Thursday, December 18, 2025
Home Blog Page 9

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_১১ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১১
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

মফিজ সাহেব চলে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আজলান না যেতে বলায় আর কিছু বলে উঠার সাহস করেনি। ওই ব্যাটার হালচাল বুঝে উঠা দুষ্কর। আবার কখন কি বলতে কি বলে বসে।

রমলা চাচীর সাথে হাতে হাত মিলিয়ে আয়জা রান্নাবান্না করছে। আগে করতো না। ভাবি অসুস্থ থাকায় এখন তাকে কাজকর্ম করতে হয়। তিথি এসে আচারের বৈয়াম দিয়ে বলল,

” এটা তোমার। তোমার ভাইয়া এনেছে। নাও, পরিমিত খাবে। বেশি খাবে না। ”

আয়জা খুশি হলো। বলল,

” তু্মি খাচ্ছ নাকি? সুগন্ধিটা দারুণ। ”

তিথি গালের ভেতর বরই বিচি কটরমটর করতে করতে বলল,

” হ্যা। আমার জামাই আনছে। আমি খাব না, তো কে খাবে? ”

বলেই আম্বিয়া বেগমের দিকে আঁড়চোখে তাকালেন। রমলা চাচী হাসলো। তিথি তাকে আচার দিল একটা ছোট বয়ামে করে। বলল,

” তোমার মেয়েকে দিও। বেশি দিইনি। ওসব বেশি খাওয়া ভালো না। পরিমিত খেতে হয়। বুঝলে?”

রমলা চাচী বলল,

” তোমার জন্য আনছে তুমি খাও। সবাইরে দেওয়ার কি দরকার? ”

” কি যে বলো না। নাও নাও। লজ্জা পেওনা। সবাইকে তো দিচ্ছি না। শুধু তোমাকে দিচ্ছি আমার ভাগ থেকে। শ্বশুর আব্বাকেও দেব যদি খেতে চায় তবে। ”

আয়জা হাসতে লাগলো। ভাবির কথা শুনে সে না হেসে পারেনা। আম্বিয়া বেগম এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন। বললেন,

” দেখেছিস রমু আজকাল বউয়ের জন্য আচার-টাচারও আনে!”

রমলা চাচী হেসে বলল, ” তাই তো দেখছি ভাবি। ”

তিথি কপাল কুঁচকে ফেললো। এক হাত কোমরে রেখে বললো,

” এমন হারামি তো জীবনে দেখিনি। তোমার মেয়ের জন্যও আনছে সেটা দেখছো না? শুধু আমার জন্য আনছে সেটা চোখে পড়লো? তোমার মনটা দেখছি হিংসায় ভরা শ্বাশুমা। ”

আম্বিয়া বেগম খুন্তি হাতে নিয়ে বললেন,

” আমি কি তোরে গালি দিছি? তুই পকপক করছিস কেন? ”

তিথি বলল,

” তুমি তখন থেকে কোণা চোখে তাকাচ্ছ দেখে আমি সব বুঝে গিয়েছি। তোমার কইলজ্যা ফেটে যাচ্ছে ও আমার জন্য আচার আনছে বলে।”

আম্বিয়া বেগম খুন্তি নেড়ে বললেন,

” যা তো যাহ এখান থেকে। তোর মতো খানকির সাথে কথা বলার সময় নেই। ”

তিথি আঙুল থেকে আচার চেটেপুটে খেয়ে বলল,

” আমারও অত সময় নেই। আমার জামাই বাড়ি আসছে অনেকদিন পর। আমি তার কাছে যাই। শোনো রমলা চাচী, আমার জামাই আমারে দেখতে পারলে এটা কারো সহ্য হয় না। এজন্যই বদনজর লাগে। ”

রমলা চাচী ঠোঁট টিপে নিঃশব্দে হাসলেন।
আম্বিয়া বেগম তিরস্কার করে বললেন,

” তুই এতদিন কি কি করছিস সব বললে তোরে বের কইরা দিবো বাড়ি থেইকা। ”

তিথি ক্ষেপে তাকিয়ে রইলো। কিছু বললো না।
আম্বিয়া বেগম পাতিলে খুন্তি নাড়তে নাড়তে বললেন,

” তুই এক পোয়াতি হইছোস! বাচ্চা পেটে ধরে তোর এক দাম বাড়ছে! বাপরে বাপ। এর আগে পোয়াতি আর কেউ হয়নাই। শুধু তুই হইছোস। তোরে কিছু বলাও যায় না। তোর যা মুখ। ”

তিথি মুখ মোচড় দিয়ে বেসিনের হাত ধুতে লাগলো। আয়জা বলল, ” মা এভাবে কথা বলছো দেখলে ভাইয়া কি ভাববে?”

আম্বিয়া বেগম রেগে গিয়ে বললেন,

” কি ভাববে? পোলা আমার। ওকে আমি পেটে ধরছি। ও আমাকে ভালো করে চেনে। ”

তিথি বলল, ” শোনো শ্বাশুমা তোমার সাথে ঝগড়া করার কোনো মুড নেই আমার। আমাকে আমার জামাই ডাকতেছে। ”

বলেই ঝামটি মেরে চলে গেল। আয়জা আর রমলা হাসি হো হো করে হেসে উঠলো। আম্বিয়া বেগম বিড়বিড়িয়ে বললেন,

” আমার একটামাত্র ছেলে! তার কপালে এমন পাগল জুটে গেল কেমনে কে জানে? ”

তিথি ড্রয়িং রুমে চলে গেল। আফতাব শেখ আর মফিজ সাহেবকে প্লেটে করে আচার খেতে দিল। আফতাব শেখ বললেন,

” এসব তুমি খাও। আমাদের দেওয়ার কি দরকার?”

মফিজ সাহেব বললেন, ” তাই তো। এসব তোর জিনিস। তুই খা। আমাদের ওসব খাওয়ার রুচি নেই। ”

তিথি প্লেটের আচারগুলো বয়ামে ঢেলে দিল।
তারপর বয়ামের ঢাকনা ঘুরাতে ঘুরাতে উপরে চলে গেল। আজলান তার স্যুটকেসটা ধুচ্ছিলো। তিথির বড়ো বিরক্ত লাগে। এতবড় স্যুটকেসটাও ধুতে হবে এতরাত্রে? সে বললো,

” তোমার মায়ের জন্য একটা আচারের বয়াম আনোনি কেন? ”

আজলান কপাল কুঁচকে চেয়ে বললো,

” কেন? ”

” তোমার মা আমাকে এভাবে এভাবে দেখছে তুমি আচার এনেছ শুনে। ”

বলেই কোণাচোখে অভিনয় করে দেখালো। আজলান বলল,

” তুমি কিছু বলেছ? ”

” বলেছি আমার জামাই আমার জন্য আচার আনছে তোমার কি সমস্যা? ”

আজলানের দাঁত কটমট করে উঠলো। তিথি তার দিকে না তাকিয়ে বলে গেল,

” আসলে শ্বাশুড়িদের এই এক সমস্যা। ছেলের বউয়ের খুশি সহ্য করতে পারে না। ”

আজলান বলল,

” মাকে আর কি বলেছ তুমি? ”

তিথি বললো, ” কি আর বলব? বলেছি তোমার কইলজ্যা ফেটে যাচ্ছে না? ও আমার জন্য আচার আনছে তাই?”

আজলান বলল, ” আউট। ”

তিথি চমকে উঠে বলল, ” অ্যাহ? ”

আজলান বলল,

” বাংলায় বলতে হবে? ”

তিথির মুখখানায় অন্ধকার নেমে এল। কন্ঠস্বরও ঝিমিয়ে এল। বলল,

” ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বউ তো আনোনাই যে ইংলিশ বুঝবে। ”

আজলান বলল,

” ওকে ফাইন। বাংলায় বলছি। ঘর থেকে বেরোও।”

তিথি বলল,

” আমার কি দোষ? ”

আজলান গর্জে বলল, ” সেটা যতদিন না বুঝে উঠতে পারবে ততদিন দূরে থাকো। ”

তিথি ঘর থেকে বের হলো। তারপর বলল,

” তুমি একটা মাম্মাস বয়। ”

আজলান বলে উঠলো, ” হোয়াট? ”

তিথি নিজ থেকে দরজাটা টেনে দিয়ে বলল,

” মানে মা ভক্ত। রাগ কমে গেলে ডেকো। আমি তার আগে আসবো না। ”

আজলান চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো সদ্য ধোয়া স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে। রাগে ফুঁসছে সে। তিথি পুনরায় দরজা খুললো। বলল,

” আব্বার সাথে বসে ভাত খেও কেমন? আব্বা খুশি হবে খুব। তোমার মায়ের সাথে আমি আজ থেকে আর কোনো কথা বলব না, ঝগড়া তো দূর। কসম।”

আজলান কোনো উত্তর না দিয়ে মুখটা বেজার করে দাঁড়িয়ে রইলো। তিথি বলল,

” ওভাবে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। তুমি আমার আব্বার সাথে বসে না খেলে আমি তোমার মায়ের সাথে আরও বেশি বেশি ঝগড়া করবো। তুমি আমাকে ঘর থেকে বের দিলেও সমস্যা নেই। সব আমার বাচ্চা দেখতেছে। ও সুদে-আসলে শোধ নেবে। ছাড় নেই। ”

বলেই দরজাটা টেনে দিয়ে চলে গেল।

_________

রাতে তিথির একদম খেতে ইচ্ছে করে না। এতদিন শ্বাশুড়ি আর ননদকে ফাঁকি দিতে পারলেও ফাটাকেষ্ঠকে ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রথম প্রথম সে অনেক খেতে পারতো, বমি হতো খুব। এখন বমি কমে এসেছে কিন্তু খেতে ইচ্ছে করে না। শুধু টুকটাক এটা ওটা খেতে ইচ্ছে হয়। মাছ মাংসে একদম বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। শুধু ভর্তা দিয়ে কচলে কচলে ভাত খেতে ইচ্ছে করে।

শ্বশুর আব্বা বাজার থেকে থানকুনি পাতা কিনে এনেছিলো। তিথি সেগুলো বেছে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলো। রোজ সেখান থেকে কয়েকটা নিয়ে পোঁড়া মরিচ, আর পেঁয়াজ মেখে মেখে ভাত খেয়েছে। আজ রমলা চাচীকে বলে পেঁয়াজ আর মরিচ ভেজে রেখেছে। কাঁচা পেঁয়াজ খেতে পছন্দ করেনা আজলান শেখ, কেউ খাচ্ছে সেটাও পছন্দ করেনা। তিথি তো ভয়ে খায় না। তাকে আবার আদরটাদর করবে না।

মফিজ সাহেবের জন্য আজ রাতের খাবারের আয়োজন একটু তাড়াতাড়ি করা হয়েছে। উনি চলে যাবেন তাই। টেবিলে হরেক রকমের রান্না দেখে উনি বললেন,

” এত কষ্ট করে এত আয়োজনের কি দরকার ছিল? ”

তিথি কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে বললো,

” তুমি কি প্রতিদিন খাচ্ছ এই বাড়িতে? এত ঢং না দেখিয়ে যা খেতে ইচ্ছে করে খাও। ”

আফতাব শেখ বললেন,

” বৌমা তুমি বেড়ে দাও তোমার আব্বাকে। আর হ্যা, তোমার বর কি আজ নীচে নামবে? যদি নামে তাহলে বলো যেন একটু তাড়াতাড়ি নেমে আসে। বাড়িতে কুটুম এসেছে। কুটুমের সাথে একসাথে বসে খেতে হয়। ”

তিথি বললো, ” ওসব জ্ঞান বউয়ের মুখে মানায় না। ওসব শিক্ষাদীক্ষা মায়ে বাপে দেয়, বউ না। এমনিতেই আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে রাগে। সেখানে আমি আর জ্ঞান দিলে আব্বার হাতে আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বলবে আপনার মেয়ে আপনি নিয়ে যান। ”

হেসে উঠলো আফতাব শেখ। মফিজ সাহেব মেয়েকে চুপ থাকার জন্য ইশারা করছেন কিন্তু মেয়ে উনার দিকে তাকাচ্ছে না। আয়জা এসে মফিজ সাহেবকে বললো,

” আঙ্কেল যেটা খেতে ইচ্ছে করে নিয়ে খান। আপনার মেয়ের বাড়িতেই তো এসেছেন। ”

মফিজ সাহেব বিড়বিড়িয়ে বললেন,

” আমার মেয়েকে সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে আবার বলা হচ্ছে এটা আমার মেয়ের বাড়ি!”

তিথি বলল, ” এই ননদিনী ফাটাকেষ্ঠ ভাত খেতে আসবে কি আসবে না জিজ্ঞেস করে আসো তো। ”

আয়জা বলল, ” ভাইয়াকে বলব তুমি ফাটাকেষ্ঠ ডেকেছ? ”

তিথি হাসলো। বলল,

” তাড়াতাড়ি যাও। আব্বাকে চলে যেতে হবে। ”

তিথি মফিজ সাহেবের কানের কাছে গিয়ে বললো,

” আব্বা তোমার জামাই এলে খাওয়ার সময় কোনো কথা বলিওনা। শ্বশুর আব্বা বললেও না। আমি বেশি কথা বলি বলে আমার সাথে খেতে বসে না। বুঝলে? ”

মফিজ সাহেব মাথা নাড়লেন।

আজলান যখন খেতে এল তখন আফতাব শেখ বললেন, ” বৌমা তোমার মা এলে উনাকে কয়েকদিন তোমার সাথে রেখে তারপর তুমিও চলে যেও উনার সাথে। কয়েকদিন বাপের বাড়িতে থাকলে তোমার ভালো লাগবে। ”

তিথি হাসলো। কিন্তু কিছু বললো না। আজলান চামচ দিয়ে ভাত বাড়তে লাগলো চুপচাপ। মফিজ সাহেব তার হাতের নখগুলো লক্ষ করছিলেন। কাটা নখগুলো সাদা ঝকঝকে একদম ভাতের মতো। জামাই রক্তশূন্যতায় ভুগছে নাকি? চোখতুলে উনার দিকে তাকাতেই মনে হলো উনার হৃদপিণ্ডটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে।
বাবা শ্বশুর দুজনকে ভাত বেড়ে দিয়ে আজলান তিথিকে ইশারা করলো তরিতরকারি আর মাছ মাংস তুলে দিতে। তিথি চুপচাপ বেড়ে দিল।

মফিজ সাহেব বললেন,

” আর দিস না মা। অত খেতে পারবো না। ”

তিথি শাসিয়ে বলল, ” কতবার বলেছি ফাটাকেষ্ঠ খেতে এলে কথা বলবে না। ”

বলেই বড়বড় চোখ করে আজলানের দিকে তাকালো। আফতাব শেখ বিষম খেলেন। আজলান কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। তিথি আজলানকে মাছ তুলে দিতে যেতেই আজলান হাত রাখলো না দেয়ার জন্য। তিথি তার হাতের উপরে মাছের টুকরোটা দিয়ে দিল। রমলা চাচী বললেন,
” হায়হায় এটা কি হলো? ”

তিথি দাঁত দিয়ে নখ কুটতে কুটতে আজলানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। আজলান টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু টেনে নিয়ে হাতের উপরটা মুছে নিল। মফিজ সাহেব মনে মনে আওড়ালেন,

” মেয়েটা কোনো কাজের না। তোর মায়ের মতো হতে পারলি না পাগল? বাপের মতো বলদ হতে হলো তোকে? ”

তিথি আর কোনো বাড়াবাড়ি করলো না।

আজলান মফিজ সাহেবের পাতে গরুর সলিড কষা মাংস তুলে দিচ্ছিলো। তিথি চুপ থাকতে পারলো না। বলে উঠলো,

” আরেহ আরেহ আমার আব্বা নরম নরম চর্বিগুলো খেতে পছন্দ করে। গমের বস্তার মতো মাংসগুলো খেতে অনেক সময় লাগবে। দাঁতগুলো সব পোকাদের খাইয়েছে। এখন কোনোকিছু চিবিয়ে খেতে পারেনা। তুমি ওসব তুলে দিওনা। ”

আজলানের চাহনি দেখে একেবারে চুপসে গেল সে। রমলা চাচী তা দেখে এগিয়ে এসে বললো,

” ওগুলো শক্ত না বউ। নরম আছে। খেতে পারবে।”

আজলান চোখ সরিয়ে নিল। তিথির নাকের পাতা কেঁপে উঠলো। রান্নাঘরে চুপচাপ হেঁটে চলে গেল সে। রমলা চাচী এসে বললো,

” বউ মন খারাপ করছো কেন? ”

তিথি বললো, ” আমি আমার আব্বার সাথে চলে যাবো চাচী। ”

” এমা কেন? কি হলো আবার? ”

তিথি রেগে বলল,

” আমাকে বের করে দেয়ার আগে আমি নিজেই বের হয়ে গেলে ভালো হবে না? ”

রমলা চাচী বললো,

” জানিনা বাপু। ”

আম্বিয়া বেগম এসে রান্নাঘর থেকে বাটি গেলেন। তিথিকে আঁড়চোখে দেখলেন কিন্তু কিছু বললেন না। তিথি বিড়বিড় করে বললো,

” এই বুড়ির বদনজর লাগছে আমাদের উপর। ”

মফিজ সাহেব যাওয়ার সময় তিথি ভীষণ কাঁদলো। বাবা চলে যাচ্ছে সেই কষ্টে নয় তার জন্য অপেক্ষা করা শাস্তির ভয়ে। মফিজ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন,

” কাল তোর মাকে নিয়ে আসবো। ”

আজলান বললো, ” চলুন। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। ”

মফিজ সাহেব বললেন, ” আমি যেতে পারবো বাপ। তুমি অনেক জার্নি করে আসছো সন্ধ্যায়। আরাম করো। ”

আজলান বললো, ” চলুন। আমারও কাজ আছে কিছু।”

তিথি তাকে ভেস্ট স্যুট হাতে নিয়ে বেরোতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। আজ রাতে কি আর বাড়ি ফিরবে না? গাড়ির কাছে বহুকষ্টে ছুটে এসে আজলানকে শুনিয়ে শুনিয়ে মফিজ সাহেবকে বলল,

” আব্বা আম্মাকে নিয়ে সময়মতো এসো কেমন? আর তোমার জামাইকে সময়মতো বাড়ি পাঠিয়ে দিও। ”

আজলান গাড়ির হর্ন বাজালো। তিথি বললো,

” আব্বা আব্বা শোনো না, কাল আম্মাকে ওই শাড়িটা পড়ে আসতে বলিও। আমাদের কলপাড়ে যে মটু বিলাইটা পায়খানা করে আম্মাকে রাগিয়ে দিত ওটার গায়ের রঙের শাড়িটা। লাল কমলা রঙের শাড়ি পড়ে এলে কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে দেব না। যদি তুষার না আসতে চায় ওকে বলবে তোর দুলাভাই এখন ভালো হয়ে গেছে। ”

শেষের কথাটা একটু ছোট করে বললো সে। আজলান গাড়ি ছেড়ে দিল। তিথি বললো,

“সবখানে ভিলেনগিরি দেখাবে শালা মদন। ”

______

আজলান বাড়ি ফিরে দেখলো তিথি ঝাল ঝাল শুঁটকি ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে। নাকমুখ ঘেমে উঠেছে ঝালে। আজলানকে খেয়াল করেনি সে। ভাতগুলো দলা মেখে মেখে সাজিয়ে রেখে একটা একটা মুখে পুরছে। সবাই খেয়েদেয়ে উঠে গেছে ও এখনো খাওয়া শেষ করতে পারেনি। আজলানকে ঘরে যেতে দেখে দ্রুত খাওয়া শেষ করলো। ঘরে গিয়ে ব্রাশ করে হাতমুখ ধুয়ে ফেললো। হাত শুঁকে দেখলো। না শুঁটকির গন্ধ লাগছে না।

আজলান তার ভেজা কাপড়চোপড় গুলো ছাদ থেকে নিয়ে ঘরে এল। তিথি তাকে দেখামাত্রই বললো,

” আর কোনোদিন ফাটাকেষ্ঠ ডাকবো না, জীবনেও তোমার পাতে কিছু তুলে দেব না, খাওয়ার সময় দাঁতের পোকামাকড়ের কথা তুলবো না। ”

আজলান জবাব দিল না। তিথি বলল,

” কথা বলছো না কেন গো? আমার ব্যাথা শুরু হচ্ছে তুমি কিছু তো বলো। ”

আজলান বললো, ” বিছানা ঠিকঠাক করে রেখেছি। চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ো। ”

তিথি শুয়ে শুয়ে আজলানের কাজ দেখতে লাগলো।
আজলান শুয়ে পড়তেই তিথি ওর হাতটা পেটের উপর টেনে নিল। বিগত দিনগুলোতে সে পেটের ব্যাথায় কেঁদেছে। আজ কাঁদেনি কারণ আজ বাবু ভালো হয়ে গিয়েছে। কারণ তার বাপ তার মাকে রেগেমেগে হলেও অনেকদিন পর অনেকক্ষণ ধরে আদর করেছে।

চলমান….

সকালে রিচেক করব।

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_১০ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১০
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আয়জা ঠান্ডা শরবত নিয়ে ঘরে এসে দেখলো আজলান কোচের উপর শুয়ে আছে। আয়জা ডেকে বললো, ” ভাইয়া শরবত এনেছি। ”

“টেবিলে রেখে দে। ”

আয়জা মাথা নেড়ে গ্লাসটা বেড সাইড টেবিলে রেখে বেরোনোর সময় শুনতে পেল।

” মেহবুবকে ডেকে দে। ওর বাবা কখন এসেছে? ”

” এই তো তিনটের দিকে। ”

” বল আমি ডাকছি। ”

” আচ্ছা। ”

আয়জা বেরিয়ে গেল। তিথি ঘনঘন চোখ মুছছিলো মফিজ সাহেবের পাশে বসে। আফতাব সাহেব বললেন,

” আমি তো বলছি তোমাকে যেতে। তুমি কাঁদছো কেন?”

তিথি চুপ করে রইলো। সে এখন বাবার সাথে চলে যেতেই পারে কিন্তু তারপর কি ঝামেলা হবে তা বলার বাইরে। অসুস্থ শরীরে এত ঝক্কিঝামেলা তার ভালো লাগেনা। আয়জা এসে বলল,

” ভাইয়া তোমাকে ডাকছে, ভাবি। ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, ” ভাইজান ওর মারে নিয়া আসেন কাল। কিছুদিন এখানে থাকবে। আপনার জানা কথা ও নিয়মটিয়ম মেনে চলতে পছন্দ করে। তাই এখন ওরে কোথাও যেতে দিবে না। আপনি কাল ওর মা আর ভাইরে নিয়ে আসেন। ”

মফিজ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

” আচ্ছা কাঁদিস না। আমি তোর মারে নিয়ে আসবো। ”

তিথি বলল, ” সত্যি? মিছা কথা বলাবানা আব্বা। ”

মফিজ সাহেব হেসে ফেলে বলল,

” তোর আব্বা মিছা কথা বলে না। ”

তিথি বলল,

” আচ্ছা। আয়জা টিস্যু দাও। ”

আয়জা দৌড়ে তার ঘরে গিয়ে টিস্যু বক্স নিয়ে এল। তিথি সেখান থেকে টিস্যু নিয়ে ঠোঁট দুটো মুছতে মুছতে ঘরে গেল। আজলানকে উদাম গায়ে কোচে শুয়ে চোখ বুঁজে থাকতে দেখে বিড়বিড়িয়ে বলল,

” আসামাত্রই কাপড়চোপড় খুলে ফেলেছে। বেশরম লোক। ওরকম গায়ে দেখলে তিথির তাকে লুইচ্চা লুইচ্চা লাগে। ”

তিথি ঠোঁট মুছতে মুছতে নাক টানলো। আজলান চোখ মেলে তাকে দেখলো। খানিকক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইলো। তারপর উঠে তোয়ালে আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার পথে তিথিকে ফিরে দেখলো। লিপস্টিক ঠোঁটের আশেপাশে ছড়িয়ে অবস্থা নাজেহাল। সে ভুরু কুঁচকে চাইতেই তিথি বলল,

” ওটা দামী লিপস্টিক তাই সহজে যাচ্ছে না। ”

আজলান দেখলো তার নাক আর থুঁতনির নীচে ঘাম জমেছে। গালের দুপাশে জড়িগুলো ঝকমক করছে। গালের পাশে আঙুল চেপে তা দেখিয়ে বলল,

” মুখে এসব কি দিয়েছ? ”

” মেকআপ করেছি। বাপের বাড়িতে সেজেগুজে না গেলে শ্বশুরবাড়ি আর জামাইয়ের বদনাম হয়।”

” আচ্ছা, তারপর? ”

তিথি বলল,

” তাই সেজেছি। সবাই আমাকে বলছিলো সুন্দর লাগছে। ”

” গুড। এবার ধুয়ে ফেললো এন্ড অফকোর্স ডাবোল ক্লিনজিং। কুইক। আমি গোসল নেব। ”

তিথি মুখ ভালো করে ধুয়ে বের হলো। আজলান তোয়ালে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

” মুখ মুছে ওই শরবতের গ্লাসটা নিয়ে এসো। ”

তিথি মুখটা মুছে তারপর গ্লাসটা নিয়ে এসে তার দিকে বাড়িয়ে দিল। আজলান বলল,

” তুমি অর্ধেক খাও। ”

তিথি খুশিমনে খেয়ে নিল। অর্ধেক খাওয়া শেষ করে বাকিটা আজলানের দিকে বাড়িয়ে দিতেই আজলান বলল,

” আরও খাও। ”

তিথি খানিকটা রেখে বাকিগুলো খেয়ে নিল। শেষটুকু আজলানের দিকে বাড়িয়ে দিতেই আজলান বলল,

” পুরোটা শেষ করো। ”

তিথির বুক ভার হয়ে এল। সে ভেবেছিলো ফাটাকেষ্ঠ তার চুমুক দেয়া গ্লাসে মুখ বসিয়ে বাকি শরবতটুকু খাবে। এত রাগ লাগলো তার। শরীরে জোর পাচ্ছে না নইলে কি করতো সে নিজেই জানে না।

আজলান ওয়াশরুমে চলে গেল। গেল যে গেল আর আসার নামগন্ধ নেই। তিথি বুঝে পায় না গায়ে সাবান কয়বার মাখে, কয়বার ধোয়। এতক্ষণ লাগে ব্যাটামানুষের গোসল করতে?

গোসল শেষে বের হতেই আজলানকে অনেক প্রাণবন্ত দেখালো। চুলগুলো কপালে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। উদাম গায়ে খুশবু বেরোচ্ছে। পরনে শুধু সাদা ট্রাউজার। বিছানায় বসে স্যুটকেসটা টেনে কাপড়চোপড় জিনিসপত্র বের করতে করতে তিথিকে ডাকলো,

“মেহবুব!”

তিথি শব্দ করলো।

” হু। ”

” তোমার বাবাকে রাতে খেয়ে যেতে বলো। ”

তিথি ” আচ্ছা ” বলে খুশিমনে বেরিয়ে গেল। বলে এসে বিছানায় উঠে আজলানের পাশে বসে বললো,

” তুমি এতদিন কোথায় ছিলে গো? তোমাকে অনেক মিস করেছে বাড়ির সবাই। ”

” শুনে খুশি হয়ে গেলাম। কারা কারা মিস করেছে?”

” সবাই। বাবা, মা, আয়জা, সামির, আভিরা, আতিফা আপা সবাই সবাই। ”

” আর? ”

তিথি বলল,

” কিন্তু তেলাপোকা, নেংটি ইঁদুরগুলো ভীষণ খুশি হয়েছে। বেশ আনন্দের সাথে ছোটাছুটি করেছে এ কয়দিন। ”

” আচ্ছা। আর কেউ মিস করেনি?”

” করেছে। ”

” কে? ”

” রমলা চাচী। বললো, আহারে বাবুটার কথা মনে পড়তাছে বউ। বাড়িত থাকলে কত মেজাজ দেখায় এখন দেহো বাড়িডা একদম শান্ত হয়ে পড়ে আছে।”

” ইন্টারেস্টিং! আর কেউ? ”

তিথি বিছানার উপর দুই হাঁটুতে ভর করে তার পিঠের সাথে লেগে কপালের সামনের চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বললো,

” আম্মাও মিস করেছে। ফোন করলে জিজ্ঞেস করে জামাই কখন আসবে? ”

আজলান বলল,

” আর কেউ? ”

তিথি বললো,

” ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা মিস করেছে। ”

” বাহ! তারপর? ”

” আমার পাশের বালিশটা। ”

” আর? ”

” চাদরটা। ”

” আর কেউ? ”

তিথি ভেবে ভেবে বললো,

” ওহ হ্যা তোমার বাবু তোমাকে মিস করেছে। তোমাকে মিস করলে তখন এমন জোরে লাথি মারে, ওরে বাবারে কি আর বলব! আমি তো সেইরাতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছি। ”

” সিরিয়াসলি! আর কেউ মিস করেনি? ”

তিথি বললো, ” তুষারও মিস করেছে। দু’দিন আগে ফোন দিয়ে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলো। দুলাভাই কোথায় গেছে, কখন আসবে সেকথা জিজ্ঞেস করেছে।”

আজলান জোরে জোরে শব্দ করে স্যুটকেসটা বন্ধ করলো। পায়ে ঠেলে পাশে রেখে তিথির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,

” এটা ধুতে হবে। কি যেন বলছিলে না? ”

তিথি তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

” কিছু না। তোমাকে সবাই মিস করেছে ওটা বলেছি। ”

আজলান বললো, ” আর কেউ মিস করেনি? ”

তিথি বললো, ” সবাই মিস করেছে। আর কেউ বাকি নেই। ”

আজলান তার হাত সরিয়ে আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো,

” ছাড়ো। ”

তিথি এমন ভয় পেয়ে গেল। তাকে ছেড়ে দূরে সটকে পড়ে গোলগাল চোখে চেয়ে রইলো। বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠেছে, শরীর কাঁপুনি দিয়েছে। হাঁপাতে গিয়ে কষ্ট লাগায় কেঁদে উঠলো সে। আজলান তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললো,

” তুমিও ওই নেংটি ইঁদুরগুলোর মতো বেশ খুশি ছিলে?”

তিথি বাম হাতে চোখ মুছে নিয়ে পিছিয়ে গিয়ে বললো,

” না না আমিও মিস করেছি। তোমার কথা মনে করে করে ব্রাশ করেছি, শ্যাম্পু করেছি, ভেজা তোয়ালেটা বিছানা থেকে সরিয়ে রেখেছি, ব্যায়াম করেছি, গোপাল ভাঁড় দেখতে গিয়ে টিভি বন্ধ করে দিয়েছি, টাইমে টাইমে গ্যাস্টিকের ঔষধ খেয়েছি, বেশিবেশি পানি খেয়েছি। ”

আজলান বলল, ” তারপর? ”

তিথি পিছু টলতে গিয়ে আজলানের গলা জড়িয়ে ধরে ফেললো। বলল,

” তুমি এসে গালাগালি করবে তাই সবসময় তোমার কথা ভেবে কাজ করেছি। ”

আজলান বলল, ” আমি গালাগালি করি? ”

” না। ”

” কি করি? ”

” সাবধান করো। নিয়ম মেনে চলতে বলো। ”

” গুড। আমার কথা মনে করে সব নিয়ম মেনেছ কিন্তু সেজেগুজে বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় আমার কথা মনে ছিল না? ”

তিথি দুপাশে মাথা নেড়ে বললো,

” বিশ্বাস করো ওখানে গিয়ে তোমাকে আবার মনে করতাম। ”

আজলানের চোখমুখ কঠিন হয়ে আসতেই তিথি দুঃখের সাথে বললো,

” আমার ব্যাথা লাগছে। ওরে বাপ্রে। ”

আজলান বললো,

” কোথায়? ”

তিথি পেটের দিকে আঙুল তাক করে বললো,

” এখানে। কাল এদিকে বেশি লাথি দিয়েছে ও। মনে হচ্ছিলো হাডুডু খেলছে। তাই আমি ঠিক করেছি ওর নাম দেব ডোডো। ”

আজলান বললো,

” একেবারে বাজে নাম। ওর নামধাম সব আমি দেব। তুমি দূরে থাকো। ”

তিথি মুখ গোমড়া করে বসে রইলো।
আজলান একটা বয়াম এনে বাড়িয়ে দিল তার দিকে। বললো,

” বেশি খাবে না। পরিমিত খাবে। ”

তিথি খপ করে বয়ামটা কেড়ে নিল। দেখলো বরই আচারের বয়াম। চোখ বড় বড় করে চাইলো। আজলান বললো, ” বাহ্বা! খুশি দেখি ধরে না। ”
তিথি খুশি হয়ে তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো।
দু’জন দু’জনকে অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেল।

তিথি বয়ামের ঢাকনা খোলার চেষ্টা করলো। খুলতে না পেরে আজলানকে দিল। আজলান বয়ামের ঢাকনা খুলে দিতেই তিথি হেসে উঠে বললো,

” কি সুগন্ধি গো। খুব মজা হবে নিশ্চয়ই। ”

আজলান বললো, ” হু, আরও একটা আছে। ওটা আয়জাকে দিয়ে দেবে। ”

তিথি মাথা নেড়ে একটা আচার তুলে মুখে পুরার আগেই আজলানের দিকে বাড়িয়ে দিতেই আজলান মুখ ফিরিয়ে নিল। তিথি সেটা খেয়ে নিল। খেতে খেতে বললো,

” উমম কি মজা! ”

আজলান ভুরু কুঁচকে বলল,

” কোনটা? ”

তিথি বললো,

” আচার। ”

আজলান তাকে কোলে তুলে নিল তখুনি। আচারের বয়ামটা শক্ত করে ধরে রেখে তিথি চেঁচিয়ে উঠলো,

” না না তোমার আদর বেশি মজা। এবার নামাও প্লিজ। ফেলে দিলে আমার ডোডো ব্যাথা পাবে। ”

আজলান ধমকে বলল,

” শাট আপ। ”

তারপর ওজন মাপার মেশিনে দাঁড় করিয়ে দিল তিথিকে। তিথি আচার খেতে খেতে বললো, ” ওহহহহহহ এই ব্যাপার। ”

চলমান….

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_৯ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_৯
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আজলান র‌্যাবের সদর দপ্তরে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে গিয়েছে। বাড়ির সবাইকে বলে গেলেও তিথিকে কিছু বলেনি। গেল যে গেল প্রায় পনের দিন পার হয়ে গেলেও বাড়ি আসার নাম নেই। তিথি তার কাজবাজ নিয়ে অত মাথা ঘামায় না। শুনেছে সে একটা ট্রেনিংয়ে গিয়েছে। ট্রেনিং শব্দটা শুনলেই তিথি বড়ো খুশি হয়। এতে করে আজলান শেখ বাড়িতে থাকেনা তাই সে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়তে পারে।

বিয়ের পর তার এক মামাতো ভাই বলেছে ” তোর বর ক্রসফায়ারে মানুষ মারে। ”
তা শুনে তিথি অবাক হয়নি। জাঁদরেল লোকটাকে দেখলেই তার জান্তবের মতো লাগে। এতদিনে তাকে মারেনি এই বেশি। কিন্তু একদিন ঘরে ব্রাওনিং এম সেমি অটোমেটিক পিস্তল আবিষ্কার পরার তিথি যেন নিজের মধ্যে ছিল না। কি ভয়ানক জিনিসপত্র ঘরে রাখে লোকটা। আজলান দেখামাত্রই কেড়ে নিয়েছিলো। তিথি আর একটা শব্দও করেনি। তাকে চুপসে যেতে দেখে আজলান কোণা দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো।
“এটা খায় না, মাথায় দেয়? ” এই প্রশ্ন কেন জিজ্ঞেস করেনি সেটাই আজলানকে ভাবাচ্ছিলো তখন।

তিথির মাতৃকালীন সময় ছ’মাস। পেট সামান্য উঁচু হয়েছে। এখন হাঁটতে চলতে একটু অসুবিধা হয়। তবুও সে হাঁটে, ক্ষেত্রবিশেষে দৌড়ায়ও। আম্বিয়া বেগমের যত্নআত্তির এখন একটু বেড়েছে। আতিফা বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গিয়েছে। আয়জার বিবাহের প্রস্তাব আসছে কয়েকদিন পরপর। বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসার অপেক্ষায় আছে সবাই তাই আর কোনোদিকে মনোযোগ দিচ্ছে না।

আজলান ট্রেনিংয়ে গিয়েছে শুনে হঠাৎ করে একদিন মফিজুর রহমান নিজে এসে হাজির হলেন শেখ বাড়িতে। তিথি তো মহাখুশি। ফাটাকেষ্ঠটা না থাকলে একের পর খুশিতে মেতে থাকে সে।

মেয়েকে দেখে মফিজুর রহমান আবেগী হয়ে পড়লেন। তিথির স্বাস্থ্য বেড়েছে আগের চাইতে, গায়ের রঙটা খুলে গিয়েছে, হাত পা হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। মা মা একটা ভাব চলে এসেছে তারমধ্যে । পরনে ছাইরঙা ম্যাক্সিটাতে তাকে কি সুন্দর মানিয়েছে। মেয়েটা যত্নে আছে দেখে উনার মন জুড়িয়ে গেল।

মেয়ের শ্বশুরবাড়ির মানুষ একটু ঠাটবাট বজায় রেখে চলেন এটা তিনি জানেন। যেহেতু মেয়েকে বড় ঘরে বিয়ে দিয়েছেন সেহেতু আসার সময় একটু সংকোচে ভুগেন। জামাইটা ঘাড়ত্যাড়া গাদ্দার বলে উনার দুঃখ হয় নইলে মেয়েটা ঠিক জায়গায় গিয়ে পড়েছে।

কিছুদিন আগে সংসারটা একেবারে ভেঙে যাচ্ছিলো। মেয়েটাকে পাঠিয়েই দিয়েছিলো শ্বাশুড়ি। ফোনে বললো, “আদবকায়দা শিখিয়ে তারপর বিয়ে দিতে পারেননাই মেয়েকে? ” মফিজুর রহমান বড়ো দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন তখন। বাচ্চা আসার খবর শুনে তাও একটু দমেছে সবাই। মেয়েটাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।

কিন্তু তার তিন মাসের মধ্যে মেয়ে নিজেই কেঁদেকেটে চলে এল। জানালো, তার বর তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।

কারণ জানতে চাইলে বললো,

” বাবা ওই আমি শুধু বলেছি আমার কলেজের একটা বান্ধবী খুঁতখু্ঁতে, ভীষণ পরিষ্কার, নাক সিটকানো টাইপ। ডেপুটি অফিসারের সাথে একদম মিল আছে।
ওর গায়ের রঙও এক্কেবারে লাল টকটকে, আমার মতো কালোনি নয়। থুঁতনির নীচে একটা তিল আছে। গালে দুটো বড় বড় টোল পড়ে। এক্কেবারে নায়িকাদের মতো দেখতে। মানে তোমার জামাইয়ের মনের মতো মেয়ে যাকে বলে। বললাম, আমাকে ছেড়েটেড়ে দিলে সমস্যা নেই। আমি কিছু বলব না। কিন্তু বিয়েশাদী করলে বলো। ওই মেয়ের সাথে তোমার একেবারে সবকিছুতে মিলে যাবে। ওর সাথে তোমার হাত করিয়ে দেব। ওর দাঁতগুলো এক্কেবারে সাদা ঝকঝকে, ব্রাশ না করলেও চলবে। চুলে শ্যাম্পু না দিলেও খুশবু থাকে, কাপড় চোপড়ে ধূলোময়লা লাগতে দেয়না, যে রঙের কাপড় পড়ে সেই রঙেই তাকে মানায়, তোমার মতো সেকেন্ডে সেকেন্ড হাত ধোয়। আরও কিছু কথা বলেছি যেগুলো তোমাকে বলতে পারছিনা।
আরেহ! কথাটা বলে শেষ করে উঠতে পারিনি। আমাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। একেবারে বাড়ি থেকে। ভাবো একবার, ভুল কি বলেছি আমি! এমন লোকের সাথে কি সংসার করা যায়? ঠাট্টা মশকরা না বুঝলে সেইসব নিরামিষ মানুষের সাথে ঘর সংসার করা যায়? তুমি বলো আমার দোষ কোথায়? ”

মফিজ সাহেব রেগেমেগে বললেন, ” গোলামের পুত এক বাড়ি গাড়ি জুড়ায়ছে শুধু সেসবের কারেন্ট দেখায়। ওর কারেন্টের খেতাপুরি। ”

তিথি বললো, ” শুধু কারেন্ট দেখায় না। তেলে যেন পানি পড়ছে ওইভাবে ছ্যাত ছ্যাত করে উঠে আমি কোনো কথা বললে। আসলে বাবা সত্যি কথা কি জানো? আমার কথাগুলো একদম ঠিক জায়গায় গিয়ে লাগে। তাই ওমন করে। ”

মফিজুর রহমান মেয়ের কোনো ভুল দেখতে পাননি। মেয়েটা একটু কথাবার্তা বেশি বলে। বয়সই বা কত যে গুছিয়ে কথা বলতে পারবে। অতবড় দামড়াটা যদি একটা বউ সামলাতে না পারে, এটুকুনি মেয়েটার কথায় রেগেমেগে আগুন হয়ে যায় সেখানে আর কি বলার থাকতে পারে? তবে মালেকা বেগম মেয়েকে বেশ শাঁসিয়েছেন। ওই মহিলা মেয়ে জামাইয়ের অন্ধভক্ত। ওই দামড়াটা যা বলবে সেই মহিলা তাতেই মাথা নাড়বে।

মফিজ সাহেব অমন মেরুদন্ডহীন না। শ্বশুর জামাইয়ের মধ্যেকার সম্পর্ক বজায় থাকার জন্য উনি মানসম্মানের কথা ভেবে ফোনে কিংবা সামনাসামনি কিছু বলতে দ্বিধা করলেও মেয়েকে বারংবার সাহস দেন। বলেন,

” ওই দামড়ার কথা গায়ে মাখলে চলবে না। ওই গোলামের পুতের গায়ের চামড়া মোটা, ঘাড়ের রগ ত্যাড়া তাই এমন করে। ”

সেসব কথা কাটাকাটি, দুশ্চিন্তা তো গেল। ডিভোর্সের কথা পর্যন্ত উঠে এল। বাচ্চার এবোরশনের কথা পর্যন্ত উঠলো।
আবার কি মনে করে দামড়াটা হঠাৎ সেদিন বাড়ি বয়ে এসে মেয়েটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল তার কারণটা আজও জানতে পারলেন না মফিজ সাহেব। অবশ্য তারপর আর কোনো বিচার দেয়নি মেয়ে। বাচ্চার কথা ভেবে হয়ত দামড়াটা শোধরে গেছে।

কিন্তু অত শোধরালো কই? মেয়েটার উপর অত্যাচার আর অপমান করা কমিয়েছে কিন্তু দামড়াটার ঘাড়ত্যাড়ামি কমেনি।
এইতো ট্রেনিংয়ে যাওয়ার কয়েকদিন আগে বাজারে হঠাৎ দেখা হলো শ্বশুর জামাইয়ের। মুখে মাক্স পড়েছিলো তবুও মফিজ সাহেব তাকে চিনে ফেললো। এগিয়ে গিয়ে কথা বলতেই তাকে বললো, ” ওদিকে পঁচা মাছ বিক্রি করে। ওদিকে কি করছিলেন? দেখি কি কিনেছেন? ”

মফিজ সাহেব থলে খুলে দেখালো। তিনি লইট্টা মাছ কিনেছেন দুই কেজি। একটু নরম হয়েছে কিন্তু খাওয়া যাবে। উনার অল্প রোজগারের টাকায় সংসারটা চলে। সেখানে বড়বড় রুই কাতলা খাওয়ার সামর্থ্য নেই। সেজন্য মেয়েটাকেও এই অবস্থায় নাইওর আনতে পারছে না ভালোমন্দ খাওয়াতে পারবেন না বলে।
লজ্জা শরম পাশে রেখে মাছগুলো দেখিয়ে ফোকলা হেসে বললেন, ” তোমার শ্বাশুড়ি বড়ো পছন্দ করে লইট্টা মাছ। ”

আজলান জিজ্ঞেস করলো, ” এগুলো মনে হয় ফ্রেশ লইট্টাগুলো না। দেখি দেখি পলিথিনটা খুলুন। ”

মফিজ সাহেব পলিথিন খুলতেই আজলান বললো,

” ফ্রেশ লইট্টা চেনার উপায় হচ্ছে এরা লাল রঙের হবে। যেগুলোতে অলরেডি পচন ধরেছে সেগুলো ধূসর রঙের হয়ে যাবে গন্ধও ব্যাপক। মাছের গা নরম হয়ে আসবে। আপনার চশমার পাওয়া কমেছে নাকি নাসারন্ধ্রে কোনো সমস্যা? ”

মফিজুর রহমান চুপ করে রইলেন। দামড়াটা ভরা বাজারের মধ্যে ইজ্জৎ সম্মান রাখবে কিনা কে জানে! মাছগুলো নিয়ে মাছওয়ালাকে ফেরত দিয়ে বলল,

” এসব মাছ পঁচে গেছে। বয়স্ক মানুষ পেয়েছিস বলে ধরিয়ে দিয়েছিস নাকি? ”

মাছওয়ালা বললো,

” সবাই কিনতেছে বদ্দা। আপনি কিনলে কিনেন না কিনলে অন্য মাছ কিনেন। হাঁটের দিনে ঝামেলা করিয়েন না। ”

আজলান বলল, ” ফরমালিন দেয়ার পরও টাইম ওভার হওয়ায় সেগুলোতে পচন ধরেছে। তারপরও সেগুলো বেঁচছিস। আবার গলাও পাকাচ্ছিস! ”

মাছ বিক্রেতা বললো, ” জোর করে তো বেঁচতেছিনা। ”

আজলান বলল, ” সস্তায়ও তো বেঁচছিস না। ওই দোকানে যত দিয়ে বেঁচছে তুইও সেই দামে বেঁচছিস। তাহলো তফাত রইলো কোথায়? ”

দোকানদার অন্য ক্রেতার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তাকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গেল। আজলান মাছগুলো ঢেলে দিয়ে বলল,

” ভালো থেকে মাছ দে। নয়ত টাকা ফেরত দে। ”

মাছ বিক্রেতা এবার রেগে গিয়ে বলল,

” ওই মিয়া অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করতেছি। আপনে পাইছেনটা কি? কম টাকার মাছ কিনে আবার বাহাদুরি। সমস্যা কি অ্যাহ? ”

বলতে না বলতেই লোকটা একেবারে অভদ্রের মতো চেঁচিয়ে মানুষ জড়ো করে ফেললো। মফিজুর রহমান বিপাকে পড়ে গেলেন। বললেন,

” ওরেহ রাগিস না। ও আমার মেয়ে জামাই। আইনের মানুষ। কথা বাড়াস না ভাই। অযথা ঝামেলা বাড়বো। ”

মাছ বিক্রেতা ঝিমিয়ে গেল। সেখানে আশেপাশে বাজার পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। তিনি এসে আজলানকে দেখে বললেন,

” আপনাকে চিনতে পারেনি তাই ভুল করছে। এমন আর কখনো হবে না। ওই স্যারের কাছে মাফ চা। ”

মাছ বিক্রেতা চুপসে গেল। মাথা নত করে রইলো।

আজলান বলল, ” ওসব নাটকের দরকার নেই। কথাটা ভালো করে শোন। এখানে যত পঁচা মাছ আছে সব ভাগাড়ে ফেলবি। সব এখান থেকে সরা। ভালো মাছগুলো সামনে রাখ। এই যাদের যাদের পঁচা মাছ আছে সবাই ওর মতো ভাগাড়ে ফেল পঁচা মাছগুলো। ”

একটা ছোটখাটো ভীড় জমে গেল সেখানটাতে।
ঝামেলা কমে যেতেই শেষমেশ কি কি যেন কিনে দিয়ে থলেটা উনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দামড়াটা বলল,

” সোজা বাড়ি যান। আপনারা বাপ মেয়ের কারণে আমার মাথা নষ্ট হবেই। যেখানে যায় সেখানে একটা না একটা ঝামেলা না হয়ে শান্তি নেই। ”

মফিজ সাহেব থলেটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আজলান ভুরু কুঁচকে বললো, ” কোনো সমস্যা? ”

মফিজ সাহেব সাহস করে মৃদুস্বরে বললেন,

” বলছিলাম কি বাবা। ওর মা বলেছে একটু ওকে নিয়ে যদি তুমি বাড়ি আসো। আসলে মায়ের মন তো। এইসময় মেয়েকে একটু কাছে রাখতে চায়। ”

আজলান সরাসরি মুখের উপর বলে দিল।

” অসম্ভব। ওর ট্রিটমেন্ট চলছে। ওর পেছনে গাধার খাটুনি খাটছে আমার মা বোন মিলে। এইসময় ওখানে যাওয়া মানেই রুটিনের হেরফের হওয়া। ওসব বাজে আবদার করে লাভ নেই। যান বাড়ি যান। মেয়ের জন্য অত দরদ থাকলে গিয়ে দেখে আসবেন। ”

মফিজ সাহেব ভীষণ রেগে গেলেন। মনে মনে বললেন, ” শালা তোরে যদি আমি কোনোদিন ফাঁদে ফেলতে না পারি আমার নামও মফিজুর রহমান নয়। তোর ঘাড়ত্যাড়ামি আমি চুটিয়ে ছাড়বো। ”

বাড়ি ফিরে মালেকা বেগমকে সব বলতেই উনি গর্বের সাথে বললেন, ” ভাবা যায় আমাদের জামাই কতবড় গুর্দাওয়ালা মানুষ! ”
মফিজ সাহেব বললেন, ” গুর্দাওয়ালা না গাদ্দার ব্যাটালোক। সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে ফেলেছে এক চিল্লানি দিয়ে। আমার মেয়ে ঠিকই বলে সকাল বিকাল নিয়ম করে ওর চিল্লানি শুনলে হার্টের রোগী হতে বেশি সময় লাগবে না। ”

মালেকা বেগম থলে থেকে বড় একটা কাতলা মাছ, তাজা লইট্টা মাছের পলিথিন, সাথে টমেটো, কাঁচা মরিচ, আর শাকসবজি বের করতে করতে বললেন,

” যাই বলো আমার জামাই কিন্তু লক্ষীটি। আজ বাজার থলেটা ভরে গেল তার ভাগ্যে। ”

___

বাবাকে পেয়ে তিথি যেমন খুশি হলো তেমন রাগ দেখালো কেন এতদিন একবারও তাকে আসেনি। মাকে কেন আনেনি। তার ভাইটাও কেন আসেনি। মফিজ সাহেব বললেন,

” তোর বর তো নেই। আজ যাবি? কয়েকদিন থেকে চলে আসবি আর কি। তোর শ্বাশুড়িকে আমি বুঝিয়ে বলি। ”

তিথি খুশি হয়ে গেল। বলল, ” আমার শ্বশুরআব্বাকে বললে হয়ে যাবে কিন্তু ওই লোক না শুনেমতো। শুনলে দেখবে উড়ে উড়ে চলে এসেছে আমাকে জব্দ করতে। ”

মফিজ সাহেব অনেক অনুরোধের পর আম্বিয়া বেগম রাজী হলেন। আফতাব শেখও অনুমতি দিল। আয়জা বলল,

” ভাইয়ার সাথে বাবা কথা বলবে। তুমি চিন্তা করো না ভাবি। কিন্তু সাবধানে থেকো। হ্যা? নইলে আমাদেরও রক্ষে থাকবে না। ”

তিথি মনে মনে বললো, ” আমি একবার শুধু বাড়িতে যাই তারপর নিজে ফোন করে জানিয়ে দেব ফাটাকেষ্ঠকে। চিল্লাক সেখানে বসে। ”

_______________

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে ১২টি হত্যাসহ ৮টি মামলার দায়ে আসামী হান্নানকে ক্রসফায়ারে মৃত্যু মৃত্যু দেয়ার আদেশ কার্যকর হয় গতরাত বারোটার দিকে। তন্মধ্যে শুটারের একজন ডেপুটি কমান্ডার আজলান শেখও ছিল।
অভিযান শেষ হওয়ার পর বেলা তিনটের দিকে সে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিলো।

তিথি তখন সেজেগুজে ঠোঁটে লালরঙা লিপস্টিক মেখে, মুখে প্রাইমার, কনসিলার, ফাউন্ডেশন লাগিয়ে লুস পাউডার দিয়ে ঘষেমেজে গালের দুপাশে ব্লাশ লাগিয়ে, তারউপর হাইলাইটার দিয়ে সেজেগুজে বসে আছে। আয়নায় বারবার নিজেকে দেখে লাল হচ্ছিলো সে। ফাটাকেষ্ঠর সাথে থাকতে থাকতে সে সুন্দর, স্মার্ট হয়েছে তা বলতে বাকি রাখে না। নিজের মুখটা চকচক করছিলো দেখে লজ্জা পাচ্ছিলো সে। এবার সে বুঝতে পারলো এতদিন সে অসুন্দর ছিল না, গরিব ছিল।

খুশিমনে নীচে নেমে এসে শ্বশুর শ্বাশুড়িকে সালাম করে, আয়জা আর রমলা চাচীর সাথে গলাগলি করে হেসেখেলে বাবার সাথে বেরোনোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সে। বোরকাটা সবেমাত্র হাতে নিয়েছে তক্ষুণি সদর দরজা পার হয়ে মঈন ঢুকে এল স্যুটকেস হাতে। মঈনের পিছুপিছু গটগট পায়ে হেঁটে বাড়িতে আজলান শেখ ঢুকলো ব্ল্যাক ইউনিফর্মে। জার্নি করায় ক্লান্ত তারপরও কেমন তেজ, হাঁটার ধরন আর চোখের নিস্তেজ চাহনির ধার! তিথিকে আঁড়চোখে দেখে হাঁটতে হাঁটতে আম্বিয়া বেগমের কথার জবাব দিল।

” ওমা না জানিয়ে এলি যে? ”

” বলে এলে এত সুন্দর একটা নাটক মিস করে যেতাম। মেহবুব ঘরে এসো। কুইক। ”

তিথির কান্না আটকে রইলো গলার কাছে।

চলমান….

এই_ভালো_এই_খারাপ ( কপি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ) #পর্ব_৮ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ ( কপি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
#পর্ব_৮
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছিলো। ঘুমটাও বেশ ভালো হয়েছে তিথির। অবশ্য স্বামী সোহাগ পেলে সেদিন ঘুম এমনিতেই ভালো হওয়ার কথা কিন্তু তিথির ঘুম বেশি ভালো হয়েছে ফাটাকেষ্ঠর হাসি দেখে। বিয়ের পর হয়ত এই প্রথমবার সে ফাটাকেষ্ঠকে হাসতে দেখেছে। যারা হঠাৎ করে হাসে তাদের হাসি দেখলে মনে হয় এত সুন্দর দৃশ্য আর হতেই পারে না।

লোকটা সচারাচর হাসে না। তিথির সাথে একদমই না। শৈশব থেকেই একটা কড়া নিয়মের মধ্যে বড় হওয়া আজলান শেখ হয়ত এমন এলেবেলে, অগোছালো, উচ্ছৃঙ্খল মেহবুবা মাহনূরের মতো মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়নি। হয়ত চেয়েছে একজন ফিটফাট, গোছালো, সুশৃঙ্খল, শান্ত-ভদ্র, সংযমী, টিপটপ, গোলগাল গোছের সংসারী মেয়ে। যে হাসবে, কাঁদবে, কথা বলবে কিন্তু তার আওয়াজ ঘরের বাইরের মানুষের কানে যাবে না।
যাকে বকলে রাগ করবে, অভিমানে হয়ত গাল ফুলাবে, বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদবে। বিনিময়ে হাজারটা আবদার করবে। সেখানে তারও রাগ ভাঙানোর সুযোগ থাকবে কিন্তু উল্টো চেঁচামেচি করবে না।
যার প্রতিটা কাজ হবে নিখুঁত। যার হাতের ছোঁয়ায় ঘরের প্রতিটি আনাচকানাচ হয়ে উঠবে ঝকঝকে তকতকে।

কিন্তু সেই জায়গায় মেহবুবা মাহনূরের মতো এমন বাচাল, চঞ্চলমতি, দুরন্ত, ঠোঁটকাটা, উচ্ছৃঙ্খল, অগোছালো মেয়েকে দেখে পাগলপারা দিশেহারা আজলান শেখ একের পর এক বিস্মিত হচ্ছিলো তখন মেহবুবা মাহনূর তাতে আরও তেল মশলা যোগ করে দিল নিজের বোকামি দ্বারা।

আজলান শেখ চুপচাপ তার কাজ, চলনবলন দেখছিলো প্রথম দিন থেকেই। চোখের সামনেই যেন নিজের একটা বিপরীত প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছিলো সে। পিতার উপর রাগ চেপে চুপচাপ ঘরের বধূকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বিয়ের পরের দিনই তার বৈপরীত্য টের পেল সে।

হিসেব নিকেশ করে, গুছিয়ে কথা বলা আজলান দেখলো, তার বধূর প্রনাউন্সিয়েশন ঠিকঠাক নেই, লাগামহীন প্রকাশভঙ্গী, কনসিডারেশন লেভেল জিরো, ম্যানার্স আয়ত্ত করেনি। সবাইকে নিজের মতো করে ভেবে নেয়। সবাইকে তার নিজের ভাষায় বুঝাতে চেষ্টা করে।

শুধু তাই নয় আজলান দেখলো তার বিয়ে করে আনা নতুন বধূ একটা শাড়ি খু্ঁজতে গিয়ে সবকটা কাপড়চোপড় এলোমেলো করে তারমধ্যে বসে আছে। এমনকি তার আইরন করা সব কাপড়চোপড় বিছানায় পড়ে আছে এলোমেলো হয়ে।

যেখানে লেভেন্ডার, রোজিব্রাউন, ট্যান, অলিভ, ধূসর ইত্যাদি ইত্যাদি শীতল রঙগুলোর শাড়ি আর সেলোয়ার-কামিজ এনে ভরিয়ে দিয়েছে আজলান শেখ সেখানে তিথির পছন্দ টকটকে লাল, কমলা আর হলুদ সবুজ রঙের পোশাক।

হাজারটা পছন্দ, অপছন্দের ভীড়ে আজলান শেখের কাছে তিথির ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে আদর করাটা পছন্দের হলেও চুল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানিতে ভিজে যাওয়া ব্লাউজের পিঠ একদম অপছন্দ কিন্তু সেই অপছন্দের কাজটাই যেন তিথির ভারী পছন্দের। ভালো করে চুল না মুছে তোয়ালে ছাড়িয়ে নেয়াটা তার একটা বাজে অভ্যাস।

মাথার একগাদা লম্বা চুলগুলো না আঁচড়ে মোচড়াতে মোচড়াতে রমলা চাচীর মতো উঁচু করে বেঁধে রাখাটা যেখানে তিথির পছন্দ আর স্বস্তি সেখানে তার চুলের বেণীতে গেঁথে দেয়ার জন্য আজলানের আনা ফুলের জায়গা হয়েছে জালানার ওপাশে।

বিয়ের দু’দিনের মাথায় তিথির পিরিয়ড দেখা দিয়েছে। পিরিয়ডকালীন সময়ে সে আজলানের ধারেকাছে আসেনি। বিয়েতে আসা এক মুরব্বি নাকি তাকে বলেছে, ওইসব হলে তারা স্বামীর আশপাশে যেত না। মাটিতে শুঁতো। তিথি আশেপাশে আসা তো দূর। জরুরি কাজে ডাকলেও আভিরাকে দিয়ে বলে পাঠালো, তোমার মামাকে বলবে আমি নাপাক, নাপাক।

তোতা পাখির মতো হুবহু নকল করে আভিরা এসে সেটা বলাতেই আজলান স্তব্ধ। একটা নর্মাল বিষয়কে সে নাপাক নাপাক বলে ঘৃণা ধরিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে আজলান তাকে বিছানায় আর ডাকেনি। না ডাকায় সে আরেক রাগ। সুস্থ হওয়ার পর বিছানায় বসে নাক টানতে টানতে বলল, ” আমি ভালো হয়ে গেছি। ”

আজলান বলল, ” হোয়াট? ”

তিথি বলল, ” মানে এখন ওসব শেষ। ”

” কোনসব? ”

তিথি বলল, ” ওইসব আর কি। নাম ধরলেও ঘৃণা লাগে আমার। ”

আজলান বলল, ” আউট। তুমি ওখানেই থাকবে। ”

তিথি কেঁদেকেটে রেগেমেগে দু তিনরাত মেঝেতে শুয়েছে। তারপর এক ঝড়ের রাতে বজ্রপাতের শব্দে ভয় পেয়ে বিছানায় উঠে বরের বুকে গুঁজে যেতেই যখন আরাম পেল আর নামেনি। আজলানের ঘুমন্ত মুখটার উপর আলতো হাতে চড়াতে চড়াতে বলল, “ছেলেদের ওগুলো হয় না জানি। অন্যকিছুও হয় না? ”

আজলান জবাব দিল। ” হয়। ”

তিথি ইয়াকক বলে একলাফে দূরে যাবে তক্ষুণি খপ করে ধরে তাকে নিজের জিম্মায় নিয়ে নিল আজলান। বুকের নীচে চাপা দিয়ে বলল, ” বউ থাকলে কিচ্ছু হয় না। না থাকলে হয়। ঘুমাও তো ডিস্টার্ব না করে। ”

তিথি ফিসফিস করে বললো, ” ওগুলোকে স্বপ্নদোষ বলে মদন। ”

তা শুনে আজলান তাকে সোজা ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। পরে আবার মায়া লাগলো কান্না শুনে। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে আনলো ঠিকই কিন্তু মেঝেতে ঘুমাতে হয়েছে তিথিকে। ওখানে ঘুমাতে ঘুমাতে সে বড়ো দুঃখ নিয়ে কেঁদে বললো,

” ওহ এজন্যই তুমি অত পারফিউম ইউজ করো। বুঝি বুঝি সব বুঝি। ”

আজলান রাগ করে কয়েকটা দিন একদম কাছে ডাকেনি তাকে। তিথি তাও শোধরালো না। নিজ থেকে উঠে এল না। উল্টো বললো,

” তুমি সুস্থ হলে আমাকে ডেকো। বর ছাড়া ঘুম আসে নাকি? ”

আজলান দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলো সে হাসবে নাকি কাঁদবে। নাকি এই মেয়েকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেবে।

চলমান….

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_৭ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধু

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_৭
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

বাড়ি ফেরার পর তিথি রাতের খাবারটা খেয়েদেয়ে আয়েজার ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। আয়জা এসে বলল,

” ভাবি তোমার কোমরে মলম মালিশ করতে হবে। ভাইয়া বললো, এক্ষুণি যেতে। ”

তিথি বললো, ” তোমার ভাইকে বলো ওর সাথে আমার কোনো কথা নেই। ”

আয়জা বলল, ” এমন করো না প্লিজ। এখন এসে চেঁচামেচি জুড়ে দেবে। ”

তিথি শুয়েই থাকলো। আয়জা বলল, ” দেখো তোমাকে ডাকছে। ”

তিথি বলল, ” চুপ করে থাকো। ”

আয়জা বারবার দরজার দিকে তাকালো। আজলান দরজাটা ধপাস করে ঠেলে ঘরে ঢুকে বলল,

” আশ্চর্য! তিনটে ট্যাবলেট খেতে হবে, আর মলম লাগাতে হবে। তুমি এখানে এসে শুয়ে পড়েছ? ”

তিথি বলল, ” ট্যাবলেট গুলো একেকটা হাতির সাইজের। গিলতে পারবো না। তুমি খাও। ”

আজলান বিছানায় বসে আয়জাকে বলল, ” পানি দে। ”

আয়জা গ্লাস ভরে পানি দিল। আজলান ঔষধের বক্স থেকে ঔষধ বের করতে করতে বলল,

” তোমার বাবা মায়ের উচিত ছিল তোমাকে পঁচিশ বছর বয়সে বিয়ে দেয়া। ”

তিথি বলল, ” তুমি পঁচিশ বছর বয়সী মেয়ে তো বিয়ে করতে না। ”

আজলান চুপচাপ ঔষধ বাড়িয়ে দিল দু টুকরো করে। ঔষধগুলো খেয়ে ধপাস করে পড়ে রইলো তিথি। আজলান বলল,

” কামিজ সরাও। মলম লাগাতে হবে। ”

তিথি আয়জার দিকে তাকালো। আয়জা লজ্জা পেয়ে বেরিয়ে যেতেই তিথি কামিজ সরালো। বলল,

” তোমার হাত বহুত শক্ত কিন্তু অফিসার। ”

আজলান বক্রহেসে বলল, ” এই হাতেই মানুষ পিটিয়ে সোজা করি বুঝলে? ”

তিথি বলল, ” তুমি একটা পাষাণ। উফ একটু ধীরে মালিশ করো। কেমন শক্ত হাত বাপু। ”

আজলান বলল, ” কোমর ব্যাথাটা সেড়ে গেলে এক্সারসাইজ করতে হবে। দিস এক্সারসাইজ আর ভেরি ইমপোর্টেন্ট ফর প্র্যাগনেন্ট ওম্যান হবে।। ”

তিথি বলল, ” ওরে বাপরে ওই হাত পা ছুঁড়ে যে ব্যায়ামগুলো করে সেগুলো! আমার বাচ্চা যদি গুন্ডা হয়? ”

” শাটআপ। কামিজটা সরাও ভালো করে। ”

তিথি কামিজ অনেকটা তুলে দিল। বলল,

” শোনো না ব্যায়ামগুলো করলে যদি আমার হাতেও তোমার মতো এরকম খোয়া খোয়া মাংস হয়? ”

আজলান বলল, ” এগুলোকে সিক্সপ্যাক বলে ষ্টুপিড। ”

তিথি হেসে উঠে মুখ বিকৃত করে,

” খোয়া খোয়া মাংসগুলোকে নাকি সিক্সপ্যাক বলে! দেখলেই ঘৃণা লাগে। ইচ্ছে করে কামড়ে গোস্তগুলো ছিঁড়ে ফেলি। আবার সেগুলো নিয়ে নাকি দম্ভও দেখায়। যেসব মেয়েমানুষ এই খোয়া খোয়া গোস্তগুলো দেখে কাত চিৎ হয়ে পড়ে যায় সেগুলোর মাথায় নির্ঘাত সমস্যা আছে। ”

আজলান মাথা নেড়ে বলল, ” হ্যা সবাই পাগল শুধু তুমিই ভালো। ”

তিথি বলল, ” যে মুখে বললে ওই মুখে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু খাব না। আমার পেট ভরা। দুই প্লেট ফুচকা, এক বাসন ভাত আর তোমার বাচ্চা মিলে আমি টুইটুম্বুর। ”

মলম মালিশ করা শেষে আজলান বললো,

” চলো এবার। ”

তিথি বলল, ” আমি এখানে থাকবো। ”

আজলান বলল, ” তোমাকে মেঝেতে শুঁতে হবে। ফোমের বিছানায় শোয়া যাবে না। ”

তিথি বলল, ” তাও এখানে শুবো। ”

আজলান তাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,

” আমি ওখানে বিছানা অব্দি ঠিক করে ফেলেছি। সবসময় মাথা নষ্ট করার তালে থাকো। ”

তিথি শক্ত করে তার গলা জড়িয়ে রাখলো। বলল,

” তুমি রাতে আবার দুষ্টুমি টুষ্টুমি করবে না তো ডেপুটি আফিষাড়? ”

” হোয়াট ইজ আফিষাড়? ”

তিথি হাসতে হাসতে বলল,

” কিসসু না। তুমি আমার সাথে মেঝেতে না শুলে আমি কিন্তু আয়জার রুমে চলে যাবো বস। ”

আজলান বলল, ” ওকে। ”

তিথি বলল, ” ব্যাপার কি বলোতো? তুমি আজকাল পল্টি খাচ্ছ? তোমার বাচ্চার জন্য? ”

” হাহ। ”

” গুডবয়। ”

আজলান ঘরে ঢুকে তাকে মাদুর আর কাঁথার বিছানার উপর বসিয়ে দিল। তিথি তাকে সহ ধরে শুয়ে পড়ে বলল,

” আজকে তোমাকেও আমার সাথে শুতে হবে বুদ্ধু। নইলে বুঝবে কি করে এভাবে ঘুমাতে কত মজা। যাইহোক একটা চুমু খেয়ে ফেলোতো। মুড সুয়িং হচ্ছে বুঝলে। ”

আজলান একটু ঝুঁকে তার মুখ শুঁকে বলল,

” অসম্ভব। ঔষধের ঘ্রাণ। ”

তিথি হেসে উঠে বলল, ” কাল তো ব্রাশ করিনি তবুও খেয়েছ আজও খেয়ে ফেলো। তুমি আদর করলে তোমার বাচ্চা পেটের ভিতর এক্কেবারে খুশিতে লাফিয়ে উঠে। ”

তক্ষুণি আয়জা দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে ঔষধের বক্সটা নিয়ে। দুজন দুজনকে ছাড়ার আগেই আয়জা যেপথে এসেছে সেপথে পালিয়েছে। আজলান বলল,

” দরজা খোলা আছে সেদিকে তোমার হুঁশ নেই? ”

তিথি গড়াগড়ি খেয়ে বলল,

” আদরের পিনিক উঠলে সেসব মনে থাকে না বস। ”

আজলান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” হোয়াট ইজ পিনিক? ”

তিথি বলল,

” অর্থনীতিবিদদের ভাষায় একে চাহিদা বলে। আর তুমি যদি তৎক্ষনাৎ একটা আদর দাও সেটা হবে ভোগ। আমি যে হুটহাট আদর চাইতে পারি সেটা হচ্ছে ভোগ প্রবণতা। ”

আজলান দরজা বন্ধ করতে গেল।

তিথি বলল, ” আচ্ছা শ্বাশুমা বললো। তুমি নাকি বিয়েশাদী করতে চাওনি? সেটা কেন? ”

” আমার অনেক রেস্ট্রিকশন আছে। সবাই আমার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে না। যার স্পষ্ট উদাহরণ তুমি। ”

তিথি বলল, ” জোর করেছে সবাই মিলে। তাই করেছ? ”

” হ্যা আবার না। ”

তিথি আরেকটু গড়াগড়ি খেয়ে বলল,

” করলে ভালো কথা কিন্তু আমার মতো কালোনিকে কেন?”

” সেটা তোমার শ্বশুরআব্বা জানে। গো এন্ড আস্ক হিম।”

তিথি বললো, ” তিনি বলেছেন তুমি আমার ছবিটা বেছে নিয়েছিলে। ”

বলেই জোরে হেসে উঠলো। আজলান রেগে গিয়ে বলল,

” এটাতো হাসির কি আছে? আমি কি জানতাম তুমি অসভ্য? ”

তিথি চোখদুটো ট্যারা করে তাকিয়ে বলল,

” আমি শাঁকচুন্নি সেটা বুঝোনি না? আহারে উহুরে। হতাশ খুবই হতাশ। ”

আজলান লাইট নিভিয়ে পাশে এসে শুয়ে পড়লো ওপাশ ফিরে। তিথি তার গায়ের উপর পা তুলে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,

” এক্সারসাইজ করছি। ”

আজলান তার পা সরিয়ে দিয়ে বলল,

” সোজা ঘর থেকে বের করে দেব মেহবুব। ”

তিথি এবার নিজেকেই উঠিয়ে দিল তার গায়ের উপর। বলল,

” এটাকে কোন এক্সারসাইজ বলে আফিষাড়?”

আজলান হঠাৎ দমফাটা হাসিতে ফেটে পড়লো।
তিথি হাসতে হাসতে কেঁদে উঠলো। জোরে কাঁদলো। কাঁদতে কাঁদতে আজলানের বুকের কাছে শার্টে নাকের পানি মুছে দেয়ায় যেখানে দশটা চুমুর পাওয়ার কথা সেখানে পেল শুধু দুটো। বাকি আটটা না পাওয়ার দুঃখে তিথি কেঁদে গেল। বহুদিন সে এভাবে কাঁদেনি।

চলমান….

চেক টেক পরে করা হবে। 🥱

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_৬ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_৬
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আজলান পায়ের উপর পা তুলে বসে টিভি দেখছিলো। আম্বিয়া বেগম হন্তদন্ত পায়ে হেঁটে ঘরে এসে বলল, ” বউটার কোমরে কত জখম হয়েছে দেখেছিস? মনে হয় হাড্ডিতে আঘাত লেগেছে। এবার মনে হয় বাচ্চাটার আর রক্ষে হলো না। ”

আজলান ভুরু কুঁচকে কথাগুলো শুনে বলল,

” এসব কখন হলো? ”

” পালঙ্ক থেকে পড়ে যাওয়ায় হয়েছে। তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাহ ওকে। এখন হাঁটতে অব্দি পারছে না। তোকে তো কিছু বলাও যায় না।”

” আমাকে কিছু না বললে বুঝবো কি করে? ”

” বৌ বাচ্চা তোর। অথচ চিন্তায় মরি আমি। তোকে কেন যে বিয়ে করাতে গেলাম! ”

আজলান রিমোট চেপে টিভি বন্ধ করে বিছানা থেকে নামলো।

অনেক বাছাবাছির পর থিন স্পোর্ট উইন্ডব্রেকার আল্ট্রা লাইট জ্যাকেটটা বাছাই করে পড়ে নিল। তারপর মাথার চুল আঁচড়ে আবার হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিল। আবার আঁচড়ালো। আমেনা বেগম সরু চোখে চেয়ে আছেন। ছোট থেকেই তার এসব ঢঙ দেখতে দেখতে অতিষ্ঠ তিনি। বৌটা সহ্য করছে এই বেশি। কিছু বলতেও পারেন না।

আজলান পারফিউম স্প্রে করে
ফোনটা পকেটে ভরতে ভরতে বের হলো। আয়জাকে ডেকে বলল,

” ওকে বোরকা পড়িয়ে দে। মঈনকে গাড়ি বের করতে বল। ”

আম্বিয়া বেগম তার পিছুপিছু এসে বললেন,

” তুই ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিস? ”

আজলান বলল, ” ওখানে পরিচিত একজন ডাক্তার আছে তার কাছে যাবো। ”

আম্বিয়া বেগম খুশি হয়ে বললেন, ” আল্লাহ সুবুদ্ধি দিল এবার। ”

তিথি শ্বশুরের সাথে গল্পগুজব করছে। এই বাড়িতে এই মানুষটা সম্পূর্ণভাবে তিথির পক্ষে কথা বলে। শ্বাশুড়ি মায়ের মতো ক্ষণেক্ষণে পল্টি খায় না। সে দেখেছে ছেলের সাথে উনার অঘোষিত একটা যুদ্ধ চলে সবসময়। তবে উনি ভদ্রলোক। সবসময় তর্কে জড়াতে ভালোবাসেন না। সুকৌশলে এমনভাবে আজলান শেখকে খোঁচা দিয়ে কথা বলেন যেটা বাড়ির অন্যরা সহজে ঠাহর করতে না পারলেও আজলান শেখের কোণা চোখের চাহনি দেখে তিথি স্পষ্ট বুঝতে পারে এ যেন খোঁচা নয়। ওই গোঁয়ার গালটাতে ঠাস ঠাস করে পড়া চড়। দৃশ্যটা ভাবতেই তিথির শান্তি লাগে।

তিথির অসহ্য রকমের যন্ত্রণা হচ্ছিলো। এমনকি পায়ের উপর ভর দিয়ে হাঁটতেও দমবন্ধ লাগছিলো ব্যাথায়। আয়জা বোরকা পড়িয়ে দিতেই আজলান বলল,
” চলো। ”

তিথি মুখ গোমড়া করে চেয়ে বলল, ” আমি মুখটুক কিছুই ধুইনি। ”

আজলান বলল,

” তোমার মুখ দেখছে কে? ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, ” ওর কথা শুনিস না তো বাবা। নিয়ে যাহ। ও মনে হয় সাজগোছ করার কথা বলছে। ”

তিথি বলল, ” এগজ্যাক্টলী শ্বাশুমা। ”

আজলান তার হাত ধরে বলল, ” শাটআপ। চলো। ডাক্তারের কাছে যাচ্ছ সিনেমা হলে নয়। ”

তিথিকে টেনে তুলতেই তিথি কোমরে হাত চেপে “ও মারে বাপরে” বলে ডেকে উঠলো। আজলান ভয় পেয়ে হাতটা ছেড়ে দিল। তিথি বলল,

” যাব না ডাক্তারের কাছে। আমি হাঁটতে পারছিনা।”

আফতাব শেখ চশমা ঠিক করে বললেন, “তোমার বরকে বলো যেন কোলে তুলে নিয়ে যায়। ”

তিথির ব্যাথিত মুখখানা ঝলমলিয়ে উঠলো। আজলান বলল, ” এতক্ষণ তো বেশ হাঁটছিলে। ”

তিথি বলল, ” তোমার কোলে উঠবো আমি? কোনসময় ধপাস করে ফেলে দাও তার গ্যারান্টি নেই।”

আফতাব সাহেব মঈনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

” মঈন তুমি তোমার স্যারের হয়ে সব কাজ করো। এটুকু করতে পারবে না? ”

মঈন মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইলো। আজলান উনার দিকে তাকিয়ে কাঠকাঠ গলায় বললো,

” মঈন গাড়ি স্টার্ট দাও। ”

মঈন চলে গেল। আম্বিয়া বেগম উনার স্বামীকে বিড়বিড় করে বললেন, ” বেয়াক্কেল একটা। ওর বউ মঈন কোলে নেবে কেন? নাতিপুতি হয়ে গেছে এখনো আক্কেল হয় না বুড়োর। ”

তিথির কিছু ভালো লাগছিলো না। তবুও চুপটি করে সবার তামাশা দেখছিলো বিশেষ করে আজলান শেখের। তাকে কিভাবে কোলে নিলে তার একটুও আয়ু ক্ষয় হবে না, এতটুকু সৌন্দর্য কমবে না সেটা বোধহয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো। তারপর অনেক ভাবাভাবির পর তাকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তিথি কিচ্ছু বললো না। ব্যাথায় সে জগত সংসার ভুলে যাচ্ছে। আজলান শেখকে বোধহয় সবার আগে ভুলে গেছে। হঠাৎ করে মাথায় এল, আরেহ এ কে? কোথা থেকে এল?
তার জীবনটা তো ঝকঝকে নীল আকাশের ওই রংধনুর মতো রঙিন ছিল। হাসিখুশি চঞ্চলমতি তিথি সে! এত দুঃখ চেপে হাসতে কবে শিখে গেছে?

ডাক্তার তাকে ভালোমতো দেখে ফরোয়ার্ড বন্ডিং, ব্যাকওয়ার্ড বন্ডিং পরীক্ষা দিল। সাথে নিউরোলজিক্যাল ডিফিসিয়েন্সি আছে কী না সেই ব্যাপারেও কথা বললো। কোমরের এক্স-রে এবং এমআরআই করাতে বললো। এবং পরামর্শ দিল সব সময় শক্ত সমান বিছানায় ঘুমাতে হবে। ফোমের বিছানায় ঘুমানো যাবে না এবং ফোমের নরম সোফায় অনেকক্ষণ বসা যাবে না। ঘুমানোর সময় সোজা হয়ে ঘুমাতে হবে। বেশি নড়াচড়া করা যাবে না।

আজলান বাচ্চার কথা ভেবে অস্থির হয়ে পড়েছিলো। ডাক্তার একটু রাগত স্বরে বললো, ”
“প্রেগন্যান্সির সময় শুধু মাকে নয় ফ্যামিলির সবাইকে সতর্ক থাকতে হয়। ভাগ্য ভালো বেবির কিছু হয়নি। অনেক বড় একটা বিপদ হয়ে যেতে পারতো। ”

তিথি পুরোটা সময় কোনোপ্রকার কথা বললো না। দুটো ইনজেকশন পুশ করার পর কেবিনে প্রায় দু’ঘন্টার মতো সময় কাটিয়েছে সে। ব্যাথা কমে আসার পর দু একটা কথা বলেছে নার্সের সাথে। আজলান ভেবেছিলো মারাত্মক কিছু হয়ে গিয়েছে। তিথি কথা বলায় স্বস্তি পেল সে।
কি ডেঞ্জারাস মহিলা! সারাক্ষণ বকরবকর করে মাথা নষ্ট করে দেবে আবার চুপ করে থাকলেও আতঙ্কের শেষ নেই।

গাড়িতে নিয়ে আসার পথে আজলান বলল,
” হাঁটতে পারবে?”

তিথি বলল, ” দৌড়াতে পারবো। ছুঁবে না একদম। অসহ্য লাগে। ”

আজলান বলল, ” তার আবার ছিঁড়ে গেল! ”

তিথি বলল, ” তোমার ষড়যন্ত্র কি আমি বুঝতে পারছিনা? তুমি আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলার জন্য ষড়যন্ত্রটা করেছ। তোমাকে আমি ছাড়বো না। ”

বলেই আজলানের বাহু খামচে দিয়ে টলমলে চোখে তাকালো।
আজলান তাকে সংশোধন করে দিয়ে বলল, ” ওটা আমার বাচ্চা ঠিক আছে? এবোরশন করানোর জন্য ডাক্তারের পিছুপিছু কে দৌড়েছে তার প্রমাণ আমার কাছে আছে। শুকনো দরদ দেখাচ্ছ এখন? ডিজগাস্টিং! একদম চুপ থাকো। বেশি কথা বললে এখানে রেখে চলে যাবো। ”

তিথি মুখ ভার করে রইলো। ব্যস্ত শহরের এই কোলাহল তিথির একটুও ভালো লাগছে না। হঠাৎ হঠাৎ জীবনটাকে বেশ পানসে লাগে। যেন কোথাও একটুও স্বস্তি নেই, শান্তি নেই, আনন্দ নেই। জীবনে ভালোবাসার মানুষ থাকার চাইতে ভীষণ করে ভালোবাসতে পারার মতো একটা মানুষের দরকার হয়। যাকে খুব করে মন ভরে ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে। তিথির জীবনে এরকম কেউই আসেনি। না তাকে কেউ ভালোবেসেছে, না তার কাউকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করেছে। যার দিকেই দু পা এগিয়েছে সেই তাকে দশ পা পিছিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।

যেতে যেতে হঠাৎ করে মঈনকে সে বলল,

” ভাইয়া একটা ফুচকার দোকানে নিয়ে চলেন। দুই প্লেট খাবো। ”

মঈন আজলানের দিকে ফিরে চাইলো। তিথি বলল,

” আমি যেটা বলছি সেটা করুন।”

মঈন বলল, ” স্যার…

আজলান বলল, ” ওইসব তেল চিটচিটে ফুচকা খাবে তুমি? ”

তিথি বলল, ” হ্যা খাবো। তুমি চলে যাও। আমি ভাইয়ার সাথে ফিরবো। ”

আজলান বলল, ” আমি খেতে দেব না তোমাকে। শুধু নিজের চিন্তা করছো। বেবির চিন্তাও করতে হবে তোমাকে। ”

তিথি বলল, ” ও আমাকে গুঁতো মেরে বলছে ফুচকা খেতে। বলছে, মা মা এরকম সুযোগ আর পাবে না। ”

মঈন ঠোঁট টিপে টিপে হাসতে লাগলো। আজলান বলল,

” ও গুঁতো মারবে কি করে? ”

তিথি বলল, ” সেটা তুমি বুঝবে কিভাবে? তুমি কখনো মা হয়েছ? নাকি কখনো হবে? ”

আজলান বলল, ” মেহবুব তোমাকে আমি ওয়ার্ন করছি এগুলো অস্বাস্থ্যকর খাবার। ”

তিথি ফিসফিসিয়ে বলল, ” তোমার চুমুর চাইতে স্বাস্থ্যকর আছে। ”

আজলান চুপ করে রইলো। তিথি বলল, ” ভাইয়া চলেন। ”

মঈন গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল। স্যার কিছু বলেনি দেখে সে ফুচকার দোকানের সামনে গিয়ে গাড়ি থামালো। তিথি সবার আগে নেমে গিয়ে ফুচকা তার জন্য আর মঈনের জন্য ফুচকা অর্ডার দিল। আজলান গাড়ি থেকে নেমে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। দোকানের ভেতরটা কেমন, কিভাবে বানাচ্ছে, কি দিয়ে বানাচ্ছে এসব জিনিস লক্ষ করছে বেশ সূক্ষ্মভাবে। তিথি খেতে খেতে তাকে দেখলো। এত সুন্দর পুরুষ মানুষকে সে ভালোটালো বাসতে পারেনি কেন? অথচ তার মতো কালো বুঁচকি কি এর মতো কাউকে পাওয়ার যোগ্যতা রাখে? কথায় আছে না কপালে থাকলে সে অটোমেটিক্যালি চলে আসে। আজলান শেখও তার জীবনে অটোমেটিক্যালি চলে এসেছে। তাই বোধহয় তাদের মধ্যে সংসার করাটা জরুরি হয়ে পড়েছিলো, ভালোবাসা নয়।

মঈন আজলানের উদ্দেশ্যে বলল,

” স্যার খেয়ে দেখতে পারেন। দারুণ। ”

আজলান বলল, ” তুমিও ওর সাথে তাল মিলাচ্ছো? এসব খেলে পেটে গ্যাস হয়। ”

তিথি টুলের উপর বসে খেতে খেতে বলল,

” এত স্বাদ ক্যা? ”

আজলান তার দিকে চাইতেই তিথি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ” একটা খাবে? পেটের সব গ্যাসগ্যাস ফুড়ফুড় করে বেরিয়ে যাবে কাল সকালে। ”

খাওয়ার সময় বিষম উঠে গেল মঈনের। আজলান মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দোকানিকে ধমকে বলে উঠলো,

” এই তোরা গ্লাভস পড়িস না কেন? ”

দোকানি হেসে উঠে বলল, ” কে ভাই? এসব জেনে আপনি কি করবেন? ”

আজলান বলল, ” গ্লাভস ছাড়া হাত দিয়ে সবাইকে খেতে দিচ্ছিস। আবার শসা, ডিমগুলোও হাত দিয়ে ধরছিস। তেঁতুলগুলো হাত দিয়ে কচলাচ্ছিস। এসব স্বাস্থ্যকর? মানুষকে মজার জিনিস খাওয়াচ্ছিস নাকি বিষ? ”

” আরেহ ভাই জ্ঞান দিয়েন না তো। অনেক বছর ধরে দোকানটা চলতেছে। আপনার সমস্যা হলে খাইয়েন না। ব্যস। ”

আজলান বলল,

” পুলিশ এসে দোকানটা উড়িয়ে দিলে ভালো হবে? প্লেটগুলোও তো ভালো করে ধুয়েমুছে রাখিস না। এখানে এত মাছি কেন? ”

দোকানি বিরক্তিকর গলায় বলল,

” আরেহ ভাই কি সমস্যা আপনার? না খাইলে না খান। আপনার জ্ঞান শুনবার জন্য আমরা বসে নাই। পুলিশ অনেকবার আসছে। ওরাও চটপটি ফুচকা খেয়েদেয়ে সাথে বউয়ের জন্য নিয়ে গেছে।”

আজলান বলল, ” আমি ঝামেলা বাঁধাচ্ছি? ”

তিথি ফুচকা মুখে পুরে দ্রুত গিলে ফেলে আজলানকে বলল, ” এখানে ঝামেলা করো না প্লিজ। ”

আজলান তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল,

” এখনো ঝামেলার কি দেখলে ডার্লিং? অনেক কিছু দেখার বাকি আছে এখনো। ”

দোকানি তিথিকে বলল, ” আপা টেকা দিয়া যান। ”

মঈন এসে কিছু বলতে যেতেই আজলান বলল,

” তুমি কথা বলবে না। মেহবুব গাড়িতে যাও। ”

তিথি বলল, ” কি করবে তুমি? ”

আজলান পায়চারি করতে করতে রাস্তার একপাশে চলে গেল। ফুচকার টাকা মঈন শোধ করে দিল। তিথিকে বলল,

” আপনি বসুন। আমি স্যারকে নিয়ে আসছি। ”

প্রায় দশ বারো মিনিটের মতো গাড়িতে বসে রইলো তিথি। তন্মধ্যে একটা গাড়ি থেকে কয়েকটা লোক নেমে এল। গায়ে ক্যাজুয়াল ফুল হাতা সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট। আজলান একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো পকেটে হাত গুঁজে। লোকগুলোর সাথে শুধু দৃষ্টি বিনিময় হলো তার।

সবাই দোকানের সামনে ভীড় জমালো। তিথি আজলানকে গিয়ে বলল, ” ওরা কারা? ”

” ফুড সেফটি ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছে। ”

তিথি অবাককন্ঠে বলল, ” কোনো দরকার ছিল এসবের? ”

” কতবড় বেয়াদব সে। আর সাহস কত! আমার সাথে তর্ক করছে!”

তিথি বলল, ” তাই বলে ওদের পেছনে পুলিশ লাগিয়ে দেবে? ”

দোকানিটার বিলাপ শুনতে পেল তিথি। বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠলো তার। আজলানের কাছে ছুটে এসে লোকটা বলল,

” স্যার ভুল হয়ে গেছে। আমি অনেকদিন ধরে দোকানটা চালাই স্যার। এটা দিয়ে সংসার চলে। ”

আজলান বলল, ” সিল পড়বে তোর দোকানে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে যেদিন দোকান চালাতে পারবি সেদিন দোকান খোলার অনুমতি পাবি। ”

বলেই ঘাড় বেঁকিয়ে ইশারা করতেই দোকানটা বন্ধ করে দেয়ার তোড়জোড় শুরু হলো। তিথি অবাকচোখ স্বার্থপরতা চেয়ে রইলো। যেন ইচ্ছে করে, নিজের দম্ভ, অহংকার জাহির করার জন্য কাজটা সে জেদের বশে করেছে। তিথির আরও বেশি ঘৃণা জমলো লোকটার উপর। বলল,

” যেখানে সেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার না করলেই নয়? ”

আজলাম গর্জে বলল, ” চুপ। ”

তিথিকে টেনে গাড়িতে এনে বসিয়ে দিল সে। বলল,

” মঈন গাড়ি ছাড়ো। ”

ফুড সেফটি ডিপার্ট্মেন্টের অফিসারগুলো এসে আজলানের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কি যেন বলাবলি করলো। আজলান গাড়িতে উঠে বসতেই দোকানিটা ছুটে এসে বলল,

” ও স্যার আমারে একবার সুযোগ দিন। ”

আজলান জানালার কাচ তুলে দিতে দিতে বলল,

” আগে গ্লাভস কিনে নিয়ে আয়। ”

তিথি বলল, ” কি পাষাণ তুমি! ”

আজলান মুখ শক্ত করে বসে রইলো। তিথি বলল,

” আমি খেতে গিয়েছি তাই তুমি প্রতিশোধ নিয়েছ না? ”

” এতকিছু যখন বুঝতে পারো তখন আমার সাথে পাল্লা দিতে যাও কেন? ”

তিথি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,

” তোমার সব দম্ভ একদিন ভাঙবে। ”

আজলান বলল, ” আমার মতো মানুষের দম্ভ আছে বলেই তোমাকে এখন অব্দি তেলাপোকার স্যুপ খাওয়ায়নি কেউ। ”

তিথি চুপ করে রইলো। রাগে তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।

চলমান…

কাল বড় পর্ব দেব।

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_৫ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_৫
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

তিথির চেঁচামেচি শুনে আম্বিয়া বেগম ছুটে এসেছেন। দরজা ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগলেন,

” তোরা কি শুরু করেছিস বলতো। শান্তিতে একটু বসতেও দিবি না? ”

আজলান দরজা খুলে দিতেই আম্বিয়া বেগম আর আয়জা ঘরে ঢুকে পড়লো। দুজনেরই চক্ষু ছানাবড়া তিথিকে দেখে। মুখে টেপ, হাত পা বাঁধা। তিথি পা দুটো লম্বা করে টেনে টিভিতে গোপাল ভাঁড় দেখছে। আয়জা ঠোঁট টিপে হাসলো। আম্বিয়া বড় বড় চোখ করে বললেন,

” কি করলি এটা? ”

আজলান বলল, ” এই বাড়িকে নাকি ঠ্যাং দেখিয়ে চলে যাবে। তাই বেঁধে রেখেছি। ”

আম্বিয়া বেগম তিথিকে জিজ্ঞেস করলো,

” এবার ভালো লাগছে তোর বজ্জাত মেয়ে? ”

তিথি উপরনীচ মাথা দুলিয়ে জানালো “হ্যা”। আম্বিয়া বেগম অবাককন্ঠে বলল,

” হারামজাদি। ”

তিথি কথা বলতে পারছেনা তাই চোখদুটো ট্যারা করে তাকালো। আজলান ফোল্ডিং আইরন টেবিলে তার ইউনিফর্মটা আইরন করাচ্ছিলো। করার সময় ঘাড় ফিরিয়ে তিথির দিকে একপলক তাকাতেই দেখলো সে ট্যারা চোখে তাকাচ্ছে। আয়জা হাসছে। আম্বিয়া বেগম ক্ষেপাটে চোখে চেয়ে আছেন। বললেন,

” উচিত হয়েছে। একদম ঠিক কাজ করেছে। থাক তুই এভাবে। ”

তিথি চোখের আইরিশ ঘুরাতে লাগলো। আম্বিয়া বেগম কাছে মাথায় একটা চড় মেরে চলে গেল। আয়জা গেল না। বলল,

” ভাইয়া খুলে দেই? ”

আজলান আইরন টেবিল ফোল্ড করে বলল,

” এত দরদ আসছে কোথাথেকে? ”

আয়জা মাথা নামিয়ে চলে গেল।
তিথি আজলানের দিকে চোখ ট্যারা করে চেয়ে রইলো। আজলান বলল,

” গাধাকে পিটালেও সে গাধাই থাকবে। তোমার ক্ষেত্রেও সেই দশা। থাকো এখানে পড়ে। ”

গন্ডারের ঘরে একা থাকতে তিথির ভয় করে তাই পা দিয়ে বিছানায় ধপাস ধপাস মারলো তিথি। আজলান দরজা বন্ধ করে চলে গেল।

বাইরে দাঁড়িয়ে ফোনালাপ সাড়ছিলো সে । হঠাৎ সামির আর আভিরা ছুটতে ছুটতে এলল। বলল,

” মামা মামা! মামণি কাত হয়ে পড়ে গেছে। ”

আজলান ফোন সরিয়ে বলল,

” কোথায়? ”

আম্বিয়া বেগম চেঁচাতে চেঁচাতে আসছেন।

” বাচ্চাটারে কি মারার পরিকল্পনা করতেছোস সবাই মিলে? ওরে ওভাবে বেঁধে রাখছোস, ও গড়াতে গড়াতে পড়ে গেছে পালঙ্ক থেকে। গিয়ে দেখি ব্যাথায় কোঁকাচ্ছে। ”

আজলান ফোনটা পকেটে পুরে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। আম্বিয়া বেগম চেঁচাতে চেঁচাতে বললেন,

” পরের মেয়েরে কি দোষ দেব? আমার নিজেরটাই তো দোষে ভরা। ”

আজলান গিয়ে দেখলো তিথি ব্যাথায় কোঁকাচ্ছে। আয়জা পায়ের বাঁধনটা খুলতে ব্যস্ত। আজলানের দিকে তাকালো না সে। আজলান বলল,

” গবেট কোথাকার। গড়াতে গিয়েছ কেন? পড়ে যাবে সেটা জানতে না? ”

তিথি জবাব দিল না। আয়জা পায়ের বাঁধন খুলে দিতেই তিথি পা নামালো। আয়জা বলল, ” কোথাও ব্যাথা পাচ্ছ? ”

পিছুপিছু আম্বিয়া বেগম এসে বলল, ” পেটে লাগেনি তো বউ? এসময় কত সতর্ক হতে হয় মেয়েদের। আল্লাহ তোদের কেন যে বুদ্ধিসুদ্ধি দেয় না!”

তিথি কারো কোনো জবাব দিল না। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। হাঁটতে গিয়ে কঠিন ব্যাথা অনুভব করলো কোমরে। কিন্তু কাউকে কিচ্ছু বললো না। কাউকে দুর্বলতা দেখাতে নেই। এদেরকে তো নয়ই।
তাকে হাঁটতে দেখে আজলান বড়সড় শ্বাস ফেলে বলল,

” হুদাই টেনশন করছো। ওর কিচ্ছু হয়নি। ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, ” ওর সাথে যেমন তেমন করতে পারবিনা কিন্তু আজলান। বাচ্চাটার কিছু হলে আমি তোদের ছাড়বো না একদম। ”

__

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে তিথি আয়জার কাছে চলে গেল। আয়জা বলল, ” তুমি তোমার ঘরে চলে যাও ভাবি। ভাইয়া আমার উপর ক্ষেপে যাবে। ”

তিথি বলল, ” তো আমি কি করব? ”

আয়জা বলল, ” ভাইয়া আমাকে বকবে। ”

তিথি বলল, ” কিছু হতে না হতেই আমাকে মেঝেতে ঘুমাতে বলবে। আমি অনেক সহ্য করেছি। এখন আমার সাথে আমার বাচ্চা আছে। আমাকে কিছু বলা মানে আমার বাচ্চার অপমান। কিছু বলবে না। চিল মুডে থাকো। ”

আয়জা বলল, ” সামনে তোমার ইনকোর্স পরীক্ষা। পরীক্ষা দেবে না? ”

” জানিনা। ” বলেই তিথি কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। এবার ব্যাথাটা ক্রমশ বাড়ছে। উফফ কি জ্বালা রে। কোমরের হাড্ডি বোধহয় গেল ভেঙে। সকালে ঘুম থেকে উঠে খেয়াল করলো মেঝেতে পা বসাতে অব্দি কষ্ট হচ্ছে। এতটা এতটা ব্যাথা করছে কোমরে। কোনোমতে পা টিপে টিপে ঘরে বিয়ে দেখলো ঝকঝকে তকতকে মেঝে, বিছানা। ইউনিফর্ম পড়ে মাথা চুল ঠিকঠাক করছে আজলান শেখ। তিথি এসেছে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। তিথি আহত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কেউ কিছু বললো না।

তিথি ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগিয়ে নিল। ব্রাশ করতে করতে লাগলো। এত শব্দ করে কুলি করতে লাগলো যে আজলানের বিরক্তির সীমা রইলো না। কাতকুত করে গলা পরিষ্কার করতে লাগলো। যেন গলা নয় ইটের কারখানা। আজলান বেরিয়ে গেল।

তিথি মুখ মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা করে কোমরের দিকে উন্মুক্ত করে দেখলো ফুলে গেছে সেখানটাতে। কি টনটনে ব্যাথা!

আজলান তক্ষুণি ঘরে প্রবেশ করতেই তিথি চেঁচিয়ে উঠে বললো, ” ছিহ। ”

আজলান তার টুপিটা নিতে ভুলে গিয়েছিলো। সেটা হাতে নিয়ে তিথির দিকে তাকিয়ে বলল,

” সমস্যা? ”

তিথি আয়নার আজলানের দিকে চেয়ে বলল,
“বিরাট সমস্যা। আমি যখনই আমার কাপড় সরাবো তখনই তোমাকে চলে আসতে হবে। শয়তানটা তোমাকে বলে দেয় না? তোমার সাথে ওর খুব ভাব? ”

” শাট আপ। ”

তিথি চুপ করে গেল। আজলান তার বাহু ধরে তার দিকে ফিরিয়ে বলল,

” ঘর, বিছানা, ওয়ারড্রব কিছু যেন এলোমেলো না হয়। ”

তিথি বলল, ” ওকে বস। ”

আজলান বলল, ” এডভোকেট তসলিমা খাতুনকে বলে দিয়েছি পেপারটা যেন আর ন’টা মাস পর দেয়। ”

তিথি চেঁচিয়ে বলল, ” ডিভোর্স পেপার? ”

আজলান বলল, ” হ্যা। ”

তিথি বলল, ” সত্যি সত্যি ডিভোর্স দেবে আমাকে?”

আজলান বলল, ” জাস্ট শাটআপ। উনার কাছে তুমি গিয়েছিলে সো উনি যা বলেছেন আমি শুধু তোমাকে তাই বলেছি। সবকিছুতে আমাকে ইনভলভ করাটা বন্ধ করো। এন্ড ইউ নৌ হোয়াট! তুমি একটা অসহ্য বাদড়। ”

তিথি বলল, ” আরেহ না না। বাদড় না। গন্ডারনি। ”

আজলান বলল, ” মানে? ”

” মানে হচ্ছে গন্ডারের বউকে গন্ডারনি বলে। ”

আজলান কন্ঠ একটু খাদে নামিয়ে বলল, ” তোমাকে আমি এই বাড়ি থেকে চিরতরে বের করে দিতাম। পারছিনা কেন জানো? জাস্ট বিকজ ইউ আর মাই সো কল্ড ওয়াইফ এন্ড মাদার অফ মাই চাইল্ড। ”

তিথি বলল, ” আর কিছু? ”

আজলান বলল, ” আমি এসে যদি দেখি তুমি সবকিছু এলোমেলো করে ফেলেছ তাহলে সোজা বাড়ির বাইরে আউট। তোমার জায়গা বস্তিতে। ”

তিথি মুখ বেঁকিয়ে বলল, ” বস্তির জামাই। ”

আজলান কাজে চলে গেল। তিথি রমলা চাচীর সাথে তালে তাল মিলিয়ে রান্নাঘরের কাজবাজ করে নিল। রমলা চাচী একমাত্র তার দুঃখ বোঝে। বলল, ” তুমি আইলা ক্যান এই বাড়িত? তুমি যহন ছিলানা তোমার নামে কত কি বলছে সবাই মিলে।”

” কি বলছে? ”

রমলা ফিসফিস করে বলল, ” তোমার জামাইরে আরেকডা বিয়া করাইবো বলছে। ”

তিথি হেসে উঠে বলল, ” এরকম হলে আমার চাইতে বেশি খুশি কেউ হবে না বুঝলে? ”

রমলা চাচী অবাককন্ঠে বলল, ” তুমি হাসতেছো বউ? জামাই যখন অন্য কাউরে সোহাগ কইরা কথা বলবো তখন দেখবা কেমন লাগবে। ”

তিথি হাসতে হাসতে বলল, ” কি যে বলো না। আমার জামাই জীবনেও সোহাগ কইরা কথা বলতে পারবে না। ওই ব্যাটা সেসব জানে নাকি? ”

রমলা চাচী বলল, ” বাচ্চা পেটে আসছে তারপরও এইসব কথা বলবা? ”

তিথি বলল, ” দেখো চাচী বাচ্চা পেটে আসার জন্য প্রেম ভালোবাসার দরকার পড়েনা বুঝলে। তুমি দেখো কত মানুষের সংসার হয়ে যাচ্ছে প্রেম ভালো বাসা ছাড়া। জগতের নিয়ম তাই সবাই সংসার করছে। একসাথে ঘুমাচ্ছে, বাচ্চা নিচ্ছে, তাদের মানুষ করছে। ভালোবাসা থাকে গুটিকয়েকটা দম্পতির মধ্যে। ওরাই আসল সুখী। বুঝলে?”

রমলা চাচী বলল, ” তুমি তোমার জামাইরে ভালাটালা বাসো না?”

তিথি ব্যঙ্গ করে বলল, ” পারিনা আজকেই ছেড়ে যাই। আবার বলো ভালোবাসা!
ভালো কাকে বাসা যায় জানো যে ওসবের মূল্য দেবে। তুমি কারো জন্য একটু রান্না করলে সে তোমার রান্নাটা খেল না। তোমাকে অবজ্ঞা করলো। তার প্রতি তোমার ভালোবাসা আসবে? তুমি কারো জন্য সাজলে সে তোমাকে দেখে বিশ্রীভাবে কটাক্ষ করলো। তোমার মধ্যে ভালোবাসা আসবে? তুমি কারো কপালে মলম লাগিয়ে দিলে যত্ন করে। তোমার হাতে পেঁয়াজের গন্ধ বলে সে তোমার দিকে ঘৃণাভরে তাকালো। তোমার তার প্রতি ভালোবাসা আসবে? ভালোবাসা কি অত ক্যালকুলেশন করে হয় বলো? আমি যতবার ভালোবাসতে গিয়েছি, ততবারই আঘাত পেয়ে ফিরে এসেছি। তাই ওসবের উপর আমার বিশ্বাস নেই। ”

রমলা চাচী বললো, ” অত কঠিন কথা বুঝিনা বাপু। বিয়া হলেই জামাই বউয়ের মধ্যে ভালোবাসা হইয়া যায়। তোমাদের হইলো না ক্যান? ”

তিথি হেসে বলল, ” আমাদের হবেও না। ”

” এইভাবে সংসার করবা? ”

” মোটেও না। সংসার কি জেলখানা যে বেরোতে পারব না? একটা সময় দেখবে ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে যাবো। তোমাদের বাবু ভাবে আমি বড়ই অসহায়। এসব অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য পেয়ে থেকে যাবো। কিন্তু তা হবে না বস। আমি হলাম মেহবুবা মাহনূর তিথি, মুখের কথায় না হলে মারপিট করে জিতি। ”

রমলা চাচী বলল, ” বাবু আইনের মানুষ। তুমি তার লগে মারপিট করবা? ”

তিথি হেসে বলল, ” আইনের মাইরে মাপঝোঁক আছে বুঝলে? কিন্তু আমার মাইর মাপঝোঁক ছাড়া। ”

রমলা চাচী এবার হাসলো। বলল,
” বিয়ার পর তুমি কিন্তু কথাও বলতানা। এখন কত কথা বলো। ”

তিথি বলল, ” শোনো মেয়েরা যখন মা হয় না! তখন তারা বর কেন পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করার ক্ষমতা রাখে। তাই হয়ত একটুআধটু গলাবাজি করি। ”

রমলা চাচী বলল, ” হ্যা তাই তো। কিন্তু তুমি তো বাচ্চাটারে মাইরা ফেলতে চাইছিলা। ”

তিথি আর জবাব দিল না। তার শেকড়ে ভয়। যদি শেকড় একবার গেড়ে যায় বহু গভীরে। এই অবজ্ঞা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান তাকে সারাজীবন সয়ে যেতে হবে । মেয়েরা চাইলেই সব পারে না। আবার সব পারলেও সব জায়গায় একটু না একটু ত্রুটি থেকেই যায়।

রাত আটটার দিকে আজলান বাড়ি ফিরলো। ইউনিফর্ম পাল্টে নিয়ে কোচের উপর শুয়ে আরাম করছিলো।

তিথি বড় কাতলা মাছ কেটে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে সবেমাত্র ঘরে প্রবেশ করেছে। আজলান কোচ থেকে উঠে নাক টেনে বললো, ” আঁশটে গন্ধ। এই মেহবুব মাছ কেটেছ?”

কোমরের ব্যাথায় তিথির সব বিরক্ত লাগছে। আজলানের এমন প্রশ্ন শুনে বললো,

” হ্যা তো? আঙুল দিয়ে মাছের নাড়িভুঁড়ি গু মুত সব বের করছি। তারপর সেগুলো দিয়ে কচলে কচলে ভাত খেয়ে আসছি। তোমার জন্যও রাখা আছে। ”

আজলান শেখের মুখের এমন অবস্থা হলো যেন বমি তার মুখের সামনে এসেই পড়েছে। গর্জে উঠে বলল,

” অ্যাই চুপ। একদম চুপ। ”

তিথি বলল, ” চুপ করবো না। এই মাছের গন্ধ নিয়ে তোমার সাথে মাখামাখি করবো আজ। ”

তিথি যেন তখনই তাকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিলো! সে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নীচে গিয়ে চেঁচামেচি জুড়ে দিল। তিথি পা টিপে টিপে নীচে যেতেই আতিফা বলল,

” ভাইয়া এসব পছন্দ করেনা জানো। তারপরও বলতে যাও কেন? ”

তিথি বলল, ” সেটা আমার আর উনার ব্যাপার। তুমি সেখানে নাক গলাচ্ছো কেন? ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, ” সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছে। তুই একটু শান্তিতে ওকে বসতেও দিলি না। ”

তিথি বললো, ” তোমার সামনেই তো সাবান দিয়ে ডলে ডলে হাত ধুলাম। তোমার ছেলে বলে আমার গায়ে নাকি আঁশটে গন্ধ! ”

আম্বিয়া বেগম আর কিছু বললেন না। আতিফা বলল,

” মাছ কাটার সাথে সাথে তোমাকে ভাইয়ার সামনে যেতে হবে কেন? ”

তিথি বলল, ” আমি আমার বরের কাছে কখন যাব সেটা তুমি বলে দেবে? ”

আয়জা বলল, ” আপু তুই কেন ভাবিকে বকছিস? ভাইয়ার দোষ আছে। এত খুঁত ধরলে আমার নিজেরও রাগ লাগবে। ”

আজলান বাড়িতে ঢুকে এল। কারো দিকে তাকালো না। চুপচাপ ঘরে চলে গেল।

তিথি যখন ঘরে গেল তখন আজলান সবেমাত্র গোসল শেষ করে বের হয়েছে। উদাম গায়ে ঘরময় পায়চারি করতে করতে মাথা মুছছে। গায়ে সাবানের খুশবু! তিথি নাক টানতে টানতে বলল,

” কি বিচ্ছিরি গন্ধ রে বাবা। এসব সাবানও মানুষ ব্যবহার করে আজকাল! ”

আজলান তার দিকে তাকালো। বললো,

” বস্তির লোকজন এই সোপ কখনো চোখেও দেখেনি ব্যবহার করা তো দূর। ”

তিথি ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো বাঁকা হেসে। সাবানটা দিয়ে ডলে ডলে মুখহাত ধুয়ে নিল। কামিজের ওড়নাটা বালতিতে ডুবিয়ে রেখে বেরিয়ে এল। আজলান নাক টেনে বলল,

” তুমি আমার সোপ ইউজ করেছ? ”

তিথি বলল, ” কই না তো। ”

আজলান এগিয়ে এসে তার হাত ধরে শুঁকে বললো,

” মিথ্যে বলছো কেন? ”

তিথি বলল, ” শুধু হাত দিয়ে ধরেছি। ”

আজলান তার কপালের কাছে শুঁকে বলল,

” মুখও ধুয়েছ। সাবানে আবারও চুল লাগিয়ে রাখোনি তো? ”

তিথি বলল, ” ওটা দিয়ে তো চুলও ধুয়েছি দুপুরে। ”

আজলান দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো। তিথি বিড়বিড়িয়ে বলল, ” ফাটাকেষ্ঠর পছন্দ আছে। আহা কি মিষ্টি গন্ধ! আচ্ছা এসব গন্ধ মেখে মেয়ে মানুষের সামনে হাঁটলে তো তারা পাগল হয়ে যাবে। জড়িয়ে ধরতে চাইবে। সে জড়িয়ে ধরে নাক টেনে বলল,

” বাপ্রে কি খুশবু! ”

আজলান চোখ নীচু করে তাকে দেখে বলল,

” এসব কি হচ্ছে? ছাড়ো। তুমি আমার গায়ে পড়ো কোন সাহসে? ”

তিথি বললো,

” চুপ চুপ আমার গায়ে তোমার ওই রাতের শয়তানটা এসে বসেছে। ”

” মানে? ”

” মানে আদর পেতে ইচ্ছে করছে। একটু করো না গো। ”

আজলান তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বলল,

” আমার মেজাজ খারাপ করে এসেছ আদর চাইতে? আর হোয়াট ইজ আদর? এসব ওয়ার্ড শুনতে কেমন লাগে? ”

তিথি বললো,

” ভালোই তো লাগে। ”

আজলান কপাল চেপে ধরে বললো, ” উফ। ”

তিথি বললো, ” আমাদের পাড়ার ওই রাতুল ভাই ছিল না? সেও তোমার মতো এরকম করতো। উফ যা লাগতো না তখন। ”

বলেই তিথি কপাল চেপে ধরে উফ বলে আজলানের মতো হাঁটতে লাগলো। আজলান বলল,

” সে শয়তানটা আবার কে? ”

তিথি ফিক করে হেসে উঠে বলল,

” চাইল্ডহুড লাভ। তোমার যেমন একটা পিংকি ছিল। আমারও তেমন একটা ডিংকি ছিলো। তাকে দেখলেই আমার দিলের ধারকান বাইড়া যেত। সেখানে শব্দ হতো ধুপধাপ ধুপধাপ। যেন ভেতরে ডিজে চলছে। আহ কি ফিলিংস মাইরি! কোথায় হারিয়ে গেল সেসব ফিলিংস। কপালে একটা ফাটাকেষ্ঠ জুটে গেল, আর আমার সেসব ফিলিংসের মাইরে বাপ হয়ে গেল। ”

বলতে না বলতেই বেসিনের কাছে ছুটে গিয়ে গলগল করে বমি করলো তিথি। পানির ঝাপটা মেরে ঢলে পড়তে পড়তে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো বহুকষ্টে। আজলানের দিকে চেয়ে বলল,

” তুমি যত্তগুলা চুমু খেয়েছ সব এখন বের হচ্ছে। আগেই বলেছিলাম আমার পেটে ভালো কিছু সহ্য হয় না। ”

আজলান তাকে ধরতে আসলে তিথি এক ঝটকায় দূরে ঠেলে দিয়ে বলল,

” আয়েম ওকে বস। ”

আজলান বলল,

” বমি-টমি করেছ। তাই একেবারে গোসল করে ফেলাটাই বেটার হবে। ”

তিথি ছুটে গিয়ে সোজা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। আজলান তাকে চিৎ করে শোয়াতেই টের পেল তিথি জ্ঞান হারিয়েছে।

জ্ঞান ফিরতেই তিথি দেখলো তার মুখের উপর একটা পুরুষ মানুষ লেবু পাতা কচলাচ্ছ। তিথি চোখ মেলামাত্রই দেখলো খুশবুওয়ালা। আহ কি খুশবু রে! আজলান তাকে চোখ খুলতে দেখে বলল,

” তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ। ”

তিথি তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ” ডাক্তার কিন্তু চুমু খেতে বারণ করেনি। দেখি জোরসে একটা চুমু দাও তো। এখন ফিলিংস এসেছে। ফিলিংসের বারোটা বেজে গেছে। তেরটা বাজলে সমস্যা। কুইক। ”

আজলান বলল, ” অসম্ভব। আগে ব্রাশ করো। ”

তিথি বলল, “একটা চুমুর জন্য ব্রাশ! লাগবে না চুমু।”

________

তিথি আজলানকে খুঁজতে খুঁজতে সুইমিংপুলের ধারে চলে এসেছে। আজলান ফোনালাপে ব্যস্ত। তিথির কোমর ব্যাথাটা বাড়ছে। কিসের উপর ভর করে হাঁটছে সে নিজেই জানে না। ফাটাকেষ্ঠকে বলা ছাড়া উপায় নেই। নইলে পরে দেখা যাবে অবস্থা কেরোসিন হয়ে গেছে। তখন আর রক্ষে নেই। সে হাঁটতে না পারলে ফাটাকেষ্ঠ তাকে নিজের মর্জিমাফিক ব্রাশ করাবে, আর গোসল করাবে।
সে গিয়ে বললো, ” একটা জরুরি কথা। ”

আজলান রাগত দৃষ্টিতে চেয়ে ইশারা করলো চুপ থাকতে। ভীষণ ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথা বলছে সে। তিথি তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

” ভীষণ জরুরি। আর সহ্য হচ্ছে না। ”

আজলান আঙুল তুলে ঠোঁটের কাছে রেখে চুপ থাকতে বললো। তিথি তার শার্ট টেনে ধরলো।

“একবার শোনো। রাতে আমার ঘুম হবে না। ”

আজলান তাকে চুপ করানোর জন্য মাথাটা টেনে চেপে ধরলো বুকে। যদি ইট পাথরের উপর চেপে ধরতো এতক্ষণে তার কপাল ফেটে রক্ত গড়াতো। এতটা জোরে চেপে ধরে মানুষ!
তারপর ফোনের ওপাশের জনকে একের পর এক কমান্ড দিয়ে গেল। থামার নয়। তিথি খুশবুতে মগ্ন হয়ে রইলো। তাই নড়াচড়া করেনি। ব্যাপারটা তার মন্দ লাগেনি।

শেষে, “ওকে ফাইন, গুড নাইট ” বলার পর ফোনটা পকেটে রাখতে দেরী। তিথি মুখ তুলে চেয়ে কিছু বলার আগেই আজলান জোরসে একটা চুমু খেয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল,

” আজব পাবলিক! কথা বলছি সেখানে এসে ডিস্টার্ব করছে। অসহ্য। ”

বলেই গটমট পায়ে হেঁটে চলে গেল।
তিথি হতচ্ছাড়ার মতো তার যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো। ঠোঁট মুছে বললো, ” ওমা চুমুতে কি কোমরের ব্যাথা যাবে? এই লোক! আরেহ আরেহ ব্রাশ তো করিনি। ”

চলমান…….

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_৪ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_৪
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

তিথির ঢেঁকুর বেড়েই চলেছে। আজলান গাড়ি থামিয়ে একটা পানির বোতল কিনে দিল। বলল,
” আর একটা কথাও বলবে না। ”
তিথি বোতলের ছিপি খুলে মুখ বসিয়ে চুকচুক করে পানি খেতে খেতে আজলানের দিকে তাকালো। আদেশ অনুযায়ী কোনো কথা বললো না। লোকটার কালো কুচকুচে দাঁড়ি গোঁফের ভীড়ে ঠোঁটদুটো যেন গভীর জঙ্গলের মাঝে হদিস না পাওয়া সেই গুহার মুখ। খুললেই যেন গপ করে একটা আস্ত মানুষ গিলে ফেলার ক্ষমতা রাখে।

মনের দুঃখে তিথি আপাতত কিছু বললো না। ঝগড়া করতে দুজন মানুষ লাগে। একজন মানুষ কতক্ষণ একা একা ঝগড়া চালিয়ে যেতে পারে? তারমধ্য তিথি আবার গর্ভবতী। তার এত শক্তি কোথায়? এদের পুরো শেখ গোষ্ঠীর কাজ হচ্ছে জুতো মেরে গরু দান করা। তাকে সেদিন অপমান করে বের করে দিল আর আজ আবার গরুর মতো টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। শ্বাশুড়িটাও সারাক্ষণ গালিগালাজ করে আবার বিপদে পড়ে গেলে মিঠামিঠা কথা বলে তাকে হাত করার চেষ্টা করে। সবকটা ভন্ড। তিথির দুঃখ হলো। একটা ভালো মানুষ, ভালো পরিবার তো সে চেয়েছে। এত বাড়ি-গাড়ি দিয়ে কি হবে? এসব কে কতবার সে ঠ্যাং দেখিয়েছে হিসেব নেই। এসব তো সে চায় না। একটা মিষ্টিমুখো বর চায়।

বাড়ি পৌঁছামাত্রই তিথি গাড়ি থেকে নেমে ডানেবামে উঁকিঝুঁকি দিল। বাড়ির দক্ষিণদিকের সুইমিংপুলে বাড়ির বাচ্চাকাচ্চাগুলো হৈচৈ করছে। আয়জাকেও উপস্থিত দেখলো সে। ওদের দেখাশোনা, গোসল করানো আর খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব আপাতত আয়জা নিয়েছে। সারাক্ষণ ওদের পেছনে লেগে থাকে।

বরটা ছাড়া বাকিদের তিথির অতটা খারাপ লাগে না। বকলে, কথা শোনালে অত গায়ে লাগেনা। কারণ দোষ তো তারও আছে। সে বিশ্বাস করে দোষেগুণে মানুষ। দোষ না থাকলে তাকে মানুষ বলে না, তাকে বলে রোবট।

তিথিকে দেখে বাচ্চাগুলো ইতোমধ্যে চেঁচিয়ে উঠেছে। তাদের সাথে মিশলেও গন্ডারটার সমস্যা। ওর কাছে ঘেঁষতে দেয় না বাচ্চাগুলোকে। যেন ওর আশপাশে থাকলে গায়ে গন্ধ লেগে যাবে। তিথির বড়ো অপমান লাগে সেসব।

আজলান বাচ্চাদের ডাকাডাকি চেঁচামেচি কানে না তুলে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। তিথি ব্যাথা পেয়ে বলল,

” আল্লাহ কেমন লোহার মতো হাত! আমার হাড্ডি-গুড্ডি ভেঙে গেল! ”

আজলান ঘরে এসে তাকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ” দ্রুত গোসল নাও। ”

তিথি বলল, ” আমার কাপড়চোপড়, ফোন সব বাড়িতে।”

আজলান কাকে যেন ফোন করলো। মফিজুর রহমান ফোন তোলামাত্রই বললেন,

” হ্যা বাবা ওকে এভাবে নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হলো? ”

আজলান বলল,

” অত ঠিকবেঠিক জানতে চাইনি। আপনার মেয়ের ব্যাগ ফোন আর যাবতীয় জিনিসপত্র যা আছে সব আমাদের ড্রাইভারকে দিয়ে দেবেন। সে কিছুক্ষণের মধ্যে যাবে। রাখুন। ”

মফিজ সাহেব বলে উঠলেন, ” ওর সাথে যদি একটু কথা বলতে পারতাম। মেয়েটা চলে গেল। মুখটাও দেখলাম না। ”

আজলান বিরক্তিকর গলায় বলল, ” অসহ্য। ”

বলেই তিথির দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিল। তিথি একটু দূরে চলে গেল। ফিসফিস করে বলল,

” হ্যা বাবা বলো। ”

মফিজ সাহেব গর্জন করে উঠলেন।

” সবাই এখানে বলাবলি করছে ওই গোলামের পুত নাকি তোকে টানতে টানতে গাড়িতে তুলেছে। ”

” হ্যা। ”

” শালাকে আমি দেখে নেব। ও পেয়েছেটা কি? আমার মেয়ে কি হাতের পুতল? ”

আজলান ভেস্ট খুলে রাখতে রাখতে ভুরু কুঁচকে তিথির দিকে তাকালো। তিথি তার দিকে কোণাচোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

” আচ্ছা আর গালাগালি দিওনা। আমার উপর ভরসা রাখো। আমি এদের সাইজ করে ছাড়বো।”

” তোর শ্বাশুড়ি মাতারি এক নম্বর জল্লাদ বুঝলি? ছেলের কান ভারী করে। আমাকে আজ তোর শ্বাশুড়ির এক আত্মীয় বললো, তোর জামাইরে নাকি তোর শ্বাশুড়ি আরেকটা বিয়ে করাবে বলেছে। কতবড় বজ্জাত দেখেছিস? ”

তিথি বলল, ” আমি সব জানি আব্বা। ”

” তোর পাশে ওই আহাম্মক আছে নাকি? ”

” হ্যা। ”

” ওহ তাই তুই এভাবে কথা বলছিস। শোন যদি তোকে আর একবারও ঘর থেকে বের করে দেয় এক্কেবারে ঠ্যাং দেখিয়ে চলে আসবি। আমার মেয়েকে বের করে দেবে!”

তিথি বিড়বিড়িয়ে বলল, ” ঠ্যাং দেখিয়েও লাভ হয়নি। এদের অপমান করলে তা গায়ে লাগে না। ”

আজলান এসে ফোন কেড়ে নিল। তিথিরকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে তোয়ালে আর শাড়িটা দিল। তিথি বলল,

” আমি তোমার ঘরে থাকবো না। ”

আজলান বলল,

” কোথায় থাকবে সেটা আমি ডিসাইড করব নট ইউ। ”

তিথি লম্বা জিহ্বাটা বের করে বলল,

” আমি ঠিক করব। ”

আজলান দরজাটা টেনে বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল। তিথি চেঁচিয়ে বলল,

” এই লোক, পেটিকোট ছাড়া শাড়ি পড়া যায় নাকি? ”

আজলান দরজা খুলে দিল। বলল,

” নিজে নাও। ”

তিথি তার ড্রয়ার খুলে পেটিকোট বের করলো। ওয়াশরুমে ঢুকে আবারও কি মনে করে বের হলো। আজলান মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেঝেটা ভিজিয়ে ফেলছে তিথি। সে চেঁচিয়ে বলল,

” এই মাথায় মগজ বলতে কিচ্ছু আছে? ”

তিথি ভড়কে গিয়ে কপাল কুঁচকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল, ” এমন করে ক্যা ব্যাটা? ”

বললো, ” ওমা ওমা কি করলাম আমি? ”

আজলান বলল, ” তুমি ভেজা পায়ে হাঁটছো। মেঝে ভিজে যাচ্ছে দেখছো না? আবার কেন বের হয়েছ? ”

তিথি বলল, ” ওগুলো নেয়ার জন্য। ”

আজলানের কপালে ভাঁজ পড়লো।

” কোনগুলো? ”

তিথির লজ্জাবনত মুখে বলল,

” ব্লাউজ আর ওটা…

আজলান বলল,

” তোমার যা যা লাগে সব একেবারে নিয়ে ওয়াশরুমে যাও। ”

তিথি জোরেজোরে ড্রয়ার খুলে কাপড়চোপড় খুঁজে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। গোসল সেড়ে বের হতেই দেখলো লোকটা উদাম গায়ে বসে টিভি দেখছে। কিন্তু চোখ হাতের ফোনের দিকে।
টিভিতে চোখ রাখামাত্রই তিথির চক্ষু ছানাবড়া। একটা নেংটী মেয়ে কি বাজে পোশাক পড়ে কোমড় দুলিয়ে দুলিয়ে নাচছে। তিথি রিমোট কেড়ে নিয়ে টুপ করে টিভি বন্ধ করে বলল,

” বউ নাই তাই এতদিন ওসব দেখছিলে নাকি তুমি? ”

আজলান ফোনে এতটাই ব্যস্ত যে চোখতুলে তাকালো না। কাজশেষে মাথা তুলে বলল,

” কি বললে? ”

চেহারাটা এখন হনুমানের মতো বানিয়ে ফেলেছে অথচ এতক্ষণ স্বাভাবিক ছিল। তিথি স্পষ্ট করে বলল,

” নেংটী মেয়েগুলোকে দেখতে তোমার ভালোলাগে। তাই না? ”

কথাগুলো একটু আওয়াজ করে বললো সে।
বলার পর স্তব্ধ হয়ে গেল আজলানের প্রতিক্রিয়া দেখে! কি এমন বললো যে এভাবে দাঁত কটমট করতে হবে! বিছানা থেকে নেমে টিশার্ট হাতে নিয়ে এমন ঝাড়া মারলো তার মুখের সামনে তিথির মনে হলো তার কলিজা ফুসফুস সব দুলে উঠলো যেন।

তারপর দাঁতের পেশনে নিজের ঝকোমকো দাঁতগুলোকে পিষতে পিষতে বেরিয়ে গেল লোকটা। তিথি দরজার কাছে গিয়ে বলল,

” সদা সত্য কথা বলিবে” এই কথা যে বলেছে তার সাথে রাগ দেখাও। আমি তো জাস্ট সেটা করে দেখিয়েছি। আজব! ”

_______

আম্বিয়া বেগম ঘরে এসে বললেন, ” এই বাড়িকে ঠ্যাং দেখিয়েছিস না? তাও আবার এলি যে? ”

তিথি হা হা করে হেসে বলল, ” তোমাদের লজ্জাশরম নেই। ঠ্যাং দেখানোর পরেও ঠ্যাং ধরে মাফ চেয়ে নিয়ে এলে কেন? বুঝো আমার দাম কত! ”

আম্বিয়া বেগম অপমানিত হয়ে চেয়ে রইলেন। এই মেয়ে কিসের তৈরি? বললো,

” আমি কি তোর শত্রু? আমি চাই তুই ওর সাথে ভালো করে সংসার কর। নাতিপুতিতে ভরে উঠুক আমার ঘরদুয়ার। এতবড় বাড়ি ঘর ওদের জন্যই তো বানিয়েছি। ”

তিথি শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে বললো,

” তোমার ওই রসকষহীন ছেলেকে আমার সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে বহুত নাচা নেচেছ সাসুমা। রসকষ নেই বলেই তো গরীব ঘরের মেয়ে এনেছ। নইলে তো মিস পার্ফেক্টিকে খুঁজে আনতে। ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, ” বেকুব মাথামোটা। ও ছোট থেকেই ওরকম গাদ্দার তাই ওর জন্য একটা সাদামাটা বউ খুঁজে এনেছি। যাতে মুখে মুখে তর্ক না করে, ওর মন যুগিয়ে চলে। তুই এমন বোম্বেমরিচ হবি কে জানতো? তোকে প্রথম দেখায় তো মন্দ লাগেনি রে। তুই একটু ওর মনের মতো হয়ে চলতে পারিস না?”

তিথি বলল, ” অনেক মন যুগিয়ে চলেছি। আমার ডিসিশন ফাইনাল। বাচ্চাটা তোমাকে ধরিয়ে দিয়ে আমি এই বাড়িকে ঠ্যাং দেখিয়ে চিরতরে চলে যাবো। ”

আম্বিয়া বেগম তিথির মাথাটা ঠেলে দিয়ে বললেন, ” তোর মতো খানকি মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখিনি।”

আজলান ঘরে আসতেই আম্বিয়া বেগম বেরিয়ে গেলেন। আজলান ফোনটা কানে চেপে ধরে তার সিক্রেট ড্রয়ারটাতে চাবি লাগালো। কথা বলতে বলতে দেখলো তিথি ব্লাউজটা শুধু টানছে। কোথায় একটা টান পড়ছে। অস্বস্তিতে তার চোখমুখ তেঁতো হয়ে আছে। আজলান ফোনে কথা বলা শেষে বলল,

” সমস্যা কি তোমার? ”

তিথির হাত থেকে তোয়ালেটা মেঝেতে পড়ে গেল। সে মেঝে থেকে ভেজা তোয়ালেটা নেয়ার সময় আজলান দেখলো ব্লাউজের উপরের বোতাম নীচেরটার সাথে লাগানো। এভাবে সব এলোমেলোভাবে লাগিয়েছে। আশ্চর্য হলো সে।

গালের ভেতর কথা রেখে একদৃষ্টে তিথির দিকে চেয়ে রইলো সে। তিথি তোয়ালেটা বালতিতে ছুঁড়ে মারলো। আজলানকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপালকুঁচকে বালতিটা হাতে নিল। আবারও ফিরে চাইলো। আজলানকে একইভাবে চেয়ে দেখতে দেখে বিড়বিড় করে বলল,

“মনে হয় রাতের শয়তানটা গায়ে এসে বসেছে।”

সে ঘর থেকে বের হবে এমন সময় আজলান তার বাহু খপ করে ধরে টেনে এনে বলল,

” গবেট কোথাকার। ব্লাউজের বোতাম উল্টাপাল্টা লাগিয়েছ। ঠিক করো। ”

তিথি শাড়ি আঁচল সরিয়ে বললো, “ওমা তাই তো। তোমার চোখ তো ডেঞ্জারাস।” বলেই বোতামগুলো ঠিকঠাক লাগাতে শুরু করলো। আজলান বলল,

” ওহ শিট। তোমার মধ্যে লজ্জা বলতে কিছু নেই? মানুষকে দেখিয়ে দেখিয়ে কেউ বোতাম ঠিক করে?”

তিথি বুঝলো না বরের সামনে ব্লাউজের বোতাম ঠিক করতে লজ্জার কি আছে? সে জিজ্ঞেস করলো, ” তোমার আছে? ”

আজলান বলল, ” মানে? ”

তিথি হেসে বলল, ” তোমার লজ্জাশরম থাকলে সেটাকে যত্ন করে রাখো। আমরটা তুমি কবেই চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছো। ”

আজলান বলল, ” জিভটাকে কন্ট্রোল করতে শেখো। নইলে…

আয়জা এসে বলল, ” ভাবি তোমার কাঁথাটা নিয়ে এসো শুধু। বাকিটা আমি ঠিকঠাক করে রেখেছি।”

আজলান বললো, ” কি হয়েছে? ”

আয়জা বলল, ” ভাবি বলছিলো আজ থেকে আমার সাথে থাকবে তাই বলতে এসেছি। ”

আজলান বলল, ” হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন? ”

তিথি বলল, ” ডাক্তার বলেছে। ”

” কি বলেছে? ”

তিথি বলল, ” ওটা তো আর করতে পারবে না। তাই আর কি। ”

আজলান গর্জে উঠে বলল, ” ওটা মানে কি? স্পষ্ট করে বলো ফাজিল। ”

তিথি ভড়কে গিয়ে বলে ফেললো, ” সহবাস আর কি। যেন বুঝে না কিছু। ডাক্তার বারণ করেছে। ”

পিনপতন নীরবতার একটা ফোয়ারা বয়ে গেল চারপাশে। আজলান স্তব্ধ, হতচকিত, অপমানিত! আয়জা লজ্জায় কোনোমতে পালিয়ে গেল।

তিথি বলল, ” ডাক্তার পইপই করে বলে দিয়েছে বর ডাকলে একদম কাছে যাবে না। বলবে, আমার কাছে বাচ্চা আগে। ”

আজলান পাথরের মূর্তির ন্যায় চেয়ে রইলো তার দিকে। তিথি খেয়াল করলো তার চোখদুটো পিটপিটও করছেনা। র‌্যাপিড একশন ব্যাটালিয়নের ডেপুটি ডিরেক্টর কোনো অস্ত্রযুদ্ধ ছাড়াই ভবলীলা সাঙ্গ করলো নাকি? পরে ভাবলো ধুরর ফাটাকেষ্ঠ চিল্লানি দিতে না পারলে এরকম পাথরের মতো শক্ত হয়ে চেয়ে থাকে। কিন্তু জিভ থেকে পাকস্থলী অব্দি সব গালাগালি ধমকাধমকি আর চিল্লাচিল্লির দিয়ে ভরা। তিথি বলল,

” আমি ডাক্তারকে কি বলেছি জানো? বলেছি, কাছে এলেই মারবো এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে।”

বলেই একা একা হেসে উঠে বেরিয়ে যাবে অমন সময় আজলান তাকে চেপে ধরে ঘরে ঢুকিয়ে ধপাস ধপাস শব্দে দরজা দুটো বন্ধ করে দিল। তিথি চিল্লিয়ে উঠে বলল, ” আমি সদা সত্যি কথা বলি। আজও তাই বলেছি। ”

চলমান……..

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_৩ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_৩
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

বিকেলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলো তিথি। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর পার হওয়ার সময় সে দেখলো কপোত-কপোতী পাশাপাশি বসে বাদাম আর ডালমুট খাচ্ছে, হাসছে, কথা বলছে। আহা কি সুখ তাদের মনে! কি সুন্দর জুটি! তার জীবনে এরকম কোনো মানুষ এল না কেন?

অথচ কলেজে উঠার পর সে কত স্বপ্ন দেখতো! সমবয়সী অথবা কলেজের সিনিয়র কেউ তার প্রেমে পড়বে। তাকে খুব সুন্দর নামে ডাকবে। হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটবে। ভীষণ ভীষণ ভালোবাসবে। একটু চোখের আড়াল হলে পাগলামি করবে। তাকে সুন্দর সুন্দর উপমা দেবে। বলবে, তোমার গায়ে রঙ যাইহোক না কেন তুমি আমার চোখে দেখা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী।

অথচ তার কপালে কি জুটলো! একটা আঠাশ-উনত্রিশ বছর বয়সের বুড়ো খেঁচড়।
না জানে প্রশংসা করতে, না জানে একটু মিষ্টি করে কথা বলতে, না জানে একটু সুন্দর নামে ডাকতে।

সেসব তো দূর কোনোদিন তাকে নিয়ে শপিংমলে যায়নি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি। এমনকি রেস্টুরেন্টে তার পাশাপাশি বসে খায়নি। কারণ সে পাশে দাঁড়ালে মানসম্মান কমে যাবে।

জীবনে যা যা চেয়েছিলো কিছুই পেল না সে। যা চায়নি তাই পেয়েছে। যেমন মানুষ দেখে তার ঘৃণা লাগতো তেমন মানুষ তার কপালে জুটেছে। একটু যত্ন-আত্তির ভালোবাসা যা সে চেয়েছে কিছুই পায়নি। চেয়েছে সিনেমার হিরোদের মতো কাউকে। কপালে একেবারে ফাটাকেষ্ঠ জুটে যাবে কে জানতো?

ডাক্তার দেখানোর জন্য ওয়েটিং রুমে বসেছিলো সে। কম্পাউন্ডার এসে বলল, ” ম্যাম এখন আপনি যেতে পারেন। ”
তিথি চেম্বারে ঢুকতেই দেখলো মহিলা ডাক্তারটি তাকে আগাগোড়া পরখ করছে। কেমন রাগী রাগী ভাব। সব কি ফাটাকেষ্ঠর বাপের বীজ নাকি? নইলে সবখানে এমন মানুষ জুটে কেন?

” এবোরশন কেস? ”

তিথি উপরনিচ মাথা নেড়ে বলল।

” জ্বি। ”

” নাম? ”

” মেহেবুবা মাহনূর তিথি। ”

” আপনার স্বামী কোথায়? ”

” মৃত। ”

” আপনাকে তো বিধবাদের মতো লাগছে না। ”

তিথির দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ডাক্তারনী। তিথি বলল,

” আমি বাচ্চাটা চাই না। আমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে। ”

” সেটা বাচ্চা নেয়ার সময় খেয়াল ছিল না? ”

তিথি ভড়কে গেল। বলল,

” বাচ্চা যে দিয়েছে তার দোষ। ওসবে আমার হাত নেই।”

ডাক্তার মহিলাটি বলল, ” আপনার হাসবেন্ড আজলান শেখ না? ”

তিথি চমকে উঠলো। চোখদুটো ঈষৎ বড়বড় করে বলল, ” আপনি কিভাবে জানেন? ”

” উনাকে কে না চেনে। দেখুন আপনার হাসবেন্ড একজন আইনের মানুষ। বাচ্চাটা তারও। আমি তাকে ছাড়া আপনাকে কোনো সল্যুশন দিতে পারবো না। আমাদের উপর চাপ আসবে। ”

তিথি বলল, ” টাকা তো আমার আব্বা দিবে। টাকা পেয়ে গেলে কাজ করতে সমস্যা কোথায় ডাক্তার?”

” ডাক্তাররা সব কাজ টাকার জন্য করে একথা আপনাকে কে বললো? আপনি এখন যান। ”

তিথি সরু চোখে চেয়ে বলল, ” এখানে কি আগে থেকেই আজলান শেখ এসেছিলো? তো আসুক সমস্যা কি? আমি অন্য ডাক্তারের কাছে যাব। এই শহরে কি ডাক্তারের অভাব আছে? ”

ডাক্তার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তিথি বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলল, ” ফিসটা তাহলে আজলান শেখের কাছ থেকে নিয়েন। ”

” গন্ডারের বাচ্চা গন্ডার তোর বংশবৃদ্ধি হতে দেব না আমি” এ বলে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে এল তিথি।

_____

বাড়ি ফেরার পথে অন্য একজন গাইনী বিশেষজ্ঞের খোঁজ নিয়ে এল তিথি। আজলান শেখের এসব ষড়যন্ত্র তাকে ঠেকাতে পারবে না। দরকার পড়লে সে গলায় দঁড়ি দিয়ে আজলান শেখের নামে চিঠি লিখে যাবে। মরেও শান্তি দেবেনা সে লোকটাকে। তাকে অসহায়, অবলা পেয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন করেছে শারীরিক মানসিকভাবে। লোকটাকে সে কিছুতেই ক্ষমা করবে না।

বাড়ি ফিরতেই মা হাসিমুখে দৌড়ে এসে বললো,
“হ্যা রে তিথি, শোন না। জামাই ফোন দিছে আমার ফোনে। বলছে তোরে পাঠাই দিতে। ”
ফোন দিয়েছে শুনে তিথি একটু খুশি হলো। কারণ আজলান শেখ এখন ভয় পাচ্ছে বাচ্চাটা হারিয়ে ফেলবে বলে। এমন ভয়ই তো দেখতে চেয়েছিলো তিথি।
” আর কি বলেছে? ”
” বললো গাড়ি যাবে, আপনাদের মেয়েকে বলুন তৈরি হয়ে থাকতে। গাড়ি গেলে যেন উঠে পড়ে। মেয়েকে একটু ভালো বুদ্ধিসুদ্ধি দিন। বাবা মা মিলে মেয়েকে উস্কে দিলে ঘর তো ভাঙবেই। ”

তিথি হা হা করে হেসে উঠে বলল,

” ফাটাকেষ্ঠ ভয় পায়ছে আম্মা বুঝলে? অনেক তো বাহাদুরি করলো। তুমি ফোন করে বলো আমি যাব না। কিছুতেই না। ”

মালেকা বেগমের মুখখানা চুপসে গেল। বলল,

” জামাই যদি আসে তাও যাবি না? ”

তিথি গালে হাত দিয়ে বলল,

” তওবা তওবা কি বলো আম্মা? আজলান শেখ জীবনেও আসবে আমাকে নিতে? তুমি কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতেছো? মাঝেমধ্যে এমন আউলাঝাউলা কথা বলো যে কচু গাছে ফাঁস খাইতে ইচ্ছে করে। ”

” তুই সত্যি সত্যি বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলবি তিথি? তোর মনে একটুও মায়াদয়া হচ্ছে না বাচ্চাটার জন্য? মায়ের মন এত পাষাণ হতে পারে না তিথি।”

মাকে ঝাড়ি মেরে চলে এলেও কথাটা তিথিকে ভাবালো। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবলো ওয়েটিং রুমে বসা ওই রোগীটার কথা। ওই মহিলার কিছুতেই বাচ্চা হচ্ছে না তাই কত কষ্টে আছে। তিথির ভীষণ কান্না পেল কিন্তু সে কাঁদলো না বাচ্চার খচ্চর বাপের কথা মনে পড়ায়।

মালেকা ফোনটা কানে ধরে ঘরে ঢুকে এসে বললো,

” এই তিথি নে তোর শ্বাশুড়ি ফোন করেছে। ”

তিথি মাথা তুলে চাইলো। বলল,

” কথা বলার মুড নেই। ”

মালেকা বেগম বললেন,

” হ্যা বেয়াইন দিচ্ছি। এ নে কথা বল। সালাম দে। ”

তিথি ফোনটা কানে লাগিয়ে বললো,

” হ্যা বলো। ”

মালেকা বেগম অবাক হয়ে বললেন,

” আদবকায়দা সব ভুলে গেছিস দেখছি। ”

” আহা কথা বলতে দাও তো আম্মা। ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, ” দেখ বউ তুই ভুলভাল ঔষধ টষুধ খাবি না কিন্তু। আল্লাহর কসম লাগে ওই বাচ্চার যদি কিছু হয় আমি নিজে বিষ খাবো। ওই বাচ্চাটা হোক। তারপর তোরা যা ইচ্ছে তাই করিস। ”

তিথি বলল, ” এসব তোমার কথা? নাকি তোমার ছেলের? ”

” আমার ছেলের কথা হবে কেন? ”

তিথি বলল, ” তোমার গুণধর ছেলে কোথায়? ”

আম্বিয়া বেগম পাশে তাকালেন। উনি ছেলের ঘরে বসে আছেন। আজলান এক পায়ের উপর অন্য পা লম্বা করে রেখে পিঠের নীচের বালিশে ঠেস দিয়ে বসে টিভিতে নিউজ দেখছে। কোলের উপরও একটা বালিশ।
মনোযোগ কোনদিকে আম্বিয়া বেগম বুঝে উঠতে পারলেন না। বললেন,

” ওর ঘরে বসে টিভি দেখছে। ”

তিথি বললো,

” শুনে খুশিতে মরে গেলাম। রাখো ফোন। ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, ” শোন না বউ। ও নিজেই বলছে তোকে চলে আসতে। বাচ্চাটা হোক। তারপর এই ডিভোর্স ডিভোর্স খেলিস মা আমার। বাচ্চাটারে নষ্ট করিস না। ”

তিথি বলল, ” ব্যাপারটা কি সাসুমা? ছেলের সামনে বসে এত ভালো কথা বলছেন। ছেলে সরলে তো খানকির বেটি ডাকতে দু’বার ভাববেন না। ”

আম্বিয়া বেগম থতমত খেয়ে বললেন, ” তুই একটা কথা বল । আসবি কি আসবি না? ”

তিথি বলল, ” যাব না মানে যাব না। ব্যস। আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে আবার বলছে ফিরে যেতে। কেন? আমাকে কি কিনে নিয়েছ মা ছেলে মিলে? ”

আম্বিয়া বেগম কিছু বলার আগেই আজলান বলল, ” মা ফোনটা দাও। ”

আম্বিয়া বেগম ফিসফিস করে বললেন, ” বকিস না বাবা। একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি আনতে পারিস কিনা দেখ। তারপর ওই বেটির কি হাল করি আমি দেখ। ”

আজলান ফোন কানে দিয়ে বলল,

” হ্যালো! শুনতে পাচ্ছ। ”

তিথি চুপ করে রইলো। মাকে খুঁজলো। মালেকা বেগম বাথরুমে গিয়েছেন। তিথি তেঁতোমুখে বলল, ” হাগার আর সময় পায়নি। ”

আজলান আরও কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বলতেই তিথি নাকিসুরে রোবট গলায় বলল,

” দুঃখীত ফোনের মালিক এখন হাগতে গেছে। অপেক্ষা করুন নইলে ফোন রাখুন। ”

তিথি কথাটা বলামাত্রই আজলান ঘর ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো,

” মেহবুব! ”

আম্বিয়া কেঁপে উঠলেন। বুক ধড়ফড় করে উঠলো উনার। বুকে হাত দিয়ে অগ্নিশর্মা ছেলের শক্ত মুখপানে চেয়ে বিড়বিড় করলেন,

” লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
খানকির বেটি আবার কি বলে বসলো কে জানে? কেন আমি ওই মেয়েরে বউ করে আনতে গেলাম খোদা?”

তিথি ফোনটা কেটে দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। জোরে জোরে হাসলো। মন থেকে হাসলো।
মনের দুঃখে রসিয়ে রসিয়ে গাইলো,

” দেখতে বর বর, কিন্তু আস্ত বর্বর
একটা জুটে গেছে কপালে
দেখতে handsome, কিন্তু ফেলুরাম
ফেঁসে গেছি আমি অকালে ”

আম্বিয়া বেগম ধীরেসুস্থে জিজ্ঞেস করলেন,

” কি হলো রে? কি বললো আবার? ”

আজলান ঘরের একোণা হতে ওকোণা অব্দি চোখ বুঁজে পায়চারি করতে লাগলো। তার মাথার রগ দপদপ করছে। আম্বিয়া বেগম বললেন,

” ও আজলান? কি হলো। বল না। ”

আজলান অনেকক্ষণ পর থামলো। রিমোট চেপে টিভি অফ করলো। ড্রয়ার থেকে চাবিটা হাতে নিল। বালিশের উপর থেকে ফোনটা হাতে নিল। আলনার উপর থেকে গ্রে স্যুট ভেস্টটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,

” আমি আসছি। ”

আম্বিয়া বেগম পিছু পিছু ছুটলেন।

“কোথায় যাচ্ছিস?ও আল্লাহ। কিছু তো বল বাবা।”

আজলান বলল, ” ওকে নিয়ে আসবো। ”

_____________

তিথির ভীষণ খিদে পেয়েছে। মাগরিবের পরপর ভীষণ খিদে পাচ্ছে ইদানীং। দুপুরের ভাত বেঁচে গেলে সে আছরের আজানের পর আবার খায়। আজকে খায়নি তাই খিদে আরও জোরসে বেড়েছে। তরকারির পাতিলের ঢাকনা উল্টে দেখলো চিংড়ি মাছের ঝোল আর তিনটে চিংড়ি রয়ে গেছে। সেই পাতিলে দুমুঠ ভাত মিশিয়ে মাখতে মাখতে দু-চার লোকমা পুরে দিয়েছে মুখে। তক্ষুণি কলিং বেল বেজে উঠলো। তুষার আর বাবা নেই বাড়িতে। মা নামাজ পড়ছে। তিথি ভাবলো, হয়ত তুষার আর বাবা কেউ এসেছে। তাই ভাত চিবোতে চিবোতে বাম হাতে টেনে দরজা খুললো।

দরজা খোলামাত্রই আজলানকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠতে দেরী। তার হাতটা শক্ত করে ধরে ” একদম চুপ ” বলে গাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যেতে আজলানের দেরী হয়নি। কোরবানির গরুকে যেমন টানে ঠিক সেভাবেই টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিলো।

তিথি বসে গেল আর না পারতে। আজলান চোখ নীচু করে তাকে দেখলো। তিথির ঠোঁটের একপাশে ভাত আর ঝোল লেগে আছে। ডান হাতে ভাতমাখা তো আছেই। দেখতে দেখতে বমি পেয়ে গেল তার।

তিথি এতক্ষণ কথা বলতে পারছিল না ভাত মুখে থাকায়। ভাতগুলো খাওয়া শেষে হাতে লেগে থাকা ঝোলঝাল খেতে খেতে বলল,

” আচ্ছা ভাতগুলো খেয়ে আসি? আমার হাতে মাখা ভাতগুলো এখন কে খাবে? ওগুলো ফেলে দিলে অপচয় হবে না? তুমি তো অপচয় করা পছন্দ করো না।”

আজলান দাঁতে দাঁত চেপে তাকে হ্যাঁচকা মেরে টেনে তুলে গড়িতে বসিয়ে জোরে গাড়ির দরজা বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল,

” কি দোষ করলাম জানিনা। এমন একটা বস্তি কি করে জুটলো কপালে! ”

সারারাস্তা ভর তিথি ঢেঁকুর তুলতে তুলতে এল। একটু পানি পর্যন্ত খেতে দেয়নি গন্ডারটা। এত অত্যাচার করে তাকে!

গন্ডারটা সন্ত্রাস দমনকারী চৌকস বাহিনীর সদস্য না হলে নারী নির্যাতন কেসে সে কবেই গরাদে ভরে দিত। তারপর বলতো,

” নে মদন, এবার টান জেলের ঘানি। তুই করবি সন্ত্রাস দমন? নিজেই তো আস্ত একটা সন্ত্রাস। ”

চলমান….

রিচেক করিনি শ্লা😾

এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_২ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_২
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

” আমার মুখের সামনে থেকে খাবার কেড়ে নিয়েছে ওই লোক। আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করলে সেটা মুখ ফুটে বলতে পারিনি। কিছু বলার আগেই চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় করে। মেঝেতে কখনো ঘুমিয়েছ আম্মা? আমি ঘুমিয়েছি। মুখে অনেক কিছু বলে ফেলা যায়। আমি কি তোমাদের সব কথা বলি? বলিনা। তাই তোমরাও পেয়ে বসো। আমি কি ইচ্ছে করে ওই বাড়ি থেকে চলে এসেছি?”

মালেকা বেগম বললেন, ” মুখ পাকাবি না। বিয়ে দিয়ে দিয়েছি যখন তখন ওখানে থাকতে হবে। এত তেজ কেন তোর? জামাই ওরকম বকতেই পারে। বেরও করে দিবে তাই বলে সোজা চলে আসবি? আর এখন ও যে তোকে ডিভোর্স দিবে বলছে! ডিভোর্সিদের এই সমাজ কোন চোখে দেখে সেটা জানিস? গায়ে রক্তমাংস কিছু আছে তোর যে বাচ্চাটা নষ্ট করবি? ওর অভিশাপে মরে যাবি। নিষ্পাপ প্রাণটা নিয়া খেলা শুরু করছোস সবাই মিলে। ”

” এখন তো সব আমার দোষ। সবাই এখন ধোঁয়া তুলসী পাতা। ওই লোকটাকে কিছু বলতে পারো না? ”

” নিজের মেয়ে আমাদের কথা শোনেনা, সেখানে পরের ছেলে কোন ছাঁই। ”

তিথি বলল, ” তুমি বলছো আমি ওখানে লাথি খেয়েও পড়ে থাকি? ”

” হ্যা থাকবি। তোর বাপের কি অট্টালিকা আছে যে জামাই কিছু বলতে না বলতেই ঠ্যাং দেখিয়ে চলে আসবি? কত্তবড় বেয়াদব তুই ওই বাড়িকে ঠ্যাং দেখিয়েছিস!”

তিথি বলল, ” আমার বমি পাচ্ছে। আমার সাথে চিল্লাচিল্লি করবে না আম্মা। আমি একদম বেরিয়ে যাব এই বাড়ি থেকে। কেউ খুঁজেও পাবে না। ”

” পারবি না কোথাও যাইতে। তুই এত সহজে কাউরে নিস্তার দিবি না। ”

তিথি চুপটি করে পড়ে রইলো বিছানায়। এবার শক্তি ফুরিয়েছে। আর কথা বলতে পারবে না। গলার উপরে কিছু একটা উঠে আসার চেষ্টা করছে। একদৌড়ে বেসিনের কাছে ছুটে গেল সে। গলগল করে বমি করতেই মালেকা বেগম ছুটে এসে পিঠে মালিশ করে দিতে দিতে তুষারকে ডাকলো,

” তোর আপার জন্য লেবুপাতা ছিঁড়ে নিয়ে আয় তো কয়েকটা। ”

তুষার লেবুপাতা এনে দিল। তিথি সেগুলো নাকের কাছে কচলে শুঁকতে শুঁকতে বলল,

” আম্মারে আমি বোধহয় মরেই যাবো। ”

মালেকা বেগমের চোখ টলমল করে উঠলো। মেয়েকে বুকে চেপে ধরে দোয়া পড়ে ফুঁ দিতে দিতে বলল,

” এমন অলক্ষুণে কথা বলিস না তো। মা হওয়া কি মুখের কথা? এজন্যই তোকে বলছি ওই বাড়িতে চলে যেতে। ভালোমন্দ খেতে তো পারবি। শুধু তিনবেলা ভাতপানি খেলে হয় না। ফলমূল খাওয়া লাগে। তোর বাপের এত হেডম আছে তোকে ফলমূল খাওয়ানোর? ”

তিথি বলল, ” না না আমি মরে গেলেও আর ওই বাড়িতে যাব না। আমাকে দু পয়সার দাম দেয় না। আমি এক পয়সারও দেব না। ”

তিথির বাবা মফিজুর রহমান মেয়ের জন্য ফুচকা নিয়ে এলেন আসার সময়। তিথি পইপই করে বলেছে ” বাবা ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে। বেশি করে আনিও। ”

মফিজ সাহেব তাই বেশি করে নিয়ে এলেন। তিথি বড় তৃপ্তি নিয়ে সেগুলো খেল। মনে পড়লো বিয়ের পরের দিনগুলোর কথা। বিয়ের মাত্র তিনদিন পার হয়েছে। বাড়িভর্তি মানুষ। আয়জা কোথাথেকে ফুচকা এনে দিল। বলল, ” ভাবি ভাবলাম তুমি খেতে পছন্দ করবে। তাই নিয়ে এলাম। ভাইয়া আসার আগে খেয়ে নাও। ”

তিথি তো মহাখুশি। প্লেট নিয়ে গপাগপ মুখে পুরছিলো একটার পর একটা। ঠিক তখনি কোথাথেকে লোকটা এসে চেঁচাতে চেঁচাতে তার হাত থেকে ফুচকার প্লেট কেড়ে নিল।
এমনকি অনেক কটুকথাও শুনিয়ে দিল। সে নাকি কোনোদিন খেতে পায়নি তাই খাবার দেখলে অমন করে এমন কথাও শুনতে হয়েছে তাকে। নীরবে চোখের জল ফেলেছিলো সে সেইদিন। নতুন বউকে কি করে মানুষ অমন কটুকথা বলতে পারে?

লোকটা যে এমন বেয়াদব গাদ্দার হবে তিথি সেটা বিয়ের দিনই বুঝতে পেরেছে। ভরা বিয়ের আসরে তাকে দেখে এমনভাবে নাকমুখ কুঁচকে ফেললো যেন তার সুন্দর টলটলে মুখটাতে গু লেগে আছে।

কেন মুখটা অমন করে ফেললো তিথি সেটা জানতে পারলো বিয়ে পড়ানো শেষে। যেন অধিকারবোধটুকু অর্জন করার জন্য এতক্ষণ চুপ করে ধৈর্য ধরে বসে ছিলো লোকটা।

তার ঘরে এসে মুখটাকে বাদুড়ের পাছার মতো বিকৃত করে সাফ সাফ বললো, ” এই মেয়ে মুখে এসব কি দিয়েছ? লাগছে কিরকম? এইসব সাদা বেসন তাড়াতাড়ি ধুয়েমুছে নাও। নইলে তোমার আর ওই বাড়িতে যাওয়া হবে না। সময় দশ মিনিট। ”

তিথিকে এমন অপমান জীবনে আর কেউ করেনি। শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময় সে অনেক কেঁদেছে। মা বাবা আর ভাইয়ের জন্য নয় তার সাজ ধুয়ে ফেলতে হয়েছিলো বলে। লাক্স সাবান দিয়ে ডলে ডলে মুখটা ধুয়েমুছে তাকে গাড়িতে তোলা হয়েছিলো। একটু ফেয়ার লাভলী পর্যন্ত মুখে মাখতে দেয়নি ওই দামড়া গন্ডারটা। তিথি এই দুঃখে অনেক রাত অব্ধি কেঁদেছে ফুলের বিছানার উপর বসে বসে।

তারপর লোকটা যখন ঘরে এল তখন সে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু লোকটা যে মহাবাদড় সে কথা তিথি তখনই জানতে পারলো যখন আদরটাদর করা শেষে তাকে বললো, ” খবরদার একদম লজ্জা পাওয়ার ভান করবে না। তুমি যে লজ্জাবতী নও সেটা আমি ভালো করেই জানি। ”

তিথি বলল, ” আমার আজ ঘুম পাচ্ছে খুব। ”

লোকটা যেন শুনলো না। তিথির অবশ্য একটা অপরিচিত লোকের চুমু খেতে মন্দ লাগেনি। আরও পেতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু দামড়া ব্যাটা মাঝপথে তাকে ছেড়ে দিয়ে ভসভস ভসভস করে ঘুমাতে লাগলো।

ভোররাতে তাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে গোসল করালো। ঘুম থেকে ডেকে তোলায় তিথি তখন মহাবিরক্ত। লোকটার গায়ে আঙুলের গুঁতো মেরে যখন বলল, ” আমি এত সকালে ঘুম থেকে উঠিনা।”
লোকটা আচমকা এমন রেগে গেল। ছিটকে দূরে সরে বলল, ” তোমার এত সাহস কি করে হয় আমার গায়ে হাত দেওয়ার? তুমি বেকুব সেটা জানতাম। এতটুকু ম্যানার্স জানো না সেটা তো জানতাম না। ফারদার এমন গায়ে হাত দিয়ে কথা বললে সোজা বাড়ি থেকে বের করে দেব। ”

তিথি স্তব্ধ। লোকটার হুমকিধামকি খেয়ে যখন সে কাঁদছিলো। শ্বাশুড়ি এসে বলল, ” আরেহ কাঁদিস না। একটু মানিয়ে নে। দেখবি তোকে অনেক ভালোবাসবে। আর গায়ে হাত দিয়ে কথা বলিস না। নিজে নিজে আগ বাড়িয়ে কাছে যাস না বুঝলি। ওর মতো করে চল। ”

তিথি তখন কথাগুলো চুপটি করে শুনলেও মনে মনে ঠিক করলো, ” কচু কচু। আমি কেন তার মনের মতো করে চলবো? আমার কিসের দায় পড়েছে? আমি কি অশিক্ষিত বকরি নাকি? আমি হলাম এন্ট্রান্স পাস মেয়ে। আমি গায়ে হাত দিতে না পারলে আমার গায়েও হাত দিতে আসুক। ”

আর ঝামেলাটা লাগলো সেখানে। শাড়ির আঁচলটা ঠিকঠাক করে দেয়ার বাহানায় তিথিকে ছুঁতে আসলে তিথি একলাফে দূরে সরে গিয়ে বলল,

” নারীপুরুষ সমান অধিকার। বুঝলে? পারমিশন নিয়ে তবেই গায়ে হাত দেবে। ”

লোকটা এমনভাবে গলা ফাটিয়ে ” অ্যাই চুপ ” বললো যেন সে সিনেমার ফাটাকেষ্ঠ! আর তিথি হচ্ছে রানুমন্ডল।

চলমান…