থাকার দরকার নেই। আর ভাইয়া যে ঘুম পাগল। এই ক’দিনের ব্যস্ততায় ঠিকঠাক ঘুমাতে পারেনি। এই রুমে ঢোকার অনুমতি না পেয়ে নাক ডেকে সাব্বিরের রুমে যেয়ে ঘুমাচ্ছে। কতক্ষণে ঘুম ভাঙ্গবে খবর আছে? তুমি এগুলো চেঞ্জ করে আসো । আমি তোমাকে হালকা করে একটু মেকওভার করে দিচ্ছি। যাও।

শান্তার আন্তরিকতায় মিথিলায় সাহস পায়। সে ফ্রেশ হবার জন্য গেল। আধাঘণ্টা পরে মোটামুটি ফ্রেশ হয়ে রুমে ফিরল। একটা টকটকে লাল কালারের জামদানী নিয়ে অপেক্ষা করছে শান্তা। মিথিলাকে খুব সুন্দর করে শাড়িটা পরিয়ে দিলো। হালকা প্রসাধনী আর গয়নায় চমৎকার লাগছে। চুলগুলি ছাড়া রেখে একপাশে ক্লিপ দিয়ে একটা কাঁচা ফুলের মালা পরিয়ে দিলো। একটা টিপ পরাতে গেলে মিথিলা একটু আপত্তি জানায়। সে বলল, আমি তো টিপ পরি না।

– টিপ পরলে তোমাকে কিন্তু চমৎকার লাগবে। ছোট একটা পরিয়ে দেই।

– সরি, শান্তা! আমি ছোটবেলা থেকেই টিপ পরি না, তাই ববলছিলাম কি!

– কেন পরো না? শান্তা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।

– আমার দাদি পছন্দ করতেন না। আম্মু মাঝেমাঝে পরিয়ে দিলে দাদি আম্মুকে বকাঝকা করতেন। এটা নাকি আমাদের ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। দাদি আমাকে সেই নবীদের আমলের ঘটনা খুলে বলেছিলেন। পরে ভেবে দেখলাম শুধুশুধু উনাকে কষ্ট দিয়ে এই একটা টিপ না পরলেই বা কি! তাছাড়া আম্মুও আর বকাঝকা শুনতে হবে না। তাই টিপ পরতে গেলেই দাদির কথা মনে পড়ে।

– উনি বেঁচে আছেন?

– না , গতবছর মারা গেছেন দাদি।

– দাদি বেঁচে নেই অথচ সে কষ্ট পাবে ভেবে তুমি তার আদেশ এখনো ফলো করছ। বাহ! তুমি খুব ভালো মেয়ে তুমি জানো, ভাবি?

– হা হা হা! এই তো জানলাম। তুমি বললে যে!

– এর আগে কেউ বলেনি? আমার ভাইয়াও না? এমনিই কি পটে গেল তোমার প্রেমে নাকি কোনো যাদুমন্ত্র করেছ ? বিয়ের জন্য যে পাগল হলো ।

– কি যে বলো! যাও!

বেশ কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করতেই শান্তার সাথে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেল মিথিলা। রাতের খাওয়ার সময়ও সাজিদের দেখা মিলল না। মিথিলার বুকের মাঝে ধুকপুক করছে। না জানি তাকে নিয়ে কী ভেবে বসে আছে সাজিদ। আইমানের উপর রাগে ফেটে যাচ্ছে সে। কি দরকার ছিল আজেবাজে কথা গুলো বলার?

রাত সাড়ে বারোটার দিকে সাব্বির ঠেলেঠুলে সাজিদকে ঘুম থেকে উঠিয়ে রুমে পাঠিয়েছে। সাজিদের কাজিনরা এ নিয়ে কী হাসাহাসি! নতুন বউ রেখে ভাইয়ের রুমে এসে ঘুমাচ্ছে!

সাজিদ রুমে ঢুকে দেখে মিথিলা তখনো জেগে আছে। সাজিদকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল । মিথিলা আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, কোথায় ছিলে এতক্ষণ ?

– সাব্বিরের রুমে। খুব ঘুম পাচ্ছে। শুয়ে পড়ো। নিরুত্তাপ উত্তর সাজিদের।

– তোমার সাথে কথা ছিল আমার। প্লিজ, একটু যদি শুনতে!

– কথা বলার সময় সারাজীবন পড়ে আছে। সারাদিন তো অনেক ধকল গেছে। খুব ক্লান্ত তুমি। শুয়ে পড়ো, প্লিজ। আমিও শুয়ে পড়ছি। লাইট টা অফ করে দিলাম। আগামীকাল আবার রিসেপশানের ঝামেলা পোহাতে হবে। বোঝই তো ! বাবা বেঁচে নেই। সব দায়িত্ব আমাকেই পোহাতে হয়।

মিথিলাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইট অফ করে একটা কোলবালিশ টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সাজিদ।

সাজিদের ব্যবহারে মিথিলার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কী আজব এক ভাগ্য নিয়ে সে পৃথিবীতে এসেছে।

“যেদিন তার মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল সেদিনই কী সে সাথে করে ওরে সৌভাগ্যটুকুও নিয়ে গেল? ”
নিজের কাছে নিজের প্রশ্ন তার।

চলবে…

পর্ব-৩৪

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/375607844221891/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here