আজলান আর কথা না বাড়িয়ে মেঝ ফুপুর ঘরে গিয়ে দেখলো তিথি ডোডোকে কোলে নিয়ে বড় ফুপুর পাশে বসে গল্প করছে। মেঝ ফুপুও উপস্থিত সেখানে। কারো চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না গতকাল এখানে যুদ্ধ চলছিলো। সে আফসোসের সহিত মাথা দুলিয়ে চলে এল ঘরে। তিথি কিছুক্ষণ পর ডোডোকে নিয়ে হাজির হলো। ডোডোকে বলল,
“কোমরটা ব্যাথা হয়ে এল আমার। তুই মা ছাড়া কিচ্ছু বুঝিস না ডোডো?”
আজলান ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। ডোডো তার মায়ের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তিথি বলল,
“আরেহ ব্যাটা হাঁ করে কি দেখছিস? তোর দাদা দেখে পছন্দ করে ছেলের বউ করে নিয়ে এল। তোর বাপ এক বাচ্চার মা বানিয়ে দিল। কিছুদিন পর তুই আমাকে শ্বাশুড়ি বানাবি। এখন আর মুখ দেখে কি করবি? তুই কি বড় হবি না? তোর আর ভাইবোন লাগবে না? আমি কি তোকে কোলে নিতে হাঁটতে হাঁটতে বুড়ি হয়ে যাব?”
আজলান ধমকে উঠে বলল,”ননসেন্স ও কিছু বোঝে এসবের?”
ডোডো এবার আজলানের দিকে তাকিয়ে হাত ঝাপটাতে লাগলো। আজলান তাকে কোলে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
আজলান এতে কিছুটা চমকালো। কিন্তু অত মাথা ঘামালো না। তিথি শাড়ি পড়া শেষ করে মাথায় সাদা মালা পড়তেই ডোডো কেঁদে উঠলো। তিথি ছুটে গিয়ে তাকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে বলল,
“ওই গুলুমিয়া তুই দেখি হেব্বি বজ্জাত। তোর মা বাপকে একটু ভালো সময় কাটাতেও দিস না। ঘুমা চুপচাপ।”
আজলান দাঁত চিবিয়ে বলল,”হোয়াট ইজ গুলুমিয়া?”
তিথি ফিক করে হেসে ডোডোর গালে চুমু খেতে খেতে বলল,”আমার বাপ। আমার কইলজ্যা। আমার জামাইয়ের একমাত্র আবিষ্কার।”
আজলান আরও রেগে গেল। তিথি হাসলো। তিথি লিপস্টিক দেখিয়ে দিল। আজলান তার কথামতো লিপস্টিক নিয়ে এসে ঠোঁটে পড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
“আহা নড়চড় করো না তো।”
তিথির ঠোঁট একে অপরের সাথে লাগিয়ে প্পাহ প্পাহ শব্দ করে ডোডোর গালে চুমু দিতেই লিপস্টিকের দাগ বসে গেল। আজলান চাপা স্বরে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
“এটা কি করলে?”
তিথি ফিক করে হেসে বলল,
“আদর দিলাম। সব তুমি নেবে নাকি?”
আজলান বলল,”আচ্ছা ওকে রেখে দাও। চলো।”
তিথি বলল,”না। ওকে রেখে যাব না। আমার বাচ্চা ভয় পেয়ে কেঁদে উঠবে।”
বাইরে বাতাস বইছে। আকাশের অবস্থা ভালো না। যেকোনো সময় ঝড়ো হাওয়া বইবে। আকাশ ভাঙবে, বৃষ্টি ঝড়বে।
আজলান তিথির হাত ধরে বাইরে নিয়ে এসেছে। আকাশের এমন অবস্থা দেখে সে তিথিকে নিয়ে ঘরে চলে এল। তিথি বলল,”কি হলো?”
আজলান দরজা বন্ধ করে দিল। তিথি তেড়ে এসে বলল,”খেলবো না। তুমি আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছিলে। বাইরে কি সুন্দর আবহাওয়া। না না খেলবো না। ভন্ড লোক কোথাকার। মিথ্যে বলেছ কেন?”
আজলান ঘরের জানালা খুলে দিয়ে বলল,”ওই দেখো আকাশের অবস্থা কেমন। মনে হচ্ছে এক্ষুণি কেঁদে দেবে।”
তিথি রাগে শাড়ির আঁচলে লিপস্টিক মুছে ফেলেছে। আজলান লিপস্টিক নিয়ে তাকে জানালার পাশে টেনে এনে বলল, “মেহবুব তুমি না খেললেও আমি খেলবো। লিপস্টিক পড়ো।”
তিথির মন খারাপ হয়ে এল আকাশের মতো। সে আজলানকে সরিয়ে দিয়ে বলল,”না না আমার মন খারাপ করে দিয়েছ তুমি। এভাবে লোভ দেখানো ঠিক হয়নি। তারমধ্যে বলছো আমি কালো। এসব ঠিক না।”
আজলান তাকে তার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলল,”ওই দেখো বৃষ্টি হচ্ছে।”
তিথি দেখলো। আজলানের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,”ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে গো। চলো না।”
আজলান তার কোমর পেঁচিয়ে ধরে গালে নাক ঠোঁট ঘষে চুমু খেয়ে বলল,
“এত বেশি কথা বললে এক্ষুণি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেব।”
তিথি চুপ করে রইলো। পুরুষালী ঠোঁটের চুম্বনে গোটা মুখটা ভিজে উঠতেই তিথি ফিক করে হেসে ফেলে বলল,”আমার চরিত্রহীন বেডামানুষ।”
আজলান ভীষণ খেপে গেল। এইসময় কেন এসব কথা বলতে হবে? এক বাচ্চার মা হয়ে এখনো জানেনা কোথায় কি বলতে হবে। সে তিথিকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে আদর করার চাইতে ঘুমানো ভালো।”
তিথি তার গলা জাপ্টে জড়িয়ে ধরে ফরসা গালে ছোট্ট ছোট্ট চুমু দিয়ে লিপস্টিকের ছাপ বসিয়ে দিতে দিতে বলল,
“মেহবুব! তোর জামাই একটা লাল কুমড়াপটাশ।”
আজলান বলল,”কি অবস্থা করেছ আমার?”
তিথি বলল,”ধুর ব্যাটা, তোমাকে আদর করার চাইতে ঘুমানো ভালো।”
বলেই সে চলে যাচ্ছিলো। আজলান পেছন পেট জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে চেপে ধরতেই তিথি খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলল,
আজলানকে নিয়ে বেরিয়ে এল সে। আজলান সদর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। তিথি একদৌড়ে বাইরে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে বলল
“আফিষাঁড় এত সুন্দর বৃষ্টি আমি আগে দেখিনি।”
আজলান বলল,”জ্বর হলে সর্দি মুছতে এসো আমার বুকে!”
তিথি দুহাত মেলে ঘুরতে ঘুরতে বলল,”
“আফিষাঁড় আমার এত খুশি লাগছে কেন?”
আজলান তার কাছে দৌড়ে এল। বলল,”তুমি পাগল? এভাবে চেঁচাচ্ছ কেন? আস্তে বলো।”
তিথি এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আজলান বলল “হয়েছে এবার চলো।”
তিথি বলল,”জ্বর হোক।”
আজলান বলল,”না না চলো।”
তিথি থামলো না। আজলান তাকে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে বলল,
“মাথা খারাপ করবে না মেহবুব। জ্বর হলে আমাকেই সামলাতে হবে।”
তিথি চুপ করে রইলো। তার হঠাৎ কান্না পাচ্ছে। সে তো এমন একটা স্বপ্ন দেখেছিলো। যাকে সে ভালোবাসবে তার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে। কিন্তু এই ব্যাটা তাকে ভিজতে দিল না কেন আরেকটু?
আজলান তাকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“একি তুমি কাঁদছো কেন?”
তিথি কাঁদতে কাঁদতে বললো,”আমি এমন বৃষ্টি আগে কখনো দেখিনি।”
আয়জা গায়ে হলুদের শাড়ি পড়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তিথি তার ঘরে এসে দেখলো সে ঘুম। শুধু চুলগুলো খুলেছে। মুখের সাজগোছ এখনো রয়ে গেছে। সে আয়জার গায়ে হাত দিয়ে ধীরেধীরে ডাকলো। ডোডোও মায়ের দেখাদেখি ফুপীর গায়ে হাত রেখে ঝাঁকালো। তিথি আয়জার গায়ের উপর তাকে শুইয়ে দিয়ে বলল,
ডোডো তার চুল শক্ত করে ধরলো। আয়জা বলল,”আমি চলে যাব আজ। তবুও মারে।”
ডোডো আবোলতাবোল কি যেন বকতে লাগলো। আম্বিয়া বেগম এসে দেখলো ফুপু ভাইপোর আদর মহব্বত দেয়া-নেয়া চলছে। তিনি বললেন,
“উঠে পড়। আর কতক্ষণ ঘুমাবি?আজ কি ঘুমানোর সময়? আশ্চর্য! আমার ভাই কি করছে?”
ডোডো আম্বিয়া বেগমকে দেখে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে এল। আম্বিয়া বেগম তাকে কোমরে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
তিথি রমলা চাচীর সাথে রান্নাঘর পরিষ্কারের কাজ শুরু করেছে। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে, এক হাতে স্কাবার ধরে, সিঙ্কের তলা পরিষ্কার করছে। রমলা চাচী রান্নাঘরের মেঝে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে বলল,
“তোমার মেঝ ফুপু শ্বাশুড়ি কাল অনেক রাত অব্দি রুমের মধ্যে প্যানপ্যান প্যানপ্যান করছিলো।”
তিথি রান্নাঘরের কাউন্টার টপ ও অন্যান্য প্রান্তগুলো মুছতে মুছতে বলল,”ধুর পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়। বাদ দাও।”
রমলা চাচী বলল,”তোমার জামাই কিছু বলেনাই কেন? ওইরকম বেডিগুলারে কিছু বলা লাগে। নইলে এরা শোধরায় না। নিজের মেয়ের ঘর বাঁচাইতে পারেনাই আসছে পরের মেয়ের দোষ ধরতে। নির্লজ্জ বেডি মানুষ।”
তিথি চুলা পরিষ্কার করছে সে-সময় আজলান রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। তার গায়ের খুশবু শুঁকে তিথি বুঝে ফেলেছে সে এসেছে। আজলানের কোলে ডোডো। সে আম্মা আম্মা ডাকছে মৃদুস্বরে। তিথি দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
আম্বিয়া বেগম বললেন,”ততক্ষণ বসে থাকতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করে আয়। নইলে আবার শুরু করবে।”
বিয়ে বাড়িতে যেমন মানুষের ভীড় তেমন খাওয়াদাওয়া। তিথি একটু ফাঁক পেয়ে আয়জার চুল ছাড়াতে চলে এল। তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিতে দিতে হাসাহাসি করছিলো তারা গতরাতের ভিডিওগুলো দেখে। তন্মধ্যে আজলান এসে বলল,
আম্বিয়া বেগম সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,”আচ্ছা রাগ করিসনা।”
আম্বিয়া বেগম ঘরে এসে আজলানকে বললেন,”তোকে বলছিনা তোর ফুপুর হয়ে কোনো কথা না বলতে বৌমাকে?”
আজলান অবাকস্বরে বলল,”আশ্চর্য! কি বলেছি আমি? ফুপু আমাকে দেখামাত্র বললো তোর বউ ভাত দিবে বলে কোথায় চলে গেছে। আমি বাড়িতে এতক্ষণ না খেয়ে থাকিনা। তাই মেহবুবকে জিজ্ঞেস করেছি।”
আম্বিয়া বেগম বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলল,”ওকে কাল যা তা বলছে। ও ভাত দিবে কেন? ওকে ভাত দেয়ার লোক আর নাই বাড়িতে?”
আজলান বলল,”উফফ অসহ্য। মনে হচ্ছে ছোট বাচ্চাদের ঝগড়া লেগেছে তাই কথা বলবেনা একে অপরের সাথে। তোমরা মেয়েরা কি চাও আমি বুঝিনা। মাথা খারাপ করে ফেলো।”
সে বেরিয়ে গেল গটগট পায়ে হেঁটে বিড়বিড় করতে করতে। প্রত্যেকটি পদক্ষেপে রাগ প্রকাশ পাচ্ছে।
আয়জাকে বউ সাজানো হয়েছে অত্যন্ত যত্ন করে। পরনে খয়েরী হাফসিল্ক জামদানী শাড়ি। শাড়িটা আজলানের পছন্দ হয়েছে শুনে আয়জা ভীষণ খুশি।
তার চুলে পড়ানো হয়েছে গোলাপ ফুলের মালা। গলায় ভারী সোনার হার, হাতে চুড়ি ও বালা,
সিঁথির মাঝখানে টিকলি। মুখে সূক্ষ্মভাবে দেওয়া হয়েছে লাল লিপস্টিক।
ডোডোকে কোলে নিয়ে বসে আছে সে। ডোডো মুখ তুলে খানিকটা হা করে তাকিয়ে আছে। আয়জা তার ঠোঁট আলতোভাবে ডোডোর গালে, নাকে, ঠোঁট ছুঁয়ে আদর করতে করতে বলল,”আব্বার মন পুড়বে ফুপীর জন্য?”
ডোডো একটা আঙুল তুলে আয়জার নাকের নথটা ধরতে চায়। আয়জা হাসতে হাসতে বলে,”পাগল ছেলে।”
তিথি এসে ডোডোকে কোলে নিয়ে বলে,”ডোডো চল চল আমরা মা ছেলে বসে আগে পেটপুরে খেয়ে নিই।”
সে ডোডোকে নিয়ে ঘরে চলে এল। আজলান তাদের জন্য গরম গরম বিয়ের ভাত নিয়ে এসেছে। সাবধান করে বলল,”এখানে বসে চুপচাপ খাও। ডোডোকেও খাইয়ে দাও। সবার সামনে ওকে খাওয়াবে না বেকুব।”
তিথি মুরগীর পিস তুলে ডোডোর সামনে দিল। ডোডো দু’হাতে তা ধরছিলো। আজলান তিথির হাত ধরে ফেললো। আজলান হাত ধুয়ে ছোট ছোট করে মাংস ছিঁড়ে ডোডোকে খাইয়ে দিতে লাগলো।বলল,
“ও হাতে নিয়ে খাওয়া শিখেছে এখনো? তাছাড়া এগুলো গরম। এইভাবে খাওয়াবে।”
তিথি বলল,”না,খাওয়াবো না এভাবে।”
আজলান কপাল ভাঁজ করে তাকালো। তিথি বলল,”সুন্দর করে বলো।”
আজলানের কপালে দ্বিগুণ ভাঁজ পড়লো। তিথি বলল,”বলো, মেহবুব এভাবে এভাবে খাইয়ে দিতে হয়। বলো।”
আজলান চোখ সরিয়ে নিল বেশ ভঙ্গিমা করে, যেন সে তিথির কথা গায়ে মাখেনি।
“বুঝেছি এবার। তুমি পাম্প দিয়ে দিয়ে খেতে বসে গেছ। নো বাছাধন। তোমাকে ভাগ দেয়া যাবে না। ডোডো বল, এই স্বাদের ভাগ হবে না। তুমি আমার যত পেয়ারি বাপ হও না কেন।”
আজলান চুপ করে মা ছেলের কান্ড চেয়ে রইলো। সে হাসবে নাকি কাঁদবে? এই মহিলা কি কোনোদিন শোধরাবে না? একে নিয়ে এভাবে জীবনটা পার হবে? তিথি তাকে ওভাবে তাকাতে দেখে হঠাৎ ভারী লজ্জা পেয়ে গেল। এই ব্যাটা হঠাৎ হঠাৎ এমনভাবে তাকায় যে অন্তরআত্মা কেঁপে উঠে।
আম্বিয়া বেগম ব্যস্ত পায়ে হেঁটে এসে বলল,
“আজলান ওরা চলে এসেছে আব্বা। চল। কি করছিস এখানে? ও–মা আমার ভাই ভাত খাচ্ছে? মাংস খাচ্ছে?”
ডোডো হাত বাড়িয়ে ডাকলো। আম্বিয়া বেগম বললেন,”আমার অনেক কাজ ভাই। পরে কোলে নেব। তুমি খাও।”
আজলান দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,”চলো ওরা খেয়ে নিক।”
“হ্যা, চল।”
আম্বিয়া বেগম হঠাৎ খেয়াল করলেন আজলানের গালে ভাতের দানা লেগে আছে। তিনি ফিক করে হেসে ফেললেন। আজলান, তিথির সাথে সাথে ডোডোও বড় বড় চোখ করে চেয়ে রইলো উনার দিকে। আজলান বিরস গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“হাসছো কেন?”
আম্বিয়া বেগম হাসি চাপা দিয়ে বললেন,
“তোর গালে ভাতের দানা লেগে আছে।”
তিথি গুরুতরভাবে বলল,”আমাদের মা ছেলের মাঝখানে এলে এই অবস্থায় হবে।”
আজলান গাল মুছে নিয়ে বলল,”হয়েছে। এবার চলো।”
আম্বিয়া বেগম বললেন, “বউ ওকে খাওয়ানো শেষ হলে তাড়াতাড়ি আয়। তোকে খুঁজবে ওরা।”
তিথি ডোডোকে খাইয়ে নিজেও বাকিগুলো খেয়ে নিল। তারপর পেটে হাত বুলিয়ে বলল,
“বিয়া খাইয়্যা লইছি।”
ডোডোও তার দেখাদেখি পেটে হাত দিল। তিথি হো হো করে হেসে উঠে তাকে কোলে তুলে ঘুরিয়ে সোহাগ করে বলল,
“বউ কি বললো?” আম্বিয়া বেগম একপ্রকার ছুটে এসে প্রশ্ন ছুঁড়লেন। আজলান সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল,” কি বলবে? বিয়ের ঝামেলা শেষ হলে চলে যাবে, এই বলছে।”
আম্বিয়া বেগম বললেন,”যাক বাবা একটু ঠান্ডা হলেই হলো। তোর ফুপু তো আবার ঢং শুরু করছে চলে যাওয়ার জন্য। তোর বাপ দরজা বন্ধ করে রাখছে।”
আয়জাকে নিয়ে যুবতীরা ছাদে চলে গেল। অনুষ্ঠান যথারীতি শুরু হয়েছে আবারও। তিথি ঘরে শাড়িটাড়ি খুলে ছুঁড়ে মেরেছে সেলোয়ার-কামিজ পড়ে বসে আছে। তাকে কি পেয়েছেটা কি? অমন শক্ত করে ধরে চুমু দিলেই সে সব ভুলে যাবে? বিয়েটা চুকে যাক এই আজলান শেখকে যদি সে কাঁদিয়ে না ছাড়ে তার নাম তিথি নয়।
“তোর বড় ফুপু, ছোট ফুপুশ্বাশুড়ি ভালো মানুষ। মাঝখান থেকে এটা বেশি কুচুটেগিরি করছে। কেন করছে সেটাও বুঝতে পারছি আমি।”
তিথি বলল,”করুক গে। ওসব কানে তুলিনা আমি। ওর মেয়ে সংসার করতে পারেনি এটা ওর কপালের দোষ। আমার নাকি। তোমার জামাইয়েরও না। ওর মেয়েই তার ভাইপোকে ছেড়ে চলে গেছে। কেউ ওকে তাড়ায়নি।”
মালেকা বেগম বলল,”তারপরও সাবধানে থাকিস।”
তিথি বলল,”সাবধানে না থাকলে ডোডোর আব্বাকে নিয়ে যাবে বলছো?”
মালেকা বেগম বলল,”ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারিস না? ছেলেদের মাথা ঘুরতে বেশি সময় লাগেনা। তোর জামাই যেমন ফুপুভক্ত। কিছু বললো না দেখলিই তো। ছাড় দিবিনা একদম।”
তিথি চুপ করে রইলো। মালেকা বেগমের পাশে শুয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,”তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই আম্মা।”
মালেকা বেগম বললেন,”এখানে যা অবস্থা দেখছি। জামাই তোর হয়ে কথা না বললে তো সমস্যা।”
মা মেয়ের কথার ফাঁকে হঠাৎ নিজস্ব গতিতে হেঁটে ঘরে ঢুকে পড়ে আজলান। মালেকা বেগমকে দেখে কপালের একপাশ চুলকে বলল,
“ওহ আপনি থাকুন। আমি ছাদে যাচ্ছি।”
মালেকা বেগম দ্রুত উঠে পড়লেন। বললেন,
“না না আমি চলে যাচ্ছি। যেওনা। তোমার শরীর খারাপ।”
আজলান তিথির দিকে একটুখানি তাকিয়ে বলল,”না আমি আছি। আপনি থাকুন।”
“ফাইজলামি করিস না তিথি। আমি যাচ্ছি। যা ডেকে নিয়ে আয়।”
তিথি বলল “মাথা খারাপ হয়নি আমার। ও ওর বোনের গায়ে হলুদে নেচে আসুক। আমি আর বাচ্চা ঘুমাই। এই ডোডো তুই ভুসভুস করে ঘুমাচ্ছিস কেন বেয়াদব। ওঠ।”
মালেকা বেগম বলল,”আহা ডাকিস না। ঘুমাক।”
তিথি ডোডোর গালে গাল চেপে ধরে বলল,”কত জোরে মারছি আম্মা। বড় হয়ে জানতে পারলে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে।”
মালেকা বেগম বললেন,”ফালতু কথা সবসময় তোর মুখে। সর, আমি যাই।”
মালেকা বেগম চলে গেলেন। তিথি উনার পিছু পিছু ছাদে চলে এল। আয়জার বান্ধবী আর কাজিনরা মিলে নাচানাচি করছে। তিথিকে দেখামাত্র সবাই হৈচৈ করে উঠে বলল,
“তিথি ভাবি চলে এসেছে। ভাবি চলে এসো। আমাদের একটাই ভাবি।”
তিথি বলল,”আমার বাচ্চা ঘুমোচ্ছে।”
ওর কথা না শুনে সবাই তাকে টেনে নিয়ে গেল। লুঙ্গি ডান্স গানে নাচানাচি চলছে। তিথি তাদের মাঝখানে পড়ে ফেঁসে গেল। সবার ফাঁকে সেও নেচে নিয়েছে। এত নাচানাচির ভীড়ে না নেচে থাকা যায় নাকি? ঘাম ছুটে গেল নাচানাচি করতে গিয়ে। টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছে আম্বিয়া বেগমের পাশে বসতে যাবে তখুনি দেখলো বুকে হাত ভাঁজ করে আজলান শেখ দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ নাচানাচি দেখছিলো। তিথির দিকে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তিথির হঠাৎ করে লজ্জা লাগলো। হুহ, তাকানো দেখে মনে হচ্ছে এই প্রথম বউকে দেখছে। যত্তসব ঢং। আয়জা আর তার বান্ধবীরা কালা চশমা গানে নাচছে। আয়জা তিথিকে কালো চশমা পড়িয়ে দিয়ে টেনে নিয়ে গেল।
তা দেখে আম্বিয়া বেগম আজলানের দিকে কোণাচোখে একপলক তাকালো। এত শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে দেখে উনি অবাক হয়েছেন। বউ এমন তিড়িংবিড়িং নেচে চলেছে আর সে কিছু বলছেনা।
আফতাব শেখ হাততালি দিয়ে বললেন,”বৌমা তোমার বরকেও নিয়ে যাও। জীবনে মিষ্টি জিনিসটার সাথে একটু সাক্ষাৎ হওয়া দরকার।”
তিথি বলল,” আরে গরে গরে মুখেরেতে কালা কালা চশমা..
আম্বিয়া বেগম ফিক করে হেসে উঠলেন। পাশ থেকে বড়ফুপু বললেন,”আজলানের চেহারাটা দেখেছ?”
আম্বিয়া বেগম বললেন,”বউকে এখন তেল মারছে। চলে যাবে বলায় ভয় পাইছে ”
“ভয়ও পায় আজকাল।”
“ও যেমন বউ। ভয় পাবে না? কে বলবে এই মেয়ে কিছুক্ষণ কেঁদেকেটে একসা করেছে।”
তিথি নাচানাচিতে এতটা ব্যস্ত হয়ে গেল আজলান কে সেটাই ভুলে গেল। তিথির গলা শুকিয়ে এসেছে। সে পানি খেয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে দেখলো আজলানের কোলে ডোডো! গোলগোল করে তাকিয়ে নাচ দেখছে। মাকে দেখে হাত দুটো মাথার উপর তুলে দিয়ে সে উপরে লাফ দিয়ে উঠলো। তিথি এসে বলল,
“ঘুম শেষ?”
ডোডো তার মাথায় তুলে দেয়া সানগ্লাস কেড়ে নিতে হাত বাড়ালো। তিথি তাকে কোলে টেনে নিয়ে দুগালে টাপুসটুপুস চুমু খেয়ে নিয়ে চলে গেল। ডোডো লাফাচ্ছে তার কোলে। আয়জা তাকে দেখে হাসতে লাগলো। গান বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে ডোডো চমকে উঠে চারপাশে তাকালো। তিথি বলল,
তিথি দেখলো ঘুম পাওয়ায় আজলানের চোখদুটো লালচে হয়ে গেছে। বোনের বিয়ে বলেই হয়ত এই প্রথম হাসি তামাশার মাঝে সে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কোনোকালেই তার এসব পছন্দ না। তারউপর বউটাও এরকম। এখন নিজের পছন্দের বাইরেও গিয়েও কাজ করতে হয়। দেখা যাচ্ছে তাতেই সব শান্তি।
আজলান তিথিকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ডোডো উল্টাপাল্টা শব্দ করে ছাদ থেকে কেন তাদের মা ছেলেকে নিয়ে এসেছে তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আজলান তাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে তিথিকে টেনে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে নতুন খয়েরী রঙের নাইট ড্রেস ছুঁড়ে মেরে চলে গেল। তিথি সেলোয়ার-কামিজ পাল্টে গা মুছে ধুয়ে ঢিলেঢালা নাইটিটা পড়ে বেরিয়ে এসে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“এসব বেয়াদ্দব পোশাক পড়তে বলে আবার নিজেকে ভদ্রলোক দাবি করে? নূন্যতম হায়া শরম।নেই। মানুষ বৌয়ের জন্য এসব পোশাক কিনে?”
তিথি হাতমুখ মুছে মুখে নাইটক্রিম মাখতে যাচ্ছিলো। আজলান চোখের উপর হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। তারপর দৃঢ়বদ্ধ ঠোঁটদুটো দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেজাজ সপ্তম আসমানে। তিথি মুখ মোচড়ে লাইট নিভিয়ে এল। ডোডো আজলানের ওপাশে শুয়েছে। মাঝখানে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। তিথি শুয়ে পড়লো বেশ সাবধানে। ডোডো আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে। ডোডোর বাপও। তিথি বিড়বিড় করে বলল “আমার বাচ্চাটাকে সরিয়ে ফেলেছে।”
সে আজলানের উপর দিয়ে ডোডোর নিজের কাছে নিয়ে আসার জন হাত বাড়ানোমাত্রই আজলান তাকে এমনভাবে ছুঁড়ে মারলো সে পড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠামাত্রই আজলান ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। তিথি বলল,”মরে গেলাম, মরে গেলাম।”
আজলান ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে বলল,”কোথায় লেগেছে? উফ মুসিবত। কোথায় লেগেছে বলো।” শেষে ধমকে উঠলো সে। তিথি তার হাত ধরে পিঠের নীচে দিয়ে বলল,
“পিঠে।”
আজলান বলল,”বেশি লেগেছে?”
“খুব।”
আজলান বলল,” দেখাও।”
তিথি লজ্জা পেয়ে গিয়ে বলল,”ধুর দেখাবো কিভাবে? কি এক মরার কাপড় পড়ছি। শুধু উপরে উঠে যাচ্ছে।”
আজলান ক্যালেন্ডারের রোলটা নিয়ে এগিয়ে এল। তিথির দৌড়ে অন্য জায়গায় সরে দাঁড়ালো। বউ বর দৌড় ছুট খেলতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। আজলান শেষে বিছানায় বসে দু’হাত পেছনে ঠেলে ভার নিয়ন্ত্রণ করে তিথির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার চোখে ঘুম নেই মেহবুব?”
তিথি ধীরপায়ে এগিয়ে এসে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওটা ফেলে দাও। ঘুমিয়ে পড়বো এখন।”
আজলান রোলটা ফেলে দিল, আর ঠিক তখনই তিথি তার কোলে এসে চেপে বসে পড়ল। তার কণ্ঠে মিষ্টি অনুরোধ, “চলো ঘুমিয়ে পড়ি।”
আজলানকে ধাক্কা দিতে গিয়ে, নিজেই হঠাৎ শক্ত দু’হাতের মধ্যে বন্দী হয়ে গেল তিথি। মুহূর্তের মধ্যে আজলান তাকে কাছে টেনে নিল, এবং তার ক্রুদ্ধ দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকা জ্বালাময় আবেগ প্রকাশ পেল গলার ভাঁজে পড়া কঠিন, আগ্রাসী চুম্বনগুলোতে। এই চুম্বনগুলো যেন আজলানের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ আর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। আজলানের আগ্রাসী চুম্বন থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়ে তিথি শ্বাস নিতে নিতে বলে উঠল, “ওহ আল্লাহ রে! ডোডো দেখলে দুজনকেই ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেবে। কি নির্লজ্জ মা বাপ তার। ছিহ!
মালেকা বেগমের সাথে মেঝ ফুপুর তর্ক তীব্র হয়ে উঠেছে। মালেকা বেগম আজলানের বড় ফুপুদের সাথে বসে গল্পগুজবে মগ্ন ছিলেন। মফিজ সাহেবও আফতাব সাহেবের সাথে ছিলেন। ঘটনাস্থলে না থাকলেও মেঝ ফুপুর চেঁচামেচি শুনে সব কিছু স্পষ্ট হয়ে গেল তাদের। মালেকা বেগম নীরবতা ভেঙে ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠলেন,
“আপনি আমার মেয়েকে বস্তি ডাকলেন কোন সাহসে? আমার মেয়ে বস্তিতে বড় হলেও অনেক ভালো শিক্ষা পেয়েছে। আপনি তো ভদ্রবাড়িতে বড় হয়ে সেটুকুও পাননি। আসার পর থেকে দেখছি মেয়েটা কাজের জন্য বাচ্চাটাকে পর্যন্ত কোলে নিতে পারছে না, সেখানে আপনার বড় বড় কথা। অনেকক্ষণ ধরে আপনার কথা শুনছি।”
মেঝ ফুপু বললেন, “মেয়েকে বেয়াদব বানিয়েছেন, সেটা স্বীকার করুন। মুরব্বিদের সাথে কি করে কথা বলতে হয় সেটা জানে না।”
মালেকা বেগম তীব্র কণ্ঠে বললেন,
“এখানে মুরব্বি তো আরও আছে। কারো সাথে তো বেয়াদবি করেনি। আপনার সাথে কেন করলো?”
মফিজ সাহেব রাগে কাঁপছেন, তবুও কিছু বললেন না। তিনি মালেকা বেগমকে বললেন, “আহা, থামো। বাদ দাও।”
মেঝ ফুপু বললেন, “আমার তো এখন আপনার জন্য মায়া হচ্ছে ভাইসাব। এই মা-মেয়ের জ্বালায় আপনি অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছেন না? এখন বুঝতে পারছি বীজ কিসের।”
তুষার বাবা আর মাকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। আফতাব শেখ এসে তীব্রভাবে ধমক দিয়ে বললেন, “আছিয়া, তুই চুপ করবি? অশান্তি লাগিয়ে দিয়েছিস গোটা বাড়িতে। কি শুরু করেছিস তোরা?”
বড় ফুপুও প্রতিবাদ করে বললেন, “আছিয়া, তুইও কি বাচ্চা মেয়ে হয়ে গেছিস? নতুন মা হয়েছে, বাচ্চার নামে বাজে কথা সইতে পারেনি। চুপ কর না।”
ছোট ফুপুও বড় ফুপুর মতো শান্তিপ্রিয় মানুষ। তিনি বললেন, “আজলান ঘরের দিকে গেছে। কি হবে, কে জানে। তুমি একটু চুপ করবে মেঝোবু?”
আফতাব সাহেব মালেকা বেগমের উদ্দেশ্যে বলেন, “বেয়াইন, মাথা ঠান্ডা করুন। সবাই রেগে গেলে তো হবে না। হেনা, তোর মাকে নিয়ে যা। আছিয়া, ঘরে যা। আর কোনো কথা নয়।”
মেঝ ফুপু বিড়বিড় করে বললেন, “কোথাথেকে আত্মীয় করেছে আল্লাহ জানে। পুরো ন্যাংটার গোষ্ঠী।”
তুষার ঘাড় ঘুরিয়ে আছিয়া বেগমের দিকে তাকাল। মালেকা বেগম তাকে টেনে নিয়ে গেলেন। তুষার বলল, “আম্মা, আপাকে বাড়ি নিয়ে চলো। এখানে একমুহূর্তও থাকবো না আমি। আপাকেও রাখবো না। এখানে সবকটা আপার সাথে খারাপ ব্যবহার করে।”
তুষার উত্তেজিতভাবে বলল।
“আপাকে যা ইচ্ছা তাই বললো ওই মহিলা। দুলাভাইও কিছু বললো না? আপাকে সবাই এভাবে কথা শোনায় নাকি?”
আয়জা শান্তভাবে বলল, “তুমি শান্ত হয়ে বসো ভাইয়া। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মফিজ সাহেব অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বললেন, “গোলামের ফুতটা কিছু বললো না আমার মেয়ের হয়ে। ওকে আমি ছাড়বো না।”
—
আজলান ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল তিথি ডোডোকে বিছানায় বসিয়ে কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিচ্ছে। সে হতবাক হয়ে গেল, মাথায় একাধিক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। কি করতে চাইছে মেহবুব? বিস্ময়ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করল।
— “কি করছো তুমি?”
তিথি ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তার দিকে। তার চোখে যেন রাগের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে। এমন দৃশ্য দেখে আজলানের মনে ভীতির শিহরণ জাগিয়ে তুলেছে। আবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে নাকি? আশ্চর্য!
ঠিক তখনই আয়জা আর আম্বিয়া বেগম ঘরে এসে দাঁড়াল। তাদের চোখে উদ্বেগের ছায়া।
ডোডো বিছানায় বসে নিজের ছোট্ট চোখ দিয়ে মা আর বাবার দিকে তাকাচ্ছে। তার সরল দৃষ্টিতেও অস্থিরতা স্পষ্ট। মায়ের চেঁচামেচি শুনে সে ভড়কে গেছে। সে ছোট্ট করে আম্মা ডাকলো। তিথি শুনলো না।
আজলান এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে বলল,”আমার সাথে কথা বলো তুমি।”
তিথি তার চোখের দিকে তাকালো। বলল,
–“তুমি আমার সাথে একটা কথাও বলবে না। সবসময় আমাকে শাসন করতে চলে আসো। অথচ তোমার বাপের বোনকে কিচ্ছু বলতে পারোনি মুখের উপর?”
আজলান তাকে শান্ত হতে বলে বলল,”বাড়িভর্তি মানুষ। এখন কি করব আমি?”
তিথির চোখে ক্রোধমিশ্রিত জল। সে ব্যাগটা টেনে নিয়ে বলল,”এই বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে তোমার ফুপু আমাকে অপমান করে যা ইচ্ছা তাই।বলেছে। আমাকে সারাদিন বলে গেল আমি কিচ্ছু বলিনি, এখন সাহস পেয়ে আমার ছেলেকে বলছে। আমি একমুহূর্তও এই বাড়িতে থাকব না। দরকার পড়লে ভিক্ষে করে খাব, নইলে চায়ের দোকানে কাজ করে খাব। কিন্তু তোমার সাথে আমি থাকবো না।”
আয়জা এসে বলল,”ভাবি একটু শান্ত হও।”
ঘরটা থমথমে হয়ে উঠেছে। ডোডোর কান্নার করছে। ছোট্ট হাত দুটি বাড়িয়ে আয়জার কোলে উঠতে চাইলো সে।
তাকে সপাটে চড় বসিয়ে তিথি বলল, “চুপ করে বস। দরদ দেখাবি না। এখানে কেউ তোর আপন নয়। তুই খাচ্ছিস এটাতেও অনেকের সমস্যা। তোর মা তো কখনো খাবার দেখেনি। বস্তি থেকে উঠে এসেছে তুই সেই বস্তির ছেলে হয়ে এত ভালোমন্দ খাবি কেন?”
ডোডো তার মায়ের চড় খেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। তাকে কাঁদতে দেখে আম্বিয়া বেগমের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তিনি চড়া গলায় বললেন,
“তুই তোর জামাইর উপর রাগছিস ভালো কথা। আমার নাতির গায়ে কেন হাত দিচ্ছিস? এটা কি তোর বাপের বাড়ি থেকে এনেছিস?”
ডোডোকে কোলে তুলে নিয়ে শান্ত করতে লাগলেন তিনি। আজলান মায়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, “মা, তোমরা এখন যাও। ঘর খালি করো।”
আজলানের কথা শুনে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তিথির রাগ তখনও মাথার ভেতর আগুনের মতো জ্বলছিল। সে সোজা আজলানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এসব নাটক বন্ধ করো। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তো শুধু আমাকেই বের করতে পারো তুমি। তোমার শক্তি শুধু আমার উপর দেখাও। কারো মুখের উপর দুটো কথা বলার সাহস আছে তোমার? শুধু আমাকে জব্দ করতে শিখেছ। এই ছোটলোক বস্তি তোমার সাথে থাকবে না আর। দুটো ডাল ভাত আমার জুটে যাবে।”
আজলান শান্ত থাকার চেষ্টা করল। সে তিথির হাত ধরে রাখতে রাখলো, তিথি ঝাঁকিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল। আজলান ধীরে বলল, “রাগের মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত নিওনা মেহবুব।”
তিথির ক্ষোভ কমলো না। সে আরও জোরে হাত ঝাঁকিয়ে বলল, “এতগুলো মানুষের সামনে আমাকে এতকথা শোনালো, তুমি একটা কথাও বললে না। আমি এই বাড়িতে শুধু ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য পড়ে আছি?”
আজলান কণ্ঠ উঁচু করে বলল, “কি বলব আমি? ফুপুকে বের করে দেব তাও এতগুলো মানুষের সামনে? বিয়েটা চুকে যাক। আমি বলব ফুপুকে।”
তিথি ক্ষিপ্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ বলল, “কি বলবে? আমার বউকে আর বস্তি ডেকো না এটা বলবে? নাকি আমার বাচ্চার খাবারে নজর দিওনা বলবে? কোনটা?”
তিথি চোখ মুছে বলল, “আমি চলে যাব আমার ছেলেকে নিয়ে। যাবই।”
আজলান তার হাত ছেড়ে দিল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তিথি তাড়াতাড়ি কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিচ্ছে। আয়জা ঘরের বাইরে উঁকি দিয়ে তা দেখে আম্বিয়া বেগমকে বলল, “আম্মা, ভাবি সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে।”
তার কণ্ঠে কান্না স্পষ্ট। ফুপুর ওপর তার রাগ হচ্ছে। আফতাব সাহেব এসে তিথির পাশে দাঁড়ালেন। তিথি আফতাব সাহেবকে দেখে চুপচাপ কাপড় ভরতে লাগলো। আফতাব সাহেব বললেন, “বৌমা, সবকিছু কানে নিতে নেই।”
তিথি তার দিকে ফিরিয়ে বলল, “কানে নিয়েছি? সকাল থেকে অনেককিছু বলে গেল আপনার বোন। কিচ্ছু কানে তুলিনি। তাই বলে একটা বাচ্চার খাবারে নজর দেবে? মানুষ আর কতক্ষণ সহ্য করবে? যাই বলো বাবা, তোমার এই ছেলের সাথে আমি আর থাকবো না। ও মনে করেছে দুটো ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য, ভালো থাকার জন্য আমাকে এখানে পড়ে থাকতে হচ্ছে, ও যা মনে করে, ওর আত্মীয়রাও মনে করে।”
আফতাব সাহেব বললেন, “আমি এক অকালকুষ্মাণ্ড জন্ম দিয়েছি সেটা তুমি আজ নতুন করে জানছো না।”
আজলান বাঁকা চোখে উনার দিকে তাকালো।
তিথি দৃঢ়ভাবে বলল, “না না, আমি থাকবো না।”
আম্বিয়া বেগম হতাশভাবে বললেন, “আজলান, তুই কিছু বলবি না? ও সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে।”
আজলান ফুঁসে উঠে বলল, “ও চলে যেতে চাইলে আমি করব? আমি তো আর ওর মতো হুটহাট সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। নিতে পারলে সব মিটে যেত। ও যা চাইছে তা যখন পারছি না, তখন ওর সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াটাই ভালো।”
তিথির এই অবস্থা দেখে আয়জা তাড়াতাড়ি তার ব্যাগটা কেড়ে নিল। ব্যাগটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভাবি, তুমি এভাবে যেও না, প্লিজ। তুমি চলে গেলে এতসব কে সামলাবে?”
তিথি অশ্রু সংবরণ করে বলল, “হ্যাঁ, তোমারও তো একই চিন্তা। ভাবি চলে গেলে এতকাজ কে করবে? এত ঝামেলা কে সামলাবে? ভাবির অপমানে তোমার কিছু যায় আসেনা। ছোটলোককে ছোটলোকই তো বলেছে।”
তিথির চোখ থেকে রাগ মিশ্রিত জলের ধারা গড়িয়ে পড়লো। আফতাব শেখ তিথির এই অবস্থা দেখে মাথায় হাত রেখে বললেন, “আমি ওকে বকে এসেছি। ও আমার মা-বাবার বেয়াদব সন্তান, আমারও একটা আছে এমন একটা। কি করব এদের নিয়ে বলো।”
আজলান কিছু বলতে চাইলো কিন্তু বলল না।
আফতাব শেখ তিথিকে বুঝিয়ে বললেন, “তুমি যদি এখন চলে যাও, তাহলে তোমার জায়গাটা নড়বড়ে দেখাবে সবার সামনে। এটা তোমারই বাড়ি। তুমি যদি শক্ত হাতে এই সংসারের হাল ধরো, এরপর থেকে কেউ তোমাকে ছোটলোক বলার সাহস পাবে না। আমরা মরে গেলে তোমার ফুপু শ্বাশুড়িদের তোমার কাছেই আসতে হবে। ওদের আর ভাই নেই। ভাইপোর বৌও নেই।”
তিথি দৃঢ়ভাবে বলল, “আমাকে আটকে রাখার জন্য এখন এসব বলবেনই। তোমার বোনকে এমনটা বললে সে বলবে এটা তার বাপের বাড়ি। আমাকে বুঝ দিও না।”
আম্বিয়া বেগম এবার ধমকের স্বরে বললেন, “তুই এখনো কিছু বলবি না, আজলান?”
আজলান এবার ক্ষোভের চাপে রেগে গিয়ে বলল, “আশ্চর্য, এখন কি ওর পায়ে ধরতে হবে আমাকে? হাত ধরে অনুরোধ পর্যন্ত করলাম, ও শুনছে আমার কথা। যাক, দিয়ে দাও ডোডোকে।”
মালেকা বেগম ঘরে প্রবেশ করে বললেন, “এই তিথি, বোরকা নে। তোর আব্বা সিএনজি নিয়ে এসেছে।”
আম্বিয়া বেগম অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, “আপনিও মেয়ের পাগলামিতে সায় দিচ্ছেন বেয়াইন?”
মালেকা বেগম পাল্টা বললেন, “কি করব? আপনার ছেলের উপর যথেষ্ট ভরসা রেখেছি। সে তার বউয়ের অপমান চুপচাপ সহ্য করে বসে আছে। মনে হচ্ছে সে বেশ খুশিই হয়েছে। আপনার ননদ আমার সামনে যা যা বলেছে, এসব কি কোনো ভালো মানুষের কথা?”
আজলান এই মুহূর্তে তার মত পাল্টে বলল, “ও কোথাও যাবে না। ও আপনাদের মেয়ে কম, বাড়ির বউ বেশি।”
মফিজ সাহেব এসে বললেন, “না না, আমরা ওকে রাখবো না। আমরা ওর কথাগুলো এতদিন তেমন বিশ্বাস করিনি, কিন্তু আজ স্বচক্ষে দেখলাম ওকে কিভাবে অপমান করা হয়। ও থাকবে না আর এই বাড়িতে। আমি আমার মেয়েকে নুনে ভাতে খাওয়াতে পারব।”
আজলান তিথিকে বলল, “মেহবুব, আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, ডোডোকে নিয়ে তুমি কোত্থাও যাবে না। যদি যাও…”
তিথি তার পাল্টা প্রশ্ন করল, “যদি যাই?”
আজলান দাঁতে দাঁত পিষে রেগে শুধু চেয়ে রইলো, তার মনের অশান্তি ও বিরক্তি চক্ষু দিয়ে প্রকাশ করতে চাইছে সে। তিথি চোখ সরিয়ে ব্যাগের দিকে হাত বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আজলান হনহনিয়ে এগিয়ে এসে তিথির হাত খপ করে ধরে টেনে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। আম্বিয়া বেগমও দৌড় লাগালেন। আফতাব সাহেব দ্রুত পদক্ষেপে এসে আম্বিয়া বেগমের পথ আটকে বললেন, “ওদের ছেড়ে দাও।”
আজলান তিথিকে রূঢ়ভাবে ধরে ছাদের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। মফিজ সাহেব, মালেকা বেগম এবং অন্যান্যরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
তিথি বিরোধিতা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু আজলানের শক্তিশালী হাত থেকে তার মুক্তি পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আজলানের মুখে ক্রুদ্ধ ভাব ফুটে উঠেছে। তিথির চোখে অসহায়তা ও ক্ষোভের মিশ্রণ স্পষ্ট। সে চেঁচিয়ে যাচ্ছে তবুও আজলান তাকে ছাড়ছেনা। তিথি হার মেনে নিল একপর্যায়ে।
—
ছাদে এখন কেউ নেই। স্টেজে কেকটা পড়ে আছে, এবং চেয়ার ও টেবিলগুলো সামানো এলোমেলো হয়ে আছে। তিথিকে এনে আজলান তার হাত থেকে ছেড়ে দিল। তিথি কাঁদছে। আজলান ছাদের দরজা বন্ধ করে তার সিদ্ধান্তের প্রতি দৃঢ়তা দেখিয়ে বলল, “তুমি আমাকে বিয়ে করতে বলেছিলে না তোমার কোন একটা বান্ধবীকে?”
তিথি ভাঙা স্বরে উত্তর দিল। “হ্যা,”
“তার নাম্বারটা এনে দিও।”
তিথি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল। “কেন?”
আজলান সংকটের মুখে তাঁর সিদ্ধান্ত জানালো। বলল, “বিয়ে করব। তোমার সাথে আমার হবে না। তাই ঠিক আমি আরেকটা বিয়ে করব।”
তিথি নাক টানলো। আজলান তার বাহু চেপে ধরে বলল, “আমি ফেডআপ মেহবুব। আমি জেদী হলে তুমি গাধী। এরকম গাধীর সাথে আমি এক সেকেন্ডও থাকবো না আর।”
তিথির চোখের অবস্থা ভয়ংকর। তার চোখ ফুলে গেছে। আজলান তার চিরকালীন রাগের সুরে বলল, “যত ইচ্ছা কাঁদো। তোমার সতীন এলে ইচ্ছেমতো হেসো। তোমার বহুদিনের ইচ্ছা।”
আজলান কপাল চেপে ধরে বলল, “তারপরও দাও। ওর বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আসবো।”
আজলানের চাহনি ও কথায় তিথির মনোযোগ বিভ্রান্ত হয়ে গেছে।
দুজনেই দু-জনের দিকে খেপাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
হঠাৎ করে মনে হলো, দূরত্ব তাদের মধ্যেকার স্বাভাবিক সম্পর্কের সেই মিষ্টি নিকটতা হারিয়ে দিয়েছে। যেন সময়ের স্রোতে ভেসে গিয়েছে তাদের প্রণয়ের চিরচেনা স্বামী স্ত্রীর ঘনিষ্ঠতা।
দীর্ঘদিন পর একে অপরের মুখোমুখি হওয়ার পর তাদের চোখে চোখ পড়তেই যেন পুরনো দিনের স্মৃতি ফিরে এল। এক মুহূর্তের জন্য, সবকিছু থেমে গেল।
আজলান বলল,”তোমার সতীন আমার গায়ের উপর পা তুলে ঘুমালে তোমার ভালো লাগবে?”
আজলান হিংস্র হয়ে উঠে বলল,”তোমার কষ্ট হবে না বেয়াদ্দব?”
তিথি দৃঢ়ভাবে উত্তর দিল। “না।”
“কেন?”
তিথি একটু সময় নিয়ে বলল,
“আমি মরার আগে তুমি বিয়ে করতে পারলে তবেই তো।”
আজলান তার মনোরম চোখে অধিকারবোধের চিহ্ন দেখতে পেল। কি শান্তি এই অধিকারবোধের মধ্যে! আজলান শেখ তো এটাই চেয়ে এসেছে বরাবর।
নিজেকে সামলে নিয়ে তিথির গালটা মুছে দিয়ে আজলান বলল, “সব আটাময়দা তো ধুয়ে চলে গেল। সেজে কি লাভ হলো?”
তিথি তীব্র রেগে উঠে তার হাত সরানোর চেষ্টা করতেই, আজলান তাকে নিজের কাছে টেনে ধরে ধমকে উঠে বলল, “মেহবুব!”
তিথি স্তব্ধ হয়ে গেল। আজলানের কঠিন মুখের সামনে দাঁড়িয়ে তার সাহস হারিয়ে গেল। আজলান ধীরে ধীরে তিথির কাছে এল, তার চোখে তীব্রতা এবং মৃদু তেজের মিশ্রণ। তাদের মাঝে শূন্যতা ক্রমশ সংকীর্ণ হতে লাগল।
এক স্নিগ্ধ মুহূর্তে, দুজনের ঠোঁট একে অপরের ঠোঁটে স্পর্শ করল। আজলান তিথির ঠোঁটে ধীরে ধীরে চুম্বন করল, যেন সেই চুম্বন সমস্ত কথা এবং অনুভূতি বহন করছে যেন। তিথি অবাক হয়ে তার প্রতিক্রিয়া দিল। হঠাৎ করেই, দুজনেই একে অপরের ঠোঁট কামড়ে ধরল, যেন তাদের ক্ষোভ আর রাগের সমস্ত অভ্যন্তরীণ আবেগ বাইরে বের হয়ে আসছে। চুম্বনের এই অস্থিরতা, ঝগড়ার উত্তেজনা আর অম্ল স্বাদের এক অদ্ভুত মিশ্রণ থেকে তিথি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“তুমি একশোটা বিয়ে করো। আমার কোনো আপত্তি নেই। এমন রাক্ষসের মতো কেউ চুমু খায় নাকি?”
আজলান হতভম্ব! তিথি তার বুকে কিল বসিয়ে বলল, “ছাড়ো। চিৎকার করে ক্যামেরাম্যানকে ডাকবো। তোমার ইজ্জতের দফারফা করতে আমার দু সেকেন্ড লাগবে আজলান শেখ।”
আজলান তাকে ছেড়ে দিল নির্লিপ্তভাবে। যেন কিছুই করেনি সে। নিজের ভাবগাম্ভীর্য ধরে রেখে টিস্যু দিয়ে নিজের মুখ মুছতে মুছতে বলল, “তুমি ছাদ থেকে নেমে সোজা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বুঝতে পারবে, কার ইজ্জতের দফারফা হয়ে গেছে।”
ছাদে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। আয়জার কয়েকজন বান্ধবী এসেছে। তারা আর ফুপাতো মামাতো খালাতো ভাইরা মিলে স্টেজ সাজিয়ে ফেলেছে। আজলান জানে এরা এসবে ওস্তাদ। সেখানে যদি কয়েকটা মেয়ে থাকে তাহলে কাজ আরও সহজ।
কেক চলে এসেছে। পার্লারের মেয়েও চলে এসেছে। পার্লারের মেয়েদের এনেছে তিথি। আজলান শেখ তা শোনার পর আর কিছু বলার জন্য খুঁজে পাননি।
ডোডো চড় খেয়ে এমন জোরে কাঁদা শুরু করেছে বিরিয়ানির ডেকচি পাকাতে থাকা বাবুর্চির সাথে কথা বলতে থাকা আজলান শেখ পর্যন্ত থমকে গেল। আবার হলোটা কি? আম্বিয়া বেগম ডোডোকে কোলে নিয়ে ফেলে তিথিকে বলল,
” আমি ওর বাপকে দিয়ে আসি। ”
” দাও। সারাক্ষণ হাওয়া খেয়ে বেড়ানো ছাড়া আর করছেটা কি? সব আমার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে এ এসেছে ম্যাম্যা করতে। একচড় দেব। ”
ডোডো ঠোঁট টেনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। তিথি উপহাস করতেই সে আরও জোরে কাঁদতে লাগলো। আজলান এসে বলল,
” কি হয়েছে? সমস্যা কি? ওকে এভাবে কাঁদাচ্ছ কেন?”
তিথি মুখ ফিরিয়ে নিল। আম্বিয়া বেগম বললেন,
” ওর মাকে জ্বালাচ্ছে। ওকে একটু রাখ। আর কারো কোলেই যাচ্ছে না। কতজন নিতে চাইলো, তোর ছেলে কারো কোলে যাবে না। ”
আজলান হাত বাড়িয়ে ডোডোকে কোলে নিয়ে নিল। ডোডোর কান্না তারপরও থামে না। মা তাকে বকেছে, তাই মাকে আদর করে দিতে হবে। তার আগে কান্না থামবে না।
আজলান তাকে শান্ত করানোর জন্য হাতের ঘড়িটা খুলে দিল। ডোডো সেটা দেখে কান্না থামিয়ে হাতে নিল। তার পরপরই ঘড়িটা ভারী হওয়ায় টুপ করে ফেলে দিল নীচে। আম্বিয়া বেগম আঁতকে উঠলেন। ডোডো চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো পুনরায়।
আজলান হতভম্ব। এই ছেলে কি শুরু করেছে? তিথি আর না পারতে ডোডোকে কোলে নিয়ে হনহনিয়ে যেতে যেতে বলল,
” বাপের মতো হয়েছে। ”
আজলানের ভুরু যুগল দ্বিগুণ কুঁচকে গেল। আম্বিয়া বেগম তা দেখে বললেন,
” হয়েছে আর ওদিকে অমন করে তাকিয়ে থাকতে হবে না। ভুল কিছু বলেনি। ”
যেতে যেতে শেষের কথাটা একটু আস্তে বলেছেন উনি। আজলান যদিও শুনেছে কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখানোর ফুরসত পায়নি। আজলান ঘড়িটা তুলে দেখলো কাচ ভেঙে গিয়েছে। “চ” কারান্ত শব্দ করলো সে মুখ দিয়ে।
আফতাব শেখ এসে বললেন,
” বিরিয়ানি মনে হচ্ছে ভীষণ ঝাল হবে। ”
আজলান অতিষ্ঠ এই মানুষটার জ্বালায়। কিছুক্ষণ আগে এসে বললো, মশলাপাতি কম হয়েছে। মাংস কম পড়েছে। এখন এসে বললো ভীষণ ঝাল হবে। অসহ্য!
গটগট পায়ে হেঁটে সেখান থেকে চলে গেল সে। যে জন্ম দিয়েছে সে শান্তি দেয় না, যাকে জন্ম দিয়েছে সে বুঝবে কি করে? এত যন্ত্রণা সহ্য করা যায় না।
” ভালো লাগছে দেখতে। আমার নাতিটাকে একটা নতুন দেখে গেঞ্জি পড়িয়ে দে। ”
তিথি ডোডোকে উপুড় করে ধরে বলল, ” ডোডো আম্মাকে কেমন লাগছে বল। ”
ডোডো তার নাক কামড়ে দেয়ার জন্য ঝুঁকে এল। তিথি ঝাড়ি মেরে বলল,
” সবসময় ফাইজলামি করতে থাকে। মার খেয়েছিস বেশিক্ষণ হচ্ছে না আবারও দুষ্টুমি করছিস! ”
ডোডো ঠোঁট টানলো। তিথি আদর করে বলল,
” আচ্ছা আর বকবো না। আমার ছেলের মতো লক্ষ্মী ছেলে আর দুটো নেই। ”
আজলান ডার্ক গোল্ড কালারের একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছে। ডোডোকে একটা ওই রঙের টিশার্ট পড়িয়ে, পায়ে জুতো পড়িয়ে, মাথায় হ্যাট পড়িয়ে দিয়েছে। ডোডো হ্যাট খুলে দূরে ছুঁড়ে মারলো। আজলান ধমক দিয়ে হাতে একটা ঘড়ি পড়িয়ে দিল। তারপর বলল,
” দুষ্টুমি করলে মারবো আইজান। ”
ডোডো হাতের বাঁধা ঘড়িটা কামড়াচ্ছে।
আজলান চিরুনীতে পারফিউম স্প্রে করে চুল আঁচড়ালো। হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে ডোডোর কাছে এসে দেখলো ঘড়িটার মধ্যে অন্য হাতটাও ঢুকিয়ে বসে আছে সে। রাবারের ঘড়ি হওয়ায় হাতটা ঢোকাতে সহজ হয়েছে। আজলান কোমরে হাত দিয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলো। ডোডোও তার দিকে চোখ তুলে চেয়ে রইলো।
তিথি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দেখলো তাদের বাপ ছেলের কান্ড। এমনভাবে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে মায়া না লেগে যাবে কোথায়? আজলান কোলে তুলে বলল,
” এত জ্বালালে আমি যাব কোথায়? ”
ডোডো তিথিকে দেখে ফেলেছে। আম্মাহ বলে চিৎকার দিল তক্ষুণি। আজলান ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখলো। তিথি মুখ পাশ করে দাঁড়িয়েছে। আজলান ঘর থেকে বের হতেই সে ঘরে ঢুকলো।
খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকে গিয়েছে। আজলান যতকেজি চাউল ততকেজি মাংস দিয়ে বিরিয়ানি করেছে। সবাই খেয়ে বেশ প্রশংসা করছে। আফতাব বুক ফুলিয়ে সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন “আমার ছেলে কাঁচা কাজ করে না। ও চেয়েছে এমন হোক।”
আজলান ভাবলো, ” কেমন পল্টিবাজ লোক তার নিজের বাবা! ”
খাওয়াদাওয়ার ঝামেলা চুকে যাওয়ার পর স্টেজে কেক কাটতে উঠেছে অবিবাহিত মেয়েগুলো। গান বাজনা করছে সবাই মিলে। আজলানের এসব পছন্দ নয় কিন্তু পোলাপানগুলোকে বারণ করতে যেতেই আম্বিয়া বেগম বাঁধা দিয়ে বললেন,
” ওরা বিয়েবাড়িতে ঘুমানোর জন্য আসেনি। আনন্দ করতে এসেছে। খবরদার কিছু বলবি না। ”
আজলান পেছনে হাত ভাঁজ করে আয়জাকে দেখতে লাগলো। সাজানোর পর তাকে আর চেনা যাচ্ছেনা। যদিও সাজটা কুৎসিত হয়েছে বললে বাড়িয়ে বলা হবে কিন্তু নিজের চেহারা বোঝা না গেলে সেজে লাভ কি? আতিফাকে একদমই চেনা যাচ্ছে না। তার উপর ক্ষেপে গেলে আতিফা বলল,
” ভাবির চেহারা তো পাল্টায়নি। আমাদের চেহারা ওরকম তাই চেঞ্জেস এসেছে। সবার ফেস কাটিং একরকম না। ”
আজলান বলল, ” তোর বর তোকে চিনতে পারছে? এতক্ষণ ধরে এসব সাজছিস সবাই মিলে? ”
আজলান তাদের মা ছেলের পিছুপিছু ঘরে চলে এল। তিথি টিস্যু দিয়ে কেক মুছে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আজলান মুখ ধুয়ে ডোডোর হাতটাও ধুয়েমুছে দিয়ে বলল,
” তুমি আজকাল বড্ড পাজি হয়েছ আইজান। এসব যে শেখাচ্ছে তাকে বলে দেবে এর ফল ভালো হবে না। ”
তিথি সাথে সাথে বলল,
” কার ফল কেমন ভালো হয়েছে দেখতেই পাচ্ছি। ”
আজলান শাণিত দৃষ্টিতে তাকালো। তিথি চলে গেল আবারও।
আজলানকে আম্বিয়া বেগম টেনেটুনে নিয়ে গেলেন ডোডোকে সহ। কেক কাটার জন্য দু’জনকে ঠেলেঠুলে একসাথে তুলে দিলেন। তিথি ডোডোকে সাবধানে কোলে নিয়েছে। হাতে একটা কমলা ধরিয়ে দিয়েছে সে সেটা নিয়ে আপাতত ব্যস্ত। আয়জাকে কেক কেটে খাওয়ানোর পর আয়জা ভাই আর ভাবিকে খাইয়ে দিল। ডোডোকেও খাইয়ে দিল। ডোডো মায়ের মতো আয়জার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই আয়জা তার হাতে আদর দিয়ে আমআম করে খাওয়ার ভান করতেই ডোডো খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। আজলান দ্রুতপায়ে নেমে আসবে ঠিক তখুনি ক্যামেরাম্যান বলল,
” ভাইয়া ভাবিকে কেক খাইয়ে দিন তারপর ভাবি আপনাকে খাওয়াবে। ”
তিথি আর আজলান দুজনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। আজলান কেক কেটে অন্যদিকে চোখ রেখে তিথিকে খাইয়ে দিল। কিন্তু সেটা তিথি খেল না। ডোডো খেয়ে নিয়েছে। আম্বিয়া বেগম ক্যামেরাম্যানকে বলল,
” বউকে বড় টুকরো খাইয়ে দিতে বল। ”
ক্যামেরা ম্যান বলল, ” এবার ভাবির জন্য কেক বড় করে কাটেন ভাইয়া। ”
আজলান হতবাক! ডোডো কেক খেতে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। আজলান পুনরায় কেক কেটে তিথির দিকে বাড়িয়ে দিল। তাকিয়ে রইলো ক্যামেরার দিকে। তিথির দিকে ভুলেও তাকালো না।
তিথি ঝুঁকে বড় পিসের কেক থেকে একটুখানি খেল। এমনভাবে খেল যেন আজলান শেখের হাত তার ঠোঁট লাগলেই আগুনে পুড়ে ছাঁই হয়ে যাবে।
আজলানের এতবড় অপমান সইলো না। মুখটা স্বাভাবিক রাখলো বহুকষ্টে। তিথিও কেক কেটে এমনভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে, মানুষ ভিক্ষুককেও এর চাইতে যত্ন করে কিছু খেতে দেয়। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে রইলো। অথচ হাতটা আজলানের বুকের কাছটায়। আজলান তার হাতটা শক্ত করে ধরে কেক খেল। তিথি প্রাণ যায়যায় অবস্থা। রাক্ষসটা হাতটা এমনভাবে ধরেছে যেন সব অপমানের বদলা নিয়ে নিল। ডোডোর হাতের উপর হাত রেখে তিথি কেক কেটে ছেলের হাতে কেক খেল। ততক্ষণে আজলান নেমে গিয়েছে। তিথির গলা শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। তিথি ক্যামেরা ম্যানকে বলছে,
” আমার ছেলে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে এটার একটা ছবি তুলুন। ”
ডোডোর হাত থেকে কেক খেল তিথি। তারপর গালে আদর করে বলল,
” আমার সোনা ছেলে। ”
আজলান গটমট পায়ে হেঁটে নীচে চলে গেল। তিথি ডোডোর জন্য একটা প্লেটে কেক কেটে নিয়ে নেমে যাওয়ার সময় আয়জা বলল,
” ভাবি তুমি কি বলোতো। ভাইয়া অতবড় কেক কেটে দিল, খেলে একটুখানি। ডোডোর হাতে একা একা কেক খেলে, ভাইয়াকে দিলে না। ভাইয়া তো রেগে বোম। ”
তিথি বলল,
” তোমার ভাই ঠান্ডা ছিল কখন? ”
আতিফা আম্বিয়া বেগমকে বলল,
” দেখলে আম্মা? ও সারাক্ষণ আমার ভাইয়াকে রাগিয়ে দেয়ার তালে থাকে। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” ও কিভাবে কেক বাড়িয়ে দিয়েছে দেখলিনা? ওর কাছ থেকেই তো শিখছে। তোর ভাই ধোয়া তুলসী পাতা নয়।”
আতিফা বলল, ” তুমি ওকে মাথায় তুলছো আম্মা।”
” সংসার টিকিয়ে রাখা এত সহজ না। শ্বাশুড়ি হ তারপর বুঝবি। ”
আতিফা তর্কে না জড়িয়ে তার বরের কাছে চলে গেল।
ডোডোকে কেক খাওয়াচ্ছিলো তিথি। যতটা না খাচ্ছে ততটা নিজেরে হাতে মুখে লাগিয়েছে ডোডো। মাকেও খেতে বলছে। কত দরদ তার! পাশ থেকে মেঝ ফুপু বলল,
” আজব ব্যাপার! আমার ছেলে কি খাবে, কতটুকু খাবে,কখন খাবে এসব আমার ব্যাপার। আমি ওকে দরকার পড়লে একটা বিরিয়ানির ডেকচি পুরো খাওয়াবো। আপনার তাতে কি? সবকথা মুখবুঁজে সহ্য করছি বলে, শুনেও না শোনার ভান করে থাকছি বলে আমার ছেলেকে নিয়ে কথা বললে তা শুনে চুপ থাকবো না। কেমন মানুষ আপনি একটা বাচ্চার খাবারে নজর দেন? ”
ডোডো মায়ের চিৎকার শুনে কেঁদে উঠেছে। মেঝ ফুপু আম্বিয়া বেগমকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
” দেখছো ভাবি তোমার ছেলের বউ কেমন সুরে কথা বলে? আমি আগেই ভাবছি এই মেয়ে এত ভালো হয়ে গেল কিভাবে? এখন আসল রূপ বেরিয়ে এল। ”
” ফকিন্নির মেয়ের বড়ঘরে বিয়ে হলেও কি মুখের ভাষা পরিবর্তন হয়? একটা জুটছিলো আমার ভাইয়ের কপালে, আরেকটা জুটছে আমার ভাইপোর কপালে। কি ভাষা! কোথাকার বস্তি, ছোটলোকের মেয়ে। সামান্য কথা জিজ্ঞেস করছি সে উত্তর কিভাবে দিল দেখলে সবাই? ”
সবার বাকবিতন্ডার মধ্যে সবার পেছনে এসে দাঁড়ালো আজলান। জলদগম্ভীর স্বরে ” কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই” মেঝ ফুপু ছুটে এসে বলল,
” তোর বউ কি ভাষায় কথা বলছে জানিস? আমি কি এত অপমানিত হওয়ার জন্য আসছি এতদিন পর? এই মেয়ের সাথে তুই ঘর করিস কেমনে? কি মুখের ভাষা? আমি শুধু বললাম এতটুকুনি একটা বাচ্চাকে এসব খাওয়ানোর কি দরকার? এত খাওয়ালে বদহজম হবে। শুনেছি ওর এমনিতেই মাঝেমধ্যে পেট ব্যাথা হয়। মাগোমা তোর বউ ক্ষেপে গেল আমার উপর। যেন আমার উপর তার অনেক ক্ষোভ। মেয়ে তো আমিও পেটে ধরছি। মুরব্বির মুখে মুখে এমন জবাব তো ও দেয় না বাপু। ”
তিথি রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ নিয়ে টলমলে চোখে আজলানের দিকে চেয়ে রইলো। চোখ দিয়ে যেন আগুনের স্ফূলিঙ্গ বের হচ্ছে। আজলান তাকাতেই চোখ সরিয়ে ডোডোকে নিয়ে হনহনিয়ে নীচে চলে গেল সে। হেনা এসে মাকে জোর করে টেনে নিয়ে যেতে চাইলো। তিনি বললেন,
” তুই কেমন ছেলে! আর কেমন বউ জুটলো। তোর মা কেন সারাক্ষণ তাকে তেল মাখে এবার বুঝলাম। আস্ত বেয়াদব একটা মেয়ে। দূর করে তাড়িয়ে দে।”
আরও কয়েকটা দিন কেটে গেছে বাংলোয়। পুরো বাংলো আর বাংলো ভর্তি মানুষ একদিকে, তিথি আর তার বাচ্চা অন্যদিকে। মা ছেলের হাসাহাসি পাগলামি দেখে সবার মন ভালো না হয়ে যাবে কোথায়?
ডোডো দ্রুত হামাগুড়ি দিতে জানে। তিথির পিছু পিছু এমন দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে পাগলা ষাঁড়কেও হার মানাবে। তারপর ধরতে পারলে খামচি দিয়ে নিজের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে।
তিথি পাগলা ডাকলে মাথা ঝুঁকে ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো তাকাবে। তিথি হেসে খুন।
ঘরের দরজার ওপাশে, জানালার ওপাড়ে আর পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আজলান শেখ মা ছেলেকে চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করে যায়। তাকে দেখামাত্রই মা ছেলে এমন সাধুসন্ন্যাসী হয়ে যায় যা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যকেও হার মানাবে।
বিদায়বেলা ঘনিয়ে আসতেই জাফর আহমেদ বললেন, ” আয়জার বিয়েতে আমরা দাওয়াত না দিলেও যাচ্ছি। আর হ্যা ওদের বিয়ের পর আবারও এই বাংলোয় দাওয়াত। বৌমার কিন্তু বেশ লেগেছে এই বাংলোয় থাকতে। তাই না বৌমা? ”
তিথি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। আজলান বলল,
” সে দেখা যাবে। ”
” দেখা যাবে টাবে পরে। বৌমা তোমাকে বলছি। যখনি মন খারাপ হবে এই মশা মাছির আখড়ায় চলে আসবে। মশা মাছিগুলোকেও কিন্তু তখন বন্ধুর মতো লাগবে। তোমার জন্য সবসময় এই বাংলোটা খোলা। ”
তিথি বলল, ” আপনারা কিন্তু আগেভাগে চলে যাবেন। মা তুমি কিছু বলো আন্টিকে। ”
তাহেরা বেগম বললেন,
” বাড়ির বউ দাওয়াত দিয়েছে এতেই হয়েছে। উনাকে আর বলতে হবে না। আমরা যাবো। কিন্তু ডোডোবাবু চলে যাচ্ছে দেখে ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে। ”
ডোডো আয়জার কোলে বসে চুপচাপ সবাইকে দেখে যাচ্ছে। যেন মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শুনছে সে। তাহেরা বেগম তাকে কোলে নিয়ে নিল।
ডোডো উনার কোলে বসে ডাকলো, ” দাদ্দাহ “।
সবাই হাসলো। তাহেরা বেগম তার গালের সাথে গাল ঠেকিয়ে বলল,
” দেখেছ, আরও মায়া ফেলছে দাদা ডেকে। আবার এসো দাদুভাই। তোমরা মা ছেলেকে রেখে দিতে ইচ্ছে করছে আমার। ”
তাহেরা বেগম আর জাফর আহমেদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সবাই গাড়িতে উঠে বসলো। শায়লাকে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দিয়েছে আজলান।
শেখ বাড়িতে পৌঁছানোর ঘন্টাখানেকের মধ্যে রমলা চাচী এসে হাজির। সাথে মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। উনার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। তিথিকে দেখে বুকে টেনে নিয়ে বলল,
” আমার মাইয়্যার বিয়ায় তোমরা থাকবা। আমার ডোডোভাইও যাবে। তুমি আসছো শুনে চইলা আইছি। বলছিলাম কি তোমার জামাই এখন সুস্থ হয়ছে তো? ”
তিথি বলল, ” তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করো। ”
” আমি কেমনে কইতাম? তুমি যাওয়ার পর আমি তারে কত কথা শুনাইছি জানো? জীবনেও তার সামনে দাঁড়ায় কথা বলছি আমি? সেইদিন গায়ে মনে হয় ভূত ভর করছিলো। কথা শোনাইয়া মুখ ঝামটা দিয়া চইলা গেছি। বলছি, আর জীবনেও আসমু না এই বাড়িত। তুমি কি তার লগে কথা কওনা? ”
” কথা থাকলেই তো বলব। ”
রমলা চাচী ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো। বলল,
” আইচ্ছা পরে কথা বলবোনে। যাও বাচ্চা নিয়ে ঘরে যাও। ”
তিথি সোফায় বসে থেকে জবাব দিল।
” এখন ঘরে যাওয়া মানা। পরিষ্কার করছে। অনেক ধূলো জমে আছে। ”
রমলা চাচী মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
” তোমার জামাইটা একটা বদ্ধপাগল বুঝলা বউ? মাথা খারাপ ছেলে। মানুষ এত জার্নি করে বাড়িত আইসা একটু আরাম করে। আর তোমার জামাই করতেছে ঘর পরিষ্কার। ”
তিথি বোরকাটা খুলে কোলের উপর নিয়ে চুপ করে বসে রইলো। আজলান কাশতে কাশতে এল। ডোডোর উদ্দেশ্যে বলল,
” ডোডো ঘরে আসতে পারো এবার। ”
ডোডো মিষ্টি খাচ্ছে বসে বসে। বাবার কথা শুনে চোখ তুলে চাইলো। হাতের মিষ্টি বাড়িয়ে দিল বাবার দিকে।
তিথি তাকে কোলে নিয়ে ঘরে চলে যেতে যেতে বলল,
” মানুষ কি পাগল হয়ছে যে তোর লালা খাবে? পাগল তো আমি। ”
ডোডো হা করে চেয়ে রইলো মায়ের মুখের দিকে। তিথি অবাক। আজকাল হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কথা শুনে সে। কি বুঝে আল্লাহ জানে।
আজলান টি টেবিলে মিষ্টির কাটুন দেখে বলল,
” মা মিষ্টি কে এনেছে? ”
রমলা চাচী এসে বলল,
” আমি আনছি বাবু। ওই, আমার রুম্পার বিয়া ঠিক হয়ছে তো তাই।”
রমলা চাচী ভড়কে গেলেন। আবার রুম্পার বিয়ে ভেঙে দিবে না তো? আমতাআমতা করে বললেন,
” পোলা ভালা। পাইপ ফিল্টারের কাজ করে। পয়সা কামাই ভালো। ”
” পয়সা তো এখন ভিক্ষুকও কামায়। ছেলের আগপিছ কোনো ভালোমন্দের রেকর্ড আছে কিনা দেখেছ? বিয়ে একবারই হয়। ”
রমলা চাচী হেসে বললেন,
” না না ছেলে বড়ো ভালো। রুম্পারে পছন্দ করছে ইস্কুলে যাওয়ার সময়। ”
” ওর বয়স আঠারো হয়েছে? ”
” হ হয়ছে। ঊনিশে পড়ছে। বিয়াতে তুমি যাইবানা?”
” যাব। ছেলে কি কি নিচ্ছে? ”
” তেমন কিছু না। দুই পদ ফার্নিচার আর চারশো বৈরাতী। আশেপাশের মাইয়াদের বিয়া দিতে আরও বেশি খরচা লাগছে সেইখানে রুম্পার জামাই তেমন কিছুই নিতাছে না। ”
” টাকাপয়সা যোগাড় হয়েছে? ”
” হয়ছে লাখ দুখানেক। আমার মামাতো ভাই, ফুপাতো ভাইরাও দিতেছে সামর্থ্য অনুযায়ী। কোনোমতে হাতে তুলে দিতে পারলেই হলো। ”
আজলান বলল, ” রুম্পার বাবা ভাই কেউ নাই সেটা জেনেও এতকিছু দাবী করলো কেন? ”
রমলা চাচী ভড়কে গেলেন। আম্বিয়া বেগম এসে বলল,
” এ রমু রুম্পার বিয়েতে কি চাস তুই? ”
রমলা চাচী একটু জিরিয়ে বাঁচলেন। সাহস করে বললেন,
” একটা পালঙ্ক আর একটা ওয়াল শোকেস চাইছে ভাবি। ওয়াল শোকেসটা দিলেই হইবো। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” আচ্ছা ওটা আজলান দিবে। তোর বড়বাবুর কাছ থেকে কিছু চাস। দিবে। ”
” না না বড়বাবু দোয়া কইরা দিলে হইবো।”
আজলান বলল,
” ওদের আক্কেল দেখে আমার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। স্বচক্ষে দেখছে চাচী একা মেয়েটাকে মানুষ করেছে তারপরও এত দাবীদাওয়া! ”
আম্বিয়া বেগম ধমক দিয়ে বললেন,
” এর চাইতে আরও বেশি নেয়। যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলিস না। আজকাল যৌতুক ছাড়া বিয়ে হচ্ছে নাকি? সবাই তোর মতো আইন বুঝে না। ও যা চাইছে তা দিয়ে দে। মেয়েটা সুখে থাকলেই হলো। ”
আজলান মাথা দুলিয়ে ঘরে যেতে যেতে ভাবলো,
” একজন না আইন বানাতে পারে, না ভঙ্গ করতে। মানুষের কবে যে সুবুদ্ধি হবে। ”
__
বাংলোয় দুটো শাড়ি পড়ে কাটিয়েছে তিথি। স্যুটকেসটা তাদের বাড়িতে। সব কাপড়চোপড় সেখানে। পুরো ঘরে ডোডোর জিনিসপত্রে ভরা অথচ তার কাপড়চোপড় খুঁজলে আর পাওয়া যাচ্ছে না। যেগুলো দামী শাড়ি সেগুলো আজলান শেখের কাবার্ডে। ওই কাবার্ডে বিয়ের পর থেকে হাতও দেয়নি তিথি।
আম্বিয়া বেগম এসে বললেন,
” তোর ভাইকে বল স্যুটকেসটা যাতে দিয়ে যায়। ”
তিথি বলল, ” না না। আমি গিয়ে নিয়ে আসবো। ওর এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। ”
” তুই আবার কখন যাবি? এখন আর কোথাও যাস না।”
তিথি বলল,
” একেবারের জন্য যাচ্ছি না। আমার আর যাওয়ার জায়গা আছে? ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” আমি তোর ড্রাইভার কাকাকে বলব ও যাতে নিয়ে আসে। তোর মাকে বলে রাখিস। ”
তিথি বলল, ” তুমি ভয় পাচ্ছ? ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” পাচ্ছি কারণ ও যদি অন্য কিছু মনে করে? ছেলে তো আমার তাই আমি বুঝি কোন সময় কোন কাজ করাটা ঠিক হবে না। তুই এখন বাপের বাড়ি উঠলে ও মনে করবে তুই ওর উপর জেদ দেখাচ্ছিস। আর অশান্তি ভালো লাগেনা বউ। ”
তিথি বলল,
” আচ্ছা কাকাকে পাঠাও। ”
আম্বিয়া বেগম খুশি হলেন। বললেন,
” আচ্ছা। ”
তিথি ডোডোর হাতটা ধুয়ে দিল বেসিনের পানি ছেড়ে। মুখটা মুছে দিল। তারপর গালে ঠোঁট চেপে বলল,
” এবার ঘুমা ডোডো। ঘুম ঘুম। ”
ডোডো চোখ বন্ধ করলো মিছিমিছি। তিথি হেসে উঠে বলল,
” অভিনয়টা ভালো জানে পাজি ছেলে। ”
ডোডো খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। তিথি তার গালে গাল চেপে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
______
বাবা ছেলে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছে। আফতাব শেখ কথা বললেন কম খোঁচা মারলেন বেশি। আম্বিয়া বেগম তামাশা দেখছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আজলান যদি বলে, আপনার মেয়ের বিয়ে নিয়ে কি ভাবছেন?
তিনি উত্তরে দেন,
” সে আমার মেয়ে কম তোমার বোন বেশি। যাকে পছন্দ করেছে সে আমার পরিচিত কম কিন্তু তোমার পরিচিত বেশি। তাই সব সিদ্ধান্ত তোমার। আমি শুধু পায়ের উপর পা তুলে দেখবো। ”
আজলান চুপ করে রইলো উনার এমন উত্তর শুনে। তারপর কিছুক্ষণ ভাবুক হয়ে রইলো। পরে জিজ্ঞেস করলো,
” ওর আগে-পরে চাকরি হয়ে যাবে। আপাতত বৌ পালার মতো পয়সা কামাচ্ছে। সো দেরী করছেন কেন? মেয়েকে পাত্রস্থ করুন। আপনার পেছনে আমি আছি। কি বলেন? ”
” আমার পেছনে থেকে লাভ নেই। আমার সামনে থাকো। আমি বরঞ্চ তোমার পেছনে থাকি। ”
ডোডো উঃ উঃ করে কাশার মতো অভিনয় করলো। তিথি অবাক। আয়জা হেসে উঠে ডোডোর গালে গাল চেপে ধরে আদর করতে করতে বলল,
” আম্মাকে জিভ দেখাও। ”
ডোডো জিহ্বা বের করে দেখালো। তিথি হাঁ করে চেয়ে রইলো। কপাল চাপড়ে বলল,
” তোর সভ্য বাপ বলবে এসব আমি শিখিয়েছি। ”
___
আয়জার বিয়ের কথাবার্তা এক বৈঠকে সেড়ে নিয়েছে আজলান। সে অত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা পছন্দ করে না।
যারিফের বাবার গ্রামের বাড়িতে বাড়িঘর আছে। উনারা বংশধর মানুষ কিন্তু অভাবের তাড়নায় চাকরি খুঁজতে গিয়ে শহরে উঠার পর আর গ্রামে ফিরতে পারেননি। বড় ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করিয়েছেন, ছোট ছেলেটা এখনো নবম শ্রেণীতে পড়ছে। তিনি এখনো একটা কাপড়ের কারখানায় কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। বেশ আত্মনির্ভরশীল মানুষ। আজলানের কথা তিনি আগে যারিফের মুখে শুনলেও দেখা হয়েছে এই প্রথম। তিনিও সোজাসাপটা কথায় বিশ্বাসী। দেনাপাওনা কথা উঠলে বলে দিলেন,
” আমি এর আগেও আপনার আব্বাকে বলেছি বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হবে। আমার ছেলের এখন ধরাবাঁধা চাকরি বাকরি নেই তাই আমি কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছি না। যদি আল্লাহ কখনো তৌফিক দান করেন তাহলে ও একটা ওয়ালিমার ব্যবস্থা করবে। লোকদেখায় কোনোকিছু দিতেও হবে না আপনাদের মেয়েকে। আমার ঘরে মেয়ে নেই ঠিকই কিন্তু একটা মেয়ের জন্য যা যা আসবাবপত্র লাগে সব আছে। যা নেই তা ধীরেধীরে ওরা জুড়িয়ে নেবে। আপনাদের যদি তাতে অস্বস্তি থাকে কিংবা আপনাদের মেয়ের ঘর সাজানোর জন্য কিছু দিতে চান তা আপনাদের মেয়ের সাথে পরামর্শ করে তারপর দেবেন। আগে সে ঘরে উঠুক। আমার মনে হয় না তার বাবার কাছে তার কোনোকিছু চাইতে হতে পারে। ”
আজলান চুপ করে শুনলো। জায়গির হোসেনের কথায় সে মোটামুটি সন্তুষ্ট। বলল,
” আমার বাবা উনার মেয়েকে কিছু না দিয়ে বিয়ে দেবেন বলে মনে হয় না। সে যাইহোক সেটা উনার ব্যাপার। উনি উনার মেয়ের ঘর সাজিয়ে দিতে চাইলে দিক।
আমাদের মধ্যে কথা হবে শুধু বিয়ে নিয়ে। আমি আমার নিকটাত্মীয়দের জানাবো আপনিও আপনার নিকটাত্মীয়দের জানাবেন। মেয়েকে আপনারা কি দেবেন তা ফয়সালা করে নেবেন নিজেরাই। সময়টা আগামী সপ্তাহের দিকে ফেললে ভালো হয়। কারণ তার পরের সপ্তাহ থেকে আমি ডিউটিতে জয়ন করব। ব্যস্ত হয়ে যাবো। এখন ধীরেসুস্থে সবটা সামলে নিতে পারবো। ”
জায়গির হোসেন বললেন,
” তাহলে সেটাই কথা থাকলো। ”
______
বিয়ের ধুমধাম শুরু হতে না হতেই বাড়িটা মেহমানে ভর্তি হয়ে গেল। আজলানের ফুপু, খালা, মামিরা এসে পড়েছে। এর আগে ডোডোর আকীকায় এসেছিলো সবাই কিন্তু মেঝ ফুপু আসেনি। এবার তিনি এসেছেন। সাথে মেয়েকেও নিয়ে এসেছেন। মেয়েটা কোথাও যায় না তেমন। ঘরের মধ্যে বেশিদিন বন্দী হয়ে থাকতে কার ভালো লাগে?
হেনা আপাকে দেখে আয়জা তেমন খুশি না হলেও
ভাইয়ার প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় ছিল সে।
একসময় হেনা আপা তাদের বাড়িতে থাকতো। তখন দাদীমা বেঁচে ছিলো। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলো এই বাড়িতে থেকে। ভাইয়া তাকে আর হেনা আপাকে পড়াতো। হেনা আপা ভাইয়ার জন্য পাগল ছিল। ভয় পেত সামনে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলতে কিন্তু পাগলামির শেষ ছিল না। এমনকি তাদের বিয়ে নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে কথাবার্তাও ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিলো।
ভাইয়ারও কোনো আপত্তি ছিল না এতে। হেনা আপার প্রতি তার বিশেষ কোনো অনুভূতি দেখা না গেলেও দূরছাইও করেনি কখনো। না আপার অনুভূতিকে কখনো অসম্মান করেছে।
কিন্তু ভাইয়ার চাকরি হওয়ার পর কি যেন হয়ে গেল! দাদীমাও মারা গেল, হেনা আপা কলেজে উঠে গেল, ভাইয়ারও চাকরি হয়ে গেল। দু’জন দুদিকে।সেই ফাঁকে হেনা আপা বদলে গেল চোখের পলকে। চোখের আড়াল হলেই কি মানুষ মনের আড়াল হয়ে যায় এত সহজে? কত সহজে হেনা আপা অন্য একজনকে ভালোবেসে ফেললো। এটা আদৌ কি ভালোবাসা ছিল নাকি মোহ? কত সহজেই হেনা আপা সেদিন বলে দিল,
” ওর মতো রোবটের সাথে সংসার করতে পারবো না আমি। আমি এর চাইতে ভালো কাউকে পেয়েছি। বেটার কাউকে জীবনসঙ্গী করার রাইট আমার আছে। আমি এবার উপলব্ধি করেছি আমি এতদিন আবেগের বশে পাগলামি করেছি কিন্তু ভেবে দেখেছি তোর ভাইয়ের সাথে সংসার করা অনেক কঠিন। একেই সে ওসিডি রোগী, দ্বিতীয়ত ওর এমন মেজাজ, তৃতীয়ত রসকষহীন একটা পাথর, জীবনেও কোনো মেয়ে ওর সাথে সুখী হতে পারবে না, ওর মধ্যে প্রেমিক ভাবটা নেই। ”
আয়জা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। বাড়ির কেউ হেনা আপাকে বিয়ে করতে ভাইয়াকে চাপ দিয়েছে এমনও না। ভাইয়া নিজেই রাজী ছিল কারণ তার যুক্তি ছিল এই, হেনা আপা তাকে ছোট থেকে চেনে সেহেতু তার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে খুব সহজে যেটা বাইরের একটা মেয়ে কোনোদিনও পারবে না। কিন্তু হেনা আপা তার এই ভরসা, বিশ্বাসের মূল্য দেয়নি। বরঞ্চ তার পাগলামি, আবেগ সবকিছুকে মিথ্যে প্রমাণ করে বিয়ের সপ্তাহখানেক আগেই সে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে গেল। কিন্তু কপালে সুখ সয়নি। শ্বশুর শ্বাশুড়ি, ননদ ননাসের অত্যাচারে বেহাল দশা তার। পালিয়ে বিয়ে করায় কেউ নূন্যতম সম্মান দেয় না। স্বামীও গায়ে হাত তুলতে দুবার ভাবে না। এখন চার মাস হয়েছে বাপের বাড়িতে এসে উঠেছে, স্বামী একবার খোঁজও নেয়নি। মেঝ ফুপু এখন এই দুঃখে মরে যান।
” এটা তো পুরা রসগোল্লা। কি নাম রে ওর? ”
” শেখ তাশদীদ আইজান। ওর মা ডোডো ডাকে। এখন আমরাও ডাকি। ”
ডোডোকে আদর করে দিল হেনা। বলল,
” ওর মাকে তো দেখিনি। ”
আয়জা বলল, ” কাজ করছে। রান্নাঘরে চলো। ”
হেনা বলল, ” না থাক। এখানে এলে দেখবো। ”
” ঘরে বসে থাকবে? ”
” হ্যা, একেকজন একেক কথা বলছে। বাদ দে। ”
আয়জা ডোডোকে আদর করতে করতে বের হয়ে এল। আম্বিয়া বেগম তাকে চুপিসারে বললেন,
” তোর মেঝফু’র আক্কেলটা দেখেছিস? এমনিতেই চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। তারউপর মেয়ে একটা এনেছে। ওই মেয়ের মুখ দেখতে ইচ্ছে করেনা আমার। ”
আয়জা বলল, ” আহা এসব বলো না তো। ভাবিকে সরিয়ে রাখো ফুপুর সামনে থেকে। কখন কি বলে বসে। ”
” দেখছি। ”
তরতর করে হেঁটে রান্নাঘরে চলে গেলেন আম্বিয়া বেগম। তিথি মেহমানদারি করছে। যেন সবাই তার ঘরের মানুষ। কেউ কেউ খোঁচা মেরে তার বাপের বাড়ির কথাও জানতে চাইছে। কিছুদিন আগে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলো সেই কথাও জানতে চাইছে। আরও কতশত কথা! তিথি হাসিমুখে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। আম্বিয়া বেগমের গা জ্বালা করছে। বিরক্ত হয়ে নিজের বোনকে বললেন,
” এত কথা বলিস না তো। ওর বাচ্চাকে খাওয়ানোর সময়টুকু পাচ্ছে না সকাল থেকে। এই বউ তুই যা আমার নাতিটাকে খাইয়ে দিয়ে আয় আগে। আয়জার কোলে চেঁচাচ্ছিলো। ”
ডোডো হাতদুটো দিয়ে তার মাথার চুল টেনে ধরলো। এত শক্ত করে ধরলো ছাড়ার নাম নেই। তিথি কাছে গিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সে ছাড়লো না। আজলান তাকে বিছানায় ফেলে হাতদুটো শক্ত করে ধরে ধীরেধীরে ছাড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত চেপে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। ডোডো বিছানায় শুয়ে চুপ করে বাবার দিকে চেয়ে হাসতে লাগলো খিলখিলিয়ে। আজলান একটা বড়সড় রুমাল নিয়ে তার হাতদুটো বেঁধে ফেলে বলল,
” বেশি বাড় বেড়েছ তুমি।”
ডোডো হাত নাড়াতে না পেরে পা নাড়াতে লাগলো। আজলান তাকে ওভাবে রেখে কাবার্ড খুলে তার শার্ট বের করে গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল তিথির দিকে চোরা চোখে চেয়ে। সে বেরিয়ে যেতেই তিথি ছুটে এসে ডোডোর গালে চুমু দিতে দিতে বলল,
” কেমন লাগছে এবার? ”
ডোডো খুলে দিতে হাত বাড়িয়ে দিল।
তিথি গিঁট খুলতে যেতেই আজলান ঘরে ঢুকে খ্যাঁক করে উঠে বলল,
” খবরদার বলছি। ”
তিথি গিঁট খুলতেই থাকলো। আজলান চুপচাপ চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। সত্যি সত্যি খুলছে দেখে খপ করে তার হাত ধরে ওড়না টেনে দুহাত বেঁধে ফেললো। তিথি ধস্তাধস্তি করেনি বলে শক্ত করে বাঁধতে সুবিধা হয়েছে। তারপর বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
ডোডো অসহায় মুখ করে শুয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ পর আয়জা এসে দেখলো মা ছেলে দুজনেই ঘুম। সে নাকিসুরে কেঁদে বলল,
” আমার গায়ে হলুদের দিন মা ছেলে ঘুমোচ্ছে। এখন আমি..
তখুনি মা ছেলের হাত বাঁধা দেখে হাঁ করে চেয়ে রইলো সে। আজলান তার পেছন পেছন ঘরে ঢুকে বলল,
” ঘুমোক। ঘুম থেকে উঠে বাকি কাজ করবে। ”
আয়জা চুপচাপ বেরিয়ে গেল। আজলান প্রথমেই তিথির হাত খুলতে বসেছিলো। ওড়নার গিঁট খুলতে গেল আর ঠিক তখুনি ঘুমঘুম চোখে তিথির মনে হলো যেন ডোডোকে কেউ একজন তার বুক থেকে তুলে নিচ্ছে ধীরেধীরে। সে খপ করে আজলানের কলার চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। আজলান মুখ থুবড়ে পড়লো তার উপর।
ডোডো একটু একটু করে দাঁড়াতে শিখছে। দাঁড়াতে গিয়ে আবার পড়ে গেলে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থাকে আবার নিজে নিজে দাঁড়িয়ে পড়ে।
তাহেরা বেগম এই কয়েকদিন খেয়াল করলো মাকে পেয়ে সে পুরোদস্তুর ভালো ছেলেতে রূপান্তরিত হয়েছে। সারাক্ষণ আম্মা আম্মা বলে চেঁচাবে, তার মাকে উত্তরে জি জি বলতে হবে।
ব্যস সে খেলতে থাকবে।
এইটুকুনি বাচ্চা, অথচ মাকে সে আপাদমস্তক চিনে ফেলেছে। তার সাথে সাথে মাকেও কথা বলতে হয় এখন। নইলে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠবে। মা ছেলে এখন পুরো বাংলোটা মাতিয়ে রাখে। উনার বেশ ভালো লাগে। চলে যাবে ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
ডোডো এখন বাবার কোলে উঠে বসে আছে। বাবার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। বাবাকে সে অনেকগুলো দিন পর দেখছে। আয়জা আম্বিয়া বেগমকে বলল, ” আম্মা দেখো ভাইয়াকে কিভাবে দেখছে। ”
আম্বিয়া বেগম হাসলেন। আজলান ফোনে কথা বলছে ,ডোডো ফোনটা কেড়ে নেওয়ার পায়তারা করছে। বাবা তার সাথে কথা না বলে কেন ফোনে কথা বলবে?
রাতের খাবারের বন্দোবস্ত চলছে রান্নাঘরে। শায়লা একাহাতে রান্নাঘর সামলাতে পারলেও তিথি আসার পর থেকে তার কাঁধ থেকে কাজের ভার হালকা হয়ে গেছে। বরং সে এ কয়েকটা দিন ভীষণ আনন্দে কাটিয়েছে বাংলোয়। একমাসের বেতন নিয়ে সে চলে যাবে মাস শেষে। স্যারেরাও মনে হয় তাদের বাড়ি ফিরে যাবে।
যারিফ হসপিটাল থেকে আনা যাবতীয় সব জিনিসপত্র গুলো গাড়ি থেকে নামিয়ে বাংলোয় নিয়ে এল। আজলান ফোন রেখে বলল,
” হয়েছে, ওখানে রাখো। বাকিটা আয়জা সামলে নেবে।”
যারিফ বলল, ” আরেকটা ব্যাগ আছে। ওটা নিয়ে আসছি। ”
যারিফ বেরিয়ে গেল। তাকে ইস্যু করে এত কাহিনি ঘটে গেছে সে এইসব ব্যাপারে জানে না। আয়জা তাকে কিছু বলেনি। সেদিন ঘটনাস্থল হতে স্যারের এক সহকর্মী প্রথম ফোনটা তাকে করেছিলো। হয়ত নাম্বারটা স্যারের কললিস্টে শুরুতেই ছিল নয়ত স্যার বলেছে। আর তারপর যারিফ একমুহূর্তও অপেক্ষা করেনি। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল হসপিটালে ভর্তি করানোর আট দিনের মধ্যে আজলানের শরীরের অবস্থার একটু উন্নতি ঘটলে যারিফ তাকে সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করায় এক্সট্রা কেয়ারের জন্য। এই যাত্রায় স্যার বেঁচে গিয়েছে তবে লাংস এখনো দুর্বল। প্রপার ট্রিটমেন্ট নিতে হবে। আর রেস্টে থাকতে হবে আরও দেড় দুইমাস। কিন্তু সেটা আপাতত হয়ে উঠবে কিনা স্যারই জানেন। আজ রাতটা বাংলোয় কাটিয়ে দিয়ে কাল সকাল সকাল বাড়ি ফিরে যাবে সে। তার দায়িত্ব শেষ।
বাবা ছেলের মান অভিমান ভেঙেছে অনেক আগে। একমাত্র ছেলেকে জানপ্রাণ দিয়ে হলেও সুস্থ করার লড়াইয়ে নেমেছিলেন আফতাব শেখ। ছেলের এমন দুর্দশার কথা শুনে সকল দ্বন্দ ভুলে উদভ্রান্তের মতো তিনি ছুটে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। বেডে শায়িত মরণাপন্ন ছেলের মুখ দেখে দ্বিতীয়বার ভাবার ফুরসত পাননি যে, এই ছেলের সাথে বহুদিন ধরে উনার দ্বন্দ চলছিলো। মৃত্যুভয় কত সহজ করে দেয় সবকিছু।
সবাইকে চা খেতে দেখে ডোডো কাড়াকাড়ি করছে। আজলানের চা, সিগারেট এসব খাওয়া বারণ। যদিও সে জীবনেও সিগারেট নামক জিনিসটা ছুঁয়েও দেখেনি কিন্তু আফতাব শেখকে সিগারেট খোর বলা যায়।
আম্বিয়া বেগম পইপই করে বারণ করে দিয়েছেন সিগারেটের ধোঁয়া, গন্ধ কোনোটাই যেন উনার ছেলের নাকে না যায়।
আয়জা ডোডোকে চা খাওয়ানোর জন্য কোলে নিয়ে নিল।
কি তৃপ্তি নিয়ে চা খাচ্ছে সে। আজলানের মনেই ছিল না সে এভাবে চা খেতে পছন্দ করে। আয়জা চামচে ফুঁ দিচ্ছে, খাওয়ার আগে সেও চামচে ওভাবে ফুঁ দিচ্ছে। আয়জা হেসে খুন। পুরো বাঁদর একটা।
খোশগল্পের মধ্যে ডোডোর অসুস্থতার কথা উঠলো। তাকে হসপিটালে ভর্তি করাতে হয়েছে শুনে আজলান খানিকটা ক্ষেপাটে স্বরে বলল,
” এত ঠান্ডা লেগে গেল কি করে? ”
তাহেরা বেগম বললেন,
” বাচ্চাদের ঠান্ডা লাগা স্বাভাবিক। মায়েদের ভীষণ সতর্ক থাকতে হয়। সেখানে ওর মা ছিল না। ঠান্ডা লেগে যাওয়া অসম্ভব কিছু না। ”
আফতাব শেখ কথা বলে উঠলেন এবার। বললেন,
” জন্মের পর থেকে ওর শরীর শুকোয়নি তেমন। এখানে এসে শুকিয়েছে। তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” যা হয়েছে তা নিয়ে কথা বলে আর লাভ আছে? তুই একটু ঘুমাবি আব্বা? ”
আজলান বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল, ” না। তবে কাজ আছে। ”
আম্বিয়া বেগম তীব্র প্রতিবাদ করে বলল,
” বউ ঘরদোর সব সাফ করছে আজ। খবরদার কোনোকিছুতে হাত দিবি না আজলান। সবসময় অবাধ্য হোস না। ”
আজলাম হাঁ করে চেয়ে রইলো। মা বুঝে গেল কি করে? আয়জা বলল,
” হ্যা ভাইয়া। আমি আর ভাবি মিলে সব ঝেড়েমুছে ধুয়ে পরিষ্কার করে রেখেছি। ”
আফতাব শেখ বললেন,
” তোমার শরীরের উপর যাতে প্রেশার না পড়ে। সবসময় নিজের মর্জিমাফিক চলা যায় না। ”
আজলান ঘরে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়াতে গিয়ে আবার থেমে গিয়ে যারিফকে বলল,
” আমি না বলা অব্দি কোথাও যাবে না। ”
যারিফ মাথা নাড়লো। আয়জা তার কোলে ডোডোকে দিয়ে বলল,
” ফুপী কাজে যাই। কেমন? ”
ডোডো আঙুল তুলে বলল,
” আমমাহ। ”
আয়জা তার নাক টিপে দিয়ে বলল,
” আপনার আম্মা কাজ করছে। যাই দেখে আসি।”
যারিফ বলল, “আমাকে কাল চলে যেতে হবে। স্যারকে একটু বুঝিয়ে বলবে?”
আয়জা মাথা নেড়ে বলল,
” আম্মাকে বলব। ”
আজলান ঘরে গিয়ে বিছানায় বসলো। ঘরটা পরিপাটি করে রাখা হয়েছে। ডোডোর দোলনা, খেলনা, বেবি ওয়াকার, কাপড়চোপড়, ঔষধের বক্স ছাড়া আর কিছুই ঘরে দেখা যাচ্ছে না।
এই বাংলোর পেছনটা জঙ্গলের মতো। ঝিঁঝি পোকার ভারী ডাক কান ঝালাপালা করে দেয়ার মতো, এখন কুনোব্যাঙগুলোও যোগ দিয়েছে। জানালাটা বন্ধ। মশার কারণে বোধহয় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সে উঠে জানালাটা খুলে দিল। দমকা হাওয়া ঢুকে পড়লো ঘরে। আজলান ফোঁস করে একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
তারমধ্যে ঘরে কেউ একজন এমনভাবে এল যেন মেঝেতে পায়ের ধূলো না পড়ে, এমনভাবে গেল যেন পায়ের শব্দ না হয়। ঠিক এভাবে হাসপাতালের কেবিনেও এমন একজোড়া পা আসা যাওয়া করতো যা আজলান শেখের জানার কথা নয়।
_______
রাতের খাবারের বেশিরভাগই ঝাল কম দিয়ে রান্না করা হয়েছে। গত চৌদ্দ দিন বাংলোতে যেভাবে রান্না করেছে ঠিক সেই নিয়মে।
চিংড়ি মাছটা বেশ ঝাল করে রেঁধেছে তিথি। কারণ আজলান চিংড়ি মাছ খায় না। তারমতে চিংড়ি মাছ নয়, পোকা। জলজ অমেরুদণ্ডী প্রাণী। তাছাড়া চিংড়িতে হাজার রকমের এলার্জি। সে ঘৃণা করে চিংড়িকে। তাই তিথির মনে হলো চিংড়িটা সে নিজের মতো রাঁধতে পারবে। বাকি সব রান্না শায়লা রেঁধেছে। তিথি এটা ওটা বাড়িয়ে দিয়েছে।
আজলান তেল মশলা বেশি খেতে পছন্দ করে না। আগেও কম খেত। এখন আরও কম। অপরদিকে তিথির পছন্দ তেল চটচটে মাছ মাংস। মাছ মাংসের উপর তেল না ভাসলে, লাল মরিচ আর পেঁয়াজ মশলায় মাখা ঝোলঝাল না হলে খাবার তার মুখে রোচে না।
আম্বিয়া বেগমও আগে এমন খেতেন। ছেলের জন্য পছন্দ বদলে ফেলেছিলেন। এখন তিথি রান্না করলে তা বেশ আরামে খান। যদিও তিথির রান্না খুব কম খাওয়া হয়েছে।
কিন্তু গত চৌদ্দ দিন তিথিই রেঁধেছে তাও শায়লার কথামতো আর হাসপাতালে খাবার নিয়ে গিয়েছে। বেশ ঘন করে করে ডাল, পেঁপে ভাজি, অথবা মসুর ডাল আর লাউ তরকারি, পটল কিংবা বরবটি ভাঁজা, ডিম এসব। মাছ মাংস একদম ছুঁয়েও দেখেনি আজলান। মাংস খাওয়া বারণ ছিলো।
খাওয়ার ফাঁকে আফতাব শেখ আর জাফর আহমেদ চিংড়ি রান্নার বেশ প্রশংসা করলেন। তিথি আম্বিয়া বেগম আর তাহেরা বেগমকে মাছ মাংস তুলে দিচ্ছিলো। তখনি জাফর আহমেদ বললেন,
” শায়লা আজ সব রান্না দারুণ মজা হয়েছে। চিংড়িটা দশে এগারো। আজলান শেখ আপনি এটা মিস করে গিয়েছেন। একবার খেয়ে দেখুন। দেব? আরেহ কিচ্ছু হবে না। একবার খেয়ে দেখুন। চিংড়ি মাছ আবার মিস দেয় নাকি কেউ? ”
তিথির ইশারায় শায়লা বাটি সরিয়ে নিয়ে বলল,
“এটা ম্যাডাম রেঁধেছেন স্যার। আমি নই।”
বাটিতে শেষ কয়েকটা চিংড়ি ছিল। সেগুলো তাহেরা বেগমের পাতে দিয়ে বাটিটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল তিথি। আয়জা চুপচাপ খেতে খেতে মায়ের চোখ বরাবর তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিল। আজলান খেতে খেতে যারিফকে বলল,
” তুমি কাল ওদেরকে নিয়ে চলে যাচ্ছ। ”
আম্বিয়া বেগম অবাককন্ঠে বললেন,
” তুই যাবি না? ”
” যাব। এখন না। কাজ আছে। আমাকে হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে একটু। ”
জাফর আহমেদ বললেন,
” আমি সামলে নেব। তুমি আগে বাড়ি যাও। যদি না যাও তাহলে সবাই এখানে থাকুক। ”
আজলান আর কিছু বললো না। তিথি ডোডোকে নিয়ে ফিরে এল। বাসনের এককোণায় এক চামচ ভাত নিয়ে চিংড়ির ঝোল নিয়ে মেখে ডোডোকে হাঁটতে হাঁটতে খাইয়ে দিতে লাগলো। ডোডো ঝাল খেতে ঠোঁট দুটো লম্বা করে উঃ উঃ বললো। তিথি গালে চেপে চুমু খেয়ে বলল, ” মজা? ”
ডোডো মাথা ঝাঁকালো। জাফর আহমেদ বললো,
” ছেলেও মাথা ঝাঁকিয়ে মায়ের প্রশংসা করছে।”
আম্বিয়া বেগম বললেন,”বেশি ঝাল দিস না বউ। ওর পেট খারাপ করবে। ”
আয়জা বলল, ” পাতলা খাবার খেলে ওর পেট খারাপ হয় আম্মা। ঝাল খেলে ঠিকই থাকে। ”
ডোডো তিথির কোল থেকে খানিকটা নীচে ঝুঁকে গলা কাত করে চুপচাপ খেতে থাকা আজলানকে ডেকে বলল, ” এ-পাপ্পাহ। ”
আজলান সবেমাত্র পানির গ্লাস ধরেছিলো মুখের কাছে। ডেডোর এমন ডাক শুনে তার কাশি উঠে গেল তখুনি। আম্বিয়া বেগম চেয়ার ছেড়ে ছেলের কাছে ছুটে এসে বুকে পিঠে মাথায় মালিশ করে দিতে দিতে আয়জাকে বলল,
” পানি দে। এখন কি হবে রে?”
আজলান কাশতে কাশতে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার খাওয়া এমনিতেই শেষ হয়ে এসেছিলো। দুর্দান্ত একটি কাশির ধমক ফুসফুস বেয়ে উপরে উঠে আসছে ধীরেধীরে। সে দ্রুতবেগে হেঁটে ঘরে চলে গেল।
ঘরে এসে নিজের ঔষধপত্র খুঁজতে গিয়ে একেরপর এক সব ড্রয়ার ধুপধাপ টেনে খুললো। বিছানার বালিশ, চাদর তুলে ফেললো, টেবিলের ড্রয়ারটা চেক করলো। ঔষধের বক্সটা কোথায় রেখেছে মাথায় আসছে না। কোথায়? কাশির ধমকটা বুকে এসে আটকে গেছে। উতলে উতলে উঠছে কাশির বেগ। শ্বাস ছাড়তে কষ্ট হলো। কাশির চোটে চোখে পানি চলে এল। গলার দুইপাশের শিরা ক্রমাগত উঠানামা করতে লাগলো। লাংসে বুলেটের আঘাত লাগায় তা এখনো অনেকটা দুর্বল। ডাক্তার নিয়মিত নেবুলাইজার অথবা ইনহেলার ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে। কিছুতেই বুকে চাপ সৃষ্টি করা যাবে না। ইনহেলারটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না সে। কাউকে ডাকার মতো অবস্থায়ও নেই। টেবিলের উপর হতে ঝপাৎ করে একগাদা ঔষধ পড়ে গেল। হাঁটুভেঙে বসে ঔষধগুলো হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে গলা চেপে ধরলো সে। চোখদুটো প্রায় ঝাপসা হয়ে আসছে।
ডোডোকে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিলো তিথি কিন্তু সে ঘুমাবে না এখন। তিথি তার মাথা বুকে রেখে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে আর সে মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তিথি বলল,
” ঘুম কবে আসবে? আমার অনেক কাজ ডোডো।”
ডোডো হা করে চেয়ে রইলো। তিথি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে দুগালে আদর করতে করতে ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। ঘরের ভেতর সমস্ত জিনিস এলোমেলো পড়ে থাকতে দেখে কৌতূহলবশত ঘরে পা রাখলো। তখুনি আজলানকে পাগলের মতো ঔষধ হাতড়াতে দেখে ডোডোকে মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে ইনহেলারটা খুঁজে আজলানের ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিল। দুঠোঁটে ইনহেলার চেপে ধরে শ্বাসকষ্টকে দমিয়ে রাখার চেষ্টায় রত হলো আজলান। ডোডো হামাগুড়ি দিয়ে আজলানের সামনে এসে বসে বাবার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তিথি তাকে বুকে টেনে নিয়ে আজলানের দিকে চেয়ে রইলো। আজলান একটু স্বাভাবিক হয়ে আসতেই তিথি ডোডোকে নিয়ে উঠে যাওয়ার সময় আজলান বলল,
” ডোডো সামনে বসো। ”
তিথি ডোডোকে তার সামনে বসিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। পায়ে জোর দিয়ে দাঁড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো আজলান। পাশে ডোডোকেও শুইয়ে দিল। ধীরেধীরে ধীরেধীরে শ্বাসপ্রক্রিয়া চলছে তার। ডোডো তার হাতে থাকা ইনহেলারটা কেড়ে নেয়ার জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করলো তার গায়ের উপর উঠে। আজলান বলল,
” মহামুশকিল তো। ”
তিথি এসে একটানে কোলে নিয়ে নিল ডোডোকে। হাতদুটো চেপে ধরে গালে আলতো করে চড় বসিয়ে বলল, ” ঘুমা। খুব মারবো ডোডো। ”
মা ছেলের মধ্যে কথা শেষ হতে পারেনি তার আগেই আম্বিয়া বেগম কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন। আজলান রাগত স্বরে বলল,
” তুমি এভাবে কাঁদলে আমি আর ফোন দেব না মা। ”
আম্বিয়া বেগম ক্ষীণ স্বরে বললেন,
” আরেক মায়ের কোল থেকে বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে তুই আমাকে মা ডাকিস না। পাঁচদিন তোর গলা না শুনে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। সেখানে ওই দুধের বাচ্চাটাকে না দেখে ওর মায়ের কেমন লাগছে বুঝতে পারছিস তুই? কতটা পাষাণ রে তুই। ”
আজলান বলল, “কেঁদোনা। আমি দেখছি কি করা যায়। আগামী দুসপ্তাহ কাজের মধ্যে ডুবে থাকবো তাই সুযোগ হবে না। তারপর দেখি তোমাকে নিয়ে আসতে পারি কিনা। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” ওর মা কতবার ফোন দিয়েছে ডোডোর খবর জানার জন্য। তুই ওর সাথে কথা না বল কিন্তু বাচ্চাটার গলা তো শুনতে দিবি। এ কেমন রাগ তোর? ”
আজলান বলল,
” আমার কাজ শেষ হোক। ডোডোকে এসে তুমি নিয়ে যেও। এখানে আপাতত লোক রেখেছি। ওরা দেখভাল করছে ওর। ”
” আর ওর মা? ওর কাছে ওর বাচ্চাকে দিবি না?”
আজলান কোনো কথা বললো না তিথির ব্যাপারে শুধু জানার ছিল ও ফোন দিয়েছে কি দেয়নি। আম্বিয়া বেগম আফতাব সাহেবের অসুস্থতার কথাও চেপে গিয়েছেন। ছেলের উপর উনার অনেক রাগ কিন্তু তা দেখালেন না। ডোডোর কাছে পৌঁছানোর জন্য উনাকে শান্ত হয়ে কথা বলতে হবে। আজলান ফোন রাখার সাথে সাথে আফতাব শেখ জানতে চাইলেন,
” আজলান শেখ কেন ফোন দিয়েছে? ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
“নিজের ছেলেকে এভাবে সম্বোধন করছো কেন? ”
” ছেলে আমাকে কিভাবে সম্বোধন করে দেখেছ? ”
” এসব তুমি শিখিয়েছ ওকে। ”
” তোমার ছেলে চায় টা কি বলোতো। কি চায় সে? বাচ্চাটাকে তার মায়ের কাছ থেকে দূরে রেখে কি প্রমাণ করতে চাইছে? ”
আম্বিয়া বেগম রেগেমেগে বললেন,
” সব তোমার জন্য হয়েছে। তুমি সব নষ্টের মূল। তোমার ছেলে কেমন তুমি জানতে না? ওরকম মেয়ে পছন্দ করে এনেছ কেন? ”
” এর চাইতে ভালো মেয়ে তো চোখের সামনেই ছিল। তোমার ছেলে তাকে পাত্তা দেইনি। তাই সে নিজের মতো করে কাউকে পেয়ে ভেগেছে। ডোডোর মাও এমন ভেগে গেলে ভালো হতো। ”
সরোষে চেঁচিয়ে উঠলেন আম্বিয়া বেগম,
” মুখে অলক্ষুণে কথা এনো না। তোমার বোনের মেয়ে তলে তলে ব্যাটামানুষ হাত করে রেখেছিলো। সেই মেয়ের সাথে তুমি আর তোমার বোন আমার ছেলের বিয়ে ঠিক করলে কোন সাহসে? ”
আফতাব সাহেব নির্লিপ্ত গলায় বলল,
” তোমার ছেলেকে হুর-পরী এনে দিলেও সে দোষ খুঁজে বের করতো। হেনারও দোষ খুঁজে বের করেছিলো সে। তাই হেনা বুঝে গিয়েছিলো ওর সাথে বাকি জীবন কাটানো সম্ভব না। তাই পালিয়ে গিয়েছে। এখন বৌমার হাত পা তো বাঁধা তাই তাকে বাগে পেয়ে তোমার ছেলে তাকে শাস্তি দিচ্ছে। ”
” তোমার বোন, তোমার ভাগ্নি সবকটা বেঈমান। ওদের সাথে ডোডোর মাকে মিলাবে না। তুমি আর তোমার ছেলের কারণে ওকে ঘর ছাড়তে হয়েছে। তোমার ছেলে ওকে ছেড়ে দিলে ও যাবেটা কোথায়? খবরদার বলছি এসব ভুলভাল কথা কারো সামনে বলবে না। ”
আফতাব শেখ বললেন,
” তুমি কি তোমার ছেলেকে ডোডোর মতো দুধের শিশু ভেবেছ নাকি? ওর মাথায় কি ঘোরে তা তুমি বুঝতেও পারবে না। ও বৌমাকে জব্দ করতে পারলেই খুশি। ওই ছেলেকে আমি চিনি। আমার রক্ত তো। ও মরে যাবে কিন্তু বৌমার কাছে মাথা নত করবে না। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” বউ কি ও আনছে? বউ আমরা আনছি। ওর বউ আমি রাখবো। ও রাখার না রাখার কে? আমি ওকে আজকে গিয়ে নিয়ে আসবো। ”
” তোমার কি মনে হয় ডোডোর মা তোমার সাথে আসবে? যার সাথে ঘর করবে সেই ওকে পাত্তা দিল না আর তোমার কথায় চলে আসবে? ”
” কি বলতে চাইছো তুমি? ”
” আমি কিছু বলতে চাইছিনা। তোমার ছেলে যেটা করতে চাইছে সেটা আন্দাজ করে বলছি ও বৌমার সাথে সংসার করতে ইচ্ছুক নয়। এইসব ভং ওর অজুহাত মাত্র। ”
আম্বিয়া বেগম টলমলে চোখে চেয়ে রইলেন।
_______
দিন বিশ একুশ দিনের মতো গড়িয়ে গেছে।
ঝড়বাদলের দিন। সকাল বিকেল রাত তিনবেলা নিয়ম করে বৃষ্টি পড়ছে। নিস্তার নেই। ভীষণ আলসে আর বিষণ্ণ সময় কাটছিলো সবার।
মাগরিবের নামাজ পড়ছিলেন মালেকা বেগম। তিথি নামাজ পড়ে চা বসিয়েছে চুলায়। মফিজ সাহেব নামাজ পড়ে এসে চা খান। চায়ের পানি টগবগ করে ফুটে উঠামাত্রই তুষার এসে বলল,
” আপা কে যেন এসেছে। তোকে খুঁজছে। ”
তিথি সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ” কে? ”
তুষা কি যেন বললো। তিথি শুনতে পেল না ঠিকঠাক। কিন্তু তুষারের উত্তরের অপেক্ষা করেনি সে। বারান্দার চেয়ারে যারিফকে বসে থাকতে দেখে অবাকচোখে চেয়ে বলল,
” আপনি? ”
যারিফ তাকে দেখামাত্রই দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল, ” ভাবি আপনি একটু ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিন। আমরা বান্দরবান যাব।”
যারিফ বলল, ” জি। আমি বাইরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। ”
তিথি ব্যাকুল হয়ে বলল, ” আমার ডোডো কেমন আছে? ”
যারিফ বলল,
” সব ঠিক আছে। আপনি রেডি হয়ে নিন। ”
তিথি আচ্ছা বলে ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে যেতেই থমকে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে বলল,
” আপনার স্যার নিশ্চয়ই নিয়ে যেতে বলেনি? ”
যারিফ বলল,
” স্যার আমার সাথে কথা বলেনি। উনি কথার বলার মতো সিচুয়েশনে নেই। আমার মনে হলো এই মুহূর্তে আপনাকে দরকার। তাই এসেছি। ”
তিথি ঘরে চলে গেল। ছোট একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিল। কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না সে। হাতটা ভীষণ রকম কাঁপছে। কতদিন পর ডোডোকে দেখবে সে।
দুটো শাড়ি, গামছা, কিছু জরুরি জিনিসপত্র আর কিছু টাকা নিয়ে নিল সে। বাকি টাকাগুলো মায়ের হাতে দিল। বলল,
” ডোডোর কাছে যাচ্ছি আম্মা। আমি ফোন দেব তোমাকে। ”
মালেকা বেগম চুপ করে রইলেন। বেরোনোর সময় মফিজ সাহেব বললেন,
” মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করিস মা। তোর এখন একটা বাচ্চা আছে। এখন নিজের কথা ভাবলে চলবে না। ওর কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিবি।”
তিথি বাবাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইলো। তারপর বেরিয়ে এল যারিফের সাথে।
পুরো শহরটা তখন নির্জীব। যানবাহনের চলাচল না থাকলে আর কোনো শব্দই থাকতো না কোনোখানে। সড়ক বাতির আবছা আলোয় পিচঢালা রাস্তা চকচক করছে। কানের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শোঁশোঁ বাতাসের শব্দ।
ডোডোর মুখটা কয়েকবার কল্পনা করলো সে। পেটে মুখ গুঁজে দিলে খিলখিল করে হাসিতে ফেটে পড়তো ডোডো। হাসিটাতে কি মায়া! এত মায়া কভু দেখেনি তিথি। তার চোখে জল নামলো। সাথে সাথে মুছে নিল সে। একবার ডোডোকে পেলে জাপ্টে জড়িয়ে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলবে সে। আর একমুহূর্তের জন্যও ছাড়বে না।
দুনিয়া উল্টে যাক কিন্তু ডোডোকে আর ছাড়বে না সে।
পথিমধ্যে একটা দোকান দেখতে পেয়ে নেমে গেল সে। ফিরে এল কিছু চিপস, আর মিনি বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে। ডোডো এখন খেতে শিখেছে। মাকে দেখামাত্রই যদি মুখের দিকে চেয়ে থাকে? মা খালি হাতে এসেছে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে?
যারিফ তার উত্তেজনা বুঝতে পারলো। মায়েরা এমনই হয়। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে গাড়িটা একটা সেন্ট্রাল হসপিটালের পার্কিং প্লেসে গিয়ে থামলো। তিথি অবাককন্ঠে বলল, ” হসপিটালে কেন? আপনার স্যারের কিছু হয়েছে? ”
যারিফ বলল,
” তিন তলায় যেতে হবে। চলুন। ”
তিথি ওর পিছু পিছু কম্পিত পায়ে হেঁটে গেল।
আয়জা আর আম্বিয়া বেগম হসপিটালের লাউঞ্জে বসে আছেন। আয়জার পায়ের কাছে বড় একটা ব্যাগ। কোলে ছোট্ট একটা কাপড়ের ব্যাগ। ব্যাগটাতে ডোডোর ছোট ছোট কাঁথা আর প্যাম্পাস রাখতো সে। তাকে দেখে আম্বিয়া বেগম হাঁ করে চেয়ে রইলেন। তিথি ছুটে গিয়ে বলল,
” কার কি হয়েছে মা? আমার ডোডো? কোথায় ও?”
কেউ কিছু বললো না।
ভয়ের চোটে আম্বিয়া বেগমকে একটা সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁদে উঠলো তিথি। আম্বিয়া বেগমও এতক্ষণ পর ফুঁপিয়ে উঠলেন। তিথি স্তব্ধ হয়ে গেল। আয়জাকে বলল,
” ডোডো কোথায়? আমার ডোডো। ”
আয়জা আঙুল দিয়ে কেবিনটা দেখিয়ে দিল। তিথি দৌড়ে গিয়ে জানালার কাচ বরাবর দাঁড়াতেই কেবিনের মধ্যে একটা ছোট্ট বাচ্চাকে দেখতে পেল। নিজের ছেলেকে নিজে চিনতে ভুল করলো তিথি। হাতে ক্যানোলা, নাকে অক্সিজেন। শুকিয়ে এতটুকুনি হয়ে গেছে হৃষ্টপুষ্ট শরীরটা। গায়ের রঙটা পর্যন্ত ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তিথি চেয়েই রইলো। কাঁদতে ভুলে গেছে সে। শুধু চোখ ফেটে উত্তপ্ত জল গড়িয়ে পড়লো।
শ্বাসকষ্টের জন্য কিছু খেতে পারছিলো না ডোডো। হা করে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে কাঁদছিলো ভীষণ। নিউমোনিয়ার লক্ষ্মণ বুঝে তিনদিন আগে ডোডোকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন জাফর আহমেদ। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছিলো প্রায়। তিথি সবটা শুনে জড়পদার্থের ন্যায় বসেছিলো অনেকক্ষণ। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে ডাক্তার জানিয়েছে বুকের ভেতর শুকনো কফ জমে গিয়েছিলো।
তিথি করিডোরের মেটাল ফ্রেমের সোফায় বসে ডোডোর কাছে যাওয়ার অপেক্ষায় বসেছিলো। কেবিনে সিস্টার আর ডাক্তারদের আনাগোনা আছেই।
কেবিনে যাওয়ার অনুমতি পেতেই আর দেরী করেনি। মা এসেছে শুনে ডাক্তার একনজর তাকে দেখে নিল। তখন অক্সিজেন মাস্কটা খুলে ফেলা হয়েছে। ডোডো নড়েচড়ে উঠে আবার ঘুমে তলিয়ে গেল। ডাক্তার তাকে ক্যানোলা দিয়ে ইনজেকশন পুশ করে তিথির কোলে তুলে দিল। তিথি দেখলো পনের মাসের বাচ্চাটা কেমন ছয়মাসের বাচ্চার মতো হয়ে গেছে। এতক্ষণ চেপে রাখা কান্নাটা এবার আর কোনো বাঁধ মানলো না। ছেলের গালে আদর করতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে বলল, ” আমাকে এতবড় শাস্তি দিস না ডোডো। ”
তার কান্নার ফাঁকে ডোডো চোখ মেলে তাকিয়েছে। তিথি বড়বড় চোখ করে বলল,
” আব্বা চোখ খুলেছে! মা দেখো ডোডো চোখ খুলেছে।”
আম্বিয়া বেগম এসে বসলেন তার সামনে। ডোডো মায়ের মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো। তিথি সশব্দে কেঁদে বলল,
” মাকে শাস্তি দিচ্ছিস ডোডো? ”
ডোডোর ঠোঁটদুটো নড়ে উঠলো। তিথি বুঝলো। সে আম্মা ডাকতে চাইছে। সে মুখে অজস্র আদর দিয়ে নিজের গালের সাথে ছোট্ট গালটা লাগিয়ে রেখে বলল,
” তোকে ছেড়ে আর কোত্থাও যাবো না ডোডো। একবার আম্মা ডাক। ”
কাঁদতে গিয়ে গলাও ভেঙে গেছে ছেলেটার।
অনেকক্ষণ পর সুচিক্কণ ভাঙা স্বরটা কানে এল তিথির। মা ডাক শুনে তিথি পাগলের মতো কাঁদলো। আম্বিয়া বেগম সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
” আর কাঁদিস না। একটা কথা সারাজীবন মনে রাখবি, মায়ের মতো করে কেউ ভালো রাখতে পারে না বাচ্চাকে। ”
তিথি ডোডোর গালে গাল ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে রইলো।
সারারাত মা ছেলে জেগে ছিলো। ডোডোর একদৃষ্টে চেয়ে থাকা দেখে তিথি মনে মনে ভাবছিলো হয়ত সে ভাবছিলো, এই মা এতদিন কোথায় ছিল? ভোরবেলায় মা ছেলে দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রায় সকাল দশটার দিকে তিথির ঘুম ভেঙেছে। ডোডো তখনো তার বুকের উপর নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছে। যেন কতরাত সে এভাবে ঘুমাতে পারেনি।
আফতাব শেখ এসেছেন তখন। খাবার দাবার এনেছেন। ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ করার পর ডাক্তার জানিয়েছেন আজ রাতেই ডোডোকে রিলিজ দেয়া হবে।
তিথি কেবিন থেকে বের হয়নি। দু-পিস পাউরুটি খেয়েছে জেলি দিয়ে।
ডাক্তার এসে শেষ ইনজেকশনটা পুশ করলো। ঔষধ খাওয়ানোর সময় আর ইনজেকশন পুশ করার কেবিন ফাটিয়ে কেঁদেছে ডোডো। আম্বিয়া বেগম বললেন, ডাক্তার দেখামাত্রই সে কান্না শুরু করে। কান্নার এক পর্যায়ে তিথিকে জড়িয়ে “আম মাম মা” বলে ডেকে চুপ করে গেল। তিথি তার গালে আদর করতে করতে বলল,
” আমার আব্বা সুস্থ হয়ে গেছে। আর মারবে না ওরা। আমরা এবার বাড়ি যাবো। ”
ডোডো তার শাড়িটা ধরে রাখলো শক্ত করে। কাঁধে মাথাটা ফেলে রাখলো। তিথি তাকে কোলে নিয়ে হাঁটার সময় খেয়াল করলো সে একদম হালকা হয়ে গিয়েছে। অথচ আগে বেশিক্ষণ কোলে রাখলে কোমর ব্যাথা করতো।
__________
আজলান শেখের কথা তিথি জিজ্ঞেস করবে ভেবেছে কিন্তু করেনি। কারণ সে নিজেই অপেক্ষায় ছিল কবে আজলান শেখ আসবে। কিন্তু এল না। হয়ত নিজের পরাজিত মুখখানা তিথিকে দেখাতে চায়নি কিংবা নিজের ছেলের অসুস্থতার দায়ে তিথিকে দায় করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে যাবে তাই সামনে আসেনি। তিথির এতকিছু ভাবতে ইচ্ছে করলো না। তার ছেলে তার বুকে আছে এটাই এখন তার সবচাইতে বড় পাওয়া।
আয়জা, আম্বিয়া বেগম এমনকি আফতাব শেখও কিছু বলেনি এই ব্যাপারে। তিথি খেয়াল করেছে ঔষধ আনা, খাবারদাবার আনা নেওয়া, সব ছোটাছুটি যারিফই করছে। তার কাছে নিশ্চয়ই তার স্যারের খোঁজ থাকতে পারে। কিন্তু সে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না। ডিসচার্জ পাওয়ার পর ডোডোকে ভালো করে কাঁথা দিয়ে মুড়িয়ে নিয়ে শিশু ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিথি আম্বিয়া বেগমকে ডেকে বললো,
” আয়জা কোথায়? তোমরা যাবে না? ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” তোর ছেলে সুস্থ হয়েছে। আমার ছেলে নয়। ”
তিথি ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো। আফতাব শেখ এসে বললেন,
” বৌমা তোমাকে বাংলোয় যেতে হবে। আমরা বাড়ি যেতে পারছিনা আপাতত। যারিফ তোমাকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছে ওটা ডোডোর বাপের স্যারের বাংলো। ওখানে উনার স্ত্রী আর একজন সিটার আছেন। রান্নাবান্না তোমাকে করতে হবে না। তুমি চলে যাও। ”
তিথি মাথা নাড়লো। যারিফ ব্যাগপত্র নিয়ে এসে বলল,
” ভাবি চলুন। ”
তিথি যেতে যেতে আরও একবার ফিরে তাকালো। আম্বিয়া বেগমের চোখে জল থৈথৈ করছে। তিথি যেতে যেতে যারিফকে জিজ্ঞেস করলো, ” কি হয়েছে আপনার স্যারের? ”
যারিফ একটু চমকে যেতেই তিথি বলল, ” আমি বুঝতে পেরেছি কিছু একটা হয়েছে। ”
যারিফ সংকোচ ঝেড়ে তাকে জানালো, পনের দিন আগে হাসানুজ্জামান নামের এক অবৈধ অস্ত্র পাচারকারী বিদেশী পিস্তল নিয়ে নাশকতার উদ্দেশ্যে টেলাপাড়া এলাকায় অবস্থান নিয়েছে বলে র্যাবের কাছে সংবাদ আসে। ওই সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-7 পূর্বাচল ক্যাম্পের একটি দল অভিযান চালিয়ে পিস্তল সহ হাসানুজ্জামানকে আটক করে। আটকের খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে সেই দলের এক সদস্য আড়াল হতে গুলি ছুঁড়ে। আর সেখানেই..
তিথির কন্ঠস্বরে কাঁপুনি।
” সেখানে?..
” স্যারের ফুসফুসে বুলেটের আঘাত লেগেছে। ”
তিথি আটকে রাখা দমটা সবেগে ছেড়ে বলল, ” ওহহ। ”
ডোডোকে যারিফের কোলে দিয়ে দ্বিতীয় তলার একটা সাদা কাচের কেবিনের ভেতর সিডেটিভে আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে থাকা আজলান শেখকে দেখে তিথির অন্তরআত্মা কেঁপে উঠেছিলো। দাপুটে যার চলনবলন, আর ধারালো যার কথা। তাকে এমন পরাজিত সৈনিকের মতো পড়ে থাকতে তিথির আপনমনে বলল, ” তুমি আমাকে তোমার বিরোধীদল ভাবলেও আমি তোমাকে সবসময় বিজয়ীর বেশে দেখতে চেয়েছি। এভাবে নয়। ”
তার ঠিক তের কি চৌদ্দ দিনের মাথায় আজলান শেখের গাড়ি এসে থামলো বাংলোর সামনে। ডোডো তখন দোলনায় চড়ছে আর হাসছে। গাড়িতে বসে একদৃষ্টে তার বাবা তার দিকে চেয়ে রইলো। বাবা এখনো জানতে পারেনি তার অনুপস্থিতিতে ছেলেকেও হাসপাতালে ঘুরে আসতে হয়েছে। তবে ছেলের সবল দেহ, মুখের ঝলমলে হাসিই বলে দিচ্ছিলো এই বাংলোয় তার মায়ের উপস্থিতি।
আফতাব শেখ গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললেন,
” এসো, এসো। বেলাশেষে পাখি নীড়ে ফেরে। ”
আজলান গাড়ি থেকে নেমে আসতেই আয়জার কোল থেকে ডোডোও নেমে এল হামাগুড়ি দিয়ে। এসে তার পায়ের কাছে বসে মুখ তুলে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে পা ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো পায়ের পাতায় ভর দিয়ে। হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে ডাকলো, ” পাপ্পাহ। ”
তিথি কপালের ব্যান্ডেজটা খোলার জন্য ডাক্তারের কাছে এসেছে। সাথে পায়ের বুড়ো আঙুলটাও দেখাবে। বুড়ো আঙুলটার কোণা ফুলে পুঁজ জমে আছে। ব্যাথায় কাল সারারাত ঘুম হয়নি। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে একটা ফার্মেসির সামনে বসেছিলো সে। একটা কলা পাউরুটি কিনে খেতে খেতে ভাবলো, এখানে ফ্যাক্সির দোকান থেকে আজলান শেখকে একবার ফোন দেবে। কিন্তু আয়জা বলেছে সে সিম চেঞ্জ করে ফেলেছে। ফোন দিয়েও লাভ হবে না। রাস্তায় একটা কুকুর তার হাতে পাউরুটি দেখে ছুটে এসেছে ইতোমধ্যে। জিহ্বা লম্বা করে হাঁপাচ্ছে। তিথি তার দিকে বাকি পাউরুটিটা ছুঁড়ে মারলো। তারপর ঔষধগুলো কিনে নিল।
টাকাগুলো ডোডোর আকিকার সময়কার টাকা। টাকাগুলো খরচ করতে গিয়ে তিথির বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আজ পাঁচদিন হয়ে গেছে সে ডোডোকে দেখেনি। কেমন আছে সেটা অব্দি জানে না। এমন দুঃসময়ও তার জীবনে আসবে তা সে কখনোই ভাবেনি। এর আগে কবে এমন কষ্টে ভুগেছে সে মনে পড়ে না। সত্যিই মনে পড়ে না। মনে হচ্ছে এর আগের সমস্ত দুঃখগুলো এটার কাছে হালকা, তুচ্ছ। ডোডোটা তার একটা অংশ জুড়ে আছে। কি যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। কি যেন নেই তার কাছে। ভীষণ নিঃসঙ্গ, একা, অসহায় লাগছে নিজেকে। এমন খারাপ সময়ের সাথে এই প্রথম সাক্ষাৎ তার।
ফার্মেসিতে তার পরপর আরও অনেকেই এসেছে।
একটা মহিলা এসে তার পাশে বসলো। বলল,
” আপনি কি এখানকার মানুষ? ”
তিথি মহিলাটিকে আগাগোড়া দেখলো। মহিলাটিকে দেখে মনে হচ্ছে সম্ভ্রান্ত পরিবারের বৌ। গায়ে দামী বোরকা, মাথায় সোনালী রঙের হিজাব। যেটা বেশি চোখে পড়লো সেটা তার গোলাপি ঠোঁট, আর চোখের পাপড়ি। তিথি সুন্দর কাউকে দেখে প্রশংসা না করে পারে না। মহিলাটির কোলে একটা তিন-চার বছরের শিশু। তিথি জবাব দিল,
” হ্যা। ”
মহিলাটি তার পাশে বসলো। বলল,
” আমি এখানে নতুন এসেছি। বাচ্চার বাবার মামার বাড়ি। কিছুই চিনতে পারছিনা। ”
তিথির চোখ বাচ্চাটার দিকে আটকে আছে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল,
” বয়স কত ওর? ”
” চারে পড়েছে। আপনি কোথায় থাকেন? ”
” জলিল চেয়ারম্যানের বাড়িতে। ”
মহিলাটি অবাককন্ঠে বলল,
” ওহহ তাই! উনি আমার মামা শ্বশুর। ”
তিথি বাচ্চাটাকে আদর করতে মগ্ন হয়ে গেল। বাচ্চাটার হাসিটা সুন্দর। তার কোলে উঠে এসেছে ইতোমধ্যে। গায়ে অসম্ভব সুন্দর একটা ঘ্রাণ। কিন্তু ডোডোর মতো নয়। ডোডোরটা সব সুগন্ধিকে হার মানাবে। কত আদুরে, মায়াময়। ওটা শুঁকলেই যেন মন ভরে যায়। কেমন আছে কে জানে তার বাচ্চাটা। তিথির চোখদুটো সজল হয়ে উঠলো। তন্মধ্যে একটা পুরুষ কন্ঠস্বর শুনতে পেল সে।
” তোমরা এখানে? তোমাদের খুঁজতে খুঁজতে আমি পাগলপ্রায়। ”
মহিলাটি তার স্বামীর কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে ফিরে তাকালো। তিথি দ্বিগুণ চমকে উঠলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তার চাইতে দ্বিগুণ বিস্ময়ে চেয়ে আছে সেই লোকটি।
মহিলাটি কত রকমের প্রশ্ন করলো। লোকটা মহিলাটিকে নিয়ে চলে গেল বাচ্চাটাকে আদর করতে করতে। তিথি মহিলাটির দিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। বয়স বোধহয় তার চাইতে দু এক বছরের বেশি হবে। কত লম্বা! কত সুন্দর! এই অসম্ভব সুন্দর মেয়েটা কি জানে তার স্বামী একজন ভয়ানক রকমের বেঈমান?
তিথির বুকটা ভার হয়ে এল। যতটা ভার হয়ে এলে নিঃশ্বাস ফেলতে অব্দি কষ্ট হয়। চোখ বুঁজে চোখের জল ঝড়াতে ভুলে যায় ঠিক ততখানি। চারপাশটা অন্ধকার ঠেকলো তার চোখে। বেঈমানটা ভালো আছে দিনশেষে কিন্তু সে ভালো নেই কেন?
বহুকষ্টে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো একটা রিকশার জন্য। খুব শীঘ্রই বৃষ্টি নামবে। ওর মনের মতো আকাশেও মেঘ গর্জন করছে। কেমন নীরব আর্তনাদের মতো। বিকট শব্দ নেই অথচ কেমন ভয়ংকর।
রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ খেয়াল করলো পাশে একজন এসে দাঁড়িয়েছে।
” তিথি?কেমন আছো? বাড়িতে কবে এসেছ? ”
তিথি রিকশা থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোনো রিকশা থামাতে পারলো না।
লোকটার দিকে না ফিরে বলল,
” ওটা তোমার বউ? ”
” হ্যা। ”
তিথি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” তোমার বউ খুব সুন্দর। তোমার বাচ্চাটাও খুব আদুরে। তুমি অনেক সুখী তাই না? ”
” দেড় বছরে পড়েছে। খুব আদুরে। একদম পুতুলের মতো ছোট। ”
লোকটা চুপ করে রইলো। তিথি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। রাস্তার দিকে চেয়ে রইলো। কখন যে একটা রিকশা থামবে? লোকটা তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
” তোমার বর শুনেছি একজন র্যাব।”
তিথি সগর্বে বলল,
” হ্যা। অনেক বড় অফিসার। ডেপুটি কমান্ডার। ”
হায় আল্লাহ, এতকিছু কখন মনে রেখেছে সে? স্বাভাবিক ভাবে কেউ প্রশ্ন করলে বোধহয় বলতেও পারতো না।
” তোমার বরের নাম আজলান শেখ? ”
তিথি চমকে উঠলো। তুমি কিভাবে চেনো জিজ্ঞেস করতে যাবে তখুনি মনে পড়লো প্রশাসনের লোক তাই চিনতেই পারে। ওকে তো টিভিতে দেখায়। তাই বললো,
” হ্যা, আজলান শেখ। তুমি ওকে চেনো তাহলে। অবশ্য চিনবে না কেন? ওকে চেনে না এমন কেউ নেই বাংলাদেশে। ”
” আমি খুশি হয়েছি তুমি সুখে আছো শুনে। ”
তিথির মন কেঁদে উঠলো কিন্তু মুখটা স্বাভাবিক। মন কেঁদে উঠে বলল, ” না না আমি সুখে নেই বেঈমান। আমি একটুও সুখে নেই। কেন সুখে নেই আমি? ”
তিথি বলল, ” তুমি কি ভেবেছ, তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলে আমার বিয়েশাদি হবে না? ”
” আমি তোমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেলে যাইনি। ”
” জানি। তোমার বাবা তোমাকে ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে। আমি কালো বেঁটেখাটো মেয়ে। তোমার কোনো দোষ নেই। আমি তোমার কোনো দোষ দিচ্ছি না। কারো কোনো দোষ নেই। সব ভালোই ভালোই হয়েছে। তুমিও ভালো কাউকে পেয়েছ। আমিও। ”
রায়হান বলল, ” হ্যা, তা ঠিক। এখানে একা এসেছ? মনে হচ্ছিলো খুঁড়িয়ে হাঁটছো? ”
তিথি বলল, ” ওই আঙুলে একটু চোট পেয়েছিলাম। ”
রায়হান বলল,
” তুমি আমার উপর রেগে নেই তো? ”
তিথি সাথে সাথে বলল,
” না না। রেগে থাকবো কেন? কপালে যা ছিল তাই হয়েছে। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। ”
রায়হান বলল,
” কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনো আমার উপর ক্ষেপে আছো। ”
একটা রিকশা এসে থামলো তখুনি। তিথি রিকশায় উঠতে যাবে তখুনি থেমে গিয়ে বলল,
” আমি ক্ষেপে থাকলেও কি যায় আসে? শেষবারের মতো একটা কথা বলে যাই তোমাকে। কাউকে কথা দেয়ার আগে তোমার মা বাবা, তোমার মামা চাচাদের কথা ভেবো। যা করতে পারবে না, তার আশা কাউকে দেখিওনা। তুমি আমার আশা ভঙ্গ করেছ তাতে বেশিদিন কষ্ট ভোগ করতে হয়নি আমাকে। তেমন কিছুই হয়নি।
কিন্তু তুমি আমার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছিলে, তাই এখন কাউকে সহজে বিশ্বাস করে উঠতে পারিনা আমি । মিথ্যে মিথ্যে স্বপ্ন দেখানো কত সহজ তাই না? যদি হয় আমার মতো বোকা হাঁদা। তুমি ভালো থেকো। তোমার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই আর। ”
রিকশায় উঠে পড়লো তিথি। তার কিছুক্ষণের মধ্যে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সারারাস্তা ভর সে ভেবে কূল পেল না “কেন সে ভালো নেই? ”
তাকে কেউ একজন ছেড়ে গিয়েছে, সে কালো বেঁটেখাটো তাতে কি? তার তো সব আছে।
” শুধু আমি ভালো নেই আম্মা। সবাই ভালো আছে। বেঈমানটা কত সুখে সংসার করছে বউ বাচ্চা নিয়ে। আর আমার কাছে আমার বাচ্চাটা অব্দি নেই। কিচ্ছু নেই আমার। কেউ নেই। ”
_______
ডোডোর কান্না আজ একটুর জন্যও থামেনি। থামছে তো কিছুক্ষণ পরপর আবার কাঁদছে। তাহেরা বেগমসহ নাকানিচুবানি খেয়েছেন তাকে সামলাতে গিয়ে। শায়লার হাতে কোনো কাজ উঠেনি। তাহেরা বেগম না থাকলে দুপুরে সবাইকে না খেয়ে থাকতে হতো। ঘুমোচ্ছেও না। যতক্ষণ কোলে নিয়ে বাইরে হাঁটছে ততক্ষণ শান্ত। ঘরে প্রবেশ করামাত্রই কান্না শুরু। আজলানের কাছে খবর পৌঁছানো হয়েছে কিন্তু তার কাজের এত চাপ সে বাড়ি ফিরেছে প্রায় রাত সাড়ে ন’টায়। তাদের একটা মিশন চলছে এখন। অস্ত্র পাচারকারীদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে। চাইলেও ডোডোর কথা সে ভাবতে পারছে না। বাড়ি ফিরে দেখতে পেল ডোডো কাঁদছে। তাও মেঝেতে বসে। তাকে দেখামাত্রই হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে এল। আজলান কোলে তুলে দুগালে আদর করতেই ডোডো আরও চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলো। শায়লা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
” সরি স্যার। আজ সারাদিন এভাবে কেঁদেছে। আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো তারও সুযোগ পাইনি। ”
” আন্টি কোথায়? ”
” রান্না শেষ করে উনি এশার নামাজ পড়ছেন। রান্নাবান্না আজ উনিই করেছেন। বাবু আজ এতটা জ্বালিয়েছে যে আমি রান্নার কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারিনি।”
আজলান বলল,
” তাই বলে মেঝেতে বসিয়ে রাখবেন? মেঝে ঠান্ডা সেটা আপনার মাথায় নেই? ওর ঠান্ডা লেগেছে এমনিতেই। ”
শায়লা চোখ নামিয়ে রেখে বলল,
” সরি স্যার। ”
” সবসময় সরিতে কাজ হয় না। যান আপনি এখন। ”
শায়লা বেরিয়ে গেল চুপচাপ। আজলান ডোডোকে আদর করলো। তারপর কাপড়চোপড় পাল্টে দিয়ে নতুন কাপড় পরালো। তার ছোট্ট গাড়িটাতে বসিয়ে দিয়ে বলল,
” বাবা গোসল করবে। কাঁদবে না ঠিক আছে? ”
ডোডো ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো। আজলান ইউনিফর্ম চেঞ্জ করে ওয়াশরুমে ঢুকতেই ডোডো চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো। আজলান দরজা খোলা রেখে বলল,
” বাবা আছি এখানে। কোথাও যাচ্ছি না আর। ”
ডোডো তার দু-হাতে ছোট্ট ফিডারটা ধরে চুুকচুক করে খেতে খেতে বলল,
” আমমাহ। ”
আজলান তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে গায়ে সাবান লাগালো। কথা বলতে বলতে গোসল সেড়ে নিল। তারপর গোসল সেড়ে ছেলেকে নিয়ে নীচে এসে খেতে বসতেই তাহেরা বেগম বললেন,
” এখন শান্ত হয়ে আছে। সারাদিন কেঁদেছে আজ। একটুও থামেনি। এতটুকুন বাচ্চাকে কি মা ছাড়া সহজে রাখা যায়? সারাক্ষণ ম্যা ম্যা করেই যাচ্ছে। মা চিনে ফেলেছে ও। ”
শায়লা মাছের বাটি নিয়ে টেবিলের উপর রাখতেই শব্দ হলো কিঞ্চিৎ। যদিও বাসনকোসনের শব্দ হওয়া বারণ। সেই শব্দ শুনে ডোডো চোখ তুলতেই শায়লাকে দেখলো। দেখামাত্রই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আজলানকে জাপ্টে ধরে রাখলো। শায়লা ভড়কে গেল। আজ সকাল দশটার দিকে “আমমমা আমমমা ” ডেকে তার বুক খামচাচ্ছিলো বাচ্চাটা। ভীষণ জোরে একটা ধমক দিয়েছিলো সে। সেই থেকে কান্না শুরু করেছে আর থামেনি। ভাগ্যিস তাহেরা বেগম দেখেননি। আজলান ভুরু কুঁচকে একবার শায়লাকে একবার ডোডোকে দেখে নিল। শায়লা হাত বাড়িয়ে বলল,
” চলো আমরা ঘুরে আসি। ”
ডোডো হাত পা নেড়ে কাঁদতে লাগলো। আজলান কোনোমতো খেয়ে উঠে গেল তাকে বুকে জড়িয়ে। বলল,
” মা? মায়ের কাছে যাবে তুমি? ”
ডোডো কান্না একটু থামিয়ে তার মুখে মুখে,
” মা মা মা। ”
আজলান তার ছোট্ট কপালে তার কপাল ঠেকিয়ে বলল,
” কি করব আমি? ”
ডোডো হেঁচকি তুলে বলল,
” আম মাম মা। ”
আজলান ঘরে চলে এল। আয়জাকে ফোন করতে গিয়ে থেমে গেল। ফোন ঘাটতে ঘাটতে একটা রেকর্ড খুঁজে পেল সে। তিথি সেদিন ফোন করে ডোডোকে তার গলা শোনাচ্ছিলো। সে রেকর্ডটা ছেড়ে দিয়ে ডোডোকে বলল,
” তোমার মা এখানে। কথা বলো। ”
তিথি ওর কানের কাছে ফোন রেখে হ্যালো হ্যালো করেছে এর আগে। সে তা বুঝে। হাত পা লাফিয়ে উঠে জোরেশোরে ডেকে বলল,
” ডোডো, এই ডোডো কথা বল। তোর বাপ শুনছে। আব্বাহ ডাক। এই বোবা ছেলে। হা করে চাইয়া থাকোস ক্যান? কথা বল। কথা বলতে বলছি ডোডো। ”
ডোডো কানকাড়া করে চুপটি করে শুনে আছে। আজলান দৃশ্যটা অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইলো। ডোডো ফোনটার সাথে কান লাগিয়ে তার উপর শুয়ে থাকলো। মুখে কি একটা যেন অস্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করে গেল। তারপর কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়লো।
আজলান তাকে বুকে টেনে নিল। একদম বুকের উপর তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে আম্বিয়া বেগমের ফোনে কল দিল। রিসিভ করামাত্রই আম্বিয়া বেগমের আহাজারি শুরু করে বলল,
” আমার ঘরদোর আন্ধার করে তোরা কই চলে গেলি বাপ? আমি কি এমন দোষ করছি যে এতবড় শাস্তি দিতেছোস তোরা। এতবড় শাস্তি দিস না। আমার নাতিটারে কোথায় রাখছিস তুই? ”
আজলান ক্ষীণ স্বরে বলল, ” ও তোমার কাছে আর ফোন দিয়েছে মা? ”
মাছ কাটতে গিয়ে বুড়ো আঙুলের পেট কাটা গিয়েছে তিথির। কাজ করতে যাবে অথচ তার ভুল হবে না এটা অসম্ভব।
গতকাল ফ্যান মুছতে গিয়ে চেয়ার থেকে পড়ে গেল। এমনিতেই সে শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছে মাথা ফেটে, বাথরুমে আছাড় খেয়ে। এখানে এসে একবার চেয়ার থেকে পড়লো, আবার আঙুল কাটলো।
মালেকা বেগম অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন। দুধের শিশুটাকে ফেলে এসেছে। কতবড় পাষাণ মা সে? জামাই না হয় দুটো কথা শুনিয়েছে তাতে এভাবে চলে আসতে হলো?
ভালো ঘরে বিয়ে দেয়ায় কত নিশ্চিন্তে ছিলেন তিনি। কিন্তু কয়েকদিন পর পর একেকটা ঝামেলা করে সে বাপের বাড়ি চলে আসে।
কিসের এত আত্ম অহমিকা তার? কিসের এত দেমাক? কি আছে তার বাপের? অমন বর-ঘর পেয়েছে কপাল করে। সেসব আঁকড়ে ধরে সুন্দর করে সংসার করবে তা না। কিসের বলে ঘনঘন বাপের বাড়িতে চলে আসে সে?
বাপ একদিন কামাই দশদিন বসে থাকে। দোকানে কেনাবেচা নেই, ছোট ভাইটা এখনো পড়াশোনা করছে। কে তার অসুখ বিসুখের চিকিৎসা খরচ দেবে? কেনই বা দেবে? যে অমন ছেলের ঘর করতে পারে না তার হাতে চাঁদ এনে দিলেও সে তার মূল্য দিতে পারবে না।
যতবার তিথি তার সামনে আসছে ততবারই তিনি বকাবকি করছেন। অন্যবার শ্বশুরবাড়ি থেকে আসার পর বাপের সাথে মিলে উনাকে জব্দ করলেও এবার তিথির কোনো সাড়াশব্দ নেই।
ছেলের জন্য কাঁদছে কিন্তু ছেলের খোঁজ নিতে পারছে না। তাকে ফোনে ব্লক করে রেখেছে আজলান শেখ এমনকি বাড়ির সব নাম্বার।
সে জানিয়েছে, এখানে না খেয়ে পড়ে থাকবে তবুও শ্বশুরবাড়িতে সে যাবে না। মায়ের মন তাই মেয়ে না খেয়ে ঘরে শুয়ে থাকলে উনার খারাপ লাগে, সংসার ভেঙেছে তাই দুঃখ হয়, বাচ্চার শোকে কাঁদছে তাই মায়া লাগে নয়ত চুলের ঝুঁটি ধরে বের করে দিত ঘর থেকে।
রাগে, দুঃখে উনি কাঁদতে বসেন। কত খুশি হয়েছিলেন একটা নাতি হওয়ায়। ভেবেছিলেন এই বুঝি তার সব পাগলামি চুটে যাবে।
মেয়েরা মা হওয়ার পর অনেক বদলে যায়। সংযত হয়। কিন্তু তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন এল না। স্বামী সংসারের প্রতি হেয়ালি গেল না। এভাবে কি সংসার হয়?
এই যে এখন কাঁদছে, খাচ্ছে না, কথা বলছে না, কাজ করতে গিয়ে হাত পা কাটছে সবটাই বাচ্চাটার জন্য।
নইলে স্বামী সংসারের জন্য তার অত মায়া নেই। বাচ্চাকে ফেলে এসেছে বলে এত কান্নাকাটি নইলে আগেরবারের মতো উনার মুখে মুখে তর্ক করতো। আর বলতো, “কেন যাব ওই বাড়িতে? কেন যাবো ওই লোকের কাছে। আমি না গেলেই বাঁচি। ”
উনার বড্ড রাগ হয়। পেটে ধরেছেন তাই কঠোর হতে পারেন না। কিন্তু এভাবে যে সংসার হয় না তা উনি বুঝাতে পারেন না।
সংসার করতে অনেক ধৈর্য লাগে, অনেক সংযমী হতে হয়। স্বামী সংসারকে ভালোবাসতে হয়, আপন করতে হয়। যেটা উনার মেয়ে করেনি।
এখনো বাচ্চাটাকে পেয়ে গেলে সে স্বামী সংসারের দিকে ফিরেও তাকাবে না। অতবড় কলিজা তার আছে। বরঞ্চ ছেলেটা হওয়ার দেড়বছরের মধ্যে কোনো অভিযোগ আসেনি কেন এটা নিয়েই উনি ভাবছিলেন এতদিন। এত সহজে সে শোধরানোর নয়।
বিয়ের আগেও পাড়াপ্রতিবেশিরা কত কথা বলেছে। বিয়ে হবেনা, সংসার করতে পারবে না, ভালো ছেলে জুটবে না, শ্বশুরবাড়িতে ভাত জুটবে না।
চেয়ারম্যান বাড়ির এক ভাগ্নের সাথে সেবার কত কথা রটে গেল। সেই ছেলে তাকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লাগলো। সেও কম না। বাপকে এসে আবদার করলো,
” আব্বা আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও। তোমার ঘাড়ে বসে আর কতদিন খাবো? আমার পড়াশোনা ভালো লাগে না। ও বলেছে আমাদের বিয়ে হলে তোমার দোকানটা সাড়িয়ে দেবে। নতুন মাল তুলে দেবে। তুমি বাজারের সবচাইতে বড় সওদাগর হবে। তারপর ধীরেধীরে ওর টাকা ওকে শোধ করে দেবে। ”
কিন্তু ওই ছেলেটা ওকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে শেষমেশ কোথায় যেন পালিয়ে গেল। সেই থেকে বিয়ে করবে না বলে তিথি জেদ ধরলো।
“সবকটা ব্যাটামানুষ ভন্ড” বলে এমনভাবে বেঁকে বসলো মালেকা বেগম কত কেঁদেছেন শুধু বিয়ে দিতে পারবেন না ভেবে।
শেষমেশ উনার ভাইজির বিয়েতে আফতাব শেখ তিথিকে দেখে উনার ছেলের জন্য পছন্দ করেন। পছন্দের প্রথম কারণ তিথির কাছ থেকে উনি পানি চেয়েছিলেন তিথি একেবারে শরবত এনে দিয়েছিলো। দ্বিতীয় কারণ হয়ত তিনি এমন মেয়েই খুঁজছিলেন মনে মনে।
যেন লোকটা তার বহুদিনের পরিচিত অমনভাবে উনার সাথে গল্পসল্প জুড়ে দিয়েছিলো তিথি। আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছেন তাই আফতাব শেখ তিথিকে পুত্রবধূ করার সিদ্ধান্ত সেই বিয়েবাড়িতেই পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন।
আজলান শেখও বিয়েতে এসেছিলো কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে। বরযাত্রীদের সাথে এসেছিল, খেয়েদেয়ে সোজা চলে গিয়েছে।
প্রথম কারণ, সময়টা বর্ষাকাল হওয়ায় গ্রামের বাড়ির মাটি কর্দমাক্ত ছিল, পা ফেলতেও তার অস্বস্তি।
দ্বিতীয়ত সেখান থেকে কিছুটা দূরে গরুর গোয়াল, দেখেই ঘৃণা লাগছিলো।
তৃতীয়ত খাবার পরিবেশনকারী গ্রাম্য ছেলেগুলো একে অপরকে বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করছিলো যা শুনে কেউ তেমন প্রতিক্রিয়া করেনি।
চতুর্থ কারণ, টেবিলের উপর যে সাদা কাপড়টা বিছানো হয়েছিলো সেটাতে মাংসের ঝোলঝাল লেগেছিলো, আশেপাশে মাছি উড়ছিলো দু-একটা, আর গ্লাসগুলোতে চর্বির তেল।
পঞ্চম কারণটি একটু ভিন্ন। বহুকষ্টে আতিথেয়তা রক্ষা করার পর যখন সে তাড়াহুড়ো করছিলো কোনোমতে বিয়েবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার ঠিক সেই মুহূর্তে আফতাব শেখ তাকে ডেকে একটা গোলাপি পোশাক পড়া মেয়েকে দেখিয়ে বলল,
” ওকে দেখতে পারো। আধুনিকতার বাতাস গায়ে লাগেনি। তুমি যেমনটা চাইছো ঠিক তেমনটা। সহজ সরল অত মারপ্যাঁচ নেই মনে। মনের কথা আমাকে খুলে বলে ফেললো। বুঝতে পেরেছ আজলান শেখ? মাটির দলা। তুমি যেমন আকার দেবে তেমনই হবে। রঙ নিয়ে নিশ্চয়ই তোমার সমস্যা নেই কারণ তুমি ফর্সা, সুন্দরী, আধুনিকাদের পছন্দ করো না। এবার নিশ্চয়ই বলবে না একেও আমার পছন্দ না। দেখো, আমি ওকে তখন থেকে লক্ষ করছি এখানে এত এত সুদর্শন কুদর্শন বরপক্ষের ছেলেপেলে এসেছে ও একবারও ফিরে তাকালো না। ”
আজলান শেখ দেখলো মেয়েটা বরপক্ষের কাছ থেকে টাকা আদায় করার জন্য নাছোড়বান্দার মতো লেগে আছে। আঙুল তুলে ঝাঁজালো সুরে বলল,
আজলান বিরক্ত হয়ে সোজা বেরিয়ে এসেছিলো।
মেয়েটা শ্যামকালো হলেও চেহারা খারাপ না কিন্তু খারাপ ছিল তার ড্রেসসেন্স আর সাজগোজ।ননসেন্স।
মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে গিয়ে ভয়ে বুক কাঁপছিলো মালেকা বেগমের। যদি নামিদামী আসবাবপত্র আর বৈরাতী চেয়ে বসে তাহলে তো হাতছাড়া হয়ে যাবে এমন পাত্র। অত টাকা তিনি কোথায় পাবেন, কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো। বরপক্ষ কিছু চাইলো না তেমন।
মালেকা বেগমকে উনার মা প্রায়সময় বলতেন, মেয়েদের সুন্দর হওয়ার চাইতে কপাল সুন্দর হওয়া বেশি দরকার। তিথিরও যেন তেমনটাই হলো।
পাড়াপড়শিরা অবাক হয়ে গেল এমন সম্বন্ধ আসায়। হাঁটেবাজারে সবাই বরপক্ষের লোকের কানভারী করার চেষ্টা করলো কিন্তু ছেলে আইনের লোক হওয়ায় সেই চেষ্টায় কেউ তেমন সফল হতে পারেনি।
অমন ভালো ছেলে, যেমন পেশা তেমন দেখতে, বাড়ি-ঘর, ধন-দৌলত, মেয়ের এত সুখের কপাল দেখে মালেকা বেগম আর মফিজ সাহেব কতবার যে খোদাতায়ালার দরবারে শুকরিয়া জানালেন তার হিসেব নেই।
কিন্তু যার বিয়ে সে পুরোপুরি নির্বিকার। যেন সে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে যাচ্ছে শ্বশুর বাড়িতে। স্বামীর প্রতি তার মায়া নেই, মুগ্ধতা নেই, সংসারের প্রতি কোনো টান নেই, দায় নেই। যেন সংসারটা তার কাছে চড়ুইভাতির মতো খেলা। স্বামী সংসারটা যেন তার নয়। একদিন তো বলেই বসলো,
” আম্মা তোমাদের জামাই আরেকটা বিয়ে করতে চাইলে বলবো করো গে। ওটাকে তুমি কাজের জায়গায় রেখো। এখানে না আনলে হবে। আমি ভালো বউ না হতে পারি কিন্তু ভালো সতীন হবো। ”
মালেকা বেগম কপাল চাপড়াতেই রেগেমেগে বলল,
” এই কথা কি এমনি এমনি বলছি আম্মা? আমার কোনো কাজ তার পছন্দ না তাই বলছি। আমার রান্না পছন্দ না, কাপড় ধোয়া পছন্দ না, হাঁটা পছন্দ না, খাওয়া পছন্দ না, সাজা পছন্দ না, কথা বলা পছন্দ না তাই তো বললাম। একটা পছন্দের বউ থাকুক তার। তখন দেখবে আমার সাথে খ্যাঁকখ্যাঁক করা বন্ধ করে দেবে। ”
মালেকা বেগম ভীষণ ভয়ে ভয়ে ছিলেন। তাদের অগাধ টাকাপয়সা আছে। দিনে দিনে বউ দিয়ে ফেলার ক্ষমতা আছে। যদি ছেলেটাও এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে? কিংবা আরেকটা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়?
আজকাল কত খবর কানে আসে এমন। বউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিচ্ছে এমনকি ছেলেপেলে অব্দি হয়ে যাচ্ছে। সেখানে তিথি নিজেই বিয়ে করতে বলছে। যদি ওর কথা শুনে ওই চিন্তা মাথায় নেয়? অন্যত্র সংসার পাতে তখন কি হবে?
বুদ্ধিশুদ্ধি ওয়ালা, চালাকচতুর সতীনের সাথে জামাই ভাগ করে নেয়া কি চারটে খানে কথা? কিন্তু মেয়েটাকে সেটা কে বোঝাবে? কে বোঝাবে পুরুষ মানুষের সামনে যা তা বলা যায় না। ওদের এত হেয়ালি সহ্য করার ক্ষমতা থাকে না।
নেহাতই ছেলেটা ওর কোনো কথা পাত্তা দেয় না নইলে কবেই সংসারটা ভেঙে যেত। কবেই তার গায়ে ডিভোর্সির তকমা লেগে যেত।
কিন্তু তারমধ্যেই সুখবরটা কানে এল।
উনি মনেপ্রাণে চাইছিলেন কোলে একটা বাচ্চা-কাচ্চা আসুক। তাহলে সংসারে মন বসবে। জামাইয়ের প্রতি মন ঘামবে কিন্তু হলো কই? এবার চিরতরে বাড়ি চলে এল তাও বাচ্চাটাকে রেখে।
***
পাশের বাড়ির হাসিবের জন্য বউ এনেছে বছর খানেক হয়েছে। সে তিথিকে দেখতে এসেছিলো কয়েকবার। আজও এল দই চিঁড়া নিয়ে। তিথি কিছু খাচ্ছে না শুনে সে এনেছে তিথিকে খাওয়াতে। তিথির জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে তার। হাত কেটেছে, পায়ের আঙুল ফুলে ডবডবে হয়ে আছে,তারউপর মাথার ক্ষত শুকানোর ঔষধ ফুরিয়ে গেছে। ক্ষতটা এখনো সেড়ে উঠেনি। তারউপর চাচী যা ইচ্ছা তাই বলে বকছে। তিথির ঘরে তিথিকে দেখতে না পেয়ে সে পাকঘরে গেল। তিথির আঙুলে কাপড় জড়িয়ে দিতে দিতে মালেকা বেগম চেঁচাচ্ছেন,
” বাচ্চাটার হায় লাগছে তোর উপর। মা হয়ে কেমনে তারে ফেলে আসছোস তুই? কত বড় পাষাণ তুই। দেখ সেজন্য তোর হাত কাটছে, মাথা ফাটছে আর পায়ের আঙুল ফুলছে। বাচ্চাটার হায় লেগে মরবি তুই। ওরকম দুধের শিশু রেখে কোন মা একা একা বাপের বাড়ি চলে আসে?”
” বাচ্চাটারে দুনিয়াতে না আনার জন্য কতকিছু করলি তুই। তোর মতো বেয়াক্কেলের পেটে অমন সোনার চান ধরছে এটাই বেশি। তুই কোন আক্কেলে তারে ফেলে আইলি? অন্যসময় একা একা লাফাইতে লাফাইতে চলে আসতি তখন কিছু বলিনি এখন কোন সাহসে এলি? ”
তিথি জবাব না দিয়ে পিঁড়ি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কোনো জবাব না পেয়ে মালেকা বেগম আরও ফুঁসে উঠে বললেন,
” কুত্তার পেটে ঘি সইনা। তোর পেটেও অমন সোনার চান ধরছে সেটা তোর সইনায়। বাচ্চাটার জন্য তোর একটুও মায়া হইতেছে? হইতেছে না। কারণ তুই মা নামে কলঙ্ক। ”
তিথি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করতে যাবে ঠিক তখনি রুনা আটকে ফেললো। বলল,
” এগুলা নাও আপা। তোমার জন্য আনছি। খালি পেটে থাকা ভালো না। ”
তিথি হাত বাড়িয়ে নিল। বলল,
” খিদে লাগলে খাবো ভাবি। ”
রুনা বলল, ” তোমার বরের কাছে আমার মোবাইল থেকে ফোন দেয়া যাবে। আমার নাম্বার চেনেনা তাই ব্লক করবে না। দিবা? ”
তিথি কিছু সময় ভেবে বলল,
” দাও। ”
রুনা তার ফোনটা বাড়িয়ে দিল। তিথি আজলানের নাম্বার তুলে ফোন দিল। যখন রিং পড়ছিলো তখন বুকটা ধড়ফড় করছিলো তিথির। মনে হচ্ছিলো এক্ষুণি ডোডোর গলা শুনতে পাবে। তৃষ্ণার্ত বুকটা আরও তৃষ্ণাতুর হয়ে উঠলো যেন। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয় এভাবে সাতবার ফোন দেয়ার পরেও আজলান ফোন তুললো না। তিথি ফোনটা রুনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” রিসিভ করছে না। ”
রুনা বলল, ” এখন কি করবে আপা? ”
তিথি বলল, ” দেখি কি করা যায়। ”
” চিঁড়া দইটুকু খেয়ে নাও আপা। ভালো লাগবে। না খেয়ে থেকো না। ডাক্তারের কাছে যাবে না? ”
তিথি বলল, ” যাব। আগে ডোডোর কোনো খবর পাই কিনা দেখি। ”
তিথি বলল, ” আচ্ছা ফোন দিলে আমাকে ডেকো।”
রুনা মাথা নেড়ে বললো ” আচ্ছা। ”
রুনা চলে যেতেই তিথি তার কাপড়চোপড় গুলো গুছিয়ে রাখার সময় ডোডোর দুটো ছোট ছোট শার্ট-প্যান্ট পেল। আরামদায়ক বলে ডোডোকে অনেকবার পড়ানো হয়েছে সেগুলো। আসার সময় তার সাথে নিয়ে আসবে বলে স্যুটকেসে ভরে নিয়েছিলো। কাপড়গুলো হাতে নিতেই জনসন বেবি পাউডারের খুশবুতে তার মনটা যেন ভরে গেল। নাকের কাছে নিয়ে শুঁকতেই মনে হলো এই তো ডোডোর গায়ের খুশবুটা। নাক চোখ চেপে খুশবুটা শুঁকতে শুঁকতে ঝরঝরে কেঁদে ফেললো তিথি।
_____________
রাত দশটা কি সাড়ে দশটা। তিথির চোখ লেগে এসেছিলো একপাশে কাত হয়ে পড়ায়। ধড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে বসতে গিয়ে পিঠে ভারী ব্যাথার অনুভব হলো। তারপরও সে চিৎকারটা অনুসরণ করে ঘর থেকে বের হলো। মালেকা বেগম তেড়ে এসে চুলের ঝুঁটি ধরে ঠেলে দিয়ে বললেন,
তিথি দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে নামলো। হাসিব তার বউকে মেরেই চলেছে। তিথিকে দেখামাত্র রুনা ছুটে এসে বলল,
” আপা ওকে একটু বলো ওটা তোমার বর ছিল। আমি কোনো পরপুরুষের সাথে কথা বলছিলাম না। তোমার বর ফোন দিছিলো কিছুক্ষণ আগে। তোমার হাসিব ভাই রিসিভ করে পুরুষ কণ্ঠ শোনায় আমাকে মারতেছে সন্দেহ করে। ”
তিথি হাঁ করে চেয়ে আছে তার দিকে। ঠোঁট আর চোখের কোণায় রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। হাসিবের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো সে। বলল,
” তোমার মাথা কি গেছে? নতুন বউকে সবার সামনে মারতেছো? ”
হাসিব বেরিয়ে এসে বলল,
” জানে মেরে ফেলবো ওকে। ”
তিথি বলল, ” ওটা তোমার দুলাভাই ছিলো। আমি ভাবির ফোন থেকে কল দিছিলাম। না জেনেশুনে ভাবিকে এমন করে মারলে কেন? ”
হাসিবের মা তেড়ে এসে বলল, ” জামাইয়ের ঘর ছেড়ে এসেছিস দু’দিন হয়নি। এখন আমার ছেলের ঘর ভাঙতে নামছোস তুই অলক্ষ্মী কোথাকার! ওর ফোন থেকে তোর বরকে ফোন দিছোস কোন সাহসে? বেশরম মাইয়া। ”
তিথি বলল, ” ফালতু কথা বলবে না চাচী। হাসিব ভাই ভাবিকে এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।”
হাসিবের চোখে অপরাধবোধ দেখা দিলেও সে ক্ষেপাটে চোখে চেয়েই রইলো। রুনা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” সত্যিটা এবার মানছো তো? আমার কথা পুরোটা না শুনে আমার গায়ে হাত তুলছো। ”
হাসিবের মা বললো, ” আর কাইন্দো না। ও ভুল বুঝে মারছে। কার মাথা গরম হইবো না বউয়ের ফোনে পরপুরুষ ফোন করলে। ”
তিথি বলল, ” ওকে ডাক্তারের নিয়ে যাও চাচী। ”
রুনা বলল, ” এতরাতে কিসের ডাক্তার? লাগবে না আমার ডাক্তার। ”
কেঁদেকেঁদে ঘরে চলে গেল সে। তিথি হাসিবের উদ্দেশ্যে বলল,
” গায়ে হাত তোলা খুব বাহাদুরি না? একবার ভাবো না কার গায়ে হাত তুলছো। ”
হাসিব চলে গেল গটগট পায়ে হেঁটে। তিথি তার ঘরে চলে এল। মালেকা বেগম বললেন,
“ওদের সংসারেও আগুন লাগিয়ে দিয়েছিস না হতচ্ছাড়ি? যেদিকে যাবি সেদিকেই আগুন লাগাবি তুই। বউটার কাছ থেকে কিছু শিখ। তোরে জামাই কোনোদিন মারেনাই তারপরও তুই ঢংঢং করে চলে এসেছিস এখানে। মারলে তখন কি করতি? ”
মফিজ সাহেব চুপ করে আছেন। অন্য সময় মেয়ের পক্ষে কথা বললেও এবার তিনি মেয়ের সিদ্ধান্তে বেশ ক্ষেপেছেন। অন্তত বাচ্চাটার কথা ভেবে ওর থেকে যাওয়া উচিত ছিল। তিথি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখ ঢাকলো। মালেকা বেগম চেঁচিয়ে বললেন,
” যেভাবে পারিস সেভাবে বাচ্চাটার কাছে যাহ। নইলে নিয়ে আয়। নইলে তোর খাওয়া বন্ধ এই বাড়িতে। অনেক সহ্য করছি তোর নকড়ামি। ”
______
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। সবুজে ঘেরা বাংলোটার চারপাশে বড় বড় অশ্বত্থ গাছ, মুচকুন্দ চাঁপা ফুলের গাছ। দূরে একটা কয়েকটা বেলীফুলের গাছও আছে। এই গন্ধটা আজলান ঠিকঠাক সহ্য করতে পারেনা, অপরদিকে বেলীফুল তিথির ভীষণ প্রিয়। বেলীফুলের তেল হোক সাবান কিংবা পারফিউম এককথায় তিথি বেলীর পাগল। বিয়ের পরপর তাকে সবসময় বেলীফুল আনার কথা বলতো কিন্তু আজলান কখনো আনেনি। ওই গন্ধটা এতটা অসহনীয় লাগে তার এককথায় বমি চলে আসে। সে নিতে পারে না গন্ধটা। এখনো হিমেল বাতাসের সাথে বেলীর গন্ধ ভেসে আসছে। কি অসহ্য গন্ধ! ডোডো বাইরে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। সে যখন ডিউটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো তখন ঘুম থেকে উঠে তাকে এমনভাবে জাপ্টে ধরে ফেললো যেন বাবা আজ কোথাও গেলেই সে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে। আজলান তাই কাজে যায়নি। বৃষ্টি দেখে যদিও বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে মরে গিয়েছিলো তারউপর ডোডোর এমন কান্না দেখে সে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করেছিলো।
শায়লা ডোডোর জন্য সাবুদানার পোরিজ বানিয়েছে। আজলান চামচে করে ডোডোকে একটু একটু করে খাওয়াচ্ছে আর জানালা দিয়ে পাখি দেখাচ্ছে। বৃষ্টিভেজা একটা কাক বসে আছে নারিকেল গাছের ডালে। সেটি গা ঝাড়ছে দেখে ডোডো হাসছে। আজলান তার গালে মুখ ঘষে আদর করে বলল,
” ওটা কি বাবা? ”
ডোডো তার দুঠোঁট নাচিয়ে বলল,
” আম মাম মা। ”
আজলান দেখলো ছোট কাকটার পাশে একটা বড় কাক এসে দাঁড়িয়েছে। ঠোঁটে োএকটা আঁশজাতীয় খাবার। বাচ্চাকে সেটি যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। আজলান আরেক চামচ পোরিজ তুলে দিল তার সামনে। ডোডো খাওয়ার সময় নিজের গায়েও ফেললো। আজলানের গায়েও ফেললো। আজলান তাকে খাওয়ানো শেষে চেঞ্জ করে দিল তারপর নিজেও চেঞ্জ করে নিয়ে কোলে তুলে বলল
” চলুন নীচে যাই। ওখানে একটা দাদু আছে। ”
ডোডো উত্তেজিত হয়ে বলল, ” দাদ্দাহ। ”
আজলান বলল, ” হুম। ”
নীচে নামার সময় ডোডো যা খেয়েছে সব বমি করে দিল। আজলানের বুক ভেসে গেল দুধ সাদা সাবুদানায়। ডোডোর দিকে চোখ তুলে চাইতেই ডোডো ঠোঁট টানতে টানতে আচমকা চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো। আজলান বলল,
” কিছু বলেছি আমি? বকিনি তো? আইজান!”
ডোডো কাঁদতে লাগলো। শায়লা এসে কোলে নিয়ে নিল। বলল,
” আপনি চেঞ্জ করে নিন স্যার। আমি ওকে রাখছি। ”
ডোডো কাঁদতে কাঁদতে আজলানের দিকে চেয়ে রইলো। তাহেরা বেগম এসে বলল,
” বাবা কি বকেছে বাবুকে? ”
আজলান যেতে যেতে বলল,
” এমনিই কাঁদছে। আমি এক্ষুণি আসছি। ”
শায়লা কত চেষ্টা করলো ডোডোর কান্না থামলো না। সে আরও একবার বমি করলো, পাতলা পায়খানা করলো। একবার নয়। দু-তিনবার। ডোডো নরম হয়ে পড়লো তারপর। আজলান তা দেখে ভয় পেয়ে গেল। শায়লাকে বলল,
” এমন হওয়ার কোনো কারণ দেখছিনা। কি খাইয়েছেন ওকে? ”
শায়লা ভয় পেয়ে গেল। তাহেরা বেগম বললেন,
” আগে ডাক্তার তো ডাকো বাবা। ”
আজলান দ্রুত ডাক্তার ডেকে নিয়ে এল। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলো,
” বাচ্চা কি খায়? ”
আজলান বলল, ” ফর্মুলা, আর আজ পোরিজ খেয়েছে। মাঝেমধ্যে একটুা সেদ্ধ নুডলস আর দুটো ভাত। ভাত খায়নি কাল তাই আমি পোরিজ বানাতে বলেছিলাম। ”
ডাক্তার বলল,
” ফর্মুলা কত বার খাইয়েছেন কাল? ”
শায়লা বলল,
” সন্ধ্যায় একবার বানিয়েছিলাম স্যার। সেটা রাতে খেয়ে ঘুমিয়েছে আর কিছু খায়নি। ”
” মধ্যরাতে? ”
আজলান বলল, ” ফিডারে যা ছিল তা খেয়েছে। ”
ডাক্তার বললেন, ” দু’ঘন্টার বেশি হলে সেগুলো ফেলে দিতে হবে আর আপনারা বাসি ফর্মুলা খাইয়েছেন বাচ্চাটাকে? এখনো দেড়বছর চলছে তাকে ফর্মূলা খাওয়ানোর কি দরকার? বাচ্চার মা কে? আপনি? ”
শায়লা সোজা দাঁড়িয়ে রইলো। আজলান বলে উঠলো,
” নো। সিটার। বাচ্চার মা নেই। ওটা স্কিপ করে বাকি কথা বলুন ডক্টর। ”
ডাক্তার ক্ষণকাল চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন,
” আমি ঔষধ দিচ্ছি। তার পেটে গ্যাসও হয়েছে। বুকে কফ আছে মনে হচ্ছে। ঠান্ডা পানিতে গোসল করাবেন না। পানি গরম করে ঠান্ডা হয়ে এলে সেটা দিয়ে গোসল করাবেন । পানিটা বেশি ঠান্ডা হবে না, আবার গরমও থাকবে না। দু’ঘন্টা পরপর ফিডার পরিষ্কার করবেন । ”
ঔষধ খাইয়ে দেয়ার পর ডোডো ঘুমিয়ে গেল। এই বাড়িতে প্রচুর মশা। মশার কয়েল জ্বালানো বারণ আজলান তাই একটা মশার ব্যাট কিনে এনেছে সাথে ডোডোর জন্য মশারি। একটা দোলনাও কিনে এনেছে। সেখানে ও বসে বসে খেলতেও পারবে, ঘুমাতেও পারবে। দোলনার সাথেও মশাটি ফিট করা আছে। আজলান তাকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে দোলনার কাছে অনেকক্ষণ বসে রইলো। তাহেরা বেগম এসে বলল,
” ঘুমিয়েছে? ”
” জ্বি। ”
” আসলে বেচারি শায়লা নিজেও বুঝতে পারেনি। ”
শায়লার নাম শোনামাত্রই আজলানের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। শায়লার কাছে গটগট পায়ে হেঁটে গিয়ে বলল,
আজলান বলল, ” হবে না মাইফুট। আপনার মন কোথায় থাকে? একটা বাচ্চার ভালোমন্দ না বুঝে রোবটের মতো কাজ করে গেলে আপনাকে আর রাখা হবে না। দরকার পড়লে চাকরি ছেড়ে বসে থাকবো আমি। ননসেন্স। ”
শায়লা শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। তাহেরা বেগম এসে বললেন,
” মানুষ মাত্রেই ভুল আজলান। তুমি তোমার বোনকে নিয়ে এসো পারলে। সে তার ভাইপোকে ভালোমতো দেখভাল করবে। ”
আজলান বরাবরের মতো শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে উত্তর দিল,
” আইজানের জন্য আমি একাই যথেষ্ট। ”
তাহেরা বেগম বললেন,
” না একা যথেষ্ট না। শায়লা তোমাকে সাহায্য করছে। আমিও করছি। তারপরও তোমাকে বেগ পেতে হচ্ছে। বাচ্চা কেউ একা মানুষ করতে পারে না। ”
আজলান চলে গেল। ডোডো ঘুম থেকে উঠে চেঁচিয়ে উঠেছিলো কাউকে না দেখে। আজলান ওয়াশরুমে কাপড়চোপড় গুলো ধুচ্ছিলো। ডোডোর কান্না শুনে সে ছুটে এল। আজ ডোডোকে শায়লার হাতে ছাড়েনি সে। ছুটে এসে ডোডোকে কোলে তুলে নিয়ে আলতো করে গালে আদর করে বলল,
” গুড ইভিনিং বাবা। ”
ডোডো মুখ দিয়ে অসুস্থ রোগীদের মতো শব্দ করলো। আজলান বলল,
” আমরা কাল ঘুরতে যাবো। আপনাকে সুস্থ হতে হবে। ”
ডোডো তার দিকে পিটপিট করে চেয়ে থাকলো। আজলান ভুরু উঁচিয়ে বলল
” কি? ”
ডোডো বলল, ” এমম্যা। ”
আজলান তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হাতদুটোর তালুতে চুমু দিয়ে বলল,
” আব্বা ডাকুন ”
ডোডো বলল, ” বেবেহ। ”
আজলান হেসে আরও কয়েকটা আদর দিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,
ইউ হ্যাভ টু আন্ডারস্ট্যান্ড আইজান, ঘৃণা আর ভালোবাসায় ঘর হয় না। আমি তোমার মায়ের সাথে ভালো থাকার চেষ্টা করেছি কিন্তু অসফল হয়েছি। আই ফেইলড মিজারেবলি এট দিজ পয়ন্ট। আয়েম এ ফেইলড হাসবেন্ড। বাট আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি এ ফেইলড ফাদার। ”
ডোডো তার গলা জড়িয়ে ধরে নরম গালটা বাবার গালের সাথে লাগিয়ে রেখে বলল, ” আম মাম মা, আব বাব বা। ”
We use cookies to ensure that we give you the best experience on our website. If you continue to use this site we will assume that you are happy with it.Ok