Thursday, December 18, 2025
Home Blog Page 8

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_২১ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_২১
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

বান্দরবনের একটা বাংলো বাড়িতে উঠেছিলো আজলান। নিজের সিনিয়র জাফর আহমেদের কথামতো রাতারাতি বাংলো বাড়িতে আসার পর প্রথমেই যে সমস্যা তাকে পড়তে হয়ে তা হচ্ছে ডোডোর কান্না।
হঠাৎ করে অপরিচিত জায়গায় অপরিচিত মানুষজন দেখে সে ভয় পেয়ে কাঁদছে। এমতাবস্থায় মাকে পেলে তার কান্না থেমে যাওয়াটা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু এখানে তার মা কখনো আসবে না আজলান তাই কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ালো কান্না থামার জন্য কিন্তু তা হওয়ার নয়। ডোডো কিছুক্ষণ পরপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো। বাইরে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল যে গাড়িতে করে এসেছে সেই গাড়িতে করে ফের তার মায়ের কাছে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তা আদৌ সম্ভব?

সকালের ব্রেকফাস্টের সময় জাফর স্যার জানালেন, কাল থেকেই একজন ন্যানি আসবে। সে আগে আমার এখানে রান্না বান্না করে দিয়ে যেত। বাচ্চাও বেশ সামলাতে জানে। আগে এমন অনেক কাজ করেছে। যদিও মাইনে একটু বেশি খোঁজে কিন্তু বেশ বিশ্বস্ত এবং পরিচ্ছন্ন মেয়েমানুষ। তার কাজ আপনার পছন্দ হবেই। আপনি আপাতত কয়েকদিন ছেলের সাথে সময় কাটান। ন্যানিকে সুবিধা মনে হলে ডিউটিতে জয়ন করবেন, অপছন্দ হলে আরও একটা দেখা যাবে। যেহেতু এমন হঠকারিতা দেখিয়ে ফেলেছেন আপাতত সিচুয়েশনটা মোকাবেলা করতে হবে। এমন দুধের শিশুকে সামলানো শুধু কঠিন নয় তুলনামূলক যুদ্ধের সমান। এই যুদ্ধে আপনাকে জয়ী হতে হবে। আর কোনো পথ খোলা নেই।

সকালের দিকে ফর্মূলা দুধের বস্তা নিয়ে এসেছেন উনার এসিসট্যান্ট। ডোডো তখন ঘুম। রাতে একটুখানি সাবুদানা খেয়েছে। একটু মধু। মধুটা বোধহয় ওর ভালো লেগেছিলো। তাই আরও খেতে চেয়েছে। কিন্তু বেশি খেলে পেট করবে তাই বেশি খাওয়ায়নি আজলান। বাকিটা রাত সে নির্ঘুম ছিলো। আসার পথে গাড়িতে অনেক ঘুমিয়েছে কিন্তু এখানে আসার পর তার চোখের ঘুম উদাও। থেকে থেকে কেঁদে উঠে মাকে ডাকছে।

ভোরের দিকে যখন একটু ঘুম এসেছিলো চোখে তখন আজলানের বুকে খামচি দিচ্ছিলো সে মা ভেবে। বুকে মুখ গুঁজে হাপুসহুপুস করছিলো মাতৃদুগ্ধের নেশায়। আজলানের বুকটা তখন কেঁপে উঠেছিলো ছেলের এমন ছটফটানি দেখে। মায়ের স্পর্শ না পেয়ে, সে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়লো।

বিছানায় বসে ফর্মূলা দুধ তৈরির রুলসগুলো পড়ছিলো আজলান। বাইরের হিমেল হাওয়ায় ঘরের পর্দা দুলছে, ঠিক তখনি মনে হলো সেটা কারো শাড়ির আঁচল। সে কাগজের দিকে চেয়ে আপনমনে বলল,

” মেহবুব, দেখো তো কতখানি গরম পানির মধ্যে কতটুকু পাউডার মিক্স করতে হবে। ”

কথাটুকু মুখ ফস্কে বেরিয়ে আসার পর চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখলো সেটা পর্দা। মাথা ঝাড়া মেরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। কেউ ছিল না?
তন্মধ্যেই জাফর স্যার গটগট পায়ে হেঁটে এসে বললেন,

” ও চলে এসেছে ডেপুটি সাহেব। আপনি আসুন। ডোডো তার কোলে আছে। ”

আজলান উনার সাথে সাথে বেরোলো ঘর থেকে। বাড়ির বাইরে আউটডোর টেবিলের উপর ডোডোকে বসিয়ে হাতদুটো ধরে রেখে উনি ডোডোর দিকে তাকিয়ে আছেন একনাগাড়ে। ডোডোও উনাকে মনভরে দেখছে। বাবার আগে হয়ত সে নির্বাচন করছে এই মহিলার কাছে সে থাকবে কি থাকবে না। নাকি মাকে খুঁজছে?

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো। আজলান এসে একপ্রকার কেড়ে নিল মহিলাটির কাছ থেকে। শান্ত করাতে করাতে বলল,

” ওইতো তোমার মা এসেছে। ”

ডোডো, ” মাম মাম মা ” শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। একটু শান্ত হয়ে আসতেই আজলান মহিলাটির সাথে কথা বলতে এগিয়ে এল। শক্তপোক্ত মজবুত শরীরের গাঁথুনি মহিলাটির। রোবটের মতো প্রতিক্রিয়াহীন মুখের আদল, এবং চোখের দৃষ্টি। অপ্রয়োজনীয় কোনো কথাবার্তা বললো না। বাড়ির দেখভাল থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, বাচ্চার দেখাশোনা সব করতে ওস্তাদ সে। বয়স আঠাশ উনত্রিশ হবেই। মোটা অংকের একটা অ্যামাউন্ট তাকে দিতে হবে। আজলান বলল,

” রান্না-বান্নার কথা পরে আপনাকে সর্বপ্রথম বাচ্চা সামলাতে হবে। ও যেন একটুও না কাঁদে, একটুও ওর মাকে না খোঁজে, এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। ”

মহিলাটিকে ভাবুক দেখালো। ডোডোর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,

” আপনি চিন্তা করবেন না। ওর চাইতে বেশি দুষ্টু বাচ্চা সামলানোর অভিজ্ঞতা আমার আছে। ”

ডোডো গালে একটা আঙুল ঢুকিয়ে রেখে মহিলাটির দিকে চেয়ে আছে। মহিলাটি তার দিকে তাকানোমাত্রই সে আজলানের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা ফেলে ডাকলো,

” আম মাম মা। ”

জাফর আহমেদ বললেন,

” কাল থেকে আমার বউরাণীও আসবে। চিন্তা নেই মিস্টার শেখ। আপনার বাচ্চা যদি মায়ের মতো হয় তাহলে মানিয়ে নিতে পারবে। বাবার মতো হলে বলতে পারছিনা। ”

আজলান টের পেল কথার পিঠে সূক্ষ্ম খোঁচার আঁচ। মহিলাটির মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। একনাগাড়ে ডোডোর দিকে চেয়ে আছেন। ডোডোর আবারও কান্না শুরু হলো। আজলান জিজ্ঞেস করলো,

” আপনি কবে থেকে আসছেন? ”

মহিলাটি জবাব দিল।

” এখন থেকে। আমার স্যুটকেস অলরেডি বাড়ির ভেতরে। স্যার আমার এডভান্স পেমেন্টের কথা বলেছেন? ”

জাফর স্যার বললেন,

” ইয়েস। মিস্টার শেখ আপনাকে বলেছিলাম। ”

আজলান বললো, ” সন্ধ্যায় পেয়ে যাবেন। ”

” থ্যাংকস। ”

আজলান বলল, ” ওকে এখন শান্ত করাতে পারবেন প্লিজ? ”

মহিলাটি হাত বাড়িয়ে ডাকতেই ডোডো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো আরও জোরে। আজলানের কোল থেকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আজলান পিঠে আলতো চাপড় দিতে দিতে বলল,

” কিছু খাবে বাবা? ”

ডোডো কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুললো। জাফর আহমেদ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলল,

” সে তার মাকে মিস করছে। ”

আজলান বলল,

” আমি দিনের পর দিন দূরে থাকি। আমাকে এভাবে মিস করেনা? ”

” কি হিংসুটে আপনি ডেপুটি সাহেব! ”

আজলান মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জোরালো একটা শ্বাস ফেলে ডোডোকে বলল,

” ওই দেখো তোমার মা। মেহবুব, তোমার ছেলেকে নিয়ে যাও। ”

ডোডো বাবার আঙুলের ইশারায় বেড়ে উঠা ঝোপঝাড়গুলোর দিকে চেয়ে কাঁদতে থাকে। মহিলাটি এসে সামনে দাঁড়ায়। নিউজ প্রেজেন্টারদের মতো করে শাড়ি পড়া। মাথার চুলগুলো পেছনে গুছিয়ে বাঁধা। বলল,

” আমাকে দিন। ও হয়ত পটি করবে। ”

আজলানের ভুরু কুঁচকে এল। মহিলাটি কোলে নিয়ে বলল,

” দয়া করে কার পটিটা এনে দিন। ”

আজলান দ্রুত গতিতে ঘর থেকে কার পটি নিয়ে এল। মহিলা ডোডোকে পটিতে বসিয়ে দিতেই সে শান্ত হয়ে এল। আজলান অবাক চোখে চেয়ে বলল,

” বুঝলেন কি করে? ”

মহিলাটি বলল,

” আমি অবাক হচ্ছি আপনি এতদিন বাচ্চাটাকে রেখেছেন কিভাবে? ওর মা বিয়োগের কতদিন হলো? ”

আজলানের পিলে চমকে উঠে বলল,

” ওর মা? ওর মা আছে। ”

মহিলার অবাক চাহনির সাথে সাথে প্রশ্ন ছুটে এল।

” কোথায়? ”

আজলান খানিকটা ধমকের সুরে বলল,

” আপনি আপনার কাজ করুন। এই ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন নয়। চেষ্টা করুন ওর প্রিয় হয়ে উঠার। ভীষণ মা পাগল ছেলে। মায়ের গা ঘেঁষে থাকার অভ্যাস। ওটা ছাড়াতে হবে। ”

” আমি চেষ্টা করবো। ”

______

ঘরটা গোছগাছ করতে লেগে পড়েছিলো আজলান। ডোডোর জন্য কিছুতে হাত লাগাতে পারছিলো না। সব ঠিকঠাক করার সময় মহিলাটি দরজায় কড়া নাড়লো।

” আইজানের যাবতীয় জিনিসপত্র যদি আমি আমার ঘরে রাখি তাহলে আমার জন্য ভালো হয় স্যার। নইলে আপনাকে ডিস্টার্ব করতে হবে। ”

আজলান বলল,

” নিয়ে যান। এই গোটা ব্যাগটাতে ওর জিনিসপত্র।”

মহিলাটি সব নিয়ে যেতেই ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। আজলান চুপিসারে ওই মহিলার ঘরে গিয়ে উঁকি দিতেই দেখলো ডোডো শুয়ে আছে, বালিশের সাথে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে ফিডারটি, নিপল মুখে নিয়ে সে চোখ বুঁজে ঘুমোচ্ছে। আজলান বলল,

” ও কি ঘুমিয়ে গিয়েছে? ”

মহিলাটি চমকে উঠে তার কন্ঠস্বর শুনে। বলে,

” হ্যা একটু ঘুম এল। মনে হচ্ছে না বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে। আমাকে চিনতে ওর সময় লাগবে। ”

আজলান বলল,

” ঘুমালে আমার ঘরে রেখে আসবেন এরপর থেকে। ”

” আচ্ছা। ”

ঘরে ফিরে যাওয়ার সময় আজলান ঘাড় ফিরিয়ে ঘরটার দিকে তাকালো। অল্পসময়ের মধ্যে মহিলাটি ঘরটা গুছিয়ে ফেলেছে দক্ষ হাতে। বেশ পরিচ্ছন্ন মনে হলো। আজলান একটু ভারমুক্ত হলো। এমনিতেই সে টেনশন ফ্রি থাকার চেষ্টা করছে। নিজেকে বোঝাচ্ছে সবটা নর্মাল। কিচ্ছু হয়নি কিন্তু ডোডোর কান্না সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। ডোডোর রাতের কান্না বড্ড ভয়ংকর লাগে তার। অনেকটা কষ্ট, হাহাকার, মিশে থাকে সেই কান্নায়। সময়টা তখন ফুরোতেই চায় না।

__________

মহিলাটি কাজকর্মে দারুণ পটু। একহাতে রান্না সামলে ডোডোকে সামলাচ্ছে। কোনোকিছুতে বিরক্ত নেই যদিও তাকে রান্না কাজে রাখা হয়নি কিন্তু জাফর আহমেদ স্যারের ওয়াইফ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তিনি রান্না বান্না করতে পারবেন তাই রান্নার অনুরোধটা উনারই। আলাদা করে রান্নার লোক রাখার চাইতে সেই টাকাটা উনাকে দিলে সে আরও যত্নের সাথে কাজ করবে। যেহেতু তার কাজ পরিপাটি সেহেতু উনি এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন। দুপুরে ডাল, আলু ভর্তা, পাবদা মাছের ঝাল, মুরগীর মাংস রেঁধেছে মহিলাটি। জাফর স্যারের ওয়াইফ দশটার দিকে এসেছেন। খেতে খেতে বললেন,

” ভালো রেঁধেছ শায়লা। তুমি কখন খাবে? ”

” আপনারা খেয়ে নিন। তারপর। ”

জাফর আহমেদ খেতে খেতে বললেন,

” ডেপুটি সাহেবের কেমন লাগছে রুমার রান্না? ”

আজলান খেতে খেতে মাথা নাড়লো। আর আপন মনে ভাবলো কবে তিথির হাতের রান্না খেয়েছে সে। মনে নেই ঠিক। বিয়ের পরের দিনগুলোর মধ্যে কোনো একদিন মাছের ভেতর চুল পাওয়ার পর মাকে সে বারণ করে দিয়েছিলো তিথিকে রাঁধতে না দেয়ার জন্য। ওর ঘাড়ে কাঁটা বাছার দায়িত্ব পড়েছে তারপর থেকে। রান্না মা করতো, নইলে রমলা চাচী। চুল দেখে আজলান না খেয়ে উঠে গিয়েছিলো সেদিন।

” ভালো হয়নি স্যার? ”

আজলান শব্দ করলো, ” হুহ, ভালো। ”

জাফর আহমেদ হেসে বললেন,

” ডেপুটি সাহেব আমার বিবির হাতের শুঁটকির ঝাল ভুনা না খেলে আপনার জীবন বৃথা। আহ! জিভে জল চলে এল। কাল রতনকে বলব। ও শুঁটকি দিয়ে যাবে তুমি একটু রসুন বেশি করে দিয়ে শুঁটকি ভুনা রেঁধো তো। ”

উনার বিবি তাহেরা বেগম হেসে বললেন,

” যেভাবে বলছো মনে হচ্ছে কি এক অমৃত! ”

” তুমি বুঝবে না বুঝবে না। তোমাকে শ্রেষ্ঠ রাঁধুনির খেতাব দিলেও কম হবে আর সেই তুমি নিজের রান্নাকে এত তুচ্ছজ্ঞান করো। ভেরি ব্যাড। হেই জেন্টলম্যান আপনি শুঁটকি খান না মনে হয়? ”

আজলান অপ্রতিভ হেসে বললো,

” না সরি। ”

টেবিলে ধড়াক করে চড় মেরে উনি বললেন,

” আমার বিবির শুঁটকির ঝাল ভুনা খেলে আপনি শুঁটকির ফ্যান হয়ে যাবে। বন্দরের মানুষ হয়ে শুঁটকি খান না এ কেমন কথা ডেপুটি সাহেব? এ তো ভারী লজ্জার। আপনার বিবি কি শুঁটকি রান্না জানে না? ”

আজলান খেতে খেতে বিষম খেল। তাহেরা বেগম পানি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

” তুমি বড্ড বকো। খেতে দাও ছেলেটাকে। ”

তক্ষুণি ঘুমঘুম চোখে উঠে এল ডোডো। শায়লার কোল থেকে বাবার দিকে পিটপিট করে চেয়ে আছে। তাহেরা বেগমকে পেছন থেকে দেখে খুশিতে দুহাত একত্র করে তালি দিল। তারপর উনার কাছে হামলে পড়ার জন্য হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে ডাকলো,

” আম মাম্মা! ”

তার আদুরে কন্ঠস্বর শুনে তাহেরা বেগম ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে হাসলো।

” বাবুসোনা উঠে গিয়েছে। ভাত খাবে তুমি? ”

ডোডো উনার মুখের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। উনি কোলে নিতে যাবে তক্ষুণি শায়লাকে ঝাপ্টে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। যেন ধোঁকা দিয়েছে তার মা তাকে। এবারের কান্না আরও জোরালো। আজলান ভুক্তাবশেষ রেখে উঠে গেল হাত ধুয়ে। দোল দোল দিতে দিতে দোতলার বারান্দায় চলে গেল। বলল,

” ওই-যে মা। ডোডোর মা। এই দ্রুত আসো। নিয়ে যাও।”

ডোডো শান্ত হলো না। করুণ সুরে মা মা শব্দে কাঁদতে লাগলো। আজলানের বড্ড মায়া হলো। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে খেয়াল করলো তার কাঁধটা ডোডোর চোখের জলে ভিজে উঠেছে।

_________

শায়লা সবটা সামলে নিতে পারছে দেখে আর তাহেরা বেগমের হাতে ডোডোকে রেখে নিশ্চিন্তে কাজে এসেছে সে কিন্তু মনটা সেখানে পড়ে রইলো। ডোডো কিছুক্ষণ পর পর তার মাকে খুঁজছে। ফিডার মুখে তুলছেনা। ভাত একদমই খাওয়ানো যাচ্ছে না তাকে। তিথি চা খাওয়ার সময় ঠান্ডা করে ডোডোকেও চা খাওয়াতো। আজলান সকালে সেভাবে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে। ডোডো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শায়লাকে বললে শায়লাও চেষ্টা করলো খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু ডোডো মুখে নিল না। আজলান মনে করার চেষ্টা করলো তিথি তাকে কি বলে বলে খাওয়াতো। সে কত কথা! যুক্তিহীন, উজবুক আর আজগুবি কেচ্ছা কাহিনী। কথার কোনে আগা নেই, মাথা নেই। সেসব শুনে ডোডো খিলখিল করে হাসতো আর সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে চা টানতো চামচ থেকে। যন্ত্রমানবী শায়লা এসব কিছুই জানেনা। তাই ডোডোর খাওয়াও হলো না। প্রচন্ড খিদে পেলে তখন ফিডার টেনে মুখে দেয়। কয়েক চুমুক খেতে খেতে কেঁদে উঠে। আজলান অবাক হয়। এইটুকুনি ছেলে মাকে কি সুন্দর চিনে ফেলেছে, মায়ের আদর, কথা, ছোঁয়া, অনুপস্থিতি সব সে বোঝে।

যেহেতু কর্মস্থল কাছে সেহেতু সে দ্রুত ফিরে আসে। আজ দ্রুত ফেরার পর শুনতে পেল ডোডোর কান্না। তাহেরা বেগম বললেন,

” এমনি এমনি কাঁদছে। কোনো কারণ ছাড়া। এ কেমন ছেলে? ”

আজলান শায়লাকে ডাকতেই সে হাজির হলো তৎক্ষনাৎ। হাতে বাটি। তাতে সেদ্ধ নুডলস। বলল,

” সরি স্যার। ও কিছুতেই খেতে চাইছেনা। দুপুরে একটা লোকমা খাওয়াতে পেরেছি কোনেমতে কিন্তু সেটাও বমি করে দিল। এরকম চলতে থাকলে ও অসুস্থ হয়ে পড়বে। ”

আজলান ডোডোকে কোলে তুলে জড়িয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বিরক্তিকর এবং ঝাঁজালো সুরে বলল,

” মায়ের মতো করে খাওয়াতে জানতে হয়। আপনি দেখছি কিছুই পারেন না । ”

শায়লা একটু রাগান্বিত স্বরে বলল,

” কি পারিনা? ”

” আপনার ট্রেনিং কাঁচা। বেবি ফ্রেন্ডলি হতে হবে আপনাকে। একজন মা বাচ্চাকে যেভাবে ট্রিট করে সেভাবে। ”

বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে ঘরে চলে গেল সে। ডোডো একটু ঘুমিয়ে এলেই আজলান তাক সযত্নে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গালে, কপালে, হাতের তালুতে চুমু দিল। ইউনিফর্ম চেঞ্জ করার জন্য প্রস্তুত হতেই শায়লাকে খেয়াল করে বলল,

” এনিথিং রং? ”

” আমাকে শিখিয়ে দিন কিভাবে মায়ের মতে ট্রিট করবো বেবিকে। ”

আজলান বলল,

” মায়েরা সবসময় ফিটফাট যন্ত্রের মতো গোছানো থাকেনা, যার কোলে উঠলে বাচ্চারা স্বস্তি পায়। আপনি আগে সেসব আয়ত্ত করুন। ”

শায়লা বলল, ” সরি স্যার আমি বুঝতে পারিনি। ”

আজলান বিরক্তি চেপে রেখে বলল,

” আপনি এমন রোবটের মতো চলাফেরা করলে, এমন সেজেগুজে ফিটফাট থাকলে, মেপে মেপে কথা বললে বেবি আপনার সাথে ভাব জমাবে কেন?”

শায়লা বলল, ” তাহলে কি করব? ”

” এখন আমাকে ট্রেনিং দিতে হবে? তাহলে আমি আপনাকে রেখেছি কেন? ”

শায়লা চোখ নামিয়ে বলল,

” সরি স্যার। আমি চেষ্টা করবো। ”

আজলান কপালে আঙুল বুলিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,

” ননসেন্স। ”

শায়লা চলে গেল। আজলান বিছানায় বসে ডোডোর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে রইলো।

চলমান

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_২০ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_২০
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আম্বিয়া বেগম বিলাপ করছেন। আফতাব সাহেব গম্ভীরমুখে বসে রয়েছেন। আম্বিয়া বেগম কপালে দুহাত চেপে রেখে বলে যাচ্ছেন,

” তোমার জন্য ওদের সংসারটা ভাঙলে আমি তোমাকে মাফ করবো না বলে দিলাম। তোমার হঠকারীতার জন্য ওদের মধ্যে এত ঝামেলা হচ্ছে। তোমরা বাপ মেয়ে মিলে আমার সোনার সংসারটা ভাঙছো। মাফ দেব না তোমাদের আমি। ”

আফতাব শেখের মুখে কথা নেই। তিনি একদৃষ্টে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। আর ভাবছেন আজলান শেখের কথা। উনাকে শায়েস্তা করার জন্য সে এখন যা খুশি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বউয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথাও ভাবতে পারে কারণ বউটাকে তিনি পছন্দ করে এনেছেন। তাই সব দোষ এখন বৌয়ের ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। এখন তিনি কোনো কথা বলবেন না। সে কতদূর যেতে পারবে তিনি তা দেখবেন।

ডোডো কাঁদছে। আয়জাও কাঁদছে তার সাথে। সে মায়ের কাছে যেতে চাচ্ছে কিন্তু এখন ওখানে যাওয়া সম্ভব না। ছোট বাটিতে করে সেদ্ধ নুডলস নিয়েছে সে। ডোডো সেটা মুখেও নিচ্ছেনা। সে মায়ের কাছেই যাবে।

তিথি স্যুটকেসে কাপড়চোপড় সব ভরতে ভরতে হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছলো। এই শেখ বাড়িতে হয় সে থাকবে, নয় আজলান শেখ।
আজলান শেখ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এমন চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী বউয়ের সাথে সে সংসার করবে না। বিশেষ করে যে বরের কথা না ভেবে শ্বশুরের হয়ে কাজ করে তার সাথে তো নয়ই।

তিথি কোনটা চায় জিজ্ঞেস করার পর তিথি জানিয়েছে সে চলে যাবে। বাড়ির ছেলে বাড়িতে থাকুক। আম্বিয়া বেগম কাঁদছিলেন ছেলে চলে যাবে শুনে। কারণ কিছুবছর আগেও সে একবার ঘর বিমুখী হয়েছিলো, একবার ঘর বিমুখী হলে তাকে ঘরমুখো করতে অনেক পোহাতে হবে।
সে এমন এক পাষাণ, বর্বর হৃদয়ের মানুষ যে স্বজনদের ছায়ায় থাকতে না পারলেও বেশ ভালোভাবে বাঁচে।

শ্বাশুড়ির কান্না দেখে তিথি বুঝে গিয়েছিলো তিনি চাইছেন তিথি এমনটাই বলুক। কারণ ঘরের বউ একবার চলে গেলে আবার ফিরিয়ে আনা যাবে খুব সহজে। সে বেশ সহজলভ্য কিনা।
কিন্তু ছেলে গেলে ফিরিয়ে আনা দুষ্কর।

আফতাব শেখ ছেলের প্রতিশোধের ধরণ দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন। উনাকে সে জিততে দেবেনা কিছুতেই। তাই তো কথার পিঠে কথার জবাব না দিয়ে একেবারে মোক্ষম জায়গায় ছালটা দিয়েছে।

রমলা চাচী তিথির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে কাপড় ভরা শেষে বলল,

” ডোডোকে একটু এনে দাও চাচী। ”

রমলা চাচী বললেন,

” পারুম না। ওরে আনা বারণ। ”

তিথি অবাককন্ঠে বলল,

” কেন? ”

” কেন মানে? তুমি একা যাইতেছ তোমার বাপের বাড়িতে, তোমার বাবুরে নিয়ে যাইতে পারবানা। ”

তিথি জিজ্ঞেস করলো,

” আজলান শেখ বলেছে? ”

” হ বলছে। এবার তুমি খুশি হইছো? যাও এবার নাচতে নাচতে বাপের বাড়ি যাও। এটাই চাইছো সবাই। তুমি চলে যাইতেছো যাও, আমিও চইলা যামু। এই বাড়িতে আর কাজকাম করুম না। ”

তিথি স্যুটকেসটা গুছিয়ে ঘরের বাইরে এনে রাখলো। আজলানের সাথে আজ নতুন ড্রাইভার এসেছে। তিনি কাকাদের বয়সী। উপরে উঠে তিথির স্যুটকেসটা নিয়ে গেল। আম্বিয়া বেগম তা দেখে আফতাব শেখকে বললেন,

” তুমি আটকাবে না? কিচ্ছু বলবে না? ”

আফতাব শেখ বললেন,

” এখন তোমার ছেলের হাতে পায়ে ধরতে হবে আমাকে? ও চাইছে আমি ওর হাতেপায়ে ধরে অনুরোধ করি। যাক। বউটাকেও সম্মানে করে উল্টে ফেলছে এমনও না। যাক, কিছুদিন পর নিজে গিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। বউ তার। মাথাব্যথাও তারই হবে। বাচ্চাকে না দেখে ক’দিন থাকতে পারব ”

আম্বিয়া বেগম কপাল চাপড়ে বললেন,

” বাচ্চাকে দিচ্ছে না ও। আমি এতক্ষণ কাকে কি বলছি? ডোডো ওর মায়ের সাথে যাবে না। ”

আফতাব শেখ রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। বললেন,

” মগের মুল্লুক নাকি? ও এখনো মাকে ছাড়া থাকতে শিখেছে? বর্বর ছেলে। নিজের বাচ্চার প্রতিও তার মায়া মহব্বত নেই। ”

আম্বিয়া বেগম কাঁদতে লাগলেন।

” তুমি করেছ যা করার। আমি কতকিছু সহ্য করি ওদের সংসারটা টিকিয়ে রাখার জন্য। কতকিছু লুকিয়ে যাই। কতকথা চেপে রাখি। তুমি সব শেষ করে দিয়েছো। তোমাকে আমি মাফ দেব না। ”

আফতাব শেখ বললেন,

” আসল কথা হচ্ছে ওর বউয়ের প্রতি ওর নিজের মায়া মহব্বত নেই। কোনোমতে সংসার করছে। বউ চলে যাচ্ছে ভালো করছে। আরও আগে যাওয়া উচিত ছিল।”

ডোডোর কান্না ভেসে আসছে। আয়জা দোল দিতে দিতে বলল,

” চাচী ওর মা কোথায় এখন? ”

রমলা চাচী বলল, ” বেরিয়ে গেছে। ”

আয়জা অবাককন্ঠে বলল, ” কখন? না বলে? ”

সে ডোডোকে নিয়ে দ্রুতপায়ে নেমে গেল।

__

আজলান সুইমিংপুলের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। তিথি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে আজলান ঘাড় ফিরাতেই তাকে বোরকা পড়া দেখে বলল,

” আগে থেকেই মনে হয় প্রস্তুত ছিলে যে চলে যাবে। দারুণ। যাও যাও। বাড়িঘর খালি করো। আফতাব শেখ বুঝুক হঠকারিতার ফল কি হতে পারে। ”

তিথি বলল,

” ডোডোকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। ”

আজলান চোয়াল ঝুলিয়ে বলল,

” কোথায়? ”

” আমার সাথে। ”

” ওর ডায়াপার কেনা থেকে ঔষধ খরচ তুমি কিভাবে সামলাবে? বললেই হলো? ”

তিথি বলল, ” হয়ে যাবে। ”

” হয়ে যাবে বললেই আমি মানবো কেন? বাড়ির ছেলে বাড়িতে থাকবে। তোমাকে আমি যেতে বলছিনা তুমি নিজেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছ। তাহলে একা যাও। আমার ছেলেকে টানবে না। ”

তিথি বলল,

” ওর দুধ ছাড়ানো হয়নি এখনো। শুধু রাতে ভাত খায় তাও কম। ”

” সেসব আমি দেখবো। ”

তিথি বলল,

” ও এখনো আমাকে ছাড়া থাকতে শেখেনি। ”

আজলান গর্জে বলল,

” তো থাকো তোমার ছেলেকে সাথে নিয়ে তোমার শ্বশুরবাড়িতে। ”

” থাকব না। ”

” তাহলে যাও। তোমার চেহারা আর দেখিওনা আমাকে।”

আম্বিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলেন। বললেন,

” আজলান, এমন করিস না আব্বা। তোর বউ বাচ্চার প্রতি কি তোর একটুও মায়া মহব্বত নেই? বাপের উপর রাগ করে ওদের কষ্ট দিস না আব্বা। তুই তোর বউ বাচ্চাকে নিয়ে অন্যত্র চলে যা। তোকে তোর আব্বার সাথে থাকতে হবে না। তোর সেই ক্যাপাসিটি আছে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে ঝামেলা তৈরি করিস না। ”

আজলান বলল,

” তোমার কি মনে হয় শুধু আফতাব শেখ আমাকে অপমানিত করতে চেয়েছিলো? ও চায়নি? ও নিজেই রাস্তা খুঁজছিলো আমাকে অপমান করার। আমি আর কারো কথা ভাববো না। না ওর, না তোমাদের, না আয়জার। ”

আম্বিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

” তোর আব্বার উপর রাগ করে আমাদের কেন শাস্তি দিচ্ছিস? ”

” দোষ শুধু উনার নয়। যারা যারা জড়িত ছিল সবার। ”

তিথি বলল,

” মা তুমি কেঁদো না। আমি স্বেচ্ছায় যাচ্ছি। ”

আম্বিয়া বেগম তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। তিথি উনাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আজলানের দিকে চেয়ে রইলো। আজলান মুখ ঘুরে দাঁড়িয়ে রইলো।

মাকে দেখামাত্রই আয়জার কোলে ঝাপটাঝাপটি শুরু করে দিয়েছে ডোডো। চোখের পানিতে গাল ভিজে আছে। তিথি তাকে কোলে নিয়ে দুগালে, কপালে আদর করলো। গাল মুছে দিয়ে গালে গাল ঠেকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো। রমলা চাচী মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে কাঁদলো তার সাথে। আম্বিয়া বেগম কেঁদে উঠে স্বামী সন্তানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

” ছোট বাচ্চাটার উপরও মায়া লাগে না তোদের। তোরা বাপ ছেলে থাক তোদের জেদ নিয়ে।
তুইও কেমন রে বউ? এতদিন হয়ে গেল এই সংসারের প্রতি তোর মায়া জন্মায়নি। তোকে বললো আর তুই চলে যাচ্ছিস। আমার সংসারটা গেল ছারখার হয়ে। ”

ডোডো মায়ের কোলে এসে শান্ত হয়ে গেছে। মাকে কাঁদতে দেখে সে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে ডাকলো, ” আম্মাহ আম্মাহ। ”

তিথি বলল, ” জি। ঘুম ঘুম। ”

ডোডো মিছিমিছি চোখ বন্ধ করলো। তিথি তার গালে পুনরায় চুমু খেয়ে আয়জার কোলে দিয়ে দিল। আম্বিয়া বেগম ধরে রেখে বললেন,

” আগে তো যেতে চাইতিনা বউ। আজ এভাবে চলে যাচ্ছিস কেন? তুই যাস না, তোর বরকেও যেতে দিস না। তোরা থাক। আমরা চলে যাই কোথাও। তোর বাবুর মুখ চেয়ে থেকে যা। ওকে সামলাবো কেমন করে? ”

তিথি এর জবাব দিতে পারলো না। শাস্তিটা তার প্রাপ্য। আর আজকের সিদ্ধান্তটা শুধু নিজেকে শাস্তি দেয়ার জন্য নয়। উপলব্ধি করা কতটুকু জড়িয়ে আছে সে এই সংসারের সাথে, যার ঘর করছে তার সাথে। তার আজ যাওয়া উচিত।

আয়জা আজলানের ইশারায় ডোডোকে বাড়িতে ঢুকিয়ে ফেলেছে। সে চেঁচিয়ে কাঁদছে। তিথি গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই আম্বিয়া বেগম ধরে রেখে বলল,

” যাস না বউ। তোর পাগলামি আমি মেনে নিছি, তোর শ্বশুর মেনে নিছে। এই বাড়িটা তোর শ্বশুরের। তোর থাকার অধিকার আছে। ”

তিথি ঝরঝরে কেঁদে ফেলে বলল, ” যে মানার সে মেনে নেয়নি। মানুক সেটাও চাই না। ”

” আর কবে ফিরবি? তোর বাবুর কথা ভাববি না?”

” ওর কথা ভেবেই চলে যাচ্ছি। বুদ্ধি হওয়ার পর যাতে ওকে দেখতে না হয় ওর মা একজন পাগল, শুনতে নয় হয় ওর মা বস্তি থেকে উঠে এসেছে। কারো যোগ্য বউ হওয়ার কোনো দরকার নেই আমার। আমি একজন যোগ্য মা হতে চাই। ওর বাবা ওকে ভালো রাখবে। তাই আমার কোনো চিন্তা নেই। ”

” তুই কেমন পাষাণ মা? ”

” তোমার ছেলে ভালো বাবা হোক। ”

আম্বিয়া বেগম চিৎকার করে কাঁদলেন। আজলানকে বললেন,

” তুইও চলে যা। তোকেও দরকার নেই আমার। তোরা সবকটা আমার সংসার ভেঙেছিস। যাহ তোকে দরকার নেই আমার। ”

তিথি গাড়িতে উঠে গেল। আজলান গাড়ির কাছে এসে বলল,

” তুমি সত্যি সত্যি যাচ্ছ মেহবুব? ”

” হ্যা। ”

আজলান ড্রাইভারকে বলল,

” নিয়ে যান। ”

গাড়ি ছেড়ে দিতেই আম্বিয়া বেগম বাচ্চাদের মতো করে কাঁদতে লাগলেন। রমলা চাচী টেনে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল উনাকে। আজলান বাড়িতে ঢোকার সময় থমকে দাঁড়ালো আফতাব শেখের কাছে গিয়ে। বাবা ছেলে একে অপরের দিকে রোষাগ্নি দৃষ্টিতে চাইলো। আফতাব শেখ বললেন,

” বাড়িটা আমার। বাড়ির বউকে তাড়িয়ে তুমি থাকবে তা কি করে হয়? ”

আজলান বলল,

” ডোডোকে নিয়ে আজকেই চলে যাব আমি। আপনার বাড়িতে আমি কিংবা আমার আওলাদ কেউ থাকবে না। ”

আফতাব শেখ কম্পিত কণ্ঠে বললেন,

” আমার বংশধরকে কোথাও যেতে দেব না আমি।”

” আটকে দেখান। ”

আফতাব শেখ বললেন, ” তোমার পায়ে পড়তে হবে এখন? ”

” আপনার কাছে কোনোকিছুরই এক্সপেকটেশন রাখিনা আমি। আমার বিরুদ্ধে আমার বউকে উষ্কেছেন, বাচ্চাকেও উষ্কাতে পারেন। আপনার সান্নিধ্যে কাউকে রাখবো না। ”

আফতাব শেখ শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন,

” তাহলে একটা কথা কান দিয়ে শুনে রাখো। এই বাড়িতে তোমার আর জায়গা নেই। ”

আজলান ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,

” এটা বলবেন জানতাম। তাই অবাক হইনি। ”

” বড্ড জেদি হয়েছ তুমি। ”

” জন্মদাতার মতো। ”

ডোডোকে নিয়ে রাতারাতি বান্দরবান পাড়ি জমিয়েছে আজলান।

চলমান….

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_১৯ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১৯
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

বাথরুমে পড়ে মাথা ফেটে গেছে তিথির। হাতের কনুইতে আঘাত লেগেছে। পায়ের বুড়ো আঙুলটা মুচড়ে গেছে। হাসপাতালে সতের ঘন্টা কাটিয়ে এসে বাড়িতে রেস্ট নিচ্ছিলো সে। আজলান সদর দপ্তরে গিয়েছে চারদিন হলো। এরিমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে।

তিথি সেদিন শ্বশুরমশাইকে যারিফের কথা বলেছিলো। শোনার পর উনি কোনো মন্তব্য করেননি। তিথি ভয় পেয়ে গিয়েছিলো উনার নীরবতা দেখে কিন্তু খাওয়ার টেবিলে ছেলেকে হঠাৎ চ্যালেঞ্জ করে বসবেন এটা তিথি কল্পনাও করেননি। বাপ ছেলে দুজনেই ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড়।

আজলান যাওয়ার পরদিনই যারিফের বাড়িতে গিয়েছেন আফতাব শেখ। কথাবার্তা সেড়ে এসেছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দুজনের আকদ পড়িয়ে রাখবেন। যারিফের চাকরি হলে তখন তারা বউ তুলে নিয়ে যাবে। এইকথা আয়জা, তিথি আর উনি ছাড়া কেউ জানেন না। আম্বিয়া বেগম সন্দেহের চোখে দেখছিলেন সবাইকে। কিছু একটা হচ্ছে যেটা উনি বুঝতে পারছেন না। আজলান আজ ফিরবে। উনি ঠিক করলেন সবটা আজলানকে খুলে বলবেন।

আফতাব শেখ সন্তুষ্ট যারিফের বাবা মায়ের সাথে কথা বলে। যারিফ এমনিতেও শিক্ষিত ছেলে। তার একটা নাম আছে। পাশাপাশি ড্রাইভিং শিখেছিলো শখ করে। কিন্তু সেটাও আয়ের পথ বের করবে তা সে ভাবেনি। আজলান শেখের ড্রাইভার হিসেবে তিন বছর ধরে কাজ করে আসছে সে। এর আগে অনেকগুলো ড্রাইভার বদল হয়েছে আজলান শেখের। বেশিদিন টিকতো না কেউ। যারিফ কিভাবে স্থায়ী হয়ে গিয়েছে তা যারিফ নিজেও জানে না। তাই হয়ত সে স্যারের বিশ্বাসে আঘাত দিতে চাইনি। চেয়েছিলো নিজেকে যোগ্য করে তবেই সামনে গিয়ে দাঁড়াবে কিন্তু তার আগেই সব এলোমেলো হয়ে গেল। আফতাব শেখের সিদ্ধান্তেও সে খুশি হয়েছিলো এমন না। স্যারের কথা ভাবতেই তার খারাপ লাগছিলো। সে এমনটা চায়নি। একটু একটু করে অর্জন করা স্যারের সব বিশ্বাস, ভরসা এক লহমায় ধূলিসাৎ হয়ে যাবে যখন তিনি জানতে পারবেন উনার পিতার সমস্ত ষড়যন্ত্রের পেছনের শক্তপোক্ত হাতিয়ারটা সে নিজেই।

আফতাব শেখ সন্ধ্যা থেকে হৈহৈ করছিলেন আনন্দে। পাত্রপক্ষের মামাকে যা বলার উনি বলে দিয়েছেন। আম্বিয়া বেগম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন সবটা শুনে। শুধুমাত্র ছেলেকে হারানোর জন্য উনি মেয়ের এত ভালো সম্বন্ধটা ভেঙে দিলেন? যারিফের কথা উনি তখনও জানতে পারেননি। সমস্ত রাগ, ক্ষোভ সব গিয়ে পড়লো আয়জার উপর। আফতাব শেখ কড়া হুশিয়ারি দিলেন।

” আমার বাড়ি এটা। আমার মেয়ের গায়ে হাত দেয়ার আগে দশবার ভাববে। ”

আম্বিয়া বেগমের পায়ের তলার মাটি যেন নড়ে উঠলেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না একজন বাবাও এমন করতে পারে। শ্বশুরমশাইয়ের হৈহল্লা আর গাড়ির হর্নের শব্দ কানে আসার পর তিথি নিজেকে ঘরে আর আটকে রাখতে পারেনি। বাবা ছেলের মধ্যে এখন শুরু হবে তুমুল যুদ্ধ। না আজলান শেখ দমবে, না আফতাব শেখ। দরজার নিকটে এসে দাঁড়িয়ে একনজরে বাবার দিকে চেয়ে রইলো আজলান। উনি আম্বিয়া বেগমকে বলে যাচ্ছেন,

” আমি এই বাড়ির মালিক। একমাত্র কর্তা। আমার সিদ্ধান্তই হবে শেষ কথা। আমার সিদ্ধান্তে আতিফার বিয়ে হয়েছে, আমার সিদ্ধান্তে ওর বিয়ে হয়েছে, আমার সিদ্ধান্তে আমার ছোট মেয়েরও বিয়ে হবে। আজলান শেখ, হা হা সে এখনো চেনেনি তার জন্মদাতাকে। সে চলে ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়। ”

আম্বিয়া বেগম শাড়ি আঁচল মুখে গুঁজে গুমরে কেঁদে উঠে বললেন,

” তুমি বাবা নও। তুমি একটা পিশাচ। ”

তিথির চোখদুটো তখনো আজলানের দিকে নিবদ্ধ। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে চেয়ে আছে আফতাব শেখের দিকে। আফতাব শেখের দৃষ্টি তার উপর পড়ামাত্রই তিনি হৈহৈ করে উঠে বললেন,

” আসুন আসুন ডেপুটি কমান্ডার সাহেব। আপনার জন্য সুখবর। ”

আজলান আঁড়চোখে তিথি আর আয়জাকে দেখে নিল। তারপর বলল,

” আপনি যা করেছেন তা ভালো করেননি। এরজন্য আপনাকে ভুগতে হবে। ”

আয়জা কাঁদছে। আজলান তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়জা মাথা নামিয়ে কেঁদে যাচ্ছে একনাগাড়ে। আফতাব শেখ বললেন,

” কাঁদছিস কেন? তোর কোনো ভাইয়ের দরকার নেই। আমি আছি। তোর জন্য আমি একাই যথেষ্ট।”

আম্বিয়া বেগম এসে বললেন,

” আব্বা তোকে কি ওরা ফোন দিছে? কিছু বলেছে? ”

আজলান রেকর্ড ছেড়ে দিয়ে উপরে চলে গেল চুপচাপ। তার অতি শান্ত কন্ঠস্বর, চলনবলন তিথিকে শেষ করে দিচ্ছে। রেকর্ডের প্রতিটা কথা আয়জার চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, আজলান শেখের মতো একজন ডেপুটি কমান্ডারের পেশাদারিত্ব আর সততার দিকে আঙুল তোলা, আফতাব শেখের মতো মানুষের দীর্ঘদিনের অর্জিত সুনামের উপর প্রশ্ন তোলা।

আম্বিয়া বেগম কাঁদতে লাগলেন। এত অপমান কার গায়ে সইবে?

_______

তিথি শরবতের গ্লাস নিয়ে ঘরে এসে আজলানকে খুঁজলো। ঘরে আলো নিভানো। কোচের উপর চোখ বুঁজে শুয়ে আছে সে। তিথি আলো জ্বালিয়ে দিয়ে বলল,

” তুমি ওসব কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। উনি উনার মেয়ের বিয়ে যেখানে ইচ্ছে সেখানে দিক। আয়জাও সেটাই চায়। ”

আজলান চোখ খুললো চট করে। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,

” তুমি জানো ছেলেটা কে? ও নাম বলেছে? ”

তিথি তার দিকে শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

” আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলব। এটা খাও আগে। ”

আজলান শরবতের গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললো। বলল,

” এবার বলো। ”

তিথি গ্লাসটা নিতে চাইলে আজলান বলল,

” নাম বলতে বলছি। ”

তিথি বললো,

” এমন করো না প্লিজ। তুমি এত টাকা পয়সা খরচা করে বিয়ে দিবে কিন্তু আয়জা সুখী না হলে তখন কি করবে? উনি উনার মেয়ের বিয়ে যার সাথে ইচ্ছে দিক। তুমি ওসব নিয়ে আর মাথা ঘামিও না। ”

আজলান গর্জে বলল,

” তোমাকে জাস্ট সত্যিটা বলতে বলছি ড্যাম। ”

তিথি কেঁদে উঠলো। আজলান কপাল চেপে ধরে বলল,

” তোমার মাথায় কি হয়েছে? ”

তিথি বলল, ” বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম। ”

আজলান তার ব্যান্ডেজ ছুঁয়ে বলল,

” ভালো কাজ করেছ। তোমার কাজ আমাকে জ্বালানো। তুমি এটা ছাড়া কিছু পারো না। ভবিষ্যতেও এই কাজটা করবে। ”

তিথি বলল, ” তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি।”

আজলান খেঁকিয়ে উঠে বলল, ” আমি কষ্ট পাচ্ছি তোমাকে সেটা কে বললো? আমি কষ্ট পাইনি। কষ্ট আমাকে ছুঁতে পারেনা। আমি অবাক হচ্ছি এটা ভেবে তারা বাপ মেয়ে মিলে আমার সাথে এমনটা কি করে করলো? ”

তিথি বললো, ” তুমি প্লিজ শান্ত হও। ”

আজলান বলল, ” না পারবো না। আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো। ও ছেলেটার নাম জানো না তুমি? কি নাম ওর? কোথায় থাকে? জানো না এটা বলো না। আকদের তারিখ পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে। ”

তিথি বিনা সঙ্কোচে বলল, ” যারিফ। ”

আজলান পায়চারি করতে করতে বিড়বিড় করলো, ” যারিফ, যারিফ, যারিফ। ”

তারপর চমকে গিয়ে ফিরে তাকালো তিথির চোখ বরাবর। চোখে অপার বিস্ময়।

________

আজলান কপালের উপর হাত রেখে লম্বা হয়ে চুপ করে শুয়েছিলো। আয়জা দরজা মেলে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে ভাইয়ের পায়ের কাছে গিয়ে বসে থাকলো অনেকক্ষণ। আজলান ফোঁপানির শব্দে চোখের উপর হতে হাত সরিয়ে নিয়েছে। মেঝেতে হাঁটু রেখে পায়ের কাছে আয়জাকে বসে থাকতে দেখে সে জিজ্ঞেস করলো,

” কি চাই এখানে? ”

আয়জা কান্নার শব্দ একটু বাড়লো। বলল,

” আমাকে মাফ করে দাও ভাইয়া। তুমি মত না দিলে এসব বিয়েটিয়ে কিচ্ছু হবে না। ”

আজলান পা সরিয়ে নিয়ে বলল,

” আমি ঘুমোচ্ছি। বিরক্ত করিস না। ”

আয়জা কাঁদতে লাগলো। আজলান চুপ করে রইলো। আয়জা বলল,

” তুমি অপমানিত হও এটা আমি চাইনি ভাইয়া। ”

আজলান বলল,

” আমি কৈফিয়ত চাইনি। তুই যাহ এখান থেকে। ”

আয়জা তার পায়ের কাছে পড়ে কাঁদতে লাগলো। আজলান অনেকক্ষণ পর বিছানা থেকে নেমে গেল। বলল,

” যারিফ ভালো ছেলে। ও তোকে ভালো রাখবে। তোর বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু আসল কথা হচ্ছে তোর বিয়েতে আমি থাকতে পারবো না। সম্ভব না। তুই যাহ এখন। ”

আয়জা বলল,

” এমন করো না ভাইয়। আব্বা করেছে যা করার আমি এমন কিছু করতে বলিনি যাতে তোমার অপমান হয়। আমি আব্বাকে কিচ্ছু বলিনি। আমি শুধু ভাবিকে বলেছি…..

আজলান ঘাড় ফিরিয়ে ভ্রুকুটি করে বলল,

” ভাবি? মেহবুব সব জানতো? ”

আয়জা আমতাআমতা করে বলল,

” না মানে..

তিথি তখনি কফির মগ নিয়ে এল। আজলান বলল,

” তুই যা এখন। ”

আয়জা বলল,

” না ভাবি এমন কিছু বলেনি। তুমি ভাবিকে ভুল বুঝো না। ”

আজলান তার হাত ধরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তিথি কফির মগটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। আজলান তার পেছনে হেঁটে এসে জিজ্ঞেস করলো,

” তুমিও সুযোগটা লুফে নিলে? আসল ষড়যন্ত্রকারী দেখছি আমার বউ। ”

চলমান..
রিচেক করিনি।

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_১৮ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১৮
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আয়জাকে পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়েছে। পাত্রকেও আম্বিয়া বেগম আর আজলানের পছন্দ হয়েছে। আফতাব শেখ কোনো মতামত জানাননি। তিথিরও মনে হলো ছেলেটা মন্দ না। বিয়েটা হয়ে যাওয়ায় ভালো। স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলার সাহস বোধহয় যারিফের এই জীবনেও হবে না। আজলান একবসায় কথা পাকাপাকি করে নিল। দিনতারিখ, দেনাপাওনা সবকিছুর হিসেব। আয়জা দেখলো কেনা-বেচার বাজারে তার দাম নেহাতই কম না। তিথিকে সব ব্যাপারে খাপছাড়া দেখে তার রাগ হলো। তাকে আশা দেখিয়ে এখন চুপ করে আছে। সবকিছু হালকা ভাবে নিয়েছে। আসলে ব্যাথা যার সে ছাড়া বাকিদের কাছে তা একটা বিরহের গল্পমাত্র। তাই ভাবি তাকে বুঝার চেষ্টা করছেনা।

তিথি ডোডোকে ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলো। রাত ন’টায় ডোডোর ভাত খাওয়ানোর সময়। আজলান সময় ঠিক করে দিয়েছে। ঠিক সময়ে ভাত না খাওয়ালে এসে চেঁচামেচি জুড়ে দেবে। তিথির আজকাল এসব ভালো লাগছে না।
আয়জা সেখানে এসে বলল বলল, ” তুমি কিছু বলবে না ভাইয়াকে? ভাইয়ার সব কথায় সায় দিয়ে যাচ্ছ দেখলাম। তোমাকেও কব্জা করে নিয়েছে নিজের দলে? ”

তিথি বলল, ” অনেক চেষ্টা করেছি কাল। ও অনেক খুশি তোমার বিয়ে নিয়ে। আমি অশান্তি চাই না। তাই কিছু বলিনি।
বিয়েটা করে ফেলো প্লিজ। পরে যখন তুমি সুখী হবে না তখন তোমার পরিবারের সবাই অশান্তিতে ভুগবে। যারিফ ভাইয়ার কোনো চাকরি নেই এখন। তোমার ভাই ওর হাতে তোমাকে তুলে দেবে কেন? ”

আয়জা বলল, ” তুমি চেষ্টা করেছ আদৌ?”

তিথি বলল, ” বিশ্বাস না হলে তুমি গিয়ে বলো। আমাকে কেন ঝুঁকিতে ফেলছো? ”

” আমি ভাইয়াকে এসব কথা কি করে বলব? ”

” নিজের ভাইকে যমের মতো ভয় পাও আবার আমাকে ঠেলে দিচ্ছো সেই যমের কাছে? এমনিতে দিনরাত আমার ভুল ধরতে ধরতে কাহিল সেখানে এসবে জড়ালে আমাকে এককাপড়ে বাড়ি ছাড়তে হবে। ”

আয়জা বলল,

” আমি বললে আমাকেও বাড়ি থেকে বের করে দেবে নয়ত উনাকে ডেকে এনে অপমান করবে। তুমি তো ভাইয়াকে চেনো। সে মধ্যবিত্ত হতে পারে কিন্তু আত্মসম্মান আছে। ”

তিথি বলল, ” আমি কোনোপ্রকার সাহায্য করতে পারব না ননদিনী। তাই আমার আশা ছাড়ো। ”

আয়জা দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লো। ডোডো হামাগুড়ি দিয়ে তার পিঠের উপরে উঠে মাথা ফেলে ডাকলো, “এপিপ্পি। ”

তিথি তাকে টেনে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

” ফুপীর মাথা খারাপ। এখন কথা বলবে না। নে খাওয়া শেষ কর ডোডো। অনেক কাজ পড়ে আছে। ”

আয়জা বেরিয়ে গেল রাগ করে।
ডোডোও আর খেতে চাইলো না। তিথি পানি খাইয়ে দিয়ে গাল মুছে দিল। দোল দিয়ে বলল,

” এবার চুপচাপ ঘুমিয়ে পড় সোনা। মায়ের অনেক কাজ। ”

ডোডো দুপাশে মাথা নাড়লো। তিথি বলল,

” ঘুমাবিনা? ”

ডোডো তার দিকে চেয়ে রইলো। তিথি টাপুসটুপুস আদর করে বলল,

” তাহলে চল বাসনকোসন ধুয়ে দিবি মাকে। ”

ডোডো দু’পাশে মাথা নাড়লো। তিথি বলল,

” তাও করবি না? তাহলে বসে বসে পড়াশোনা কর। ”

বলেই ড্রয়ার থেকে তার জন্য আনা বইটা বের করে দিল তিথি। বইটা আজলান এনেছে ডোডোর জন্য। তিথি ডোডোকে বিছানায় বসিয়ে বইয়ের পাতা উল্টে দিয়ে ডোডোর আঙুল টেনে নিয়ে ছবিতে আঙুল টিপে টিপে বলল,

” এই দেখ গরু, এটা ছাগল, এটা বানর, এটা সাপ। মাকে যদি জ্বালাস তাহলে এরা এসে গপ করে তোকে খেয়ে ফেলবে। ”

ডোডো ছবির সাথে নাক লাগিয়ে ছবিগুলো দেখছে। তিথি হেসে বলল,

” ওরে আমার পড়াকু ছেলেরে। কি মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ”

ডোডো মাথা তুলে মায়ের সাথে হাসলো। তিথি তার গালে শক্ত চুমু বসিয়ে বলল,

” পড় পড়। আমি কাজ সেড়ে আসছি। বেশি করে পড়। তোর স্কুল কলেজে পড়া লাগবে না। সোজা ইউনিভার্সিটিতে যাবি ঠ্যাঙ্গুর ঠ্যাঙ্গুর করে। ”

ছেলেকে জ্ঞান দিয়ে তিথি বেরিয়ে গেল। সে যাওয়ার পর ডোডো বইটা ছিঁড়ে কুটিকুটি করলো। তিথি কাজ সেড়ে এসে দেখলো ডোডো বইটা ছিঁড়ে চিবিয়ে চিবিয়ে কাগজগুলি খাচ্ছে। তিথি কপাল চাপড়ে বলল,

” তোর বাপ তো আমাকে আজ আস্ত রাখবে না ডোডো। এটা কি করলি? পড়তে বলেছি আর তুই চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিস? ”

ডোডো কিছুক্ষণ গালো আঙুল রেখে মায়ের দিকে ভীত চোখে চেয়ে রইলো। ক্ষণকাল পর লাফিয়ে উঠে বলল,

” আববাব্বাহ। ”

তিথি চমকে উঠে পেছন ফিরতেই আজলানকে দেখে জমে গেল।

তারপর দৌড়ে গিয়ে ডোডোর গাল থেকে কাগজগুলি বের করলো। ডোডো তার আঙুল কামড়ে ধরতেই তিথি ঠাস করে চড় দিল। ডোডো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সেই ফাঁকে তিথি সব কাগজ বের করে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বলল

” তোকে পড়তে দিয়েছি আর তুই এসব করছিস পঁচা ছেলে? ”

ডোডো কাঁদতে লাগলো। আজলান হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে মা ছেলেকে দেখতে লাগলো চুপচাপ। তার চোখ ডোডোর দিকে আর মেঝের দিকে। তিথি ডোডোকে কোলে তুলে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখে বেরিয়ে গেল। আজলান হেঁটে গিয়ে বইটা হাতে নিতেই দেখলো দুটো পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলেছে ডোডো। বইয়ের গায়ে এখনো ডোডোর লালা লেগে আছে। বইটা রেখে কোমরে হাত দিয়ে মেঝের দিকে তাকালো সে। মেঝেতে ভাত, আর কাগজের ছেঁড়া ভেজা টুকরো পড়ে আছে।

তিথি ডোডোকে আফতাব সাহেবের কাছে রেখে এল। তারপর মেঝেটা পরিষ্কার করে আজলানের দিকে একপলক চেয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল।

_________

ষোল-সতের দিনের মতো বাকি আছে বিয়ের। এখন থেকেই বিয়ের যাবতীয় কেনাকাটার লিস্ট তৈরি হয়ে গিয়েছে। নিজ হাতে লিস্টটা লিখতে গিয়ে তিথির হাত কাঁপছিলো। যার জন্য এত আয়োজন সে এসব ফিরেও দেখছেনা।

আম্বিয়া বেগম আর আতিফাকে খুশি দেখালো। আতিফার স্বামীর সাথে বহুদিনের দ্বন্দ চলছে আজলানের সাথে। এই প্রথম জামাইকে বাড়ি আনবেন আম্বিয়া বেগম তাও অনেক কষ্টে।

আতিফা একবার বাচ্চা দুটোকে নিয়ে বাড়ি চলে এসেছিলো একা একা। তাও ঝড়ের রাতে। শ্বাশুড়ির সাথে তার কিছুতেই বনিবনা হয় না। সেই থেকে আজলান ক্ষেপেছিল বোনের জামাইয়ের উপর। কত্তবড় সাহস মা বাবা বউ বাচ্চাকে বের করে দিয়েছে অথচ তার হুঁশ নেই। দুজনের মধ্যে বহুদিন রেষারেষি চললো। আতিফার বর জামিলের আর শেখ বাড়িতে আসা হয়নি সেজন্য। আতিফা এবার অনেক জোর করলো, আম্বিয়া বেগমও অনুরোধ করলো তাই আসার জন্য মত দিয়েছে সে।

আজলান যাদের যাদের দাওয়াত করবে তাদের একটা লিস্ট করেছে। তিথি দেখলো বেশিরভাগই আইনের লোক। র‍্যাবের সদস্য, পুলিশ সদস্য, গোয়েন্দা অধিদপ্তরের লোকজন।

বিশাল পরিসরে লোকজনের খাওয়ার দাওয়ার আয়োজন করা হবে। আজলান জানালো আড়াই হাজার মানুষের দাওয়াত থাকবে সেদিন। গরু দুটো জবাই করা হবে। সে বড় পরিসরে আয়োজন করতে চাচ্ছে কারণ তার বিয়ের সময় তেমন কোনো আয়োজন হয়নি।

তিথি তা শুনে আয়জার ঘরে এল বলার জন্য। ঘরে আলো নিভানো ছিল। আয়জা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। সে তিথির সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে চারদিন হলো। তিথির ঘরে যায় না। তিথিকেও ডাকেনা। ডোডোকেও কোলে নেয়নি। এমনকি ঘর থেকে পর্যন্ত বের হয়নি সে। খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি চুল পর্যন্ত ভালো করে আঁচড়ায়নি এ ক’দিন। আম্বিয়া বেগম সারাক্ষণ বকে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছেনা।

তিথি বলল,

” এই ননদিনী শোনো, তোমার বিয়ে হবে এই এলাকার গ্র্যান্ড ওয়েডিং। খবরদার উল্টাপাল্টা কোনো কাজ করার পরিকল্পনা করো না। তোমার ভাইয়ের নাক কাটা গেলে কারো আস্ত রাখবে না। আচ্ছা সারাক্ষণ ঘরে শুয়ে থাকো, বোর লাগে না? তাকাও আমার দিকে।”

তিথি পিঠে হাত রাখতেই আয়জা মুখ তুলে তাকালো। চোখদুটো ফোলা। মুখটা শুকিয়ে সরু হয়ে গিয়েছে। তিথির মায়া হলো। বলল,

” নিজেকে আয়নায় দেখেছ তুমি? ”

আয়জা বলল, ” দেখতে চাই না। কি বলতে এসেছ বলে চলে যাও। ”

তিথি বলল, ” তুমি আমার উপর রাগ দেখিয়ে যাচ্ছ এখনো। তোমার কি মনে হয় আমি বললে তোমার ভাইয়া মেনে নেবে? যারিফ ভাইয়াকে তখুনি ডেকে আনবে না? অপমান তখন করবে না? ”

আয়জা বলল, ” আমি কিচ্ছু চাই না। আমি তাকে দেয়া কথা রাখতে পারিনি, তাই তাকে ডেকে অপমানও করতে চাই না। কি বলতে এসেছ বলো।”

তিথি তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

” আচ্ছা নিজেকে সামলাও তুমি। সবার আগে নিজের কথা ভাবা জরুরি। আমি তোমার ভাইয়াকে বলব । ”

আয়জা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে বলল,

” না বলতে হবে না। আমার কারো সাহায্য চাই না। আমি ভাইয়ার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করবো। আমাকে দয়া দেখিওনা প্লিজ। ”

কেঁদে উঠলো সে। তিথি বলল,

” পিরিতির বড়ো জ্বালা। ”

আয়জার গাল মুছে দিল সে। বলল,

” যারিফ ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছে? ”

আয়জা দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,

” ব্লক। ”

তিথি অবাক হয়ে বলল,

” সোজা ব্লক? তুমি কি কথা দিয়েছ ওকে? ”

” চাকরি পাওয়া অব্দি অপেক্ষা করব। ”

তিথি কপালে হাত দিয়ে বলল,

” বাড়িতে এমন ভাই আছে তোমার, তা জেনেও কাউকে কথা দেয়ার আগে তুমি দু’বার ভাবলে না?”

আয়জা কাঁদতে লাগলো হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে। তিথি বলল,

” তুমি এমন করলে আমি তোমাকে কোনো সাহায্য করব না ননদিনী। তুমি স্বাভাবিক হও। আমি দেখছি কি করা যায়। ”

_____________

আফতাব শেখ এতদিন চুপ ছিল দেখে আজলান ভেবেছে উনি হয়ত বিয়েতে মত দিয়েছেন কিন্তু হঠাৎ করে তিনি জানালেন,

” আমার এই বিয়েতে মত নেই। ”

আজলান শুনেও না শোনার মতো চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিলো। আম্বিয়া বেগম বললেন,

” কি বলছো গো? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এমন ভালো ছেলে আর পাবো আমরা? কেন বলছো এসব?”

আফতাব শেখ বললেন,

” বলছি তার যথেষ্ট কারণ আছে। আমি এমনি এমনি কোনো কথা বলিনা। ”

আজলান খাওয়া থামিয়ে বাবার দিকে চোখ তুলে সোজাসাপটা প্রশ্ন করলো,

” মত কেন নেই তার দুটো কারণ দেখান। ”

আফতাব শেখ বললেন,

” প্রথম কারণ আয়জা এই বিয়েতে রাজী নয়। দ্বিতীয় কারণ আমি ওকে ওর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাই। আমার কাছে আমার মেয়ের সুখ আগে। ও আমার ছোট মেয়ে। অনেক আদরের। তুমি বাবা মেয়ের মমতাময় সম্পর্কের মানে বুঝবে না আজলান শেখ। ”

আজলান রাগত বলল,

” এসব আপনার চালাকি। আমাকে গোল খাওয়ানোর জন্য আপনি হয় গল্প বানাচ্ছেন, নয়ত আপনার মেয়ের সমস্ত ছেলেমানুষী মেনে নিচ্ছেন। কারণ, যে করেই হোক আমাকে হারাতেই হবে। আর তাতে আপনি আপনার মেয়েকে ব্যবহার করতেও পিছপা হবেন না। ”

আফতাব সাহেব খেতে খেতে বললেন,

” আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। আছি, থাকবো। ”

আজলান খাওয়ার পাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল,

” আমিও আমার সিদ্ধান্তে অটল। আছি, থাকবো।”

বলেই সে গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। তিথিকে কয়েকবার ডেকেছে। ভয়ে সে যাচ্ছে না। শেষমেশ যখন গেল তখন সে আজলানকে ফোনে কারো সাথে কথা বলতে শুনলো,

” শোনো যারিফ, তুমি যেহেতু কোচিংএ অনেকে ছেলেপেলে পড়াও। তাদের মাধ্যমে হলেও খোঁজ নাও আয়জার সাথে কোন ছেলের ওঠাবসা বেশি। তোমার হাতে এক সপ্তাহ সময় আছে। ঘাড় ধরে নিয়ে এসো আমার সামনে। বুঝেছ কি বলতে চাইছি? তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে। তুমি পারবে। ইউ আর দ্য গ্রেট। তোমার অভজার্ভেশন পাওয়ারের কথা আমি জানি। তদন্ত বিভাগে তোমার জায়গা আমি নিজেই করে দেব। তুমি আমাকে এটুকু হেল্প করো। ”

তিথি কপালে হাত দিয়ে বলল, ” সর্বনাশ। ”

আজলান কথা বলা শেষে তার উপস্থিতি টের পেয়ে দরজা খুলে টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। ডোডো ঘুমাচ্ছে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাবার গায়ের উপর উঠে অনেকক্ষণ বক্সিং খেলার চেষ্টা করেছে। তারপর ক্লান্ত হয়ে এখন ঘুম।

তিথিকে ঘরে ঢুকিয়ে এনে আজলান তার হাত ছেড়ে দিল। বলল,

” কাল থেকে আফতাব শেখকে নজরে নজরে রাখবে। কখন কি করছে, সব। যারিফকে বলেছি খোঁজ নিতে। এমন কেউ থাকলে ও খুঁজে বের করবে। তুমি চেষ্টা করো আয়জার কাছ থেকে কিছু জানতে। ”

তিথি বলল, ” আচ্ছা। যদি ওরকম কেউ থেকে থাকে যাকে আয়জা পছন্দ করে তখন তুমি কি করবে? ”

আজলান ঘরময় পায়চারি করতে করতে বলল,

” গারদের পেছনে ঘুমানোর ব্যবস্থা করব। শুয়ে পড়ো। ”

তিথি তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

” ছেলেটা যদি তিথিকে ভালোবাসে?”

” পুলিশের ডান্ডার বাড়ি খেয়ে ভালোবাসা বেরিয়ে যাবে। ”

তিথি বলল, ” শ্বশুর মশাই তোমার সাথে পারবেনা। চিন্তা করো না। ”

আজলান তার হাত দুটো থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সন্দিগ্ধ কন্ঠে বলল,

” আজ তোমার ঘৃণা কোথায় গেল?”

তিথি বলল,

” সবসময় ঘৃণা করিনা। ”

আজলান বলল,

” ঘৃণাটাকে বাঁচিয়ে রাখো। তোমার মতো মেয়েরা এটাকেই সম্বল করে বাঁচে। যাও ঘুমিয়ে পড়ো। আর হ্যা, কাল ডোডোর গায়ের উপর পা তুলে দিয়েছ ননসেন্স। বি কেয়ারফুল। আরেকবার যদি দেখি সোজা মেঝেতে নামিয়ে দেব। ”

রাতে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। আজলান তাকে পাটি বিছিয়ে মেঝেতে নামিয়ে দিল। বলল,

” তোমার জায়গা এখানে। ”

তিথি তাকে জাপটে জড়িয়ে ধরে তার উপর শুয়ে থেকে বলল,

” বউ যেখানে তোমার জায়গাও সেখানে। ”

আজলান বলল, ” ডোডো ওখানে একা। ”

তিথি বলল, ” ও বড় হোক ওর জন্যও একটা বউ নিয়ে আসবো। শিক্ষিত, পরিষ্কার, ফর্সা, লম্বা। ”

বকবক করতে তিথি ঘুমিয়ে গেল ওর বুকের উপর।

চলমান….

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_১৭ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১৭
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ছবিটা দেখার পর আম্বিয়া বেগম বললেন, “একবার দেখ। ছেলে দেখতে ভালো। এটাই তো চাস তুই। ”

আয়জা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো। তিথি ডোডোকে কোলে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রমলা চাচী আয়জার উদ্দেশ্যে বলল,

” তোমার ভাইরে কি তুমি চেনো না? এমন করতেছো ক্যান? ঘরে অশান্তি না হলে তোমাদের ভাল্লাগেনা? ছবিখান দ্যাখো। ছেলেটা দেখতে ভালো। ”

আয়জা বলল,

“দেখবো না। ”

আম্বিয়া বেগম বললেন,

” তোর বাপ শুনলে এখন চিল্লিয়ে উঠবে। আবার লাগবে বাপ ব্যাটার যুদ্ধ। ”

” লাগুক। সাহস থাকলে তোমার ছেলে আর বর দুজনকে গিয়ে বলো আমি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করব। তারপরও বিয়ে করব না। ”

আম্বিয়া বেগম ভৎসনা করে বলল,

” ঢংয়ের কথা বলিস না। নিজের কাপড়টুকু ভালো করে ধুঁতে পারিস না আবার করবি চাকরি। ”

” শ্বশুরবাড়িতেও কি আমাকে বসে বসে খাওয়াবে মা? ভাবিকে কি বসে বসে খাওয়াচ্ছ? ”

” শ্বশুরবাড়ি আর চাকরি দুটো আলাদা ব্যাপার। ”

” তোমার সাথে তর্ক করতে ইচ্ছে করছেনা। যাও তো সবাই। আমি বিয়ে করব না। ভাবি তোমার বরকে গিয়ে বলো আমি বিয়ে করব না, ব্যস। ”

আম্বিয়া বেগম চুলের ঝুটি ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল,

” তুই আমাদের মেরে ছাড়বি শয়তানি। বিয়ে না করলে দূর হ ঘর থেকে। ”

তিথি আম্বিয়া বেগমকে টেনে নিয়ে এল। ডোডো চেঁচিয়ে উঠলো আয়জার ফোঁপানো দেখে। তিথি বলল, ” কিছু হয়নি বাবা “।

ডোডো আয়জাকে ডাকলো, ” এপিপ্পি! ”

আয়জা তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আরও জোরে ফুঁপিয়ে উঠলো। আম্বিয়া বেগম তিথিকে বলল,

” তুই ওকে কিছু বলতে পারিস না বউ? এমনিতে সারাদিন তোদের কত কথা হয়। কত ছেলে নিজের সংসার হওয়ার পর বোনের দিকে ফিরেও চায় না সেখানে তার ভাই নিজে দাঁড়িয়ে ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিতে চাচ্ছে তারপরও সে রাজী হচ্ছে না দেখলি।”

তিথি বলল,

” আমি কি বলব? আমি যা বলি তাই তো ভুল। তোমার ছেলে আমাকে ঘর থেকে বের করে দেবে না ভুলকিছু বললে? ”

” ওকে বোঝাতে বলছি গাধী। ”

” ওকে আমি কি বোঝাবো? আমি যে ভুল করেছি ওকেও সেটা করতে বলবো? ”

আম্বিয়া বেগম রাগ সামলে বলল,

” তুই আমার ছেলেকে বিয়ে করে ভুল করেছিস? ”

” আলবাত ভুল। আমি এমন বড়লোক বাড়িতে যেতে পারতাম না ঠিক, কিন্তু একজন ভালো মানুষ তো পেতাম। লাল দেখে ফাল দিয়েছি তাই আজ আমার এই দশা। ”

রমলা চাচী বলল,

” বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ তারপরও একথা কি করে বলতেছো বউ? ”

তিথি ডোডোকে জড়িয়ে ধরে বলল,

” তাতে কি হয়েছে? ”

আম্বিয়া বেগম বলে উঠলেন,

” তোর সাত কপাল আমার ছেলের মতো কাউকে পেয়েছিস। তোর চাইতে ভালো মেয়ে পেতাম আমি। ”

” তো যাও। আরেকটা বিয়ে করাও। স্মার্ট, আধুনিক, সুন্দরী, ফর্সা, কম কথা বলে এমন কাউকে খুঁজে নিয়ে এসো তোমার ছেলের জন্য। বিশ্বাস করো উপরে ঢং দেখালেও মনে মনে ভীষণ খুশি হবে। সেও এটাই চায়। শুধু লোকলজ্জার কারণে আমাকে নিয়ে সংসার করছে। ”

রমলা চাচী বলে উঠলো,

” আহা থামো থামো। এসব কথা কেন বলতেছো বউ? বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেছে এখন এসব কথা তুলোনা। পুরুষ মানুষের মাথা গরম। কখন কি করে বসে রাগের মাথায়। ”

তিথি অবাককন্ঠে বলল,

” কি বলছো চাচী? রাগের মাথায় বিয়ে করে নেবে বলছো? করুক। করলেও সেই মেয়ে স্মার্ট, আধুনিকা হবে না। আমার চাইতে বোকা হাঁদা গাধা হবে। আমি যে ভুল করেছি সেটা একটা শিক্ষিত মেয়ে করবে না। অশিক্ষিত মূর্খরা করবে।”

ডোডো মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ড্যাবড্যাব করে। আম্বিয়া বেগম রাগের মাথায় আয়জাকে মারধর করা শুরু করলো। চুল ধরে গালে চড় মারতে মারতে বলল,

” তুই আমার সংসারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিস। তোকে আমি আজ মেরেই ফেলবো। তোর মতো মেয়ে দরকার নেই আমার। এত মানুষ মরে তুই মরিস না কেন? ”

আয়জার চিৎকারে ডোডো ভয় পেয়ে কাঁদা শুরু করলো। আজলান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছিলো সবে। মাথা মুছতে মুছতে আয়জার কান্নার শব্দ কানে আসতেই দ্রুতপদে হেঁটে বেরিয়ে এল। আয়জার ঘরে এসে দেখলো আয়জাকে একনাগাড়ে মেরে যাচ্ছে আম্বিয়া বেগম। রমলা চাচী চেষ্টা করেও থামাতে পারছেনা। তিথি ডোডোকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ অবিশ্বাস্য রকমের স্বাভাবিক। শুধু ডোডো কাঁদছে।

সে ছুটে এসে আয়জাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আম্বিয়া বেগমকে বলল,

” পাগল হয়ে গেছ? কি সমস্যা? বাড়িটাকে মাছের বাজার বানিয়ে ফেলেছ সবাই মিলে। ”

আয়জা ভাইকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কেঁদে গেল। আফতাব শেখ দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। উপহাস করে বললেন,

” খেলা জমে উঠেছে। চলুক। চলতে থাকুক। আমি ঘরে বসে শুনতে থাকি। চালিয়ে যাও সবাই মিলে।”

আম্বিয়া বেগমের দিকে ক্ষেপাটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলেন তিনি। তিথিও বেরিয়ে গেল ডোডোকে দোল দিতে দিতে।

আম্বিয়া বেগম হাঁপাতে লাগলেন। রমলা চাচী উনাকে ধরে খাটে বসালেন। পানির গ্লাস এনে পানি খাইয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আজলান আয়জাকে বলল,

” কান্না বন্ধ কর। ”

_____________

ডোডো তালি দিতে দিতে বলল, ” তাত তা তাত তা।” তিথি তার কান্ড দেখে বলল,

” তোর মনে এত ফূর্তি কোথা থেকে এল? ”

ডোডো হাসলো। তিথি তার গালে টুপটাপ আদর বসিয়ে বলল,

” গাড়িতে বসে খেলা কর কেমন? আমি তোর ফুপীকে ভাতটা খাইয়ে দিয়ে আসি নইলে আজ না খেয়ে ঘুমাবে।”

ডোডো মায়ের যাওয়া দেখলো। কিছুক্ষণ পর ঠোঁট টেনে কাঁদা শুরু করলো। আজলান এসে দেখলো তিথি নেই। ডোডো একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে। সে ডোডোকে কোলে নিয়ে চেঁচিয়ে বলল,

” ছেলেটাকে এভাবে ফেলে রেখে গিয়েছ কেন ননসেন্স? এই মেহবুব!”

তিথি তার ডাকাডাকি শুনে দৌড়ে এল। বলল,

” আয়জাকে খাওয়াতে গিয়েছিলাম। আয় ডোডো। ”

হাত বাড়িয়ে দিল সে। ডোডো বাবার গলা ধরে মায়ের দিকে চেয়ে থাকলো। আজলান দিল না। বলল,

” আমি একটা জরুরি কথা বলছি মন দিয়ে শোনো। ওকে বলো কাউকে আগে থেকে পছন্দ করলে তার নাম অব্ধি ভুলে যেতে। ওর হাবভাব দেখে তো স্পষ্ট যে ও ভার্সিটিতে কোনো বন্ধু জুটিয়েছে। ”

তিথি বলল, ” থাকলেও সমস্যা কোথায়? ”

” তোমাকে যেটা বলতে বলছি সেটা গিয়ে বলো। কাল ওকে দেখতে আসবে। তুমি ওকে সাজিয়েগুছিয়ে রাখবে। ওরা ভদ্র পরিবারের মানুষ। ও যদি উল্টাপাল্টা কিছু ভেবে রাখে তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে বলো। ওদের সামনে যেন কোনো সিনক্রিয়েট না হয়। ”

তিথি বলল, ” ও বিয়ে করতে চাইছেনা। তুমি ওকে জোর করছো কেন? আইনের লোক হয়ে এটা জানো না যে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে। ”

” অধিকার মাইফুট। এই বয়সে ভালোমন্দ কি বোঝে ও? এসব জাস্ট আবেগ বৈকি কিছু না। ভালো থাকার জন্য টাকা দরকার আর সামাজিক অবস্থান, বংশগৌরব। ভালোবাসা, আবেগ চুলোয় যাক। ”

তিথি বলল, ” তোমার পিংকিও টাকা দেখে আরেক মদনের সাথে পালিয়েছে নাকি? ”

আজলান ঘর ফাটিয়ে হুংকার ছেড়ে খপ করে হাত ধরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল। তিথি দরজায় চাপড়াতে চাপড়াতে বলল,

” টাকা টাকা টাকা। এই টাকাই তোমার ঘাড়বাঁকা করে দিয়েছে আজলান শেখ। তোমাকে আমি ঘেন্না করি। যতটুকু সম্মান আছে ওইটুকু ডোডোর বাপ বলে নইলে তখনই চলে যেতাম। ওইটুকুও যখন থাকবে না তখন তুমি আমাকে আটকে রাখতে পারবে না। ”

আজলান বলল,

” জাস্ট অফ ব্লাডি ইডিয়ট। ”

তিথি বলল,

” সভ্য দেখে কাউকে নিয়ে আসো। সে তোমার টাকার গন্ধ শুঁকে চুপ করে থাকবে। ”

আজলান খানিকক্ষণ চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো। তিথি চলে যেতেই ডোডোর পরনের কাপড়চোপড় পাল্টে দিয়ে গা মুছে বেবি পাউডার মাখিয়ে দিল। দুগালে আদর করে নতুন কাপড়চোপড় পড়িয়ে দিয়ে হাত পা টেনে দিতে দিতে বলল,

” কাঁদবে না আইজান। ”

ডোডো ঠোঁট টেনে কান্নার সুর তুলে বলল,

” আমমাম্মাহ। ”

আজলান ওর হাতের আঙুল টেনে তাতে চুমু দিয়ে বলল,

” ওই ননসেন্স মহিলার কাছে যাওয়ার দরকার নেই। ”

_______________

আজলান ব্যস্ত ভঙ্গিতে সদর দরজার দিকে এগোতে এগোতে ফোনের ওপাশের জনকে বলে গেল,

” দ্রুত গাড়ি নিয়ে বের হও। উনাদের শ্যামবাজার থেকে গাড়িতে তুলবে। হ্যা,দ্রুত যাও। সোজা বাড়ি নিয়ে আসবে। এখানে আগে কখনো আসেনি। আমার নাম বললে হয়ে যাবে। ওকে, কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাও। ”

রমলা চাচী টি টেবিলটা সাজাচ্ছে। ডোডো তার গাড়িতে বসে আছে চুপচাপ। গাড়ির রিমোটটা নিয়ে খেলছে। আজলান ওকে সাদা টিশার্ট পড়িয়ে দিয়েছে গোসল করিয়ে। বেবি লোশনও মাখিয়েছে। হঠাৎ কপালের একপাশে কালো টিপ দেখে চেঁচিয়ে উঠতেই আম্বিয়া বেগম ছুটে এসে বলল,

” নজর পড়বে তাই দিয়েছি খোকা। রাগারাগি করিস না এটা নিয়ে। ”

আজলান বলল,

” এসবে নজর কাটে কে বলেছে তোমাকে? এক্ষুণি তোলো। ”

আম্বিয়া বেগম ডোডোকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন। আজলান আয়জার ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তিথিকে আর আয়জাকে দেখলো। আয়জাকে শাড়ি পড়িয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে চুল বাঁধছে তিথি। ফোনে কল আসায় আজলান ব্যস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেল। আতিফা এসেছে ওর ছেলে মেয়ে নিয়ে। ওরা ডোডোকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ডোডো তাদেরকে পেয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে করে খেলছে।

তিথি আয়জাকে রেডি করিয়ে মেহমানদের অপেক্ষায় ঘুরঘুর করছে। আর ড্রয়িংরুমে সামির, আভিরা আর ডোডোর খেলা দেখছে। ডোডো মাকে দেখামাত্রই ফোকলা হেসে হাতদুটো মাথার উপর তুলে ডাকলো,

” আমমাম্মাহ তুত্তু। ”

তিথি হাত দেখিয়ে বলল,

” মাইর দেব। ”

ডোডো কান্নার সুর তুলে হাত বাড়িয়ে ডাকলো। তিথি হেসে বলল,

” যাব না। ”

দরজার কলিং বেল বেজে উঠতেই তিথি মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দৌড়ে গেল। দরজা খুলতেই দেখলো যারিফ দাঁড়িয়ে। এক হাতে অনেকগুলো মিষ্টি আর সন্দেশের কাটুন, অন্য হাতে মিষ্টি দইয়ের হাঁড়ি। তিথি বলল,

” আপনি? পাত্রপক্ষ এসেছে? ”

আম্বিয়া বেগম এসে বলল,

” এই ছেলে তুমি এতদিন পর এলে? এতদিন কই
ছিলে? ”

” আমার এমবিএ ফাইনাল পরীক্ষা চলছিলো আন্টি। ”

“তোমার আম্মা আব্বা কেমন আছে? ”

” ভালো আছে। ”

” মেহমান চলে এসেছে? ”

যারিফ উত্তর দিল।

” হ্যা। স্যারের সাথে আসছে। ”

আজলান মেহমান নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করামাত্রই আম্বিয়া বেগম এবং আফতাব শেখের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। যারিফকে এককোণায় দাঁড়িয়ে ডোডোকে কোলে নিয়ে আদর করতে দেখে বলল,

” মঈন, তুমি আজ আমাদের সাথে রাতে খাবে। আজ কোনো না শুনতে চাই না। ”

” কিন্তু স্যার। ”

“কোনো কিন্তু না। ”

ডোডো যারিফকে বলল,

” তুত্তুহ। ”

আজলান চলে যাচ্ছিলো। ডোডোর কথা শুনে থেমে গিয়ে ফিরে চাইলো। বলল,

” বাবু কি বলছে? ”

যারিফ বলল, ” বুঝতে পারছিনা স্যার। ”

আজলান ডোডোকে কোলে নিয়ে গালে আদর করে বলল,

” কি চাই বাবা? ”

ডোডো বলল, ” আম্মান তুত্তু। ”

আজলান দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

” বোকা মহিলা সাজগোজের খপ্পরে পড়ে বাচ্চাকে খাওয়াতে ভুলে গেছে। ”

তিথির কাছে নিয়ে যাওয়ার পর সে দেখলো তিথি সন্দেশ খাচ্ছে। আজলান বলল,

” ওর খিদে পেয়েছে। খেতে দাও। ”

তিথি ডোডোর মুখে সন্দেশ ভেঙে পুরে দিয়ে বলল,

“অসম্ভব। শাড়িতে পিন করেছি। এখন ওকে খাওয়াতে গেলে অনেক সমস্যা। ”

আজলান শক্ত গলায় বলল,

” ওর খিদে পেয়েছে মেহবুব। শেষবার খাইয়েছো কখন? ”

তিথি ডোডোকে কোলে নিয়ে ফেললো।

” মনে নেই” বলে ডোডোর গালে আলতো করে চড় দিতে দিতে বলে গেল ” এই বেয়াদব ছেলে তোর খিদে লাগলে আমাকে বলবি। তোর বাপকে বলিস কেন? তোর বাপের তুত্তুর গোডাউন আছে? হ্যা? আর বলবি তোর বাপকে? মিষ্টি খাবি? সন্দেশ খাবি? দুধ পাউরুটি খাবি নাকি আঙুর খাবি? আচ্ছা দই খাবি? ”

ডোডো মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তিথি তার দিকে চোখ রেখে আদুরে ঠোঁট দুটোর উপর চুমু দিয়ে বলল,

” চাইয়া থাকোস ক্যান? কি কবি ক। ”

ডোডো ঠোঁট লম্বা করে বলল, ” তুত্তুহ “।

তিথি কপালে চড় মারতে মারতে বলল,

” ও জ্বালারে জ্বালা। ”

ডোডো কপালে হাত রেখে মায়ের দিকে চেয়ে রইলো। তিথি তার কান্ড দেখে বলল হাসতে হাসতে বলল,

” তোর কিসের এত দুঃখ যে কপালে হাত দিচ্ছিস? তুত্তু খাওয়া, আর হাগুমুতু ছাড়া আর কোনো কাজ আছে তোর? ”

ডোডো গলা টেনে দুঃখের সাথে ডাকলো, ” আমমাম্মাহ। ”

তিথি বলল, ” মাকে কি করে পটাতে হয় ভালো করে শিখে গিয়েছিস তুই। ”

___

আয়জাকে তার ঘরে দেখতে এল বরের মা, ভাবি আর বোন। আয়জার সাথে অনেক কথাবার্তা বলার পর তিথির সাথেও বললো। তারপর আম্বিয়া বেগম আর আতিফার সাথে কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তিথি সেই ফাঁকে আয়জাকে বলল,

” তুমি ওই মদনটাকে পছন্দ করো? ওই মদন দেখো ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে। ”

যারিফকে দেখিয়ে দিল তিথি। আয়জা তাকে দেখার সাথে সাথে যারিফও চোখ তুলে তাকালো। চোখ সরিয়ে নিতেই তিথি বলল,

” মাগোমা কেমন করে চোখ সরিয়ে নিল। এ তো উল্টো তোমার উপর রাগ দেখাচ্ছে ননদিনী। তুমি ওকে বলোনি তোমাকে আজকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে?”

আয়জা গলায় জোর দিয়ে বলল,

” না। ”

” আব্বেশালা এজন্যই তো মেজাজ হট। এ দেখছি ফাটাকেষ্ঠর চাইতে কোনোদিক দিয়ে কম নয়। থাক গে এই কালা বিলাইয়ের চাইতে ধলা বিলাই ভালো। তাকে বিয়ে করে নাও। আমিও এক কালা বিলাইকে ছেড়ে ধলা বিলাইকে বিয়ে করছি। বর্তমানে আমি এক বাচ্চার মা। মোটামুটি ভালোই আছি। টাকা পয়সা ধনদৌলত আর মহব্বতের অভাব নেই। তুমিও করে ফেলো। ”

ডোডো বলল,

” নান নান না। ”

তিথি বড়বড় চোখ পাকিয়ে বলল, ” তুই না বলছিস কেন? তুই কি বুঝিস? ফুপ্পীর পক্ষ নিচ্ছিস? তুই দাঁড়িয়ে দিবি বিয়ে? কথা বলতে পারিস না ভালো করে আবার প্রতিবাদ করিস ব্যাঙের বাচ্চা ব্যাঙ। ”

ডোডো হাতের তালু দিয়ে ঠাস করে মারলো তিথির নাকে। তিথি বলল,

” দিলি তো নাকটা চ্যাপ্টা করে। ”

ডোডো ঝুঁকে এসে তার নাকটাতে গাল বসিয়ে কামড়ে দিতে চাইলো। তিথি তাকে সরিয়ে দিতে গিয়ে হাসতে হাসতে বলল,

” তোর বাপ নাককাটা বউয়ের সাথে একদিনও সংসার করবে না রে ডোডো। ”

তিথি হাসার ফাঁকে দেখলো আয়জা কাঁদছে।

সে হাসা থামিয়ে দিল। আয়জা গাল মুছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বড়সড় করে একটা দম ফেলে বলল,

” তৃতীয় পক্ষ সবকিছু কেমন বিনা কষ্টে, বিনা মূল্যে পেয়ে যায়, তাই না ভাবি? এল, দেখলো, পছন্দ করলো তারপর বিয়ে হয়ে গেল। কত সহজ!”

তিথি বলল, ” এত কিছু বুঝিনা। থার্ড পার্সনের সাথে তোমার ভাই সংসার করছে, এক বাচ্চার বাপ হয়েছে। তো? কোনোকিছু কি আটকে আছে? ”

আয়জা বলল, ” নেই বলছো? তোমাদের মধ্যকার এত ঝামেলা, মনোমালিন্য, এত এত অমিলের মধ্যেও মানিয়ে চলার চেষ্টা, প্রতিনিয়ত দুজনের কাছ থেকে দুজন ছিটকে পড়তে পড়তে আবারও সংসার নামক কেন্দ্রবিন্দুতে এসে থমকে যাওয়া। তুমিই বলো না। তোমরা আটকে নেই? ”

তিথি জবাব দিতে পারলো না। আয়জা বলল,

” দিনশেষে না তুমি সুখী না ভাইয়া। তোমরা জাস্ট মানিয়ে চলছো। আর কিচ্ছু না। ”

তিথি ডোডোকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। চাওয়া পাওয়ার হিসেবে সবসময় সবার প্রাপ্তির খাতাটা কি আসলেই পরিপূর্ণ থাকে?

চলমান..

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_১৬ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১৬
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আয়জাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিলো। পাত্র এনজিওতে চাকরি করে। আফতাব সাহেবের সাথে বেশ কথাবার্তা চলছিলো পাত্রের বাবা চাচা আর মামার সাথে। পাত্রও এসেছে। পাত্রের মায়ের সাথে বসে আছে সে। আজলানকে কয়েকবার ডেকে পাঠিয়েছে আফতাব শেখ। তিথি এসে তাকে বলেছে। কিন্তু সে এমনভাবে সেজেগুজে রেডি হচ্ছে যেন আয়জাকে নয় তাকে দেখতে এসেছে। তিথি মহাবিরক্ত। সে একটা মেরুন রঙের শাড়ি পড়েছে। আজলান তাকে চোরাচোখে দেখে বলল,

” ওদের সামনে যাবে না। ”

তিথি তার কথা শুনে ভুরু কুঁচকালো। বলল,

” কেন? আমাকে পছন্দ করে নেবে বলে?

আজলান ধমকে বলল,

” সবসময় মুখের উপর কথা বলার স্বভাব কমাও নইলে…

তিথি বলল,

” বের করে দেবে। তাই তো? এটা ছাড়া তুমি আর পারোটাই বা কি? ”

আজলান আর কিছু বললো না। তিথি মুখ ঝামটা মেরে চলে গেল।

ডোডো তার দাদাভাইয়ের কোলে বসে আছে। রিমোট নিয়ে খেলা করছে। সবার কথা ফাঁকে ফাঁকে সেও কথা বলে উঠছে। কি বলছে সে নিজেই জানে না।

অনেকক্ষণ পর আজলান এসে বসলো সেখানে। সবাই তাকে দেখে দাঁড়িয়ে হাতে হাত মিলিয়ে কুশলাদি বিনিময়ে করেছে।

আজলান বসতে বসতে দেখলো পাত্রের গায়ের শার্ট কুঁচকানো, বারবার নাকের মাথা চুলকাচ্ছে, যে পারফিউমটা ইউজ করেছে সেটার গন্ধ কড়া, দাঁড়ি নেই, ঠোঁটের উপর একগুচ্ছ গোঁফ রাখা তাও তৎকালীন রাজা বাদশাহদের মতো করে রাখা।

আফতাব শেখ বললেন,

” আমার দুই মেয়ে এক ছেলে। মেয়ে দুইটা ছোট, ছেলেটা বড়। এক মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। মেয়ের বর ইনকাম ট্যাক্স অফিসার। আর ও র‍্যাবে জয়ন করেছে দু বছর হলো। আয়জা সবার ছোট। আমার বড়ো আদরের মেয়ে। ”

আজলানকে চুপ থাকতে দেখে আফতাব শেখ বললেন,

” ইনি হচ্ছেন ছেলের বাবা, ইনি মামা, ইনি ছোট চাচা। আর ইনি মা। ”

আজলান ছেলের মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,

” আপনি আমার বোনকে একা দেখে আসতে পারেন। ও সবার সামনে আসবে না। ”

পাত্রপক্ষ শুরুতেই বুঝে গিয়েছে ভাইটা গোঁয়ার টাইপের হবে। কথাবার্তায় অহংকার ঝড়ে পড়ায় তারা একেবারে সিঁটিয়ে গেছে। আজলানের কথায় অপমানিত বোধ করলো তারা। আফতাব শেখ হেসে বললেন,

” আয়জাকে একটু ডাকো। দেখা দিয়ে চলে যাক।”

আজলান বলল,

” আমি কি বলেছি তা বোধহয় শুনতে পাননি? ”

আফতাব শেখ ছেলের উপর ক্ষুদ্ধ হলেন কিন্তু তা চেপে রেখে মলিন হেসে পাত্রের মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,

” আপনি দেখে আসতে পারেন। আমরা কথাবার্তা এগোই। ”

রমলা চাচী এসে পাত্রের মাকে নিয়ে গেল। সবাই কথা এগুলো। আজলান শুধু চুপচাপ শুনলো।

___

আয়জা কাঁদতে কাঁদতে শাড়ি পড়েছিলো। আম্বিয়া বেগম চড় মেরেছিলেন সকালে। মা মেয়ের মধ্যে তিথি তখন নাক গলায়নি। আম্বিয়া বেগম ওকে কাঁদতে দেখে বললেন,

” বিয়ে কি এখন হয়ে যাচ্ছে? আজব! তোর ভাই যেখানে দাঁড়িয়ে বিয়ে দেবে সেখানে তোর এত কান্না কিসের? ”

আয়জার কান্না তবুও থামার নয়।
তাকে তিথি শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছিলো। শাড়ি পড়িয়ে দেয়ার সময় আয়জা বারংবার তার চোখ মুছে যাচ্ছিলো। এখন তাও কান্না একটু থেমেছে। পাত্রের মা এসে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। তিথিকে বলল,

” আপনি ওর ভাইয়ের বউ? ”

” জ্বি। ”

পাত্রের মা তাকেও দেখলো ভালো করে। আম্বিয়া বেগম বললেন,

” আমার মেয়ে লাখে একটা। কোনো দোষত্রুটি খুঁজে পাবেন না। আদরে আদরে মানুষ হয়েছে তাই কাজবাজ একটু কম পারে কিন্তু শিখিয়ে দিলে সব শিখে নেবে। ”

পাত্রের মায়ের সাথে আম্বিয়া বেগম অনেক কথাবার্তা বললো। পাত্রের মা বেরিয়ে যেতেই আয়জা শাড়ি খুলে ছুঁড়ে মেরে বলল,

” করবো না বিয়ে আমি। আমাকে কোরবানির বকরি পেয়েছে সবাই মিলে। ”

শাড়িটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে বসে কাঁদতে লাগলো সে। তিথি তার কান্নার পেছনের আসল রহস্য জানে। কিন্তু মুখ খোলার সুযোগ নেই। যদি মুখ খোলে তাহলে তাকে আয়জার রক্ষে নেই সাথে তারও। আয়জা বলল,

” ভাইয়াকে বলো আমি বিয়েশাদি করবো না এখন। ”

তিথি বলল,

” না বাপু পারবো না। আমার বরের সাথে সম্পর্ক একটু ঠিকঠাক হয়েছে। এখন কোনো ঝামেলায় আমি নেই। ”

তা শুনে আয়জা কেঁদে বলল,

” তাহলে বেরিয়ে যাও এখন। ”

তিথিকে বের করে দিল সে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল,

” আমি মরব তবুও এই বিয়ে করবো না।”

তিথি দরজায় ঠোকা দিয়ে বলল,

” আরেহ বাবা আমার কি করার আছে? তুমি আমার উপর রাগ দেখাচ্ছ কেন? ডোডোর আব্বা এমনিতেই আমাকে একটু মেনেটেনে নেয়া শুরু করেছে তারমধ্যে আমি ওর বিপক্ষে কাজ করলে ও আমার উপর ক্ষেপে যাবে না? তোমার মদনটার ফোন নাম্বার দাও আমাকে। আমি কথা বলে দেখি। দরজা খোলো। দেখো, দরজা না খুললে আমারও কিছু করার নেই। ”

আয়জা দরজা খুলে বলল,

” তুমি ভাইয়াকে রাজী করাবে তো? ”

তিথি ওর দিকে চুপ করে চেয়ে রইলো। আয়জা বলল,

” না পারলে আমাকে মুখ দেখিওনা। যাও। ”

বলেই দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলো।
তিথি দরজা আটকে বলল,

” আচ্ছা আচ্ছা কেঁদো না। আমি চেষ্টা করবো। চিন্তা করো না ওই মদন তোমার হবেই। ”

___

পাত্রপক্ষ চলে যাওয়ার পর বাবা ছেলের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। কথা কাটাকাটি তারপর বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হলো। আর এখন জিনিস ছুঁড়ছেন আফতাব শেখ।
শ্বশুর মশাইকে এর আগে এত রাগ করতে দেখেনি তিথি। শ্বাশুড়ির কথা শুনে সব বোগাস মনে হতো তার। কিন্তু ক্ষেপে গিয়ে টিভির রিমোট আছাড় দিতে দেখে তিথিসহ বাড়ির সকলেই ভীত হয়ে গেছে।

তিনি চিৎকার করে বললেন,

” কতবড় বেয়াদব হয়েছ তুমি। বাড়িতে গাদ্দারের মতো কথা বলো তা ঠিক আছে তাই বলে কুটুমদের সামনেও। মেয়ে আমার, সিদ্ধান্তও আমার। তুমি কে নাক গলানোর? ”

আজলানও উনার মুখের উপর সাফ সাফ জানিয়ে দিল।

” আপনার সিদ্ধান্ত আমি মানবো না। ও যেমন আপনার মেয়ে তেমন আমার বোন। একজনকে তো দিয়েছেন বিয়ে। শ্বশুর শ্বাশুড়ি তাকে আলাদা করে রেখেছে। ”

” তুমি ভুলে যেওনা তোমার বউও আমিই পছন্দ করে এনেছি। ও এখন তোমার বাচ্চার মা। দিনশেষে ওর সাথেই তুমি সংসার করছো। ”

আজলান বলল,

” উদ্ধার করে ফেলেছেন ওরকম বউ পছন্দ করে। আপনি আমার সাথে আর আতিফার সাথে যেটা করেছেন সেটা আমি আয়জার সাথে করতে দেব না। ”

বাবা ছেলে দুজনেই হিংস্র শ্বাপদের ন্যায় ফোঁসফোঁস করছিলো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তিথি আর আম্বিয়া বেগম এসে দু’জনকে শান্ত হতে বললেও তারা শান্ত হলো না। আফতাব শেখ বললেন,

” তোমার গালে ঠাস ঠাস করে চড় বসাবো আমি। আমার ছেলে তুমি। আমার বড় হয়ে যাওনি এখনো। তোমার আগে দুনিয়াতে এসেছি। তোমার চাইতে বেশি মানুষ চিনি আমি। ”

আজলান বলল,

” চেনেন না কে বলেছে? বেশ মানুষ চেনেন আপনি। বোকা হাঁদা, নোংরা বস্তির লোকজন ধরে আনেন যেখান থেকে পারেন সেখান থেকে। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকবো মানে থাকবো। কথার কোনো হেরফের হবে না। ওই বস্তির ঘরে আমি আয়জাকে দেব না মানে দেব না। ”

” তোমাকে শান্ত হতে বলছি। বাপ ছেলে কি শুরু করছো? ” আফতাব শেখকে ধরে বসিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আম্বিয়া বেগম।

আফতাব শেখ গ্লাসটা সরিয়ে দিতেই সেটি ভেঙে খানখান হয়ে গেল। তিনি এক ঝটকায় আম্বিয়া বেগমকে সরিয়ে দিয়ে বললেন,

” তুই সর। তোর ছেলেকে মহা বেয়াদব বানিয়েছিস। এই বাড়িতে আমার কথার দু’পয়সার দাম নেই। কতবড় বেয়াদব সে। যার সাথে সংসার করছে তাকে পর্যন্ত বাজে কথা বলা ছাড়ছেনা। ”

আজলান বলল,

” আপনি জিনিস ভাঙছেন কেন? সবসময় নিজের সিদ্ধান্ত সবার উপর চাপিয়ে দেয়া বন্ধ করুন। আপনার কথায় সব হবে না। এসব রাগের ধার ধারিনা আমি। আপনার কথায় শেষ কথা হবে না। হবে না মানে হবে না। ”

আফতান শেখ রাগে ফুঁসছেন। আম্বিয়া বেগম চিৎকার দিলেন।

” আজলান!! তুই বেয়াদবি করছিস এবার। মানুষটা হাঁপাচ্ছে দেখতে পারছিস না তুই? ”

তিথি এসে আজলানকে বলল,

” তুমি যেতে পারছো না এখান থেকে। এত তর্ক করছো কেন? উনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তখন কি হবে? ”

আজলান বলল,

” এই চুপ। একদম চুপ। একদম শ্বশুরের সাফাই গাইবে না আমার সামনে। সবকটা পঁচা গাঁও-গ্রাম থেকে উঠে আসা পাবলিক। পঁচিয়ে ফেলবে ঘরদোর সবকিছু। ”

তিথি বলল,

” আমিও পঁচা গাঁও-গ্রামের মানুষ। তো কি হয়েছে?”

” কি হয়েছে দেখতে পাচ্ছ না? ”

আম্বিয়া বেগম বললেন,

” খোকারে তোর পায়ে পড়ি। আবার বউয়ের সাথে ঝগড়া শুরু করিস না। ”

আজলান গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ডোডো কান্না করছিলো খুব। তিথি তাকে কোলে না নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে রমলা চাচী এসে বলল,

” বউ তুমি এমনভাবে খাড়াইয়া আছে ক্যান? বাবুরে কোলে নেও। ”

ডোডো হামাগুড়ি দিয়ে তার পায়ের কাছে এসে বসলো। তার শাড়ি টান দিয়ে ডাকলো,

” আমমাম্মাহ। ”

________

আয়জা বলল, ” আমার বিয়ে নিয়ে কাউকে ভাবতে হবে না। ওদের কে বলেছে আমার বিয়ে নিয়ে ঝগড়াঝাটি করতে? ”

তিথি বলল,

” এখন কিছু বলো না প্লিজ। আগুন হয়ে আছে সবাই। ও যদি তোমাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে বলো ওর পরিবারকে পাঠাতে। ”

” কিন্তু ও একটা কোচিং সেন্টারে পড়ায়। আর মাঝেমধ্যে ড্রাইভিং করে। মা বাবা নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকে। ঘরবাড়ি করেনি এখনো। চাকরি বাকরি পায়নি। ”

তিথি বলল,

” তোমার ওই ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর আগে তোমার পরিবারের কথা ভাবা উচিত ছিল। এমন ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ানো উচিত হয়নি। এখন আমি কি করব? আমার কিছু করার নেই। আজকের পর তোমার ভাইয়ের সাথে আমি কোনো তর্কেও জড়াতে চাই না। পরে বলবে, আমি নিজে বস্তি, কথাও বলছি বস্তির হয়ে। ”

আয়জা বিছানায় দু’হাতের ভর দিয়ে বসে ঘনঘন গাল মুছতে মুছতে লাগলো। তিথি বলল,

” আমি মাকে বলব? ”

আয়জা বলল,

” ওই মহিলা মারতে মারতে মেরে ফেলবে আমাকে। তুমি কিছু করো নইলে আমি…

তিথি বলল, ” দেখো ভুলভাল কিছু ভেবো না। সবাই যা চায় তা পায় না। আমিও যা চেয়ে এসেছি তা পাইনি। যা পেয়েছি সেটাকেই আঁকড়ে ধরে আছি এখনো। ”

আয়জা বলল,

” উনার চাকরি হলে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। গ্রামের বাড়িতে ওদের পুরোনো বাড়ি আছে। টাকাপয়সা হলে নতুন ঘর তুলবে। ”

তিথি বলল,

” আচ্ছা ওর নাম্বারটা দাও। ”

আয়জা বলল,

” উল্টাপাল্টা কথা বলবে না তো? তুমি তোমার বরের হয়ে কথা বললে আমি ফোন নাম্বার দেব না।”

তিথি বলল,

” আমাকে বিশ্বাস না করলে কিছু করার নেই। ”

আয়জা ভয়ে ভয়ে নাম্বারটা দিল ওর হাতে। আয়জা বলল,

” এখন কোচিং-এ থাকবে। বিকেলে ফোন দিও। উনি কিন্তু তোমাকে চেনে। আমার মান রেখো। ”

বিকেলের দিকে তিথি ফোন দিয়েছিলো ছাদে গিয়ে। ডোডো ছাদে খেলছে। আবোলতাবেল কথা বলছে। কিছুক্ষণ পরপর আকাশে উড়ে যাওয়া পাখি দেখে চেঁচাচ্ছে। তিথির ফোন রিসিভ করেনি ছেলেটা কিন্তু পনের মিনিট পর নিজ থেকে ফোন দিয়ে সালাম দিয়ে বলল,

” আসসালামু আলাইকুম। যারিফ মঈনুল বলছি। আপনি কে বলছেন? ”

ওপাশ থেকে গাড়ির হর্নের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
গলাটাও কি কঠিন শোনালো! আরেকটা ফাটাকেষ্ঠ আয়জার কপালে জুটে গেল নাকি? কিন্তু কন্ঠস্বরটা খুব চেনা। তিথি বলল,

” মঈন ভাইয়া? ”

ওপাশ থেকে কন্ঠস্বরটা বলে উঠলো,

” আরেহ তিথি ভাবি! আপনি? ”

তিথির গলা থেকে আর কোনো শব্দ আসছিলো না। সে অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞেস করলো,

” আপনিই কি আয়জার সিনিয়র যারিফ ভাই? ”

ওপাশ থেকে উত্তর এল।

” জ্বি। কিন্তু..

তিথি ফোনটা কেটে দিল সাথে সাথে। আয়জার কাছে ছুটে এসে বলল,

” আমি কিছুতেই এই সম্বন্ধ করতে পারবো না। আমি নেই এসবে। এই তাহলে যারিফ মঈনুল! ”

আয়জা বলল,

” এভাবে বলো না। তুমি তো চেনো তাকে। ”

তিথি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

” তোমার ভাইও চেনে। তাকে গিয়ে বলো। আমি নেই এসবে। শেষমেশ বাড়ির ড্রাইভারকে…

আয়জা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

” ও গাড়ি চালানো শিখেছে। এটা কি খুব ছোট কাজ? তুমিও তোমার বরের সাথে থাকতে থাকতে অহংকারী হয়ে যাচ্ছ। ”

তিথি বলল,

” আমি ছোট করে বলিনি। তোমার ভাই যেটা বলতো সেটা বলছি। তুমি এটা ভালো কাজ করোনি। ”

আয়জা বলল,

” এমন করো না প্লিজ। ”

তিথি বলল,

” সরি আমার কিছু করার নেই। ”

আফতাব শেখ আপাতত চুপ করে আছেন। ছেলের কাণ্ডকারখানা চুপচাপ দেখছেন তিনি। তবে বাবা ছেলের কথাবার্তা বোধহয় এবার পাকাপোক্ত ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।

আজলান বাড়িতে ফিরে আধঘন্টা ধরে শাওয়ার নিল। তিথির সাথে কথা সেই বন্ধ হয়েছে আর কোনো কথা হয়নি।

কলের উপর কল আসছিলো তার ফোনে। তিথি তাকে ব্যস্ত হয়ে কথা বলতে দেখে যেটা আন্দাজ করেছিলো সেটাই হলো। রাতের খাবার টেবিলে জানালো, তার সহকর্মীর ফুপুর ছেলে র‍্যাবে সদ্য জয়ন করেছে। তার পরিবার আয়জাকে কালবাদে পরশু দেখতে আসবে। ওই ছেলের হাতেই আয়জাকে তুলে দেবে সে। ডিসিশন ফাইনাল। বাড়ি-গাড়ি, ছেলে কোনোকিছুতে খুঁত নেই।

তিথি তখন আয়জাকে দেখছিলো। তার ভেতরটা যেন দেখতে পাচ্ছিলো সে। কিন্তু তারপরও না দেখার ভান ধরে রইলো। তার কিছু করার নেই।

___

বিছানায় বসে ডোডোকে খাওয়ানোর সময় আজলান এসে একটা ছবি দেখালো ফোনের স্ক্রীনে। তিথিকে বলল,

” এটা আয়জা আর আয়জার বাবাকে গিয়ে দেখিয়ে এসো। ”

তিথি কথা শুনতে পায়নি এমন ভাব করে ডোডোকে দোল দিতে লাগলো। মাথা নীচু করে আদর করতে লাগলো। ডোডো বাবার গলা শুনে খাওয়ার ফাঁকে চোখ গোলগোল করে চাইলো। বাবার বাড়িয়ে দেয়া ফোন কেড়ে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে মায়ের বুকে গুঁজে গিয়ে বলল,

” আম্মান তুত্তু। ”

তিথি বিড়বিড় করলো, ” খাওয়ার সময় ডিস্টার্ব করলে এরকমই করবি। ”

আজলান মা ছেলের দিকে ক্ষেপাটে দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।

চলমান…

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_১৫ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১৫
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ডোডো ঘুম থেকে উঠামাত্রই কোলবালিশ ধরে উঠে বসেছে। তারপর হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে কেঁদে তার মাকে ডাকলো। তিথি এসে তাকে কাঁদতে দেখে বলল,

” আমাকে জ্বালাতে উঠে বসেছে। তোর চোখে কি ঘুম নেই ডোডো?”

ডোডো হাত বাড়িয়ে দিল মায়ের দিকে। কোলে নেয়ার আবদার জানিয়েছে।
তিথি কোলবালিশ নিয়ে ফেললে ডোডো ঢলে পড়ে গেল বিছানায়। পড়ে যাওয়ায় কেঁদে উঠলে তিথি তাকে ভ্যা ভ্যা বলে উপহাস করলো। মায়ের উপহাস করা দেখে রাগে দুঃখে জোরে জোরে কাঁদলো ডোডো। আম্বিয়া বেগম দরজা ধাক্কা দিতে দিতে বলল,

” আমার নাতিটারে এত কাঁদাচ্ছিস কেন রে? ”

তিথি বলল, ” ডোডো আরও জোরে কাঁদ। আজ তোর বাপ এলে বলবি তোমার বউ আমাকে মারছে। বলবি তো? তুই তো বোবা। কিভাবে বলবি?”

কান্নায় করায় ডোডোর চোখ লাল হয়ে গেল। তিথি কোলে তুলে দুগালে আদর করতে করতে বলল,

” ওলে ওলে বাবালে। তুই দেখছি আমার চাইতে কম ঢং জানিস না ডোডো। ”

ছেলেকে আদর করতে করতে হাসতে লাগলো তিথি। বলল,

” আয়জা চা আনোতো আমার ছেলের জন্য। মগ ভরে চা আনবে। ”

ডোডো এদিক-ওদিক তাকালো। তিথি হেসে বলল,

” ওরে চালাক রে। তুই এমন চা-খোর কেমনে হলি রে ডোডো। তোকে চা খাওয়ানো যাবে না আর। আমি চা-পাতা আর দুধ কিনতে গিয়ে ফকির হয়ে যাবো পরে। আমার জামাইয়ের টাকা পয়সার প্রতি আমার একটা দরদ আছে। ”

ডোডো গা ঝাড়া মেরে মাকে হাঁটার জন্য ইঙ্গিত দিল। দরজার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। তিথি বলল,

” পারবো না হাঁটতে। তুই আমাকে পেয়েছিসটা কি? আমার গায়ে ভীষণ জ্বর ডোডো। তোর কাপড়চোপড় ধুতে ধুতে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। তুই আমাকে এত জ্বালাস কেন? ”

ডোডো মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তিথি তার নাকে টুপ করে আদর দিয়ে বলল,

” হা করে কি দেখছিস? তোর মা কালো তাই তো?”

ডোডো হাসলো। তিথি বলল,

” ওমা আবার হাসে? ”

ডোডো আজকাল কিছু কিছু শব্দ উচ্চারণ করে। তিথি ওর কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি খায়। ডোডো ড্যাবড্যাব করে মায়ের দিকে তখন চেয়ে থাকে।

__

তিথির এ কয়েক মাস ডোডোকে নিয়ে সময় কেটে গেছে। আজলান বাড়িতে একদম সময় দিতে পারেনি। কাজের চাপে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরলেও তারপরের দিন আবারও সদরে রওনা দিতে হয়েছে। তাদের মিশন শেষ হওয়ার পর হঠাৎ করে সে না জানিয়ে একদিন বাড়ি ফিরলো। বাড়ি ফিরে শুনতে পেল, তিথির ভীষণ জ্বর। তাই ঘরে ওর ছেলেকে নিয়ে শুয়ে আছে। আয়জা বলল,

” বাবুও ঘুমিয়েছিলো। তাই ওর মায়ের পাশে শুইয়ে দিয়ে এসেছি। ”

আজলান ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াতেই দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল, তিথি চোখ বুঁজে আছে। ডোডো উঠে বসেছে। মায়ের গায়ে হাত দিয়ে খামচে দিচ্ছে। কেন তার মা অমন করে শুয়ে আছে চোখ বুঁজে এটাই তার প্রশ্ন। ওর খামচি খেয়ে তিথির ঘুম ছুটে গিয়েছিলো যদিও কিন্তু সে চোখ বুঁজে শুয়ে আছে।
ডোডো ওর বুকে দু’হাতে খামচে দিতে দিতে বলল,

” আম্মামমা তুত্তু দো। ”

তিথি ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,

” নেই। তোর বাপের কাছে যাহ। সারাক্ষণ শুধু খায় খায় করবে। দেব না তুত্তু। ”

ডোডো ঠোঁট টানলো তারপর ধপাস করে মাযের গায়ের উঠে মাথা ঠুকালো। তিথি হাসতে হাসতে বলল,

” তোর মায়ের খুব জ্বর ডোডো। তারউপর মারছিস? ”

ডোডো শাড়ির আঁচলের তলে মুখ ঢুকিয়ে বলল,

” তুত্তু দ্যা। ”

তিথি হেসে উঠে তার গালে আলতো করে চড় দিল। ডোডো বসে দু’হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে ফোঁপাতে লাগলো। তিথি বলল,

” আচ্ছা আচ্ছা কান্না করে না। ”

ডোডো বসা অবস্থায় মায়ের শাড়ির আঁচল মাথার উপর তুলে দিয়ে মুখে শব্দ করলো, ” উম উম। ”

তিথি ঘুমিয়ে গেল।
আজলান দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই ডোডো শাড়ির আঁচল তলা থেকে বেরিয়ে এসে আজলানের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকালো। হেসে আবারও মায়ের বুকে মুখ ঢুকিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর আবারও বেরিয়ে এল। আজলান হাত ধুয়ে এসে তার কাছে এসে বলল,

” মা ঘুম আর আপনি খাওয়াদাওয়া করছেন? ”

ডোডো তিথির গায়ের উপর উঠে শুয়ে থাকলো শাড়িটা মাথার উপর তুলে দিয়ে। আজলান সেখান থেকে টেনে কোলে নিয়ে বলল,

” মাকে জ্বালাচ্ছেন কেন? হুম? ”

ডোডো বলল, ” তুত্তুহ। ”

আজলান বলল, ” তুত্তু খাচ্ছেন? বাবা আপনার জন্য ঘোড়া এনেছে। দেখবেন? ”

স্যুটকেস থেকে একটা কাঠের ঘোড়া বের করে দিল আজলান। রিমোট চেপে দিলে সেটি হুংকার ছাড়ে, তারপর দৌড়ায়। আরেকবার চেপে দিলে সেটি পুনরায় ফিরে আসে। ঘোড়াটি পা তুলে হুংকার তুলে ছুটতে দেখে ডোডো কি খুশি! চিল্লিয়ে উঠলো হাততালি দিয়ে। তার খুশি দেখে আজলান তার গালে চেপে চেপে আদর করলো।

ডোডো খেলার ফাঁকে আবারও বিছানায় উঠে গেল। আবারও মায়ের বুকে মুখ আড়াল করে শাড়িটা মাথার উপর টেনে দিল।

কিছুক্ষণ পর তিথি আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো। আজলান ভড়কে গিয়েছে ওর চেঁচামেচি শুনে। তিথি দডোডোকে ঠাস করে মেরে বলল,

” অসভ্য ছেলে। তোর সবকটা দাঁত ফেলে দেব আমি। ”

পরে আজলানকে দেখে সব ব্যাথাবেদনা জ্বর ভুলে গিয়ে বলল,

” আমার জানাজায় আসতে। এত তাড়াতাড়ি কেন এসেছ? ”

আজলান ইউনিফর্ম চেঞ্জ করতে করতে বলল,

” তুমি তোমার ছেলেকে নিয়ে দিব্যি আছো। ”

ডোডোর খাওয়া তখন সম্পন্ন হয়নি। সে খেতে খেতে একবার মায়ের মুখের দিকে আরেকবার বাবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তিথি বলল,

” এই ছেলেকে আমি বেঁচে দেব। কেউ বাঁদর ছেলে কিনবে কিনা দেখিওতো। ”

আজলান বলল,

” বাঁদর বানিয়েছে কে? ”

তিথি বলল,

” আমি বানিয়েছি? ”

” আর কে? ”

তিথি বলল, ” আচ্ছা আচ্ছা তুমি গোসল করে এসো। আমি খেতে দিচ্ছি। এখন ঝগড়া করব না।”

আজলান ডোডোর দিকে চেয়ে বলল,

” আগে উনার খাওয়া শেষ হোক। ডোডো শেষে দাঁতের জোর দেখাতে ভুলো না কিন্তু। ”

ডোডো কি বুঝলো না কে জানে? উম উম বলে শব্দ করলো। তিথি রেগেমেগে বলল,

” বাপের কথায় সায় দিচ্ছিস? তোকে আমি বেঁচে দেব ডোডো। তোর মতো ছেলে আমার দরকার নেই। তোরা বাপ ছেলে দুটোই অত্যাচারী। আমি থাকবো না আর এই বাড়িতে। ”

______

আজলান ফিরেছে দেখে আম্বিয়া বেগম নানান রকম রান্নার আয়োজন করেছে। আজলানের সাথে আয়জার বিয়ে নিয়ে কথা বলছিলো আফতাব সাহেব। আজলান আপাতত কোনো মন্তব্য জানায়নি। আফতাব শেখ জানালো আগামীকাল আয়জাকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। সে যেন উপস্থিত থাকে।

রাতে তিথি খাওয়াদাওয়া করতে পারেনি তেমন। বাড়িতে ডাক্তার এনেছিলেন আফতাব শেখ। ঔষধ খাওয়ার পর তিথির জ্বর আরও বেশি বেড়েছে। ডোডো খাওয়াদাওয়ার পর একা একা খেলছে। খিদে না পাওয়া অব্দি আর কান্না করবে না। আয়জা তাকে নিয়ে গিয়েছিলো কোলে করে। ফুপীর সাথে তার দারুণ ভাব। আম্বিয়া বেগমের চোখের মণি সে। এখন কথা বলা শিখছে। সারাক্ষণ দাদ্দাহ দাদ্দাহ বলে চিল্লায়। বাবা ডাকতে বলে, আব্বাববাহহ। সবাই তার কথা শুনে হেসে কুটিকুটি হয়।

তিথি জ্বরে উল্টাপাল্টা বকছিলো। আজলান ঘরের মেঝে মুছে, ঘরটা গোছগাছ করলো। সারাঘরে ডোডোর কাপড়চোপড়, খেলনাপাতি, দোলনা ইত্যাদি মিলে হযবরল অবস্থা। সব গোছগাছ করতে করতে সে খেয়াল করলো তিথি মাথাটা পর্যন্ত তুলতে পারছেনা। মাথাটা পানি দিয়ে ধুয়ে দিল সে। তারপর মুছে দিতে দিতে বলল,

” ইচ্ছেমতো পানিতে গা চুবিয়ে রেখেছিলো বাথটবে? তাই না? ”

তিথি বলল, ” তুমি এতদিন পরে এসে আমাকে বকছো কেন গো? ”

আজলান ধমকে বলল,

” আমার প্রশ্নের অ্যানসার দাও মেহবুব। ”

তিথি বলল,

” জ্বর তোমার হয় না? ”

” না হয় না। ডোডোরও যদি এমন হয়? বাচ্চাটার কি হবে তখন? ”

তিথির মাথাটা তার বুকে ঠেকলো। বলল,

” আমার ডোডো অনেক শক্তিশালী। ওর বাহু তোমার চাইতে মোটা হবে বুঝেছ? ওর মায়ের বুকের দুধে কত ভাইটামিন আছে জানো? ”

আজলান বলল,

” ডাক্তার কি বলেছে? ”

” বলেছে আজ মরেও যেতে পারি। ”

আজলান তাকে বুক থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,

” সবসময় ফালতু কথা বলবেনা মেহবুব। ডোডোর কথা ভাবো এসব বলার আগে। ফালতু মেয়েমানুষ। ”

তিথি বিছানায় ঢলে পড়ে বলল,

” ডোডোকে তুমি রেখো। আমি চলে যাবো। ”

আজলান বলল,

” আরেকবার এসব ফাউল কথাবার্তা বললে সোজা ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব। ”

তিথি হেসে বলল, ” ধুর বোকালোক। আমার বাপের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলছি। ”

আজলান বলল, ” এতদিন যাওনি কেন? এখন আমি চলে এসেছি আর যেতে পারবে না। ”

আয়জা ডোডোকে নিয়ে এল। সে মাকে খুঁজছে। আজলানকে দেখে কোলে ঝাঁপ দিয়ে বলল,

” আমম্মাহ!”

আজলান বলল, ” ওই তো ওখানে। ”

ডোডো চোখ কচলাচ্ছে তারমানে ঘুমাবে। আজলান পিঠে কাঁধে মাথা ফেলে হাত বুলিয়ে দিল। ডোডো কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেল। ডোডো ঘুমিয়ে যেতেই আজলান তাকে দোলনায় রেখে বলল,

” দেখি থার্মোমিটার দাও। জ্বর কতটুকু দেখতে হবে। ”

তিথি থার্মোমিটার জিহ্বার নীচে দিল। আজলান জ্বর চেক করে দেখলো একশো। আয়জা বলেছে ওর গায়ে একশো দুই জ্বর ছিল। একটু কমেছে দেখে আজলান নিশ্চিত হলো। বিছানার বেডশিট আর বালিশের কভার চেঞ্জ করার জন্য একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছিলো তিথিকে। তারপর বিছানো শেষে তিথিকে কোলে করে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে ব্রাশ করালো। তিথি তার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করেছিলো।
তারপর ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে দিল। এলোমেলো চুলগুলোতে চিরুনি চালিয়ে বলল,

” অপরিচ্ছন্ন থাকলে রোগ-জীবাণু আরও বেশি আক্রমণ করে মেহবুব। এখন বলো কেমন লাগছে।”

তিথি তাকে বুকে মাথা ফেলে বড় করে শ্বাস ফেলে বলল,

” খুব ভালো। তুমি এসেছ তাই আমি সুস্থ হয়ে গিয়েছি। কিন্তু দুর্বল লাগছে। তুমি না থাকলে আমি বোধহয় মরেই যাবো। ”

আজলান তাকে কোলে নিয়ে বিছানায় নিয়ে এল। শুয়ে দিয়ে বলল,

” জ্বর উঠানামা চেক করতে হবে। যদি জ্বর কমে তো ভালো। না কমলে সোজা নিয়ে যাবে চেম্বারে।”

তিথি বললো, ” ডোডোকে আমার পাশে দাও। ”

আজলান ডোডোকে তার পাশে এনে দিল। ঘুমন্ত মুখটাতে আদর করে বলল,

” ওর মুখে আঁচড় কিসের? ”

” রাগ করে নিজের নখ দিয়ে নিজেই আঁচড় দিয়েছে। বাপের মতো হাড়বজ্জাত হয়েছে কি এমনি বলি? এইটুকুনি ব্যাটা, অথচ কত রাগ তার। তোর বাপের বউ থেকে গেছে কষ্ট করে, কিন্তু তোর বউ একদিনও থাকবে না দেখিস। আমি ভালো শ্বাশুড়ি হবো। তুই তোর বাপের মতো হলে তোর বউকে দিনে দিনে দিয়ে আসবো ওর বাপের বাড়ি।”

আজলান বলল, ” চুপ। অযথা বকছো তুমি। ওর ঘুম ভেঙে যাবে। ”

তিথি দেখলো ও ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমোচ্ছে। ফোলা ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল,

” আমার সোনা রে, ঘুমালে তোরে কত্ত আদর লাগে। ”

আজলান বলল,

” ননসেন্স। ওকে ঠোঁটে চুমু দিতে বারণ করেছি মেহবুব। এসব ভালো না। ”

” তুমি যে দাও। ”

” কখন দিয়েছি? ”

” আমাকে দাওনি? ”

আজলান দাঁত কিড়মিড় করতেই তিথি বলল,

” নিজে দিলে দোষ নেই আমি দিলেই দোষ। আমি আমার সোনাটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। ”

ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল তিথি। আজলান ডিমলাইট জ্বালিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

মাঝরাতে তিথি ডোডোকে তার পাশে এনে আজলানের বুকে গুঁজে গিয়ে বলল,

” কতদিন পর এসেছ। আমাকে একটু জড়িয়েও ধরোনি। এই? ”

আজলান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তিথি তার বুকে মুখ ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে গেল । আজলান অনেকক্ষণ পর বলে উঠলো,

” জ্বর কেমন তোমার?”

তিথি বলল, ” অনেক বেশি। ”

আজলান তার কপাল চেক করলো। তিথি বলল,

” জ্বর তো এখানে থাকে ” বলেই আজলানের হাতটা উদরের উপর রাখলো। আজলান উদর ধরে টেনে এনে জড়িয়ে ধরে বলল,

” হুম কমে এসেছে। ”

তিথি বলল, ” অনেক জ্বর আছে এখনো। ”

আজলান বলল, ” আচ্ছা সকালে ঔষধ দেব। ঘুমাও চুপচাপ। ”

তিথি বলল, ” এখন দাও। সকালে ডোডো জেগে উঠবে।”

আজলান ভালো করে চোখ মেলে দেখলো ডোডোকে ওপাশে রেখেছে তিথি। সে অবাককন্ঠে বলল,

” তুমি ওকে ওদিকে রেখেছ কেন? ”

তিথি বলল, ” আমার তোমার সাথে লেপ্টে ঘুমাতে ভালো লাগে। ”

আজলান তার দিকে চোখ ফেলে বলল, ” কে যেন চলে যাবে বলেছিলো। ”

” হ্যা তাইতো। সময়টা চলে আসতেছে। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি না থাকলে আমার কিচ্ছু ভালো লাগেনা। ”

আজলান বলল, ” তাহলে যেওনা। ”

” না যেতে হবে। বাপের বাড়ির জন্য মন পুড়ছে, সাথে তোমাকেও বুঝাতে হবে আমি না থাকলে কেমন লাগে। ডোডোকেও বুঝাতে হবে। ”

আজলান বলল, ” ঘুমাও চুপচাপ। ”

তিথি বলল, ” খুব শীত করছে। তোমার গা কি গরম! তোমারও কি জ্বর?”

” না। আমার গা সবসময় এমন থাকে। ”

” মাথার মতো গাও সবসময় গরম থাকে। বুঝলাম।”

তিথি তার বুকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করতেই আজলান তাকে বুকের নীচে চেপে ধরে গলায় মুখ গুঁজে বলল,

” আর কোনো নড়াচড়া করলে সোজা বের করে দেব। ”

তিথি বলল, ” আদর করার সময়ও ধমকায়। কেসটা কি বুঝলাম না আজও। ”

ভোর নাগাদ ঘুম ভাঙতেই আজলান দেখলো ডোডো তাদের মাঝখানে চলে এসেছে। মাথাটা তিথির পেটের সাথে লেগে আছে , একটা পা আজলানের মুখের উপর, আরেকটা গলায়। আজলান আফসোসের সুরে বলল,

” সব আয়ত্ত করে নিয়েছে মায়ের কাছ থেকে। ”

চলমান.
রিচেক হয়নি

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_১৪ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১৪
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আজলান কাজে বেরোনোর আগে পইপই করে বলে দিয়ে গেছে ” মেহবুব আইজানকে ভেজা অবস্থায় বেশিক্ষণ ফেলে রাখবে না। ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে মাকে অথবা আয়জাকে ডেকে নেবে। খাওয়ানোর পর ওকে কোলে নিয়ে বেশি দোল দেবে না, হাসাবে না। ”

তিথি লক্ষীটির মতো মাথা নেড়েছে। আজলান নিশ্চিন্তে কাজে গিয়েছে। ফিরতে দেরী হলেও তিথির জন্য একটা ফুল আনতে ভুলেনি। যদিও ফুলটা বাসি। সহকর্মী উনার ওয়াইফের জন্য কেনার সময় একটা আজলানকে দিয়ে বলেছিল,

” আপনার বিবিকেও দেবেন। দেখবেন ভালোবাসার অভাব হবে না। ”

ভালোবাসা শব্দে আজলানের একপ্রকার এলার্জি আছে। বিয়ে করলে সংসার হবে, বাচ্চা-কাচ্চা হবে, বউকে পরিমিত আদর সোহাগে রাখতে হবে, পাশাপাশি পরিমিত শাসনও করতে হবে এটাই হচ্ছে মূলকথা। এখানে ভালোবাসা টালোবাসা শব্দগুলোর জায়গা কোথায়? যত্তসব অপ্রাসঙ্গিক কাব্যিক কথাবার্তাকে মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। যার ফলে সে এত আদর সোহাগে রাখার পরও তার বউ বলে সে কাঠখোট্টা মানুষ, রোম্যান্টিক নয়, প্রেমিক নয়। বিয়ের পর সাংসারিক ক্যাঁচাল নামক সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনার মধ্যে জীবনের আসল স্বাদ খুঁজে নিতে হয়, সেখানে প্রেমের জায়গা কোথায়? বাচ্চা হওয়ার পর যেখানে বিছানায় ভালোমতো জায়গা হচ্ছে না সেখানে আবার প্রেম না ছাই!

এসব প্রেম ভালোবাসার মতো সস্তা সস্তা লেকচারগুলো কবি সাহিত্যিকরা আবিষ্কার না করলে প্রতিটা মানুষ সংসারী হওয়ার প্রতিযোগীতায় লেগে পড়তো। কিন্তু এখনকার মাথামোটা পাবলিকগুলো কবি সাহিত্যিক নামক উজবুকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রেম আর ভালোবাসার গভীর মর্মার্থ খুঁজতে গিয়ে স্বামী সংসার কিচ্ছু চেনেনা। মাঝেমধ্যে বোধহয় স্বামীকে বলতে ভুলে যায়, ” কে গো তুমি? কোথায় থাকো? কোথা থেকে এসেছ? তুমি নারী না পুরুষ?”

ফুলটা আনার পর সেটাকে সে বেডসাইড টেবিলে রেখে ওয়াশরুমে চলে গিয়েছে। তিথি ফুলটা দেখামাত্র চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। ফোনটা তার সহকর্মী দিয়েছে একথা তিথি বিশ্বাস করবে না। পুরুষ মানুষ কেন পুরুষ মানুষকে ফুল দেবে? এ অসম্ভব। সে কিনেছে একথাও ভুল কারণ বাসি ফুল কেউ কিনবে না তাও একটা। অতএব দাঁড়াচ্ছে ফুলটা কোনো মেয়েমানুষ তাকে দিয়েছে। রাগারাগির ফাঁকে কান্নাকাটিও করে ফেললো তিথি। চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আজলানের কিছুই করার রইলো না।

আজলান এমনিতেও রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারেনা। মা ছেলে দুজনেই বকবক বকবক করে। শ্বশুরের বাইশ তেইশ বছরের বাচ্চাটা তার দুইমাস বয়সী বাচ্চাটার সাথে সারাক্ষণ বকবক তো রয়েছেই সাথে সে কি হাসি! যেন তারা একে অপরের ভাষা বুঝে ফেলে। আজলান কানের উপর বালিশ চাপা দিয়েও ঘুমোতে পারেনা। মাঝরাত অব্দি বকবক করতে গিয়ে যখন দু’জন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন মা তার ছেলেকে বলে,

” ডোডোরে তোর বাপটা সারাদিন কত কষ্ট করে বাইরে। কত কষ্ট করে রোজগার করে আমাদের জন্য। তোর জন্য আমি তোর বাপের কাছেও ঘেঁষতে পারিনা। একটু মাথাও টিপে দিতে পারিনা। তোর মনে কি দয়ামায়া নেই ডোডো? ”

আজলানের তখন রাগ হবে, নাকি নিজের অদৃষ্টের পরিহাস ভেবে সে দুঃখ যাপন করবে কিছুই ভেবে পায় না সে।

____

সেদিন কাজে বেরোনোর সময় আজলান দেখে, তিথি ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে কোনোমতে উঠে বসেছে। সে যাওয়ার সময় একটু এগিয়ে দেয়ার জন্য ঘরের বাইরে বের হয়। আজও তাই। আইজান তখন ঘুম। তার ঘুমন্ত মুখে কয়েকটা আদর দিয়ে আজলান বেরিয়ে যাওয়ার সময় যখন বললো,

” বাবুকে চোখে চোখে রাখবে। ”

তিথি হাই তুলে বলে উঠে, ” ও আমাকে চোখে চোখে রাখে যাতে তোমার কাছে না যেতে পারি। ”

আজলান বলল, ” ননসেন্স মহিলা। ”

তিথি বলল, ” তোমার সাদা পায়জামায় হলুদ হলুদ যে রঙটাকে আমি তরকারির ঝোল বলেছি ওটা আসলে ডোডোর পটির রঙ ছিল। আমি ভাই বুঝিনা কিছু। ও খায় সাদা তরল জিনিস। পটি কেমনে হলুদ হয়? ”

বেরোনোর সময় মাথা গরম করতে চায়নি আজলান। কিন্তু তিথির কথায় রাগ চেপে রাখতে পারেনি। বাহু চেপে ধরে বলল,

” পায়জামা ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখবে। দাগটা না গেলে আমি তোমাকে সোজা বের করে দেব। ”

তিথি বলল, ” আমি তো সেটাই চায় বস। একবার বের করে দেখো না। বাচ্চাকে ফিডার খাওয়াতে, হাগুমুতু পরিষ্কার করতে কি মজা হাড়ে হাড়ে বুঝবা। ”

______

আজলান বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে এসে ডোডোকে কোলে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসে। কোলে নিয়ে হাঁটলে ডোডোর চাইতে খুশি আর কেউ হয় না। আজলান তার নরম নাকটাতে নিজের নাক ঘষে আদর করে। তখন অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করে ডোডো। যেন কতকিছু বুঝে সে। হঠাৎ হঠাৎ ঢেঁকুর তুলে। ছোট্ট শরীরটার ঘ্রাণ অদ্ভুত লাগে আজলানের। কোনো কৃত্রিম সুগন্ধি মাখতে হয় না তারপরও মিষ্টি একটা সুঘ্রাণ বাচ্চাটার গায়ে। আজলান তার গালে টুপটাপ আদর করে তাকে হাসালো। আর তার পরপরই গলগল করে দুধবমি করে দিল সে। আজলান দেখলো তার হাত আর বুকের কাছে শার্টটা ভরে গেছে বমিতে। তিথিকে ডাকতেই তিথি দৌড়ে এল। হায়হায় করে বলল,

” যা খেলি সব বের করে দিলি ডোডো? তুমি আমাকে বকো এখন নিজেই ওকে এমন করে হাসালে কেন? ও তো সব বের করে দিল। নিজে কি ওকে খাওয়াতে পারবে? ওকে খাওয়ানোর মুরোদ তো নেই শুধু বের করে দেয়ার মুরোদ আছে তোমার। আরও মুখে কত বড় বড় লেকচার। ”

নিজের ওড়না দিয়ে সব বমি মুছে নিয়ে তিথি ডোডোকে কোলে নিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগলো,

” হ্যা রে ডোডো তোর আক্কেল জ্ঞান কখন হবে? খাওয়ামাত্রই সব বের করে দিস। এখন কিছুক্ষণ পর আবার চিল্লাবি খিদে পেয়েছে বলে। আমার কি তোকে খাওয়ানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই?তোরও কি খাওয়া আর হাগুমুতু করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই? মায়ের হয়ে তোর বাপকে দুটো কথা তো বলতে পারিস না। হাতে হাতে কাজ করার মুরোদও তোর নেই। শুধু পারিস ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে। বেয়াদব ছেলে একটা। সর, আর কাঁদিস না। তোদের বাপ ছেলের ঢং দেখলে বাঁচি না। ”

আম্বিয়া বেগমের কোলেও বেশিক্ষণ ছেলেকে রাখবে না সে। তেল মাখা শেষে কোলে নিয়ে ফেলবে। গোসল করানোর সময় ধরতে দেয়, ও খাওয়ার সময় কোলে দেয়, নামাজ পড়ার সময় দেয়। বাকিসময় ছেলেকে কোল থেকে নামাবে না। আম্বিয়া বেগম বলল,

” তুই এক ব্যাটামানুষের মা হলি। আমাদের গুলো জলে জলে ভেসে ভেসে আসছে।”

তিথি ভৎসনা করে বলে,

” তোমরা হচ্ছো পুরোনো আমলের অশিক্ষিত আনপড়াহ মেয়ে মানুষ। আমি হচ্ছি স্মার্ট মাদার। একুশ শতাব্দীর মায়েরা কি তোমাদের মতো বাচ্চাকে রশি দিয়ে বেঁধে সেই রশি কোমরে গিঁট বেঁধে ঘরের কাজ করবে? ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, “তোর এক ঠোঁট আছে। কেউ পারবে না তোর সাথে। তুই একটা জিনিস।”

তিথি বলল,

” আমাকে সবাই বলতো তুই কেমনে সংসার করোস দেখমু। জীবনেও তোর ঘর সংসার হবে না। তোর মতো পাগলছাগলের জীবনেও স্বামী সংসার হবে না। এখন আমি তাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিয়েছি। বলে এসেছি, দেখে আয় কিভাবে শ্বশুর শ্বাশুড়ি আর বরটাকে জব্দ করেছি। ”

আম্বিয়া বেগম বললেন,

” সর। ”

______

ডোডোর মুখে ভাত ছোঁয়ানো হয়েছিল অনেক আগে। পাঁচ কি ছয় মাস বয়সে। এখন তার বয়স ১৩ মাসে পড়েছে। ডোডো এখন টুকটাক খেতে শিখেছে । এখন তিথি তাকে ভাতের পাশাপাশি ঠান্ডা চা খাওয়ানো শিখিয়েছে। আর চায়ে তার এত নেশা হয়েছে যে সে চায়ের কাপ দেখলেই হাত ঝাপটানো শুরু করে। সাবু খেতে না চাওয়ায় আজলান ধমক দিতেই সে কি কান্না। তিথির কাঁধে মাথা ফেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে গেল। ছেলের দুঃখে মাও কেঁদে ফেলবে এমন অবস্থা। তিথি বলল,

” আমার ছেলেকে অমন করে বকবে না। আমরা মা ছেলে এই বাড়িকে ঠ্যাং দেখিয়ে চলে যাবো বলে দিচ্ছি” বলেই ডোডোকে বলল, ” ডোডো ডোডো পাহ কোনটা দেখা তো। পাহ পাহ। ”

ডোডো পা দুটো দোলাতে লাগলো।
আজলান হতভম্ব হয়ে গেল।
রেগে গিয়ে ডোডোর হাত পা বেঁধে দুধ খাইয়ে দিতে দিতে বলল,

” চুপচাপ খাও। মেহবুব তুমি ওকে কি শেখাচ্ছো এসব?”

তিথি বলল,

” কচু।এসব কি হচ্ছে? আমার ছেলেটার উপর এভাবে অত্যাচার করছো কেন? ”

আজলান ধমকে বলল,

” শাট আপ। ”

তিথি ডোডোর কাছে এসে জিভ বের করে বললো,

” এই ডোডো, ডোডো! তোর বাপকে ভেঙচি দে তো। ”

ডোডো জিভ বের তাকালো আজলানের দিকে। আজলান অবাক হয়ে তাকাতেই তিথি হেসে উঠলো। সাথে ডোডোও খিকখিক করে হাসতে লাগলো। রাগে আগুন হয়ে আজলান তিথিকে ধরতে যেতেই তিথি পালিয়ে গেল। আটঘাট বেঁধে আজলান তাকে ধরতে নেমেছে দেখে তিথি ছুটে এসে তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। মুখ তুলে রাগান্বিত মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল,

” আদর করার জন্য মিষ্টিসুরে ডাকতে হয় এটা তুমি কবে শিখবে আফিষাড়? ”

আজলান কিছু বলতে যাবে তার আগেই
“ডোডো ডোডো চোখ বন্ধ কর” বলে তিথি চোখ বন্ধ করে দেখালো। ডোডো তার দেখাদেখি চোখ বন্ধ করতেই তিথি আজলানের মাথা টেনে গালে ঠোঁট চেপে চুমু খেয়ে বলল,

” ডোডো চোখ খোলার আগে আমার পাওনা দিয়ে ফেলো বস। তুমি তো আবার ঋণী হয়ে থাকতে চাওনা।”

আজলান বলল, ” আগামী সাতদিনের মধ্যে ওর চায়ের নেশা কমাবে নয়ত তোমাকে আমি বাড়ি থেকে সোজা বের করে দেব। ”

তিথি বলল, ” সাথে ডোডোকে ফ্রি। ঠিক কিনা? জোরে বলো ঠিক ঠিক। ”

চলমান….

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_১৩ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১৩
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

তিথিকে বাড়িতে আনা হলো তারপরের দিন। অদক্ষ হাতে একটা তুলতুলে বাচ্চা সামলাতে গিয়ে কত নাকানিচুবানি খেতে হলো তাকে। অধৈর্য, সংযমহীন তিথি যেন একরাত্রের মধ্যেই ভীষণ সংযমী হয়ে উঠেছে। রাতে চোখ বুঁজে ঘুমাবে তার উপায় নেই। যেমন বাপ তেমন ছেলে।

বাপ ঘরদোর পরিষ্কার করতে করতে অর্ধেক রাত সাবাড় করে দেবে, আর ছেলে ক্যা কু করতে করতে ফজরের ওয়াক্ত হয়ে যাবে। রাতে ঘুমাতে না পেরে তিথি পড়েছে মহামুশকিলে। দিনের বেলায় যত ঘুমাক রাতের ঘুমের অভাবটা যেন পূরণ হতেই চায় না। সকালের দিকে একটু ঘুমাতে পারে যাও দশটা হতে না হতেই বাবু আবারও ঘুম থেকে উঠে যায়।

অবশ্য রাতে শুধু সে নির্ঘুম থাকে এমন না। তার সাথে সাথে তার বাচ্চার বাপও নির্ঘুম থাকে। তিথি স্বাস্থ্যবিধি মেইনটেইন করছে কিনা সেটা দেখার জন্য হলেও সে সারাক্ষণ মা ছেলেকে নজরে নজরে রাখবে। ভাগ্যিস কাজে চলে যায় নইলে মরার মতো ঘুমানোও চুটে যেত তিথির।

আজলান আজ হুট করে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরে এল। এসে দেখলো বাচ্চা কাঁদছে। তিথি তার কান্নাকে উপহাস করে বলছে, ” ভ্যা ভ্যা ভ্যা। ”

মায়ের এমন উপহাস দেখে সে আরও চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে হাত পা নেড়ে। আজলান দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই তিথি বলল,

” তোর জন্য চুল আঁচড়াতে পারছিনা ডোডো। দেখ দেখ চোখের নীচে কালি। একটু মায়া হয় না তোর? হবেই বা কেন? বাপ বজ্জাত। ছেলে বজ্জাত হবে না? তুই ভালা মাইনষ্যের বেটা নোস। কিন্তু আমি তো তোর মা। ন মাস পেটে রেখেছি। তোর কত লাথি খেয়েছি। আমার জন্য তোর মায়া হয় না ডোডো? ”

ডোডোর কান্না থামার নয়। আজলান তার অস্বাভাবিক কান্না দেখে ভুরু কুঁচকে ভেতরে ঢুকলো। তিথি তাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেল। আজলান হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে তোয়ালেতে হাত মুছতেই তিথি একটা ব্লু গ্যাস ম্যাচ নিয়ে এসে বললো,

” নাও নাও আগুন ধরো আগে। ”

আজলান হাত বাড়িয়ে দিতে আগুন ম্যাচ জ্বালালো। আগুন ছুঁয়ে বাচ্চার কাছে যেতেই আজলান কোলে তুলে নিয়ে দেখলো সে হিসু করে রেখেছে তাই কাঁদছে। তিথির দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে আজলান বললো,

” তুমি ওকে এভাবে ফেলে রেখেছ? ”

তিথি বলল, ” আমি জানতাম না। ”

আজলান বলল, ” ওর ঠান্ডা লাগলে তোমাকে ছাড়বো না আমি। ননসেন্স মহিলা। খেয়াল কোথায় থাকে তোমার?”

তিথি গোমড়া মুখে ডোডোর দিকে চেয়ে রইলো। ডোডোকে পরিষ্কার করে কোলে তুলে নিল আজলান। তিথি দেখলো সে একদম শান্ত হয়ে গেছে। ন’মাস পেটে রেখে দুনিয়া দেখিয়েছে সে। আর হয়েছে বাপ পাগল। বাপ ধরলেই কান্না বন্ধ। বাপ কোলে নিলেই ঘুম। এ কেমন কথা তিথি বুঝে পায় না। ডোডো ঘুমিয়ে যেতেই আজলান বলল,

” তুমি চুল আঁচড়ে নাও। আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি। খবরদার শব্দ করে জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করবে না। ”

বলেই কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল সে। এসে দেখলো তিথি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মাথার নীচে বালিশ নেই। হাত খোপাটা খুলে গিয়েছে। আজলান তার মাথার নীচে বালিশ দিল। তারপর লাইট নিভিয়ে নীচে চলে গেল।

কফি খেয়ে তিথির জন্য চা বিস্কিট নিয়ে ঘরে আসামাত্রই দেখতে পেল তিথি ঘুম থেকে উঠে দোলনার সামনে বসে ডোডোর ঘুমন্ত মুখ ধরে বলছে,

” এই দুষ্টু ছেলে উঠ বলছি। সারারাত আমাকে ঘুমাতে না দেয়ার ফন্দি এঁটেছিস না বাপ ছেলে মিলে? আমি কিন্তু অত রাত জাগতে পারবো না ডোডো। বলে দিচ্ছি কিন্তু। তুই কাঁদবি আমি ঘুমাবো। আমার মনে কিন্তু মায়াদয়া নেই ডোডো। আমি পাষাণ মা বুঝলি। এই ছেলে তুই উঠবি কি উঠবি না? ”

বলেই দোলনায় ধুপধাপ মাথা ঠুকালো। আজলান ঘরে প্রবেশ করতে করতে বলল,

” তোমার পাগলামো কমবে কিসে? ”

তিথি অসহায় চোখে চেয়ে রইলো। বলল,

” ওকে এখন ঘুম পাড়ালে কেন? সারারাত জেগে থাকবে। ”

” আমি জেগে থাকবো ওর সাথে। তুমি ঘুমিও। ”

” তাহলে তুমি ওকে খাইয়ে দিও। আমি দেব না। ”

আজলান বলল, ” চুপচাপ চা খাও। ”

তিথি এসে চা দেখে বলল, ” আমি মগভর্তি চা খাই। এসব অল্প চায়ে হবে না। ”

আজলান বলল, ” চা বেশি খাওয়া ভালো না। ”

” বেশিই খাব। ”

আজলান গর্জে বলল, ” ওকে ফাইন। ”

আজলানের নির্দেশে কিছুক্ষণ পর মগভর্তি চা নিয়ে এল আয়জা। তিথি চা খাওয়া শেষ করে আজলানকে জড়িয়ে ধরে থুঁতনিটা বুকে ঠেকিয়ে মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,

” আচ্ছা বলোতো ডোডো কাকে বেশি ভালোবাসে। তোমাকে না আমাকে। ”

” ছেলেরা মাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। ”

তিথি খুশি হয়ে বলল,

” তুমি এতদিন পর একটা ভালো কথা বললে। তোমাকে একটু কম কেন ভালোবাসবে? ”

” যেটা একটু কম মনে হয় সেটা অপ্রকাশিত রয়ে যায়। ছেলেরা বাবাকে ভালোবাসে, কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারে না। ”

” তারমানে তুমিও শ্বশুরআব্বাকে খুব ভালোবাসো। তাই না? ”

আজলান বলল,

” জানিনা, ছাড়ো। ”

তিথি বললো, ” বলো না বলো না। তুমি শ্বশুর আব্বার সাথে ভালো করে কথা বলো না কেন? একটা সময় গিয়ে তুমি উনাকে কথা বলার জন্য খুঁজে পাবে না। তুমি কথা বলাকে এত অপছন্দ করো কেন? আমাকেও কত অপছন্দ করো। ”

আজলান বলল, ” তুমি চুল আঁচড়ে নাও। তোমার কাছে এখন যথেষ্ট সময় আছে। ”

তিথি চিরুনি নিয়ে এসে আজলানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

” তুমি আঁচড়ে দাও। ”

আজলান আঁচড়ে দিতেই তিথি চেঁচিয়ে উঠে বলল,

” সব চুল ছিঁড়ে ফেললো। ইচ্ছে করে করেছ তাই না? শাস্তি দিয়েছ আমাকে?”

আজলান বলল, ” জট বেঁধেছে সেটা ছাড়িয়েছি। আজব!”

তিথি কেঁদে ফেললো প্রায়। বলল,

” তোমাকে যদি আমি ডোডোর পটি আর উঁকুন ভাজা না খাইয়েছি। ”

তিথির কথায় আজলান নিৰ্বাক হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। তার চোখমুখ দেখে তিথি পালাতে যাবে তখনি আজলান তাকে খপ করে ধরে ফেললো। তিথি চেঁচিয়ে বলল,

” ডোডোরে তোর বাপ আমাকে মারছে দেখ। ”

_____

ডোডোর নামকরণ আর গরু জবাই করে আকীকা করা হলো একুশতম দিনে। বেশ বড়সড় আয়োজন হয়েছে সেদিন। ওর পুরো নাম দেয়া হয়েছে শেখ তাশদীদ আইজান। মফিজ সাহেব আর মালেকা বেগমের খুশির শেষ নেই নাতিকে পেয়ে। তিথি এতটাই ব্যস্ত যেন সে ছেলের বিয়ে দিচ্ছে। আজলান তাকে সারাদিন আশেপাশে দেখিনি। নতুন নতুন কোল পেয়ে ডোডো ভীষণ খুশি। কোলে চড়ালে কান্না ভুলেও আসবে না তার।

মেহমান কমে আসতেই তিথি রান্নাঘর থেকে ঘরে এসে হাজির হলো। আজলানের পাশে এসে বসে বললো,

” ডোডো আজ অনেক টাকা পেয়েছে জানো? শ্বাশুমা অনেক টাকা কট করে নিয়েছে নইলে আরও বেশি হতো। ”

বলেই টাকাগুলো হিসাব করতে লাগলো। হিসাব শেষে বলল,

” তেইশ হাজার টাকা। তুমি যে আমাকে হাতখরচ দিয়েছ সেখানে কিছু আছে। সেগুলো সহ টোটাল হয়েছে ত্রিশ হাজার টাকা। শুনো এগুলো দিয়ে আমি ডোডোর বউয়ের জন্য একটা নেকলেস বানাবো। ”

আজলান বলল, ” গুড ডিসিশন। ”

তিথি তাকে জড়িয়ে ধরে তার গালের দাঁড়িগুলোতে আঙুল গলিয়ে বলল,

” তোমাকে একটা দাঁড়ি ছাটাই করার মেশিন কিনে দেব। তুমি আমার গাল টাল ছিঁড়ে ফেলো। ”

চলমান

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_১২ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১২
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

তারপরের দিন মালেকা বেগম এলেন মেয়েকে দেখার জন্য। সাজের নাশতা বানিয়ে এনেছেন। তিথি মাকে পেয়ে মহাখুশি।

মালেকা বেগম বললেন, ” জামাই কোথায় রে?”

তিথি নাশতা খেতে খেতে বললো, ” ও রাতে আসবে। তুমি বাবুর কাঁথাগুলো এনেছ আম্মা?”

মালেকা বেগম কাঁথাগুলো সব বের করলো ব্যাগ থেকে ।

তিথি সেগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাসলো। বলল, ” অনেক সুন্দর হয়েছে। ”

মালেকা বেগম বললেন,

” জামাইয়ের যদি পছন্দ না হয়? ”

তিথি বলল,

” পছন্দ হবে। ও আমাকে আরও বকবে। কেন জানো? এগুলো করতে তোমার কষ্ট হয়েছে তাই।”

” কি আর কষ্ট! আমার নাতি নাতনির জবাব এটুকু করতে পারব না? ”

মালেকা বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ” হ্যা রে তোকে এখন বকাঝকা কম করে তাই না? ”

তিথি বলল, ” না সবসময় করে। করলেও আমার কি? আমার কিছু যায় আসে না। ”

মালেকা বেগম বেকুব বনে গেলেন। বললেন, “এটা কেমন কথা? ”

তিথি বললো, “ওসব তুমি বুঝবে না। স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার। ”

মালেকা বেগম বললেন, ” পাগলের মতো কথা। ”

___

আম্বিয়া বেগম নাশতা খেয়ে প্রশংসা করলেন। আজলানের জন্য পরিষ্কার দেখে কয়েকটা তুলে রাখলেন।

রাতে আজলান বাড়ি ফিরে মালেকা বেগমকে দেখে কুশলাদি বিনিময় করে বললো, ” তুষার আসেনি কেন? ”

” ও রাঁধতে বাঁধতে পারে। ওরা বাপ ছেলে রেঁধেবেড়ে খাবে তাই আসেনি। ”

” ওহহ। আচ্ছা বেশ, থাকুন। আমি ঘরে যাই। ”

বলেই ঘরে চলে গেল। তিথি মালেকা বেগমকে বলল,

” ভালো ভালো কথা শুনে পটে যেওনা। বড় চালাক লোক। ”

মালেকা বেগম বললেন, ” চুপ থাক। এমন ছেলে কপালে জুটেছে তার জন্য শুকরিয়া কর। হয়ছে বাপের মতো মাথামোটা। লাগামছাড়া কথা বলতে বলতে স্বভাব হয়ে গেছে। বেয়াদব কোথাকার। ”

তিথি গোলগোল চোখে মাকে চাইলো। মালেকা বেগম বললেন,

” হা করে কি দেখছিস? যা ঘরে যা। দেখ জামাইয়ের কিছু লাগে কিনা। ”

তিথি চোখ দুটো পিটপিট করে অবাক কন্ঠে তোতলাতে তোতলাতে বললো, ” আম্মা আম্মা তুমি আমাকে বেয়াদব ডেকেছ? তাও আমার শ্বশুরবাড়িতে বসে? তোমার কি দেমাক খারাপ হয়ে গেছে? তুমি আমার মা হয়ে অন্যের ছেলের হয়ে কথা বলছো? খবরদার বলছি আম্মা, তুমি যদি ওই লোককে লাই দাও, আমার দোষ বুঝাও, তাহলে আমি তোমাকে কালকেই বাড়ি পাঠিয়ে দেব। আব্বেশালা এমন মা তো জীবনে দেখিনি আমি। ”

মালেকা বেগম বললেন, ” আমার দুঃখ লাগে ছেলেটার জন্য। তোর মতো পাগলছাগল তার কপালে কি করে জুটলো। ”

তিথি মুখ মোচড়ে দিল। আম্বিয়া বেগম এসে বললো,

” তুই তোর মায়ের সাথেও ঝগড়া করছিস নাকি বউ?”

তিথি উনার দিকে চেয়ে গম্ভীর মুখে তাকালো। কোনো কথা না বলে চলে গেল হনহনিয়ে হেঁটে। আম্বিয়া বেগম বললেন,

” ওর কথা বাদ দেন। চলেন, একটু চা খাই। আপনার বাপের বাড়িতে মনে হয় তেমন যাননা? ”

আম্বিয়া বেগমের বাপের বাড়ি আর মালেকা বেগমের বাপের বাড়ি একই এলাকায় তাই উনি মালেকা বেগমকে পেলেই বাপের বাড়ির গল্পগুজব শুরু করে দেন। দুজনের ভালোই জমে উঠেছে।

মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এই প্রথম এসেছে মালেকা বেগম। শুরু থেকে তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে এখন যখন দেখতে পেলেন তারা সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতির মানুষ তখন অনুশোচনায় দগ্ধ হলেন তিনি। মেয়েটাকে আল্লাহ যেন একটু বুঝ দেন। সংসারটা ভাঙতে ভাঙতে জোড়া লেগেছে । শেষ রক্ষা যেন হয়।

_____

আজলান মপ দিয়ে ঘরের মেঝে মুছে, ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা মুছে, কাপড়চোপড় সব ওয়ারড্রবে ভাঁজ করে, বিছানার চাদর আর বালিশ পাল্টে নিল। তিনদিন পরপর সে বালিশের কভার পাল্টায়। চাদর সাতদিন পরপর পাল্টায়। ক্ষেত্রবিশেষে তিনদিন পরপর। তিথি বুঝে পায় না বেডশীটটা ময়লা হওয়ার আগেই ধুতে হবে কেন? সে আজলানের কাজ দেখে বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরে এসে বসে আছে। অত পরিষ্কার হলে যা নিজে করুক।

মালেকা বেগম আর আম্বিয়া বেগমকে গল্প করে হাসতে দেখে তার হিংসে হলো। মনে মনে আওড়ালো, ” আল্লাহ এদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দাও। কেউ আমাকে পাত্তাও দিচ্ছে না। ”

আয়জাও তাদের সাথে গল্পগুজবে যোগ দিয়েছে।
রমলা চাচীও। মা রমলা চাচী সম্পর্কে জানতে বড়ো আগ্রহ দেখাচ্ছে। তিথি বললো,

” আম্মা আম্মা শুনো,

মালেকা বেগম ঝাড়ি মেরে বললেন,

” দরকারি কথা বলছি। মা মা করিস না তো। ”

তিথি রোষানলে দগ্ধ হলো। রেগে চেয়ে রইলো তাদের দিকে। তারপর শ্বাশুড়ি মায়ের পেছনে গিয়ে কাঁধ ধরে বললো,

” ও-মা ও-মা শুনো। ”

আম্বিয়া বেগম ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে বললেন,

” ছাড় ঢং করিস না তো। এমনিতে কোনোদিন মা ডাকিস? আজ মায়ের সামনে ভং ধরছে। ”

তিথি রাগত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। রমলা চাচী বললো,

” কি লাগবে বউ? আমারে কও। ”

তিথি রাগ গিলে বলল,

” কিছু না। ”

আয়জা বললো,

” কিছু খেতে চাও? ”

তিথি জবাব না দিয়ে বেরিয়ে গেল। আজলান ওয়াশরুমে ঢুকেছে। তিথি দরজা ধাক্কাতেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বললো,

” হোয়াট হ্যাপেন্ড? এভাবে কেউ ওয়াশরুমের দরজা ধাক্কায়? ”

তিথি তার গায়ে সাবান ফেনা দেখে বলল,

” আচ্ছা আচ্ছা তাড়াতাড়ি বের হও। ”

” ষ্টুপিড ” বলে দরজা বন্ধ করে দিল আজলান। গোসল সেড়ে বের হতেই দেখলো তিথি দাঁড়িয়ে আছে তার অপেক্ষায়। ভুরু কুঞ্চন করে বললো,

” কোনো সমস্যা? ”

তিথি বলল,

” আমার ভাল্লাগছেনা কিছু। ”

আজলান চোয়াল ঝুলিয়ে বললো,

” তো? ”

” আমার আম্মা সবাইকে হাত করে নিয়েছে। এমনকি আয়জাকেও। আমার সাথে কথা বলার কেউ নেই। একা একা ভালো লাগে না। ”

” তুমি একা কে বললো? ”

তিথি এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। বলল,

” তাহলে তুমি কথা বলো। ”

আজলান মাথা মুছতে মুছতে বললো,

” মনে হচ্ছে আমার জন্য দরদ একেবারে উতলে উঠছে। ”

তিথি তাকে ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসে থাকলো। আজলান তার দিকে একপলক চেয়ে ভেজা কাপড়চোপড় নিয়ে বেরিয়ে গেল। ছাদে কাপড়গুলো শুকোতে দিয়ে এসে দরজার কাছে থামতেই শুনতে পেল তিথি একা একা কথা বলছে।

” তোকে কি তোর যমের হাতে তুলে দেব? নাকি ছেড়ে দেব? তুই কোন সাহসে এই ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলি রে মদন? তোর সাহস দেখে তো আমি অবাক। তুই আমার জামাইরে চিনোস? তোকে হাত দিয়ে ধরে হাত নোংরা করবে না বুঝলি? সোজা শুট করে দেবে। তুই আ আ আ বলে চিৎপটাং হয়ে মরে পড়ে থাকবি। তোর চৌদ্দ গুষ্ঠিও কিছু করতে পারবে না। ”

আজলান ভাজিয়ে দেয়া দরজা ঠেলে ভেতর ঢুকে দেখলো তিথির হাতে একটা আরশোলার ছা। মাথার লম্বা সুঁতোর মতো অ্যান্টেনা ধরে তাকে শাসিয়ে যাচ্ছে একনাগাড়ে। আজলান গর্জে উঠে ডাকলো,

” মেহবুব! ”

তিথি চমকে উঠলো। কিন্তু আরশোলাটিকে ছাড়লো না। বলল,

” একে গুলি করে মারো যাতে তার চৌদ্দ গুষ্ঠিও এই ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে না পারে। ”

আজলান দাঁত খিঁচিয়ে চেয়ে রইলো। তিথি আরশোলাটাকে ধরে তার সামনে নিয়ে এল। আজলান দরজার সামনে থেকে সরে পড়লো। বলল,

” বের হও এটা নিয়ে। ”

তিথি মাথা নেড়ে বলল,

” ওর একটা ব্যবস্থা করে আসি। তুমি গোসল করেছ সেটা মাথায় ছিল না। সরি বস। ”

বলেই বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে বলল, ” তোকে কুচিকুচি করে কেটে তেলে ভাজা ভাজা করে খাবো শালা মদন। তোর কত্তবড় সাহস! এই এই খবরদার নড়বি না। তোকে ছেড়ে দেব সেটা ভাবিস না ভুলেও। ”

আজলান ঘর কাঁপিয়ে হুংকার ছেড়ে বলল,

” মেহবুব তুমি ওটা ফেলে এসে গোসল করবে। ”

তিথি তার চিৎকার শুনে থেমে গেল। আজলান বলল,

” কিন্তু আমার ওয়াশরুমে না। ”

তিথি বললো, ” ওকে বস। তোমার মেজাজ অল্পতেই হট হয় কেন? ”

____________

মালেকা বেগম চারদিন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে থেকে চলে গেলেন। ভেবেছিলেন দু’দিনও থাকা হবে না কিন্তু তিথির শ্বাশুড়িটাকে এত মনে ধরেছে। তুষারের কথা ভেবে চলে আসতে হলো নইলে আরও ক’টা দিন থাকতেন।
মা চলে যাওয়ার সময় তিথি হঠাৎ করে কেঁদে উঠলো। মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলো। মালেকা বেগম আদর করে দিয়ে বললেন,

” কাঁদিস না। তোকে তো ওরা ভালো রাখছে। জামাইও তোকে কত চোখে হারায়। নিজের ঘর সংসারের প্রতি একটু মনোযোগ দে তিথি। এমন শ্বশুরবাড়ি কিন্তু কপাল করে পায় মেয়েরা। ”

তিথি উত্তর না দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। তাকে ভালো রাখবে না কেন? তার পেটে ওদের বংশধর আছে তাই ভালো রাখছে। তার পেটে বাচ্চা আছে তাই ফাটাকেষ্ঠ তাকে চোখে হারাচ্ছে, আদর সোহাগ করছে। ওসব তো সব জামাইরা করে।

বউকে আদর সোহাগ করা জামাইয়ের জন্য ফরজ। তার জামাইও ব্যতিক্রম কিছু করছে না। কাল তার গালটাল ছিঁড়ে ফেললো দাঁড়িগুলোর ঘষায়। পুরুষ মানুষ চাপ দাঁড়ি রাখে বউয়ের গাল ঘষে দেয়ার জন্য। নইলে সেটার আর কোনো কাজ নেই।

_______

তন্মধ্যে তিথির ইনকোর্স পরীক্ষার ডেট পড়েছে। তিথির হাঁটতে চলতে বড়ো অসুবিধা। আর একটা মাস সময় আছে। তারও কম বলা যায়। আজলান বললো, ” ইনকোর্স পরীক্ষা এখন দিতে হবে না। ফাইনালের আগে দিলে হয়ে যাবে।”

তিথি বলল, ” কোনো পরীক্ষাই দিতে হবে না। বিবাহিত মেয়েদের প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে বরের বুকে ঘুমানো, বাচ্চা কাচ্চার হাগুমুতু পরিষ্কার করা আর নিয়ম করে বর আর শ্বাশুড়ির বকাঝকা শোনা। পড়ালেখাটেকা ওসব অবিবাহিত মেয়েদের কাজ। কোনো কাজবাজ না থাকলে মানুষ পড়াশোনার মতো ফালতু কাজ নিয়ে বিজি থাকে।”

আজলান চুপ করে শুনলো। কি বলবে সে? কি বলার আছে? কিছু বললেই তো সমস্যা। আবার না বললেও সমস্যা।

তিথি কিছুক্ষণ পর রাগত স্বরে বললো,

” আমি কি তোমার চালাকি বুঝিনা? তুমি আমাকে অশিক্ষিত মূর্খ বানিয়ে রাখতে চাও তাই পরীক্ষা দিতে দিচ্ছ না। আমাকে পরীক্ষা দেয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। আমার বাচ্চা পেট থেকে বেরিয়ে আসুক তারপর দেখো আমি কি করি। আমাকে অবলা পেয়ে তোমরা এখন যা ইচ্ছে তাই শুরু করে দিয়েছ। ”

আজলান তার ঠোঁটের উপর আঙুল চেপে ধরে বলল, ” চুপ চুপ। রেডি হয়ে নাও। চেক-আপ করাতে যাবো। এটাই শেষ। ”

তিথি চুপচাপ রেডি হয়ে নিল। চেকআপ করাতে গিয়ে তসলিমা খাতুনের সাথে দেখা হয়ে গেল। উনি তিথিকে একা একা লাউঞ্জে বসে থাকতে দেখে বললেন,

” আরেহ তিথি কি অবস্থা? কেমন আছে তুমি? ”

তিথি বলল, ” ভালো। আপনি কেমন আছেন? ‘

” খুব ভালো। তোমাকে দেখে আরও ভালো লাগছে। চেকআপ করাতে এসেছ বুঝি? ”

” জ্বি। ”

তসলিমা খাতুন একটু জিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,

” তোমার বরের সাথে সম্পর্ক এখন কেমন? ”

” আগের মতো। ”

” আগের মতো মানে? তোমাকে এখনো দূরছাই করে? ”

” হ্যা। ”

তসলিমা খাতুন হতাশ হয়ে বললো,

” তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব যত্নে আছো। আমি কত খুশি হলাম তোমাকে দেখে! ”

তিথি বললো, ” আমার বাচ্চা শেখ বংশের বাচ্চা। তাই ওর যত্ন তো সবাই করবেই। ”

তসলিমা খাতুন বললেন, ” তা ঠিক। তোমার বর তোমাকে একটুও ভালোবাসে না? ”

” না না ওসব ভালোবাসা টালোবাসা নেই। ভালোবাসলে তাকে মুক্ত পাখির মতো উড়তে দিতে হয়। আমার বর আমাকে পারেনা সারাদিন ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখতে। মন চাইলে কিছু খেতেও পারিনা। কত অজুহাত দেখাবে। একটু ঘুরতে যেতে চাইলে বলবে এই সময় কোথাও বেরোনো নিষেধ।”

” এখনো ঘর থেকে বের করে দেয়? ”

” হ্যা আগে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিত এখন আলতো হাতে ধরে বের করে দেয় যাতে ওর বাচ্চা ব্যাথা না পায়। কত পল্টিবাজ দেখুন! ”

” তুমি কার সাথে এসেছ? ”

” আর কার সাথে? ”

” তোমার বরের সাথে? ”

” হ্যা দেখছেন না আমাকে একা রেখে কোথায় চলে গিয়েছে। ”

” ওহহ। ”

তখন গটগট পায়ে হেঁটে সেখানে আজলান এল। বলল,

” মেহবুব চলো। ”

তসলিমা খাতুন তাকে দেখে হাঁ করে চেয়ে রইলেন। আজলান তাকে দেখে বলল,

” আপনি? কেমন আছেন?”

তসলিমা খাতুন বিব্রতকর পরিস্থিতি সামাল দিতে হেসে বললেন,

” জ্বি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

আজলান বলল, ” আমিও ভালো আছি। ”

তসলিমা খাতুন হেসে বললেন,

” আপনার বধূর সাথে গল্প করছিলাম। বাচ্চার বাবার অনেক প্রশংসা করছিলো। ”

তিথি ভুরু কুঁচকে চাইলো। আজলান বলল,

” ওহহ তা জানি। ”

তসলিমা খাতুন হাসলেন। আজলান তিথিকে হাত ধরে তুলে বলল,

” আমরা আসি তাহলে। দেরী হয়ে যাচ্ছে। ”

” হ্যা যান। তিথি ভালো থেকো। শীঘ্রই সুখবর শুনবো। ”

তিথি যেতে যেতে আজলানকে বলল,

” আচ্ছা মহিলা মিথ্যে বললো কেন গো? ”

আজলান বলল,

” কারণ সবাই তোমার মতে ষ্টুপিড নয়। ”

” সবাই তোমার মতো পল্টিবাজ। তাই তো?”

” হ্যা হ্যা তাই। ডাক্তার যা যা জিজ্ঞেস করবে তাই তাই বলবে। আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলবে না।”

” ডাক্তার কি আমার তালতো ভাই যে ইয়ার্কি মারবো? ”

আজলান বিরক্ত হয়ে বলল,

” এত কথা কেন বলো? ”

” ডোডো যদি বোবা হয়? ”

____________

তিথিকে প্রায় সাতদিন আগে ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয়েছিলো। ডেলিভারির সময় দিয়েছে আরও সাতদিন পর। কিন্তু তিথির ব্যাথা অনুভব হওয়ায় ডাক্তার বলেছিলো ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দিতে। ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার সময় সে হাউমাউ করে কেঁদে আম্বিয়া বেগমকে বলল,

” ও-মা আমি যদি ওখান থেকে আর না ফিরি তখন কি হবে? ”

আম্বিয়া বেগম রেগেমেগে বললেন, “কেমন অলক্ষুণে কথা বলছে দেখছিস খোকা?”

আজলান বললো, “ওখানে উন্নত চিকিৎসা দেয়। তুমি যাতে কষ্ট না পাও সেজন্য তোমাকে ভর্তি করানো হচ্ছে। ”

তিথি কাঁদতে লাগলো। রমলা চাচীকে বলল,

” আমার আচারের বয়ামটা বেড সাইট টেবিলে রাখা আছে। আমি ফিরে না এলে তুমি রেখে দিও। আলমিরায় লাল আর হলুদ রঙের যে শাড়িগুলো আছে ওগুলোও তুমি রেখে দিও। ”

রমলা চাচী মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

” তুমি কোথায় যাইবা? এটা তোমার বাড়ি। তোমাকে ফিরতে হইবো তো। তুমি তোমার বাবুরে নিয়ে ফিরবা। ”

” তাহলে মিষ্টি কিনে রাখিও। ”

” আচ্ছা আচ্ছা রাখবো। ”

” স্পঞ্জের মিষ্টি না কিন্তু। কালোজামুনের মিষ্টি। ”

আজলান বলল,

” ওকে। আর কিছু? ”

” দুই প্লেট ফুচকা, বেশি বেশি ঝাল আর বেশি বেশি টক দিয়ে। উপরে সিদ্ধ ডিমের লেয়ার থাকবে।
আর গরুর মাংস দিয়ে চটপটি। ”

” আর কিছু? ”

তিথি গাল মুছে বলল, ” এগুলো খাওয়ানোর হেডম নাই আবার বলে “আর কিছু” । কতবার খেতে চাইছি খেতে দাওনাই । ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, ” খাওয়ার পর বুক জ্বলে ছাই হয়ে যাইতেছে বলিস কেন? ”

আজলান কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ” ওকে, ওকে ফাইন। তুমি ফিরে এলে সব পাবে। ”

তিথি ব্যাথায় কাঁদতে লাগলো। আজলান কোলে তুলে নিয়ে যেতে যেতে বললো, ” তুমি তোমার কথা রাখলে আমি আমার কথা রাখবো। কাঁদবে না। তোমার ডোডোও কাঁদবে। ”

তিথি বলল, ” বাপের মতো বজ্জাত হয়ছে। শুধু আমাকে কষ্ট দেয়। সারাক্ষণ লাথি দেয়। আসুক একবার, পাই হাতের কাছে। পা দুটো যদি বেঁধে না রাখি। ”

ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার সময় তিথি আজলানকে শক্ত করে ধরে রাখলো। চেঁচিয়ে কেঁদে কেঁদে বললো,

” তুমি না গেলে আমি ওখান থেকে পালিয়ে আসবো। ওরা আমার পেট কেটে ফেলবে। ”

আজলান মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

” আমি আছি। ”

তিথির প্রসববেদনা আরও গাঢ় হওয়ায় সে চিৎকার দিয়ে কাঁদছিলো।

তারপরের দিন ফজর নাগাদ তিথির ছেলে বাবু হলো। সি সেকশন করিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছিলো। আজলান বলেছে, সি সেকশন করানোর। মা আর বাচ্চা দুজনেই যাতে সুস্থ থাকে। কিন্তু সি সেকশন করানোর আগেই তার নর্মাল ডেলিভারিতে বাচ্চা হয়ে গেছে।

হসপিটালের করিডোর মেতে উঠলো সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চার কান্নায়। মালেকা বেগম খুশিতে কেঁদে ফেললেন। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বললেন, “আমার পাগলটা মা হয়ে গেছে। ও আল্লাহ তোমার দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া। বাচ্চাটা ওদের সংসারে যেন বরকত রহমত নিয়ে আসে। ”

আফতাব শেখ আজান দিলেন নাতিকে কোলে নিয়ে। আম্বিয়া বেগম নাতি পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। আজলান এসে দেখলো ধবধবে সাদা নরম তোয়ালের মধ্যে সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটি হাত পা নেড়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। মাথাভর্তি চুল, হৃষ্টপুষ্ট সবল দেহ।
আফতাব শেখ বললেন,

” বাচ্চার বাবা এসেছে। তাকে কোলে নিয়ে কালেমা পড়ে শোনাতে বলো। আর বলো বউ তার টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছে। সেই টাকায় যেন কালোজামুন আর ফুচকা, চটপটি কিনে নিয়ে আসে বউয়ের জন্য। ”

আজলান কিছু বললো না।
আম্বিয়া বেগম আজলানের কাছে এসে বললো,

” নে নে তোর ছেলেকে কোলে নে খোকা। ”

আজলান কোলে নিয়ে আয়জাকে বলল,

” তোর ভাবিকে দেখেছিস? ”

” হ্যা জ্ঞান ফেরার জন্য একটু সময় নেবে বললো।”

আজলান ছেলের কানে কালেমা পড়ে শোনালো। আয়জা বলল, ” আম্মা আম্মা দেখো চোখ মেলেছে। ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ”

আম্বিয়া বেগম আজলানকে ফিসফিস করে বলল, ” মা চতুর ছেলে চতুর হবে না? দেখেছিস তোকে কেমন করে দেখছে? ”

আজলান বাচ্চার দিকে চেয়ে ভুরু নাচিয়ে বলল,

” শেখ বাড়ির মতো পাগলা গারদে জন্মানোর জন্য আপনাকে অভিনন্দন। ”

চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হাত পা নেড়ে কেঁদে উঠলো সে।

____

তিথির যখন জ্ঞান ফিরলো তখন মা, শ্বাশুড়ি সবাই তাকে দেখতে এল। তিথি তখন কাঁদছে। আম্বিয়া বেগম বললেন,

” এই দেখ বউ তোর বাবু। ”

তিথি তাকে একনজর দেখে নিল। এই মোটাসোটা বাচ্চাটা তার পেটে ছিল? মালেকা বেগম বললেন,

” কাঁদিস না মা। দেখ দেখ। বলতো কার মতো হয়েছে। ”

তিথি কেঁদে বলল, ” কারো মতো লাগছেনা। এখন সব বাচ্চাই এক। সরো তো। ”

মালেকা বেগম রেগে গিয়ে বললেন, ” ওমা। ”

তিথি নাক টানতে টানতে কাঁদতে লাগলো। ওই ব্যাটা এখন আসবে না তাকে দেখতে। তার কাজ তো শেষ। এতদিন পেটে বাচ্চা ছিল বলে তাকে যত্নআত্তির করেছে। এখন তাকে ফিরেও দেখবে না।

আজলান আসতেই সবাই বেরিয়ে গেল। তিথি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলো। আজলান তার পাশে বসে হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

” মেহবুব এদিকে ফিরো। কথা আছে। ”

তিথি ফিরলো না। গাল মুছতে লাগলো ঘনঘন। আজলান তার মুখটা ফিরিয়ে এনে দেখলো মুখটা একদিনের মধ্যেই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, ঠোঁট দুটো সাদা হয়ে গেছে। তার দিকে ফেরামাত্রই চোখ ভরে ভরে জল নামলো তিথির। আজলান ঝুঁকে বলল,

” কেঁদো না। চলো বাড়ি যাই। তোমার জন্য কালোজামুন, ফুচকা, চটপটি সব রেডি আছে। ”

তিথি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কাঁদতে লাগলো জোরে জোরে। আজলান পুনরায় মুখটা তার দিকে ফিরিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে ধমকে বলল,

” একদম কাঁদবে না। তুমি কেন কাঁদছো আমি জানি। কিন্তু এখন চুমু দেয়া যাবে না। ফ্রেশ হতে হবে। তারপর। ক্লিনিকে হাজারটা জার্মস আছে। ”

তিথি আরও জোরে কাঁদতে লাগলো। আজলান পকেট থেকে একটা জিনিস বের করলো। তিথিকে বলল, ” এটা তোমার জন্য। ”

তিথি এবার নিজ থেকে ফিরে তাকালো। লিপস্টিক দেখে সজলনেত্রে হাসলো। আজলান লিপস্টিকের ঢাকনা খুলে তার ঠোঁটে লাগিয়ে দিল। তিথি ঠোঁট দুটো একে অপরের লাগিয়ে পাহ পাহ শব্দ করলো। আজলান বলল,

” খাওয়ার আগে টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলবে। ”

নার্স এসে তিথির ঠোঁটে লিপস্টিক দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো। তিথি কমলার খোয়া খেতে খেতে তাকে দেখলো আগাগোড়া। যথেষ্ট রূপবতী সে। বয়সও বেশি না। জ্ঞান ফেরার পর থেকে তিথি সন্দিগ্ধ চোখে তাকে দেখে যাচ্ছিলো। ফাটাকেষ্ঠর সাথে স্যার স্যার বলে কথা বলেই যাচ্ছে তখন থেকে। কথা বলছিস বল, মুখে এত হাসি কেন? তিথি রাগত স্বরে তাকে ডেকে বলল,

” এই মেয়ে আমার বাচ্চার বাপের সাথে তোমার কি চলে? ”

আজলান চলে আসায় নার্স মেয়েটা কোনোমতে পালিয়ে গেল। আজলান বাচ্চাকে দোল দিতে দিতে তিথিকে বলল,

” কি বলছিলে উনাকে? ”

তিথি বলল, ” কিছুনা। তুমি কোথাও বেরোনোর সময় হলদে রঙের লুঙ্গি, আর লাল রঙের শার্ট পড়বে। ”

আজলান বলল, ” আচ্ছা। লাল রঙের গামছাও গলায় পড়বো।

তিথি খেতে খেতে মৃদুস্বরে বলল, ” আমার নর্মাল ডেলিভারি হয়েছে না? ”

” হুম। ”

তিথি বলল, ” হবেই তো। আমার পেট কাটবে অত সাহস কার?”

তারপর বাচ্চার দিকে চেয়ে বলল, “ওকে এনেছ কেন? আমি ওকে আর খাওয়াতে পারব না। আমার সুড়সুড়ি লাগে। ”

আজলান ধমকে বলল, ” শাট আপ ওর খিদে পেয়েছে।”

চলমান….