Tuesday, December 16, 2025
Home Blog Page 6

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (১০ম পর্ব) লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

0

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (১০ম পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

আমার মা তাহলে একদম ঠিক বলেছিল, যে একবার মন ভেঙে মজা পায় সে বারবার সেটা করতে পারে এবং সবার সাথে!

তারপরেও আবার অন্য রকম একটা ভাবনা থেকে রায়ান ভাইয়াকে বলে বসলাম,
___আপনি ওর সম্পর্কে ঠিকঠাক বলছেন তো?

আমার কথা শুনে উনি হা হয়ে গেলেন। বিমর্ষ চোখে বললেন,
___ আমাকে কি তোমার কোনো কারণে অবিশ্বাসী বলে মনে হয়? ওর সম্পর্কে মিথ্যে বললে আমার কোনো লাভ আছে? লিয়া আমি তোমাকে এখানে ওর সম্পর্কে জানা সত্যটা জানাতে চেয়েছিলাম, আর তুমি কিনা আমাকেই অবিশ্বাস করছো?

আমি থতমত করতে করতে বললাম,
___ আরে আরে শুনেন! আমি আপনাকে অবিশ্বাস করছি কোথায়? আমি বলতে চাচ্ছি দীপ্তি যা বলেছে আর আপনি যা জেনেছেন তা সঠিক কিনা? কেননা তিয়াস আমার সামনে বলেছিল দীপ্তি ওর জীবন, দীপ্তির জন্য সে সব করতে পারে!

___আচ্ছা দীপ্তির সাথে কথা বলতে চাও? এখন অবশ্য অফলাইনে সে। তুমি রাতে ফোন দিও, আমি নাম্বার দিচ্ছি।

আমি ফোনটা খুলে ওর নাম্বার নিলাম। তারপর আস্তে আস্তে বললাম,
___ আসলে আমার কথায় আপনি কিছু মনে করলে আমি দুঃখিত। এই রং মাখানো দুনিয়ায় সাদাকালোর তফাৎ বুঝা ভীষণ কঠিন জানেন তো? এরপর আবার মানুষের উপর ভরসা করাটা তো ভাবা-ই যায়না।

রায়ান ভাইয়া আমার দিকে মাথা নেড়ে নেড়ে বললো,
___ হুম হুম! বুঝতে পারছি। তোমার বিশ্বাস লুণ্ঠন হয়েছিল, আর তাই কারো প্রতি খুব সহজে বিশ্বাস জন্মায় না। এমনও হয় তুমি কারো অনূভুতিও বুঝতে পারোনা। ভীষণ কঠিন হয়ে গেছো তাইতো? আচ্ছা সময় হলে ঠিক বেঠিক স্পষ্ট হয়ে যাবে। সাথে মানুষও চিনে যাবে। এখন চলো এক কাপ কফি খাওয়া যাক। এই প্রথমবার ক্যাম্পাস ছাড়া অন্য কোথাও আমাদের দেখা।

আমি না সূচক ভঙ্গিতে বললাম,
___ আজ নয়৷ অন্যদিন খাবো। আচ্ছা আপনি আমার একটা উপকার করতে পারবেন?

সাথে সাথে উনার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বললেন,
___ কি উপকার বলো? আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।

___ আপনি কাল কি ব্যস্ত থাকবেন?

___ হ্যাঁ সকাল ১১ টা থেকে বিকাল পর্যন্ত ব্যস্ত থাকবো।

___ তাহলে চলবে। আপনি কাল সকালে আমার সাথে কোচিংয়ে যাবেন। মানে সেখানে আমাকে পৌঁছে দিবেন। তিয়াস কাল থেকে জয়েন করার কথা। আমি জানিনা আসবে কিনা, তবে আসলে যাতে দেখে তার চক্রান্ত ভেস্তে গেছে! এখন চলুন ফেরা যাক।

তিনি সানগ্লাসটা ঠিকঠাক করে, হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললো,
___ আচ্ছা তুমিই তো ওকে আমার ব্যপারে এতোকিছু বললে! কেন বলেছো প্রীলিয়া?

আমি হাতব্যাগটার উপর হাতটা কাচুমাচু করে সামনে এগিয়ে বললাম,
___ এসব পরে বলবো। এখন চলেন, কাল দেখা হবে।

উনি হেসে ডানদিকে নিজের গন্তব্যে রওয়ানা দিলো, আমি বামদিকে নিজের গন্তব্যে!

বাসায় পৌঁছে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে বিছানার উপর ধপাস করে বসে পড়লাম। অতীত যা ছিল তা বর্তমানে কেন প্রভাব বিস্তার করছে? কেন তিয়াস আবার এমন করছে? সে আসলেই কি এতটা খারাপ,যতটা আমি জেনেছি? নাকি তার চেয়েও বেশি খারাপ? অসংখ্য মেয়ের সাথে প্রতারণা করে থাকলেও শেষ পর্যন্ত সে আমাকেই কেন চায়? আমাকে পাওয়ার পেছনে তার কেমন স্বার্থ জড়িয়ে আছে? আর সে যে শোধরায় নি সেটা আমি ওদের বাসায় অপমানিত হয়েই বুঝেছিলাম। কিন্তু সে আমাকে দেখে এতটা ভালো হয়ে যাওয়ার চেষ্টা কেন করছে?আমি কি করে সত্যিটা জানবো?
তিয়াস নিজের মুখে কখনোই পুরো সত্যিটা জানাবেনা। তাছাড়া তিয়াসের মধ্যে মিথ্যে বলার ভয়ানক অভ্যাস আছে। নাহলে কি করে রায়ান ভাইয়াকে আমার সম্পর্কে আজেবাজে কথা বললো?
ওর মুখ থেকে কিছু শুনতে চাইলে সে নিশ্চিত আবার নতুন ছল করবে!

কিন্তু আমার মাথায় বহু পূর্বে তিয়াসের একটা ভালো মানুষি কাজ মাথায় ঘুরপাক খায়। যেটা ছিল নুজহাতকে সা’দের পরিবারের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া।
তার কাছে ভালোবাসার মূল্য না থাকলে সে ওইদিন এটা কেন করেছিল?
আমি নিজের মাথা চাপড়ে নিজেকেই বললাম,
কিসের মেধাবী আমি? মানুষ পড়তে জানিনা। মানুষ চেনায় অজ্ঞতা নিয়ে আমি এতো দূর এসেও কি করতে পেরেছি?
না না বহুত পড়ালেখা শিখেছি। এবার থেকে ভিন্ন রকম শিক্ষা অর্জন করতে হবে। আর আমি এখন এমন একটা পর্যায়ে আছি, যেখানে কেউ আসুক কিংবা চলে যাক আমার হৃদয়ে বিঁধবেনা। তাই হাজার কোটি মানুষের ভীড়ে সঠিক বলতে কোনো শব্দ আছে কিনা সেটা খুঁজে বের করতে হবে!

পরেরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রান্না করে খেয়েদেয়ে তারপর রায়ান ভাইয়াকে থাকতে বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।
গিয়ে দেখলাম উনি রাস্তার মোড়ে আমার আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি এগিয়ে এসে তারপর উনার সাথে হাঁটা ধরলাম। কারো সাথে পায়ে পা মিলিয়ে একসাথে বহুদিন পরে হাঁটছি। কিছুক্ষণ গিয়ে কোচিংয়ের মোড়ে আসতেই যা ভেবেছিলাম তাই দেখলাম। তিয়াসকে দূরে দেখা যাচ্ছে।
আমি আস্তে আস্তে রায়ান ভাইয়ার আরেকটু কাছে ঘেঁষলাম। আরেকটু আগাতেই বামহাতে উনার হাতের আঙুলে ধরে পায়ের তাল ঠিক রেখেই এগুতে লাগলাম।
উনি হঠাৎ হাতে ধরাতে অবাক হলেন। নিচে হাতের দিকে তাকিয়ে উনিও হাতটা ধরলেন আর সরল একটা হাসিতে বললেন,
___প্রীলিয়া সেসময় তিয়াসের সাথে সত্যের মধ্যেই অভিনয় ছিল। কিন্তু এই সময় আমার সাথে এই অভিনয়টা কি সত্যি সত্যি মন থেকে হতে পারে না? আমি সত্যিকার..

মুখের কথা আটকে হাত ছেড়ে দিয়ে আমি চোখ ইশারা করে ফিসফিস করে বললাম,
___ এই এই দেখেন তিয়াস চলে যাচ্ছে। নিশ্চিত ওর কলিজায় আগুন ধরে গেছে!

উনি তাকিয়ে দেখলেন তিয়াস চলে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই বললেন না। আমি হাসিমুখে উনাকে ধন্যবাদ জানাতে জানাতে ক্লাসে প্রবেশ করলাম।
তিয়াস আর ভেতরে আসেনি। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে গতকাল ওর বলা মিথ্যে আমার কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। এসে কি জবাব দিবে সেটা ভেবেই হয়তো চলে গেছে।

সেদিনটা স্বাভাবিক চলে গেলো। এর মধ্যে আরো ৪-৫ দিন চলে গেলো। মাঝে মাঝে খেয়াল করি তিয়াস দূর থেকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কাছে আসার সাহস পায়না। এখন কোনো কথা আছে বলেও বাহানা করে না। আমি আশেপাশে দেখলেই না দেখার ভান করে নিজের মতো করে কাজ করে যাই।
রায়ান ভাইয়ার সাথেও কথা বলিনা। উনি ফোন দিলেও রিসিভ করিনা, যদিও করি তাহলে বিভিন্ন ব্যস্ততার অজুহাত দেখাই। সত্যি বলতে আমি চাইনা উনাকে কোনো রকম ভরসা দিতে। যদি কখনো এমন হয় আমি কথা রাখতে পারলাম না, তাহলে আমিও তো তিয়াসের মতো প্রতারকের খাতারে চলে যাবো। তার চেয়ে ভালো সময় হলে আপন করে নিবো, ভালো লাগা ভেতরেই থাকুক। প্রকাশ করার চেয়ে গোপন অনূভুতির তীব্রতা বেশি!

সেদিন ছিল ছুটির দিন। সারাদিন বাসাতেই বই নিয়ে বসে ছিলাম। এর মধ্যে বাবা মাকে বারবার ফোন করে পাগল করে দিচ্ছিলাম। প্রতিটা ছুটির দিনেই আমি একটু পর পর উনাদেরকে ফোন দেই। কেন জানি এতো কথা বলেও কথা বলতে শুধু ভালোই লাগে। ভাবছি খুব তারাতাড়ি উনাদেরকে আমার কাছে নিয়ে আসবো।
সন্ধ্যার পরেরদিকে আমি পড়ছিলাম, হঠাৎই নুজহাতের ফোন আসলো। আমি বই বন্ধ করে ফোন রিসিভ করে গলা ছেড়ে বললাম,
___ কিরে বাচ্চার মা, ভালো আছিস তো?

উত্তরে নুজহাতের ভাঙা গলা স্পষ্ট শুনতে পেলাম। নুজহাত কেঁদে কেঁদে বললো,
___সা’দ আরেকটা বিয়ে করে ফেলেছে লিয়া। বিয়ে নাকি আরো দেড় বছর আগেই করছে। আমি এতোদিনে জানতে পারছি!

আমি চমকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আতংকিত হয়ে বললাম,
___ কাকে বিয়ে করছে? আর তুই এখনো ওর বিরুদ্ধে মামলা করছিস না কেন? তোদের একটা বাচ্চা আছে, সে কি করে এরপর আরেকটা বিয়ে করে? আমি হলে খুন করে ফেলতাম!

নুজহাত নাক টেনে আস্তে আস্তে বললো,
___ তিয়াসের কথা মনে আছে তোর? যাকে একদিন খুশিতে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম! আজ আমি যদি সত্যিই হাতে প্রতিবাদের অস্ত্র তুলে নেই সবার আগে ওর গলাটা দেহ থেকে আলাদা করে দিবো। কারণ সে সবকিছু জানতো!

নুজহাতের কথা শুনে আমার সারা শরীর শিউরে ওঠলো। আমার গলা থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিলোনা। একটু থেমে থেকে আস্তে আস্তে বললাম,
___ তিয়াস?

নুজহাত জোর গলায় বললো,
___ হ্যাঁ তিয়াস! যা করেছে সব তিয়াস করেছে। চার বছর আগে আমাকে মানানোর ক্ষেত্রে সে-ই সেদিন রাজী করিয়েছিলো এই বলে যে, বিয়ে করেছিস যখন মেনে ফেল। তারপর বউ রেখে যাকে ভালো লাগে প্রেম করে বেড়াবি সমস্যা নেই। তিয়াস সেদিন শুধুমাত্র তোর কাছে ভালো হওয়ার জন্য ভালো মানুষের অভিনয় করছে। মনে আছে রাতে তুই সা’দের কুকীর্তির কথা শুনে তিয়াসকে ব্লক করে দিয়েছিলি?

আমি চুপ করে রইলাম। কিছু বলার ভাষা পাচ্ছিলাম না। নুজহাত আবার বললো,
___আমার দিকে সা’দের বাজে উস্কানিতেও তিয়াসের হাত আছে। এরপর ওর মনে বিষ ঢুকানোর মাধ্যমটাও তিয়াস। তোর সাথেও তো প্রতারণা করছে সে। তুই ওকে জীবনেও মাফ করবিনা লিয়া! সে শুধু তোর জীবন নিয়ে নয়, অনেক জীবন নিয়ে খেলা করেছে।

আমি নিথর হয়ে শুধু শুনেই যাচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ করেই আমার মনে হলো সেদিন রায়ান ভাইয়ার থেকে দীপ্তির নাম্বার এনেও তাকে এখনো ফোন করে সত্যটা যাচাই করা হয়নি। তার মধ্যে আজকে এসব আমি কি শুনছি? তিয়াসকে নিয়ে আমার মধ্যে যে খারাপ ভাবনা ছিল, সে তার সীমান্তও অতক্রম করে ফেলেছে। অনেক বেশি অপরাধী সে!

চলবে…..
গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (১০ম পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

আমার মা তাহলে একদম ঠিক বলেছিল, যে একবার মন ভেঙে মজা পায় সে বারবার সেটা করতে পারে এবং সবার সাথে!

তারপরেও আবার অন্য রকম একটা ভাবনা থেকে রায়ান ভাইয়াকে বলে বসলাম,
___আপনি ওর সম্পর্কে ঠিকঠাক বলছেন তো?

আমার কথা শুনে উনি হা হয়ে গেলেন। বিমর্ষ চোখে বললেন,
___ আমাকে কি তোমার কোনো কারণে অবিশ্বাসী বলে মনে হয়? ওর সম্পর্কে মিথ্যে বললে আমার কোনো লাভ আছে? লিয়া আমি তোমাকে এখানে ওর সম্পর্কে জানা সত্যটা জানাতে চেয়েছিলাম, আর তুমি কিনা আমাকেই অবিশ্বাস করছো?

আমি থতমত করতে করতে বললাম,
___ আরে আরে শুনেন! আমি আপনাকে অবিশ্বাস করছি কোথায়? আমি বলতে চাচ্ছি দীপ্তি যা বলেছে আর আপনি যা জেনেছেন তা সঠিক কিনা? কেননা তিয়াস আমার সামনে বলেছিল দীপ্তি ওর জীবন, দীপ্তির জন্য সে সব করতে পারে!

___আচ্ছা দীপ্তির সাথে কথা বলতে চাও? এখন অবশ্য অফলাইনে সে। তুমি রাতে ফোন দিও, আমি নাম্বার দিচ্ছি।

আমি ফোনটা খুলে ওর নাম্বার নিলাম। তারপর আস্তে আস্তে বললাম,
___ আসলে আমার কথায় আপনি কিছু মনে করলে আমি দুঃখিত। এই রং মাখানো দুনিয়ায় সাদাকালোর তফাৎ বুঝা ভীষণ কঠিন জানেন তো? এরপর আবার মানুষের উপর ভরসা করাটা তো ভাবা-ই যায়না।

রায়ান ভাইয়া আমার দিকে মাথা নেড়ে নেড়ে বললো,
___ হুম হুম! বুঝতে পারছি। তোমার বিশ্বাস লুণ্ঠন হয়েছিল, আর তাই কারো প্রতি খুব সহজে বিশ্বাস জন্মায় না। এমনও হয় তুমি কারো অনূভুতিও বুঝতে পারোনা। ভীষণ কঠিন হয়ে গেছো তাইতো? আচ্ছা সময় হলে ঠিক বেঠিক স্পষ্ট হয়ে যাবে। সাথে মানুষও চিনে যাবে। এখন চলো এক কাপ কফি খাওয়া যাক। এই প্রথমবার ক্যাম্পাস ছাড়া অন্য কোথাও আমাদের দেখা।

আমি না সূচক ভঙ্গিতে বললাম,
___ আজ নয়৷ অন্যদিন খাবো। আচ্ছা আপনি আমার একটা উপকার করতে পারবেন?

সাথে সাথে উনার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বললেন,
___ কি উপকার বলো? আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।

___ আপনি কাল কি ব্যস্ত থাকবেন?

___ হ্যাঁ সকাল ১১ টা থেকে বিকাল পর্যন্ত ব্যস্ত থাকবো।

___ তাহলে চলবে। আপনি কাল সকালে আমার সাথে কোচিংয়ে যাবেন। মানে সেখানে আমাকে পৌঁছে দিবেন। তিয়াস কাল থেকে জয়েন করার কথা। আমি জানিনা আসবে কিনা, তবে আসলে যাতে দেখে তার চক্রান্ত ভেস্তে গেছে! এখন চলুন ফেরা যাক।

তিনি সানগ্লাসটা ঠিকঠাক করে, হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললো,
___ আচ্ছা তুমিই তো ওকে আমার ব্যপারে এতোকিছু বললে! কেন বলেছো প্রীলিয়া?

আমি হাতব্যাগটার উপর হাতটা কাচুমাচু করে সামনে এগিয়ে বললাম,
___ এসব পরে বলবো। এখন চলেন, কাল দেখা হবে।

উনি হেসে ডানদিকে নিজের গন্তব্যে রওয়ানা দিলো, আমি বামদিকে নিজের গন্তব্যে!

বাসায় পৌঁছে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে বিছানার উপর ধপাস করে বসে পড়লাম। অতীত যা ছিল তা বর্তমানে কেন প্রভাব বিস্তার করছে? কেন তিয়াস আবার এমন করছে? সে আসলেই কি এতটা খারাপ,যতটা আমি জেনেছি? নাকি তার চেয়েও বেশি খারাপ? অসংখ্য মেয়ের সাথে প্রতারণা করে থাকলেও শেষ পর্যন্ত সে আমাকেই কেন চায়? আমাকে পাওয়ার পেছনে তার কেমন স্বার্থ জড়িয়ে আছে? আর সে যে শোধরায় নি সেটা আমি ওদের বাসায় অপমানিত হয়েই বুঝেছিলাম। কিন্তু সে আমাকে দেখে এতটা ভালো হয়ে যাওয়ার চেষ্টা কেন করছে?আমি কি করে সত্যিটা জানবো?
তিয়াস নিজের মুখে কখনোই পুরো সত্যিটা জানাবেনা। তাছাড়া তিয়াসের মধ্যে মিথ্যে বলার ভয়ানক অভ্যাস আছে। নাহলে কি করে রায়ান ভাইয়াকে আমার সম্পর্কে আজেবাজে কথা বললো?
ওর মুখ থেকে কিছু শুনতে চাইলে সে নিশ্চিত আবার নতুন ছল করবে!

কিন্তু আমার মাথায় বহু পূর্বে তিয়াসের একটা ভালো মানুষি কাজ মাথায় ঘুরপাক খায়। যেটা ছিল নুজহাতকে সা’দের পরিবারের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া।
তার কাছে ভালোবাসার মূল্য না থাকলে সে ওইদিন এটা কেন করেছিল?
আমি নিজের মাথা চাপড়ে নিজেকেই বললাম,
কিসের মেধাবী আমি? মানুষ পড়তে জানিনা। মানুষ চেনায় অজ্ঞতা নিয়ে আমি এতো দূর এসেও কি করতে পেরেছি?
না না বহুত পড়ালেখা শিখেছি। এবার থেকে ভিন্ন রকম শিক্ষা অর্জন করতে হবে। আর আমি এখন এমন একটা পর্যায়ে আছি, যেখানে কেউ আসুক কিংবা চলে যাক আমার হৃদয়ে বিঁধবেনা। তাই হাজার কোটি মানুষের ভীড়ে সঠিক বলতে কোনো শব্দ আছে কিনা সেটা খুঁজে বের করতে হবে!

পরেরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রান্না করে খেয়েদেয়ে তারপর রায়ান ভাইয়াকে থাকতে বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।
গিয়ে দেখলাম উনি রাস্তার মোড়ে আমার আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি এগিয়ে এসে তারপর উনার সাথে হাঁটা ধরলাম। কারো সাথে পায়ে পা মিলিয়ে একসাথে বহুদিন পরে হাঁটছি। কিছুক্ষণ গিয়ে কোচিংয়ের মোড়ে আসতেই যা ভেবেছিলাম তাই দেখলাম। তিয়াসকে দূরে দেখা যাচ্ছে।
আমি আস্তে আস্তে রায়ান ভাইয়ার আরেকটু কাছে ঘেঁষলাম। আরেকটু আগাতেই বামহাতে উনার হাতের আঙুলে ধরে পায়ের তাল ঠিক রেখেই এগুতে লাগলাম।
উনি হঠাৎ হাতে ধরাতে অবাক হলেন। নিচে হাতের দিকে তাকিয়ে উনিও হাতটা ধরলেন আর সরল একটা হাসিতে বললেন,
___প্রীলিয়া সেসময় তিয়াসের সাথে সত্যের মধ্যেই অভিনয় ছিল। কিন্তু এই সময় আমার সাথে এই অভিনয়টা কি সত্যি সত্যি মন থেকে হতে পারে না? আমি সত্যিকার..

মুখের কথা আটকে হাত ছেড়ে দিয়ে আমি চোখ ইশারা করে ফিসফিস করে বললাম,
___ এই এই দেখেন তিয়াস চলে যাচ্ছে। নিশ্চিত ওর কলিজায় আগুন ধরে গেছে!

উনি তাকিয়ে দেখলেন তিয়াস চলে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই বললেন না। আমি হাসিমুখে উনাকে ধন্যবাদ জানাতে জানাতে ক্লাসে প্রবেশ করলাম।
তিয়াস আর ভেতরে আসেনি। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে গতকাল ওর বলা মিথ্যে আমার কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। এসে কি জবাব দিবে সেটা ভেবেই হয়তো চলে গেছে।

সেদিনটা স্বাভাবিক চলে গেলো। এর মধ্যে আরো এক মাস চলে গেলো। মাঝে মাঝে খেয়াল করি তিয়াস দূর থেকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কাছে আসার সাহস পায়না। এখন কোনো কথা আছে বলেও বাহানা করে না। আমি আশেপাশে দেখলেই না দেখার ভান করে নিজের মতো করে কাজ করে যাই।
রায়ান ভাইয়ার সাথেও কথা বলিনা। উনি ফোন দিলেও রিসিভ করিনা, যদিও করি তাহলে বিভিন্ন ব্যস্ততার অজুহাত দেখাই। সত্যি বলতে আমি চাইনা উনাকে কোনো রকম ভরসা দিতে। যদি কখনো এমন হয় আমি কথা রাখতে পারলাম না, তাহলে আমিও তো তিয়াসের মতো প্রতারকের খাতারে চলে যাবো। তার চেয়ে ভালো সময় হলে আপন করে নিবো, ভালো লাগা ভেতরেই থাকুক। প্রকাশ করার চেয়ে গোপন অনূভুতির তীব্রতা বেশি!

সেদিন ছিল ছুটির দিন। সারাদিন বাসাতেই বই নিয়ে বসে ছিলাম। এর মধ্যে বাবা মাকে বারবার ফোন করে পাগল করে দিচ্ছিলাম। প্রতিটা ছুটির দিনেই আমি একটু পর পর উনাদেরকে ফোন দেই। কেন জানি এতো কথা বলেও কথা বলতে শুধু ভালোই লাগে। ভাবছি খুব তারাতাড়ি উনাদেরকে আমার কাছে নিয়ে আসবো।
সন্ধ্যার পরেরদিকে আমি পড়ছিলাম, হঠাৎই নুজহাতের ফোন আসলো। আমি বই বন্ধ করে ফোন রিসিভ করে গলা ছেড়ে বললাম,
___ কিরে বাচ্চার মা, ভালো আছিস তো?

উত্তরে নুজহাতের ভাঙা গলা স্পষ্ট শুনতে পেলাম। নুজহাত কেঁদে কেঁদে বললো,
___সা’দ আরেকটা বিয়ে করে ফেলেছে লিয়া। বিয়ে নাকি আরো দেড় বছর আগেই করছে। আমি এতোদিনে জানতে পারছি!

আমি চমকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আতংকিত হয়ে বললাম,
___ কাকে বিয়ে করছে? আর তুই এখনো ওর বিরুদ্ধে মামলা করছিস না কেন? তোদের একটা বাচ্চা আছে, সে কি করে এরপর আরেকটা বিয়ে করে? আমি হলে খুন করে ফেলতাম!

নুজহাত নাক টেনে আস্তে আস্তে বললো,
___ তিয়াসের কথা মনে আছে তোর? যাকে একদিন খুশিতে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম! আজ আমি যদি সত্যিই হাতে প্রতিবাদের অস্ত্র তুলে নেই সবার আগে ওর গলাটা দেহ থেকে আলাদা করে দিবো। কারণ সে সবকিছু জানতো!

নুজহাতের কথা শুনে আমার সারা শরীর শিউরে ওঠলো। আমার গলা থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিলোনা। একটু থেমে থেকে আস্তে আস্তে বললাম,
___ তিয়াস?

নুজহাত জোর গলায় বললো,
___ হ্যাঁ তিয়াস! যা করেছে সব তিয়াস করেছে। চার বছর আগে আমাকে মানানোর ক্ষেত্রে সে-ই সেদিন রাজী করিয়েছিলো এই বলে যে, বিয়ে করেছিস যখন মেনে ফেল। তারপর বউ রেখে যাকে ভালো লাগে প্রেম করে বেড়াবি সমস্যা নেই। তিয়াস সেদিন শুধুমাত্র তোর কাছে ভালো হওয়ার জন্য ভালো মানুষের অভিনয় করছে। মনে আছে রাতে তুই সা’দের কুকীর্তির কথা শুনে তিয়াসকে ব্লক করে দিয়েছিলি?

আমি চুপ করে রইলাম। কিছু বলার ভাষা পাচ্ছিলাম না। নুজহাত আবার বললো,
___আমার দিকে সা’দের বাজে উস্কানিতেও তিয়াসের হাত আছে। এরপর ওর মনে বিষ ঢুকানোর মাধ্যমটাও তিয়াস। তোর সাথেও তো প্রতারণা করছে সে। তুই ওকে জীবনেও মাফ করবিনা লিয়া! সে শুধু তোর জীবন নিয়ে নয়, অনেক জীবন নিয়ে খেলা করেছে।

আমি নিথর হয়ে শুধু শুনেই যাচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ করেই আমার মনে হলো সেদিন রায়ান ভাইয়ার থেকে দীপ্তির নাম্বার এনেও তাকে এখনো ফোন করে সত্যটা যাচাই করা হয়নি। তার মধ্যে আজকে এসব আমি কি শুনছি? তিয়াসকে নিয়ে আমার মধ্যে যে খারাপ ভাবনা ছিল, সে তার সীমান্তও অতক্রম করে ফেলেছে। অনেক বেশি অপরাধী সে!

চলবে…..

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৯ম পর্ব) লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

0

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৯ম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

তিয়াস পায়ের তাল পেছন দিকে রেখে, মুখের উপর হাত রেখে ভীষণ হতাশার সহিত বললো,
___ কি শুনছি আমি? না না প্রীলি অন্য কারোর হতে পারে না। তার ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার কেবল আমারি আছে। আমার প্রীলি শুধুই আমার! এই এই প্রীলি তুমি না আমাকে…(কিছুটা এগিয়ে এসে বলতে চাইলো)

আমি সরে গিয়ে ধমকে বললাম,
___ দূরে থাকো তুমি। ঠিক যেভাবে দূরত্ব বাড়িয়েছিলে। তুমি বুঝতে পারছো না আমি তোমাকে কতটা ঘৃণা করি? কেন আসছো বারবার? আর হ্যাঁ আমি যেমন তোমাকে একপাক্ষিক পুরো দেড় বছর ভালোবেসেছিলাম, তেমন করে আজ সাড়ে তিন বছর ধরে রায়ান ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে। তবে তফাৎ এইটুকুই আমি তোমার মতো করে তালে তাল মিলিয়ে নাটক শুরু করিনি। কিন্তু এতোদিনে আমার মধ্যে তার অস্তিত্ব টের পেয়েছি। হতে পারে আমি তার উপর বিরক্ত প্রকাশ করি, কথা বলতে চাইনা। তাতেও মানুষটা নিঃস্বার্থভাবে আমাকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসে। আর শুনো, তোমার মতোও নয় উনি, এর চেয়ে ভালো অনেক ভালো বংশের!
বর্তমানে ক্যাডার হয়ে প্রতিষ্ঠিত একজন। আমার চেয়েও উনি ব্রিলিয়ান্ট ছিলেন, এবং তিন বছর সিনিয়র ছিলেন। তবুও তিনি বিয়ের কোনো নাম নিচ্ছেন না শুধু আমার অপেক্ষায়!

আমি ওড়নাটা আংশিক মাথায় টেনে দেওয়ার চেষ্টা করে সামনে পা বাড়ালাম। তিয়াস ওখানেই থেমে আছে। সেও হয়তো মূহুর্তেই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে!

এদিকে আমার পাগুলো কেমন শীতল হয়ে আসছে, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। নিজেকে এতোটা শক্ত করার পরেও ওর চোখ দুটো আজ ভীষণভাবে দূর্বল করে দিচ্ছিলো।
এক মূহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো সত্যিই কি সে ভুলের জন্য অনুতপ্ত? সেও কি এতটা কষ্ট পেয়েছে, যতটা পেলে তাকে ক্ষমা করা যায়?
খুব বেশি অনুতপ্ত হলে তাকে ক্ষমা করা যেতেই পারে। কিন্তু সুযোগ দেওয়া অসম্ভব! তার উপর আমার জন্য অন্য একটা মানুষের কতো বছর ধরে অপেক্ষা!

রায়ান ভাইয়াকে ইউভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার প্রথমে চিনতাম না। সেকেন্ড ইয়ারে একটা সমাধানের জন্য স্যার আমাকে উনার কাছে যেতে বলেছিল। আমার মাধ্যমিক জীবনের পরে আমি কোনো ছেলের সাথে ভালো করে কথা বলিনি। এমনকি ছেলে মেয়ের মধ্যে ভালো মেলামেশা দেখলে বিরক্ত হতাম। এর জন্য আমাকে অসংখ্যবার বাসা বদলাতে হয়েছে।
অনেক ছেলেই প্রপোজাল নিয়ে আসতো,কিন্তু রিজেক্ট করার কিছুদিন পরে দেখা যেতো আবার অন্য মেয়ে নিয়ে ঠিকি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু একমাত্র রায়ান ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে সেটা এখন পর্যন্ত বলেনও নি। শুধু এইটুকু বলেন, তুমি যেদিন বিয়ে করবে আমিও সেদিন বিয়ে করবো। আচ্ছা প্রীলিয়া তুমি বিয়ে কখন করবে?
আমি হেসে কথাটা ফেলে দিতাম। অথবা কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতাম।

উনার সাথে দেখা হওয়ার পরে ইউভার্সিটিতে অন্য কোনো ছেলে আর আমার দিকে তাকানোর সাহস পায়নি। বেশিরভাগ সময় আমি ক্যাম্পাসে বসে বই পড়তে পড়তে খেয়াল করতাম, উনি দূরে বসে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকালেই এদিক ওদিক মনোযোগ দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করতেন। লাইব্রেরিতে বসলেও নিউজপেপার নিয়ে আমাকে দেখার শত বাহানা করতেন। তবে প্রতিদিন এই পাগলামিগুলো কমে আসলো। উনার ফাইনাল পরিক্ষা, তারপর বিসিএস প্রস্তুতি। তারপর এখন আবার ক্যাডারের কর্মজীবন। পরিচয় হওয়ার প্রথম বছরই উনি আবেগী বয়সের ন্যায় পাগলামো করতেন। আজকাল উনাকে কম দেখা যায়, সবার আড়ালে অনেকটাই মিস করি। কিন্তু যেদিনই সুযোগ পান ভার্সিটিতে চলে আসেন। আমি উনার আগমনকে ভীষণভাবে গ্রহণ করতে পারি সেটা আজ পর্যন্ত বুঝাইনি। তবে আমি ঠিকি এই মুখটা দেখার অপেক্ষা করে যাই। ফেইসবুকে তেমন একটা যাওয়া হয়না, উনি প্রায়ই নক করেন। কিন্তু আমার চ্যাটিং করতেও বিরক্ত লাগে। সেই দেড় বছরের বিশ্রী অভ্যাসগুলোও কেন জানি ঘৃণায় পরিণত হয়ে গেছে।


সেদিন রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়েই কেমন দু-টানায় ভুগছিলাম। মা-বাবাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। ফোনটা হাতে নিয়ে ভিডিও কল দিলাম। কিন্তু রিং হওয়ার সাথে সাথে কেটে যাচ্ছে। আমিও বারবার দিতে লাগলাম। আমি ভালো করেই জানি আমার ফাজিল ভাইটা ফোন নিয়ে গেইম খেলতেছে। কয়েকবার দেওয়ার পরে বিরক্ত চেহেরায় সে সামনে এসে বললো,
___আপ্পি আপ্পি একটু পর ফোন দাওনা। কেমন একটা জায়গায় তুমি ফোন দিলা বলোতো।

আমি ধমক দিয়ে বললাম,
___তোর জন্য আমি আলাদা ফোন কিনে দিয়েছি না? তাহলে মা-বাবার ফোনে ধরিস কেন? এটা শুধুমাত্র উনাদের সাথে কথা বলতে দিয়েছি। যাহ ফোন দে।

___ আপু আমার ফোনে চার্জ নেই তাই এটা দিয়ে খেলছিলাম। আর তুমি তো মা-বাবাকে দামী ফোন দিছো। আমারটা দিয়ে খেলতে ভালো লাগে না। অনুমতি দাও বদল করে ফেলি।

আমি আবার ধমকে বললাম,
___ এই বিচ্ছু সারাদিন তো ফোন তোর কাছেই থাকে। আমি কি সারাক্ষণ ফোন দেই? আর সময় হলে দামী ফোন পাবি। ভালো করে পড়ালেখা করে ইউনিভার্সিটিতে আয়। তাছাড়া শুন আবার আসলে তোর জন্য গিফট নিয়ে আসবো। এখন ফোনটা দে!

সে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
___ বাবা দোকানের নতুন মালামাল তুলতে শহরে গেছে। মা’কে দিচ্ছি।

আমি মুচকি হাসলাম। সত্যিই ওর মতো বয়সটা ভীষণ খারাপ। তবে মানুষের মন নিয়ে খেলার চেয়ে মোবাইলে গেইম খেলা ভালো। সে এমনিতেই পড়ালেখায় মনোযোগী না, তাই মা’কেও কিছু বলতে মানা করেছি। কিছুদিন গেলে এমনিতেই বুঝতে পারবে!

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোনের স্ক্রিনে আমার মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো। মা’কে দেখেই কলিজাটা কেমন শীতল হয়ে গেলো। আমি স্বচ্ছ একটা হাসি দিয়ে বললাম,
___ এই মা তোমার গালে কালি লেগে আছে। রান্না করছিলে?

মা হেসে বললো,
___ হ রান্না শেষ করলাম। তুই ফোন দিয়েছিস শুনে কালি টালি খেয়াল করি নাই। তুই কেমন আছিস লিয়া?

আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম,
___ ভালো আছি মা। দাদু কোথায়? উনার শরীরটা ভালো তো?

মা দাদুর দিকে ক্যামেরাটা ঘুরিয়ে বললো,
___এই দেখ তোর দাদু তোর ফোনের কথা শুনে আমার পাশে বসে তোর দিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থেকে আমি আস্তে আস্তে বললাম,
___ আচ্ছা মা কেউ ভুল করে অনুতপ্ত হলে তাকে কি ক্ষমা করা উচিত?

মায়ের হাসিমুখটা অন্যরকম হয়ে গেলো। উদাস চেহেরায় বললেন,
___ লিয়া তিয়াস কি তোর সন্ধান পেয়েছে? ক্ষমা চাচ্ছে এখন?

আমি হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম।তৎক্ষনাৎ মায়ের চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট ভেসে উঠলো। বললো,
___ লিয়া তখন তোর ভাগ্য ভালো ছিলো বলে শক্ত মনোবলে উঠে দাঁড়িয়েছিস। কিন্তু এমন পর্যায়ে গিয়ে কতো মানুষ জীবন দিয়ে দেয়। আচ্ছা ভাব তো সেদিন যদি তুইও যদি এমনটা করতি তাহলে সে কার কাছে ক্ষমা চাইতো? ফিরে পেতো তোকে? আর তাছাড়া যে একবার মন নিয়ে খেলে সে অসংখ্যবার খেলতে পারে। তাকে বিশ্বাস করবিনা লিয়া। এরপরও যদি সে ভীষণভাবে অনুতাপ করে, নিজেকে দোষারূপ করে, তবে সর্বোচ্চ ক্ষমা করবি কিন্তু দ্বারেকাছে ঘেঁষতে দিবিনা।
এই শহরে দেহের খুনের বিচার হয় কিন্তু মনের খুনের বিচার হয় না। সেই খুনের সাজা মনের মধ্যে দিয়েই ফিরিয়ে দিতে হয়,তুইও সেটাই করবি!

আমি ভ্রু কোঁচকায়ে বললাম,
___ মা মা তুমি না খুব নরম মনের ছিলে। এতো প্রতিবাদী হলে কবে থেকে?

মা দাদুর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
___ যবে থেকে আমার মেয়ের গল্প জেনেছি তবে থেকেই!

আমার চোখ ছলছল করে উঠলো। একটা সার্থকতার হাসি হেসে বললাম,
___ মা এখন রান্না বসাতে হবে।

মা হাত বাড়িয়ে বললো,
___ নিজের খেয়াল রাখিস মা।

আমি হাত দিয়ে টাটা দিয়ে ফোন কেটে দিলাম।

সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার মাথা হ্যাং হয়ে ছিল। সত্যিই কি তিয়াস ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য? মায়ের কথাগুলোও কিন্তু মিথ্যে নয়!

এসব ভাবতে ভাবতে রাত হলো।
রাতে কি ভেবে যেন ফেইসবুক লগ ইন করলাম।
গিয়েই আমি চমকে উঠলাম।
রায়ান ভাইয়া আমাকে একটা ছবি দিয়েছে, সেটাও সন্ধ্যার দিকে। যেটা তিয়াসের সাথে আমার অনেক বছরের পুরনো ছবি। যেদিন প্রথমবার তিয়াসের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল নবীন বরণে। ছবিটা তুলেছিল আরাফ।
সেই ছবি রায়ান ভাইয়ার কাছে কি করে পৌঁছালো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

ফোন থেকে নাম্বার খুঁজে উনার নাম্বারে ফোন দিলাম। এর আগেও একদিন কি করে জানি উনি আমার নাম্বার যোগাড় করে ফেলেছিল, কয়েকদিন ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিতে চাইতো। কিন্তু এরপর আমি আরো দুইবার সিম পাল্টেছি। নতুন নাম্বার উনি আর জানেন না।
রিং বাজার সাথে সাথেই উনি রিসিভ করলেন, আমি গলা ঝেড়ে বললাম,
___ প্রীলিয়া বলছি। আচ্ছা তিয়াসের সাথে আমার এই ছবিটা কোথায় পেলেন?

ওপাশ থেকে ভীষণ থমথমে আওয়াজ। একটু গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
___, সে আমাকে নিজেই দিয়েছে। জানিনা কি করে খুঁজে বের করেছে! তোমার সম্পর্কে অনেক কথা বললো, যার পুরোটাই ভিত্তিহীন বলে আমি মনে করি। আচ্ছা তুমি আমার সাথে দেখা করতে পারবে আগামীকাল? তার ব্যাপারে অনেক কথা বলার আছে। আর তিয়াস আমাকে তোমার থেকে দূরে রাখতে এটা করেছে। কিন্তু সে যদি জানতো আমি কে, তাহলে জীবনেও এই সাহস পেতোনা। সে যাই হোক ওর সম্পর্কে আমার জানা কিছু কথা তোমাকে জানানো ভীষণ দরকার!

আমি শুধু জবাব দিলাম,
___ আচ্ছা, কাল দেখা হবে।

বিকেলে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম তিয়াসের ব্যপারে পজিটিভ কিছুও হতে পারে । কিন্তু সেই কতক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছি উনি শুধু ভাবছেনই এটা ওটা। আমি অধৈর্য্য হয়ে গেলাম। গলা উঁচিয়ে বললাম,
___, কিছু বলবেন তো নাকি? সে কি করেছে? ছবি দিয়ে বলেছে আমি তার গার্লফ্রেন্ড এইতো? এখন আপনি আমার সাথে সেটার বুঝাপড়া করতে চান?

আমার কথা শুনে উনি কেমন যেন কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
___প্রীলিয়া তোমার সাথে কি তখন খুব খারাপ কিছু হয়েছিল? সে পড়ালেখার ক্ষতি করতে চেয়েছিল?

এটা শুনে আমি আৎকে উঠলাম। চোখ থেকে চশমাটা নামিয়ে বললাম,
___, সে এসবও বলেছে? এসব কি করে জানেন?

উনি বিচলিত হয়ে বললেন,
___ না না সে আমাকে এসব কিছুই বলে নি। আমার মনে হয় সে শুধু এক দুইটা মেয়ের সাথে এমন করেনি। অসংখ্য মেধাবীদের সাথে এমন করেছে। ওর সব ঝোঁক মেধাবীদের দিকে। তোমার ক্লাসেরই তো ছিল দীপ্তি। সে আমার ফুফাতো বোন হয়, সেটা জানো?

আমি আরো চমকে গেলাম। তোতলাতে তোতলাতে বললাম,
___ দীপ্তি? তিয়াসের গার্লফ্রেন্ড ছিল। আমার সামনে ওকে প্রপোজ করেছিল।

আমার আগেই উনি বললেন,
___ সে দীপ্তিকেও ঠকিয়েছে। মেয়েটার সব জায়গায় রেজাল্ট ভালো ছিল মোটামুটি চেষ্টাও করতো কিন্তু ফাইনালে সে খারাপ করেছে। শুধু তিয়াসের জন্য এমনটা হয়েছে।

আমি তাচ্ছিল্যের স্বরে বললাম,
___, দীপ্তি তো পরিক্ষার মধ্যে দূর্নীতি করেও প্রথম হতে চাইতো। সে নাকি আবার প্রথম স্থান ছাড়া কিছু মানতে পারেনা।

রায়ান কিছুটা হাসিসুলভ হয়ে বললো,
___আরে, আমার ফুফা বিরাট বিজনেসম্যান। একমাত্র মেয়ে তো তাই ওর মধ্যে ভাবের পরিমাণটাও বেশি ছিল। আসলে ওটা বয়সের দোষ ছিল। ঠিকঠাক বুঝজ্ঞান হয়নি তখন। কিন্তু আমার কাছে সবকিছু শেয়ার করতো। আমি দীপ্তির ফোনেই তিয়াসের ছবি দেখেছিলাম। পরবর্তীতে সে আমাকে বলেছিল ক্লাসে লিয়া বলে একজনের সাথেও তিয়াস এমন প্রতারণা করেছে যেটার আংশিকও সে জানতোনা। পরিক্ষার আগে আগে সব জানতে পেরেছিল। এরপর দীপ্তির মধ্যেও বিভিন্ন খারাপ চিন্তারা ভর করেছিলো। তাইতো পরিক্ষা এতো খারাপ করছে, তবে রেজাল্টের পরেই আমেরিকায় চলে গেছে আর এখন ওখানেই আছে ।
এদিকে আজকে আমি তিয়াসের পাঠানো ছবি দেখে বুঝতে পারছি দীপ্তির বলা সেই লিয়াই আমার শত ভালো লাগার এই প্রীলিয়া!

উনার কথাগুলো শোনার স্থিরতা আমার মধ্যে শূন্য হতে থাকলো। বুক কেঁপে ওঠতে লাগলো বারবার!
মানুষ এতটাও খারাপ হয়? ছি! ছি!
এর মধ্যে আমি কিনা ক্ষমা করার কথা ভেবে বসেছিলাম? আমার মা তাহলে একদম ঠিক বলেছিল, যে একবার মন ভেঙে মজা পায় সে বারবার সেটা করতে পারে এবং সবার সাথে! ….

চলবে……

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৮ম পর্ব) লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

0

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৮ম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

তখন বাবা প্রথম দেখেছিলো তিয়াসকে। আর আমি চেয়েছিলাম শেষবার দেখতে! কিন্তু হয়ে উঠেনি।

ছয়-সাত মাসে অতিরিক্ত টেনশন, অযত্ন, নির্ঘুমের জন্য প্রচুর চুল ঝড়তো। এরপর রাগ করে চুল ছোট করে ফেলেছিলাম। সেটা তিয়াস আজ লক্ষ্য করেছিলো হয়তো।

সেদিনের পর আমার জীবনের পুরো মোড়টাই ঘুরে গিয়েছিল। ইউভার্সিটিতে পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ততা, তার ফাঁকে বাবার বোজা হালকা করার জন্য দুই-একটা টিউশনিও করাতাম। অবশ্য টিউশনিতে আমার আলাদা একটা সম্মান ছিল সবসময়। এমনো হয়েছে গার্ডিয়ানরা অনেকমাস ঘুরার পরে আমি তাদেরকে সময় দিতে পেরেছি। কেননা আমি আমার পড়ালেখার প্রতিই মনোযোগী ছিলাম বেশি।
সেটাই প্রথমবার ছিল, তিয়াসদের বাসায় ফোন নিয়ে লজ্জাজনক কথা শুনেছি ৷ সত্যি বলতে যেই মানুষটাই লজ্জাহীন, বেহায়া! তার দ্বারা ভালো ব্যবহার কীভাবে সম্ভব?
তবে সেটা যেমন পরিবারই হতো আমি সেদিনের পর ভুলেও ওখানে পা রাখতাম না। কারণ আর যাই হোক আত্মসম্মানবোধ আমার মধ্যে জাগ্রত হয়েছে বহু আগেই।



চার বছরেরও বেশি সময় পর আবার তিয়াসের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তারপরও তো আমি চেয়েছিলাম আবার হারিয়ে যেতে কিন্তু সে আমার বাড়ি পর্যন্ত কেন পৌঁছালো?
সে এখন কেন আমাকে বিয়ে করতে চায়? নাকি ভাবছে আমি পড়ালেখায় ভালো, অল্প বছরের মধ্যে ভালো একটা অবস্থান পাবো তখন আর ওর মতো ছেলেকে পাত্তা নাও দিতে পারি। তাই আগেভাগে পরিবারের হাত ধরে বিয়ে করতে চাইছে? নাকি অন্য কারণ? আমার মাথায় বারবার প্রশ্ন ঘুরছে দীপ্তি এরপর আমেরিকা গিয়েছিল কিনা? আর তিয়াস কেন আমেরিকা যাওয়ার কথা বলে চট্টগ্রামেই পড়ে আছে?
ওর বাবা-মা ঢাকাতে অথচ সে একা চট্টগ্রামে।
সেখানে ওর সাথে আমি থাকতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে আমার সাথে প্রতারণা করার পরে আমি ওই জায়গার নামটাও মুখে নেইনি। কিন্তু সে কেন এখনো ওখানে?
সে কি কিছু আমাকে বলতে চাইছে যা আমি জানিনা? আমার কি ওর সব কথা শোনা উচিত?
পরক্ষণেই স্থির হয়ে নিজেকে বললাম, না না প্রতারকরা আবারও প্রতারণার সুযোগ খুঁজবে। তাকে কোনোভাবে কিছু বলার সুযোগই দিবো না।


বিকেলের দিকে মা এসে দরজায় ঠকঠক করতে লাগলো। এতক্ষণে অবশ্য অসংখ্যবার দরজা খুলতে বলেছে কিন্তু বাবা বারবার মা’কে বাধা দিচ্ছিলো।
আমি চোখমুখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। তবে উঠে দাঁড়াতে শিখেছিলাম সেই দিনই, যেদিন আমার বাবা আমার বুকে এক পৃথিবী স্বপ্ন উদিত করেছিলো।
আমি গতকালের জন্যও বাবাকে দোষ দিতে পারবোনা। কারণ শত হোক তিনি আমার বাবা, যিনি নিজ চোখে আমাকে একদিন তিয়াসের জন্য মৃত্যুপথে দেখেছিলেন। বাবা ভেবেছে তিয়াসকে আজও ভালোবাসি তাই হয়তো মেনে নিতেও পারি! বাবা তো আর আমার ভেতরটা জানেননা, সেখানে ওর জন্য কতটা ঘৃণা পুষিয়ে রেখেছি জানলে হয়তো এমনটা করতেন না।

মায়ের ডাকাডাকিতে পরিশেষে আমি দরজা খোলে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলাম,
___ মা তুমি কি বুঝে ওদেরকে সাপোর্ট করে নিজের মেয়েকে বকতেছো? জীবনের এতটা বছর আমি কষ্ট করে এতদূর এসেছি অথচ তোমরা কিনা শেষ বেলায় সব ধ্বংস করে দিতে চাইছো?

মা রাগী স্বরে বললো,
___কেন তোকে কি আমরা বিয়ে দিবোনা? তাছাড়া ওদের স্থানটা আমাদের বর্তমান অবস্থানের চেয়ে অনেক উচ্চমানের। তুই প্রতিষ্ঠিত হলেও এমন জায়গায়ই বিয়ে হবে। তারপর একটা কথা আছেনা যতো তারাতাড়ি বিয়ে হবে ততই ভালো। বয়স তো আর থেমে থাকেনা কারো জন্য। এরপর তুই আজকে যেই খারাপ ব্যবহারটা করেছিস সেটা একদম ভালো হয়নি।

আমি মা’য়ের উপর এই মূহুর্তে প্রচন্ড রেগে গেলাম। বাবার দিকে ইশারা করে বললাম,
___ বাবা তুমি মা’কে তিয়াসের ব্যপারে সব বলে দাও। আর দাদুকেও বলো। এরপর যদি ওদের বিবেক বলে আমি যা করেছি কিংবা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা ভুল। তাহলে আজকের পরে আমি এই বাড়িতেই পা রাখবোনা। আর এমনিতেও আজকে আমাকে চলে যেতে হবে! এখন কোনো ট্রেন নেই,বাসে চলে যাবো। জানি সন্ধ্যা হয়ে যাবে তারপরও চলে যাবো। আমার সামনে পরিক্ষা বাবা। শুধুমাত্র দাদুর কথা শুনে আমি পাগলের মতো ছুটে এসেছিলাম।

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
___তোর মা সবকিছু শুনলে এই ছেলেকে বাড়িতে আসতে দিবে দূরে থাক, আশেপাশে দেখলেই ঝাড়ু নিয়ে দাঁড়াবে।

মা চোখ বড় করে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
___ কি গো! তিয়াস কি আমার মেয়ের সাথে খুব বড় অন্যায় করছে? ওদের আগে থেকেই পরিচয় ছিল এই নিয়ে ওখানে বসেও তিয়াসের মা কি যেন বলছিল। আবার লিয়া বলছিলো সে ততটা যোগ্য হবে যতটা হলে সে কোথাও রিজেক্ট হবে না। আমাকে বলো না সব প্লিজ। আসো আসো রুমে আসো এবং আমাকে সব খুলে বলো।

বাবা দাদুকেও আসতে বললো। যেতে যেতে মা কপাল, ভ্রু ভাঁজ করে দাদুকে বিরবির বলছে,
___ আম্মা জানেন ওরা বাপ বেটিই সব। আমি মাঝখানে পাশের বাসার আন্টি। যতো কুচুরমুচুর সব ওরা ওরাই করে। আমাকে কিচ্ছু জানায় না।

মা’র কথা শুনে বাবা হাসলো। আর আমি হাসতে হাসতে কাপড় নিয়ে গোসলে গেলাম।

বের হয়ে নিজে থেকেই খেয়েদেয়ে তৈরি হতে লাগলাম। ব্যাগ গুছানো শেষ এমন অবস্থায় দেখি মা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। উনার চোখভর্তি পানি। এতো বছর পরেও মেয়ের সেসময়কার প্রতিকূলতা মানিয়ে আজকের অবস্থানটা দেখে হয়তো উনার আনন্দেই কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আমি ব্যাগ হাতে নিয়ে বললাম,
___, দাদু আর তোমার মত কি? এখনো ভালো মনে হচ্ছে ওই ছেলেকে?

মা আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মায়ামাখা একটা স্বরে বললো,
___আমার লক্ষি লিয়া মা। তোকে না বুঝে বকা দিয়েছি, বোকা মায়ের উপর রাগ করিস না।

___আরে না মা কি বলছো? ঠিক আছে। জানো আমি কখনোই চাইনি তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়টা সম্পর্কে জানো। কিন্তু আজকে সময় পরিস্থিতি বলতে বাধ্য করলো। এটাই হওয়ার ছিল বোধহয়!

দাদুর মুখটাও শুকনো । তিনিও বুঝতে পারছেন একটা রং মাখানো মুখোশের ভেতর মানুষ চেনা কতো কঠিন। যেটা আমি দেড় বছরে বুঝতে পারিনি সেটা উনারা দুই-একদিনে কি করে বুঝবেন?

বাবা আমাকে এগিয়ে এনে একদম বাসে তুলে দিলো। বাসে বসে কিছুক্ষণ বই পড়ছিলাম। হঠাৎ করেই আমার নুজহাতের কথা মনে হলো। অনেকদিন ধরে ওর সাথে কথা হয়না৷ আমি বইটা বন্ধ করে ওর কাছে ফোন দিলাম। প্রথমবার রিসিভ হলোনা, পরেরবার রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে একটা বাচ্চা কণ্ঠে আওয়াজ আসলো,
___আম্মু তরকারি কাটতেছে। আমি দিচ্ছি।

এক মিনিট পর ওপাশ থেকে নুজহাত বলে উঠলো,
___ কে বলছেন?

আমি আস্তে আস্তে বললা,
___ লিয়া বলছি।

নুজহাত উৎসুক হয়ে একনাগাড়ে এতো এতো প্রশ্ন জুড়ে দিলো।
___লিয়া কোথায় আছিস, কেমন আছিস,বিয়ে করেছিস,নাকি এখনো পড়ালেখাতেই আছিস? তোর আগের একটা নাম্বার ছিল, সেটা কোথায় রে? জানিস তোর ওই নাম্বারে কতো ট্রাই করি?

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,
___ পড়ালেখা নিয়েই আছিরে। আর আমার নাম্বার অসংখ্যবার বদল হয়েছে। এইতো সেদিন এই নাম্বারটা নিলাম। আচ্ছা তোর কি খবর? সা’দ কেমন আছে?

নুজহাত এবার কেমন জানি চুপসে গেলো, আস্তে আস্তে বললো,
___ ওর জন্য আমার পড়ালেখা বাদ দিয়েছিলাম। বাচ্চার জন্য আমার রেজিস্ট্রেশনও করা হয়নি।
দুই বছর ভালোই ছিল। কিন্তু গত দুই বছর ধরে ওকে নিয়ে বিভিন্ন কথা শুনি। বাচ্চার বাবা হয়ে সে মেয়েদের পেছনে পড়ে থাকে। এই নিয়ে ঝামেলা চলে প্রায়ই, কয়েকদিন আগেও ঝগড়া করে এখন বাপের বাড়িতে আছি। দেখি কিছু একটা করতে হবে। মেয়ে হওয়াটা সত্যিই ভীষণ দূর্ভাগ্যের। তবে সেটাকে যে তোর মতো কাজে লাগাতে পারে সেই প্রকৃত বীর নারী । ওই বয়সে আমি আবেগে কতো বড় ভুল করেছি সেটা আজ বুঝতে পারি।

আমি ভেবেছিলাম নুজহাত হয়তো খুব সুখে আছে। ওর কথা শুনে আমি অবাক হলাম। আমি ওর জবাবে বললাম,
___সা’দ এখন এমন করে কেন? তোর মতো সুন্দরী বউ থাকতে সে অন্য মেয়ের দিকে কি করে তাকায়?

নুজহাত নালিশের ন্যায় বললো,
___ আমি তো এখন বুড়ি হয়ে গেছি। বাচ্চা সংসার সামলে এখন আর স্মার্ট থাকতে পারিনা। তাই উনার দৃষ্টি আমার উপরে আর আকর্ষিত হয়না। এদিকে সমবয়সী বিয়ে করেছিলাম। যখন কিনা তার সংসারের সংজ্ঞা জানার বয়স হয়নি। এখনো হয়নি ভালো করে। জানিনা কখন হবে!? তবে তুই ভালো করেছিস। তোর মতো বয়সে সমবয়সী বিয়ে করলেও ঝামেলা পোহাতে হবে না, কারণ কম হলেও সংসারের মানে বুঝবে।

আমি চুপ করে শুনলাম। তারপর পরবর্তীতে আবার কথা হবে বলে ফোনটা কেটে দিলাম।
জানালা দিয়ে মুখটা একটু বাইরে নিয়ে তাকালাম। শনশন করে বাতাস বইছে। আমার মুখে একটা অন্য রকম হাসি! সেদিন আমার সাথে যেটা হয়েছে সেটা আল্লাহ হয়তো আমার ভালোর জন্যই করেছিলো। নাহলে নুজহাতের মতো অবস্থা হলে আমি কি করে আজকের আমিটা হয়ে উঠতাম?


এরপর অনেকদিন বাড়ি যাইনি। এর মধ্যে তিয়াস আমার অনেক খোঁজ করেছিলো নাকি। কিন্তু সন্ধান পায়নি। এরপর তারও পরিক্ষা তাই চট্টগ্রাম চলে গেছে। আমিও আমার পরিক্ষা ভালোভাবেই দিলাম।
পরিক্ষার শেষে আমি একটা কোচিং সেন্টারে প্রতি সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস নেওয়ার দায়িত্ব নিলাম।
সেই কোচিংটা ইউনিভার্সিটির মেধাবী শিক্ষার্থীদের দিয়েই পরিচালিত হয়। আগে জয়েন করতে বললেও পরিক্ষার জন্য করা হয়নি।
এর ফাঁকে বাড়িতে একবার গিয়েছিলাম। তবে আমার ইচ্ছে এখন কোচিং+ টিউশনের যে টাকা পাবো তা দিয়ে একটা বাসা ভাড়া করবো। তারপর সবাইকে নিয়ে এখানেই থাকবো। এর সাথে বিসিএস প্রিপারেশন। এরপর কোনো চাকরি হয়ে গেলে বাবাকে কোনো কাজ করতে দিবোনা।

কিন্তু কোচিংয়ের পঞ্চমদিনের মাথায় একটা বিপাকে পড়ে গেলাম ইয়াসকে দেখে। সেও এই কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছে। আমি ওকে না দেখার ভান করে থাকলেও ভীষণ আতংকে ছিলাম। কারণ আবারও তিয়াস আমার সন্ধান পেয়ে যাবে৷

আমার ভয়টা যেমন ছিল, কার্যকারীতা ঠিক তেমন হলো। পরেরদিন কোচিং শেষ হতেই দেখি তিয়াস বাইরে অপেক্ষা করছে। চোখের চশমাটা এঁটে আমি পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে সে আমাকে বলে,
___কাল থেকে আমিও এখানে জয়েন করছি। আমার কোনো কথা তো শুনবেনা অন্তত কংগ্রেস জানাতে পারো প্রীলি ম্যাম!

আমি কি ভেবে তিয়াসকে বললাম,
___ তোমার কি মনে হচ্ছে তাহলে আমি এখানে থাকব? দেশে আর কোথাও জায়গা নেই? আর তাছাড়া তুমি আমার পিছু নিয়েছো কেন? কি করতে চাও তুমি? আর কিই বা বলতে চাও?

তিয়াস এবার একটু অনুনয়ের সঙ্গে বললো,,
___বিশ্বাস করো প্রীলি আমি তোমাকে অপমান করার আগে বুঝতে পারিনি তুমি আমার জীবনে কতটা জুড়ে ছিলে। কিন্তু চলে যাওয়ার পরে মনে হয়েছে তুমি আমার কাছে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছো, আমি তোমার শূন্যতায় নিজের অস্তিত্ব ……

তার আগেই আমি আঙুল উঁচিয়ে জোরে জোরে বললাম,
___জাস্ট শাট আপ। এতো সস্তা এক্সকিউজ নিয়ে আমার সামনে কীভাবে আসলে? ছি! আর তোমার কি মনে হচ্ছে এতো বছর পরে তোমার মতো একটা জঘন্য মানুষের পরে আর কেউ আমার জীবনে আসতে পারেনা? আর কারো প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মাতে পারেনা? প্রায় ৫ বছরেও কি সঠিক মানুষের দেখা মিলবেনা?

আমার কথাগুলো শোনার সাথে সাথেই তিয়াস কেমন পেছাতে লাগলো। সে এটা হয়তো কোনোভাবেই মানতেই পারছেনা। ভেবেছিল ওর শোকে আমার ভেতর এতোটাই পাথর হয়ে গেছে যেখানে কিনা আর কারোর অস্তিত্ব নেই! কিন্তু সে ভাবতে পারছেনা এই ধারণা সঠিক নাও হতে পারে!

চলবে….

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৭ম পর্ব) লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

0

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৭ম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

বাবার এতো কষ্টের টাকায় পড়ালেখা না করে একটা ছেলের জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলাম। আমার জন্য এটা উচিত শিক্ষা ছাড়া আর কি?

ছাতাটা এখনো হাতে ভাঁজ করা অবস্থাতেই আছে। আমি ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে হালকা ভিজে ভিজে নিজের গন্তব্যের দিকে হাঁটছি। খুব করে ইচ্ছে হচ্ছে এখন যদি প্রচন্ড বেগে বৃষ্টি নামতো। বৃষ্টির পানিতে চোখেরজলগুলোও একাকার হয়ে যেতো।
নিজের ভুলগুলি হয়তো কিছুটা ধুয়েমুছে সাফ হতো। কিন্তু আমার ইচ্ছেগুলো যে আজ থেকে অপূর্ণতার কুফায় পড়ে গেছে। কে জানে আজীবন এভাবেই ঠেকতে হয় কিনা!
সেদিন প্রচন্ডবেগে বৃষ্টি না আসলেও কাক ভেজা ভিজে জ্বর ঠিকি এসেছিল। সেই যে গিয়ে বিছানায় উপুর পড়ে ছিলাম আর উঠিনি। রুমের বাকিরা ভেবেছে আমি ঘুমাচ্ছি, কিন্তু কাউকে বুঝানোর সাধ্যি ছিল না সেদিন সারারাত আমি এক মিনিটের জন্যও ঘুমাতে পারিনি। রাতে না খাওয়ার জন্য শুয়ে শুয়ে শুনেছিলাম শুভা, দিয়া,রুহি আমাকে বকতেছে। হুমকি দিচ্ছে বাবাকে বলে দিবে। এমনটা ওরা প্রায়ই করে।

সেদিন খুব ভোরে উঠে ফাঁকা বারান্দায় আকাশের দিকে তাকিয়ে খুব কেঁদেছিলাম। দুইদিকে প্রতারণা, একদিকে আমি প্রতারিত হয়েছি আর অন্যদিকে আমি আমার পরিবারকে দিয়েছি! আমার বেঁচে থাকার কোনো দরকার আছে? সত্যিই কি আমার জীবনটা আর কখনো সার্থক হওয়া সম্ভব? আমি আমার পরিবারের সামনে কি করে যাবো? বাবা আমাকে নিয়ে কতো স্বপ্ন দেখতো। আমার ভাইটা তো পড়ালেখার দ্বারেকাছেও নাই। সব স্বপ্ন তো বাবা আমার উপরেই ছেড়ে দিয়েছে। তাহলে আমি এই পোড়ামুখ নিয়ে কি করে যাবো! তার চেয়ে আমার মৃত্যুটা! এটা ভাবতেই আমার বুক কেঁপে ওঠছিল। না না তাহলে আমার মা, দাদু ঠিক থাকতে পারবেনা। বাবা তো কোনোভাবেই আমাকে ছাড়া ভালো করে বাঁচতে পারবেনা।
তাহলে আমার কি করা উচিত?
এতো কম সময়ে আমি করে পারবো? এর মধ্যে আমি চ্যালেঞ্জটা কেন করলাম? সত্যি যদি রেজাল্ট খারাপ হয় তাহলে আমি এতোগুলো মানুষের কাছে আরো বেশি হাসির পাত্র হয়ে যাবো! কি করবো আমি? কি করবো?
দুইহাতে নিজের চুল মুঠো করে ধরে নিজেকেই প্রশ্ন করছিলাম!

সারাদিন চলে গেলো কিচ্ছু খাইনি রাতের দিকে জ্বরের পরিমাণটা কমলো। এক গ্লাস পানি খেয়েছিলাম মনে আছে। কারো কোনো প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই, খাওয়ানোর জন্য তাদের আকুতিও আমার কানে পৌঁছেনি। তারা সবাই বুঝতে পারছে নিশ্চয়ই তিয়াসের সাথেই কিছু হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে তা কেউ জানেনা। তিয়াস তাদের সাথেও কথা বলার সবরকম ওয়ে বন্ধ করে দিয়েছে।

পরেরদিন সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে দাড়োয়ান চাচা আমার নাম ধরে অনেক্ষণ ধরে ডাকতেছে। কিন্তু দূর্বল শরীর নিয়ে উঠার মতোও কোনো শক্তি ছিলনা। আমি হাত দিয়ে ভর করে করে কোনোভাবে ফ্রেশ হয়ে আস্তে আস্তে নিচে গেস্ট রুমে গেলাম। সবকিছু ঝাপসা দেখছিলাম। দুইদিনের না খাওয়া, হতাশাগ্রস্ত, আর কান্নায় ফোলানো চেহেরার দিকে তাকাতেই আমার খুব পরিচিত একটা কণ্ঠে লিয়া বলে একটা চিৎকার শুনলাম।
আমি চোখে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে বললাম,
___বাবা তুমি এখানে?

বাবা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে কান্না শুরু করে দিলো। বাবার কান্নায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছিলো।
আমি সইতে পারছিলাম না। আমি ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললাম,
___বাবা আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি। তোমার মেয়ে হওয়ার কোনো যোগ্যতা আমার নেই। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি বাবা। আমার কোনো যোগ্যতা নেই তোমার স্বপ্ন পূরণ করার! আমার আর কিচ্ছু করার নেই!

বাবা আমার দুই গালে হাত রেখে বললো,
___, আমার মেয়ে কোনো ভুল করবেনা। আমার বিশ্বাস আছে তোর উপর মা। বাবা সব কথা পরে শুনবো। এখন চল বাইরে যাবো। আগে তুই খাবি।

তারপর বাবা আমাকে নিয়ে একটা খাবার হোটেলে গেলো। ভাত-মাছ দিয়ে আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো। তারপর আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ধিরে ধিরে বলল,
___ এই প্রথমবার আমার মেয়েকে আমি এভাবে এতোটা ভেঙে পড়তে দেখেছি। তোকে আমি দুইবার কাঁদতে দেখেছিলাম, প্রথমবার তোর দাদা মারা যাওয়ার পরে, আর দ্বিতীয়টা আমি তোকে একদিন বকা দিয়েছিলাম বলে। তুই সেদিন ভীষণ কান্না করে বলেছিলি তোর মা হাজার মারলেও তুই ততটা কষ্ট পাস না, যতটা তুই আমার একটা বকাতে পাস। সেদিনের পর আমি তোকে কখনো বকা দেইনি। বল বাবা আর কখনো তোকে কোনো কারণে বকেছি?
এবারও তুই যত বড় ভুলই করিস আমি তোকে বকবোনা মা। প্লিজ তুই আর কান্না করিস না। জানিস রুহি যখন আমাকে ফোন করে বললো, দুইদিন ধরে তুই না খেয়ে শুধু কান্না করিস। তখন আমার পৃথিবীটা কতো অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল? আমি জানিনা এতটা পথ আমি কি করে আসলাম। পুরো রাস্তায় এটাই মনে হয়েছে আমি কবে পৌঁছাবো। আমি পারছিলাম না উড়ে উড়ে চলে আসি। এখন বাবাকে বল কেন তুই এতটা ভেঙে পড়েছিস? যেই কারণই হোক বাবা তোকে কিচ্ছু বলবোনা।

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
___ বাবা কলেজে ভর্তি হওয়ার একমাস পর থেকে আমি পড়ালেখার আদৌ কাছেও নেই! এই বয়সে দশ পাঁচটা মেয়ে যেই ভুল করে আমিও ঠিক সেটাই করেছি,কিন্তু আমি খুব মারাত্মক পরিসরে প্রতারিত হয়েছি। এখন আমার কাছে তোমার স্বপ্ন পূরণ করার রাস্তাও নেই আর ভুল শোধরানোরও!
মাঝখান থেকে আমি বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ করে ফেলেছি, তার কিঞ্চিৎ কাছে ঘেঁষাও আমার পক্ষে সম্ভব না।

তারপর তিয়াসের ব্যপারে ফার্স্ট থেকে লাস্ট সব বললাম। আগে স্কুলেও কেউ প্রপোজ করলে আমি বাবাকে বলে দিতাম। বাবা আমাকে সুন্দর করে বুঝাতো। কিন্তু এই প্রথমবার এই কথাটা বলতে এত দেরি করেছি। বললে হয়তো ভুলটা এতো দূর গড়াতোনা। আমার সাথে এটা হওয়ার ছিল বলেই হয়তো আমি এতটা গোপনীয়তা রাখতেও শিখে গেয়েছিলাম।
আমার পুরো কথা শুনে বাবা মোটেও ঘাবড়ালোনা। বাবা বুঝতে পারছে আমি তিয়াসের থেকেও বেশি আফসোস করছি বাবার স্বপ্নের জন্য! বাবা এবার একটা মুচকি হাসি টানিয়ে বললো।
___ আমার গর্ব হচ্ছে এটা ভেবে যে তুই শেষ পর্যন্ত ওকে চ্যালেঞ্জ করতে পেরেছিস! এই না হলে আমার মেয়ে? আমি জানি তুই পারবি। তোর মেধা নিয়ে আর কারো সন্দেহ থাকলেও তোর বাবার মনে কোনো সন্দেহ নেই। তোকে এইটুক বয়স থেকে আমি চিনি মা। তুই পারবি এবং তোকে পারতেই হবে। এবার থেকে তুই এটা ভাব্বিনা এটা তোর বাবার জন্য করছিস। এবার ভাবতে শিখ তোর ক্যারিয়ার তোর নিজের জন্য। তোর সাথে প্রতারণা করে যেই মেধাকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল সেটাকে এবার দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিবি। চুনকালি মেরে দে বিশ্বাসঘাতকদের মুখে! শুধু নিজের যোগ্যতার জন্য তুই এটা করবি। এতটা বড় হবি যখন তোকে রিজেক্ট করার ক্ষমতা ওর মতো ছেলের থাকবেনা। যদি থাকে সেটা তোর থেকে থাকবে।

আমি বাবার দিকে শুধু তাকিয়ে আছি। বাবার প্রতিটা কথা আমার দূর্বলতাগুলোকে একদম গভীরভাবে তীর ছুড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিলো। আমার মধ্যে আবার উদয় হলো মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার তীব্র আকুলতা। স্বপ্ন জাগলো যোগ্য হয়ে উঠার। বাবার কথামতো ততটা যোগ্য হতে হবে যতটা হলে আমার কাছে কেউ রিজেক্ট হবে!

বাবা হুট করেই বললো,
___তোর ফোন কি হয়েছে লিয়া?

বাবার সাথে এখান থেকে বের হয়ে বললাম,
___বাবা পরশুদিন বৃষ্টিতে ভিজে আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছে।

এটা শুনে বাবা নিজের হাতের ফোনটা থেকে নিজের সিম খুলে আমার হাতে দিলো। আর বললো,
___এটা রাখ আপাতত। পরে বাবা দামী ফোন কিনে দিবো। এখন আয় তোকে একটা সিম তুলে দিবো।

আমি চুপ করে হাতে নিলাম। মানা করলাম না, এতে বাবা আবার রাগ করতে পারে। বাবা আমাকে একটা নতুন সিম কিনে দিলো।

তারপর সেখান থেকে একটা রিকশায় উঠে আমাকে নিয়ে হোস্টেলের সামনে আসলো। বাবা আমাকে ভেতরে যেতে ইশারা করলো। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললাম,
___বাবা মা’কে কিছু বলোনা প্লিজ।

বাবা মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। আমি বাবার দিকে তাকাতে তাকাতে ভেতরে চলে আসলাম।

সেখান থেকে গিয়েই বই নিয়ে বসে গেলাম।
এতোদিন পরে আমার রুমমেটরা আবারও আমাকে দেখে অবাক হলো। তারা বুঝলো না কি হচ্ছে আমার সাথে। তবে আমি বুঝতে পারছিলাম আমার কি হওয়া উচিত।
রাতদিন পাগলাটে পড়ালেখা যাকে বলে! এমনো রাত সারারাত বইয়ের মধ্যেই আমি। সকাল কখন হয়েছে সেটাই খেয়াল করতে পারিনি।

যেখানে বিরহশোকে আমার এলোমেলো হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আমি এখন পড়ালেখায় এলোমেলো। নিজেকে গুছানোর জন্য ৫ মিনিট সময়ও যেন আমি অপচয় করতে চাইতাম না। বিভিন্ন সমস্যা লিস্ট করে স্যারদের থেকে সমাধান করে নিতাম। ক্লাসের প্রথমদিকে যে শিক্ষকরা আমাকে খুব ভালোবাসতো তারা আমার পূনরায় মনোযোগে প্রচন্ড খুশি ছিল, আমার প্রতি ভীষণ হেল্পফুল ছিল। যেকোনো সমস্যা হলে আমি এনি টাইম উনাদের থেকে সমাধান পেতাম। তিয়াসের কথা মনে করার জন্য আমার কাছে এক সেকেন্ড সময়ও ছিল না। তবুও মাঝে মাঝে খেয়াল করতাম আমার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে। ডান হাতে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে বাম হাতে চোখ মুছে দিতাম।

১৫ দিনের পরে নির্বাচনী পরিক্ষা ছিল। এরপরে আমার রেজাল্ট যখন এগারোতম স্থানে তখনি পুরো ক্লাস অবাক হয়ে গেছিলো। তবে দীপ্তিই প্রথম হয়েছে। তিয়াসের রেজাল্ট শুনেও আমি অবাক হয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম সে অনেক অমনোযোগী কিন্তু সেও পনেরোতম স্থানে। হয়তো নাটক করতে গিয়ে সে আমাকে এমনটা বুঝিয়েছে যে সে পড়ালেখা বলতে কিছুই করে না। আসলে সেও এতোদিন কম হলেও পড়ালেখা করেছে।
রেজাল্টের দিন তিয়াস আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু আমি শুনিনি।

ফাইনালের আগে আগে আমার প্রিপারেশনের উপর ভরসাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, স্যারদের টার্গেট আবারও আমার উপর। পরিক্ষার ১০ দিন আগে ইংরেজি স্যার এমনিতেই আলাদাভাবে একটা পরিক্ষা নিয়েছিলো যেখানে শুধু সর্বোচ্চ নাম্বার নয় অবিশ্বাস্য নাম্বার পেয়েছিলাম। সেদিন আমি দীপ্তির চেহেরায় কালো মেঘ দেখেছিলাম। যা ছিলো প্রথমবার আমার চোখে তৃপ্তির ঘোর।

এরপরের দিন তিয়াস আমার সাথে কথা বলতে বিভিন্নভাবে রুমমেটদের সাথে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি পূর্ব সচেতন করে দিয়েছিলাম আমার ব্যপারে কোনো কথা বলার চেষ্টা করলে আমি এই রুম ছেড়ে অন্য রুমে চলে যাবো। আমি ভালো করেই জানি তিয়াস আবারও মনোযোগ এড়ানোরচেষ্টা করবে।
তাই ওরাও তিয়াসকে যতটা সম্ভব ইগ্নোর করলো।

ওদের মধ্যেও গত দুইমাস ধরে অদ্ভুত পরিবর্তন আসছে, ফোন রেখে পড়ালেখা করে। হতে পারে পরিক্ষা এগিয়ে আসছে বলে তারাও পড়ালেখার গুরুত্বটা বুঝতে পারছে, অন্যথায় আমাকে দেখে তাদেরও পড়তে ইচ্ছে হয়। এটা সত্যি পড়ালেখার ক্ষেত্রে একজনের আগ্রহ অন্যজনকেও টানে।

প্রতিদিন বাবা-মার সাথে একবার অল্প কথা বলা ছাড়া বাকি পুরোটা সময়ই আমার পড়ার সাথে কাটে।
দেখতে দেখতে পরিক্ষা চলে আসলো। সেবার ডে ডিউটিতে ছিল একজন নতুন ম্যাজিস্ট্রেড, যার ডিউটি ব্যবস্থায় প্রথম দিনেই পুরো হলের স্টুডেন্টের কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিল। আর যারা টাকা পয়সা দিয়ে দূর্নীতিবাজি পরিক্ষার চিন্তায় বসে ছিলো তারা কলম কামড়ানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারলোনা।
সবদিকে বেখেয়াল হয়ে আমি সবগুলো পরিক্ষা ভালোভাবেই দিলাম। কেননা আমার কোনোদিকে খেয়াল করার দরকার ছিলো না।
পরিক্ষার উপরে আমার সর্বোচ্চ ভালো রেজাল্টের ভরসাটা ছিল। তবুও ভেতরে ভয় ছিল। কেননা আমি জানিনা ভাগ্য আমাকে এর যথাযথ মূল্য দিবে কিনা।

এখান থেকে পরিক্ষা দিয়ে বের হয়ে সোজা ঢাকা চলে গেলাম। সেখানেই এডমিশন প্রিপারেশন নেওয়া শুরু। আমি বাবাকে বলে দিয়েছিলাম চট্টগ্রাম বাদে দেশের সবখানে ভর্তির জন্য ট্রাই করবো। বাবাও সম্মত ছিল। এডমিশন কোচিংয়ের জন্য বাবাকে প্রচুর টাকা ঋণ করতে হয়েছিল।
তবে সেটার জন্য বাবার আফসোস ছিল না। উনার ভরসা ছিল আমি ভালো কিছু করবো।

যখন রেজাল্ট বের হয়েছিল তখন আমি বাড়িতে আসছিলাম। দুই রাখাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে চেয়েছিলাম আমার চেষ্টার ফলস্বরূপ যেন আমার স্বপ্নটা পূরণ হয়।
হ্যাঁ সেদিন আমার আর্জি মঞ্জুর হয়েছিল। বোর্ডের সেরা কলেজ থেকে সেরা রেজাল্ট আমার হয়েছিল। খুশিতে সেদিন বাবা পুরো এক ঘন্টা কান্না করেছিলো। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম মা-বাবারা সন্তানের সফলতায় কতটা খুশি হয়। আমার মা দাদু বারবার আমার কপালে চুমু খাচ্ছিলো।
আমার ছোট ভাইটা সারা গ্রামে তার বোনের রেজাল্ট নিয়ে গর্ব করছিলো।

তাদের সবার খুশিতে আমি জীবনের দেড়টা বছরের জন্য গভীর অনুশোচনা করছিলাম। আর পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম। যদি আমি ওখানেই থেমে যেতাম তাহলে আজকে সবার খুশিটা আমি কি করে দেখতে পেতাম?


তারপর আলহামদুলিল্লাহ আমি যেখানে প্রথমবার এডমিশন পরিক্ষা দিয়েছি, সেখানেই সুযোগ পেয়ে গেছি। তাই অন্য কোথাও আর চেষ্টা করিনি। চেয়েছিলাম এরপর তিয়াসের সাথে আমার দেখা না হোক। কিন্তু সেটা হয়েছিল। প্রশংসা পত্রের জন্য কলেজে গিয়েছিলাম। সেদিন আবার প্রশংসনীয় রেজাল্টের জন্য একটা অনুষ্ঠান ছিল। যেখানে ১৫ জনকে পুরষ্কার দিবে কলেজ কর্তৃপক্ষ। দীপ্তির রেজাল্ট সেটার আওতায় ছিল না। আমি ওর পরিক্ষা নিয়ে সংশয় করেছিলাম, সে ক্লাস পরিক্ষাতে আসলেই কি নিজের মেধার জোরে প্রথম হতো নাকি অন্য কারণ ছিল! নাহলে ফাইনালে এতো খারাপ করলো কি করে?

পুরো অনুষ্ঠানে তিয়াস আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর অনুষ্ঠান শেষে পুরষ্কার নিয়ে গেইটের বাইরের দিকে যেতেই তিয়াস দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে পেছনে এসে আমাকে বললো,
___প্রীলি তুমি আমার সাথে ৫ মিনিট কথা বলবে?

আমি না শোনার ভান করে গেইটের বাইরে পা রাখলাম। তিয়াস ওখানে দাঁড়িয়েই আরেকটু জোরে বললো,
___ তোমার চুল কোথায়? এতো ছোট আর অল্প হলো কি করে?

আমি পেছনে না তাকিয়েই বললাম,
___চুলও চলে গেছে বেঈমানের মতো!

তখনি দেখলাম বাবা রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখন বাবা প্রথম দেখেছিলো তিয়াসকে। আর আমি চেয়েছিলাম শেষবার দেখতে! কিন্তু হয়ে উঠেনি…

চলবে…..

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৬ষ্ঠ পর্ব) লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

0

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৬ষ্ঠ পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

হয়তো তিয়াসের প্রতি আমাকে আরো দূর্বল করার জন্য এটাই সবচেয়ে বড় কারণ ছিল!
কারণ পরেরদিন ঘটলো এক বিষ্ময়কর ঘটনা।
সারাদিন সবাই মন খারাপ করে বসে থাকার পরে বিকালে হঠাৎ তিয়াস রুহির নাম্বারে ফোন করে নুজহাতকে নিয়ে আমাদেরকে নিচে নামতে বললো।

আমরা কিছুটা অবাক হলেও নুজহাতকে নিয়ে গেইটের বাইরে গেলাম। যাওয়ার সাথে সাথে চমকে উঠলাম। সা’দ এবং তার মা-বাবাসহ তিয়াস এখানে দাঁড়িয়ে আছে। নুজহাতকে দেখার সাথে সাথে সা’দের মা তাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। সা’দের বাবা সা’দের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলতে লাগলো,
___এতো সুন্দর লক্ষী মেয়েটার থেকে দূরে যেতে চাইছিলি? ভাবতেই পারছিনা তুই আমার ছেলে। ভুল করেছিস অথচ সেটাকে নিয়ে সাহস করে বাঁচার চেষ্টা নেই? তুই ভালো করেই জানিস তোর মা-বাবা মেনে নিবে,তাও বলিস নি? কেন রে এরপর আরেকটা মেয়ের সর্বনাশ করার ইচ্ছে ছিল? আজকে যদি তিয়াস আমাদের সব না জানাতো কি হতো মেয়েটার? এখন চল ওদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে।

নুজহাত তিয়াসের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
___তিয়াস তোমার এই ঋণ আমি ভুলতে পারবোনা।

সা’দ এগিয়ে এসে নুজহাতকে সরি বলতে লাগলো।
আর আমার চারপাশটা মূহুর্তেই আবার রঙিন হয়ে উঠলো।
আমি কিনা তিয়াসের মতো একটা ছেলেকে ভুল ভেবে কাল সবখান থেকে ব্লক করে দিয়েছি?
আজকে ওর জন্মদিনে আমাকে সাজতে বলছিল, সেটাও কিনা আমি ভুলে গেছি। এখনো তো সময় আছে! আমি ওদের ভীড় থেকে এক দৌঁড়ে উপরে চলে গেলাম। তারাহুরো করে শাড়ী পরে আর কোনোভাবে একটু সাজগোজ করে আবার নিচে নেমে দেখি আমাদের রুমের বাকিরা রুমের দিকে আসতেছে। আমাকে দেখে ওরা হাসতে শুরু করে দিলো। আমি আঙুল দিয়ে বাইরে দেখিয়ে বললাম,
___ তিয়াস চলে গেছে?

ওরা পেছনে তাকিয়ে বললো এতক্ষণে চলে গেছে হয়তো, কিন্তু সা’দের মা-বাবা আর নুজহাত চলে গেছে। তারপরও আমি শাড়ীর কুচিতে মুঠো করে ধরে গেইটের বাইরে গেলাম। গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তিয়াস এখনো বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে সে হাসলো। আর ইশারা করলো এসে বসতে।
আমার হাতে সময় ছিল মাত্র এক ঘন্টা। কেননা সন্ধ্যার পরে আমাকে আবার ভেতরে আসতে দিবেনা।
তাই কাছাকাছি একটা ক্যাফেতে বসলাম।
সেখানে নামার পরে তিয়াস আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হঠাৎ বসে গেলো। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। নিচে তাকিয়ে দেখলাম বাইকে বসে শাড়ীর ভাজ হয়ে উপরে উঠে গেছে। তিয়াস সেটাই ঠিক করে দিচ্ছে।এই ব্যপারটা আমার অসম্ভব ভালো লাগছিলো। তারপর হাত ধরে একটা জায়গায় বসলো আর বললো,
___ তুমি রঙিন শাড়ী না কিনে এমন একটা হালকা রঙের শাড়ী পছন্দ করার পরে আমি অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু এটাতে তোমাকে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে সেটা দেখে আমি আবারও অবাক হলাম। এরপর মাত্র ১৫ মিনিটে তুমি শাড়ী পরে তৈরি হয়ে যেতে পারো সেটা দেখে..
সে বলার বলার আগেই আমি বললাম,
___ সেটা দেখে আরো অবাক হয়েছো?

তিয়াস হাসতে হাসতে বললো,
___ হ্যাঁ সত্যি তোমাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। শুনো একটা বুদ্ধি দেই, তোমার বিয়েতেও তুমি লাল,খয়েরী না পরে এমন হালকা রঙের বেনারসি পরবে ওকে?

আমি লজ্জায় হাসলাম। তিয়াস বিষয়টা খেয়াল করলেও কিছু বললো না।
পরক্ষণে খাবার আসলো। আমি খেতে খেতে বললাম,
___আচ্ছা তিয়াস তুমি এখান থেকে বের হয়ে কোথায় ভর্তি হবে?

তিয়াস চিবুতে চিবুতে বললো,
___ দেখা যাক।

আমি উৎসুক হয়ে বললাম,
___আমরা দেশের আর কোথাও চেষ্টা করবোনা। চট্রগ্রামেই থেকে যাবো। কি বলো? পাবলিক ইউভার্সিটিতে না আসলে প্রাইভেট কিংবা ন্যাশনালে থাকবো। কিন্তু আমরা চট্টগ্রামে থাকবো কেমন?

তিয়াস আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে বললো,
___ প্রীলি। এতো এডভান্স চিন্তা করো না। দেখা যাক কি হয়। তাছাড়া আমার বাবার চাকরির মেয়াদ বেশিদিন নেই। এরপর অন্য চাকরির সুবাদে অসংখ্য জায়গায় এমনকি বিদেশেও যেতে পারে।

আমি তিয়াসের এই কথার অর্থ তখন ধরতে পারিনি।
আর জিজ্ঞাসাও করিনি তার বাবা কিসের চাকরি করে।

তারপর কিছুক্ষণ কথা বলে আমরা তারাহুরো করেই চলে আসলাম। সন্ধ্যার আগে আগে রুমে এসে পৌঁছালাম। আমাকে দেখে সবাই এসে পাশে বসে বললো,
___কিরে তোদের প্রেমটা তাহলে হয়েই গেলো?

আমি লাজুক হাসিতে বললাম,
___নারে কিছু বলতে পারিনা।

রুহি বললো,
___সেও কি কিছু বলে না? কিংবা তুই কিছু বুঝতে পারিস না?

আমি না সূচক মাথা নাড়লাম। তারা হাহুতাশ করতে করতে আবার সরে গেলো।

ইয়ার ফাইনাল চলে গেলো। আমি কোনো রকম পাশ করছি। বাবাকেও রেজাল্ট জামাইনি। এর মধ্যে পড়ালেখার অজুহাতে বাড়িতেও বেশি যাইনি।
অন্যদিকে নুজহাতকে সবাই মেনে নিয়েছে। সা’দও আর এখন ভালো হয়ে গেছে। তবে নুজহাত হোস্টেলেই বেশি থাকে।

দেখতে আরো কয়েক মাস চলে গেলো। নুজহাত তাদের বাসায় এখন,কারণ ওর বেবি হওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। সব ঠিকঠাক কিন্তু আমার যাবতীয় পরিক্ষার রেজাল্ট খারাপ। তবে তিয়াসের প্রতি আমার ভালোবাসা আরো তীব্রতর। কারণ তিয়াসের সাথে পরিক্ষার আগে আগেই অন্য রকম একেকটা ঘটনার সম্মুখীন হই, যেটা তার প্রতি আমাকে এতটা দূর্বল করে যে আমি সারাক্ষণ তাকেই ভাবতে থাকি।

এতদিন অপেক্ষা করেছি সে নিজে কিছু বলবে। কিন্তু বলছেনা। এখন তো অন্তত আমার পড়ালেখা করা দরকার। এখন যদি না বলি হয়তো আর বলা হবে না। ২০ দিন পরে নির্বাচনী পরিক্ষা। নুজহাতকে নিয়ে সবাই চিন্তায় আছে,পরিক্ষা দিতে পারবে কিনা।

এদিকে আমি রুমের সবার সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঠিক করে ফেললাম আমি নিজেই তিয়াসকে প্রপোজ করবো!
এভাবে বলবো বলবো করে সময় মূহুর্ত সব এলোমেলো করলে তো আর হবে না । একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া দরকার।

সেদিন ছিল মেঘলা আকাশ, সকাল থেকে সারা আকাশ জুড়ে মেঘেদের আলোরণ। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। চারদিক নিরব,রাস্তায় আজ গাড়ীদের যানজটও তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। অথচ তিয়াস কেন জানি আগেরদিন জানিয়ে দিয়েছে আমি তার সাথে বিকাল ৩ টায় যেন দেখা করি। একটা রেস্টুরেন্টে আসার কথা বলছে।
আর আমি গত ৫ মাস থেকে ক্লাস থ্রির বাচ্চাকে পড়িয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করে ওর জন্য একটা রিং কিনেছিলাম। সেটা দিয়েই প্রথম শুরু হয়েছিল আমার টিউশন জীবন। আর প্রথমবার কারো জন্য উপহার কেনা। জানিনা মেয়েদের পক্ষ থেকে ছেলেদেরকে এইরকম উপহার দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত! কিন্তু অন্য রকম একটা আবেগ থেকেই আমি এটা করেছিলাম। ভেবেছিলাম এই দেখাতেই ওকে প্রপোজ করে ফেলবো।

বিকেলে ছাতা নিয়ে বের হয়ে গেলাম। আমি রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতেই দেখলাম আলাদা একটা জায়গা আগে থেকেই সাজানো। যার মধ্যখানে তিয়াস দাঁড়িয়ে আছে। এটা দেখে আমার মনে হচ্ছিলো তিয়াসই বুঝি আমাকে আগে প্রপোজ করবে। তবুও আমি যেহেতু ভেবে এসেছি তবে আমিই আগে করবো। তাছাড়া একজন আগে করলেই হলো। আমি হাসিমাখা মুখে ওর কাছাকাছি গিয়ে রিংটা বাড়িয়ে বললাম,
___যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই আমার মধ্যে সবচেয়ে অচেনা অনূভুতিরা ভীড় করেছিল। তখন বুঝতে পারিনি এটা কি,তবে এর কিছুদিন পর থেকেই আমি বুঝতে পারি আমি তোমাকে ভালোবাসি। এতদিন বলতে চেয়েও আমি পারিনি, অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু আমি প্রতিবার প্রতিনিয়ত, প্রতিটা সময় ব্যর্থ হয়েছিলাম। তাছাড়া আমি জানি তুমিও আমাকে…

বলার আগেই তিয়াস আমার কাঁধ বরাবর একটা ধাক্কা দিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
___দীপ্তি তুমি এসে গেছো!

আমি রিংটা হাতের মুঠোতে পুরে পেছনে তাকিয়ে দেখি দীপ্তি। বর্তমানে আমাদের ক্লাসের ভালো রেজাল্ট করা ছাত্রী। সকল শিক্ষকদের চোখের মণি।
যেটা আমার থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিয়াসকে পাওয়ার পর থেকে আমার স্থান পরিচয় এমনকি পুরো দুনিয়া বদলে গেছে। তিয়াস গিয়েই ওকে হালকা জড়িয়ে বলতে লাগলো,
___কতক্ষণ ধরে ওয়েট করছি বলোতো।

দীপ্তি মৃদু হাসি টানিয়ে বললো,
___সবাইকে নিয়ে আসতে এতো দেরি হয়ে গেলো। তাছাড়া আজকে দিনটাও কেমন যেন।

পেছনে তাকিয়ে দেখি সত্যি আমাদের ক্লাসের অনেকেই এখানে উপস্থিত। তারাও সবাই ক্লাস টপার।এসব দেখে এমন মেঘলা ঠান্ডা দিনেও আমার সারা শরীর ঘেমে একাকার। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে। তবে আঁচ করছিলাম আমি ভীষণভাবে ঠকে যাচ্ছি।

আমার সামনে বসে তিয়াস দীপ্তিকে হাঁটু গেড়ে বসে প্রপোজ করছিল। মনে হচ্ছিল আমার কলিজাটা ছিড়ে ভেতরে শনশন করে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকার পুরো শক্তি আমার হারিয়ে গেছে।
সামনে রাখা বিরাট কেকটার ঢাকনা খুললো। যেখানে লিখা
“Five Years Together ”

দীপ্তির হাসির রেশ থামছিলই না। সে কেক কাটলো।
একে অপরকে খাওয়াচ্ছে। কিন্তু আমার মাথায় যাচ্ছিলোনা ওদের পরিচয় ৫ বছর ধরে হলে এখন পর্যন্ত আমি কেন জানলাম না? প্রায় দেড় বছরেরও অধিক সময় ধরে তিয়াসের সাথে আমার পরিচয়। অথচ আজ পর্যন্ত কিচ্ছু বললো না। এসব কিছু না বুঝলেও এটা বুঝতে পারছিলাম তিয়াস আমাকে এখানে অপমান করতে ডেকেছে।
দীপ্তির গাল ঠোঁট কেক লেগে নাজেহাল সে হাত উপরে তুলে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো। তখনি তিয়াস সবাইকে উদ্দেশ্য করে আমার দিকে আঙুল করে বললো,
___গাইজ গাইজ, আজকে একটা মজার ব্যপার ঘটেছে। প্রীলি আমাকে প্রপোজ করেছিল। হাতে একটা রিং ছিল মেবি, ওহহো তোরা চলে আসায় ততটা খেয়াল করতে পারিনি।

তিয়াসের কথা শুনে বাকি সবাই হুহু করে হেসে উঠে একজন বললো,
___আরে কোটিপতি বাবার সুন্দরী ক্লাস টপারের বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে এইরকম নিম্নবিত্ত পরিবারের গেঁয়ো ব্যাকবেঞ্চার স্বপ্ন দেখে? মাই গড।

তিয়াস একজনের কাঁধে হাত রেখে বললো,
___থাক এসব নিয়ে আর কিছু বলিস না। বেচারি আর ক্লাসে প্রথম হওয়ার ক্ষমতা এমনিতেই রাখছেনা। এরপর এই বিরহবেদনা কাটাতে গিয়ে হতে পারে পরিক্ষায় দুটো সমানমাপের শূন্য নিয়ে আবার পাশের চেষ্টা করছে। তাই সত্যটা বলেই দেওয়া দরকার।

এতক্ষণ আমি তিয়াসের অন্য কাউকে ভালোবাসাটা দাঁড়িয়ে শুনতে পারলেও এই মূহুর্তে আমি আর নিতে পারছিনা। মনে হচ্ছে আমি আজকের পরে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই পোষণ করবো না।আমার প্রচন্ড জোরে চিৎকার দিয়ে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু আমি ভেতরের মৃত্যুটাকে নিশ্চিত করে তখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনে যাচ্ছি।
তিয়াস বলছে,
___দীপ্তি কে জানো? এই শহরের বিরাট বিজনেসম্যান দিলীপ খানের মেয়ে। শুধুমাত্র আমার জন্য সে এই কলেজে ভর্তি হয়েছে। পরিক্ষার পরে আমরা একসাথে আমেরিকা চলে যাবো। দীপ্তিকে তুমি বুঝতে পারো নাই, কিন্তু সবাই জানে দীপ্তি কখনো কোনোকিছুতে সেকেন্ড হয়না। সেটা হোক দূর্নীতি, অন্যায় কিংবা অভিনয়ের ছলে। কিন্তু কলেজে এসে একমাসেই দীপ্তির চেহেরা মলিন হয়ে গিয়েছিল তোমার জন্য, সে আশাহত হয়ে গিয়েছিল তার পূর্বকার রেকর্ড তোমার জন্য ভেঙে যাবে। কারণ তুমি ক্লাসে খুব ব্রিলিয়ান্ট বলে ঘোষিত হয়ে যাচ্ছিলে,কিন্তু আমি সেটা কি করে দিতে পারি বলো? দীপ্তি আমার জীবন। আমাদের পরিচয় ৫ বছরের! তাইতো প্রতিটা পরিক্ষার আগে আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য বিশাল বিশাল সারপ্রাইজ থাকে। কিন্তু বিশ্বাস করো সব দীপ্তির জন্য।

তাকিয়ে দেখলাম দীপ্তি আসতেছে। আমি চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলাম। তখন তিয়াস আস্তে আস্তে বললো,
___ইচ্ছেটা তোমার। বিরহশোকে নেতিয়ে যেওনা। তাছাড়া আমার এই এক্টিংয়ের মনে হয়না আর কোনো দরকার আছে। কারণ তুমি এতো অল্প সময়ে কিচ্ছু পারবেনা। ভ্যাঁ ভ্যাঁ! (মুখ ভাংচিয়ে বললো)

আমি বাম হাতে মুখ মুছতে মুছতে বললাম,
___আমি প্রীলিয়া হাসান যদি রক্ত মাংসে গড়া মানুষ হয়ে থাকি তাহলে আমি নির্বাচনীতে নয়, বোর্ড পরিক্ষায় সর্বোচ্চ গ্রেট এনে দেখিয়ে দিবো। শুধু তোমার মতো একটা বিশ্বাসঘাতক প্রতারককে নিজের মুখ দেখাতে চাইবোনা।

বলেই আমি পা বাড়ালাম। তবে পেছনে শুনতে পেলাম দীপ্তি বলছে,
___ তিয়াস প্রীলিয়া মুখ দেখাতে চাইবেনা বললো কেন?

এরপর কি বলেছে আমি শুনিনি। তবে আমি আজ নিজের সর্বনাশের কথা শুনেছি। নিজের ভুলের জন্য নিজের এতো বড় অধঃপতন টের পেয়েছি।
তবে এই চ্যালেঞ্জ কেন করলাম আমি বুঝতে পারছি না। আমার পক্ষে স্বাভাবিক বেঁচে থাকা সম্ভব কিনা সেটাই সন্দেহের। সেখানে কিনা এমন একটা চ্যালেঞ্জ করে বসলাম।
আমাকে কেউ আজ এভাবে ঠকালো! আমার জন্য এটাই বুঝি প্রাপ্য ছিলো। কারণ আমিও যে আমার পরিবারকে ঠকিয়েছি। বাবার এতো কষ্টের টাকায় পড়ালেখা না করে একটা ছেলের জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলাম। আমার জন্য এটা উচিত শিক্ষা ছাড়া আর কি?

চলবে……

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৫ম পর্ব) লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

0

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৫ম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

বটতলার প্রোগ্রাম শেষে সবাই যার যার মতো করে চলে গেলো। সা’দ আর নুজহাত একসাথে বেড়িয়ে গেলো, আর শুভা, রুহি,দিয়া হোস্টেলে যাওয়ার জন্য গাড়ীর অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়ালো।
আর তিয়াস আমার হাতে ধরে রাখছে বাইকে করে আমার সাথে ঘুরতে যাবে।
আমি অপ্রস্তুত হলেও তিয়াসের কোনো কথায় এখনো না বলিনি। তাই এখানেও মানা করার সাহস হয়নি।

বাইকে বসে আমি একহাতে তিয়াসকে জড়িয়ে বসলাম। সেটা ছিলো প্রথমবার তিয়াসের খুব কাছাকাছি হওয়া, যদিও প্রথমদিকে ওকে ধরতে আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিলো কিন্তু পরক্ষণে ওর কথাতেই আমি ওর সাথে লেপ্টে বসলাম।
কিছুদিন আগে রুমমেটদের সাথে পার্লারে গিয়ে চুলে একটা কাটিং দিয়েছিলাম, তবে তিয়াসের জন্য চুল ছোট করতে পারিনি। এই মূহুর্তে বাতাসে সামনের সেই কাটা চুলগুলো আমাকে পেরিয়ে তিয়াসকেও ডিস্টার্ব করছিলো, তবে আমি আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম তিয়াস মুচকি হাসিতে বিভোর! মানে তার কোনো বিরক্তি লাগছেনা।
ছেলেদের খুব কাছাকাছি গেলে একটা অন্য রকম স্মিল পাওয়া যায়, সেটা ভালোলাগায় কোনো মেয়েকে পাগল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট , তবে যে আগে থেকেই পাগল হয়ে আছে তাকে আরো কতটা পাগল করতে জানে সেটা আমি এই মূহুর্তে বুঝতে পারছিলাম। তিয়াস আমার কাছে নেশার চেয়ে বেশি কিছু, তার স্পর্শে আমি মাতাল হইনা শুধু, আমার পুরো জগৎটাই পাল্টে যায়।

সেদিন আমরা অনেক্ষণ ঘুরাঘুরি করেছিলাম। আমি ওর কাছাকাছি হচ্ছিলাম ততটাই আসক্তি বাড়ছিলো। আর তার প্রতি আমার ভালোবাসা তীব্র হচ্ছিলো।
সেদিনটা আমার জন্য ছিলো জীবনের সেরা দিনগুলোর একটা! কিন্তু ভেতরের অনূভুতিগুলো প্রকাশ করার দুঃসাহসিকতা তখনও হয়ে উঠেনি।


এর মধ্যে চলে গেলো কয়েকমাস।এখনো কেউ কাউকে কিছুই বলিনি। কলেজের বিভিন্ন পরিক্ষার মধ্যে দেখা যাচ্ছে আমার রেজাল্টের কোনো পাত্তাই নেই। যে আমি প্রথম স্থান ছাড়া কিছু মানতে পার‍তাম না, সে আমি আজকাল এসব কোনো পরোয়া করছিনা। কিন্তু সামনের মাসে আমাদের ইয়ার ফাইনাল পরিক্ষা। আমি নিজেকে ইদানীং পড়ালেখায় সিরিয়াস করার চেষ্টা করছি। তিয়াসের সাথে সন্ধ্যার পরে কথা না বলার প্রচুর চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা। তারপর আমি একদিন মুখ বুজে বলেই ফেললাম,
___তিয়াস শুনো, সামনে তো পরিক্ষা। আমাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। একমাস ভালো করে পড়লে ভালো কিছু করতে পারবো ইনশাআল্লাহ। আমি ইয়ার ফাইনালে খারাপ রেজাল্ট মানতে পারবোনা। আমি দুইমাস কম কথা বলতে চাই। আইডি ডিএক্টিভ করে দিবো। তুমিও মনোযোগ দিয়ে পড়ো প্লিজ।

জবাবে তিয়াস আমার কথাটাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে রিপ্লে দিলো,
___ কাল আমার সাথে মার্কেটে যেতে পারবে?

আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম,
___আচ্ছা যাবো।

সকালের দিকে বের হলাম। ২০ মিনিট পরে আমরা পৌঁছালাম। তবে আমার মনে হয়েছে দুই মিনিটও হয়নি। সত্যিই তিয়াসের সাথে কাটানো সময়গুলো ভীষণ দ্রুত চলে যায়।
তারপর সে আমাকে নিয়ে একটা শাড়ীর দোকানে নিয়ে গেলো। আমাকে পছন্দ করে দিতে বললো।

প্রথমত আমি ভেবেছিলাম তার মায়ের জন্য হবে হয়তো। তাই আমি ভীষণ হালকা একটা কালারের শাড়ী পছন্দ করে দিলাম। সে আমার কথামতো এইটাই নিলো।
তারপর কসমেটিকসের দোকানে গিয়ে কানের দুল থেকে শুরু করে, গলার,কোমরের,মাথার খোঁপার,হাতের চুড়ি,লিপস্টিক, এমনকি জুতার দোকান থেকে জুতাও মিলিয়ে নিলো।
তারপর আমাকে বললো,
___চলো তোমাকে পৌঁছে দেই।

আমি মাথা নাড়লাম। তারপর সে আমাদের হোস্টেলের সামনে এসে সবগুলো ব্যাগ হাতে ধরিয়ে বললো,
___এই মাসের শেষে আমার জন্মদিন জানোই তো। সা’দের মতো সারপ্রাইজ পেতে চাইনা। তুমি এইগুলা পরে সেজে আমার সামনে আসবে,তাহলে আমি সবচেয়ে বেশি সারপ্রাইজড হবো। বাই বাই!

বলেই তিয়াস বাইক স্টার্ট করে চোখের পলকে চলে গেলো। আমি ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর রুমে আসলাম। এসে দেখি নুজহাত রুমে নেই।
নুজহাতের কিছু ব্যপার আমার কাছে ইদানীং ভীষণ অন্য রকম লাগে। সে কেমন জানি আচরণ করে।
এই কয়েক মাসে নুজহাতের সাথে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। কিন্তু গত কয়েকদিন থেকে নুজহাত একদম বদলে গেছে। সা’দের সাথে দেখা হওয়ার কথাও বেশি শুনিনা। এমনকি কথা বলতেও দেখিনা। নুজহাতের মধ্যে আগের মতো আর প্রাণচাঞ্চল্য নেই।

আমি এতোকিছু ভাবলাম না। ফ্রেশ হয়ে একটা ঘুম দিলাম। রাত ৮ টায় উঠে খাইলাম। এরপর তিয়াসের সাথেও অনেক্ষণ কথা বলে অনেক রাত করে আবার ঘুমালাম। আইডি ডিএক্টিভ করার চিন্তাও বাদ দিয়ে দিলাম। আমার পড়ালেখা করার সিদ্ধান্ত আবারও শূন্য মাত্রায়।

কয়েকটাদিন এভাবেই আবার পড়ালেখাবিহীন চলে গেলো। তবে ভালোই কাটলো৷
৯ দিন পরে, তিয়াসের জন্মদিনের আগেরদিন হঠাৎ করেই নুজহাত উধাও হয়ে গেলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা ওর কোনো খোঁজ নেই।
নুজহাতের ফোন বন্ধ আমরা ওর বাসায় ফোন করেও খোঁজ নিলাম সে গেছে কিনা, কিন্তু তারা বললো নুজহাত আসেনি।
সা’দের নাম্বারে ট্রাই করে দেখলাম শুধু ব্যস্ত বলে। শুধু আমার না,রুমের সবাই ট্রাই করছে।
পাশাপাশি নুজহাতের একটা দুঃসম্পর্কিত আন্টির বাসা আছে, সেখানেও খোঁজ করে দেখলাম নুজহাত নেই।
তারপর আমি তিয়াসকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলাম সা’দ কোথায়? তিয়াস বললো সা’দ তার গ্রামের বাড়িতে গেছে সপ্তাহখানেক হলো এবং তিয়াস নিজেই ওকে বাসস্ট্যান্ডে দিয়ে আসছিলো।

আমি ভীষণভাবে চমকালাম। কোথায় যেতে পারে নুজহাত? তাছাড়া সে আমাদের কাছে কিছু শেয়ারও করছেনা। শুধু নিজের আচরণটা উদ্ভট করে ফেলেছে। নুজহাতের নিখোঁজ হওয়ার মধ্যেও আমার ততটা মাথা ব্যথা ছিলো না।
আমার সারাক্ষণ কল্পনা ছিলো আগামীকাল কীভাবে সেজেগুজে তিয়াসের সামনে যাবো। কারণ কাল তার জন্মদিন!

ঠিক এশারের আজানের সময় হঠাৎ গেইটের সামনে দাড়োয়ান চাচাকে জোরে জোরে কথা বলতে শুনলাম। আমরা দৌঁড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখলাম নুজহাত কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতেছে। হোস্টেলে সন্ধ্যার পরে আসা নিষিদ্ধ। চাচা নুজহাতকে ধমকিয়ে বললো,
___চলো স্যারের কাছে। তোমার গার্ডিয়ানকে ফোন করে জানানো হবে।

আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেলাম। তখনই রুহি বললো,
___গার্ডিয়ানকে ফোন দিলে দিবে। চিন্তা করিস না, নুজহাতের গার্ডিয়ান আমি।

আমি অবাক হয়ে তাকালাম। আমার তাকানোতে সবাই হেসে বলল,
___লিয়া তোর ক্ষেত্রে হলে নির্ঘাত বিপদে পড়ে যেতি। কিন্তু আমরা আমাদের মধ্যকার নাম্বার একেকজনের গার্ডিয়ান নাম্বার বলে ফরম পূরণ করেছিলাম। কিচ্ছু হবে না, আয় ফোন ধরে একটা এক্টিং করি।

রুহি ফোন হাতে নিয়ে পা ভাজ করে বসলো। দুই মিনিটের মাথায় সত্যি ফোন আসলো। রুহি গলা ঝেড়ে বললো,
___কেডা বলতাছেন?

নিচতলা থেকে স্যার বলছে,
___ আপনি কি নুজহাতের আম্মু বলছেন? আপনার মেয়ে হোস্টেলে এশারের সময় প্রবেশ করেছে, আপনি কি জানেন এই ব্যপারে।

রুহি গলায় ভাঙা ভাব এনে বললো,
___স্যার আমার মাইয়া তাইলে পৌঁছাইছে? আমি কতো করে কইছি কালকে যাইস, কিন্তু হে কইলো সামনে পরিক্ষা, একটা রাতেরও নাকি অনেক দাম। ভালো করে পড়তে হইবো। তাইতো সকালে আইসা বিকালের পরে রওয়ানা দিছে, এতো দূরের পথ স্যার, আমার মাইয়া ঠিকমতো গেছে তো?

বলেই রুহি কান্নার ভান করলো।
স্যার কিছুটা নরম স্বরে বললো,
___ হ্যাঁ ভালোভাবেই আসছে। আচ্ছা আচ্ছা তাহলে রাখি।

বলে ফোন কেটে দিলো। আমরা সবাই হাতের উপর হাত রেখে জোরে হেসে উঠলাম। তারপর গেলাম নুজহাতকে এগিয়ে আনতে। নুজহাত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারছিলোনা। তাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চোখ দুটো ফোলা আর আগুনের ন্যায় লাল। অনেক কান্না করেছে বুঝা যাচ্ছে।
রুমে আসার পরেই সবাই একসাথে জিজ্ঞাসা করতে থাকলাম, কি হয়েছে।
কিন্তু আমার জিজ্ঞাসাতে তার কান্নার বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটা সময় আমরা নিজেদের থামালাম। বেচারিকে সময় দেওয়া দরকার।

নুজহাত গোসল করতে গেলো। আমি তিয়াসের সাথে আজকে স্যারের সাথে হয়ে যাওয়া আমাদের কান্ডকারখানার কথা বললাম। তারপর সেও তার জীবনে এই ধরনের অসংখ্য ফাঁকিবাজির কথা বললো। এরপর আমি নুজহাতের হঠাৎ বদলে যাওয়া,কান্নাকাটির বিষয়গুলো বললাম, এটা শুনতেই তিয়াস কেমন যেন কথার মোড় পাল্টাতে লাগলো। দেরিতে জবাব, এই সেই বলতে লাগলো। আমি কিছুই বুঝলাম না।
এদিকে নুজহাত প্রায় এক ঘন্টা পরে গোসল করে আসলো। বুঝতে পারছিলাম সেখানেও কান্না করে আসছে। আমি ফোন হাতেই তিয়াসের জবারের অপেক্ষা করতে করতে নুজহাতের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বললাম,
___ সা’দের সাথে তোর কিছু হয়েছে? এভাবে কাঁদতেছিস কেন?

নুজহাত প্রচন্ডবেগে কেঁদে উঠে বললো,
___ লিয়া আমি প্রেগন্যান্ট।

কথাটা শোনার সাথে সাথে আমার হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেলো। দিয়া,শোভা,রুহি লাফিয়ে উঠে নুজহাতকে ঘিরে দাঁড়ালো। আমাদের চোখেমুখে অবিশ্বাস্য চাহুনি। বুঝতে পারছি না এই মূহুর্তে ঘৃণাটা জরুরী নাকি কথা বলে সবকিছু জানতে চাওয়া,
পরক্ষণেই নুজহাত কাঁদতে কাঁদতে বললো,
___আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। গত দুইমাস আগে আমার সার্টিফিকেটে ১৮ বছর পূর্ণ হতেই আমরা কোর্টে বিয়ে করেছি।

এইটা শুনে আমরা সবাই একটা আশ্বস্তির দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বসলাম। তবে আমি বাদে সবাই কটু দৃষ্টিতে বললো,
___ তাই আমাদেরকেও এটা জানালি না?

কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো তারা এটা গোপনীয়তার জন্য জানায়নি। তবে এখন নিশ্চয়ই কোনো গোলমাল পেকেছে। আনি নুজহাতের মাথায় হাত রেখে বললাম,
___ বিয়ে করেছিস তাহলে কাঁদছিস কেন? ওর সাথে কথা বল। তারপর তোর পরিবারকে ওর কথা বলে তারাতাড়ি পরিবারকেও মানিয়ে নে। আর এই বয়সে তো অসংখ্য মেয়েরা বাচ্চা নিচ্ছে। তোরা ভুল কিছু তো করিস নি। বিয়ে করেছিস না?তাহলে এতো ভেঙে পড়ছিস কেন? পরিবার না মানলে তোরা কোথাও পালিয়ে গিয়ে সংসার কর,দেখবি এক দুইবছর পরে সব ঠিক হয়ে গেছে।

আমার কথা শুনে নুজহাত আমাকে হুড়মুড় করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললো,
___সা’দ আমার সাথে প্রতারণা করেছে। সে বাচ্চার দায়ভার নিতে অস্বীকার করেছে লিয়া। আমার থেকে পালানোর জন্য সে নিজের গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। সে স্পষ্ট বলে দিয়েছে এই বয়সে সে এত দায়ভার নিতে পারবেনা।

আমি ওর মাথা তুলে রেগে বললাম,
___এই বয়সে দায়ভার নিতে না পারলে আকাম করলো কেন? ওর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকবি, ওরে জেলের ভাত খাওয়াবি। কতো ভালো ভাবছিলাম সা’দ কে, ছি! সে এমন!

নুজহাত ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,
___কেউ ভালো না। কেউ কথা রাখেনা। এই জগতে সবাই প্রতারক। আর লিয়া তুই কি বলছিলি মামলা করবো? কি হবে বলতো? আমার কি হবে? আমি না হয় বাচ্চা নষ্ট করলাম কিন্তু আমার পরিবার আমাকে কি ভাবে নিবে? আমার পরবর্তী জীবনটা কোন দিকে মোড় নিবে? আমার সবকিছু এভাবে শেষ হয়ে যাবে আমি ভাবতে পারিনি লিয়া।

বলতে বলতে আবার হুহু করে কাঁদতে লাগলো। আমার পুরো মাথা ঝিমঝিম করছে। এক মূহুর্তের মধ্যে আমার আগামীকালের দিন নিয়ে পুরো কৌতুহল পাল্টে গেলো। বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে, সত্যিই কি মানুষ পরে এভাবে বদলে যায়? তিয়াস তো সা’দেরই বন্ধু। সেও এই ধরনের প্রতারণা করবেনা তার কি গেরান্টি? কি করতে যাচ্ছি আমি?
না না আমি এই মোহ থেকে বের হয়ে আসবো। আমাকে সব ভুলে যেতে হবে। একটা ছেলের পাল্লায় পড়ে আমার এতো বছরের রেকর্ড বদলে আজ আমি ফার্স্ট থেকে লাস্ট পর্যায়ের স্টুডেন্টেও নিজেকে ভাবতে পারিনা। এটা তো চাইলে এখন বদলাতে পারবো কিন্তু নুজহাতের মতো পরিণতি হলে আমার কি হবে? আমাকে শোধরাতে হবে সবকিছু। সব শোধরাতে হবে!

আমি শক্ত মনোবল নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে যেভাবেই হোক এই ঘোর থেকে বের হতে হবে। এবং হতেই হবে। আমি নুজহাতকে কোনোভাবে শান্ত করে বই নিয়ে বসে গেলাম।

সেইরাতে সা’দের কার্যকলাপের কথা শুনে তিয়াসের প্রতি আমার যে একটা চিন্তাচেতনা জাগ্রত হয়েছিল সেটা ধরে রেখে যদি আমি সামনে আগাতে পারতাম তাহলে হয়তো জীবনটা তখনও সার্থক হওয়ার ছিলো। কিন্তু পরেরদিনই কেটে গেলো আমার সব বাজে ধারণা।
হয়তো তিয়াসের প্রতি আমাকে আরো দূর্বল করার জন্য এটাই সবচেয়ে বড় কারণ ছিল!

চলবে…..

আগামীকাল রহস্য উন্মোচন হবে!

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৪র্থ পর্ব) লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

0

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৪র্থ পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

তখন বুঝতে পারিনি এই ছবিগুলোই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে!

তিয়াসের সাথে সেদিন ছবি পর্যন্তই কথা। আমি তখনই সবাইকে মাথা ব্যথার অজুহাতে রুমে চলে আসি।
বাকি রুমগুলোর অধিকাংশই তালা লাগানো। এদিকে আমি আমাদের রুমে একা বসে আছি। এদিক ওদিক পায়চারী করছিলাম আর বারবার আয়নায় নিজেকে দেখছিলাম। এতোবার আয়না দেখতে চাওয়ার কারণটাও আমার তখন মাথায় আসেনি।
আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের বদলে শুধু ওই চোখ,ঠোঁট, হাসি আমার সামনে ভাসছিলো।
তারপর এইটা মিলাতে পারছিলাম না, তিয়াস আমাদের ক্লাসের অথচ আমি এতদিন দেখিনি কেন?
তিয়াস নিশ্চয়ই নুজহাতদের মতোই কলেজ ফাঁকি দেয়। ক্লাসে নিয়মিত হলে আমাকে তো অবশ্যই চিনতো।
জীবনে প্রথমবার বুকের ভেতর একটা অস্বস্তিকর যন্ত্রণা হচ্ছিলো। আজকের আগে নিজেকে এতটা উদাস আর কখনো মনে হয়নি। অন্য রকম একটা অনূভুতি আমার সারাময়!

খুব করে চাইছিলাম পড়তে বসবো। কিন্তু কিছুতেই পারছিলাম না। বিকালের দিকে নুজহাত বাদে সবাই রুমে চলে আসলো। নুজহাত নাকি সা’দের সাথে ঘুরতে গেছে।

নুজহাত ফিরলো সন্ধ্যার দিকে। এসে ফ্রেশ হয়েই ফোন নিয়ে আবার শুয়ে গেলো। অন্য সময় হলে আমি বাদে সবাই এটাই করে। আজকে আমারও কেন জানি পড়তে ইচ্ছে করছে না।
বামে তাকিয়ে দেখলাম দিয়া মুভি দেখছে। আমি আস্তে আস্তে ওর কাছে গিয়ে বসে বললাম,
___ একটু জায়গা দাও, আমিও দেখবো।

আমার কথা শুনে রুমের বাকি সবাই ফোন সরিয়ে উঁকি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। শুভা রসিকতার ভঙ্গিতে বললো,
___ ওমাহ, লিয়া আজকে এখনো পড়তে বসো নাই? অন্য সময় তো এতক্ষণে জোরে জোরে পড়ে আমাদের কান ঝালাপালা করে দিতা।

আমি সবকথাগুলো হাসিতে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে দিয়ার সাথে মুভি দেখছি, হিন্দি তেমন একটা বুঝিনা তাই দিয়া মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু একটু যাওয়ার পরেই বিভিন্ন রোমান্টিক সিন সামনে আসছে, আমি চোখ সরিয়ে আবার তাকাচ্ছি, আমাকে এমন করতে দেখে দিয়া বললো,
___আগে কখনো রোমান্টিক মুভি দেখোনি?

আমি না সম্মতিতে মাথা নাড়লাম। এটা দেখে নুজহাত আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
__দিয়া ওরে জিগা তো আজকে হঠাৎ করে মুভি দেখতে গেলো কেন? বেচারার এখনো পর্যন্ত ফেইসবুক একাউন্টই নাই। হাহাহা ওর এই বয়সটাই বৃথা! সারাক্ষণ আছে বইয়ে মুখ গুজে থাকা!

আমি চুপ করে থাকলাম। এর ৫ মিনিটের মাথায় নুজহাত জোরে জোরে বলে উঠলো,
___ এই এই শুন ফেইসবুকের কথা বলতে বলতেই তিয়াস আমার কাছে লিয়ার ফেইসবুক আইডি জানতে চাচ্ছে।

এই কথা শুনে রুহি প্রথমে কিছুটা অবাক হলো। তারপর হাসতে হাসতে বললো,
___ওরে বলে দে লিয়া ফেইসবুক উচ্চারণও জানেনা।
হাহাহা!

পরক্ষণে রুহি এগিয়ে এসে নুজহাতের পাশে বসে বললো,
___কিরে লিয়ার আইডি জানতে চাচ্ছে কেন?

নুজহাত আমার দিকে ফিরে বললো,
___লিয়ার সাথে নাকি জরুরী কথা আছে।

আমি এতক্ষণ মনযোগ দিয়ে শুনছিলাম। এবার আমি বালিশের কাছ থেকে আমার ফোনটা নিয়ে এগিয়ে বললাম,
___নুজহাত আমাকে ফেইসবুক একাউন্ট খুলে দাও।

তাকিয়ে দেখি বাকিরা উঠে এসে আমাকে ঘিরে ধরে তাকিয়ে আছে। আমার হঠাৎ এই পরিবর্তন হয়তো কেউ গ্রহণ করতে পারছেনা৷
নুজহাত মুখ ভেংচিয়ে বললো,
___সেদিন পড়তে বসে বিরবির করে বলছিলে, মেয়েরা পড়ালেখা করতে এসে কিসব নিয়ে পড়ে থাকে, বাবা-মা তাহলে হোস্টেলে দিলো কেন? আমরা তো এসব নিয়েই পড়ে থাকি, কিন্তু তুমি এখন চাইছো কেন? আচ্ছা তিয়াস ফেইসবুক একাউন্ট চাচ্ছে কেন বলোতো? আজকে আমরা চলে যাওয়ার পরে তিয়াস কি বলছে তোমাকে?

আমি চুপ করে রইলাম। নুজহাত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, কি ভেবে হাত বাড়িয়ে বললো,
___ দাও একাউন্ট খুলে দিচ্ছি। পাসওয়ার্ড তুমি দিও।

পাসওয়ার্ড দেওয়ার জন্য মোবাইল আমার হাতে দেওয়ার পরে আমি কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। দেওয়ার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনা৷ আজ তিয়াস আমাকে প্রীলি বলে ডেকেছিল এটা মনে হতেই আমি এটা ট্রাই করলাম,’ Prili ‘ কিন্তু সেটা হলো না, কারণ ছয়টা শব্দ লাগবে। এখানে মাত্র ৫ টা।
হুট করে ইংরেজিতে Priyas লিখে পাসওয়ার্ড কনফার্ম করে দিলাম। কেন করলাম সেটা আমিও জানিনা। তারপর নুজহাত রুমের সবাইকে এড দিয়ে তিয়াসকে এড করে দিলো।
এড করার সাথে সাথে তিয়াস কয়েকটা ছবি সেন্ট করলো। আমি দেখার আগেই নুজহাত চিৎকার করে বললো,
___ দেখ দেখ আমাদের লিয়া তিয়াসের সাথে কি সুন্দর করে আজকে ছবি তুলছে। অথচ আমাদের সাথে একটাও তুলে নাই। কি লিয়া, ব্যাপার কি বলোতো?

আমি টান দিয়ে ফোনটা নিয়ে দেখলাম, আজকে আমার সাথে যে ছবি তুলেছে এগুলো আমাকে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত তিনটা বোর্ড পরিক্ষা আর একবার মামার বিয়েতে নিজের ছবি তুলেছিলাম। এছাড়া আমার ছবি তুলতেই কখনো ইচ্ছে হয়নি।
ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি তিয়াসের লুকের দিকে খেয়াল করে চোখ সরাতে পারছিলাম না। দুটো ছবিতে তিয়াস আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে, সেটার দিকে তাকাতে আমার ভেতরে অন্য রকম অনূভুতিতে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো।
আরেকটা ছবিতে নিচের দিকে খেয়াল করলাম, তিয়াসের হাত আমার একগোছা চুলের উপর। কিন্তু ছবি তোলার সময় যে আবারও আমার চুলে স্পর্শ করেছিল সেটা টের পাইনি।
তবে এটাও সত্যি আমাকেও ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। আমি গালে হাত রেখে বুঝার চেষ্টা করলাম আসলেই কি আমি এতো সুন্দর? নাকি দামী ক্যামেরায় তুলেছি বলে সুন্দর দেখাচ্ছে? তিয়াস আমার চেয়ে অনেক বেশি লম্বা, আমি ওর কাঁধ বরাবর থেকে আরেকটু উপরসমান। কিন্তু দুজনকে একসাথে খারাপ লাগছে না!

সবার মনোযোগ এখন আমার দিকে থাকলেও আমি একমনে ছবিগুলো দেখছিলাম। নিজের বিছানায় এসে শুয়ে অনেক্ষণ ধরে দেখে হঠাৎ মনে হলো নিচে টেক্সটও করেছে। টাইপ করতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। কোনো কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনা। তিয়াস লিখেছে,
__ ছবিগুলো দেওয়ার জন্যই নুজহাতের কাছে তোমার আইডি চেয়েছিলাম। তা এখন কি করছো?

অনেক্ষণ ধরে ওয়ার্ড খুঁজে বের করে তারপর জবাব দিলাম,
___শুয়ে আছি, আর আমি এখনি আইডি খুলছি।

তারপর তিয়াস আবার রিপ্লে দিলো,
___নুজহাত বলে তুমি নাকি সারাদিন পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকো?

আমি সিন করেও কোনো রিপ্লে দিলাম না। তিয়াস আবার বললো,
___আচ্ছা তুমি টাইপিংয়ে মনে হয় কাঁচা। শুনো কাল আমি ক্লাসে আসবো। দেখা হবে তোমার সাথে।

আমি আচ্ছা লিখে অনলাইন থেকে বের হয়ে আসলেও ওর মধ্য থেকে বেরুতে পারলাম না। ছবিগুলো ঘন্টায় কয়েকশো বার দেখা হয়ে গেছে, খুব মনোযোগ দিয়ে বারবার দেখেও দেখার ইচ্ছের ব্যতিক্রম হচ্ছিলোনা। সবার দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছিলাম ওরা কেন পড়ালেখা ছেড়ে সারাক্ষণ ফোন, চ্যাট, এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এই পরিস্থিতিটা খুব ভয়াল! আমার একদিনেই পড়ালেখা থেকে মনোযোগ উধাও। সেদিন সারারাতে আমার ঘুম ভেঙেছে ৫০ বারেরও বেশি, একটু চোখ বন্ধ করতে পারলেও ওকে নিয়েই উল্টা পাল্টা স্বপ্ন দেখে জেগে যাচ্ছিলাম। কাঁথার নিচে লুকিয়ে বারবার ছবিগুলো দেখছিলাম। অথচ এত বছর পর্যন্ত আমার রাত পোহায় এক ঘুমে। শরীর খারাপ লাগলে যদি ঘুমে কোনো ব্যঘাত হয়।

পরেরদিন সকালে উঠে কলেজের জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। রুম থেকে বের হয়ে যাবো, তখন কি ভেবে যেন রুহির বক্স থেকে কাঁজল নিয়ে চোখে লাগালাম।
দুইতিনবার আয়না দেখে রুম থেকে বের হলাম।
ক্যাম্পাসে যাওয়ার পরেই আমার চোখ এদিক ওদিক কাউকে খুঁজছিল। পরিশেষে ক্লাসে গিয়েই তার দেখা মিললো তার।

তিয়াস বারবার বলছিল ক্লাস করার দরকার নেই। কিন্তু আমি শুনলাম না। সেও আমার জন্য ক্লাসে বসলো।
এদিকে ক্লাসে বসে পড়লাম আরেক বিপদে, আমি তো আজ পড়া শিখে যাইনি।
অন্য সময় স্যার আমাকে পড়া পারবো ভেবে বেশিরভাগই জিজ্ঞাসা করে না। প্রথমে ভেবেছিলাম আজকেও এটাই হবে, সবাইকে পড়া জিজ্ঞাসা করলো কিন্তু কেউ ভালো করে উত্তর দিতে পারলোনা। তিয়াসকেও জিজ্ঞাসা করছিল সেও পারেনি। একদম শেষ দিকে স্যার আমার দিকে আঙুল করে বললো,
___কাল অনুষ্ঠান করে সবাই কি বাসায় গিয়ে ঘুমিয়েছো শুধু? আচ্ছা সে যাই হোক কেউ না পারুক, প্রীলিয়া অবশ্যই পারবে। সে আমার প্রিয় এবং ক্লাসে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছাত্রী। উঠে দাঁড়াও প্রীলিয়া।

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বললাম,
___ স্যার আসলে আমিও…

স্যার রেগেমেগে বলে উঠে,
___ কিহহ আজ তুমিও শিখলে না? অথচ আমি কিন্তু এটা আশা করিনি প্রীলিয়া। পরবর্তীতে যেন এমন না হয়। তোমাকে দিয়ে ভালো কিছুর প্রত্যাশা করি!

আমি মাথা নিচু করেই আবার বসে পড়লাম।
স্যার ক্লাস থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে তিয়াস আমার হাতে ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেলো আর বললো,
___ আর ক্লাস করতে হবে না। আজকে সব ক্লাসেই এমনভাবে লজ্জা পেতে হবে।

আমি মন খারাপ করে বললাম,
___আজ ক্লাস না করলে তো কাল কি পড়া সেটাও জানবোনা। কালকেও পারবোনা। এভাবে দেখা যাবে আমি একদম বাজে স্টুডেন্ট হয়ে গেছি। জানেন আজকেই প্রথম আমি ক্লাসে পড়া পারিনি। ছোট থেকে এই পর্যন্ত…

বলার আগেই তিয়াস ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো,
___ চুপ চুপ, এদিকে আসো। এখান থেকে ফাঁকি দিয়ে পালাবো। একদিনে কিচ্ছু হবে না।

আমি কিছু না বুঝেই ওর পেছন পেছনে কলেজের একদম উল্টো দিকের একটা গেইটের সামনে গেলাম। এদিকে কোনো গেইট আছে আজকেই দেখেছি।
তারপর সেখান থেকে একটা টঙ্গের দোকানে দুজন বসলাম। প্রথম প্রথম কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করলেও তারপর কেমন জানি স্বাভাবিক হয়ে গেছি। ওর কথাগুলো এতো মজার আমি সেদিন এতো হেসেছি যে এর পূর্বে কবে এতো হেসেছি তাও জানা নেই। একটা মানুষ এসে আমার অতীতের সব রেকর্ড একে একে ভেঙে দিতে লাগলো। সত্যি বিষয়টা আমার জন্য চমকের!

তারপর শুরু হলো ক্লাস ফাঁকি দেওয়া, পড়ালেখায় অমনোযোগী হওয়া, সাজগোজ করে ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখা,রাতভর ফোন চালিয়ে সকালে ঘুমানো, জীবনে যে আমি কাউকে তুই করে সম্বোধন করতে পারতাম না, সে আমি সেটাও শিখে গেছি। অনন্য ক্ষেত্রে আমি আমাকে তুই বলা নিতেও পার‍তাম না আবার কাউকে বলতেও পারতাম না। তাই রুমের সবার সাথে প্রথমদিকে শুধু আমার ক্ষেত্রে তুমি সম্বোধনটাই ছিল। মানে ৮-১০ টা মেয়ের মতোই আমার জীবন শুরু হয়ে গেলো।
কিন্তু তিয়াসকে এই দুইমাসে এখনো তুই বলিনি, আর সেও বলেনি। তবে আমাদের মধ্যে প্রেম এসেছে কিনা এতদিনেও বুঝতে পারিনি। শুধু এইটুকুই জানি তিয়াসের সাথে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে!
আমাদের রুমের সবার সাথেই ওর বন্ধুত্ব, কিন্তু আমার উপরে ওর সব নির্ভরতা ভর করে।
একটা সুতো কিনলেও সেটা আমার পছন্দে কিনে।
ওর সকাল শুরু হয় আমার সাথে কথা বলে, ওর বেলা কাটে আমাকে নিয়েই,ওর ঘুমাতে যাওয়াও আমাকে শেষ টেক্সট দিয়ে। তার নির্ভরতা আমার উপরে বললে ভুল হবে। আমার নির্ভরতাও এখন তিয়াসের উপর।

সেদিন সা’দের জন্মদিন ছিলো। নুজহাত মাসের শুরুতেই প্লানিং করছে তাকে কীভাবে সারপ্রাইজ দিবে। আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে কেকটা কেমন হবে,এবং উপরের নাম দেওয়ার পরিকল্পনাটা পুরোটা আমার ছিল।
ওর জন্মদিনের দিন সবাই মিলে শহর থেকে অনেকটা দূরের বটতলায় গিয়ে সে জায়গাটা সকালের পর থেকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। বিভিন্ন ফুল বেলুন দিয়ে সাজাতে সাজাতে প্রায় দুপুর পেরুলো। তারপর আমি তিয়াসকে আগে আগে এসে কেমন হয়েছে দেখতে বললাম।
আধ ঘন্টার মধ্যে তিয়াস চলে আসলো। তখন সবকিছু প্রায় রেডি। নুজহাত এবার সাজগোজ করতে পার্লারে চলে গেলো। আমরা মোটামুটি যা তৈরি হওয়ার আগেই হয়ে নিয়েছি। শুভা, ওর রুহি গেলো কেক নিয়ে আসতে। আর দিয়া আর আমি এখানে পাহারাদার। তিয়াস এসেই চমকে গেলো।
ডেকোরেশন নিয়ে তার প্রশংসা যেন থামছেই না।

আমি সাজানো জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আমার ফোনটা তিয়াসের দিকে বাড়িয়ে বললাম,
___ একটা ছবি তুলে দাও তিয়াস।

তিয়াস ফোন হাতে নিয়ে বললো,
___ফোন তো লক। পাসওয়ার্ড বলো।

আমি অকপটে বলে ফেললাম,
___ Priyas

তিয়াসের হাসি মুখটা কেমন যেন হয়ে গেলো, সে আমার দিকে তাকিয়ে অপরাধী প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিয়ে বললো,
___ কে প্রীয়াস? তার নামে একদম ফোনের লক দেওয়া..

আমি মাঝকথায় বলে বসলাম,
___ সবকিছুর পাসওয়ার্ড এই নামেই। এবার ছবি তুলো।

তিয়াস ছবি তুললো। কিন্তু আর কোনো কথা বলল না। তার মুখটা পুরো দেখার মতো ছিলো। হাসির কোনো কিঞ্চিৎ রেশও নাই। আমার মজাই লাগছিল। মনে মনে আমারও এটাও মনে হচ্ছিলো, আমি ওর জন্য যেমন ফিল করি সেও হয়তো ঠিক তেমন!

আধ ঘন্টার মধ্যে বাকিরা হাজির হয়ে গেলো। সবাই একসাথে হওয়ার পর আমরা সামনে বড় পর্দাটা টানিয়ে নিয়ে সামনে দাঁড়ালাম, ভেতরে শুধু নুজহাত একা দাঁড়িয়ে সা’দের অপেক্ষা করছে। এর কয়েক মিনিট পরেই আরাফ বাইকে করে সা’দকে নিয়ে উপস্থিত হলো। ওকে দেখেই আমরা সবাই জোরে চিৎকার করে উঠলাম। সা’দ আমাদের দিকে তাকাচ্ছে আর নুজহাতকে খুঁজে চলেছে, সে বুঝতে পারছেনা সবাই লাল পর্দার টানিয়ে এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছি!

কাছে আসতেই আমরা সবাই একপাশে সরে গিয়ে পর্দা টেনে সরিয়ে দিলাম, সাথে সাথে আগে থেকে গাছের উপরে রেখে দেওয়া গোলাপের পাপড়িগুলো সা’দ আর নুজহাতের উপরে পড়তে লাগলো। আরাফ হচ্ছে ফটোগ্রাফার। সে এই সুন্দর দৃশ্যগুলো ক্যামেরা বন্দী করে ফেললো! সত্যিই আমাদের সাজানোটা চোখ ধাঁধানো হয়েছে, একদম সিনেমাটিক।

তিয়াসের মুখটা এখনো হুতুমপেঁচা হয়ে আছে।
সবাই এগিয়ে গেলো কেক কাটার জন্য। তিয়াসকে সা’দ তার একদম পাশে দাঁড় করালো। তিয়াস মন খারাপের সাথে ওখানে দাঁড়ালেও কেকের দিকে তাকিয়ে কেন জানি অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো। আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিল তিয়াসের উপরে। সা’দ তিয়াসের মুখে কেক তুলে দেওয়ার পরে একটু অংশ তিয়াস আমার দিকে বাড়িয়ে বললো,
___আচ্ছা “নুজসা’দ” এর মিনিং নুজহাত আর সা’দ হলে, প্রীয়াস মানে…এ্যঁ এ্যঁ…!

আমি কেকটা মুখে নিয়ে লজ্জায় ঘুরে গেলাম। তিয়াস আমার লজ্জা পাওয়াতে আরো হাসছে! তিয়াসের এরকম হাসির কবলে আমি যেন রোজ মরতে প্রস্তুত ছিলাম।
তবে বুঝতে পারিনি এর পেছনেও ছিলো ভিন্ন কোনো সত্য!

চলবে…..

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৩য় পর্ব) লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

0

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (৩য় পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

ভেজা চোখ লুকানোর চেষ্টা করে কাঁপা গলায় বললাম,
___ এখানে কেন এসেছো আবার?

তিয়াস এক হাতে দরজাটা খোলার চেষ্টা করে বললো,
___প্রীলি, প্লিজ আমাকে ভেতরে আসতে দাও। অনেক কথা আছে!

___দয়া করে আমাকে বিরক্ত করো না তিয়াস। যেখানে তোমার সব অস্তিত্বের বিলীন হয়ে গেছে, সেখানে নতুন করে কিছু শুরু করার প্রচেষ্টা আমার মধ্যে কখনোই আসবেনা।

___কিন্তু আমি তো সেদিনও বলিনি তুমি এভাবে হারিয়ে যাও! আমাকে শূন্যতায় ভাসিয়ে দূরে দূরে পালিয়ে বেড়াও।

আমি দরজার উপর থেকে হাতটা সরিয়ে বললাম,
___কিছুই বলোনি তুমি, তবে অনেককিছুই বলেছিলে তো! অযোগ্য ছিলাম না আমি? তবে আজকে যোগ্য হওয়ার আগেই তুমি কেন আমাকে পেতে চাইছো? সেদিন তুমি আমাকে দূরে যেতে বলোনি, তবে আকাশে ঘুড়ি উড়ানোর মতো করে সুতো ছেড়ে দিয়ে উড়তে দিয়েছিলে। কি করে ভাবতে পারো সেই সুতোসহ ঘুড়ি তোমার কাছে আবার ফিরে আসবে?
আসবেনা তিয়াস, আর যদিও খুঁজে পাও সেটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে! চলে যাও তুমি।

তিয়াস দরজার বাইরে থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবলো। পেছনে তাকিয়ে দেখলো বাবা এপাশে এসে আবার চলে গেছে। সে বিড়বিড় করে বললো,
___ নুজসা’দ কে মনে আছে তোমার?

___কি করে ভুলে যাবো, সা’দ আর নুজহাতকে? পুরো দুই বছর ছিলাম নুজহাতের সাথে।

তিয়াস একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
___ আর প্রীয়াস…

আমি তিয়াসকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

বন্ধ করার সময় দেখেছি মা-বাবা, তিয়াসের মা সহ আমার দাদু এদিকে আসছে। দরজা বন্ধ করতেই বাইরে থেকে শুনলাম মা বলছে,
___ লিয়া ভেতরে যেতে দেয়নি? তার মধ্যে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে? এই মেয়ে তার বাবার আশকারা পেয়ে পেয়ে মাথায় চড়ে বসেছে। কতো বড় বেয়াদব চিন্তা করছো, মেহমানের সাথে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটাও আজ পর্যন্ত শিখাতে পারলাম না। লিয়ার বাবা, সব তোমার দোষ। তুমিই মেয়ের সাথে মিলে তার কলিজাটা এতো বড় করেছো।

তিয়াস ভীষণ বিনয়ী গলায় বললো,
___ আমি কিছু মনে করিনি আন্টি। এটা আমার জন্য প্রাপ্য ছিলো।

তিয়াসের কথার জবাবটা বিনয়ী শুনলেও তিয়াসের মা রূঢ় স্বরে বললো,
___প্লিজ তিয়াস। এখান থেকে চল, তুই বুঝতে পারছিস না লিয়া তোকে গ্রহণ করবেনা। আমাকেও অপমানিত করিস না বাবা৷ চল তুই!

তিয়াস প্রতিত্তোরে বললো,
___ আম্মু আমি তোমাকে আর এসবে জড়াবো না । এখন চলো, তবে প্রীলি শুনো…আমি আবার আসবো। (কথাটা জোরে আমাকে শুনিয়ে বললো)

চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন না আকাশ দেখতে পারবো আর না চিৎকার করে কাঁদতে পারবো! বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। চার বছর আগের সেই কান্নাটা তিয়াসের সাথেই আবার ফিরে এসেছে। কেন এসেছে সে? কি চায় আমার কাছে!



আমার একজন বাবা একজন ক্ষুদে ব্যবসায়ি। যা রোজগার করেন তা দিয়ে কোনো রকম আমরা মাসের পরে মাস ভালোই চলে যাই। আমার বাবা-মার বিয়ের ৮ বছরের মাথায় আমার জন্ম হয়েছে। কয়েক বছর পরেই নিঃসন্তান আমার মা’কে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করার জন্য আমার দাদাভাই তাড়া করেছিল । কিন্তু দাদু মা’কে খুব ভালোবাসতো, বিভিন্ন তাবিজ,কবিরাজ,ডক্টর, চিকিৎসার জন্য কিছু বাদ রাখেননি। অবশেষে আমার জন্ম হলো, সবাই খুব খুশি ছিলো। কয়েক বছরেই দাদাভাই মারা গেলো।
আমার জন্মের পরে প্রায় ৫ বছরের মাথায় আমার ছোট ভাইটা হলো।
আমার তখন স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময়। আমাদের মতো পরিবারের সন্তানদেরকে মা-বাবারা কোনো রকম কাছাকাছি একটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে। কিন্তু আমার বাবা আমাকে উপজেলার সেরা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করিয়েছিলো। সেই পিচ্চি বেলা থেকে আমাকে পড়ালেখা করানোর তীব্র আকুলতা ছিল বাবার। নিজের কাজের মধ্যে আমাকে স্কুল থেকে আনা-নেওয়ায় কখনো দেরি করতেন না।

সেখান থেকে সবকিছুতে ভালো রেজাল্ট নিয়ে বের হয়ে জেলার সবচেয়ে নামি-দামি হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। সেখান থেকেই আমার হোস্টেল জীবন শুরু। প্রথম প্রথম এসব খাবার খেতে পারতাম না বলে, প্রতিদিন বাবা একবার গিয়ে আমাকে খাবার দিয়ে আসতেন। আমার স্কুল জীবন পুরোটাই কেটেছে চোখবুঁজে শুধুই পড়ালেখায়। সেখান থেকে প্রশংসনীয় রেজাল্ট নিয়ে বের হলাম। বাবা খুশিতে আমাকে বললেন দেশের সেরা কলেজগুলোতে চয়েজ দিতে। দেশের যে কোনো প্রান্তে যেমন খরচই হোক তিনি আমাকে জায়গা বিক্রি করে হলেও পড়াবেন৷
ভালো কলেজে ভর্তির জন্য নিজের বিভাগ পেরিয়ে অন্য বিভাগে পাড়ি জমাতে হয়েছিল, তবুও বাবা খুব খুশি ছিলেন। তাছাড়া আমাদের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে রেলস্টেশন, ট্রেনে যাতায়াত ছিলো আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি সুবিধার। এখান থেকে দেশের প্রায় অধিকাংশ জায়গাতেই ট্রেনে চলাচল করা যায়।
আমার দ্বারা আকাশসম স্বপ্ন নিয়ে বাবা সেদিন আমাকে কলেজ হোস্টেলে রেখে এসেছিল। তখনও আমি বুঝতে পারিনি, আমার এবং বাবার এই স্বপ্ন অন্য মোড় নিতে যাচ্ছে।

আমার রুমমেট ছিল দিয়া, শুভা, রুহি, আর নুজহাত৷ স্কুলের হোস্টেলে আমি পড়ালেখা নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত থাকতাম, কারো সাথে মিশতামই না। আমার সাথেও কেউ মিশতে চাইতোনা। দূর থেকে অনেকে অহংকারীও বলতো৷ তাই আজ পর্যন্ত কোনো বেস্ট ফ্রেন্ড হয়নি। কিন্তু এখানে আসার পরে ওরা নিজ থেকে মিশতে শুরু করে, একসাথে খাওয়ার জন্য বসে থাকে। নানান গল্প করে। ওদের সবকিছু ভালো লাগলেও একটা বিষয় কেমন যেন লাগতো! ওরা ভালো করে পড়ালেখা করতোনা, শুধু বিভিন্ন ছেলেদের সাথে চ্যাটিং, ফোনে হাসি ঠাট্টা, এসব করে রাত পুরোটাই কাটিয়ে দিতো। আর সকালে ঘুম থেকে উঠতে না পেরে কলেজ ফাঁকি দিতো।

আমি ওদের বাজে স্বভাবগুলোকে এড়িয়ে নিজের পড়ালেখার মাত্রা ঠিক রাখছিলাম। কলেজে ভর্তির ২৭ তম দিনে আমাদের নবীন বরণ অনুষ্ঠান ঘোষণা করে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
আমি ছাড়া সবাই-ই এটা নিয়ে বিভিন্ন প্লানিং করতে থাকে। কিন্তু আমি চিন্তা করছিলাম মাসের শুরুতে বাবা এতোগুলো টাকা দিয়েছে, এমনকি চাচার থেকে ধারও নিয়েছে। এখন আবার উৎসবের জন্য কি করে টাকা চাইবো? তাছাড়া আমার মধ্যে বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের ইচ্ছে আগেও ছিল না।
তার উপর আমি না গেলে কি নবীন বরণ হবে না?
সেদিন সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিবো ভেবে বসে থাকলাম।


অনুষ্ঠানের দিন সকাল সকাল রুমে ধুম ধুম শব্দ শুনে আমি লাফিয়ে উঠে বসলাম। উঠে দেখি রুমের সবাই আজ তারাতাড়ি ঘুম থেকে উঠে গেছে। তিনজন গোসল সেরে ফেলেছে আর নুজহাত বালতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে, এখন গোসলে যাবে। আমাকে উঠতে দেখেই বললো,
___ এ লিয়া এখনো ঘুমাচ্ছো কেন? উঠে পড়ো, সাজবা না? আজ না কলেজে আমাদের জন্য এতো বড় আয়োজন!

আমি চোখ কচলে উঠলাম,কিন্তু কোনো কিছু বললাম না। ফ্রেশ হয়ে আজকে একা একা হলের ডাইনিংয়ে খেতে গেলাম। ওদের খাবারের কথা জিজ্ঞাসা করেছি কিন্তু ওরা নাকি আজকে বাইরে খাবে ৷ আমাকেও জয়েন হতে বলেছিল কিন্তু আমি বাইরের খাবার খেতে পারিনা অজুহাত দেখিয়ে ডাইনিং থেকে খেয়ে রুমে গেলাম।
রুমে এসে দেখি একেকজন সেজে পরীর মতো হয়ে গেছে। বিশেষ করে নুজহাতের দিকে তাকিয়ে আমিই বারবার মুগ্ধ হচ্ছিলাম। মেয়েটা সত্যি অনেক সুন্দরী!

তারপর আবার আমাকে এলোমেলো অবস্থায় পড়ার টেবিলে বসে যেতে দেখে নুজহাত দুই হাত কোমরে ভর করে রাগী গলায় বললো,
___ আজকেও পড়তে আসছে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। সবসময়ই তো পড়ো, আজকে এসব রেখে শাড়ী পরো।

আমি ফিরে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
___আমি শাড়ী পরতে পছন্দ করিনা, সাজতেও পছন্দ করিনা৷ আর আমি অনুষ্ঠানেও যোগ দিবোনা। তোমরা যাও প্লিজ৷ আমার অনেক পড়া বাকি।

নুজহাত একটানে বইটা ছিনিয়ে নিয়ে ধমক দিয়ে বললো,
___এই মেয়ে এক্ষন উঠে রেডি হও। শাড়ী না পরো এমনিতেই স্বাভাবিক ড্রেস পরে আসো।

___ আমি গিয়ে কি করবো বলো তো? তোমরা ঘুরবে, ছবি তুলবে। আমি অযথা মন খারাপ করে বসেই তো থাকবো। এর চেয়ে রুমে বসে পড়ালেখা করি।

কিন্তু নুজহাত আমার কথা শুনলোনা। আমার ধরে টেনে উঠালো। আর বললো,
___ তুমি যদি ভাবো তোমার কোনো কাজ নেই, তাহলে আমরা তোমাকে একটা কাজ দিবো। আমাদের ছবি তুলবে। হেহে!

বলেই হাহাহা করে হেসে উঠলো সবাই। আমাকে নেওয়ার জন্য এই কথাটা মজার ছলে বলেছিল।
কেন জানি না মানা কর‍তে পারিনি। উঠে আমার ব্যাগ থেকে একটা বাদামী রঙের থ্রিপিস বের করলাম। মা বলে এটা পরলে আমাকে নাকি অনেক মায়াবতী দেখায়। মা নিজেই এটা কিনে দিয়েছিলো।
ড্রেস পরে আমি হিজাব পরার জন্য হিজাবটা খুলতেই নুজহাত একটানে খোঁপা করে রাখা চুলগুলো ছেড়ে দিলো, ভারী চুলগুলো কোমর পেরিয়ে হাঁটুর কাছ পর্যন্ত গিয়ে ছড়িয়ে গেলো।
শুভা এগিয়ে বললো,
___আমাদের এতো সুন্দর চুল থাকলে প্রতিদিন চুল দেখানোর জন্য এগুলো ছেড়ে এদিক ওদিক চক্কর দিয়ে আসতাম। মানুষ এক পলকেই চুলের প্রেমে পড়ে যেতো।

আমি না না বলতে বলতে চুলগুলো আবার বেঁধে ফেলতে যাবো তখন ওরা চারজন একসাথে আমাকে ধমকে উঠলো।
আমি কিছু না পেরে কান্নার ভান করে বললাম,
___ আম্মু আমাকে চুল খোলা অবস্থায় কোথাও যেতে বারণ করে। আমি এখন পর্যন্ত কোথাও যায়নি। দেখোই তো আমি সবসময় হিজাব পরে বের হই। প্লিজ মানা করো না।

কিন্তু সবগুলোই ছিল পুরাই নাছোড়বান্দা। বাধ্য হয়ে এভাবেই ওদের সাথে গেলাম। ওড়না মাথায় দিয়ে পেছনে বারবার ঢেকে ফেলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ওড়নার চওড়ার সাথে চুল কোনোভাবেই ঢাকতে পারলাম না।

ক্যাম্পাসে যাওয়ার পরে আমার লজ্জার পরিমাণ আরো বাড়তে শুরু করলো। সবাই সেজেগুজে হাজির হয়েছে। শুধু আমি একা এভাবে এসেছি। সব মেয়ে আজ শাড়ী পরেছে, আর সব ছেলেরা পাঞ্জাবী!
এর মধ্যে কয়েকটা ছেলেকে পাঞ্জাবী ছাড়া দেখা গেলেও খুব দামী পোশাকে দেখা যাচ্ছে।
আমি সবার দিকে তাকিয়ে নিজের দিকে চোখ রাখার সাহস করতে পারছিলাম না।
ভয়ে ভয়ে পা বাড়াচ্ছিলাম।
নুজহাত তার দামী ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
___ আমাদের তিনজনের একটা ছবি তুলো তো।

আমি মাথা নেড়ে ছবি তুলতে গেলাম। কয়েকটা ছবি তোলার পর হঠাৎই পেছন থেকে আমার চুলের হাত দিলো। আমি চমকে ফিরে তাকালাম। তাকানোর সাথে সাথে শুনলাম কেউ বলছে,
___এগুলো সত্যিই আসল চুল? নাকি আলগা লাগিয়েছে। কিরে বন্ধু মানুষের চুল এতো সুন্দর হয় কি করে?

প্রথম তাকিয়েই এক ছেলের একজোড়া চোখে আমার চোখ আঁটকে গেলো। ঘন কালো জোড়া ভ্রুর নিচে দুটো চোখ! ঠোঁটে দূর্লভ এক হাসি, ফর্সা গাল রোদে লালচে হয়ে গেছে, আমার দিকে তার দৃষ্টি ঠিক আমার মতোই অনড়! পেছন থেকে নুজহাত এসে এই ছেলেটার পাশের ছেলেটাকে হালকা জড়িয়ে ধরে বললো,
___ সা’দ তুমি এতক্ষণে এসেছো?

আমি চোখ নামিয়ে নুজহাতের দিকে তাকালাম। এই প্রথম বাস্তবে কোনো ছেলেমেয়েকে এতো কাছাকাছি ঘেঁষতে দেখেছি। তবে অনুমতি ছাড়া আমার চুলে হাত দেওয়াটাকেও প্রচুর মাইন্ড করেছি,কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না।
নুজহাত আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___ সা’দ আমার জীবন। আমরা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসি। আর এই হলো সা’দের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, আমাদের ক্লাসের বহুল মেয়ের ক্রাশ বয় তিয়াস!

আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। এতো মেয়ের ক্রাশ হওয়ার কারণটা আমারও বুঝা হয়ে গেছে। এই ছেলের দিকে আর তাকাবোনা। তখনই তিয়াস বললো,
___, হাই আমার নাম তো জেনেছো। এবার বলো তোমার নাম কি?

আমি লজ্জামাখা একটা হাসি দিয়ে বললাম,
___ আমি প্রীলিয়া হাসান!

তিয়াস নুজহাতের দিকে তাকিয়ে বাঁকা একটা হাসি দিলো। তারপর খেয়াল করলাম নুজহাত এখান থেকে চলে যাচ্ছে। পেছনে ঘুরে দেখলাম রুমের বাকিরাও উধাও। চারপাশে অসংখ্য মানুষ থাকা সত্ত্বেও আমার তিয়াসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে বুক দুরুদুরু করছিল। চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই তিয়াস বললো,
___ তোমার বাবা মেবি তোমার নামটা প্রীতিলতা ডাকতে চেয়েছিল। ভুলে প্রীলিয়া ডেকে ফেলেছে। আচ্ছা তোমাকে ওরা এই নামে ডাকতে পারে তো?

আমি থতমত করতে করতে জবাব দিলাম,
___ না মানে সবাই আমাকে লিয়া বলে ডাকে৷

তিয়াস এবার মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বললো,
___ হুম হুম বুঝলাম। তবে আমি সবার মতো নই। একটু আলাদা, সবাই যা করে আমি তা করিনা। আমি তোমাকে প্রীলি বলে ডাকবো। আচ্ছা তোমাদের ঘরে ডালিয়া নামে কেউ আছে?

আমি অবাক হয়ে বললাম,
___ হ্যাঁ আপনি কি করে জানেন? আমার মা’র নাম ডালিয়া।

তিয়াস হেসে বললো,
___তিয়াসের আন্দাজের তীর মিস হয়না বুঝলে? এই নামের সাথে আর নাম কানেক্টেড থাকবে এটা শুনেই বুঝে গেছিলাম। নয়তো এতো কঠিন নাম রাখতো না। তো উনাকেও কি লিয়া বলে ডাকে?

আমি এবার জোরে হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতে বললাম,
___আরে নাহ, আমার মা’কে সবাই ডালি বলে ডাকে।

তিয়াসও আমার সাথে হাসতে শুরু করে দিলো।
হাসির মধ্যে হঠাৎই বললো,
___প্রীলি আসো আমরা দুজন একটা ছবি তুলি।

আমি নড়েচড়ে বললাম,
___ না না আমি ভালো করে নিজের ফোনেই ছবি তুলিনা। অন্য কারো সাথে তো কখনোই না।

___ আমাকে বিশ্বাস করতে পারো প্রীলিয়া মেডাম।
তাকাও তাকাও, আরাফ ছবি তুলতেছে।

আমি তাকিয়ে দেখলাম একটা ছেলে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওর সাথে কয়েকটা ছবি তুললাম।
তখন বুঝতে পারিনি এই ছবিগুলোই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে!

চলবে….

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (দ্বিতীয় পর্ব) লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

0

গল্পঃ #শূন্যতায়_অস্তিত্ব (দ্বিতীয় পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

যার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম ,তার কাছেই সপে দেওয়ার সিদ্ধান্ত? কিন্তু সে কেন এটা করতে চাচ্ছে?
আমার মাথা কোনো কাজ করছেনা।
তারপর এতকিছু আর না ভেবে আমি এক দৌঁড়ে দাদুর রুমে গেলাম, আমি যাওয়ার সাথে সাথে দেখি আমার বাবা দাদুর পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে আর নিজের মুখ অন্যপাশে ঘুরিয়ে নিয়েছে। বাবার প্রতি যে রাগ নিয়ে এই মূহুর্তে এখানে এসেছি সেটা নিমিষেই নিঃশেষ হয়ে গেলো। দাদু সত্যি খুব অসুস্থ, হাতে এখনো একটা স্যালাইন চলছে।
বাবা চুপিচুপি রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
আমি দাদুর পাশে বসতেই উনি চোখ খোলে আমাকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আমাকে প্রতিবার দেখলেই দাদু খুশিতে কেঁদে ফেলে,কিন্তু আজকে দাদুর শরীরের অবস্থা দেখে আমারও ভীষণ খারাপ লাগলো।
মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে বললাম,
___দাদু বাইরের লোকজন আমার বিয়ে নিয়ে কি বলছে?

দাদু আবার কেঁদে উঠলো। আমি বুঝলাম না, আজকে উনি এতো বেশি কাঁদতেছে কেন! আমি উনাকে চুপচাপ থাকতে বলে মা’কে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
__ বাবা কোথায় বলো?

মা কিছুটা শঙ্কিত হয়ে বাম দিকে দেখিয়ে দিলো।
দেখলাম বাবা বসে সিগারেট খাচ্ছে। আমাকে দেখেই বাবা সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে ঢেকে নিলেন।
কাছে গিয়েই রাগী স্বরে বললাম,
___তুমি না সিগারেট ছেড়ে দিয়েছো? এখন এসব কি?

বাবা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলেন। আমি কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবার পাশে গিয়ে বসলাম।
আস্তে আস্তে বললাম,
___ বাবা আমি আমার বান্ধবীদের সঙ্গে শেয়ার করিনা এমন কথাও কিন্তু তোমাকে বলি। আমার মা জানেনা অথচ তুমি জানো আমার জীবনের হাজারো ঘটনা। আমার কাছে আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বন্ধু।
তুমি তিয়াসকে খুব ভালো করেই চিনতে, বলো চিনতে না? আমি তোমাকে বলিনি? তাহলে কি করে আমাকে না জানিয়ে তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললে? বাবা আমরা ওদের মতো উচ্চবিত্ত না হতে পারি কিন্তু আত্মসম্মানবোধ তো আছে নাকি?

বাবা এবার মুখ তুলে বললেন,
___ বিয়ে ঠিক করেছি এই কথা কে বললো তোকে?

আমি মাথা নেড়ে বললাম,
___ওই যে ওই বাসার ভাবী।

বাবা আমার মতো করে ওইদিকে তাকিয়ে বললো,
___মাসুদের বউ নীরার কথা বলছিস? আরে ওর মাধ্যমেই তো প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ওর জেঠাতো ভাইয়ের, শ্বশুরবাড়ির আর কি কি ভাবে যেন তারা আত্মীয়। ওরা বলছে যে তুই রাজী থাকলে কালই গায়ে হলুদ এবং পরশু বিয়ের আয়োজন করে ফেলবে৷ কিন্তু আমি বলছি আমার মেয়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া আমি কিছু বলতে পারছিনা। কিন্তু তারা বলে আপাতত ছোটখাট আয়োজনে, পরে নাকি..

এইটুকু বলার পরে বাবার কথার উপরে আমি জোর গলায় বললাম,
___ তোমার কি মনে হয় আমি রাজী হবো? তুমি ডিরেক্ট না বলে দিলে না কেন? এইবাড়ি সেইবাড়ি এটা রটানোর কি দরকার ছিল? এখন লোকজন ভীড় করে আমাকে দেখতে আসছে!

___ আমি সেদিনই তো জানাতাম। কিন্তু তোর ফোন বন্ধ। আজকে তোকে না পেলে আমি নিয়ে আসার জন্য যেতাম ওখানে। তোর কথা ছাড়া আমি “না” সম্মতিটাই কি করে দিবো বল তো?

___ বাবা আমি ওদের জন্য বাসা বদলে ফেলেছি। গেলেও আমাকে খুঁজে পেতেনা। যাই হোক দাদু হঠাৎ অসুস্থ হলো কীভাবে?

___তোর দাদু কিছুদিন ধরেই অসুস্থ। এই সমন্ধ আসার পরে উনি বারবার বলছেন, উনার আয়ু কম অন্তত নাতনির বিয়ে দেখা থেকে যেন বঞ্চিত না করি। আর তিয়াস আর ওদের পরিবার আসছিলো যে, তখন তোর দাদুর সাথে তিয়াস অনেক্ষণ বসে কথা বলছে, কেন জানি ওই ছেলেকে এতো পছন্দ হয়েছে, আমাকে সেদিন থেকে পাগল পাগল করে দিচ্ছে এখানেই বিয়ে ফিক্সড করতে। আমি বারবার বুঝাতে চেয়েছি তোর সামনে পরিক্ষা, তোর অনেক স্বপ্ন, কিন্তু কিছু বললেই কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলতেছে।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দুই চোখ বন্ধ করে বললাম,
___ ঘরে চলো বাবা। দাদুকে আমি দেখছি!

ঘরে প্রবেশ করে দেখি নীরা ভাবী দাদুর পাশে বসে গুনগুন করে কি জানি বলছে। আমাকে দেখেই ভাবী কিছু না বুঝার ভান করে সরে বসলো। আমার বুঝতে বাকি রইলোনা দাদুকে ওরাও রাতদুপুরে কানপড়া দেয়। তাকিয়ে দেখলাম স্যালাইন প্রায় শেষ দিকে, আমি সেটাকে খুলতে খুলতে বললাম,
___ দাদু পাত্র পছন্দ হয়েছে?

দাদু আস্তে আস্তে উঠার চেষ্টা করে দাঁত ছাড়া গালে ফিক করে হেসে বললো,
___মাশাল্লাহ ছেলে পুরো নায়েক!

আমি ধপাস করে বসে, দাদুর খুব কাছে গিয়ে বললাম,
___ তাহলে তুমি বিয়ে করে ফেলো। তোমাদের দুজনকে মানাবে বেশ!

দাদুর হাসিমুখটা তখন পেঁচার মতো করে হয়ে গেলো। পেছনে বাবা দাঁড়িয়ে ছিল উনি হাসতে হাসতে চলে গেলেন কিন্তু এখানে ভাবীটা বসে বসে হাসতেছে।

দাদু পরক্ষণে চেহেরাটায় একটা ভাব এনে বললো,
___জোয়ান বয়সে আমিও কম ছিলাম না বুঝলি? তোর দাদা তার চাচাতো ভাইয়ের জন্য আমাকে দেখতে গেছিলো , কিন্তু আমাকে দেখার পরে এমন পাগল হয়েছে যে, আমাকে বিয়ে করে তারপর তবে থেমেছে। আমাকে মজা করে রূপবান বলেও ডাকতো।

দাদুর কথা শুনে আমি হুহু করে হেসে উঠলাম। কয়েক মিনিটের জন্য আমার ভেতরের যন্ত্রণাগুলো থেমে গিয়েছিল কিন্তু সেটাকে জাগ্রত করে দিলো নীরা ভাবী। তিনি বললেন,
___লিয়া কাল সকালে রোজিনা খালা আর তিয়াস আসবে তোমার সাথে কথা বলতে।

আমি ভেতরে প্রচন্ডরকম রাগ নিয়ে মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে উনাকে বললাম,
___খুব ভালো ঘটকালি করেন তো ভাবী। এতো কম বয়সে মানে বলতে চাচ্ছি এখনো তো বাচ্চাকাচ্চা বড় হলোনা, এখন থেকেই কি নিখুঁত ঘটকী করেন। আপনি আমাদের এলাকার রত্ন হবেন!

উনার চেহেরার দিকে তাকিয়ে বুঝিনি মনে মনে আমাকে বকছে কিনা। তবে মুখে হাসি একটা ছিল, যেটা এই মূহুর্তে আমার মুখে আছে। রাগ থেকেই বোধহয় উনি এইরকম চাপা হাসিতে বুঝাতে চাচ্ছেন আমার কথায় কিছু মনে করেননি।

রাতে নানা রকম চিন্তা, অল্প পড়ালেখা আর পরিবারের সঙ্গে এই বিয়ে কীভাবে ভাঙবে সেসব নিয়ে আলোচনা করে অনেক দেরিতে ঘুমালাম। পরিবারের সবাই জানে আমি আগে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাই তাই বিয়ে করতে চাচ্ছিনা, শুধু বাবা জানে আসল রহস্যটা কি। বাবাকে পূর্বেই মানা করেছি যাতে মা’কেও এসব না জানায়। কারণ আমার মা আমার বাবার থেকে বেশি শাসন করে, এমনকি বাবাও মাকে কিছুটা ভয় পায়৷



পরেরদিন সকাল সকাল মা আমাকে ডেকে তুললো আর বললো,
___আমরা মানা করা সত্ত্বেও ওরা আসছে। আমরা কতভাবে বলেছি তুই রাজী না, তুই লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে নিয়ে ভাব্বি কিন্তু ওরা বলে এসব দায়িত্ব নাকি ওরা নিবে৷ এখন আর কোন উপায় নেই, সরাসরি তুই তিয়াসকে বুঝিয়ে বলবি। আর কথা বলে দেখতে পারিস,ছেলেটা অনেক ভালো।

আমি ঘুম ঘুম চোখে উঠে বললাম,
___ছেলেটা ঘোড়ার ডিম। যাও আসলে আমি কথা বলবো। কিছু বললে তো তুমি আবার রেগে যাবা। আর শুনো কোনো খাবারের আয়োজন করবা না। ওরা দাওয়াতি মেহমান না। তবে আমার জন্য ভালোমন্দ রান্না করতে পারো,কতদিন পরে আসছি বাড়িতে!

বলেই আম্মুর দিকে তাকিয়ে হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমে গেলাম। আম্মু রুম ঝাড়ু দিচ্ছিলো, হাতে ঝাড়ু নিয়ে আমার দিকে তাকানোর ধরন এতোটাই ভয়ানক ছিলো যে আমি ভাবছিলাম এই বুঝি দিবে একটা!



পাত্রপক্ষের সামনে যাওয়ার জন্য বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাড়া দিচ্ছে। আমার মধ্যে অনন্য মেয়েদের মতো সাজসজ্জার কোনো কিঞ্চিৎ রেশ নেই। কিন্তু আমাকে সামনে যেতে হবে, যেভাবেই হোক! কোনো রকম ঘোমটা না টেনেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গিয়ে আন্টিকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিলাম।
তিয়াসের দিকে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___লিয়া তুমি এভাবে হারিয়ে গেলে কেন? তুমি জানো তোমাকে কতো খুঁজেছি? নাম্বার অফ পাওয়ার পরে তিয়াস তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে তোমার পুরনো বাসায় পৌঁছেছে,সেখান থেকে প্রভা তোমাদের গ্রামের বাড়ির সব ঠিকানা দিলো। এখানে এসে নীরার মাধ্যমে প্রস্তাব দিলাম। কথা হলো, নীরা মিথ্যা বলেছে, আসলে আমাদেরকে নীরা চিনেনা, কিংবা কোনো আত্নীয়তা নেই। শুধু মাধ্যমের জন্য তার সাথে আমরা নতুন যোগাযোগ তৈরি করেছি।

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে আন্টিকে কিছু বলতে যাবো তখন আবার আন্টি বললো,
___ এতোকিছু কেন করছি এটাই জানতে চাও তো? তুমি আমার বাসার একজন টিউটর ছিলে,সেখান থেকে পুত্রবধূ করার জন্য হঠাৎ পাগল হলাম কেন!?
এর পুরো ব্যাপারটাই আমার ছেলের জানা। আমি এইটুকুই জানি তোমাদের মধ্যে একটা সময় খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো, আমার বোকা ছেলে সেদিন না বুঝে তোমাকে ছিন্ন করেছে, করেনি অবশ্য, তোমাকে দূরে যেতে বাধ্য করেছে। এখন তোমরা কথা বলতে পারো একান্তে,এতো বছর পর অন্তত ওর কথাগুলোও তোমার শোনার দরকার।

আমি আন্টির দিক থেকে চোখ সরিয়ে পাশে বসে থাকা দাদুর দিকে তাকালাম। দাদু আমাকে ফিসফিস করে বলছে,
___রাজী হয়ে যা না। তুই আমার বড় ছেলের বড় মেয়ে। বিয়েটা খেয়ে মরতে দিস!

আমি দাদুর কথাটার সম্মতি দেখতে বাবার দিকে তাকালাম। কিন্তু বাবার চোখেমুখ বলছে আমার সিদ্ধান্তই যেন উনার সিদ্ধান্ত।
আমি তিয়াসের দিকে তাকালাম। বহু বছর পর এই মানুষটার দিকে ভালো করে আজ তাকিয়েছি। আমি ক্ষানিক বিমূঢ় হয়ে চোখ ফিরিয়ে দাদুকে দেখিয়ে সবাই উদ্দেশ্য করে বললাম,
___ প্রথমত আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা, আগে নিজেকে এতটা বড় করে তুলি, যতটা হলে কখনো কোথাও রিজেক্ট হতে হবে না। কারণ আমি চার বছর আগের কথা এখনো ভুলিনি। আশা করি এটা বিপরীত পক্ষেরও ভুলে যাওয়ার কথা না।
এরপর দাদু তুমি যদি এটাই চাও আমি শীগ্রই বিয়ে করি, আমার সারাজীবনের স্বপ্নের কাছে তোমার কাছে বিয়েটাই বড়, তাহলে আমি যে কাউকে বিয়ে করবো। শুধু তিয়াসকে নয়। কাউকে অপমান করার সাহস কিংবা যোগ্যতা আমার নেই,শুধু আত্মসম্মান থেকে আমার এই কথাগুলো!

বলেই আমি তিয়াসের দিকে একবার তাকিয়ে সেখান থেকে উঠে গেলাম। ওর চোখ দুটো লাল হয়ে ছলছল করছে। আমার এতটাও জেদ হয়তো সে কখনোই প্রত্যাশা করেনি।
আমার মাও আমার দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শুধু বাবার দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারলাম না।

রুমের ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করার জন্য ফিরলাম,সাথে সাথে দরজার একপাশে হাত দিয়ে ধাক্কা লাগলো। আমি সরে গিয়ে চমকে উঠলাম, ভেজা চোখ লুকানোর চেষ্টা করে কাঁপা গলায় বললাম,
___ এখানে কেন এসেছো আবার?

চলবে….

গল্পঃ শূন্যতায়_অস্তিত্ব (প্রথম পর্ব) লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

0

_কেমন টিউটর রাখছো আম্মু? পড়াতে এসে দেখো মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত! যদি স্টুডেন্ট রেখে ফোনে মনোযোগ থাকে, তাহলে শিখাবে কি? শুধু শুধু এতোগুলো টাকা দাও।

পাশের রুমে এমন কথা শুনে আমি চমকালাম, হাতের ফোনটা টেবিলে রেখে শোনার চেষ্টা করলাম এরপর কি বলছে। কণ্ঠটা এই বাসায় অপরিচিত একদম, এই বাসায় দেড় মাস ধরে টিউশনি করছি কিন্তু এরকম আওয়াজের কোনো মানুষ দেখিনি৷ কথার মধ্যে প্রচন্ড রাগ বুঝা যাচ্ছে। আন্টি কিছুটা নরম স্বরে বলতে লাগলো,
___ এতদিন পরে বাসায় আসছিস, ওইদিকে কেন তাকাচ্ছিস বলতো?

সাথে সাথে একটু মেজাজের সাথে ছেলেটা উত্তর দিলো,
___মাইনে দিয়ে টিউটর রাখছো না? তাহলে ঠিকঠাক পড়াচ্ছে কিনা এগুলো খেয়াল করবেনা?

তারপর কোনো আওয়াজ শুনলাম না৷ হয়তো ভেতরের রুমে চলে গেছে। আমি ভেবেছিলাম আন্টি কিছু বলবে কিন্তু তিনি আমার সম্পর্কে পজিটিভ কিচ্ছু বললো না। এই রুমের জানালার পাশ দিয়ে অন্য রুমে যেতে হয়, উনি হয়তো পেছন থেকে আমাকে ফোন চালাতে দেখে গেছে। আমার অজান্তেই খারাপ লাগতে লাগলো। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল বারবার।
আমার স্টুডেন্ট ইয়াসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ক্লাস নাইনে পড়ে সে, কোনো কিছুই তার বুঝার বাইরে না। আমি বুঝতে পারছিলাম না এখন আমার কি বলা উচিত। ইয়াসকে আমি এই কয়দিন টাকার চুক্তিতে পড়াইনি। আমার সামনে ফাইনাল ইয়ার পরিক্ষা তারপরও ওকে আমি এতো সময় দিচ্ছি। এখন টাকার প্রসঙ্গ আসছে যেহেতু তাহলে এই টিউশনিটাই ছেড়ে দিবো।
হাত মুঠো করে আস্তে আস্তে আমি উঠে দাঁড়ালাম।

বাম দিকে আন্টির রুমে যেতে যেতে আচমকা ঝাপসা চোখে কাউকে সামনে দেখে সরে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার সাথে সাথে ছেলেটাও থেমে গেলো, শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে রুম থেকে বের হয়েছিল, আমাকে দেখে থামলো কেন বুঝতে পারলাম না। চোখ নিচু করেই অপেক্ষা করছিলাম সে চলে যায় কিনা। কিন্তু গেলোনা, উল্টো আমার এপাশ ওপাশ কিছুক্ষণ ঘুরে বলে উঠলো,
___প্রীলি তুমি এখানে?

আমি এবার খুব পরিচিত একটা স্বরের সন্ধান পেলাম। চমকে উঠে তার চেহেরার দিকে তাকিয়েই আমি শিউরে ওঠলাম, অস্পষ্টতায় ভেতরেই শব্দটা উচ্চারণ হলো, তিয়াস! একটু একটু করে সরে গিয়ে পেছনে একবার তাকিয়ে কিছু না বলেই আন্টির রুমে চলে গেলাম। গিয়ে বলে আসলাম এই টিউশনিটা করা সম্ভব নয়।
আন্টির প্রশ্নবদ্ধতায় এটাও বলেছিলো তার বড় ছেলের কথা শুনে ছেড়ে দিচ্ছি কিনা। আমি এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে নিজের পরিক্ষার বাহানায় কোনো রকম চলে আসলাম। আন্টির কোনো কথাকেও পাত্তা দিলাম না, আবার তিয়াস পেছন থেকে কিছু বলতে চাচ্ছিলো,সেটাও শুনলাম না।

রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম আর বারবার কপালের মিহি ঘামগুলো ওড়না দিয়ে মুছে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছিলাম,ঠিক তিয়াসের মতো!

রুমে এসে ব্যাগটা রেখে বিছানার উপর সোজা হয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলাম। উপরের ফ্যানের সাথে মাথাটাও যেন চক্রাকারে ঘুরছে। এতোদিন ওই বাড়িতে আছি অথচ আমি কোনোভাবেই বুঝতে পারিনি ওটা তিয়াসদের পরিবার। জানলে কখনোই আমি ওই বাড়িতে পা রাখতাম না। আমি ওই পরিবারকে দেড় মাসে চিনেছি এবং জেনেছি, কিন্তু শুধুমাত্র তিয়াসকে চিনতাম বহু বছর আগ থেকেই, তখন তার বাবা-মা পরিবার সম্পর্কে কিছু জানতাম না, জানতে চাইও নি।
সে একটুও শুধরায় নি, নাহলে টিউটরকে পাশের রুমে রেখে এরকম ব্যবহার কি করে সম্ভব?
.

ওইদিকে তিয়াস অনেক্ষণ যাবৎ রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ তার মনে হলো, সে এসে প্রীলিকে শুনিয়ে ফোন চালানো নিয়ে বাজেভাবে কথা বলছিল। এইজন্য প্রীলি টিউশন ছেড়ে দেওয়ার জন্য তখন তার মায়ের রুমে যায়নি তো? তিয়াস তারাহুরো করে বের হতেই দেখলো তার মা তার সামনে। তাকে দেখেই উনি বললেন,
___চল খেতে আয়। আর শুন তুই আসছিস যেহেতু আজ থেকে ইয়াসকে তুই-ই পড়াবি।

তিয়াস বিরবির করে বললো,
___তার মানে প্রীলি টিউশন ছেড়ে দিয়েছে?

তিয়াসের মা কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
___ কিরে প্রীলি কে? লিয়ার কথা বলছিস?

তিয়াস অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
___প্রীলিয়া থেকে আমি প্রীলি বলছি আর তুমি লিয়া বলছো। একই তো।

এবার তিয়াসের মা রোজিনা বললো,

___ছাড়বেনা তো কি করবে? এভাবে বলে কেউ? সে টাইম ধরে এক ঘন্টা, আধ ঘন্টা পড়ায় না বুঝলি? তোর ভাই যে গাধা ওরে বসে সব পড়া শিখাইয়া তারপর যায়। এতো সময় মেয়েটা কি করবে বলতো? তাই ফাঁকে ফাঁকে একটু ফোন চালাতো। একমাসের পড়ানোতেই ইয়াসের দ্বিতীয় সাময়িকের রেজাল্ট কতো ভালো হয়েছে জানিস? কালকেই রেজাল্টশিট আনলাম।

তিয়াস চোখ দুটো বন্ধ করে মাথায় একটা হাত রেখে বললো,
___ আমাকে আগে জানানো উচিত ছিল না? আমি কি জানি যে নতুন টিউটর নিছো? তাছাড়া এই মেয়ে আসছে জানলে বিশ্বাস করো, না পড়াইয়া শুধু মোবাইল চালালেও আমি চলে যাওয়ার কথা বলতাম না। উল্টো আমার পক্ষ থেকে বেশি বেতন দিয়া বলতাম বছর বছর ওকেই রাখো।

তিয়াসের মা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
___লিয়াকে আগে থেকেই চিনতিস? নাকি দেখে ভালো লেগেছে?

তিয়াস আড়চোখে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু মিটমিটিয়ে হেসে সেখান থেকে চলে গেলো। তিনি ছেলের এমন হাসিতে ধরে নিলেন লিয়াকে দেখার পরে ভালো লেগেছে হয়তো। তিয়াসের মা রোজিনাও এইকয়দিনে লিয়াকে খুব পছন্দ করেন৷ শ্যামলার মধ্যে উজ্জ্বল গায়ের রঙ লিয়ার, চোখ দুটো যেন শুধু মায়া দিয়েই সৃষ্ট হয়েছে। সে আহামরি সুন্দরী নয়। কিন্তু চিমচাম গড়ন আর মিষ্টভাষী আচরণে না চাইলেও যে কেউ মায়ায় পড়ে যাবে। প্রীলিয়া নামটা উনার কাছে কঠিন মনে হয় বলেই তিনি শেষের দিকের সহজ শব্দটা উচ্চারণ করে শুধু লিয়া ডাকেন। লিয়া ডাকতে ডাকতে এখন প্রীলিয়ার পুরো নামটাও ভুলে গেছেন। এমনিতেও তিয়াস ছাড়া সবাই-ই লিয়া বলে ডাকে।



সন্ধ্যা নেমে আসলো, আমি এখনো বিছানা থেকে উঠিনি। দুপুরে তাড়াহুড়োতে খেয়েও যাইনি। মাগরিবের আজানের সাথে সাথে আমার রুমমেট প্রভা রুমে এসে লাইটের সুইচ দিয়েই হিজাব খুলতে খুলতে পরিশ্রান্ত স্বরে বললো,
___,কিরে লিয়া অসময় ঘুমাচ্ছিস! রুমও অন্ধকার, কোনো সমস্যা হয়েছে? অসুস্থ বোধ করছিস নাকি?

আমি এক হাত ভর করে আস্তে করে উঠে এলোপাতাড়ি হয়ে থাকা চুলগুলোকে খোঁপা করে গিয়ে ভাতের পাতিল তুলে দেখলাম সকালের রান্না ভাত একদম ভিজে উঠেছে। এগুলো ফেলে দিয়ে ভাত বসালাম।
হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখলাম প্রভা তার খুব কাছের একজন ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে। প্রভা যখন তার এই ছেলে বন্ধুটার খুব প্রশংসা করে আমি কেন জানি অসহ্য একটা অনূভুতি আঁচ করি। তারপরও কোনো রকম এই বিষয়টা এড়িয়ে যাই। আমার কাছে ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব শব্দটা খুব বিষাক্ত লাগে। আজকে ওর কথার মাঝেই আমি বলে উঠলাম,
___ প্রভা এই শহরটা অনেক ছোট নারে?

প্রভা ফোনের স্ক্রিন সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___ ছোট মনে হয় তোর? আজ পর্যন্ত বাসা, ইউনিভার্সিটি, আর দুইটা টিউশন ছাড়া কোথাও গিয়েছিস? কীভাবে জানিস এই শহর ছোট?

আমি মুখ মুছতে মুছতে ওর দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম একটা হাসি দিয়ে বললাম,
___ কথা বল তোর ফ্রেন্ডের সাথে।

সন্ধ্যারাতেই খেয়েদেয়ে পড়তে বসলাম। প্রচুর পড়ালেখা করতে হবে। পারিবারিক কাঠামোর বাইরে নিজের একটা পরিচয় বানানো আমার জন্য আবশ্যক।
মন বসছিলো না, তাও জোর করে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই ফোনের রিং বেজে ওঠলো। আমি স্ক্রিনে তাকাতেই চমকে উঠলাম, স্টুডেন্টের মা, মানে তিয়াসের মায়ের নাম্বার থেকে ফোন। এর আগে উনার নাম্বার থেকে অসংখ্য ফোন এসেছে কিন্তু আজকের মতো এমনভাবে চমকাইনি। ফোন রিসিভ করতে আমার হাত কাঁপছিলো। ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে আন্টি বলতে লাগলো,
___লিয়া তুমি আমাকে এতো দিনেও চিনলেনা? আজ পর্যন্ত আমি কি কখনো তোমাকে মন্দ বলেছি? তোমার পরিক্ষা থাকলে তুমি সময় নিবে, তারপর পরবর্তীতে আবার পড়াবে৷ কিন্তু হুট করে টিউশন ছেড়ে দিবার সিদ্ধান্ত কেন নিলে? তিয়াসের কথার উপরে রাগ করে তো? তাহলে কাল আসো, ওকে দিয়ে সরি বলাবো।

আমি থতমত খেয়ে বললাম,
___ না না আন্টি সরি বলতে হবে না। তাছাড়া উনি তো খুব মেধাবী, কিছুদিন উনি পড়াক। তারপর চলে গেলে নাহয় আমি আসার চেষ্টা করবো।

ওপাশে কিছুক্ষণ বিরবির করে শব্দ হলো, তারপর আন্টি বললো,
___আচ্ছা তা বুঝলাম। কিন্তু তিয়াস তোমাকে সরি বলতে চায়। তুমি কি ওর সাথে দেখা করতে পারবে?

আন্টির কথা শুনে আমি আশ্চর্য থেকেও আশ্চর্য হলাম। তিনি কিনা মা হয়ে ছেলেকে দিয়ে একটা অচেনা মেয়েকে সরি বলানোর সুপারিশ করছেন। আমার কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমি ঠিকাছে বলে কেটে দিলেও আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার মানে কি তিয়াস আমার ব্যপারে ওর মা’কে সব বলে দিয়েছে?
যদি বলে দিয়ে থাকে তাহলে আমি এই মুখ নিয়ে কি করে আর আন্টির সামনে যাবো?
আন্টি আমাকে খুব ভালো জানেন, তিনি কি করে মানতে পারবেন আমার ভুলের জন্য হয়ে যাওয়া এতকিছু?
না না আমি কিছুতেই আবার অতীত ফিরিয়ে আনবোনা। সব ভুলে গেছি আমি, আমারই ভুল ছিলো, তাই সেসব ভুলগুলোকে ৪ বছরের ন্যায় এবারও আমাকেই শুধরাতে হবে। আমি আবার উধাও হয়ে যাবো৷

পেছনের দরজার সামনে গিয়ে বারান্দায় দেখলাম প্রভা এখনো কথা বলছে। একটা বিরক্তির নিঃশ্বাস নিয়ে শুয়ে পড়লাম। পরেরদিন সকাল সকাল প্রভাকে বললাম,
___ প্রভা এখান থেকে একটু দূরে কোথাও নতুন বাসা খুঁজবো, আর আমি সেখানে তোকে নিয়ে থাকবোনা। পরিক্ষার কয়েকটা মাসই তো, তারপর সেবারের মতো এবারও শহর ছেড়ে পালাবো।

প্রভা কিছুই বুঝলো না। শুধু হা হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।

দুইদিনের মাথায় নতুন বাসায় উঠে গেলাম৷ এখন দুটো টিউশনিই ছেড়ে দিতে হলো। নতুন টিউশনির সন্ধান করবো কাল। এই বাসা থেকে কলেজ মাইলখানেক দূরে। হোক দূরে তবুও দূরেই থাকতে চাই।
আগের নাম্বার অফ করে দিয়েছি সেদিনই, এখন নতুন নাম্বার তুলে বাবাকে ফোন দিলাম।
ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই বাবার কণ্ঠে আজ ভীষণ উৎফুল্লতার রেশ পেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম,
___ বাবা তুমি ভালো আছো?

বাবা আমার এই প্রশ্নের জবাব না দিয়েই বললো,
___,নাম্বার কি করে রেখেছিস। শুন মা তুই আজকেই বাড়িতে আয় না।

কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,
___ তুমি জানোনা আমি কতটা ব্যস্ত? আমি পরিক্ষার পরে তবেই আসবো।

প্রতিত্তোরে বাবা বললো,
___তোর দাদুর শরীরটা খারাপ। তোকে দেখতে চাইছে। আয় না লিয়া!

আমি জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে বললাম,
___ আচ্ছা!

দুপুরের আগে আগেই রওয়ানা দিলাম। পৌঁছাতে বিকেল প্রায়। স্টেশনে নামতেই দেখি আমার ছোট ভাই, আমার চাচাতো ভাই,আর তাদের কয়েকটা বন্ধুবান্ধব আমাকে এগিয়ে নিতে দাঁড়িয়ে আছে।
আমাকে দেখেই ব্যাগ নিয়ে ওরা সামনে এগুতে লাগলো৷ আজ পর্যন্ত কোনোদিনও আমাকে কেউ স্টেশন থেকে এগিয়ে নিতে আসেনি৷ তখনও কিছু বুঝতে পারিনি,
কিন্তু বাড়ির দরজায় পা রাখতেই আমার টনক নড়লো, বাড়িঘরের এতো মানুষ আমাকে ভীড় করার কারণ কি? সবাই হাসিমুখে যেন কোনো নতুন বঁধুকে বরণ করতে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি মা’কে ডেকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করতেই পাশের বাসার ভাবী বলে উঠলো,
___ লিয়া কাল তোমার গায়ে হলুদ। বিরাট পরিবার থেকে সমন্ধ বুঝলে? তাইতো এতো মানুষ এসেছে তোমাকে দেখার জন্য। আমাদের লিয়া তো মেজর এহসান মাহবুবের পুত্রবধূ হচ্ছে!

এতক্ষণ আমি হা হয়ে শুনছিলাম, কিন্তু ভাবীর শেষ কথাটা শুনে আমার সারা শরীর শক্ত হয়ে গেলো। আমি শুধু রোবটের মতো তাকিয়েই ছিলাম সবার দিকে। এর মধ্যে আম্মু এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বললো,
___ দরজার মধ্যে মেয়েটাকে এসব বলার কি দরকার বলোতো। ভেতরে আসতে দাও না , তারপর যা বলার বলো।

আমি এতো চেনা ঘরটার মধ্যে আজকে প্রবেশ করেও কেন জানি অচেনা অচেনা অনূভুতি পাচ্ছিলাম। কেউ না জানিয়ে আমার জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো! তারপর এতোগুলো বছর যার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম ,তার কাছেই সপে দেওয়ার সিদ্ধান্ত? কিন্তু সে কেন এটা করতে চাচ্ছে?

গল্পঃ শূন্যতায়_অস্তিত্ব (প্রথম পর্ব)

লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার