এবং_তুমি পর্ব ১২

0
947

গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ১২

বাবাকে ফোন করে হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো। তিনি ভীষণ চিন্তিত ছিলেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছিলো। আমি শান্ত কন্ঠে বললাম,

—বসো বাবা।

বাবা বসলেন। তিনি কৌতুহলী হয়ে ডাক্তারকে প্রশ্ন করলেন,

—কি হয়েছে?

আমি বললাম,

— বেশি কিছু না। তোমার মেয়ের জরায়ুতে টিউমার হয়েছে। তার বেশিদিন বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম।

বাবা মুহূর্তেই হতভম্ভ হয়ে গেলেন। হাত পা কাঁপতে লাগলো। তিনি নিশ্চই এই মুহূর্তে এমন সংবাদের আশা করেন নি। করার কথাও নয়। তার বড় বড় চোখ বলছিলো কতটা অবাক হয়েছিলেন তিনি। ডক্টর শিলা একজন নার্স ডেকে আমাকে বাহিরে বের করে দিলেন। আমি বললাম, আমি বাহিরে যাবো না, আমি একদম ঠিক আছি। কিন্তু তিনি শুনলেন না। আমাকে বাহিরে পাঠিয়ে বাবার সাথে কথা বললেন। কি বললেন জানি না। তবে ফিরে এসে দেখলাম বাবা কাঁদছেন। আওয়াজ করে কাঁদছেন। আমি যেয়ে উনার পাশের চেয়ারে বসলাম। শান্ত সুরে বললাম, — কান্নাকাটি করছো কেনো বাবা? তুমি জানো পুরুষরা কাঁদতে পারে না। কাঁদলে খুব বিশ্রি দেখায়। তুমি কাঁদবে না। ঠিক আছে? এখানে কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়ার মতো তো কিছু হয় নি। তাই না?
ডাক্তার শিলা আমাকে চুপ করিয়ে দিলেন।
উনার ভাষ্যমতে আমার মানসিক কন্ডিশন বিগড়ে গেছে। তাই আবোলতাবোল বকছি। আমি সেসব গা দিলাম না। বাবার সাথে বাড়ীতে চলে আসলাম। শশুড়বাড়ী গেলাম না। সেখানে যাওয়ার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছা ছিলো না। বাড়ী ফিরে এসে আমার ভীষণ শান্তি অনুভব হলো। বাবা ইতোমধ্যে দু গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়েছেন। তার অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বারবার হাটাচলা করে হিসাব মিলাচ্ছেন। তিনি খুব চিন্তিত। কী করবে তা ভেবে পাচ্ছেন না বোধ হয়।

—বাবা, এদিকে আসো। এখানে বসো তোমার সাথে কথা আছে।

বাবা বসলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি বসেও শান্তি পাচ্ছেন না।

আমি বললাম,
—তোমার ফোন কই? ফোন বের করো।

—কেনো?

—দরকার আছে। আমার শাশুড়িকে ফোন দাও। দিয়ে বলো তুমি আমাকে নিয়ে এসেছো। আর আগামী এক সপ্তাহ আমি এখানেই থাকবো।

— তোর শাশুড়ি মানবে তো? এভাবে হুটহাট না বলে। ওদের ওখান থেকে আনলে একরকম দেখাতো, কিন্তু…

— বাবা,কীভাবে ম্যানেজ করবে সেটা তোমার ব্যাপার। আমি শুধু বলেছি আমি এক সপ্তাহ তোমার এখানে থাকতে চাই। আরো একটা কথা আমার অসুখের ব্যাপারে একটা শব্দও তাদের জানাবে না। কখনো তো কিছু চাই নি। আজ চাইলাম। আর কখনো চাওয়ার সুযোগ হবে কি না জানি না।তুমি কি আমার এটুকু চাওয়া কি পূরন করবে?

বাবার চোখে পানি চলে আসলো। খুব শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। হু হু করে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। আমি আটকালাম না। পরম শান্তিতে উপভোগ করলাম। বাবা কখনো এভাবে আমার সামনে কাঁদে নি। আমার মনে হলো কাঁদা উচিতও নয়। তাদের অসহায় মুখখানা দেখলে নিজের ই কান্না পায়। কোনো বাবার ই উচিত নয় মেয়ের সামনে কাঁদা। তাদের উচিত আড়ালে কাঁন্না করা। আমি বাবাকে সরিয়ে বললাম,

—সরো তো। গরম লাগছে। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। শুনেছি মরার পূর্বে নাকি মানুষের খুব ঘুম পায়। এই দেখো আমারও পাচ্ছে। কি জানি সত্য না মিথ্যা।

বাবা অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখদুটো যেনো আমায় চেঁচিয়ে বলছে, ‘এসব কথা বলো না,আমার সহ্য হচ্ছে না।’ আমি আমার রুমে চলে আসলাম। বাবার সামনে যতক্ষণ থাকবো ততক্ষণ ই বাবা কাঁদবেন। যা আমি সহ্য করতে পারবো না। তাই চলে আসলাম। অবশ্য সত্যি সত্যি আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি কাঁথা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। বাবা নিশ্চই আমাকে রাখার ব্যবস্থা করে ফেলবেন। এ সাত দিনের মধ্যেই যা করার করে ফেলতে হবে। বাবার সাথে কথা বলা প্রয়োজন,তাকে বুঝাতে হবে। আমার চোখে নীবিড় ঘুম নেমে এলো। যেখানে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার…..

কেটে গেলো দুটি দিন।
গত দু রাতে আমার আরামের ঘুম হলো। ভীষণ আরামের। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেই আরামে আপনাআপনি চোখ বন্ধ হয়ে আসতো। ফ্লোরে শুয়ে শুয়ে শরীর ব্যাথা হয়ে গিয়েছিলো। একটা রাত আমাকে বিছানায় শুতে দেওয়া হয় নি। তাই এত ঘুম আসছে। আমার অবশ্য সেজন্য আফসোস হচ্ছে না, স্বাভাবিক ই লাগছে। যেজন্য আফসোস হচ্ছে তা হলো আমার সেদিনের পাগলামি। কেনো যেনো সেই দিনের কথা মনে পড়লেই নিজের উপর ভীষণ রাগ হয়। ভীষণ রাগ! বাবা সপ্তাহখানেকের জন্য আমাকে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। কীভাবে করেছেন তা জানা নেই। অবশ্য এ দুদিনে ইশান বাদে প্রত্যেকটা লোক ফোন করে আমার খোঁজ নিয়েছেন। মেঝ ভাবী সেদিন বললো,
—তুমি এটা ঠিক করো নি প্রভাতি। মা এত কষ্ট করে তোমাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে কাজে পাঠিয়েছিলো আর তুমি সেখানে না যেয়ে বাবার বাড়ী চলে গেলো। মা কে বললে কি তিনি দিতেন না? তুমি জানো তিনি কত কষ্ট পেয়েছেন। তোমার বাবা যখন ফোন কেটে দিলো তখন তো তার চোখ ছলছল হয়ে উঠেছিলো। আমাকে বললো,’ আমি কি খুব খারাপ শাশুড়ি? তোমরা সবাই কেনো আমাকে মানতে পারো না? কেনো আমার সম্বন্ধে এত সস্তা মানসিকতা রাখো?’ তিনি খুব কষ্ট পেয়েছেন। খুব কষ্ট।বুঝলে?

আমি চুপ রইলাম। জবাব দেয় নি। আমার নিজেরও খারাপ লাগছিলো। কিন্তু বলার কিছু ছিলো না। তাই বলি নি। এ লোকগুলো এত ভালো কেনো? কেনো এত ভালো? তারা জানে না ভালো মানুষের সময় আমার জীবনে কম সময় থাকে। আমি কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে মাথা ব্যাথা উঠে গেলো। এ বদ অভ্যাস আবার আমার ছিলো না। কিন্তু কবে থেকে যে হলো বুঝতেই পারলাম না। প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় ঘুম চলে এসেছিলো। আমি গভীর ঘুমে পড়ে রইলাম। গভীর ঘুম!

সকালে ঘুম থেকে উঠতেই চমকে গেলাম। আমার বিছানার পাশেই চেয়ার টেনে বসে আছেন ইশান। উষ্কখুষ্ক চুল, এলোমেলো পোশাক। রক্তিম চোখ। বোধহয় রাতে জেগে ছিলেন। তাই হয়তো চোখ দুটো এত লাল হয়ে আছে। রোবটের মতো বসে থাকতে দেখে ভাবলাম এটা নিশ্চই আমার ভ্রম। কিন্তু নাহ, ভ্রম নয়। তিনি সত্যি এসেছেন।

হুট করে আমার হাত ধরে বললেন, —চলো..

আমি বিস্ফোরিত কন্ঠে বললাম,

–কই?

ইশান জবাব দিলেন না। আমি আবারে বললাম,

—আপনি এই সাজ সকালে আমাদের বাড়ীতে কি করছেন?

ইশান আমাকে টানতে টানতে বললো,

— আমি আমার শশুড়বাড়ী এসেছি।

—এত সকাল সকাল কোন জামাই শশুড়বাড়ী আসে?

—আমি আসি। হয়েছে। এবার চলো।

আমি হাত টা ছাড়িয়ে বললাম,
— আমি যাবো না। আপনি চলে যান।

ইশান শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। সে বললো,

—আমি কি জানতে পারি কেনো যাবে না?

আমি নিরব রইলাম। এ মুহূর্তে আমার মাথা একদম ফাঁকা। শুধু কোনো বাক্য নয়,শব্দও আসছে না। আমার মাথায় চলছে অন্য চিন্তা। যার কারণে আমার হাত পা ও কাঁপছিলো।

#চলবে..

® সোনালী আহমেদ

[ রিচেক করি নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here