.
ছাদে বসে আছে মীরা হাটুর ভরে মাথা দিয়ে। কি থেকে কি হয়ে গেলো।জীবন টা নিমিষে বদলে গেলো।
ধ্রুভ ঘরে এসে দেখে মীরা নেই ঘরে।মীরাকে ঘরে দেখতে না পেয়ে ধ্রুভের মাথা খারাপ হয়ে গেলো।আবার পালালো কি না সেটাই ভাবছে সে।তাড়াহুড়ো করে বাহিরে আসলো তাও দেখতে পেলো না।দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলো সেও দেখে নাই,মীরাকে বাহিরে আসতে।
.
সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হতে চললো তবুও মীরার খোজ পায় নি ধ্রুভ।ইব্রাহিম দাদু এরই মধ্যে দু’বার কল করে মীরাকে চেয়েছেন।বিভিন্ন বাহানা দিয়ে এড়িয়েছে সে ম্যাটারটা এখন কিভাবে এভোয়েড করবে?
বুকের বা’পাশ টা ভীষণ চিনচিন করছে।একবার মীরাকে হারিয়েছে।আজ যদি প্রত্যয়ের এক্সিডেন্ট না হতো মীরা ঠিকই এখন অন্য কারো ঘর করতো।অন্য কারো বউ হতো।মীরা অন্য কারো বউ হতো ভেবেই ধ্রুভের মেজাজ টা আবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে।মীরাকে ভুলার জন্য লন্ডনে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড করতো তারপরেও মীরার মোহ সে ভুলতে পারে নি।জীবন বিচিত্র।যখন সাথে থাকে তখন আমরা ঘুরে তাকাই না আর দূরে থাকলে কলিজা ফাটাই দি চেচিয়ে।
.
মীরা মাথা নিচু করে এতোইবেশি মগ্ন ছিলো নিজের ভাবনাতে যে এদিকে যে সকাল থেকে রাত হয়ে গেছে তার কোন হুশ নেই।মীরা টের পেলো মশার কামড়ে।হাজার হাজার মশা তাকে কামড়ে টের পাওয়াচ্ছে,’এই মীরা বাড়ি যা নয়তো আজ তোরে আমরা উঠিয়ে নিয়ে যাবো!’
মশার দেয়া কামড় গুলোতে মীরা চুলকাচ্ছে আর নিচে নামছে।তার মাথাতেও নাই ধ্রুভের কি অবস্থা আছে।মীরা যখন ঘরে গেলো দেখতে পেলো মাথা নিচু করে তার দুই হাতের উপর ভর দিয়ে আছে।ধ্রুভের এরকম লুক দেখে মীরার আত্নার পানি শুকিয়ে গেলো।হালকা শুকনো ঢোক গিললো সে।
কারো পায়ের শব্দে ধ্রুভ মাথা উচু করে তাকালো।দেখলো মীরা দাড়িয়ে আছে।মীরাকে দেখে ধ্রুভ খুশি হলেও পরক্ষনে তার মাথা খারাপ হয়ে গেলো মীরার গায়েব হওয়া নিয়ে।সে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘কোথায় ছিলি?’
মীরা আমতা-আমতা করে জবাব দিলো,
‘ছাদে!’
মীরার মুখে কথা শুনে ধ্রুভ চিল্লিয়ে উঠলো এক প্রকারের,
‘তুই কি ভাবছিস তুই এরকম লুকোচুরি করবি আর আমি কুকুর হয়ে তোকে খুজবো?হ্যা তোকে আজকে সারাদিন আমি কুকুরের মতোই খুজেছি।আমাকে তো মানুষ মনে হয় না তোর।আমার তো অনুভূতি নাই।আমি তো রোবট না।বালের বিয়া আমার!’
ধ্রুভ এইসব কথা বলে মীরাকে ঝেড়ে ওখান থেকে চলে গেলো।মীরা থম মেরে দাড়িয়ে রইলো যে হলো টা কি?
.
‘দাদু কখন থেকে কল করেই যাচ্ছে এই লোক গেলো টা কোথায় নিজের মোবাইল রেখে।’
মীরা বলছে।কারন,ধ্রুভে ইব্রাহিম খান বারবার ফোন দিচ্ছে।তার ফোন তো দাদু বিয়ের দিন ভেঙ্গে দিয়েছিলো প্রত্যয়কে কল দিবে বলে জোর করছিলো যখন।আবারো ফোন বাজছে।
মীরা রিসিভ করলো এইবার।ফোন ধরে কিছু বলতে যাবে তার আগে থেকে ওইপাশ থেকে কর্কশ কন্ঠস্বরে কথা ভেসে উঠলো,
‘এতোক্ষন ধরে তোমাকে ফোন দিচ্ছি তুমি ধরছিলেন না কেন?’
মীরা বুকে দুই তিনবার ফু দিয়ে নিলো।সে নরম স্বরে বললো,
‘দাদু উনি ফোন রেখে বাহিরে গেছেন।’
মীরার কন্ঠস্বর শুনে ইব্রাহিমের বুকটা খা খা করতে লাগলো।তিনি মোমের মতো পুতুলের গায়ে হাত তুলেছিলেন গতকালকে।তিনি বললেন,
মীরা এই কথা বলে সালাম দিয়ে কল কেটে দিলো।ইব্রাহিম খান কে আর কিছু বলার সে সুযোগ দিলো না।মীরার এরকম ব্যবহার সম্পর্কে ইব্রাহিম খান অবগত।কারন,মীরা যখনি অভিমান করে পরিবারের কারো উপর তখনি সে সালাম দিয়ে ফোন কেটে দেয়।
ইব্রাহিম খান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘কবে যে তুমি বুঝবে তোমার ভালোর জন্য করেছি সব’
.
রাত তিন টা বাজে কিন্তু ধ্রুভের আসার কোন নামগন্ধ নেই।এদিকে মীরা এতোক্ষন গায়েব ছিলো আর এখন ধ্রুভ।মীরা কেদেঁ কেদেঁ নাক মুখ ফুলিয়ে দিয়েছে একদম তারপরেও ধ্রুভের খোজ পাচ্ছে না
একটু হেলতে দুলতে ঘরে আসছে ধ্রুভ।দরজার সাথে ঠেস মেরে দাড়িয়ে রয়েছে।সে যে ওভারলোডেড তার হেলদোল দেখে বুঝা যাচ্ছে।
ধ্রুভ নিভু আওয়াজে ডাকলো,
‘মীরু?’
মীরাকে কখনো এই নামে ধ্রুভ ডাকে নি।মীরু বলাতে মীরা যখন চোখ তুলে উপরে তাকালো দেখলো ধ্রুভ দাড়িয়ে আছে দরজাতে হেলান দিয়ে।চোখ অসম্ভব লাল তার।
মীরা জিজ্ঞেস করলো ফুপিয়ে,
‘আপনি কোথায় গিয়েছিলেন আমাকে ছেড়ে।’
ধ্রুভ এগিয়ে এসে মীরার মুখ টা উচু করে ধরে তার ঠোটে শক্ত করে একটা চুমু খেয়ে বললো,
‘আমাকে মিস করছিলি?’
মীরা থমকে যাই।হ্যা,সে এখনো ধ্রুভ নামক মানুষটাকে ভালোবাসে।ভালোবাসা কখনো হারায় না,অবহেলা আর ফেলনাতে সব হারিয়ে ফেলে মানুষ।ভালোবাসার তীব্র যন্ত্রণা সবাই কমবেশি জানে।
মীরা ধীর আওয়াজে বললো,
‘তুমি ড্রাংক করেছো?’
ধ্রুভ ম্লান হাসলো। তারপর বললো,
‘তোর মাঝে নেশা করতে চাই।দিবি করতে একটু?’
ধ্রুভের এরকম কথা শুনে মীরার বুকে তোলপাড় লাগিয়ে দিলো।বুকের ভেতর ধুকপুক করে জানান দিচ্ছে ভালোবাসার অতল সাগরে ভেসে যেতে।রক্তের কণাগুলো শিরশির করে সারা শরীত বয়ে যাচ্ছে।
মীরা সরে আসতে চাইলে ধ্রুভ তার কোমর আরেকটু কাছে টেনে বললো,
‘বল না মীরু তোর মাঝে একটু ডুব দিতে দিবি।প্রমিস সব টুকু দিয়ে দিব।’
মীরা বললো,
‘আপনি নেশার ঘোরে এইসব কি বলছেন।পরে ঘুম থেকে উঠে ঠিকই বলবেন যে,তুই আমার ইজ্জত লুটে নিয়েছিস।’
ধ্রুভ মীরাকে আরেকটু নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।তার কানের কাছে মুখ নিয়ে যেয়ে বললো,
‘তোর নেশার ঘোরে পরেছি।এমনভাবে আছাড় খেয়েছি আর যে উঠতে পারছি না রে।চল না প্রেম প্রেম খেলি।’
.
‘তুমি মিথ্যা কথা বলছো তাই না?বলো না তুমি মিথ্যা বলছো’
এইসব বলতে বলতে মীরা ধ্রুভের পা ধরে বসে পরলো।আর পাগলের মতো বিলাপ করতে লাগলো।ধ্রুভের মায়া হচ্ছে সেই সাথে প্রচন্ড রাগে ফুলছে।ধ্রুভ তার দুই বাহু টেনে তুলে বললো,
‘এটাই সত্যি মীরা।ইউ হ্যাভ টু একসেপ্ট দিস।’
মীরা অঝোরে কাদঁতে লাগলো।কাদঁতে কাদঁতে বললো,
‘তুমি মিথ্যা বলছো আমি জানি।তুমি আমাকে সেই ছোট থেকে দেখতে পারো না।এইজন্য তুমি প্রত্যয়কে মেরে মেরেছো তাই না।’
ধ্রুভের মেজাজ টা চট করে খারাপ হয়ে গেলো।সে মীরাকে দেয়ালে ঠেসে ধরে বললো,
‘প্রত্যয়কে আমি মারি নি।তবে আজকের পর থেকে কেও যদি তোর আর আমার মাঝে আসার চেষ্টা করে আমি তাকে মেরে ফেলবো।কারন,তুই শুধু আমার।’
মীরার কানে ধ্রুভের বলা কোন কথা যাচ্ছে না।চারিদিক ঝাপসা দেখছে সে।মনে হচ্ছে অতল সাগরের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে।তারপর আর কিছু মনে নেই।’
‘কেন তুই আগের মতো বুঝিস না যে আমি তোকে কতোটা চাই।’
মিনিট দশেক পর ডাক্তার এসে দেখে গেলো মীরাকে।অতিরিক্ত স্ট্রেস সহ্য করতে না পারার ফলে মীরার প্রেশার ফল করেছে যার কারনে সে সেন্সলেস হয়ে গেছে।ঘুমের ইঞ্জেকশন দিলো মীরাকে।আজকে রাত টা আরাম পাক।সকাল হতে হতে ঠিক হয়ে যাবে সে।
ধ্রুভ মীরাকে চেঞ্জ করিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আজ যদি তুই অন্য কাওকে বিয়ে করার কথা না বলতি আমার জন্য অপেক্ষা করতি তোকে আজকে আদরে ভরিয়ে দিতাম আমি মীরা।’
ধ্রুভ বেশকিছুক্ষন মীরার দিকে তাকিয়ে শাওয়ার নিতে ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে।দেয়াল হাত দিয়ে উদাম গা দিয়ে পানি বেয়ে চলছে ধ্রুভের শরীরে।মাথায় চলছে নানান চিন্তা।কিভাবে কি করবে।কিভাবে সামাল দিবে এইসব।
ধ্রুভ দেয়ালে হাত শক্ত করে রেখেই বললো,
‘তুই শুধু আমার মীরা।আর কাওকে না আসতে দিব না তোকে যেতে দিব।’
.
সকালবেলা পাখির কিচিরমিচির ডাকে ধ্রুভের আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায়।সে উঠে দেখে মীরা এখনো উঠে নি।সকালবেলার স্নিগ্ধতা যেন মীরাকে আরো মোহনীয় করে তুলছে।এক ধ্যানে চেয়ে রয়েছে সে মীরার দিকে।মীরা নাক মুখ চোখ সব মনে হয় কেও অনেক যত্ন নিয়ে নকশা করে এঁকে দিয়েছে।
মীরার মুখের উপর চুল এসে পরেছে।ধ্রুভ তা আলতো করে সরিয়ে দিলো।গালটাকে একটু ছুয়ে দিলো।ইচ্ছা করছে সমস্ত আদর দিয়ে উজাড় করে মীরাকে ভালোবাসতে কিন্তু ধ্রুভের পরক্ষণেই মনে পরে গেলো,মীরা তাকে ছেড়ে ওই প্রত্যয়কে বিয়ে করতে চেয়েছিলো।
ধ্রুভের কপালের রগটা ফুলে গেলো।এক লাফে নিচে নেমে পরলো বিছানা থেকে।ফ্রেশ হতে চললো ওয়াশরুমে।
.
মীরার ঘুম ভাঙলো বেলা এগারোটার দিকে।আড়মোড়া ভেঙ্গে এদিক সেদিক তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে।
পর মুহূর্তে সে বুঝলো সে তাদের বাগানবাড়িতে আছে যা ধ্রুভ এনেছে তাকে গতকাল রাতে।ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় চোখ গেলো তার।
নিজের জামা কাপড় চেঞ্জ দেখে মীরার চোখ কপালে।নিশ্চয় ধ্রুভ করেছে।খাট থেকে ধ্রুভ কোথায় আছে তা রেগেমেগে খুজতে গেলো মীরা।
ধ্রুভ নিচে বসে মোবাইলে টাইপিং করছে আর আরেক হাতে কফি খাচ্ছে।মীরা নিচে নেমে এসে ধ্রুভর কলার ধরে বললো,
‘আমার জামা কাপড় বদলোর অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?কে আপনি আমার’
ধ্রুভের এক তো মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে মীরা তার কলার ধরেছে তার উপর এইসব উদ্ভট কথা।ধ্রুভ উত্তর না দিয়ে মীরার চুলের মুঠি ধরে তার ঠোটে ঠোট বসিয়ে দিলো।শুরু হলো অত্যাচার মীরার ঠোটের উপর।কামড় দিচ্ছে জিদে ধ্রুভ মীরার ঠোটে।চুলের মুঠিটাও শক্ত তার।
মীরার হাত দুটো বেকিয়ে রেখেছে ধ্রুভ।চোখের একপাশ দিয়ে পানি গড়ছে।এই চুমুটা তার বেস্ট চুমু হতো যদি ধ্রুভ তার ভালোবাসাকে গ্রহন করে বিয়ে করতো এতোদিনে।ধ্রুভ তো তাকে কখনো চায় নি সে।
চুমুটা জেদ করে দিলেও ধ্রুভের কাছে মীরার ঠোট টা ওয়াইনের থেকেও নেশাক্ত মনে হচ্ছে এখন।মীরাকে নিয়ে সোফায় শুয়ে পরলো।সোফায় মীরাকে শুইয়ে সম্পূর্ণ ভর দিলো তার উপর ধ্রুভ।এতোক্ষন কামড় দিলেও এখন শুষে নিচ্ছে মীরার ঠোট ধ্রুভ।মীরার কোমর জুড়ে ধ্রুভের হাতের বিচরণ চলছে।
বেশকিছুক্ষন পর ঠোটের যুগলবন্দী থেকে মীরা মুক্তো পেলো।সে এখনো চোখ বন্ধ করে আছে।সে কনফিউশনে আছে তাকে ভালোবেসে আদর করলো নাকি জেদে।
ধ্রুভ ফিসফিস করে বললো,
‘ভেবে এখন তুই আমার কে।’
মীরার চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই।ধ্রুভের বলা কোন জবাব তার কানের কাছে যাচ্ছে না।সে শুধু একটাই কথা ভাবছে,
‘ভালোবেসে কাছে না টেনে এখন সে আমাকে কি তবে জেদে বিয়ে করেছে?’
.
বুয়া এসে সকালে সব কাজ করে দিয়েছে।মীরা বসে বসে পরোটা মিস্টি গিলছে।বিয়ের চক্করে ঠিকঠাক খাওয়া হয়ে উঠে নি তার।
ধ্রুভ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে।মীরা খেতে খেতে বিষম খেলো।ধ্রুভ তাড়াহুড়ো করে পানি দিলো।
.
স্কুল থেকে ক্লাস শেষ করে মীরা স্কুলের গেইটে দাড়িয়ে বান্ধবীদের সাথে ফুচকা খাচ্ছিলো।সাথে তার বান্ধবী রুহানি আর সানিয়া ছিলো।তারা তিনজন একসাথে মিলে ফুচকা খাচ্ছিলো।এইটা তাদের ছয় নাম্বার প্লেট ছিলো।
কোথা থেকে ধ্রুভ ভাইয়া গাড়ি নিয়ে এসে ওদের সামনে দাড়ালো।মীরা ধ্রুভকে মনে মনে প্রচন্ড ভালোবাসে কিন্তু ধ্রুভের কাছে পাত্তা পায় না সে কখনোই।যতবারই সে প্রকাশ করতে গেছে উল্টো গালে দাগ করে ফিরে এসেছে অর্থাৎ থাপ্পড় খেয়ে আর কি।ধ্রুভ আসাতে মীরা তাড়াহুড়ো করে ওখান থেকে কেটে পরতে লাগলে ধ্রুভের ডাকে থমকায়।
–‘এই চুন্নি কই যাস হ্যা?।’
মীরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।ক্ষোভ নিয়ে বললো,
–‘আমি মোটেও চুন্নি না।আমি আমার দাদুর বড়লোক পুতিন।’
ধ্রুভ মীরার কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকালো তার দিকে।সেও ট্যারা করে জবাব দিলো,
–‘হ্যা ইব্রাহিম দাদুর বিগড়ে যাওয়া পুতিন।’
মীরা এগিয়ে এসে বললো,
–‘একদম বাটপারি করে মিথ্যা কথা বলবেন না।উল্লুকের নানা।’
ধ্রুভ মীরা চুল টান দিলো।সে বললো,
–‘একদম পটর পটর করবি না।’
মীরা কিছু বলতে যাবে তার আগে দেখে দেখে তার সামনে তারই বান্ধবীর সাথে ধ্রুভ হেসে হেসে কথা বলছে।আর তার বান্ধবী সানিয়া মাঝেমধ্যে ধ্রুভের কথা শুনে তার গায়ে ঢলে পরছে।মনে হচ্ছে,কতই না রসিকের কথা বলছে কিন্তু এই লোক তো আস্ত একটা তিতকুটে করলা।
সানিয়া আবারো ধ্রুভের গায়ে হাসতে হাসতে ঢলে পরে যেতে যেতে বললো,
–‘ওহ ধ্রুভ বেবি ইউ আর সো ফানি।’
এই কথা শুনে মীরার চোখ তো কপালে।তার খুব করে বলতে ইচ্ছা করছিলো যে,
–‘ফানি বলার শখ আজীবনেত মতো ঘুচিয়ে দিব বাটপারের নানী।’
রুহানী বলে উঠলো মীরাকে,
–‘দেখ দোস্ত তোর পছন্দের মানুষের সাথে সানিয়া কেমন করে লেপ্টে পরছে বারবার ওর গায়ের উপর।’
মীরার হাতে মাম পানির বোতল ছিলো।দুই হাত দিয়ে এতো শক্ত করে চেপে ধরেছে মনে হচ্ছে বোতলটায় ধ্রুভ।আর চেপে ধরছে যেন দম ফুরিয়ে যায় ধ্রুভের।বোতল টা নিমিষে বেকিয়ে গেলো মীরার চাপাচাপিতে।
সে তাৎক্ষণিকভাবে চিৎকার দিয়ে উঠলো,
–‘ড্রাইভার!’
ড্রাইভার মীরাদের স্কুলের সামনের স্টলে বসে চা খাচ্ছিলো।মীরার এমন চিৎকার শুনে ড্রাইভারের মুখ থেকে চা বেরিয়ে দোকানির গেঞ্জিতে পরে গেছে।দোকানী রেগে বললো,
–‘তোর মুখের ভিতরে লেওড়া আছে নাকি এইভাবে ফেললি কেন?’
ড্রাইভার কোন জবাব দিতে পারে নাই।সে দৌড় দিয়ে মীরার কাছে আসলো।সে এসেই জিজ্ঞেস করলো,
ধ্রুভকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মীরা ওইখান থেকে গাড়ি নিয়ে কেটে পরলো।ধ্রুভও আর থামে নি,সেও গাড়ি নিয়ে ক্লাবে চলে যায়।
সানিয়া মন খারাপ করে বললো,
–‘দেখ না দোস্ত ও চলে গেলো নাম্বার না দিয়ে।’
রুহানী ভেংচি দিয়ে বললো,
–‘বামুন চাঁদে বাড়াস কেন?’
রুহানীও এই কথা বলে রিকশা ডেকে উঠে চলে গেলো।আএ সানিয়া মনে মনে ভাবছে,’কিভাবে আশরিক আলফাজ ধ্রুভকে পটানো যায়।’
দিন যায়,মাস যায় বছর যায়।মীরা আসতে আসতে বড় হতে থাকে।ধ্রুভকে নানানদিক থেকে নিজের অনুভূতি গুলো বুঝানোর চেষ্টা করেছে মীরা কিন্তু ধ্রুভকে পাত্তা দেয় নি কখনো সে উল্টো ধ্রুভ অন্য মেয়ের সাথে ফ্লাটিং আর টাইম পাস করতে বিজি হলো।
একদিন ধ্রুভের বাহিরে যাওয়া ঠিক হলো।লন্ডনে তাকে পড়তে পাঠাবে আর বাবা।বিলেত ফেরত ছেলের হাত দিয়ে ব্যবসার দায়িত্ব দিয়ে অবসর নিতে চান তিনি।
ধ্রুভের ঘরে যেয়ে মীরা দেখে ধ্রুভ কার সাথে ফোনে হেসে হেসে কথা বলছে।ধ্রুভ দেখলো মীরা এসেছে তার ঘরে তবুও তোয়াক্কা না করে নিজের তালে কথা বলে যাচ্ছে সে।
মীরা কান্না করতে বললো,
–‘ধ্রুভ ভাইয়া আমার কথাটা একটু শুনবে প্লিজ।’
ধ্রুভ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আবারো ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।মীরা ধ্রুভের হাত টানাটানি করতে লাগলো।
ধ্রুভ ফোনের লাইন কেটে মীরার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে তার দুই বাহু ঝাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–‘সমস্যা কি তোর?একটুও শান্তিতে থাকতে দিবি না?মনে হচ্ছে তোর জন্য বাড়িতে আমি দুই দন্ড টিকতেও পারবো না।বাহিরে যাচ্ছি এখন শান্তিতে থাকতে পারবো।’
ধ্রুভ এই কথাগুলো বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে।ধ্রুভের এরকম কথা শুনে মীরা যেন পাথর বনে গেছে।সে আর কোন টু শব্দও করে নি।
দেখতে দেখতে ধ্রুভের যাওয়ার দিন চলে আসলো।সবাই তাকে বিদায় দিতে আসলেও মীরা আসে নি।মীরা শুধু নিজের জানালা থেকে আড়াল হয়ে ধ্রুভের যাওয়ার পথ দেখছিলো।
.
কেটে গেছে পাঁচ বছর,
মীরা অনার্স শেষ করে মাস্টার্সের জন্য ভর্তি হতে হয়েছে।অনার্সে ঢুকে ঢুকে প্রত্যয়ের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়।মীরা বেষ্টফ্রেন্ড হয়ে উঠে প্রত্যয়।ধ্রুভের জন্য নিজের অনুভূতি গুলো কি ছিলো সেটাও জানতো প্রত্যয়।
প্রত্যয় মীরাকে মনে মনে এক তরফা ভালোবাসতে আরম্ভ করে কিন্তু মীরার চোখে প্রত্যয় খুবই ভালো বন্ধু।একদিন প্রত্যয় মীরাকে সাহস করে বলে দেয় নিজের অনুভূতির কথা।তখন মীরা শান্ত স্বরে জবাব দেয়,
–‘আমার দ্বারা ভালোবাসা হয়তো সম্ভব নয় কিন্তু তোকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি।বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিস,তারা যা ডিসিশন নিবে তাই মেনে নিব আমি।’
সেদিন মীরার এরকম জবাব শুনে প্রত্যয় মীরাকে জাপটে ধরেছিলো।মীরার মনে মনে তখনো চলছিলো এই যে,
‘যে তোমার অপেক্ষা করে না,তোমার পথ চেয়ে থেমে নেই তার না বলার শহরের ভিড়ে তোমার থাকার অধিকারও নেই।’
ধ্রুভ লন্ডন যাওয়ার পর হাড়ে হাড়ে টের পায় যে মীরাকে সে কতোটা ভালোবাসে।মীরার প্রতি কতোটা আসক্ত হয়ে গেছে।মীরাকে এমন কোন দিন নেই যে সে মনে করে নি।সে মীরার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলো কিন্তু মীরা সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।
পাঁচ বছর পর যখন সে দেশে ফিরলো।সিদ্ধান্ত নিলো যে মীরাকেই বিয়ে করবে যে করেই হোক তখনই এসে জানতে পারলো মীরার বিয়ে ঠিক।শুনে মেজাজ আরো গরম হয়ে গেছিলো যখন বিয়ের জন্য আসা অতিথি জানিয়েছিলো তাকে যে মীরা রিলেশন করে বিয়ে করছে।তখন তার একটাই ধারনা ছিলো এই যে,
–‘তার কাছে পাত্তা না পেয়ে সে অন্য কাওকে বেছে নিয়েছে’
কিন্তু মীরার বিয়েটা শেষমেশ প্রত্যয়ের সাথে হলো না,তার সাথে হলো।
.
অতীতের স্মৃতি থেকে ফেরত আসলো ধ্রুভ।এতোক্ষন ছাদে দাড়িয়ে সিগারেট ফুকতে ফুকতে চার প্যাকেট শেষ করে ফেলেছে।সে এইসবই ভাবছিলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত দুটো বাজে।নিশ্চয় মীরা একা একা ভয় পাচ্ছে।তাছাড়া, আজকে তার বাসর রাত আর আজকে দেরী করা চলবে না।
ধ্রুভ ছাদ থেকে নেমে ঘরের দিকে রওনা দিলো।ঘরে যেয়ে ধ্রুভ দেখলো মীরা ঘরে নাই।তাড়াতাড়ি করে নিচে যেয়ে দেখলো মীরা বাড়ি থেকে পালাচ্ছে।
ধ্রুভ দৌড়ে যেয়ে মীরাকে নিজের দিকে হ্যাচকা টান মেরে কষিয়ে থাপ্পড় মারলো।মীরা ছিটকে নিচে পরলো মার খেয়ে।এতো ঝটকা খেয়ে মনে হচ্ছে সে কাঁদতেও ভুলে গেছে।
ধ্রুভ তাকে হিড়হিড় করে টেনে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে।লেহেঙ্গার থেকে এখন নিজেকে ভারী লাগছে মীরার।
মীরা বললো,
–‘আমাকে ছাড়েন।আমার প্রত্যয় কে খুজতে হবে।প্রত্যয় আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
ধ্রুভ মীরার মুখে অন্য কারোর নাম শুনে আরো রেগে গেছে।ধ্রুভ মীরার মুখ এনে এতো জোরে চেপে ধরেছে মনে হচ্ছে গাল ভেদ করে আংগুল ঢুকে যাবে।
ধ্রুভ চিৎকার দিয়ে বললো,
–‘প্রত্যয় মারা গেছে।শুনেছিস তুই।কার এক্সিডেন্টে ইন্তেকাল করেছে তোর প্রেমিক।’
ধ্রুভের মুখ থেকে প্রত্যয়ের মারা যাওয়া শুনে মীরা থমকে গেছে।অসাড় হয়ে আসছে শরীর।যা বলছে তা কি সত্যি তবে?
–‘দাদু প্লিজ দাদু।আমি এই বিয়ে করবোনা।কিছুতেই না। প্লিজ দাদু। প্রত্যয় আসবে দাদু। তুমি একটু অপেক্ষা করো প্লিজ দাদু। আমি প্রত্যয় কে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো না। প্লিজ এমন করোনা।আমি মরে যাবো!’
এই টুকু বলেই মীরা কান্নায় ভেঙে পরে। কিন্তু মীরার দাদু এখনো সোফায় মাথা নিচু করে পাথরের মতো বসে আছে। মীরার কথায় উনার কোনো হেলদোল হলোনা।ড্রয়িংরুমে সবাই উপস্থিত। মীরার মা, বাবা, ছোট ভাই, মীরার দাদা,দিদুন, জেঠু, জেঠি এবং তার ছেলে আশরিক আলফাজ ধ্রুভ।
আজ মীরার বিয়ে ছিলো তার ভালোবাসার মানুষের সাথে। কিন্তু বরযাত্রী আর আসেনি। কেনো তা সবারই জানা কিন্তু কেউ বলতে পারছেনা মীরা কষ্ট পাবে বলে। পুরো খান বাড়ী থমথমে কারণ,খান বাড়ীর একমাত্র মেয়ে মীরার বিয়ের দিন আজ। ৮ টা বাজতে চললো,কিন্তু বরযাত্রী এখনো আসেনি। আশেপাশে কানাঘুষা সেই কখন থেকে শুরু।সবাই এই সেই কথা বলছে।
.
আর মীরা নববধূ বেশে সেই দুপুরবেলা থেকে অপেক্ষা করছে তার ভালোবাসার মানুষটির কখন প্রত্যয় আসবে আর তার করে নিয়ে যাবে।
.
কিন্তু না আসেনি প্রত্যয়। না এসেছে কোনো বার্তা তার জন্য। যদিও এসেছে ঠিকি কিন্তু সেটা মীরা জানে না।
.
সত্যি না জানিয়েই তাকে কিছুক্ষণ আগে বলা হয়েছে প্রত্যয় নয় বরং ধ্রুভকে তার বিয়ে করতে হবে।প্রত্যয় বরযাত্রী নিয়ে আর আসবেনা। এই কথা শুনেই মীরা তার দাদুর পা জড়িয়ে কাদঁছে আর উপরের কথা গুলো বলছিলো।মীরা বারবার একই কথা বলে যাচ্ছে।
মীরা আবারো বললো,
–‘দাদু, আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো না দাদু। আর একটু অপেক্ষা করো প্রত্যয় ঠিক আসবে আমায় নিতে প্লিজ দাদু।’
.
এসব বলে গুমরে কাঁদছে মীরা। মীরার দাদু এতোক্ষন চুপ করে থাকলেও এবার মীরার গালে সজোরে একচড় বসিয়ে দেয়।
মীরা চুপ হয়ে একদম স্তব্ধ হয়ে যায়।তার দাদু তাকে মেরেছে তা বিশ্বাস হচ্ছেনা মীরার। সাথে সাথেই দাদুর পা ছেড়ে দেয় মীরা।মীরা বুঝে যায় ধ্রুভ কেই বিয়ে করতে হবে তার। ধ্রুভ চোখ বন্ধ করে বসে থাকে ফ্লোরে।
.
মীরার দাদু চড় দিয়ে বুকে হাত দিয়ে বসে থাকে। তিনি যে নিজের কলিজাতেই হাত উঠিয়েছেন আজ। এই সব দেখে জেঠু কেঁদে উঠে।
মীরার বাবা চুপ করে মাথা নুইয়ে বসে আছেন। মীরার মা সে কখন থেকেই অজ্ঞান। মীরার জেঠি মীরার মার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।
মীরার দিদুন চোখ মুছছে বারবার নিঃশব্দে। আর ধ্রুভ একনজর এ মীরার দিকে তীক্ষ্ণ ও অগ্নিময় চোখে তাকিয়ে আছে।চোখ দিয়েই মীরা কে ঝালা ফালা করে দিচ্ছে ধ্রুভ। কিন্তু মুখ চোখ তার নরমাল কিন্তু চোয়াল শক্ত করে রেখেছে সে।
.
এক্টু পড় নিজেকে শক্ত করে মীরার দাদু ইব্রাহিম খান। তারপর চেঁচিয়ে উঠে,
–‘ এভাবে মরা কান্না না করে যা ভেতরে কাজী ডাক এখুনি বিয়ে হবে।মীরার সাথে ধ্রুভের।’
.
ব্যস আর কারো কথায় পাত্তা নেই। উনার দুই ছেলে চট জলদি উঠে দাঁড়ায়। মানে মীরার জেঠু আর বাবা।
উনারা কাজী ডেকে ভেতরে আনেন। যিনি প্রায় ৮ ঘণ্টা ধরে বিয়ে পড়ানোর জন্য অপেক্ষা করছেন। আর কাজীকে ভেতরে আসতে দেখে মীরা। তার দামী ও ভারী লেহেঙ্গা টা হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে।কিন্তু আর কিছুই বলতে পারেনা মীরা। না কান্না করে সে কেনো করবে প্রত্যয় নিজেই তো আসেনি তাকে নিতে।তাহলে আর কেনো কান্না করবে আয়াত?অভিমানে মীরা গুম মেরে গেলেও মন মানছেনা কিছুই।
.
আর কোনো কথা হয়না ড্রইং রুমে। শুধু বিয়ে পড়ানো হয়। মীরা আর ঝামেলা করেনা কবুল বলে দেয়। কিছুই করার নেই যেখানে সেখানে কি ঝামেলা করবে সে?
.
বিয়ে পড়ানো শেষ হলে কাজী চলে যায়। আর মীরার দাদু ইব্রাহিম খান ধ্রুভ কে নিজের কাছে বসিয়ে বলে উঠে,
— ‘মীরা খান বাড়ীর সবার কলিজা।তুমি তা জানো,কিন্তু তুমি ওকে কতোটুকু ভালোবাসো জানিনা। কিন্তু আজ থেকে ওর সব দায়িত্ব তোমার। আশা করি তুমি সব ভুলিয়ে দেবে তাকে। নতুন করে গড়বে সব!’
.
ধ্রুভ মন দিয়ে দাদুর কথা গুলো শুনে তারপর বলে উঠে,
–‘জ্বী দাদু আমি চেষ্টা করবো।’
.
ইব্রাহিম খান নাতির কাধে হাত রেখে বলে উঠে,
–‘ চেষ্টা না আমি জানি তুমি পারবে।এখন যাও তাহলে তুমি তোমার বৌ নিয়ে যাও ভেতরে। সামলাও ওকে। সবার অবস্থা বুঝতেই পারছো?’
.
ধ্রুভ মাথা দুলিয়ে বলে উঠে,
–‘দাদু তুমি বললে আমি ওকে আমাদের বাগান বাড়ীতে নিয়ে যেতে চাই। দু একদিন এখানে না থাকাই ভালো ও স্পেস পাবে। তুমি বললে নিয়ে যাবো।’
.
ইব্রাহিম খান কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
–‘ তুমি একদম ঠিক বলেছো। যাও ড্রাইভার পৌঁছে দিবে তোমাদের। সাবধানে থেকো।’
.
ধ্রুভ আস্তে করে বললো,
–‘ জ্বী দাদু!’
.
বলেই ধ্রুভ উঠে মীরার কাছে যায়। মীরাএখনো ফ্লোরেই বসে। ইভেন এই ফ্লোরে বসেই মীরা কবুল বলেছে। নিজেকে ধ্রুভের সম্পত্তি বানিয়ে দিয়েছে। ধ্রুভ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মীরার দিকে তারপর হাত ধরতে গেলে,মীরা উঠে দৌড়ে চলে যেতে নেয় কিন্তু ধ্রুভ মীরার হাতের কব্জি টেনে ধরে ফেলে। মীরা এবার চুপ থাকতে পারেনা। এতোক্ষণ সবই শুনেছে মীরা কিন্তু সে যেতে চায় না কোথাও তাই কাঁদতে কাঁদতে বলে,
–‘প্লিজ দাদু, আমি যাবো না। আমার প্রত্যয় কে খুঁজতে হবে। প্লিজ আমি কোথাও যাবো না দাদু। আমায় পাঠিয়ো না।কেনো এসব করছো আমার সাথে তোমরা।’
.
মীরা এসব বিলাপ বকছে। ধ্রুভ তার চোয়াল আরো শক্ত করে। রাগে গাঁ ফেটে যাচ্ছে তার কিন্তু কিছু বলে না। সে অপেক্ষা করছে অন্য কিছুর। মীরা নিজের হাত ধ্রুভের থেকে ছাড়াতে ছোটাছুটি করছে।কিন্তু ধ্রুভ হাত না ছেড়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
.
কিন্তু এসব দেখে ইব্রাহিম চৌধুরী প্রায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে,
–‘ধ্রুভ নিয়ে যাও ওকে।ভালোভাবে না গেলে অন্য ভাবে নিয়ে যাও।’
.
মীরা আবারো দাদুর চিৎকার এ আঁৎকে উঠে আর ভয়ে মীরার হাত গিয়ে চেপে ধরে। আর ধ্রুভ বাঁকা হাসে। সে তো এই চিৎকার টা শুনার অপেক্ষা করছিলো। এই চিৎকার কানে যাওয়ার ১০ সেকেন্ড পরই মীরাকে কে পাজা কোলে তুলে নিয়ে হাটা দেয় ধ্রুভ। আর মীরার কিছু করার নেই তাই ধ্রুভের বুকে পরেই কাঁদতে থাকে ফুঁপিয়ে। মীরার বিদায় এভাবেই হয়ে যায়। তার বাবার বাড়ী থেকে।
.
আর ধ্রুভ হাটছে আর মনে মনে বলছে
–‘ তুমি ভাবতেও পারবেনা দাদু আজ আমি তোমার কলিজার টুকরার সাথে ঠিক কি কি করবো। গেট রেডী মীরা বেবি।তোকে আজকে আমাদের বিয়ের দিনে তোর লাইফের সব চেয়ে বড় গুড নিউজ টা দেবো’
বলেই বাঁকা হেসে মীরার দিকে তাকায় ধ্রুভ।
.
ওরা খান বাড়ীটা থেকে বেরিয়ে যেতে। ইব্রাহিম খান কেঁদে দেয়। আজ ফুলের মতো বাচ্চাটার গায়ে তুলেছেন তিনি। বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে তার। অধিক রাগের অধিকার ইব্রাহিম খানকে পুরো শহর এখনো ভয় পায়। সাথে তার পুরো পরিবার। তিনি যেমন রাগি তেমনি বদমেজাজি তেমন নরম মনের। উনার এক কথায় শেষ কথা। উনার উপর কেউ কথা বলেনা। বয়স বাড়লেও এখনো ফিট তিনি। ছেলেরা বড় হয়েছে বাবা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনো বাবার কথাই উঠতে বসতে হয় তাদের। আর উনি নিজের কলিজা ভাবে মীরাকে। আর আজ মীরার উপর হাত উঠিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। মীরারা বেরিয়ে গেলেই, তিনি কেঁদে সোফায় শুয়ে পড়ে। উপস্থিত সবাই এসে উনাকে ধরে। আর ডক্টর ডাকে কারণ অবস্থা খারাপ উনার।
.
.
এদিকে ধ্রুভকে ড্রাইভার পৌঁছে দেওয়ার কথা থাকলেও,ধ্রুভ নিজেই ড্রাইভ করছে। পাশেই মীরা এখনো কাঁদছে। কিন্তু তাতে বিন্দু পরিমাণ ভ্রুক্ষেপ দেখাচ্ছেনা ধ্রুভ। সে সিগারেট খাচ্ছে আর আপন মনে।আর ড্রাইভ করছে।আর বারবার মীরাকে তাচ্ছল্য ভাবে দেখছে। যেমন মীরার কান্নায় ধ্রুভের মনে পৈশাচীক আনন্দ পাচ্ছে। ধ্রুভ মনে মনে আবারো বলে,
–‘আজ সারারাত তোর এভাবেই কাঁদতে হবে মীরা। আজকের রাত যে তুই ভুলতে পারবিনা কোনো দিন। আমি ভুলতে দেবোনা কিছুতেই না।’
.
.
ঘণ্টা খানেক বাদে ধ্রুভদের দামী কার টা তাদের নিজস্ব বাগান বাড়ীতে থামে। মীরা কেদেই যাচ্ছে।এখনো থামেনি।
ধ্রুভ বিরক্তিকর স্বরে বলল,
–‘ প্লিজ এই ড্রামা স্টপ কর!আর নাম এসে পরেছি।’
.
মীরা ভাবছে কার সাথে বিয়ে হলো তার? যে কিনা টানা ৫ বছর পড় লন্ডন থেকে এসেও মীরার সাথে একবারো কথা বলেনি।
মীরা বুঝতে পারে ধ্রুভ তাকে সহ্য করতে পারেনা, কিছুতেই না। তাই তো দূরে দূরে থাকে দেশে আসার পর থেকে।আর তার সাথেই দাদু তার বিয়ে দিয়ে দিলো। ভেবেই মীরা আরো কান্না বাড়িয়ে দেয়।
.
ধ্রুভ রেগে কার থেকে নেমে। মীরাকে এক প্রকার টেনে কার থেকে নামায়। তারপর টেনে হিঁচড়ে বাড়ীর ভিতরে নিয়ে যায়।
.
মীরার অবস্থা খারাপ। লেহেঙ্গা এতো ভারী যে তার হাটতেও কষ্ট হচ্ছে, তার উপর ধ্রুভ তাকে টেনে হিঁচড়ে এক প্রকার দৌড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মীরা বারবার লেহেঙ্গায় পা বেধে পড়ে যাওয়ার অবস্থা।
পায়ে ইতিমধ্যে ব্যাথা অনুভব করছে মীরা। চিৎকার করে কাঁদছে সে।
.
অবশেষে ধ্রুভ তাকে একটা রুমে এনে ধাক্কা দিয়ে বেডে ছুড়ে ফেলে। বেচারি পরে রয় আর উঠতে পারেনা। অনেক ক্লান্ত মীরা
আর কত?প্রায় ১ সাপ্তাহ ধরে বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত সে। তার উপর আজ বিয়ের দিন বিদায় খাওয়াদাওয়া বন্ধ প্রায় টাইম কই এতো খাওয়ার?? তাও সারাদিন একটার পর একটা ঝটকা আর কত নিবে মীরা। আর না আছে শরীরে শক্তি না আছে মনে! তাই চুপচাপ এমনি পড়ে থাকে নরম তুলতুলে বেডে।
.
ধ্রুভ আবারো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মীরার দিকে। তারপর বেরিয়ে যায় রুম থেকে সে। ছাদে চলে যায় ধ্রুভ।
.
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে একটা সিগারেট ধরায় সে। তারপর দু তিনটা টান দিয়ে,নিজে নিজেই বলে উঠে সে
–‘কেনো বদলে গেলি তুই মীরা। সব ভুলে গেলি তুই স্বার্থপর মেয়ে। আমার কাছে পাত্তা না পেয়ে প্রত্যয় কে বেছে নিলি?? তাহলে আমায় পাগল করলি কেনো??”
.
ধুভ অতীতে ডুব দেয়। সেই দিনে যেদিন থেকে মীরার পাগলামি দেখেছিলো ধ্রুভ।
.
.
চলবে
‘তুই’
#তৃধা_মোহিনী
|পর্ব এক|
কেমন লাগছে জানাবেন।ভুলগুলো ধরিয়ে দিবেন।গল্প যেহেতু বড় করে চাচ্ছেন দুইদিন পর পর দেয়া হবে।ধন্যবাদ।
আমার কথা শুনে রায়ান ভাইয়া কিছু না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
তারপর আমি উনাকে দিশার ব্যপারে সবকিছু খুলে বললাম। তিয়াস কাউকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিলো এটা শুনে রায়ান ভাইয়া রীতিমতো হতবাক।
তারপর আমি দিশার ফোন নাম্বারটাও নিয়ে নিলাম আর উনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বাসায় চলে আসলাম।
রাতের দিকে আমি দিশাকে ফোন করলাম। ফোন রিসিভ করতেই আমি আগে আগে বললাম,
___ দিশা আমি প্রীলিয়া, ওই যে একদিন দেখা করতে এসেছিলে।
___জ্বী আপু। চিনতে পেরেছি, কিন্তু আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়? আপনার সাথে দেখা হওয়ার সময় আমি আমার ফোন নাম্বার দিয়েছি বলে মনে করতে পারছিনা।
___দিশা আজ সকালের দিকে একজন ভদ্রলোক তোমার থেকে একজনের খবরাখবর জানতে ফোন নাম্বার আর আইডি একাউন্ট এনেছিল মনে আছে?
দিশা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
___ ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ উনি তো আমার চাচি মানে লায়লা আফরোজের বিষয়ে কিছু জানতে এসেছেন, কিন্তু সময় ছিল না বলে পরে জেনে নিতে আমার থেকে যোগাযোগের মাধ্যম সংগ্রহ করেছেন।
আমি গলা ঝেড়ে আস্তে আস্তে বললাম,
___আচ্ছা উনি কোথায় এখন?
তারপর দিশা যা বললো তা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। স্তব্ধ হয়ে শুনেই যাচ্ছিলাম। তারপর লাইনটা কখন কাটলাম সেটাই টের পাইনি, তবে আমার হাত পা যে কাঁপছে সেটা স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম।
পরেরদিন রায়ান ভাইয়াকেও বিষয়টা জানালাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম সামনে শুক্রবার তিয়াসকে নিয়ে আমরা ওখানে যাবো।
‘
‘
তিয়াসকে যাওয়ার কথা বলার পরে সে কোনো মানা করেনি। কিন্তু সে বুঝতে পারছেনা তাকে কোথায়, কেন আর কিসের জন্য নেওয়া হচ্ছে।
আমরা গাড়ী নিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে নামলাম। তিয়াস এখান থেকে নেমে চারপাশে তাকিয়ে ভেজা চোখে আমাকে লক্ষ্য করে বললো,
___প্রীলি তুমি আমাকে শাস্তি দিতে চাও? আইনের হাতে তুলে দিতে চাও? তাহলে আমাকে সেখান থেকেই একবার বলতে পারতে, আমি মা’কে বলে আসতাম। সত্যি বলছি আমি পালাতাম না। কিন্তু তুমি..
আমি ধমকের সুরে বললাম,
___চুপ করে ভেতরে আসো। যা ভাবছো তার কিছুই না।
রায়ান ভাইয়া সামনে সামনে যাচ্ছে আর আমি তিয়াস পেছনে পেছনে ভেতরে যাচ্ছি।
ভেতরে গিয়ে তিয়াসের সামনেই রায়ান ভাইয়া সেখানকার ডিউটিরত অফিসারকে নিজের পরিচয় দিলেন এবং বললেন,
___ আমরা লায়লা আফরোজের সাথে দেখা করতে চাই, আপনি সেটার অনুমোদন দিতে পারবেন?
রায়ানের কথার প্রতিত্তোরে সেই অফিসার ফাইল ঘেঁটে বললেন,
___সরি স্যার,আমরা এই অনুমতি ইতোমধ্যে দিতে
পারবোনা। এই কেসের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। উনার সাথে কাউকে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দেওয়ার আদেশ আমার উপর নেই। কারণ উনি কোনো সাধারণ অপরাধী নন।
রায়ান ভাইয়া মাথা নেড়ে কাকে যেন ফোন লাগালেন, আর এক মিনিটে পরে সেই অফিসারের নাম্বারে ফোন আসলো আর তিনি সাথে সাথে বললেন,
___ডিসি স্যার বলেছে আপনাদেরকে ১০ মিনিট সময় দিতে। আপনারা দেখা করুন।
বলেই তিনি আরেকজন পুলিশকে বললেন আমাদেরকে ভেতরে নিয়ে যেতে।
তিয়াস চোখ বড় বড় করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সে এতক্ষণে বুঝে গেছে আমরা কোন লায়লা আফরোজের কথা বলছি, কিন্তু তার কথা বলার শক্তি লোপ পেয়েছে এবং সে হাঁটতে পারছেনা, কেমন যেন উদাস দেখাচ্ছে তাকে।
রায়ান হাত দিয়ে টেনে টেনে তিয়াসকে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। হাঁটার মধ্যে তিয়াস দুলছিল। তারপর আস্তে আস্তে আমরা শিকের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার আগেই পরিশ্রান্ত, শুকনো মুখো, রোগা শরীরের একজন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
আমি তিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___উনিই সেই লায়লা আফরোজ, যাকে ভালোবেসে তোমার ছোট পাপা আত্মহত্যা করেছিলো।
তিয়াস এতক্ষণ স্বাভাবিক ছিল, হঠাৎ করেই সে সেটার বাইরে থেকে হাত বাড়িয়ে গর্জন করে করে বলতে লাগলো,
___তুই, তুই? তোর জন্যই তো আমার ছোট পাপা মারা গেছে, মনে আছে জুলহাজ হাবিবের কথা? উনি আমার চাচা হন। যাকে তুই আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছিলি। আমি নিজ চোখ উনাকে মরতে দেখেছি! আর তাই তোকে আমি নিজ হাতে মারতে চাই। নিজ হাতে!
ভয় পেয়ে উনি একপাশে গিয়ে জুবুথুবু হয়ে তাকিয়ে আছেন। পেছন থেকে রায়ান আর একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
সবাই মিলে তিয়াসকে বাইরে আনলাম। এক বোতল পানি হাতে দিলাম, তিয়াস ঢকঢক করে সবটা পানি খেয়ে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। রায়ান ভাইয়া আস্তে আস্তে বললো,
___তিয়াস শান্ত হও। যারা অপরাধী তারা ঠিকি শাস্তি পায়, আগে হোক কিংবা পরে। উনি উনার স্বামীকে নিজ হাতে খুন করে গুম করে রেখেছিলেন ৯ দিন। খুন করার কারণ ছিল তিনি নিজের স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সাথে পরকীয়ায় ছিলেন, যার জন্য তার স্বামী জবাবদিহিতা চেয়েছেন। প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হলেও শেষ পর্যন্ত উনি খুনের মতো একটা জঘন্য অপরাধও করেছেন, সেটাও নিজ হাতে। তবে খুন উনি বহু আগেই করেছেন, কিন্তু পরোক্ষভাবে ছিল। তোমার চাচা জুলহাজ হাবিবকে উনিই মরতে বাধ্য করেছিলেন। আমি তোমাকে নিয়ে এখানে এসেছি কারণ আমি চাই তুমি সেই আত্মহত্যার বিষয়টাও আদালতে তুলো, উনার কঠিন শাস্তি দাবী করো। এমনিতেও উনার ফাঁসি না হলেও যাবৎজীবন কারাগারে থাকার দন্ড ঠিকি হবে।
তিয়াস কেমন যেন স্বচ্ছ একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। সেই নিঃশ্বাসে ছিল এক আকাশ প্রশান্তি। সে হাসছে, অযথা পাগলের মতো হাসছে। আমি আর রায়ান অবাক হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।
তারপর তিয়াস হুট করেই উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
___প্রীলি এখন আমাকেও পুলিশে ধরিয়ে দাও প্লিজ। আমিও তো অনেক অপরাধ করেছি। তোমার সাথে করেছি, দীপ্তির সাথে করেছি, আরো অসংখ্য মেয়ের সাথে করেছি। আমি এবার শাস্তি পেলেও, এমনকি মৃত্যু এলেও একটুও কষ্ট পাবোনা। আমি আমার ছোট পাপাকে বলতে পারবো, দেখো তোমার খুনি আজ শাস্তির অভিমুখে দাঁড়িয়ে আছে, সেও তিলে তিলে শূন্য হয়ে মরবে, তুমি খুশি তো ছোট পাপা?
তোমার খুশিতেই তো আমি খুশি!
এর মধ্যে পেছন থেকে একটা হর্ণ বাজলো । আমি তাকিয়ে দেখলাম দিশা এসেছে।
তিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___তিয়াস, দিশা লায়লা আফরোজের ভাসুরের মেয়ে। তিনি যেমন তোমার চাচাকে মেরেছে, এমনভাবেই তার চাচাকেও মেরেছে। দিশা তোমাকে ভালোবাসে , সেদিন ফোনে আমাকে সব বলেছিলো।কিন্তু সেটা আমি আগে ভয়ে বলিনি, কারণ তুমি যদি জানো লায়লা আফরোজের সাথে ওর কোনো সম্পর্ক আছে তাহলে আরো রেগে যেতে পারো। কিন্তু এটা তো সত্য তুমি তার জীবনটাই বদলে দিয়েছো, তাকে সুন্দর করে বাঁচতে শিখিয়েছো, তাই তোমার প্রতি তার সম্মানবোধের সিমান্তটা অনেকদূর । তুমিই বলো যে সম্পর্কে সম্মানবোধ বেশি সেই সম্পর্কটাই সুন্দর না? আর দিশার রক্তে লায়লা আফরোজের কোনো ছিঁটাও নেই, সেও ঠিক তোমার মতো! তাই তুমি দিশাকে বিয়ে করো, আমি জানি তুমি চাইলেই একদম ঠিক হয়ে যাবে, সবার মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে, দিশা তোমার পাশে থাকবে। আর দেখো যেটাতে বহুবছরের ঘৃণা ছিল, সেটা কিন্তু ভালোবাসা নয় বন্ধুত্বে রূপ নিতে পারে। আমি আর রায়ান ভাইয়া সবসময় তোমার সাথে বন্ধুর মতো থাকবো।
তিয়াস হেসে বললো,
___দিশা তুমি আমাকে কেন বলোনি? আর প্রীলি তোমার কি মনে হচ্ছে আমি এখনো ঠিক নেই? আমি তো শাস্তির দরজায় সেই পাপী মুখটা দেখার পরেই নিজের পাপগুলির প্রায়শ্চিত্ত করে ফেলেছি, আমি টের পেয়েছি আমিও এতদিন ভুল করেছি। এগুলো করা আমার উচিত হয়নি। আমার আজ ভীষণ ভালো লাগছে!
দিশা এগিয়ে এসে তিয়াসের আঙুল আঁকড়ে দাঁড়ালো। এটা দেখে আমি আর রায়ান ভাইয়াও কাছাকাছি ঘেঁষে একটু হাসলাম।
সব শূন্যতা আজ পূরণ হয়েছে, বদল হয়েছে অস্তিত্ব! সত্যি আমরা চাইলেই অস্তিত্বের রূপভেদ করে আবার নতুন অস্তিত্বে বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু শূন্যতায় নিজেকে ঠেলে দিয়ে জীবন মরণের প্রশ্নতে আকিঁবুকিঁ টানি! যা নিঃসন্দেহে মারাত্মক ভুল এবং তাতে আমাদের সুন্দর জীবনের ক্ষতি ছাড়া কিছুই পাওয়া সম্ভব হয়না।
‘
‘
১১ মাস পরের কথা।
গতকাল থেকে বাড়িতে ঈদের আমেজ। কারণ আমার সারাজীবনের স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। আমার বাবা গ্রামের সবাইকে বিরিয়ানির দাওয়াত দিয়েছেন, মসজিদে মিলাত পড়িয়েছেন। বাবা মা দাদুর মুখ থেকে হাসির রেখাটা যেন থামছেইনা।
অন্যদিকে আমি রায়ান ভাইয়ার ব্যপারেও সব জানিয়েছি।
আজকে উনাদের বাসা থেকে মানুষ আসছে, আংটি পরিয়ে বিয়ের তারিখ পাকা করবে।
রায়ান ভাইয়ার কথামতো আজকে উনার পছন্দের একটা শাড়ী পরেছি।
উনার মা-বাবার সামনে বসে আছি, এদিকে উনি উনার বোনকে এগিয়ে আনতে আমার বাড়ির পেছনের রাস্তায় আগাচ্ছেন। উনারা একসাথে মিলিয়ে আসতে পারেননি কারণ উনার হাসবেন্ড চাকরির ডিউটি থেকে সোজা এখানে আসতে হচ্ছে।
এদিকে রায়ান ভাইয়ার মা আমার সাথে কথা বলছেন। বাবা কোনো একটা কাজে এদিকে আসছিলো। তখনই আমি কোনো একটা প্রসঙ্গ তুলে বললাম,
___ হ্যাঁ বিয়ের পরে আমার পরিবার আমার সাথেই থাকবে। আমরা সবাই মিলেমিশে থাকবো।
আমার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই রায়ান ভাইয়ার মা-বাবা একে অপরের দিকে তাকিয়ে উনার মা বললেন,
___সে-কি উনারা তো এখানেই ভালো আছেন। তাছাড়া গ্রাম থেকে গিয়ে শহরে খাপখাওয়াতে পারবেন না। এসব ঝামেলা না?
আমি টের পাচ্ছিলাম আমার পুরো রক্ত মাথায় চড়ে উঠেছে। তারপরও কিছুটা শান্ত গলায় বললাম,
___ আমি উনাদের এবং আপনাদেরকে নিয়েই একসাথে থাকতে চাই। তাছাড়া আমি তো..
আমি কথাটা বলার আগেই বাবা সেখান থেকে একদৌড়ে ভেতরে চলে গেলেন। আমি উনাদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা রাগ মিশ্রিত চেহেরায় বললাম,
___ আমি যেখানেই থাকবো আমার পরিবার নিয়ে থাকবো। আপনারা রাজী না হলে বিয়ে বাতিল করে দিতে পারেন। আমি এতে কোনো পরোয়া করিনা। কিন্তু আমার বাবা-মা কিংবা পরিবার কখনো কষ্ট পেলে সেটাকে বরদাস্ত করবোনা। আজকের আমিটাকে গড়তে গিয়ে আমার বাবার রক্ত পানি হয়েছে, চামড়া পুড়েছে, হাতে পায়ে ফোসকা পড়েছে। আর সেগুলোকে আস্তে আস্তে আমিই সারিয়ে নিবো, এবং সেই দায়িত্ব আমারই!
আমি কথা না বাড়িয়ে বাবার পেছন পেছন ছুটলাম।
গিয়েই দেখি বাবা বসে কাঁদতেছে। আমাকে দেখতে পেয়েই উনি চোখের পানি আড়াল করে আস্তে আস্তে বললেন,
___লিয়া মা তুই এখানে? দেখ সব মেহমান বোধহয় চলে আসছে। তুই যা মা।
আমি বাবার পাশে বসে কেঁদে কেঁদে বললাম,
___ আমি সব ছেড়ে দিতে রাজী বাবা। দুনিয়ার সবকিছুর বিনিময়েও আমি তোমাদের চোখের পানি সহ্য করতে পারবোনা। দরকার হলে সারাজীবন বিয়ে বিহীন কাটিয়ে দিবো। বাবা বিশ্বাস করো তোমরা থাকলে আমাকে কোনো শূন্যতা ঘিরতে পারবেনা, আমি নিজেকে হাজারবার সার্থক ভাব্বো নির্দ্বিধায়। বাবা তুমি বিয়ে ভেঙে দাও। যেখানে তোমাদের অস্তিত্ব মূল্যহীন করবে সেখানে আমি সবকিছু পেয়েও শূন্য হয়ে যাবো বাবা। আমি বিয়ে করবোনা!
বাবা ডুকরে কেঁদে উঠলেন আর মাথায় হাত রেখে বললেন,
___লিয়া, বাবা মায়েরা সন্তানের সাফল্যেই খুশি হয়। তারা আর কিছুই চায়না। আমরা তো এখানে বেশ আছি, আর থাকবোও। তোর বাবা সারাজীবনের কষ্টের প্রতিদান পেয়েছে এটাই কম কি বল? লোকে আমাকে শ্রদ্ধা করবে, তারা আমাকে দেখিয়ে কাউকে অনুপ্রেরণা দিবে, তোর নাম করে নিজের সন্তানের ভেতর স্বপ্ন জাগাবে, এর বেশি একটা বাবার কি চাওয়া থাকে বল তো? এখন তোর দাদুকে শেষ পর্যন্ত যত্ন করে দিতে পারলেই আমার আরেক সার্থকতা নিহিত হবে। তারপর তোর ভাইটা যদি কোনো একটা ধারায় যায় তাহলে তোর মা আর আমি টেনেটুনে সুন্দর চলে যাবো।
আমি বাবাকে চুপ করিয়ে বললাম,
___ বলছিনা আমি কোথাও যাবোনা। গেলে তোমাদের নিয়েই যাবো। এতদিন তুমি আমাকে একটু একটু করে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছো, এবার আমিও সযত্নে তোমাদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আগলে রাখবো। আমি বিয়ে করবোনা বাবা।
তখনই দরজার ওপাশ থেকে রায়ান ভাইয়ার গলা শুনে ফিরলাম। উনি বলছে,
___প্রীলিয়া তুমি আমার মায়ের কথা শুনে বিয়ের ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছো? একবারও আমাকে জিজ্ঞাসা করলেনা আমি কি চাই? আরে আমি তো তুমি না বললেও তোমার বাবা মাকে নিজের
মা বাবার মতো আগলে রাখতাম। তাদের জন্যই তো আমি তোমাকে পেয়েছি। আর এই যে আমার মা। আচ্ছা আম্মু বলোতো তুমি আমাকে এই আশাতেই এতদূর এনেছোনা? যে একসময় তোমার ছেলে তোমাদের দায়ভার কাঁধে নিবে, তোমাদেরকে যত্ন করবে। তেমন তো প্রীলিয়ার মা -বাবাও করেছে। সে একটা মেয়ে বলে নিজের বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখতে পারবেনা? মেয়েরা কি দায়িত্ব নিতে জানেনা?
সব মা-বাবা সন্তানের সুখে সুখ পেলেও তারা তাদের গড়ে তোলা সন্তানের থেকে শেষ পর্যন্ত ভরসা চায়। তাদের কাছে থেকে, আদর যত্নে নিজের শেষ সময়টাও সুন্দর দেখতে চায়। তুমি এটা কেন বললে মা?
রায়ান ভাইয়ার মা কিছুটা নরম স্বরে বললেন,
___রায়ান আমি আসলে বুঝতে পারিনি। আমার ভুল হয়ে গেছে, সত্যিই কথাটা ভীষণ খারাপ ছিল! লিয়া তুমি আমাকে..
আমি এগিয়ে উনার হাতে ধরে অল্প হেসে বললাম,
___ আরে না না আপনি একি করছেন? তাছাড়া আমার মা বাবার সাথে মিশে দেখুন, তারপর উনাকে বেড়াতে আসতেও দিতে চাইবেন না!
বাবা এবার একটু হাসলেন। মা কাজ সামলে এসে বুঝতে পারলেন না, এখানে কি হয়েছে! বাবা ইশারা করছে যেন না বলি। আমিও মাথা নাড়লাম।
বিয়ের তারিখ পাকা হয়ে গেলো।
কয়েকদিনের মধ্যে বিরাট আয়োজনে বিয়েটাও হয়ে গেলো। বিয়ে পড়ানো শেষ হলে যেখানে মেয়েরা একা তার শ্বশুর বাড়ি যায় সেখানে আমরা পুরো পরিবার যাচ্ছি। বড় দেখে নতুন একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি।
গাড়ীতে বসে আমি উনার কাঁধে মাথা রাখলাম। উনি আস্তে আস্তে মাথায় হাত রেখ বললেন,
___ প্রীলিয়া আমাদের দুজনের মধ্যকার অস্তিত্বটা আজ একরকম। এখানে তো আর কোনো শূন্যতা নেই তাইনা?
আমি মুচকি হেসে বললাম,
___ উমম!এখানে আর কোনো শূন্যতা নেই, যা আছে সব পূর্ণতা! এভাবেই মিশে থাকবো আমরা । তবে আপনাকে মাঝে মাঝে ভাইয়া ডাকবো, রাগ করবেন না কিন্তু!
উনি আমার কথা শুনে রাগী চেহেরায় অদ্ভুতভাবে হেসে জড়িয়ে ধরলেন!
(সমাপ্ত)
”গল্পটা পড়তে অনেকেরই ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিলো। এরপরও যারা পাশে ছিলেন সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ! ভালো খারাপ মিলিয়েই জীবন, আর রচিত হয় জীবনের গল্প।
তাই ভালো খারাপ মিলিয়েই গল্পটা নিয়ে মতামত জানাবেন। ভালোবাসা অফুরান!:)
সবকিছুর পরে আমি বুঝতে পারলাম সত্যি তিয়াস এসব নিজের বশে করছে না। তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া কি যুক্তির হবে? এদিকে নুজহাতের সাথে সে কোনো খারাপ করেনি, যা করেছে আমার সাথে করেছিল এবং আমার মতো আরো অসংখ্য মেয়ের সাথে করেছিল। কিন্তু তিয়াস বলছে সে যাদের সাথে প্রতারণা করেছে সবাই-ই উঠে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে তার মা উপায়ন্তর না পেয়ে নিজেই ছেলের শাস্তি দাবী করছেন। এতে কি সে কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারে? তার শাস্তি দেওয়া যেতে পারে তবে সেটা স্বাভাবিক মস্তিষ্কের দ্বারা যদি আবার ভুল হয়। এখন তিয়াসের কথার যেমন যুক্তি নেই, ওর মায়ের কথারও যুক্তি নেই। আগে ওর চিন্তা শক্তি কিংবা প্রতিশোধের ঘোর থেকে মুক্তি লাভ দরকার।
এখন এসব বাদ দিয়ে অন্য উপায় বের করতে হবে।
দুইদিন পরে হঠাৎ করেই রায়ান ভাইয়ার দেখা মিললো। রায়ান ভাইয়া বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। উনাকে দেখার সাথে সাথে আমি এক দৌঁড়ে নিচে গেলাম। উনি অপরাধবোধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কাছে গিয়েই আমি রেগে বললাম,
___ কি সমস্যা আপনার? আমার সাথে থাকতে বলেছিলাম তো। কিন্তু আপনি সেই যে ওখান থেকে উধাও হলেন আর খবর নেই। অন্যদিকে আমি দীপ্তিকে ফোন করেও কথাটা জিজ্ঞাসা করার সাহস পাইনি। আমি ফোন দিলে সে ভাবতে পারে, না জানি আমাদের মধ্যে কি আছে,কি হয়েছে, কি কারণ, নাকি আপনি পাত্তা দেন না,আরো কতো রকম চিন্তা।তাই দেওয়া হয়নি। এখন বলেন কোথায় ছিলেন? আর কেন উধাও হলেন?
___প্রীলিয়া আসলে তিয়াসের কথাটাই সত্যি। আমি ভেবেছিলাম তুমি ওর কথা শুনে ওকে ফিরিয়ে নিবে। আমি সেখানে বসে বসে কথাগুলো নিতে পারছিলাম না। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। আমার মনে হচ্ছিলো আমি থাকলে তুমি আমার দিকে করুণা করে তাকাবে, দু-টানায় পড়ে যাবে। তাই আমিই সরে আসতে চেয়েছিলাম। বিশ্বাস করো এই কয়দিন আমি নিজের উপর সম্পূর্ণ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমার মধ্যে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই, যা আছে তা শুধুই তোমার অস্তিত্ব, আমি ছটপট করছিলাম কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আর বুঝাতেও পারছিলাম না।
___ কি বলছেন এসব? আপনি তিয়াসের ওইসব কথা শুনে চলে আসলেন। আরে আপনি তিয়াসের ব্যপারে কি জানেন? এদিকে আসেন সবকিছু বলছি।
তারপর আমি তিয়াসের মা যেসব কথা আমাকে জানিয়েছিল সবকিছু বললাম। রায়ান ভাইয়া অনেক্ষণ ধরে হা হয়ে শুনছিলেন। তারপর অবাক স্বরে বললেন,
___ তুমি বলতেছো তিয়াসের মা নিজে বলেছে তার মাথায় সমস্যা? কিন্তু প্রীলিয়া তুমি জানো তিয়াস আমাকে নিজে এখানে পাঠিয়েছে। জানিনা সে আমার ঠিকানা কি করে পেলো। তারপর কাল রাতে আমাকে খুঁজে বের করে বললো সেদিন তুমি আমাকে দেখতে না পেয়ে কতটা অস্থির হয়ে গিয়েছিলে। এটাও বললো যতো যাই হোক তুমি নাকি আমাকেই চাও! সেটা তিয়াস স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে সেদিন। তার পর বললো, সে তোমাকে ভালোবাসে ঠিকি কিন্তু তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবে। কারণ সে অসংখ্য মেয়ের সাথে মিশেছে, তার পক্ষে ভালোবাসার পরিবর্তন স্বাভাবিক ব্যপার,তার উপর সে এটাও বললো ঘৃণার পরে ভালোবাসাটা ঠিক আগের মতো হয়না। ভালোবাসতে চাইলেও এতো বছরের ঘৃণাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর এসব কথার প্রসঙ্গকে মূহুর্তেই পাল্টে দিয়ে টিটকারি মেরে বললাম,
___ আচ্ছা ৫০০ কার্ড যে করছেন এগুলো কি করবেন?
রায়ান ভাইয়াও এবার হাসতে শুরু করে দিলো। আমি এই হাসির ভেদ কিছুই বুঝলাম না। তিনি হাসির তোড়েই বললেন,
___ কার্ডের তারিখ দেখেছিলে? এটা দেখে থাকলেও নিশ্চয়ই সনটা দেখো নাই। আগামী বছর এই তারিখ বিয়ে হলে কাজে লাগবে, নয়তো সেগুলো পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
লজ্জা মাখিয়ে একটা হাসি দিলাম। আমি সত্যিই কিছু দেখিনি, শুধু এটা চোখে পড়েছিল আগামী সোমবার লিখা। তারপর সেটার আগে তারিখ লিখা থাকলেও এই বছরের তারিখের সাথে সেদিন সোমবার কিনা কিংবা কোন বছর এসব খেয়াল করিনি। ভেবেছিলাম আমি যে তারিখ লিখতে বলেছি উনিও সেটাই লিখিয়েছেন৷ কে জানে উনি এতো এডভান্স চিন্তা করে এসব বানিয়ে ফেলবেন। তিয়াসও কি বিষয়টা খেয়াল করেনি? কি জানি!
এর মধ্যেই রায়ান ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
___বিসিএসের প্রিপারেশন নাও। প্রথম চেষ্টায় সফল হলেই তো কার্ডগুলো কাজে লাগবে। নয়তো আমার জরিমানা লাগবে।
আমি মুখ ভেংচিয়ে বললাম,
___ আচ্ছা কিপ্টে তো আপনি। ওকে, আমার চাকরি হোক, তারপর পাঁচশ নয় পাঁচ হাজার চাপাবো। পুরো গ্রাম দাওয়াত দিবো।
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উনি বললেন,
___ আমি মোটেও কিপ্টে নয়,মিতব্যয়ী। তবে দরকারে শুধু পাঁচ হাজার নয় পঞ্চাশ হাজার চাপিয়ে পুরো শহরকে দাওয়াত দিবো। তবে তুমি চাইলে!
আমি মনে ভাবছিলাম এখন বলবো আমি পুরো দেশ দাওয়াত দিবো, কিন্তু এতে কতো কার্ড লাগবে বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু মুখ চেপে হেসেও কথাটা ভেতরেই রেখে দিলাম। এতো মানুষকে খাওয়ালে সারা বছর চাকরি করেও দেনা শোধ করতে পারবোনা।
রায়ান ভাইয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু পিছিয়ে গিয়ে বললেন,
___ আমার অফিস আছে বুঝলে,এখন যেতে হবে। আর আমি আমার সম্পুর্ণ ঠিকানা তোমাকে এমএমএস করে পাঠিয়ে দিবো, আজ থেকে আর ফোনও বন্ধ পাবেনা, পাইলেও বাসায় চলে যাবে । আমার মা-বাবা তোমার ব্যপারে জানে, এটাও জানে আমি তোমার অপেক্ষায় অন্য কোথাও বিয়ের জন্য রাজী হইনা। আর শুনো, আমি কয়েকদিন পরে দুইদিন ছুটি আছে, চট্টগ্রাম যাবো। আমি তিয়াসের সুস্থতার বিষয়ে যাবতীয় চেষ্টা করবো। আমি তোমার পাশে আছি প্রীলিয়া! এখন যাচ্ছি হ্যাঁ?
আমি মাথা নেড়ে বিদায় জানালাম। তারপর একটা মুচকি হাসি দিলাম।
উনাকে না দেখলে হয়তো আমি কখনোই বুঝতাম না, একটা মানুষ সবকিছু একপাশে রেখে কীভাবে অসম্ভাব্য একটা পরিণয়ের জন্য এভাবে অপেক্ষা করতে পারে! এই অপেক্ষা কি আমাকেও ছুঁয়েছে? আমিও তো ভীষণ গভীর থেকে এই অপেক্ষাকে শ্রদ্ধা করি, অনূভব করি!
‘
‘
ইতোমধ্যে বাবা-মাকে শহরে নিয়ে আসার জন্য ভীষণ তোড়জোড় করছিলাম। কিন্তু বাবা কিছুতেই এখন আসতে রাজী না। বাবা চিন্তা করছে এতে করে আমি সমস্যার মধ্যে পড়ে যাবো, তার চেয়ে ভালো বিসিএস পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হওয়ার পর যখন ভালো একটা অবস্থানে যাবো তখনই সবাই আসবেন।
এদিকে রায়ান ভাইয়া যে দুইদিনের ছুটি পেয়েছেন সেটার পুরোটা সময়ই তিয়াসের বিষয়ে কি করা যায় সেটা খুঁজতে ব্যস্ত ছিলেন। আজকে ফিরবেন। মাঝেরদিন আমার থেকে তিয়াসের মা’য়ের নাম্বারও নিয়েছিল, কিন্তু কিছুই বলে নি। বলেছে ফিরে সব বলবে। জানিনা সেখানে গিয়ে কেমন হদিস পেয়েছেন। কিন্তু এটা ভালো করেই জানি তিয়াসকে স্বাভাবিক জ্ঞানে ফিরিয়ে এনে রায়ান ভাইয়ার কোনো ফায়দা নেই। কিন্তু রায়ান ভাইয়া এই বিষয়টাকে নিজের করে নিয়েছেন শুধু আমার জন্য। কেননা আমি একটা সময় তিয়াসের প্রতারণার শিকার হয়েছিলাম, যেটা আমার মতো অনেক প্রীলিয়ারা হয়েছে এবং হবে। তিয়াসের এমন কাজ আমার উপরে আর কোনো প্রভাব ফেলবেনা জেনেও একজন মানুষ হিসেবে এটা কর্তব্যের মধ্যে মনে করি, কারণ এর ভয়াবহতা আমি কাছ থেকে টের পেয়েছি এবং একটা মানুষ প্রতারিত হলে কতটা অসহায় হয়ে যায় সেটা গভীর থেকে বুঝতে পেরেছি, তাই সবসময়ই চাইবো এমনটা আর কারো সাথে না হোক। আর এসবকিছু ভেবেই আমার পক্ষ থেকে রায়ান ভাইয়াও তিয়াসের সুস্থতার ব্যপারে সিরিয়াস।
সন্ধ্যার আগে আগে রায়ান ভাইয়া আসলেন, এসেই আমাকে ফোন করে দেখা করতে বললেন।
আমিও তারাহুরো করে রওয়ানা দিলাম,কারণ উনি কি কি তথ্য পেয়েছেন সেই বিষয়ে আমার জানা ভীষণ জরুরী।
রিকশা থেকে নামতেই দেখলাম ফোন হাতে নিয়ে উনি ধিরে ধিরে আমার এগিয়ে নিতে আসছেন।
এদিকে আমি রিকশার ভাড়া মিটিয়েই প্রশ্ন করতে লাগলাম কি হয়েছে, কি জেনেছে, কোনো উপায় আছে কিনা, কারোর সন্ধান পেয়েছে কিনা!
কিন্তু উনি কোনো কথার জবাব দিচ্ছেনা।
হাতে ধরে টেনে সামনের একটা স্টলে ঢুকলেন। আমি অস্থিরতার সহিত এই বিষয়ে আবারও প্রশ্ন করতে যাবো তখনি উনি একটা গিফট বক্স সামনে রেখে বললেন,
___এটা খুলো প্রীলিয়া।
আমি খুলেই বক্সের উপরে একটা লিখা দেখলাম, যেটা দেখেই কিছুটা শিউরে ওঠলাম। দুটো ভালোবাসার চিহ্নের ভেতর লেখা “প্রীয়ান”।
নিশ্চয়ই এই বিষয়টা তিয়াসের থেকে শুনে উনিও দুটো নামকে মিলিয়েছেন। উনার কার্যকলাপগুলো সত্যিই অবুঝের মতো।
আমি হাসিমুখেই পুরো প্যাকটা খুললাম। খোলে দেখলাম ভেতরে ৭ ডজন চুড়ি। আরো কি কি যেন আছে,সেগুলো আপাতত দেখা যাচ্ছেনা। তার সাথে একটা চিরকুট, এসব রেখে এটা খোললাম আগে, দেখলাম লেখা আছে..
” জানি ভাব্বে প্রতিষ্ঠিত একটা মানুষ বেকার প্রেমিকের মতো এটা কেমন উপহার দিলো! কিন্তু জানো? ভালোবাসাটা কিন্তু বেকার প্রেমিকেরই বেশি হয়। তীব্র আকুলতা, দেখার আকাঙ্খা, ভালোলাগা,ভালোবাসা প্রকাশ্যের মাত্রা তাদের মধ্যেই অতাত্ত্বিক হয়, কেননা তারা প্রেমিকার খেয়াল রাখা ব্যতিত দুনিয়ার আর কিছুতে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না।
আমার স্বর্ণ কিংবা হিরে দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও আমি চুড়ি,কাজল,টিপ,আলতা,সস্তা দুলের সাথে একজন প্রেমিক উপাধি পেতে চাই। ভালোবাসায় স্থায়ীত্ববোধ দেখতে চাই। সংসারের দায়ভার, আরো উন্নতিরচেষ্টা, ভবিষ্যৎ চিন্তা, হতাশা গ্লাণি আমাকে ছুঁয়ে পড়ার আগে আমি তোমার প্রেমিক হতে চাই! ”
আমি কাগজটা ভেতরে রেখে বক্সটা বন্ধ করলাম। আর চোখ ত্যাড়া করে জিজ্ঞাসা করলাম,
___প্রেমিক হওয়ার বয়স আছে আপনার? কেন পাগলামো করেন বলেন তো? আচ্ছা এসব বাদ দিয়ে বলেন তিয়াসের ব্যপারে। কিছু জানতে পারলেন?
রায়ান ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, তারপর বললেন,
___ তিয়াসের মা’কে ফোন করে ওই মহিলার সন্ধানে বের হয়েছিলাম,যার জন্য তিয়াসের ছোট পাপা সুইসাইড করেছে। সেদিন সারাদিন ঘুরেও কোনোভাবেই খোঁজ পাচ্ছিলাম না। তারপর তিয়াসের মা’কে জিজ্ঞাসা করলাম উনারা আসলে তখন কোন কলেজে পড়তো আর কতো সনের ব্যাচে ছিল। তারপর সেটা জেনে আমি সেখান থেকে গেলাম সিলেট, কলেজের আশপাশ থেকে খোঁজ নিলাম,প্রথম সারির স্টুডেন্ট তো, অবশেষে শীগ্রই পেয়ে গেলাম তার বাবার বাড়ির ঠিকানা। তারপর সেখানে পৌঁছালাম। আর চট্টগ্রামের ঠিকানা জোগাড় করে আবার চট্টগ্রাম গেলাম। তারপর সেখানে গিয়ে জানলাম উনি সেখানে থাকেন না। সেখানে গিয়ে একটা মেয়ের কাছ থেকে উনার সব ইনফরমেশন নেওয়ার জন্য ফোন নাম্বার আর ফেইসবুক আইডি আনলাম। মেয়েটা উনার ভাতিজী। কেন নিয়েছি সেটা না জেনেই মেয়েটা আমাকে সাহায্য করতে রাজী হলো। এরপর সোজা এখানে চলে আসলাম, কারণ আমার কাল অফিস আছে। ওয়েট মেয়েটার সাথে তুমিও যোগাযোগ করো পরে।
রায়ান ভাইয়া আমাকে মেয়ের আইডি দিলো। আমি ফোনটা বের করে জেসিয়া ইসলাম নামে এই আইডিকে এড করতেই চমকে উঠলাম। জেসিয়া ইসলাম আর নামের পাশে সংক্ষিপ্ত নামে দিশা! প্রোফাইলে তার নিজের ছবি। নাহ আমার কোনো ভুল হচ্ছেনা। এটা সেই মেয়েটাই, যে তিয়াসের সম্পর্কে খুব ভালো ভালো কথা বলছিল, সাথে আমার প্রশংসাও করছিল। আমি আতংকের সহিত বলে উঠলাম,
___ওই মহিলার সাথে দিশার সম্পর্ক আছে সেটা ভুল করেও যেন তিয়াস না জানে। সে প্রতিশোধের স্পৃহায় নির্দোষ মেয়েদেরকে কষ্ট দেয়, সেখানে যদি এটা জানতে পারে একসময় তার উপকারে ঘুরে দাঁড়ানো মেয়েটা তারই শত্রুর আত্মীয়, তাহলে ভীষণ খারাপ হয়ে যাবে।
আমার কথা শুনে রায়ান ভাইয়া কিছু না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
এটা শুনে আমি চোখ ফিরিয়ে রায়ান ভাইয়ার দিকে তাকালাম আর চমকে উঠলাম।
কারণ তিনি এখানে নেই। আমি হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ালাম। না উনাকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা৷ একটু আগেই তো বুঝতে পেরেছিলাম উনি এখানেই আছেন, তাহলে হুট করে কোথায় উধাও হয়ে গেলেন?
আমি এখান থেকে আসতে চাইলেই তিয়াস বলে,
___ রায়ান ভাইয়া হয়তো ভেবেছে আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিবে, কিংবা কোনো অনুগ্রহ করবে তাই হয়তো..
আমি রাগী চোখে ফিরে তাকিয়ে, ঝাঁজালো গলায় বললাম,
___ এই এই চুপ করবে তুমি? তোমার কি মাথায় সমস্যা আছে? কি বললে এতক্ষণ পাগলের মতো? এগুলো কোনো যুক্তি কিংবা ভালো মানুষের কথাবার্তা? আর তুমি কি শুধু এই একটা পাপই করেছো? তুমি নুজহাতকে সা’দের থেকে আলাদা করেছো, রায়ান ভাইয়ার কাছে প্রথমে আমাকে নিয়ে উল্টা পাল্টা বলেছো, আবার নীরা ভাবীকেও এসব জানিয়েছো! হ্যাঁ আমি মানলাম তোমার ছোট পাপা মারা গেছে, তাই বলে তোমাকে এসব করতে হবে? অন্তত মেয়েদের প্রতি ঘৃণায় বেঁচে থাকতে, সেটাও ভালো ছিল! ক্ষতি করে জীবনের মানে শেখানোর ভুলভাল যুক্তি কোথায় পেলে তুমি?
তিয়াস আস্তে আস্তে জবাব দিলো,
___ ভেবেছিলাম তোমার প্রতি রায়ান ভাইয়ার ভালোবাসাটা দূর্বল, তোমার সম্পর্কে উল্টা পাল্টা বললে সেটা মচকে যাবে। আর তাই আমি তোমাকে আমার করে পাওয়ার জন্য এমন করেছি। কিন্তু বুঝেছি উনি তোমাকে আমার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসে, এই ভালোনাসায় কোনো খাঁদ নেই।
আর সা’দকে আমি কোনো উস্কানি দেইনি,কিংবা তাদের সংসারেও কোনো রকম আঘাত হানিনি। সা’দ নিজেই একটা খারাপ, সে আমার থেকেও খারাপ।
আমি তো শুধু ভালোবাসায় জড়িয়ে সেটা প্রকাশের সময়সীমা দীর্ঘ না করেই ছেড়ে দেই,কিন্তু সা’দ তা করে না। সা’দ যখন নুজহাতের সাথে সম্পর্কে ছিল তখনি তার আরো এক্সট্রা গার্লফ্রেন্ড ছিল। বেচারি নুজহাতকে মানবেনা বলে জেদ ধরে গ্রামে চলে গেলো। আমি ওকে বুঝানোর জন্য আর কোনো উপায় দেখিনি। নয়তো নুজহাত মেয়েটা নির্ঘাত সেদিন সুইসাইড করা ছাড়া কোনো অপশন পেতোনা। আর আমি সেটাকে প্রবল ঘৃণা করি। সেজন্যই সা’দকে বলেছিলাম বিয়ের পরেও প্রেম করিস,এখন নুজহাতকে মেনে নে। তবে আমার মনে ছিল বিয়ের পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সে শোধরায় নি। আমি মানলাম আমি ওর সাথে চলাফেরা করি, কিন্তু আমি তাকে এরকম কিছুই বলিনা। আর জানিনা এই মূহুর্তে তুমি এসব কথা কেন বলছো! কিন্তু বিশ্বাস করো…
আমি সেখান থেকে পা বাড়িয়ে বললাম,
___ আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। একবার বিশ্বস্ত হয়ে ঠকিয়েছো আর এখন আবার বিশ্বস্ত হওয়ার জন্য আজগুবি কথা বলছো। তোমার সব কথা আমার কাছে ভিত্তিহীন লাগছে।
ভেবেছিলাম সবকিছুর সমাধান হবে, সব জানতে পারবো কিন্তু নাহ এখন মাথায় আরো ঝট পাকিয়ে দিয়েছো। থাকো তুমি..
তিয়াস ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আমি মেইন রাস্তায় এসে গাড়ী নিলাম। তারপর বারবার রায়ান ভাইয়াকে ফোনে ট্রাই করছিলাম। কিন্তু উনার ফোন বন্ধ বলছে। আসলেই উনি উল্টো ভেবেছে? সব কথা না শুনে এভাবে চলে গেলেন কেন?
বাসায় এসে মা’কে ফোন দিলাম আর তিয়াস আজ যা যা বলেছে সব বললাম। মা শুনে তব্দা খেয়ে ছিলো। বাবাও বুঝতে পারছেনা এসব কেমন উদ্ভট লজিক হতে পারে? আমার মাথা একদম হযবরল অবস্থা। অন্যদিকে রায়ান ভাইয়াকে কোথাও পাচ্ছিনা, এমনকি জানিনা উনার বাসার ঠিকানাও।
এরপরেরদিন আমিও তিয়াসের বিরুদ্ধে থানায় একটা ফাইল করে আসলাম। জানিনা হুটহাট কি হয়ে যায়, তবে বিষয়টা জানানো দরকার ছিল! এতদিন ভেবেছি ওর মুখ থেকে সবকিছু শুনে নিবো, তারপর যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিবো। কিন্তু এখন আমি জানি সে যা করেছে সব খামখেয়ালে, এসবের কোনো মানে নেই।
‘
‘
কয়েকদিন চলে গেলো!
একটা চাকরির পরিক্ষা দিয়ে ফিরছিলাম। এই চাকরিটা হয়ে গেলেও পারমানেন্ট নয়। পরবর্তীতে ভালো জায়গায় চাকরি পেলে ছেড়ে দিবো এমন ভাবনাতেই পরিক্ষা দেওয়া, কেননা আমার ইচ্ছে যতো তারাতাড়ি সম্ভব পরিবারকে শহরে নিয়ে আসবো।
ফেরার পথে রাস্তার মোড়ে হঠাৎ আন্টির সাথে দেখা, মানে তিয়াসের মা। আমি সরে আসতে চাইলেও উনি ডেকে দাঁড় করালেন। আর চোখে চশমাটা আধ খোলা করে একটা পাশে এসে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। আমি তাড়ার স্বরে বললাম,
___আন্টি কিছু বলবেন?
তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
___লিয়া তিয়াস তোমাকে সবকিছু বলেছিলো তাইনা? হয়তো তুমি ওর কথা মানতে পারো নি। ওকে বিশ্বাস করোনি। আর কে মানবে বলো? একটা পাগলের কথাকে কে গুরুত্ব দেয়? !
আমি অবাক হয়ে বললাম,
___ পাগল?
আন্টি ধিরে ধিরে বললো,
___হ্যাঁ সে মানসিক বিপর্যস্ত এক মানুষ। সে শোধরাবেনা কোনোদিন। তোমাকে এসব বলার পরেও সে এক মেয়ের সাথে প্রতারণা করেছে। মানে এই কয়দিনের মধ্যে। জানিনা আমার ছেলে কোনোদিন স্বাভাবিক হবে কিনা, কিন্তু আমি মা হিসেবে আর নিতে পারছিনা।
___ তো আপনারা কোনো বিশেষজ্ঞদের কাছে যাচ্ছেন না কেন?
___বহু জায়গায় গিয়েছি, লাভ হয়নি। সে তার ছোট পাপার মধ্য থেকে আজও বের হতে পারেনি। তার মধ্যে প্রতিশোধ জেগে আছে, বিশেষজ্ঞরা বলেছে এটার আংশিক হলেও সে করে যাবে। তুমি জানো সে তারা ছোট পাপার ভয়ানক মৃত্যুদেহটা প্রথমবার দেখেছিল, আর সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। এমন একটা অবস্থা ছিল ডক্টররা বলেছিল সে সম্পূর্ণ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে । কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে সেটা হয়নি,কিন্তু কম কি হয়েছে বলো? এরপর থেকে সে যা চায় আমরা তাই তাই মানি, ওর বাবা ভীষণ ভয় পায় সেও যদি তার ছোট পাপার মতো কিছু একটা করে বসে! কিন্তু আমরা এতদিন ওর সম্পর্কে এতকিছু জানতাম না, সে মানুষের সাথে প্রতারণা করে তাদের স্বাভাবিক জীবনকে বেহাল করে তারপর তাকে শক্ত করে তুলতে চায় এসব আমরা তোমার জন্য প্রস্তাব নেওয়ার পরে জেনেছি। অন্যদিকে তিয়াস এখনো চট্টগ্রামে ওর ছোট পাপাকে মৃত্যু ঠেলে দেওয়াসেই মেয়েটার সন্ধানে পড়ে আছে। কোথা থেকে খবর পেয়েছিল সেই মেয়ের চট্টগ্রামে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো হদিস পায়নি।
অন্যদিকে তিয়াসের একমাত্র দূর্বলতা হলো সে মানুষের নিজের প্রাণ নিজে বিসর্জন দেওয়া মানতে পারেনা। ছোট বেলা থেকেই সুইসাইডের কোনো সংবাদ শুনলে সে এমনভাবে কেঁদে উঠতো যেন ওর সাথে কিছু হয়েছে । তার একটাই লক্ষ্য সবাই জীবনের গুরুত্ব বুঝুক, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকুক! কিন্তু সেটার জন্য সে উল্টা পাল্টা যুক্তি ব্যবহার করে। সে মানতেই চায়না যে তার করা কাজগুলো ভুল। ওর সাথে এই নিয়ে তর্ক করে কেউ পেরে উঠেনা। তিয়াসের মধ্যে আর কোনো সমস্যা নাই, শুধু এটাই সমস্যা, তার ভুল চিন্তা চেতনাকে সে সঠিক বলে ধরে নেয়! বিশেষজ্ঞরা বলে, সে এগুলো প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে করে, কিন্তু এরপর তার মনুষ্যত্ব থেকে এটা ধরে নেয় সেই মানুষটা প্রতারিত হয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে নিবে, জীবনকে ভালোবাসবে, কখনো অপরের উপর এতটা নির্ভর হবে না, যতটা হলে সে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে! কিন্তু তিয়াসকে কেউ বুঝাতে পারেনি এসব এক-দুইজনের জন্য হতে পারে, কিন্তু সবাই সব মানতে পারবেনা, আর সবাই উঠে দাঁড়াতে পারবে না!
সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত সে মনে মনে মেয়েদের প্রতি অন্য রকম চিন্তা চেতনায় বেড়ে উঠেছে, প্রায় ক্ষেত্রেই মেয়েদের সাথে খারাপ আচরণ করে, তোমার সাথেও তো করছিলো, ওই যে ইয়াসকে পড়ানোর সময়, এসব স্বাভাবিকভাবেই করতো তিয়াস। তবে সে মেয়ের সাথে প্রতারণা করতে চায় তার সাথে ভীষণ ভালো আচরণ করে , এতো ভালো যে ওকে মানুষ না ভেবে কেউ কেউ ফেরেস্তা ভেবে ফেলতে পারে! কিন্তু আমরা ইদানীং বুঝতে পারি ওর ছোট পাপার প্রতি তীব্র ভালোবাসা তাকে এইদিকে সম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন করে দিয়েছে।
আর এগুলো সব আস্তে আস্তে আমরা জানতে পেরেছি, বাসায় বিভিন্ন ধরনের অভিযোগও আসে, আমাদের পরিবার ছাড়া এসব শুধু তোমাকে আজ জানালাম। আরেকটা কথা বলতে চাই, আমি অনেকদিন ধরে তোমাকে খুঁজতেছি একটা জরুরী কথা বলতে ,জানিনা মা হয়ে এই কথাটা বললে কীভাবে নিবে!
আমি অস্থির ভঙ্গিতে বললাম,
___ কি কথা বলুন!
উনি চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
___ তিয়াস হয়তো ওর ছোট পাপাকে সুইসাইড করতে বাধ্য করা সেই মেয়েকে সাজা দিতে পারলে ভালো হয়ে যেতো। কিন্তু তাকে তো পাওয়া দুষ্কর। আর এতো বছর পর সেটা সম্ভবও নয়,তাই তিয়াসও এমন অপরাধবোধ থেকে সরে আসতে পারবে বলে মনে হয় না । এই জন্য আমি তোমাকে বলবো তিয়াসকে আইনের হাতে তুলে দাও। সে অপরাধ করেছে এবং করবে। কিন্তু যদি কোনো প্রতিবাদ না হয় সেটা আরো বিপদজনক পরিবেশে পৌঁছাবে। ওর নামে অনেকগুলো আইনি নোটিশ এসেছে কিন্তু গুরুতর কিছুইনা, ঠিকি পার পেয়ে যাচ্ছে। আমি চাই তুমি তাকে অপরাধী প্রমাণ করে শাস্তির ব্যবস্থা করো। হতে পারে এতেও সে শোধরাতে পারে, কারাগারে একা থাকার পরে শুধু প্রেমের একাকিত্ব নয় সব একাকিত্বের মধ্যেই সে সেটা বুঝতে পারবে যে প্রতিটি মানুষ মূল্যবান। যাকে মন থেকে একবার ভালোবাসা হয় তাকে মুছে ফেলা খুব কঠিন। ওর মধ্যেকার ভ্রান্ত ধারণাগুলোর খুব শীগ্রই পরিত্রাণ হোক! আজ পর্যন্ত সে কখনোই কোনো কারণে কষ্ট পায়নি, আমরাও দেইনি! শুধু ওই মৃত্যুটা তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। আমার বলতে কলিজা ফেটে যাচ্ছে কিন্তু তাও চাই সে শাস্তি পাক, সে বাস্তবতা বুঝুক! এভাবে আর কতোদিন? অনেক বছর তো হলো! ওর সাজা হওয়া উচিত! সেসময়টা পর্যন্ত আর কিছু মেয়ে ওর কবল থেকে নিরাপদে থাকুক! আমি আর নিতে পারছিনা এতো যন্ত্রণা!
উনি বারবার ওড়না দিয়ে চোখের জলগুলো মুছতেছেন। আর আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। যেই ছেলে সবাইকে বুঝাতে চায় একটা মানুষ চলে গেলেও বেঁচে থাকার জন্য আরো অনেক মানুষ আছে,অনেক প্রিয়জন আছে, সেই মানুষটাই কিনা তার সেই ছোট পাপার জন্য এতটা ব্যকুল, আরো এতটাই অপরাধবোধ নিয়ে বেড়ে উঠছে?
আমি আন্টির কাঁধে হাত রেখে উনাকে আশ্বস্ত করলাম। তারপর বললাম,
___ আমি ওর কাজের জন্য ঠিকি শাস্তি দিবো। ওর ভেতরে হাজার যন্ত্রণা থাকুক,প্রতিশোধের আগুন থাকুক, কিন্তু সেটা নিরপরাধ মানুষের ক্ষেত্রে কেন প্রয়োগ করবে? অবশ্যই তার শাস্তি পাওয়া উচিত!
উনি ঠোঁট ভেঙে কেঁদেই যাচ্ছেন। আমি একটা রিকশা ডেকে উনাকে তুলে দিলাম। আর নিজের বাসার দিকে এগিয়ে চললাম। মাথার উপরে বিরাট একটা পাহাড় চেপেছে যেন! সেটা বয়ে আমি চলতে পারছিলাম না। বারবার এটাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো, একটা মা ছেলের কতটুকু অপরাধ থেকে নিজে তার শাস্তি দাবী করেন! হয়তো তিনি নিজের ছেলেকে স্বাভাবিকভাবে দেখার তীব্র বাসনায় এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। যে কোনো কিছুর বিনিময়েও তিনি নিজের ছেলেকে সুস্থ স্বাভাবিক দেখতে চান! কিন্তু কে জানে এতেও সে বাস্তবতা বুঝবে কিনা!
‘
‘
পরেরদিন আমি বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। তখনই নুজহাতের ফোন। আমি ফোনটা রিসিভ করতেই শুনলাম নুজহাত বলছে,
___সা’দকে পুলিশ নিয়ে গেছে। আর তিয়াসের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ তুলে নিয়েছি। সা’দ স্বীকার করেছে সে নিজের দোষ হালকা করতে তিয়াসকে এখানে জড়িয়েছিলো। আগে আগে দোষ স্বীকার করে নিয়েছে আর বলেছে এসব যেন তিয়াস না জানে। কারণ সে বুঝতে পেরেছে তিয়াস এসে জিজ্ঞাসা করলে তার এই মিথ্যে বলার জন্য আরো বাজেভাবে ফাঁসতে হবে । এখন মাফ চাচ্ছে, বলছে এমন ভুল আর করবেনা। আমি যেন তাকে গ্রহণ করি, সে তার বউ বাচ্চা ছাড়া আর অন্যদিকে তাকাবেনা। কি করবো লিয়া?
আমি স্থির হয়ে বসে পড়লাম। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে জবাব দিলাম,
___ আচ্ছা এই দুনিয়ায় ফাঁসানো,প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, ঝগড়াবিবাদ, খুন, খারাপি ছাড়া আর কিছু নেই? আমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছিরে! আমি তোকে আর কি সাজেশন দিবো? আজকাল আমি নিজেই নিজের অস্তিত্ব টের পাইনা।
নুজহাত আমার কথা বুঝেছে কিনা জানিনা। কিন্তু কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিলাম। একদিকে তিয়াসের এই অবস্থা, অন্যদিকে রায়ান ভাইয়াও বেপাত্তা, তার উপর নুজহাতের সংসারে ভাঙচুর! এসবকিছুর সাথে আমি না থেকেও কেমন থেকে যাচ্ছি , না জড়িয়েও অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে যাচ্ছি! কেন?
গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব ( পর্বঃ ১৩ এবং ১৪)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
মা’র কথা শুনে আমার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো, আবারও মুখ ফিরিয়ে জানতে চাইলাম,
___ মা কি সেই উপায়?
মা কানের কাছে এসে ফিসফিস করে উদ্ভট এক উপায় বললো, যেটা শোনার সাথে সাথে আমার চেহেরায় বিষন্নতা ফুটে ওঠলো। আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
___ মা তোমার মাথায় এসময় এমন একটা চিন্তা কীভাবে আসলো? একজনের নাটকবাজি ধরতে দিয়ে আরেকজনের সাথে মিথ্যা নাটক করবো?
মা এই কথাতে কেমন যেন একটা স্থিরতা টানিয়ে বললো,
___ তাহলে আমি কিছু জানিনা। তবে চেষ্টা করতে দোষ কি বল? এভাবে চলতে থাকলে ব্যপারটা আরো খারাপ হয়ে যাবে না? তিয়াস যদি এভাবে আরো মানুষের ক্ষতি করে?
আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপর মা’র দিকে তাকিয়ে বললাম,
___ তাহলে পরিক্ষার পর চেষ্টা করবো। এখন এসব নিয়ে ভাবলে রেজাল্ট ভালো হবে না।
মা চুলে বিনুনি করতে করতে বললো,
___ তুই যা ভালো মনে করিস তাই কর।
আমি বসে বসে আরো ভাবলাম। তারপর মা যা বললো তাই করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে এখন না, পরিক্ষার পরেই। এদিকে নুজহাতকে ফোন করে বলে দিলাম তিয়াস আর সা’দের বিরুদ্ধে থানায় একটা জিডি করে রাখতে।
রাতের বেলা শুয়ে একটা উপন্যাস পড়ছিলাম। তখনই বাবা রুমে প্রবেশ করলো। আমি বইটা রেখে বাবাকে বললাম,
___ সারাদিন এতো পরিশ্রম কেন করো বলোতো? আজ দুপুরে তারাহুরো করে কখন খেতে এসেছিলে সেটাও টের পাইনি।
বাবা মুচকি হেসে বললো,
___ তোদের জন্যই তো মা। আর তুই কি কম পরিশ্রম করিস, আমাদের স্বপ্নের জন্যই তো পড়তে পড়তে চোখ দুইটা কানা করে ফেলতেছিস। জানিনা কবে এর পরিত্রাণ হবে!
আমি চশমাটা খোলে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,
___ বাবা তুমিই তো বলেছিলে পড়ালেখা নিজের জন্য! হ্যাঁ আমিও তাই মনে করি কিন্তু আমার সফলতাটা কিন্তু সবার খুশির! তাই আমি নিজের জন্য পড়ি আর তোমাদের জন্য সফল হতে চাই। আর একটা কথা জানো, যারা পড়াকে ভালোবেসে ফেলে, তারা এর মধ্যে একটা বন্ধন তৈরি করে ফেলে, এবং তারা বৃদ্ধ বয়সেও না পড়ে থাকতে পারেনা, ধিরে ধিরে চশমার পাওয়ার বাড়বে কিন্তু পড়ালেখার পরিমাণ কমাবেনা। বাবা সত্যি শিক্ষা অর্জনের শেষ নেই, প্রতিদিন আমার মনে হয় আরো শিখতে হবে, আরো জানতে হবে, আরো যোগ্যতা অর্জন করতে হবে! তুমিই বলো অর্থের লোভের চেয়ে শিক্ষা গ্রহণের লোভটা শ্রেষ্ঠ না?
বাবা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
___ তুই অনেক বড় হবি মা। তখন আমি সমাজের দিকে আঙুল করে বলবো, কে বলে মেয়েরা সাফল্য লাভ করতে জানেনা? কে বলে মেয়েরা আট দশটা ছেলের মতো যোগ্য হতে পারে না? কে বলে মেয়ে জন্মানো মানেই বাবার কাঁধের বোজা! দেখো আমার মেয়েকে দেখো, আমার মেয়ে পেরেছে, আজ সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । আমার মেয়েও এখন একটা ছেলের মতো দায়িত্ব নেওয়ার অধিকারী! ছেলে দিয়ে নয়,মেয়ে দিয়েই আমি একজন গর্বিত বাবা!
আমি হাত দিয়ে বাবার চোখ থেকে খুশির জলগুলো মুছে দিয়ে বললাম,
___ আমার জন্য দোয়া করো তুমি! তোমাদের দোয়াতেই তো আমি এগিয়ে যাবো। আর হাজার প্রতিকূলতা ডিঙিয়েও তোমাদের সফলতার রক্তিম সূর্য উদিত করে দেখবো!
বাবার চেহেরাটা উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করছিল, সেটা আমি স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারছিলাম।
দুইদিন পরেই চলে গেলাম!
আবারও নিয়ম করে পড়ালেখা, টিউশন,টুকটাক ক্লাস নেওয়া চলতে লাগলো।
কেটে গেলো অনেকদিন। পরিক্ষা চলছে..
তিয়াসকে এর মধ্যে ছয়বার দেখেছি। তাকে ডাকা যাবেনা, কথা বলা যাবেনা এমন জায়গা থেকে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার চলে যায়।
আর অন্যদিকে রায়ান ভাইয়া..সকাল, সন্ধ্যা, রাত, সময়- অসময় হুটহাট উনাকে বাসার নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। মানে উনার কাজ না থাকলেই এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি নিজের কাজ কিংবা পড়ালেখার ফাঁকে জানালার পর্দা সরিয়ে মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে দেখি! মাঝে মাঝে সবকিছু রেখে আমিও উনার অস্থির পায়চারি , বারবার উপরে তাকানো দেখি। একেক সময় ইচ্ছে করেই উনাকে না দেখার ভান করে বারান্দা থেকে কিছু একটা আনতে যাই। তারপর রুমে এসে লুকিয়ে দেখি আমাকে দেখতে পেরে উনার মুখে কি সুন্দর উজ্জীবিত হাসি!
পরিক্ষা ভালোভাবেই দিচ্ছিলাম। সব চিন্তা ভাবনা কিংবা পরিকল্পনা স্থগিত ছিল পরিক্ষার জন্যই।
সেদিন শেষ পরিক্ষা ছিল। আমি কেন্দ্র থেকে হাসিখুশি চেহেরা নিয়েই বের হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আজকে রায়ান ভাইয়াকে মায়ের বলা সেই পরিকল্পনাটার কথা জানাবো, তারপর উনি রাজী হলে সেটা করার চেষ্টা করবো। তিয়াসের ব্যপারে যে করেই হোক জানতে হবে!
কিন্তু গেইট থেকে বের হতেই হালকা বেগুনি রঙের জামা পরা অপরিচিত একটা মেয়ে আমার পথ আটকে সালাম দিলো। আমি সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
___ তুমি কি কিছু বলতে চাও?
সে মাথা নেড়ে বললো,
___ আপু আমার নাম দিশা। আচ্ছা আপনি তিয়াস ভাইয়াকে চিনেন? মানে উনার থেকেই আপনার পরিচয় পেয়েছি আমি।
আমি পাশ কেটে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত ঠেসে বললাম,
___ তো ওর বলির শিকার তুমিও হয়েছিলে বুঝি? আমাকে ওর সম্পর্কে এই বিষয় ছাড়া কেউ কিছু বলতে আসেনা,জানো? তো এখন কোথায় পড়ালেখা করো?
নাকি ছেড়ে দিতে হয়েছে?
মেয়েটা আমার কথা শুনে ভীষণ অবাক হয়ে বললো,
___চট্টগ্রামে, ম্যাথে এবার প্রথম বর্ষ! আর আপনি এসব কি বলছেন আপু? বলির শিকার হবো কেন? তিয়াস ভাইয়া আমার জীবন বদলের উদাহরণ, আর আপনি সেখানে আমার অনুপ্রেরণা!
এটা শুনে আমি ভ্রু কোঁচকালাম সাথে চমকালামও। বহুদিন পরে ওর ব্যপারে একটা পজিটিভ কথা শুনলে সবারই চমকানোর কথা। আর আমি মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
___ তোমাকে তো আমি চিনিই না। তাহলে আমি কি করে তোমার প্রেরণা হলাম?
মেয়েটার মুখটা অন্য রকম হয়ে গেলো। সে আমার হাতে ধরে বলল,
___ আসুন আপনাকে সব বলছি।
আমি ওর সাথে গিয়ে ঝালমুড়িওয়ালার সামনে রাখা টুলটাতে বসলাম। সেও বসে দুই প্লেট অর্ডার করলো।
তারপর আস্তে আস্তে বললো,
___ আমি একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসতাম। মানে প্রচন্ডরকম ভালোবাসতাম, যেন সে ছাড়া এ জগৎ আমার জন্য শুধুই মরুভূমি। একটা সময় সে আমার সাথে প্রতারণা করে। আমি নিজের প্রতি সকল ভরসা হারিয়ে ফেলি, রাতের পর রাত ঘুমের ঔষধ খেয়ে পড়ে থাকি। পড়ালেখার আদৌও আমার মধ্যে ছিল না, আগের যা প্রিপারেশন ছিল তা দিয়ে আমার রেজাল্ট আশানুরূপ হয়নি। আরো আরো ভেঙে যাচ্ছিলাম। ছেলেটা রোজ আমার সামনে দিয়ে অন্য মেয়ের সাথে মেলামেশা করতো, কিছু বললে ভীষণ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো, আমাকে অপমান করতো,যোগ্যতার প্রসঙ্গ তুলতো, এটাও বলতো আমি নাকি ওর বর্তমান গার্লফ্রেন্ডের মতো এতো সুন্দর আর স্মার্ট নয়, আমার সাথে তার মানায় না। আমি এসব সহ্য করতে না পেরে সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত নেই, ফেইসবুকে এমন ধরনের একটা স্ট্যাটাসও দিয়েছিলাম। সেটা দেখে তিয়াস ভাইয়া প্রথম আমাকে নক করে। আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমি কেন একটা বাজে ছেলের জন্য জীবনকে এতো তুচ্ছ মনে করি। তখন আমি উনাকে সব খোলে বললাম। শুনে আমাকে বললেন আমার সাথে ফোনে কথা বলবেন। আমি মানা করিনি, ভাইয়া ফোন দিয়েই আমাকে বলে প্রীলি নামে এক মেয়ের কথা, মানে তোমার কথা। যাকে উনি নিজে ঠকিয়েন, আর সেই মেয়ে এসবকে কাটিয়ে বীরের মতো উঠে দাঁড়িয়েছে, যা পাওয়ার ছিল না তাও সে পেয়ে দেখিয়েছে!
আমি ওর কথার মধ্যে থামিয়ে বললাম,
___ তিয়াস আমার কথা বলে মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয় নাকি আমার মতো মেয়েকে ঠকাতে পেরেছিল বলে আত্মপ্রশংসা করে? আচ্ছা যাই হোক তারপর বলো
দিশা কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে আবার বলতে লাগলো,
___ আসলে তখনও আমি কিছুতেই এসব মানতে পারছিলাম না, তারপর উনি আমাকে বললেন, সেদিন প্রীলিকে ঠকানো আমিটাই এখন ওর কাছে পাত্তা পাইনা বুঝেছো? তুমিও এমন জায়গায় পৌঁছাও যেখানে গেলে ওর মতো ১০০ ছেলে তোমার নাগাল পাবে না।
একটা ছেলে গেলে তোমার জীবনে আরেকটা ছেলে আসবে কিন্তু জীবন চলে গেলে সেটাকে কখনোই ফিরে পাবেনা। কাউকে মন থেকে ভালোবাসা পাপ নয় কিন্তু জীবন দিয়ে ভালোবাসবে না। তখন আমি কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম, আমার রেজাল্ট তেমন ভালো হয়নি, এডমিশন প্রিপারেশনও নেইনি, দেড় মাসে আমি কি করবো? আমি কোনোভাবেই আপনার বলা মেয়েটার মতো হতে পারবোনা। তখন তিনি বলেছিলেন তোমার চেষ্টার কথা। বলেছিল সারা বছর তুমি উনার জন্য না পড়ে পরিক্ষার ৪ মাস আগে প্রতারিত হয়ে এতটাই চেষ্টা করেছো যে ভালো রেজাল্ট নয়, বোর্ডে প্রথম হয়েছো। এখন সবখানে, সব জায়গায় তোমার মেধার পরিচিতি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারপর আমার ভেতরও জাগলো তোমার মতো এক প্রতিজ্ঞা, আমি সব ভুলে নিজেকে গড়তে লড়াই শুরু করে দিলাম। আজকে আমি ভার্সিটিতে টপ টেন মেধাবীদের খাতারে, যেখানে কিনা দেড় মাস আগেও আমি পরিক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা হবে সেটা কল্পনা করিনি।
আর হ্যাঁ প্রীলি আপু, এখানে আমি ফুফির বাসায় আসছি, ভাইয়া বলেছিল কখনো আসলে এই ভার্সিটিতে এসে খোঁজ করতে। আমি অনেক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম তোমার, শুধু তোমার মতো একটা সফল নারীকে দেখবো বলে, যার অনুসারী আমিও হতে চাই । কারণ আমি সেদিন ভেবেছিলাম তিনি একটা মেয়ে হয়ে সবকিছু রেখে ঘুরে দাঁড়িয়ে সফলতার শীর্ষে যাওয়ার পরিস্থিতিতে আসতে পেরেছেন, আমি কেন পারবোনা? অতঃপর আমার চেষ্টা আর প্রিপারেশন আমাকে ভার্সিটিতে ভালো সাব্জেক্টে ভর্তির সুযোগ দিয়েছে। এটার সবোর্চ্চ ক্রেডিট ভাইয়ার, তবে তুমি আমার কাছে সেটার প্রধান অনুপ্রেরণা। অনেক ইচ্ছে ছিল তোমাকে দেখার, আজ সেটা পূরণ হলো।
এগুলো বলেই মেয়েটা কথা থামিয়ে ঝালমুড়ির দিকে নজর দিলো,দেখলো এগুলো নেতিয়ে গেছে। এদিকে আমি ওর কথা শুনতে শুনতে খেয়ে শেষ করে ফেলেছি।
আমি পেছনে তাকিয়ে আবার ওর দিকে তাকালাম আর বললাম,
___ তারপর বলো তিয়াসের ব্যপারে আর কিছু জানো তুমি?
মেয়েটা এগুলোই খেতে খেতে জবাব দিলো,
___ উঁহু তেমন কিছু জানিনা, তবে শুনেছি উনি ইউনিভার্সিটিতে এসেও ইন্টারমেডিয়েটে পড়া প্রথম স্থান অধিকারী মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করেন এরপর ছেড়ে চলে আসেন। অনেকেই অনেক কথা বলে,কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনা। উনি এমন হতেই পারে না। কারণ আমি উনার মধ্যে খারাপ চরিত্রের মতো এমন কিছুই পাইনি।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
___ অথচ এতক্ষণ ধরে তুমি আমার গল্প বললে, তিয়াস আমাকে ঠকানোর পরে কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছি সেটা বললে। এখন কিনা বলছো এসব বিশ্বাস করো না। তো আমি কি করে তোমার কথা বিশ্বাস করবো বলো তো? জ্বলজ্যান্ত ঠকে যাওয়া মানুষটাকেই কিনা এসব বলছো?
মেয়েটা থতমত করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
___ মানে আপনার কথা তো উনিই বলেছে। এরপর যে অন্যদের সাথেও এমনটা করেন সেটা আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়না সেটাই বলতে চেয়েছিলাম..
আমি হাত বাড়িয়ে বললাম,
___ আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে, আমি বুঝতে পারছি। আর তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। ভালো থাকবে, সত্য মিথ্যা আর বিশ্বাস অবিশ্বাস বাদ দিয়ে পড়ালেখা করবে, মনে রেখো এই যুগে তুমি যে কাউকেই অন্ধ বিশ্বাস করলে ঠকে যাবে। আত্মবিশ্বাস বাড়াও, তবে সেটা শুধু নিজেকে নিয়ে! আসছি আপু…
বলেই আমি সেখান থেকে চলে আসার জন্য উদ্যত হলাম। মেয়েটা হয়তো আমার কথা বুঝেছে হয়তো বুঝেনি। তবে আমি বুঝেছিলাম এসব মিথ্যা চালবাজিও হতে পারে। কে জানে এই মেয়ে কে? হঠাৎই বা কেন তিয়াসকে নিয়ে প্রশংসার জন্য আগমন ঘটালো!
চলবে…
পর্বঃ ১৪
বাসায় এসে সোজা বিছানায় গিয়ে পড়লাম।
জানিনা আসলেই মেয়েটা তিয়াসের ব্যপারে সত্য বললো কিনা। কিন্তু আমার মাথায় কাজ করছেনা, যদি সে জীবনকে এতো মূল্যবান বলে মনে করে তাহলে সে মানুষকে এই ধরনের চিন্তা করাতে বাধ্য করে কেন? যেমনটা সে আমার সাথেও করেছিলো?
এমন অনেক মেয়ের সাথেই সে করেছে?
কেন করেছে? যদি এতোই বুঝে তাহলে নিজের দিকটা কেন বুঝেনা?
বহু বহুদিন ওরে নিয়ে আমি মাথা ঘামিয়েছি। এবার আমাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে সে আপনা আপনি আমাকে তার কার্যকলাপের পেছনের কারণ বলে। মা’কে ফোন করেও জানিয়ে দিলাম মা যেটা করতে বলেছিল আমি সেটাই করতে যাচ্ছি।
তারপর ফোন দিলাম রায়ান ভাইয়াকে।
আমার ফোন পেতেই উনি যেন হুশে এলেন, ভীষণ অভিমান জড়িয়ে এতো শত অভিযোগ ছুড়ে দিলো।
আমি নাকি উনাকে পাত্তা দেইনা,কথা বলিনা,ফোন ধরিনা, আরো অনেক ছেলেমানুষী কথা।
উনার সব কথার মধ্যে আমি বললাম,
___ আপনাকে নিয়ে বিয়ের কার্ড বানাবো। আপনার আর আমার বিয়ের!
আমার কথা শুনে থমথমে নিরবতা। হয়তো কথাটা উনি শুনলেও নিজে কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না। আমি জোরে হেসে উঠে বললাম,
___ আরে নাহ ভয় পাবেন না, সত্যি সত্যি বিয়ে না। আমরা বিয়ের মতো করে একটা আয়োজন করতে যাচ্ছি। যেখানে তিয়াসকে দুজন মিলে ইনভাইট করতে যাবো। আমার বিশ্বাস সে তারপর সবকিছু স্বীকার না করে পারবেনা। মানছি সে অনেক অপরাধ করেছে কিংবা অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে ঠকিয়েছে, তবে সে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকেই ভালোবাসে। নয়তো এভাবে ফিরে আসতোনা। আর ভালোবাসার হারানোর যন্ত্রণা কিন্তু নেশাক্ত দ্রব্যের চেয়েও ভয়ানক ক্ষতিকর, আর সেটার চূড়ান্ত পর্যায়ে দাঁড়িয়ে তিয়াস কিছুই লুকাতে পারবেনা। সত্যিটা তাকে বলতেই হবে। আমি আশা করি আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।
ওপাশ থেকে ঘন নিঃশ্বাস। কেমন যেন একটা ব্যথাতুর গলায় উনি বললেন,
___ আচ্ছা এরপর যদি জানতে পারো তিয়াসের এসব করার পেছনের কারণটা ক্ষমার যোগ্য কিংবা যৌক্তিক কিছু, তাহলে কি তুমি তাকেই মেনে নিবে?
আমি হেসে বললাম,
___ কোনটা যুক্তির হবে বলে ভাবছেন? ওর মধ্যে কিছুই যৌক্তিক নেই। মানুষের মন নিয়ে রঙ তামাশা করে জীবনের বেহাল পরিণতি করা কোনোভাবেই যৌক্তিক কিছু হতে পারে না। এখন বলেন আপনি আমার পাশে থাকবেন?
রায়ান ভাইয়া আস্তে আস্তে বললো,
___, আমি চিরকাল তোমার পাশে আছি এবং থাকবো।
আমি আমার ঠোঁটের উপরে অদেখা হাসিটা নিজে নিজেই অনূভব করে নিলাম। তারপর উনার ফোন কেটে শুয়ে পড়লাম।
দুইদিন পরে বাসার নিচে এসে রায়ান ভাইয়া আমাকে নামতে বললো। আমি কোনো রকম তারাহুরোর মধ্যে তৈরি হয়ে নিচে গেলাম। গিয়েই দেখি উনাকে যেমন বলেছিলাম উনি তেমন করেই মিথ্যে বিয়ের কার্ড বানিয়েছেন। খুব সুন্দর বানিয়েছেন, ডিজাইনটা ভীষণ ভালো লাগছে। আমি হাতে নিয়ে বললাম,
___ কয় কপি বানিয়েছেন?
উনি সামনে আগাতে আগাতে বললেন,
___ ৫০০ কপি।
আমি চমকে উঠে বললাম,
___ মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার? এতো কার্ড দিয়ে কি হবে? ৫০০ মানুষকে দিবেন নাকি? আর আপনি কি মানুষকে নিজের বিয়ের কথা বলে দিবেন? তাহলে তো মানুষ এসে দেখবে বিয়ের আয়োজনও নেই আর সেখানে বউও নেই। হাহাহাহা!
উনি আমার এইসব কথাকে কোনো পরোয়া না করে বললেন,
___ তিয়াসকে বলেছো তো কোথায় আসতে হবে?
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
___ হুম বলেছি, আর সে বলেছে আসবে। তারপর আমি আবার ব্লক করে দিয়েছি।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন একটা ভাবলেন তারপর একটা রিকশা ডাকলেন।
আগে আগে উঠে হাত বাড়িয়ে দিলেন আমি উঠার জন্য। আমিও কিছু না ভেবে হাতে ভর করে উঠে বসলাম।
একটা খোলা মাঠের পাশে সরু রাস্তা, এখানে মানুষজন তেমন দেখা যায়না। রায়ান ভাইয়া ইচ্ছে করেই এমন একটা জায়গা বাছাই করেছে। আমরা ওখানেই পৌঁছাতেই দেখলাম তিয়াস পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা একটা শার্ট পরে রেখেছে,বাতাসে সেটা বারবার ফুলে উঠছে।
কাছে যেতেই সে ফিরে তাকালো। আমার সাথে রায়ান ভাইয়াকে দেখে সে অবাক হলো। কেননা আমি দেখা করতে বলেছি শুধু, সাথে অন্য কেউ আসবে বলিনি।
আমি বিয়ের কার্ডটা ওর দিকে বাড়িয়ে বললাম,
___ আমাদের বিয়ে সামনে সোমবার, অবশ্যই আসবে।
তিয়াস আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে জোর করে একটা মুচকি হাসি দিলো আর কার্ডটা বাড়িয়ে নিলো। খোলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তারপর বললো,
___ প্রীলি এই কয়েকমাস ধরে তোমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। শুধু আমার সম্পর্কে তিক্ত সত্যিগুলো বলতে হবে বলে! কেন জানি বলতে ইচ্ছে করে না। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি সব বলবো। আমার এতকিছু করার পেছনের সবগুলো কারণ তোমাকে জানাবো। আমি সুযোগ নয় শুধু তোমার থেকে ক্ষমা পেতে চাই।
আমি আস্তে আস্তে তিয়াসের পাশে দাঁড়ালাম। রায়ান ভাইয়া পেছনেই। বাতাসের বেগ তীব্র বলে কথাগুলো ধাক্কা খাচ্ছিলো। আমি একটু জোরে জোরেই বললাম,
___, তুমি তো শুধু আমার কাছে অপরাধ করোনি । অনেকের সাথে অপরাধ করেছো। কি করে ভাবো সবার থেকে ক্ষমা পেতে পারো?
তিয়াস আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
___ কি করে ভাবি সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা কিন্তু! কিন্তু আমি তোমার কাছে ছাড়া আর কারো কাছে ক্ষমা চাইবোনা। আর আমি শুধু অপরাধী না,অনেক বড় অপরাধী। তুমি আমাকে যতটা খারাপ জেনেছো তার থেকেও আমি বেশি খারাপ।
আমি নিজেকে অনেক কষ্টে আটকে ধৈর্য্য নিয়ে বললাম,
___ কেন করো এসব?
তিয়াস আমার কথা শুনে ঘাসের উপর বসলো। ওর সাথে সাথে আমরা দুজনও বসলাম।
তিয়াস ধিরে ধিরে বলতে লাগলো,
___ আমার দাদাভাইয়ের দুই ছেলে ছিল। প্রথমজন আমার আব্বু আরেকজন আব্বুর থেকে অনেক বছরের ছোট, যাকে আমি ছোট পাপা বলে ডাকতাম। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, চাচা তখন কলেজে নতুন ভর্তি হয়েছে। ভীষণ মেধাবী ছিলেন উনি। আমার বাবা তো চাকরির জন্য আমাদেরকে তেমন সময় দিতে পারতেন না, অন্যদিকে দাদাভাই অসুস্থ ছিলেন, দাদু অনেক আগেই মারা গেছেন। তো আম্মু যখন বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকতেন ছোট পাপা আমাকে যত্ন করতেন, আমাকে খাওয়াতেনও তিনি।
আস্তে আস্তে আমি বড় হতে লাগলাম, যখন থেকে আমার পড়ালেখা শেখার বয়স হয়ে উঠেছে, আমি তখন থেকেই ছোট পাপার সাথে থাকতাম। তিনি এতো বেশি পড়ালেখা করতেন যে আমি বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে আম্মুর সাথে থাকার বায়না করতাম। কারণ উনার জোরে জোরে পড়ার জন্য ঘুমাতে পারতাম না। কিন্তু আম্মু বলতো উনার সাথে থাকলেই একসময় আমি এমন মেধাবী হয়ে উঠবো। কারণ ছোট পাপা আমাকে নিয়ে প্রতিদিন পড়তে বসতেন,পড়া শেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার অনুমতি দিতেন।
কিন্তু আমি ক্লাস ফাইভে উঠার পরে আর চাচা কলেজে যাওয়ার পরে সবকিছু উল্টো হতে থাকে। প্রথম চার পাঁচ মাস ভালোই ছিল কিন্তু এরপর সারাক্ষণ উনি আনমনা হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে দেখি ফিসফিস করে কার সাথে যেন কথা বলেন। আমি তখন এসব বুঝতাম না।
আমার মজা লাগতো কারণ তখন ছোট পাপা আমাকে পড়ার জন্য তোড়জোড় করতেন না। কারণ তিনি নিজেই পড়তেন না। দেড় বছর চলে গেলো, ফাইনালে ছোট পাপার রেজাল্ট শুনে সবাই হতবাক। কারণ তিনি ফেইল করেছেন। এরপর থেকে প্রায় রাতেই উনাকে মেয়েদের মতো মরা কান্না করতে দেখতাম, সারারাত বারান্দায় বসে কাটিয়ে দিতে দেখতাম। আব্বু একবার উনাকে অনেক মেরেছিলও,উনি নাকি নেশা করতেও শুরু করে দিয়েছিলেন। আম্মু উনার সাথে আমাকে আর থাকতে দিতে চাইতো না। কিন্তু আমি কেন জানি ছোট পাপাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না, হাত পা ছুড়ে কান্না জুড়ে দিতাম। তারপর বাধ্য হয়ে আমাকে উনারা দিয়ে আসতেন, কিন্তু অনেকদিনই আব্বু মাঝ রাতে কোলে করে উনার থেকে নিয়ে আসতেন।
কিন্তু সেদিন শনিবার, আমি সারারাতই ছোট পাপার সাথে ছিলাম। পাপা সেদিন ভীষণ চুপচাপ ছিল। কান্নাকাটিও করেননি। আমি উনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে ঘুম ভাঙতেই আমি বিকট চিৎকার করে উঠেছিলাম। কারণ ছোট পাপার মুখ থেকে রক্ত পড়ছিল, সারা শরীর পুরো ঠান্ডা হিম ছিল। আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম। তারপর সবাই এসে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো, আর ছোট পাপার জন্য কবর খুড়তে গেলো! হ্যাঁ সেদিন ছোট পাপা সুইসাইড করেছিলো!
তিয়াসের কণ্ঠে আর কোনো আওয়াজ আসছেনা। সে আওয়াজ করে করে কাঁদতেছে। আমি আস্তে আস্তে বললাম,
___ উনি কেন এমন করেছিলেন?
আমি প্রসঙ্গ টেনে বললাম,
___ তুমি এতো কিছু দেখে নিজে কেন এমন করো? যদি তোমার জন্য কারো এমন অবস্থা হয়?
তিয়াস আমার দিকে তাকিয়ে কান্নাভেজা চোখেই অদ্ভুত একটা হাসি দিলো। আর বললো,
___ এই দুনিয়ায় প্রতিটা কাজের সাথে মানুষ একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় মেতে থাকে, টাকা পয়সা বাদই দিলাম, কিন্তু শিক্ষার অর্জনে কেন আরেকজনকে দমাতে চায় বলোতো? জানো মেয়েটা ছোট পাপার সাথে কেন প্রেমের অভিনয় করেছিল? চাচাকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান নেওয়ার জন্য! হুহহহ এই প্রথম স্থান! সে ঠিকি নিতে পেরেছিল, মেয়েটা বাজিতে জিতেছিল কিন্তু শুধু রেজাল্টে নয় ছোট পাপাকে জীবনের কাছেও হারিয়ে দিয়েছিল সেই মেয়ে। আর আমার ছোট পাপা কোথাকার কোন মেয়ের জন্য সবকিছু ছেড়ে জীবন ত্যাগের কথাটাই ভেবে নিলো। একটাবার ভাবলোনা আমার কি হবে? আমি যে আমার আম্মু আব্বুর থেকেও বেশি উনাকে ভালোবাসতাম। তারপর আমার অসুস্থ দাদুটাও ছোট পাপার শোকে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো।
তারপর থেকেই আমি একটা শপথ নিয়েছিলাম, মানুষ কোন পর্যায়ে গেলে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয় সেটা দেখেই ছাড়বো। আর সেসময় থেকে অন্য রকম একটা প্রতিশোধের স্পৃহায় বেড়ে উঠছিলাম। তখন থেকেই আমি প্রথম স্থান জিনিসটা ঘৃণা করতে শিখি। আর সেই মানুষটার উপরে আমার কুদৃষ্টি ঠেকে যায়। আমি দেখতে চেয়েছিলাম সেই স্থান পরিবর্তন জিনিসটা কতটা ভালোবাসা বিসর্জনের পরে সম্ভব হয়।যখন সবকিছু শেষ করে ভালোবাসার মানুষটা চলে যায় তখন কেন সে ভাবেনা তাকে কষ্ট করে বড় করার পেছনে অসংখ্য মানুষের মায়া জড়িয়ে আছে, তার মা আছে আর বাবা আছে তার আত্মীয়স্বজনরা আছে। কিন্তু নাহহ আমি কাউকে পাইনি, সবাই ভেঙে যাওয়ার পড়েও উঠে দাঁড়িয়েছে, আমি তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছোট পাপাকে জোরে হাঁক পেড়ে ডেকে বলি, ছোট পাপা তুমি এতো বোকা ছিলে কেন? তুমি আর কয়েকটা বছর অপেক্ষা করতে, দেখতে ঠিকি তোমার জীবন বদলে গেছে, আর তুমিও বদলে গেছো, তখন একবার হলেও মন থেকে বলতে বেঁচে থাকা অনেক আনন্দের, অনেক আনন্দের!
প্রীলিয়া আমি কাউকে মারতে চাইনা, কিন্তু মানুষ চেনাতে চাই। চেনাতে চাই তার নিজেকে। বুঝাতে চাই ক্ষনিকের জন্য আসা মানুষটা ছাড়াও আমাদের জীবনে অনেক কিছু আছে, তোমাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। জানি তোমার ক্ষতি হবে, কষ্ট পাবে, কিন্তু ঠিকি তুমি মানুষকে অন্ধ বিশ্বাস থেকে নিজেকে পরবর্তীতে বিলীন করে দিবেনা। বুঝতে শিখবে বেঁচে থাকাটা একান্তই নিজের জন্য! হ্যাঁ আমি সফল হয়েছি,তুমি সফল হয়েছো,দীপ্তি সফল হয়েছে,আমার এমন উদ্ভট ফাঁদে পা রাখা প্রতিটা মেয়ে সফল হয়েছে। তারা বুঝতে শিখেছে জীবন এতটাও তুচ্ছ নয়, যেটা কিনা কোনো ফাউ মানুষের জন্য বিলিয়ে দেওয়া যায়। মচকায়েও তারা ভেঙে যায়নি। এই পৃথিবীতে নিজের প্রাণ দিয়ে দেওয়ার মতো জঘন্য কিছু আমার কাছে নেই। আমার ইচ্ছে করে সবাইকে বুঝাই, তোমার জীবন থেকে একটা মানুষ চলে গেলেই তুমি একা নও! শক্ত হও তুমি,প্রতারকের প্রতি ঘৃণা নিয়ে এগিয়ে যাও। তাকে তার উচিত জবাব দাও। আর হ্যাঁ একটা কথা, সেদিন রুহিকে আমিই বলেছিলাম তোমার বাবাকে খবর দিয়ে আনতে, তোমাকে বুঝাতে। আমি জানি তুমি পারতে, উঠে দাঁড়ানো তোমার দ্বারা সম্ভব।
তিয়াস শ্বাস ছেড়ে বললো,
___ হ্যাঁ আমি। প্রীলিয়া প্রেম প্রায় সবার জীবনেই আসে, আর প্রথম বিচ্ছেদে তারা ভেঙে পড়ে এবং প্রবলভাবে। সেই মানুষটা ছাড়া নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে করে। কারা করে জানো? তোমার মতো সহজ সরল আর পড়ায় গুজে থাকা মানুষরা। তারা সফল হয়েও এতটাই অভ্যাস্ত যে তারা হার মানতে পারেনা, প্রয়োজনে জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে। আমি না হয় এমন কয়েকটা মানুষের সাথেই প্রতারণা করে বুঝিয়ে দিলাম তুমি পৃথিবীতে বেঁচে থাকো, তুমি হেরে গিয়েই জিতে যাবে। তুমি একা নও, তোমার দিকে তাকিয়ে আছে তোমার পুরো পরিবার। এতটাই যোগ্য হও যখন এসব মানুষকে পিষে ফেলার ক্ষমতা রাখো। বিশ্বাস করো আমি ছোট পাপার মৃত্যুর পরে ভেবেছিলাম এভাবে আমিও কাউকে মৃত্যু দিবো। প্রতিশোধ নিবো, কিন্তু আমি বড় হয়ে বুঝেছি আমি ভুল প্রতিজ্ঞা নিচ্ছি, আমার এটা করা উচিত নয়।
তার চেয়ে বরং সেই তাড়নাটা অন্যভাবে প্রকাশ করি, কিছু মানুষকে বুঝাই তার জীবনের মূল্য! প্রীলি আমি জানি তুমি আমার কথার পরে বলবে আরেকজনের শাস্তি নির্দোষদেরকে কেন দিতে চাই?
কিন্তু বলো আমার ছোট পাপার সেদিন কি দোষ ছিল? কেন উনার সত্তাকে কেড়ে দিয়ে মৃত্যু উপহার দিলো? জনেবনে আমি এই প্রশ্ন ছুড়েছি কিন্তু এই জবাব আমি আজও পাইনি! একটা কথা জানো, ছেলেদের থেকে মেয়েরা শক্ত, ছেলেরা উঠে সহজে উঠে দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু মেয়েরা একটা সময়ের পরে ঠিকি পারে।
আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছিলাম। আমার কথা বলার মতো কোনো শক্তিও নেই।
তিয়াস আবার বলতে লাগলো,
___ রায়ান ভাইয়া ভীষণ ভালো। আমি তার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জেনেছি তার জীবনে প্রথম প্রেম তুমি। আমি খারাপ, ভীষণ খারাপ। জানিনা আমার ভেতর থেকে এসব তাড়না কবে বের হবে, আমি কবে শোধরাবো? কিন্তু সবকিছুর ভীড়ে এটা উপলব্ধি করেছি আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। দীপ্তির সাথে প্রথম অভিনয় শুরু করলেও তুমি ছিলে আমার প্রতারণার প্রথম মুখ। আমি তোমার সাথে মিশে থাকা দেড় বছর আজও ভীষণ মনে করি, তারপর এতোগুলো বছর তোমার শূন্যতায় শুধু তোমারই অস্তিত্ব খুঁজি! কিন্তু আমি তোমার যোগ্য নই। এভাবেই দূর থেকে এই অস্তিত্ব আঁকড়ে বেঁচে থাকবো। আমি পারবো!
কিন্তু রায়ান ভাইয়া পারবেনা!
এটা শুনে আমি চোখ ফিরিয়ে রায়ান ভাইয়ার দিকে তাকালাম আর চমকে উঠলাম।
চোখ কেন ভিজে উঠছিলো বুঝতে পারছিলাম না। তবে সেটা লুকানোর চেষ্টা করে মৃদু হেসে বললাম,
___ খুব ভালোবাসেন?
কিছুক্ষণ থমথমে নিরবতা। কোনো কথা বলছেননা তিনি। আস্তে আস্তে ডান হাতের দুই আঙুল দ্বারা ডায়েরির আরেকটা পাতা উল্টালো! আমি মনোযোগ নিক্ষিপ্ত চোখে আবার সেই লেখাটার উপর চোখ বুলালাম, সেখানে লেখা আছে….
‘””
স্থায়িত্ব প্রত্যাশিত জীবনে স্বচ্ছতার ঘাটতি সামান্যতর থেকেই যাবে! অল্প ভুল-ভ্রান্তি,অভিযোগ-অশান্তি,
ভিন্নতার হাতছানি হবেই নিয়মে অনিয়ম! তবে তার মধ্যেকার কঠিন সত্য সেটাই হবে, আমি তোমার।
ঠিক যেভাবে তুমি তোমার!
আমি তোমার মতো করেই এক জীবন তোমাকে জানতে চাই! তোমার রাগ,জেদ, অত্যাচারের প্রতিটা
স্পর্শ বুকে বিঁধে সেখানে ভালোবাসার স্বর্গ গড়তে চাই। তোমার দূর্বলতা,কাঠিন্যতা, মন্দদিক সবকিছু মেনে নিয়েও শুধু তোমাকেই জায়গা দিতে চাই এবং জায়গা নিতে চাই! ততটা প্রশস্ত জায়গা , যতটা হলে একদিন আমার শূন্যতায় তোমার হৃদকম্পন ধির হয়ে উঠবে, তোমার নিঃশ্বাসও আমার অস্তিত্ব খুঁজে যাবে রাতদুপুর! খুব গভীরতা থেকে তোমার ঠোঁটের কাঁপনে সেদিন ঝড়বে একটা বাক্য,
ভালোবাসি, তোমায় ভীষণ ভালোবাসি! “”
আমি টের পাচ্ছিলাম লেখাগুলো পড়তে পড়তেই আমার ঠোঁট কাঁপছে, হৃদয় নেড়ে যাচ্ছে অনূভুতিরা!
আমি আস্তে আস্তে উপরে তাকালাম, ঠিক চোখ বরাবর। ফিসফিস করে বললাম,
___ যদি এখন না পেয়ে কাল সকালে দরজার উপর রাখা কাগজটা পেতাম তাহলেও কি এখানে থাকতেন?
___ শুধু কাল পর্যন্ত না, যদি আরো দুইদিন চলে যেতো তাহলেও আমি অপেক্ষা করতাম! তবে জানি একদিনের বেশি অপেক্ষা করতে হবে না। তুমি ঠিক ঠিক আমার আহবানে শীগ্রই চলে আসবে!
আমি নিজের মুখ চেপে জোরে হেসে উঠে বললাম,
___রায়ান ভাইয়া আপনি কিন্তু ভীষণ আবেগ নিয়ে কথা বলেন। কিশোরে পা রাখা বাচ্চা ছেলেটা যখন প্রথম প্রেমে পড়ে তখন সিনেমা দেখে দেখে এই বাক্যগুলো মুখস্থ করে আর প্রেমিকাকে বলে নিজের দিকে দারস্থ করে ফেলে! এদিকে আমি একজন মাস্টার্স পড়ুয়া আর আপনি দেশের প্রথম শ্রেণির একজন সফল চাকুরীজীবি! আপনি কিনা এসব বলে এই বয়সে প্রেম করতে চান? এই বুড়া বয়সে? হাহাহাহা!
আমার হাসির তীব্রতা আরো বেড়ে গেলো। আমি এক হাত নিজের কোমরে আর অন্য হাত দিয়ে মুখ চেপে হেসেই যাচ্ছি। পাশের ছোট্ট দোকানটার পাশে একটা ল্যাম্পের আলো আমাদের দুজনের উপর।
প্রচন্ড হাসির মধ্যে একটা সময় আমি হঠাৎ নিরব গেলাম। ভীষণ অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে রায়ান ভাইয়া তাকিয়ে আছে। এক দৃষ্টি ভীষণ চুম্বকীয়! আমি জুবুথুবু দৃষ্টিতে নিজের দৃষ্টি নত করে বললাম,
___ আচ্ছা আমি বাসায় যাচ্ছি।
রায়ান ভাইয়া একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে আরেকটু এগিয়ে এসে বললো,
___ এখানে কেন ডেকেছি সেটাই জিজ্ঞাসা করলেনা প্রীলিয়া! আমাকে বুড়ো বলে হাসলে, আরো হাসতে পারতে তো! আমি মুগ্ধ হয়ে সারারাত এখানে দাঁড়িয়ে তোমার হাসি দেখে যেতাম!
আমি একটু রাগী গলায় বললাম,
___ভাইয়া আপনি আবার এসব বলছেন? আপনার সাথে এসব কথা যায়, বলুন?
উনি আরেকটু এগিয়ে আসলেন। আর আমি আরেকটু পিছিয়ে গেলাম। হাতটা বাড়িয়ে উদাস চেহেরায় বললো,
___ আমাকে বিয়ে করবে প্রীলিয়া?
আমি এবার প্রচন্ডভাবে রেগে গেলাম। সরে গিয়ে চেহেরাটা পুরো বাংলার পাঁচ করে বললাম,
___ এই সময় এটা কি করে বললেন? আপনি ভালো করেই জানেন আপনার স্বপ্নের সীমান্ত কতদূর! একটু আগেই না ডায়েরিতে পড়লাম আপনি আমার মতো করে আমাকে বুঝবেন, তাহলে এটা বুঝেন না আমি কখন বিয়ের কথা চিন্তা করবো?
বিনয় নিয়ে রায়ান ভাইয়া বলতে লাগলো,
___বলো এতদিন ধরে আমি তোমাকে ভালোবাসি সেটা প্রকাশ করেছি? কিংবা বুঝাতে চেয়েছি? তারপরও হয়তো বুঝেছো তুমি! কিন্তু আমি না বলে পারছিলাম না। আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে তোমাকে হারিয়ে ফেলি কিনা! আমি জানি তুমি ভীষণ কঠিন মনের, সেখানে আমার মতো একটা ছেলে এতো বছরেও কোনো পাত্তা পায়নি, তাতে অপরাধ করা একটা ছেলে দ্বিতীয়বার কোনো সুযোগ পাবেনা। কিন্তু তাও আমার ভীষণ ভয় করে প্রীলিয়া! তুমি আমার হবে তো? আমি তোমার জায়গায় কখনোই আর কাউকে ভাবতে পারবোনা, সত্যি বলছি তোমাকে না পেলে আমি এলোমেলো হয়ে যাবো। জানি এই কথাগুলোকে আবার আবেগ বলে হেসে উড়িয়ে দিবে, কিন্তু আমার এই বয়সটা আবেগের নয় প্রীলিয়া, এখানে ভুল করে কারো উপর মোহ জন্মায় না, যেটা কিনা পরবর্তীতে বদলে যাওয়ার। এখানে যেটা জন্মায়, সেটা সত্যিকার অর্থে কাউকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা যেটা পূরণ না হলে বাকি জীবন একা কাটিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞাও করে ফেলা যায়। তোমাকে না পেলে আমি বেঁচে থাকতে পারবোনা এমন নয়, কিন্তু একটা কিছুর মৃত্যু অবশ্যই হবে, সেটা আমার হৃদয়ের! প্রীলিয়া আমি তোমার জন্য আরো ১০০ বছর অপেক্ষা করতে রাজী, শুধু তুমি কথা দাও অন্য কারো হবে না?
কথাগুলো শুনতে শুনতে আমি পিছিয়ে যাচ্ছিলাম। দুচোখে মেঘেরডাক সাথে ঘুটঘুটে অন্ধকার, এখনি যেন শুরু হবে অঝোরে বৃষ্টিধারা!
আমি নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম না আমার ঠিক কি বলা উচিত! একদিকে আমি তিয়াসের সত্যটাও জানিনা, নুজহাতের সাথে হয়ে যাওয়া এতে বড় অপরাধ এখনো মাথায় চক্রাকারে ঘুরছে। কেন জানি মানুষকে বিশ্বাস করতে পারাটা আমার কাছে অসম্ভব লাগছে। না না আমি এমন কথা দিতে পারবোনা। আমি আর কোনো ভুল করবোনা। তার আগে আমি সন্ধান করে নিবো একটা নিখাঁদ সঠিক মানুষের। তড়িঘড়ি করে জীবনে অনেক ভুল করেছি, আর নয়। আগে নিজে প্রতিষ্ঠিত হই তারপর বাবা-মার মুখে হাসি টানাই তারপর বাকি জীবনটাতে আর কারোর দরকার আছে কিনা চিন্তা করবো!
তাকিয়ে দেখলাম রায়ান ভাইয়া আমার জবাব শুনতে অস্থিরতার সহিত তাকিয়ে আছেন। আমি মুখের উপরে বেয়ে উঠা চিনচিনে ঘামগুলো মুছে দিলাম আর স্পষ্ট গলায় বললাম,
___ কীভাবে কথা দিবো আমি? আজকে রাতেই যদি আমার মৃত্যু আসে তাহলে তো সারাজীবন আমাকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী বলে সংজ্ঞায়িত করবেন। তাছাড়া আমি যেহেতু নিজের ক্যারিয়ার গড়ার আগে বিয়ের কথা ভাবছিনা, সেহেতু এমন ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আমার অনেক সময় দরকার নিজের জন্যও আর মানুষ চেনার জন্যও! এতোদিন আপনি অপেক্ষা করতে হবে না, পরে দেখবেন বুড়ো হয়ে গেছেন,চুলে পাক ধরেছে, তখন কেউ আর তখন বিয়ে করছেনা।
___কেউ না করুক তুমি তো করবে প্রীলিয়া। আর তুমিও তো বুড়ি হয়ে যাবে তাইনা? তখন আমরা দুজন….
___প্লিজ ভাইয়া এমন উদ্ভট কথা বন্ধ করুন। আপনি সত্যি পাগল হয়ে গেছেন। যান এখন বাসায় যান। আমি কাল গ্রামের বাড়ি যাবো। গোছগাছ করতে হবে। রুমে যাচ্ছি।
বলেই আমি হাঁটা ধরলাম। তিনি পেছনে তাকিয়েই আছেন। হঠাৎ পেছন থেকে উনার গলায় জোরে জোরে বলতে শুনলাম,
___কিছু কিন্তু বললে না তুমি, আমাকে এখন এড়িয়ে যেতে পারলেও পরে কিন্তু পারবেনা। অনেক ভালোবাসি তোমায়।
আমি হাঁটার গতি কমালেও থামলাম না। কথাগুলো শুনে অজান্তেই একটুখানি হেসে সেখান থেকে চলে আসলাম। বাসার সামনে আসতেই মনে হলো আমার ডিম কেনার কথা ছিলো, সেখানে কিনা কিনে আনলাম হারিয়ে যাওয়া ভিন্ন রকম অনূভুতি!
দোকান থেকে দুইটা ডিম নিয়ে উপরে উঠলাম।
সেদিন রাতটা অদ্ভুতভাবে কেটে গেলো। জানিনা কেন কিছু দুঃখ আর কিছু অন্য রকম সুখ মানুষকে ভালো করে ঘুমাতে দেয়না।
সকাল সকাল তৈরি হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে দিলাম। ট্রেনের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। এতো সকালে চারপাশে মানুষজনও বেশি নাই, যখন বাসা থেকে বের হয়েছিলাম রাস্তায় দু একজনকে হাঁটতে বের হওয়া ছাড়া কাউকে দেখিনি।
ট্রেনে বসেও গতকাল সন্ধ্যার পরে রায়ান ভাইয়ার সাথে ঘটে যাওয়া কথাগুলো ভাবছিলাম। ট্রেনটা বিকট হর্ণের সাথে ধিরে ধিরে সামনে আগাচ্ছে, এমনি জানালার ওপাশে রায়ান ভাইয়াকে হঠাৎ দেখে চমকে উঠলাম। হাত নাড়িয়ে আমাকে টাটা দিচ্ছে।
আমি যতক্ষণ দেখা যায় পেছন দিকে তাকিয়েই রইলাম। এর মধ্যে জায়গাটা পার হয়ে গেলো আর উনার দাঁত বের করে সুপ্ত হাসি মুখটাও অদৃশ্য হয়ে গেলো। আজকে সকালের ট্রেনে বাড়ি যাবো শুনেছিল বলে মানুষটা এতো সকালে ঘুম থেকে উঠে আমাকে বিদায় জানাতে এলো? সত্যিই কি এই ভালোবাসায় কোনো খাঁদ থাকতে পারে?
স্টেশনে পৌঁছাতেই ছোট ভাইকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরলাম। আমি ভালো করেই জানি সে গিফট পাওয়ার জন্য আগে আগে এসে হাজির হয়েছে।
আমি ওর জন্য নিয়ে আসা শার্টটা হাতে ধরিয়ে বললাম,
___ কিরে বাবা কোথায়?
সে প্যাকেটটা খুলতে খুলতে বললো,
___ বাবা জমিতে কি যেন সমস্যা হয়েছে, সেটা নিয়ে সকাল থেকে পর্যবেক্ষণ করছে।
বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই দূর থেকে স্পষ্ট দেখছিলাম মা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখতে পাওয়ার পর উনি আরো এগিয়ে আসছে।
দেখেই একটা দৌঁড়ে মাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিলো। খুব তারাতাড়ি করেই এগিয়ে গেলাম। মা কাছে এসেই আমার হাতব্যাগটাও টেনে নিলো, কাঁদো কাঁদো স্বরে আমাকে হালকা জড়িয়ে ধরে বললো,
___, আমার লিয়া মা! রাস্তায় কোনো সমস্যা হয়নি তো মনা?
আমি মাথায় হাত রেখে বললাম,
___ না মা, একদম কোনো সমস্যা হয়নি। ব্যাগটা আমাকেই দাওনা।
মা নাছোরবান্দা, উনিই নিয়ে যাবে। আমি আর মানা করিনি। এদিকে আবার বাড়ির সামনে আসতেই দাদু গুটি গুটি পায়ে এসে খুশিতে কেঁদে উঠলো। দাদু আমার কাছে একটা অন্য রকম ভালোবাসা। আজ পর্যন্ত যতবার আমি বাড়িতে আসি ততবার খুশিতে তিনি কেঁদে বুক ভাসাবেন। জানিনা এই মানুষটা আমার সফলতা কখনো দেখতে পারবেন কিনা, তবে মা-বাবার চেয়ে উনিও কম খুশি হবেন না। এখনি উনি উনার বয়সী লোকেদের সাথে নিজের নাতনীর ভয়ানক প্রশংসায় মেতে উঠেন। সেসময় উনার মুখের হাসিটা আমাকে নিজের উপর ভীষণ তৃপ্ত করে! আর তখন আমার স্বপ্ন দেখার মাত্রাও বেড়ে যায় বহুগুণে! দাদু তিয়াসের ব্যাপারে শোনার পর থেকে আমার বিয়ে নিয়ে আর বায়না করেন না।
তিনি বুঝতে পারছেন উনার যুগের সহজ সরল দেখতে সাদাসিধে আর বিশ্বাসযোগ্য স্বভাবের মানুষগুলো এই যুগে আর নেই। এখন একেকটা ভালো রূপের আড়ালে লুকিয়ে থাকে অসংখ্য কালো রূপ!
ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আগে খেয়ে নিলাম। অনেকদিন পরে মায়ের হাতের রান্না,আহ! প্রতিবার আসার সময় ইচ্ছে করেই কিছু খেয়ে আসিনা, মায়ের হাতের রান্না খাবো বলে! তারপর খাবারের নিয়ম ভেঙে দিয়ে একদম গলা পর্যন্ত খাই।
খেয়েদেয়ে তেলের বোতলটা নিয়ে মা’কে বললাম মাথায় তেল দিয়ে দিতে। এটা মা’কে পেলেই একটা রোজকার বাহানা। তেল না হোক হাত বুলিয়ে অন্তত দিতে হবে।
মা হাসিমুখে মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে তেল নিয়ে মাথায় লাগাচ্ছেন। হঠাৎ করেই মা একটু থেমে বললো,
___ ভার্সিটির কোন সিনিয়র ভাইকে তুই পছন্দ করিস আমাদেরকে তো বললিনা।
আমি হঠাৎ আৎকে উঠে ফিরে তাকালাম আর বললাম,
___ এসব কে বললো তোমায়?
___ ওই যে তোর নীরা ভাবী বললো । তিয়াস ওরে বলছে নাকি। নীরা এটাও বললো, তিয়াস নাকি এটা জেনে অনেক দুঃখে আছে। হ্যাঁরে ছেলেটা খুব ভালো বুঝি?
আমি মুখ ফিরিয়ে বললাম,
___ মা তেমন কিছুই না। তবে উনি অনেকদিন ধরে আমাকে পছন্দ করেন। আমি পাত্তা দিতাম না, ভেবেছিলাম সেটা শুধুই ভালো লাগা, আর কয়েকদিন পরে কেটে যাবে। কিন্তু কাল জানলাম উনি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন। তবে তুমি তো জানো আমার এখন এসবে কোনো ইন্টারেস্ট নেই। তাছাড়া আমি তিয়াসের ব্যাপারে ভীষণ দোটানায়। সে ইচ্ছে করে এমন করছে নাকি এর পেছনে অন্য কোনো গুরুতর কারণ আছে! আমাকে জানতেই হবে মা, সে অনেক অপরাধ করেছে। কিন্তু কি করে জানবো সেটাই বুঝতে পারছি না। তাইতো বাড়ি আসলাম।
আমার কথা শুনে মা একটা উৎফুল্লের হাসি হেসে বললো,
___ লিয়া আমার কাছে দুর্দান্ত একটা উপায় আছে।
মা’র কথা শুনে আমার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো, আবারও মুখ ফিরিয়ে জানতে চাইলাম,
___ মা কি সেই উপায়?
তিয়াসকে নিয়ে আমার মধ্যে যে খারাপ ভাবনা ছিল, সে তার সীমান্তও অতক্রম করে ফেলেছে। অনেক বেশি অপরাধী সে!
আমি নুজহাতের কথার প্রতিত্তোরে বললাম,
___নুজহাত তুই এসব কোথা থেকে জেনেছিস? তোর আর সা’দের মধ্যে তিয়াস কেন আসবে? এতে ওর কি ফায়দা?
নুজহাত গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
___ জানিনা আমি! কিন্তু তিয়াসের জন্যই সব হয়েছে। সা’দ তিয়াসের সাথেই চলাফেরা করে। তো তার চরিত্র তো ওর মতোই বানাবে নাকি?
আমি থেমে বললাম,
___ নুজহাত কান্না করিস না। আমি এর সত্যতা যাচাই করে নিবো যে করেই হোক। তারপর তিয়াস আর সা’দকে আমি অবশ্যই সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। শুন তুই ঘরে বসে থাকবিনা। চাকরি খুঁজে নে, মেয়েদের জন্য অসংখ্য কর্মসংস্থান আছে। নইলে গার্মেন্টসে যাবি, তবুও আত্মনির্ভরশীল হবি। বুঝেছিস আমার কথা?
নুজহাত বললো,
___ অবশ্যই হতে হবে। নিজের জন্য না হোক আমার সন্তানের জন্য আমাকে পারতে হবে।
আমি ফোনটা রেখে জোরে জোরে দুইটা নিঃশ্বাস ফেললাম।
রাত এগারোটার দিকে ফোন দিলাম দীপ্তিকে। প্রথমেই কুশল বিনিময় তারপর বললাম নাম্বার কোথায় পেলাম। রায়ানের সাথে আমার পরিচয় আছে শুনে সে প্রথমে একটু অবাক হলো। তারপর আমি তিয়াসের ব্যপারে কোনো কথা তোলার আগেই সে ক্ষমা চাইতে লাগলো, অনুনয় করে বলতে লাগলো,
___হঠাৎ তুমিও হারিয়ে গেলে, আর আমিও চলে আসলাম। তাই ক্ষমা চাওয়াটা হয়ে উঠেনি। সত্যি বলতে আমরা দুজনেই একই মানুষের প্রতারণার স্বীকার। তাই জানিনা তোমার কাছে আমি কীভাবে ক্ষমা চাইবো? কিন্তু ক্ষমা চাওয়াটা অনিবার্য মনে করি কারণ তিয়াস আমার নাম দিয়ে তোমার সাথে প্রতারণা করেছিল। সে বলেছিলো সে আমার জন্য এসব করেছে। কিন্তু সত্যি এটাই আমি এই সম্পর্কে কিচ্ছু জানতাম না।
আমি ধিরে ধিরে বললাম,
___ তার মানে তিয়াস পরবর্তীতে সত্যি তোমাকে ঠকিয়েছে?
___হ্যাঁ লিয়া। সে ভীষণ নিখুঁতভাবে মানুষকে ঠকায়। প্রথমে এতটা বিশ্বস্ত হয়ে উঠে যতটা কেউ পরিবারকেও করে না। তারপর সে সুযোগ বুঝে ঠকায়। তিয়াসের বাবার চাকরির ট্রান্সপারেন্ট যখন চট্রগ্রামে, তখন সে এইটে এসে আমাদের ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। তখন থেকেই সে আমার সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলে। সে এসে আমাকে সবসময়ই ক্লাসে প্রথম স্থানে দেখেছে। তবে সেও ভালো ছাত্র বটে। তারপর আমাদের বন্ধুত্বটা কলেজেও ছিল। তবে তিয়াস ক্লাসে অনিয়মিত ছিল, যার জন্য সেটা তেমন কারোরই চোখে পড়েনি। সেটা ছাড়াও কথাবার্তা কম বলতাম, মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়টা ভীষণই কম জানোই তো। তবে কলেজের প্রথম দিকে একদিন আমি ওর সাথে তোমার ব্যপারে বলেছিলাম, তখন ক্লাসে তুমি সবার নজরে ছিলে। এরপর তোমার হঠাৎ পরিবর্তন, ক্লাসেও আসোনা, আর পরিক্ষাতেও কোনো কম্পিটেশন রাখো না। আমি খুশিই ছিলাম, কারণ আমার প্রথম স্থানটার মধ্যে আর কাউকে আসার সম্ভাবনা দেখছিলামনা। এরপর এভাবেই চলে গেলো সেই বছর। চেয়েছিলাম পরিক্ষার পরে একসাথে তিয়াস আর আমি মন বিনিময় করবো,অনূভুতি প্রকাশ করবো। কিন্তু নির্বাচনী পরিক্ষার আগেই সেটা করে ফেলার প্লানিং করে। আরে হ্যাঁ তোমার সামনেই তো করেছিলো।
এরপর আমাকে ইম্প্রেশন করার যাবতীয় কার্যকলাপ করতে থাকে। তাকে ভীষণভাবে ভালোবেসে ফেলি, কিন্তু এরপরেই আমার একটা কাছের বন্ধুর থেকে জানতে পারি তিয়াস লিয়ার সাথে মানে তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করেছে। সেটার বিষয়ে তিয়াসকে জিজ্ঞাসা করতে যাওয়ার পরে সে বললো, তোমাকে নাকি এতোদিনে ভালোবেসে ফেলেছে। তোমার শূন্যতা ওর পুরো অস্তিত্ব ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।
দীপ্তির এই কথা পর্যন্ত থামিয়ে দিয়ে বললাম,
___ তোমাকে সে এই কথা বলেছে? এদিকে তুমি জানো সে নুজহাতের সাথে কি করেছে? সা’দ আর নুজহাতকে নিজের হাতে মিলিয়ে দিয়ে এখন সে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ টানিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে আমাকে বলেছে তোমাকে ভালোবাসে, আর তোমাকে বলেছে আমাকে ভালোবাসে। তাকে নিয়ে আসলে কিছু বলার ভাষা নেই, পুরো চরিত্রহীন একটা!
___ আমারও তাই মনে লিয়া। আমি বিদেশে এসেও ওর এমন অনেক কুকর্মের কথা শুনেছি। সে মেধাবীদের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। তারপর পরিক্ষার আগে আগে এমন একটা কান্ড করে যে তারা সারা বছর যেই ফলাফল আশা করে, তার কাছেও যেতে পারে না! আমি জানিনা এসবের রহস্য কি? কিংবা কেন করে!?
___ আমিও জানিনা। আচ্ছা শুনো আরেকদিন কথা হবে। ভালো থাকবে কেমন? আজকে নুজহাতের কথা শুনে ভীষণ খারাপ লাগছে!
___ আচ্ছা ঠিকাছে, তুমিও ভালো থাকবে লিয়া।
লাইনটা কেটে দিলাম। তবে আমার ভাবনার ঘোর এখনো কাটছেনা। সত্যিই সে এমন কেন করে?
ওর মা বাবা তো খুব ভালো। সে ভালো ভালো ভাব নিয়ে মানুষের সাথে প্রতারণা করে কেন?বছর বছর একটা মানুষের সাথে মেলামেশা করে, এরপর তার বিশ্বাস জুগিয়ে তারপরই কেন এমন প্রতারণা করে?
যদি মেয়েদের প্রতি ওর বেশিই ইন্টারেস্ট থাকে, সে চাইলে সে ধরনের মেয়েদের সাথেই টাইম পাস করতে পারে! কিন্তু ভালো ভালো মেয়েদের পেছনে কেন ছুটে?
সত্যিই ওর এই কাজের উপরে আমার মতো মানুষ চিন্তা করলে মাথা একদম বরবাদ হয়ে যাবে। তার চেয়ে কৌশলে ওর নিজের মুখ থেকেই শুনে নিতে হবে আসল সত্যিটা কি!
‘
‘
সপ্তাহখানেক পরে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়িতে গিয়ে দুইদিন থাকবো। এসব চিন্তায় চিন্তায় আমার দিনক্ষণ সব এলোমেলো। এতদিন আমার সাথে হয়ে যাওয়া এতকিছুর জন্য তিয়াসের বিষয়ে সিরিয়াস ছিলাম না, কিন্তু সে নুজহাতের সাথে কেন এমন করলো? নুজহাত তো এখন চাইলেই সহজে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারবেনা। তারপর একটা বাচ্চার মা!
এদিকে তিয়াসকেও আশেপাশে দেখিনা আর এসব সত্য জানার কোনো রাস্তাও পাইনা।
পরেরদিন বাড়িতে যাবো মা’কে জানিয়ে দিয়েছি। মা ভীষণ খুশি, আমার জন্য কি কি রান্না করবে সেগুলো আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। আমি বিন্নি ভাতের সঙ্গে বোয়াল মাছের ভাজা পছন্দ করি বলে মা প্রতিবার গেলেই সেটা একবার হলেও রান্না করে খাওয়াবে। আর বাবা সারা গ্রামের জেলেদের বলে রাখে বোয়াল মাছ পেলেই যেন বাবাকে খবর দেয়!
বাবাও বারবার ফোন দিয়ে বলছে স্টেশন পৌঁছেই যেন জানাই।
বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবতেই মনটা ফুরফুরা লাগছিলো।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, মাগরিবের নামাজের পরে বসে ভাবছিলাম কি রান্না করা যায়?
যদি এখন নতুন কোনো তরকারি রান্না করি তাহলে সেটা থেকে যাবে। কেননা কাল সকালের ট্রেনেই চলে যাবো। আর তাছাড়া এখন বাসায় ডিমও নেই।
প্রথম ভাবলাম পাশের রুমের আন্টি থেকে চেয়ে আনবো, কিন্তু পরে ভাবলাম . নাহ নিচে গিয়ে কিনে নিয়ে আসি।
যেই ভাবা সেই কাজ। চুলগুলো ঠিক করে, মাথায় ছোট করে ওড়না টেনে দরজা খোললাম।
দরজা খোলার সাথে সাথে দরজার সামনে একটা কাগজ পড়লো, আমি সেটাকে হাতে নিলাম।
চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের বিস্তার এখানের হাতের লেখায়, আমি প্রথমে অবাক হয়ে লেখাগুলো দেখছিলাম। তারপরেই খেয়াল করে লেখাগুলো পড়তে লাগলাম, লেখা আছে..
“”ক্লান্তি আর কিছুটা গ্লানিবোধে দরজার কপাট খুলে বিস্মিত চোখে এই টুকরোটা উঠিয়ে নিবে! কেন নিবে কীভাবে নিবে অথবা কি ভেবে নিবে জানিনা। তবে এখানে কি আছে সেটা দেখার আগে আস্তে আস্তে মাথার উপরের ওড়না ঠিক থাকলেও আবার ঠিক করে নিবে, এটা তোমার মতো ভদ্র মেয়েদের একটা চিরস্থায়ী চিত্র! বিকাল, সন্ধ্যা, রাত কিংবা সকাল, কখন এই চিরকুটে তোমার স্পর্শ পড়বে সেটা বলতে পারবোনা, তবে বলবো যখনি পাবে চলে আসবে উত্তরে লেকের পাড়, আমি অপেক্ষমান! “”
আমি কিছুক্ষণ কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর কি ভেবে মিটমিট করে হাসলাম। দরজার উপরে লক করে আস্তে আস্তে পা বাড়ালাম লেকের পাড়ের দিকে। খুব বেশি দূরে নয়, বাসার বারান্দা থেকে এর একটা কর্ণার দেখা যায়।
ডিম কেনার কথা এই মূহুর্তে আর মনে নেই।
ধির পায়ে এগুচ্ছি। ভেতরে ভিন্ন একটা কম্পন। ঠিক ষোলো থেকে আঠারো বছর একটা মেয়ের জীবনে প্রথম যে অনূভুতি জাগ্রত হয়!
বারবার মাথায় ওড়নাটা টেনে ঠিক করছি। জানিনা কাগজের লেখাটার জন্যই কিনা ওড়নার দিকে এতো মনোযোগ!
লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে পূর্ব পাশে কিছুই দেখলাম না। পশ্চিমেও না, তারপর উত্তরেও কিছু দেখলাম না।
দক্ষিণে তাকাতে যাবো তখনি চমকে উঠলাম। একদম আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে কালো রঙের পাঞ্জাবী পরা একটা মানুষ। চোখে চিকন ফ্রেমের একটা চশমা, বাম হাতের বদলে ডান হাতে পাঞ্জাবীর সাথে মিল রেখে কালো একটা ঘড়ি!
তার হাতে আমার জন্য একটা একটা খোলা ডায়েরি যেখানে আমার জন্য লেখা আছে একটা কবিতা!
আমি আবারও সেই লেখার মাঝে ডুবে গেলাম, লেখা আছে…
‘ উষ্ণতার বৈচিত্র্য টের পাইনি, তবে স্বচ্ছতার আগুনে পুড়ে ছাই হই রোজ!
বলতে পারো তোমার মাঝে কি আছে?
ফাল্গুনের মোহনায় কবিতা না সাজায়েও, তোমাকে ভেবে সহস্ররূপে আঁকিবুঁকি টানি!
কীভাবে টানতে পারো এতো কাছে?
We use cookies to ensure that we give you the best experience on our website. If you continue to use this site we will assume that you are happy with it.Ok