এবং_তুমি পর্ব ১৬-১৭

0
901

গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ১৬+১৭

উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপছিলো। খেয়াল করেছিলাম, ফোনটিও ঠিকঠাক ধরতে পারছি না। বারবার কান থেকে সরে যাচ্ছে। ফোনের ওপাশ থেকে ততক্ষণে টুট টুট শব্দ ভেসে আসছিলো। অর্থাৎ শাশুড়িমা ফোন কেটে দিয়েছেন। নিশ্চই আমার কথাটা শুনেন নি। বিষণ্ণ মনে আমি আবারো ফোন দিলাম। কিন্তু ধরলো না। পর পর দুবার দিতেই ফোন বন্ধ শুনালো। ইংরেজী কন্ঠে ভেসে আসছিলো, -‘The number you have call is currently switched off.’ আমার নিঃশ্বাস আটকে গেলো। মনে হচ্ছিলো কেউ বোধহয় আমার গলা চেপে ধরে রেখেছে। দমবন্ধ-শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। আমার ভেতর কি যে ভয়ংকর ঝড় বইছিলো তা বলে বুঝাতে পারবো না। পাগলের ন্যায় পরিবারের বাকি সদস্যদের ফোনে কল দিলাম। কিন্তু কেউ ধরলো না। সারা রাত আমার চোখে ঘুম লাগলো না। অল্প পানির মাছের মতো ছটফট করছিলাম।

সকাল না হতেই আমি ছোট হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এলোমেলো, বিচ্ছিরি পোশাকে। বাবা তখন ঘুমে। একবার ভাবলাম ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলে যাই। পরক্ষণে বাদ দিয়ে দিলাম। দরজা টা ভিড়িয়ে বেরিয়ে আসলাম। আমার শশুড়বাড়ীতে পৌঁছাতেই দেখলাম গেইট তালাবদ্ধ। কিন্তু কেনো? সবাই কই গেলো? আমার বুক দ্বিতীয়বারের মতো কেঁপে উঠলো। আশেপাশে কোনো লোকজন দেখতে পেলাম না। মোবাইলে তখন সাত টা বত্রিশ বাজে। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। কি করবো?কই যাবো? বুঝতে পারছিলাম না। কেনো যেনো কান্না পেলো। ভীষণ কান্না। টলমল চোখে একটু পথ পাড়ি দিতেই আশার আলো দেখতে পেলাম। অন্ধকারে এক চিলতে আলো। সেই আলো হলেন ইদ্রীস চাচা। তিনি পাশের বাসায় থাকেন। আমার শশুড়ের সাথে গলায় গলায় খাতির।
আমাকে দেখেই তিনি অবাক হয়ে বললেন,

—তুমি এখানে? তুমি ওদের সাথে যাও নি?

আমি লম্বা শ্বাস নিলাম। নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করছিলাম। কারণ আমার ভাবভঙ্গি দেখে যে কেউ স্পষ্ট বুঝবে আমি এখন কতটা পেরেশানিতে রয়েছি। হালকা হেসে বললাম,

— কোথায় যাবার কথা ছিলো? আসলে,আমি আমার বাবার বাড়ীতে ছিলাম তো,তাই আর কি…..

ইদ্রীস চাচা বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তিনি বোধহয় আশ্চর্য হয়েছেন। হবার ই কথা। বাড়ীর বউ অন্যের কাছ থেকে যদি এমন প্রশ্ন করে তাহলে তো যে কেউ ই হবে। তিনি আশ্চর্য হয়েছেন দেখে আমার ভেতরে কোনোরুপ পরিবর্তন আসলো না। আমি কন্টিনিউয়াসলি উনাকে প্রশ্ন করে গেলাম,’ তারা কই গিয়েছেন?’

ইদ্রীস চাচা আমার কথাটা বোধহয় কর্ণপাত করলেন না। উল্টো তিনি আগ্রহী কন্ঠে বললেন,

—তোমাদের কি মনমালিন্য চলছে? ইশান কি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে?

—চাচা এসব পরে বলবো, আমাকে প্রথমে বলুন উনারা সবাই কই গিয়েছেন? প্লিজ, আমার জন্য খুব জরুরী।

ইদ্রীস চাচা মনে পড়া ভঙ্গিতে বললেন,

—-ওহ,হ্যা। তুমি বোধহয় জানো না, প্রতি ২৬ এপ্রিল ওরা সবাই ওদের দেশের বাড়ী কুমিল্লায় যায়। ইশানের দাদার মৃত্যু বার্ষীকি পালন করতে। খুব আয়োজন করে লোকজন খাওয়ায়। আমি গত নয় বছরে কোনোবার ই ওদের না যেতে দেখি নি। মরে পিঠে হলেও ওরা যায়। আমি ভাবলাম এ বছর বোধহয় তুমি যাবে কিন্তু…

— সবাই গিয়েছেন? উনি মানে ইশান স্যার ও গিয়েছেন?

—কি বলো ইশান যাবে না কেনো? প্রত্যেকবার তো ইশান সবার আগেই যায়। কিন্তু আজ আমি ওদের যেতে দেখি নি। বুঝলে, আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়েছিলো। তোমার চাচীর জন্যই উঠতে পারলাম না। শেষরাতে তার নাকি কোমরে ব্যাথা দেখা দিয়েছে। ঘুমটাও ঠিকমতো হয়নি।তাই ওদের যাওয়ার সময় দেখতে পাই নি।

—স্যার এবার বোধ হয় যান নি। কারণ শাশুড়ি মা গতকাল বলেছিলেন ইশান নাকি বাড়ী ফিরেন নি।

ইদ্রীস চাচা ভ্রু কুচকে বললেন,

—তুমি কি কিছু বললে?

—না,না। কিছু বলি নি। ধন্যবাদ! আপনাকে অসংখ্যা ধন্যবাদ।

কথাটা বলে দাড়ালাম না। দ্রুত হেটে সেখান থেকে চলে আসলাম। আমার গাট ফিলিংস বলছে ইশান স্যার যান নি। তিনি নিশ্চই এখন অফিসে রয়েছেন। রাত টা ও বোধহয় সেখানে কাটিয়েছিলেন। ইদ্রীস চাচা মিথ্যা বলেন নি। সত্যি সত্যি আমার শশুড় বাড়ীর লোকজন দেশের বাড়ীতে গিয়েছেন। উনারা প্রতিবছর এই দিনে যান। আমিই অতিরিক্ত টেনশনে ভুলে গিয়েছিলাম। সকালের থেকেও দ্বিগুণ উত্তেজনা নিয়ে অফিসে চলে আসলাম। পাক্কা আড়াই ঘন্টা লেগেছে। অথচ অন্যসময় দুই ঘন্টাও লাগে না। মানুষ ঠিক ই বলে,বিপদের সময় এগোয় না। এই যে দেখো আজ আমার সময়ও কেমন ধীরে চলছে।

অফিসের চারপাশের ছোট্ট জায়গা জুড়ে শত মানুষের ভীড়। এত এত মানুষ দেখে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। সবাই এখানে কি করছে? দ্রুত পায়ে হেটে অফিসের ভেতর প্রবেশ করলাম। প্রথম যে দৃশ্য চোখে পড়লো তা হলো, নাফিয়া আপা, মাধবি আপাকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। মাধবি আপা এখানে?কিন্তু কেনো? তারপরেই জোরপূর্বক ইশান স্যারকে খাওয়ালেন।স্যার খেতে চাইছেন না বারংবার বারণ করছেন। কিন্তু নাফিয়া আপা কিসব বলে খাওয়াচ্ছেন। নাফিয়া আপা এখানে কাজ করেন। ডিজাইনিং এর বিষয়ে অত্যন্ত তুখোড় তিনি। আমাদের সকল প্রজেক্টের ডিজাইনিং তিনিই করেন। খুব ভালো একজন মানুষ। মুহূর্তের মধ্যেই আমার ধারনা হয়ে গেলো এখানে কি চলছে। সেই মুহূর্তে দুনিয়া টা অন্ধকার,কুৎসিত কালো রঙের দেখলাম। মনে হচ্ছিলো কেউ আমার কলিজায় খামছে ধরেছে। আমার নিঃশ্বাস যেনো পুরোপুরি আটকে গেলো। কিন্তু আমি সেদিনের মতো উল্টো বেরিয়ে গেলাম না। মনে অদম্য সাহস নিয়ে আওয়াজ তুলে পা ফেলে ভেতরে যাচ্ছিলাম। মুহূর্তেই সবার নজর আমার দিকে চলে আসলো। ইশান, আমার দিকে হতভম্ভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। যেনো এই মুহূর্তে উনার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি এখানে এসেছি। হালকা হেসে টেবিলের কাছে দাড়ালাম আমি। আনন্দিত কন্ঠে বললাম,

—কংগ্রেচুলেশন আপা,কংগ্রেচুলেশন স্যার।

আপা ভীষণ আনন্দিত হলেন। কান্নামাখা গলায় আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

— ওরা আমাকে শেষ করে দিয়েছে রে। একদম শেষ করে ফেলেছে।

আমি বললাম,

—তো কি হয়েছে? এখন তো আবার তোমার সব ফিরে পেতে যাচ্ছো।

আপা ব্যাথাতুর কন্ঠে বললো,
—যা চলে যায় তা ফিরে পাওয়া যায় না, রে বোন। মেয়েদের ইজ্জত এমনই জিনিস। আমার সাথেই কেনো এমন হয় বলতো?

কথাটা বলেই আপা কেঁদে দিলেন। আপার কথার সঠিক অর্থ বুঝতে পারলাম না। তবে ধারনা করলাম রিয়াজ ভাইয়ের সত্যি বোধহয় বের হয়ে এসেছে তাই দুঃখ পাচ্ছেন।

আমি বললাম,

— আপা তুমি একদম কেঁদো না। স্যারের সাথে আমার কিন্তু কোনোরকম সম্পর্ক ছিলো না। আমাকে তিনি ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেন নি। উনি তোমাকে এখনোও ভালোবাসে। তোমার অপেক্ষায় এতদিন কাটিয়ে ছিলেন।আগে যা হয়েছে ভুলে যাও। আবার নাহয় নতুন করে সব শুরু করবে।

আপা তৎক্ষণাৎ আমাকে ছেড়ে দিলেন। কান্না থামিয়ে অবাক কন্ঠে বললেন,

—কি বলছিস তুই? কিসের সম্পর্ক, কিসের ভালোবাসা?

—সত্যি বলছি আপা। এমনকি আমরা এক বিছানায় পর্যন্ত ঘুমায় নি। তিনি আমাকে মেনে নেন নি তো। যদিও তুমি এসব জানো,তবুও তোমার বিশ্বাসের ওন্য আরেকবার বলছি।
উনি কিন্তু এতদিন তোমার অপেক্ষায় ছিলেন।

মাধবি আপার চোখ ততক্ষণে আরো গোল হয়ে গিয়েছে। ইশান স্যার তো সাথে সাথেই দাড়িয়ে পড়লেন। সবাই অবাক নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। যা আমার নিকট অস্বাভাবিক লাগলো,খুবই অস্বাভাবিক। আমি আপার হাত ধরে বললাম,

— তুমি এভাবে দেখছো কেনো? বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি সত্যিই বলছি। আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। থাকবেই বা কেনো তিনি তো তোমাকে ভালোবাসতেন। শুনো, শীঘ্রই আমি ডিবোর্স দিয়ে তোমার সংসার তোমাকে পুনরায় ফিরিয়ে দিচ্ছি। এবার কিন্তু আর কেঁদো না। ঠিক আছে? আর সত্যিই আমাদের মধ্যে কিছুই ছিলো না। উনি আমাকে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেন নি।

মাধবি আপার কাশি উঠে গেলো।চোখভর্তি জল নিয়ে বললেন,— এসব কি বলছিস তুই? তোর মাথা ঠিক আছে তো? কি ডিবোর্স? কি ফিরিয়ে দিবি?

আপার রিয়েকশনে আমি অবাক হলাম। ভীষণ অবাক। মুখ দিয়ে আ বের করতেই, ইশান গর্জন করে বললেন,

—শাট আপ! মুখ বন্ধ করো। দ্বিতীয়বার উল্টাপাল্টা শব্দ বের করলে ঠোঁট সিলি করে দিবো।

ইশান স্যার হুট করেই রেগে গেলেন। সবাইকে শান্ত স্বরে বেরিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু কারো নড়চড় দেখা দিলো না। এবার তিনি অসম্ভব জোরে ধমক দিয়ে সবাইকে বের করে দিলেন।আমি সহ উপস্থিত সবাই কেঁপে উঠেছিলাম। ইশান দরজা আটকে দিলেন। গটগট আওয়াজ তুলে আমার সামনে খবরের কাগজ টা বারি দিয়ে রাখলেন।

—পড়ো এটা…

আমি থরথর করে কাঁপছিলাম। ইশান আরো জোরে আওয়াজ করে বললেন,

—কি হলো? হাতে নাও বলছি..

আমি কাঁপা কাঁপা হাতে এগিয়ে নিলাম। প্রথমেই দেখলাম পত্রিকার প্রথম পেইজে গোটা গোটা বড় অক্ষরে লেখা,

” রিয়াজ রাজ চৌধুরী এবং রিপন রাজ চৌধুরীর গোপন কুকীর্তি ফাঁস। তথ্যসূত্রে জানা গিয়েছে, জনাব রিয়াজ নিজের মামাতো বোন মাধবি নামের মেয়েকে জোরপূ্র্বক ধর্ষণ করেছেন। এ ঘটনায় তার বাবাও শামিল ছিলেন। বিস্তারিত, ৪ পৃষ্টা কলাম ৫।”

#চলবে….

®সোনালী আহমেদ

[রিচেক করি নি। এক্সট্রা পর্ব চান? গঠনমূলক মন্তব্য করলে কিন্তু আগামিকাল বোনাস পর্ব দিতে পারি।]

গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ১৭

” রিয়াজ রাজ চৌধুরী এবং রিপন রাজ চৌধুরীর গোপন কুকীর্তি ফাঁস। তথ্যসূত্রে জানা গিয়েছে, জনাব রিয়াজ নিজের মামাতো বোন মাধবি নামের মেয়েকে জোরপূ্র্বক ধর্ষণ করেছেন। এ ঘটনায় তার বাবাও শামিল ছিলেন। বিস্তারিত, ৪ পৃষ্টা কলাম ৫।”

পৃষ্ঠা-৪

|কলাম ৫|

মিস মাধবি, একজন সাধারণ নারী। ছোট বয়সে উনার মা চলে যান। এরপর থেকে ছোট বোনকে নিয়ে বাবার সাথেই তার বসবাস। স্কুল-কলেজের ছুটির দিনে তিনি প্রায়ই ফুফুর বাড়ীতে যেতেন। এমনই এক ছুটির দিনে তিনি যখন গেলেন, তখন তার ফুফা-ফুফু বাড়ীতে ছিলেন না। ছিলো শুধু বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রিপন রাজ চৌধুরীর ছেলে রিয়াজ রাজ চৌধুরী। অর্থাৎ উনার ফুফাতো ভাই। এ বিষয়ের পুরো ফায়দা লুটে নেন মিস্টার রিয়াজ। তিনি জঘন্য ফন্দি এঁটে মিস মাধবির বস্ত্রবিহীন ভিডিও ধারন করেন। এবং এ ভিডিও’র হুমকি দিয়ে তার সাথে শারিরীক সম্পর্কে পর্যন্ত লিপ্ত হোন। মিস মাধবি এ বিষয়ে কাউকে জানাতে পারেন নি ভিডিও ফাঁশ হবার ভয়ে। সেই ঘটনার পর টানা কয়েক বছর তাকে এভাবেই শাসিয়ে রাখা হয়েছিলো। একদিন রিয়াজের মা অর্থাৎ মিস মাধবির ফুফুকে এ বিষয়ে মিস মাধবি জানিয়েয়ে দিয়েছিলেন। অতি মাত্রায় ডিপ্রেশনে এসে তিনি হাল ছেড়েই কথাটি জানাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তখন এ বিষয়টি রিপন রাজ চৌধুরীর কর্ণগোচর হয়। তিনি এ বিষয় শোনার পর-মুহূর্তেই মিস মাধবিকে হুমকি-ধমকি দিয়ে চুপ করিয়ে রাখেন। এমনকি তার ফুফুকে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দেন। ফলে আবারো চুপ হয়ে যান মিস মাধবি।
মিস মাধবির সাথে সেই সময় চুক্তি হয় যে, তিনি এ বিষয়ে যাতে কাউকে না জানান।তাহলে তার ভিডিও ডিলেট করা হবে এবং ফুফুর সংসার বেঁচে যাবে। কিন্তু এমন টা হয় নি। মিস মাধবির বিয়ের দিন পুনরায় মিস্টার রিয়াজ তাকে ব্ল্যাকমেইল করলেন। এবং ভিডিওর কথা বলে তাকে আবারো তাদের কাছে নিয়ে যান। বাধ্য হয়েই বিয়ের আসর ছেড়ে পালাতে হয় তাকে। এমন কয়েকদিন কেটে যাবার পরপরই মিস মাধবি তার না হওয়া স্বামী অর্থাৎ ছোট বোনের স্বামীর সাহায্য নিয়ে আজ ২৬ শে এপ্রিল তিনি মুক্ত হোন। এবং পর্যাপ্ত প্রমানের মাধ্যমে রিয়াজ রাজ চৌধুরী এবং রিপন রাজ চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছেন। এ ঘটনার ম……

আর পড়তে পারলাম না। হাত থেকে পত্রিকা টা পড়ে গেলো। আপার সাথে এতকিছু হয়ে গিয়েছে আর আমি এসবের কিছুই জানি না। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আপার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ততক্ষণে আপার চোখ দিয়ে তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। আওয়াজ তুলে কাঁদছেন। জীর্ণ, রোগা পাতলা শরীর। যেনো আপার সাথে ঘটিত তুমুল অত্যাচারের জলজ্যান্ত প্রতিচ্ছবি। আমার শরীর কাঁপতে লাগলো। ঠিকঠাক দাড়াতে পারছিলাম না। কান্নাভেজা কন্ঠে বললাম,

—এসব সত্যি আপা?

আপা মাথা নাড়লেন। সাথে সাথেই কেঁদে দিলাম। একদম বাচ্চাদের মতো। আপাকে জড়িয়ে ধরতেই যেনো কান্নার গতি হুরহুর করে তীব্র হয়ে উঠলো। হৃদপিন্ড বিষাক্ত সাপের ছোবলের ন্যায় ব্যাথা হচ্ছিলো। কাঁদতে কাঁদতে আমার হেচকি উঠে গেলো। নাক টেনে বললাম,

—-তুমি আমাকে বলো নি কেনো আপা? ওই কুকুর টা তোমার সাথে এত দিন থেকে এত কিছু করে আসছে আর তুমি আমাকে একটা কথাও বলো নি। তুমি খুব খারাপ,আপা! খুব খারাপ। আই হেইট ইউ।

আপা কাঁদছেন। আমি আবারো বললাম,

—এমন তো কথা ছিলো না আপা। মা চলে যাবার পর থেকে কিন্তু আমরা সব শেয়ার করতাম। তুমি হুট করে বদলে যাবার পরেও আমি তোমাকে সব বলতাম। অথচ তুমি আমাকে বলতে পারলে না। আমি কত কাঁদতাম যে আপা তুমি কেনো বদলে গেছো? কেনো একা একা থাকো, তুমি কিছুই বলতে না। উল্টো আমাকে বকা দিয়ে বের করে দিতে। তুমি তো জানতে আমি একা ঘুমুতে পারতাম না। তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে আমার ঘুম হতো না। অথচ তুমি কি করলে, আমাকে আলাদা বিছানা দিয়ে দিলে। সারা রাত জেগে কেঁদেও তোমার মন গলাতে পারি নি। জানো,আমি সারাক্ষণ ভাবতাম, কি এমন ভুল করেছি যে আপা এমন বদলে গেছে,কেনো আমার থেকে দূরে থাকছে। সবসময় নিজেকে দোষারোপ করে কষ্ট পেতাম। অথচ আমি জানতাম ই না তখন আমার থেকে দ্বিগুন কষ্ট তোমার হচ্ছিলো। আমাকে কেনো বললে না আপা।

আপা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

—কীভাবে বলতাম? আমার নিজের ই যে ঘেন্না হতো আমার শরীরের প্রতি। তুই যে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতি। আমি কীভাবে পারতাম তোকে আমার এই নষ্ট শরীর স্পর্শ করতে দিতে। আমি কখনো চাইতাম না তোর আশেপাশেও আমার নষ্ট শরীরের ছায়া পড়ুক। তাই সবসময় তোকে দূরে দূরে রেখে আগলে ছিলাম। আমিই কোনোদিন তোকে ফুফুর বাড়ীতে যেতে দেই নি। সবার কান ভরিয়ে দিতাম তোর নামে উল্টাপাল্টা কথা বলে। যাতে কেউ তোকে কোথাও না নিয়ে যেতে পারে। জানি তুই সেজন্য কাঁদতি। তবুও আমি শক্ত ছিলাম। কারণ ওই নরক যন্ত্রণা থেকে এই সামান্য কষ্ট ঢের ভালো ছিলো। তোর আমার উপর খুব অভিমান জমে গেছে না রে? আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি খুব খারাপ বোন। খুব খারাপ। আমার মতো কোনো বোন যাতে কোনোদিন কারো না হয়।

আপা কান্নার জন্য কথা বলতে পারছিলেন না।বারবার তার গলায় আটকে যাচ্ছিলো। আমি তখন শব্দ করে কাঁদছি। আমার মনের দীর্ঘ অভিমান আর রাগ যেনো ধুয়ে মুছে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কথা তো বলছিলাম কিন্তু শব্দ হচ্ছিলো না। গলা বোধ হয় ভেঙ্গে গিয়েছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে আপাকে বললাম,

—খবরদার এমন কথা আরেকবার বলো তো। তুমি সবচেয়ে ভালো বোন। সবচেয়ে ভালো। বেস্ট,বেস্ট,বেস্ট! তোমার মতো বোন যেনো ঘরে ঘরে থাকে। আমার মতো ভাগ্যবতী বোধহয় দ্বিতীয় টি নেই।কারণ আমি তোমার মতো বোন পেয়েছি। তোমার বোন হতে পেরেছি। তুমি হচ্ছো পৃথিবীর বেস্ট বোন।

আপা ততক্ষণে কেঁদে টেদে অস্থির। আমি আপার শরীরের সাথে একদম মিশে বললাম,

—এ শরীরের উপর যদি পৃথিবীর সব নিকৃষ্ট বস্তু আর জীবজন্তু রাখা হয় তবুও আমি নির্দ্বিধায় জড়িয়ে ধরবো। এ শরীর যদি আগুণে ধ্বংস ও হয়ে যায় তবুও আমি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখবো। এ শরীর যদি পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিরি জিনিসের থেকেও বিচ্ছিরি হয়ে থাকে তবুও আমি জড়িয়ে ধরে থাকবো। খবরদার তুমি আরেকবার নিজেকে নিকৃষ্ট বলে থাকো তো!
নিকৃষ্ট ওই কুকুর রিয়াজের শরীর। নিকৃষ্ট ওই কুকুরের মন, নিকৃষ্ট ওই কুকুর।

রাগে আমার শরীর জ্বলছিলো। রিয়াজ ভাইকে নিশ্চই পুড়িয়ে ভষ্ম করে ফেললে রাগ টা একটু কমে টমে যেতো। লোকটার উপর ভীষণ রাগ উঠছে। যাকে বলে ভয়ংকর রাগ! আমার শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে যদি হালকা পাতলা একটা চড়ও দিতে পারতাম তাহলে একটু শান্তি মিলতো। বেয়াদপ টা ব্যাথা না পেলেও কিন্ত আমি আরাম পেতাম। স্বস্তি বোধ করতাম। আচ্ছা আমার কি এখন মারা উচিত? হু,একদম। আরেকবার যদি তাকে দেখি তাহলে ঠাডায় চড় দিবো। দরকার পড়লে স্যান্ডেল দিয়েও মারবো। আমার বাদামি রঙের জুতো জোড়া দিয়ে। ওটা পরলে ঠকঠক আওয়াজ হয়। এটা দিয়ে মারলে নিশ্চই জোরে লাগবে, আর বেশি ব্যাথাও পাবে।

কান্নাকাটির এক পর্যায়ে আপা বললেন,

—তুই তখন কি বলেছিলি? কিসের সম্পর্ক? তোর বোধহয় কোথায় ভুল হয়েছে, আ….

আপা বলতে চাইলো ইশান স্যারকে কীভাবে চিঠির মাধ্যম দিয়ে যোগাযোগ করে নিস্তার পেয়েছিলেন। কিন্তু আমি শুনতে চাইলাম না। মনে মনে তখন বিশাল অপরাধবোধ হচ্ছিলো। ছিঃ,আমার মেন্টালিটি এত খারাপ? সত্যিই খুব খারাপ। যা নয় তা বলে ফেলেছিলাম। কত আজেবাজে চিন্তা করে ফেলেছিলাম। এর জন্য নিশ্চই আমার শাস্তি পাওয়া উচিত! কঠিন শাস্তি। ইশান স্যার তো খুব ভালো একজন মানুষ। তার সম্পর্কে এত নিচু মানসিকতা রাখা রীতিমত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি না জানি আমার সম্পর্কে কী ভাবছেন? উনার কথা মনে পড়তেই তাকে খুঁজতে লাগলাম। তিনি তখন জানালার পাশে দাড়িয়ে আছেন। তার মুখের উপর ধূসর রঙের ধোঁয়া উড়ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম সিগারেটের ধোয়া। ইশান স্যার সিগারেট খান? কিন্তু কবে থেকে? আমি তো তাকে খেতে দেখি নি। নাকি আমার সামনে খান ই নি। উদ্ভট চিন্তার মাঝেই ইশান এসে বললেন,

—আপু, আপনার বাবাকে ফোন দেওয়া হয়েছে। তিনি হয়তো ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চলে আসবেন।

আপু মাথা নাড়ালেন। আমি তখন ইশানকে সরি বলতে চাইলাম, কিন্তু বলা হলো না। ইশান আমাকে কথা বলতে না দিয়ে পুনরায় আপাকে বললেন,

—আপু, আপনার বোনের সাথে আমার খুব জরুরী কাজ আছে। তাই আমি তাকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি প্লিজ এদিক টা একটু সামলে নিন। সাংবাদিকদের বলবেন, আমি কাল বাকি ইন্টারভিউ দিবো। আজ যেনো আমাকে খোঁজ না করা হয়, প্লিজ। আমি জানি এই মুহূর্তে আপনার বোনকে আপনার দরকার। কিন্তু তার থেকেও বেশি আমার প্রয়োজন। আপনি চিন্তা করবেন না, আমার কাজ হয়ে গেলে সরাসরি তাকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিবো। প্লিজ একটু হ্যান্ডেল করে নিন।

আপা মাথা নাড়তে দেরী হলো ইশান স্যার আমাকে টেনে নিয়ে যেতে দেরী হলো না। আমি বললাম,
-‘কই নিয়ে যাচ্ছেন? আমি এখন কোথাও যাবো না। দেখুন আমার মন-মানসিকতা এখন ঠিক নেই। আমি আপার কাছে যাবো।’

ইশান স্যার কঠিন ধমক দিয়ে বললেন,-‘মন-মানসিকতা আমার ঠিক নেই। তুমি যদি এই মুহূর্তে চুপ না থাকো তাহলে আই সোয়ার আমি তোমার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবো। ‘
কথাটা শেষ করেই তিনি তার ফোন আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। একটু বেসামাল হলে এতক্ষণে এটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতো। আমি রাগ দেখিয়ে স্মার্ট ফোনটার দিকে তাকালাম। যখন তাকালাম তখন ই বোধহয় আমার হুশ চলে গেলো। শরীরের সব শক্তি উড়ে গিয়েছিলো। বিষ্ময়ে আমার চোখদুটো বড় হয়ে গেলো। হাত-পা অটোমেটিক থেমে এলো। আমি মুখে হাত দিয়ে উনার দিকে একপলক তাকিয়ে পুনরায় স্ক্রিনের দিকে তাকালাম। ততক্ষণে আমার বাক-শক্তি হারিয়ে গিয়েছিলো। মুখ দিয়ে শব্দ ই বের হচ্ছিলো না।

#চলবে…..

®সোনালী আহমেদ

[আশানুরূপ গঠনমূলক মন্তব্য না দেখে বোনাস পর্ব দেওয়া হয়ে উঠলো না। এইজন্য আবার মন খারাপ করবেন না। এখন ইয়া বড় পর্ব দিয়ে দিলাম। সবাই অবশ্যই মন্তব্য করে গল্প সম্পর্কে নিজেদের মতামত জানাবেন। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here