গল্পের নাম— #এবং_তুমি
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ৩
—শাড়িতে পিন আটকানো। আমি ব্যাথা পাচ্ছি, স্যার।
স্যার বোধহয় শুনলেন না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনতা জল। জানালার পর্দা ভেদ করে দমকা বাতাস ছুঁয়ে গেলো আমাদের।
–
চারদিকে বিয়ের উৎসব লেগে রয়েছে। লোকজনের ভীড়ে চাপা পড়ে গেছি আমি। চোখ দুটো ঘুমে ঢুলঢুল করছে। কাল সারারাত নির্ঘুম কেটেছিলো। ভোর ছয়টার সময় ডেকে তুলা হয়েছিলো আমায়। তখনও জেগে ছিলাম। এখন সাড়ে আট টা বাজে, এখনও জেগে আছি। হ্যা,এর মধ্যে আমাকে মিষ্টিজাতীয় জিনিস খাওয়ানো হয়েছে। কাল ডায়বেটিস নীল হয়ে গিয়েছিলো। তাই আজ খাবার পূর্ণ ব্যবস্থা করেছেন। আমার পাশের সব লোকজন অপরিচিত। কেউই এ পরিবারের সদস্য নয়। সবাই যে ইচ্ছে করে আসছে না, সেটা বুঝতে পারছি। কেননা স্যারদের ছোট সংসার নয় যে দু-একজনের সবাই ব্যস্ত তাই আসতে পারি নি। স্যারদের বড় সংসার। স্যারের পাঁচ ভাই-বোন। স্যার সবার ছোট। বাকি সবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে এবং তাদের প্রত্যেকের বাচ্চা -কাচ্চা রয়েছে। আপুর বিয়ের কথা ঠিক হবার পর আপু অবাক হয়ে বলেছিলো,’ এই প্রভাতি শুনেছিস, উনাদের কত বড় সংসার। ও মাই গড,ও মাই গড! এত বড় সংসার কীভাবে সামলাবো?’ আমি তখন হেসে ফেলেছিলাম। আজ আমার নিজের ই টেনশন হচ্ছে এত বড় সংসার কীভাবে সামলাবো? এত মানুষের মন কীভাবে জয় করবো? কেউ ই তো আমার সাথে কথা বলছে না। চিন্তায় মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। না জানি কবে আবার সেন্সলেস হয়ে যাই? ও গড একবারেই সেন্সলেস হয়ে যাই না কেনো? তাহলে তো আর টেনশন নেই। সবাই শান্তি! উফফ, আবার আজেবাজে চিন্তা করছি। ড্রয়িংরুমে ফুফুমণিকে দেখতে পেয়ে আমার বিরস মুখে উজ্জ্বলতার ছোঁয়া ফুটলো। উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। ফুফুমণি একজন বৃদ্ধমহিলাকে নিয়ে এদিকে আসছেন হাসিহাসি মুখে আমার দিকে ইশারা করে কিছু বলছেন মহিলার বয়স ষাটোর্ধ হবে। গালের মাংসপিণ্ড ঝুলে রয়েছে। তবে হাসি দেখে মনে হচ্ছে তিনি সদ্য যৌবনে পা রেখেছেন।
— ফুলবউ, ইনি আমার মা। তোমার দাদী-শাশুড়ি! সালাম করো।
আমি ঝটপট পা ছুঁয়ে সালাম দিলাম। পা ছুঁয়ে সালাম দেওয়ার কারণ রয়েছে। আপুর বিয়ের আগের রাতে বাবা আপুকে পইপই করে বুঝিয়েছেন যে শশুড়বাড়ীর লোকজনকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে। নাহলে তারা নারাজ হন এবং আদব-কায়দা ও শিক্ষার উপর প্রশ্ন তুলেন। আমি চাই না আমার জন্য আমার পরিবারের উপর আঙ্গুল তোলা হোক। তাই সব রিতী / আদেশ-উপদেশ মানবো। সবাইকে দেখিয়ে দিবো, আমি আমার মায়ের মতন নয়। আর না কোনোদিন হবো। হুহু!
—-থাক,থাক। বেঁচো থাকো মা, স্বামী সোহাগী হও!
আমি লাজুক হেসে মাথা নুয়ালাম। দাদী খিলখিল করে হাসলেন। মনে হয় তিনি আমাকে লজ্জা পেতে দেখে ফেলেছেন। ইশশ, এবার তো আরো লজ্জা লাগছে। দাদীর হাসির কলধ্বনি শুনে ফুফুমণিও হাসলেন। আমি অবাক চোখে দুজনকে দেখছি। দুজনের হাসি অবিকল একই রকম। তাদের হাসি দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীও হাসছে। জগতের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য বোধ হয় তখন হয় যখন মা, মেয়ে একসাথে হাসে। আমার আবার মায়ের সাথে একসাথে হাসার সৌভাগ্য হয় নি। তবে হ্যা, কাঁদার সৌভাগ্য হয়েছিলো। সেদিনের ঘটনা বলি। একদিন আনোয়ার চাচা আমার হাতে ছোট কাগজের ব্যাগ দিয়ে বলেছিলেন মাকে দিতে। আমি জানতাম না ভেতরে কি ছিলো। তখন অসাবধানতাবশত একটা চুড়ি ভেঙ্গে যায়। মা কে এনে দেওয়ার পর তিনি এটা দেখলেন। এবং সাথে সাথে রেগে যান। সেদিন আমায় খুব মেরেছিলেন। ওনার হাতের গরম খুন্তি আমার হাতের তালুতে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। হাতে ফোসকা পড়ায় জ্বলছিলো,আমি খুব কাঁদছিলাম। মা সেটা দেখতে পান নি। কেননা তিনি তখন ভাঙ্গা চুড়ি হাতে নিয়ে কাঁদছিলেন।
—- ফুলবউ, তুমি কাঁদছো কেনো?
ফুফুমণি অস্থির হয়ে আমার পাশে আসলেন। দাদিমা বললেন,
—-কি হয়েছে নাতবৌ? কাঁদছো কেনো?
আমি স্বাভাবিকভাবে বললাম,
— কিছু হয় নি। ওই এমনি….
— মিথ্যা বলবা না। মিথ্যা আমার পছন্দ নয়।
আমি চুপ করে গেলাম। ফুফুমনি মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— মায়ের কথা মনে পড়েছে, তাই না? বোকা মেয়ে,এজন্য মন খারাপ করবা? আজ থেকে আমি তোমার এক মা। কি মানবে না আমায় মা?
আমি মাথা নাড়ালাম। ফুফু বললেন,
—তাহলে বলো মা।
আমি চুপ রইলাম।
— কি হলো? ডাকো মা।
আমি অনেক্ষণ চুপ রইলাম। ফুফুমনি আরেকবার বলতেই অস্ফুটসুরে বললাম, ‘মা’। ফুফুমনি তৃপ্তির হাসি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি আনন্দে কেঁদে দিলাম।
—- এই পঁচা মেয়ে, কাঁদছো কেনো? থামো বলছি। দেখো মেয়ের কান্ড থামছেই না। চোখের পানি আর নাকের পানি দিয়ে যে মেক-আপ নষ্ট করে ফেলছো সেই খেয়াল আছে? ইশশ রে কি বিচ্ছিরি হাল! এক্ষুণি যে লোকজন আমার মেয়ে আস্ত একটা ভূত বলে চিল্লিয়ে পালাবে তখন কি হবে?
আমি হেসে ফেললাম। ফুফুমনি আঁচল দিয়ে আমার চোখের জল মুছে দিলেন। আমার এই মুহূর্তে খুব জানতে ইচ্ছা করলো, ফুফু তুমি এত ভালো কেনো? কিন্তু জিজ্ঞাস করলাম না। মনের কথা মনেই রেখে দিলাম। ফুফুমনি শাসনের সুরে বললেন,
— আর যেনো কোনোদিন কাঁদতে না দেখি। মনে থাকবে তো?
আমি মাথা নাড়ালাম। ফুফুমনি মিষ্টি হাসলেন। আমি আবারো মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলাম। কি অমায়িক হাসি। দাদিমা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
—-ইশান কই?
—ঘুমাচ্ছেন।
—-কিহ, দামড়া এখনো ঘুমাচ্ছে। হেলেনা, যা যেয়ে দামড়া টাকে নিয়ে আয়।
ফুফুমনি মিষ্টি হেসে উঠে গেলেন। দাদিমা আমার পাশে এসে বসলেন। তিনি গম্ভীর কন্ঠে আমায় ডাকলেন,
—নাতবৌ!
—জ্ জ্বি।
—-তোমার বোনের সাথে কি তোমার যোগাযোগ আছে?
—ন্ না।
—-সে কার সাথে পালিয়েছো জানো?
—ন্ না।
— ভালো, খুবই ভালো। এসব জানার দরকারও নেই। শুনো তুমি এখন আমাদের বাড়ীর বউ। ওই মেয়ের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ রাখবে না, বুঝেছো?
আমি মাথা নাড়ালাম। দাদিমা আমার হাতের উপর হাত রেখে বললেন,
— আমি জানি মন খারাপ করেছো। কিন্তু আমি তোমার ভালোর জন্যই বলেছি। তুমি বুদ্ধিমান। সংসার সম্পর্কে হয়তো অবগত নয়। কিন্তু শীঘ্রই যখন অবগত হবে তখন বুঝবে কেনো বলেছি।
—জ্বি,বুঝতে পারছি।
— আরো একটা কথা, তোমার শাশুড়ির মুখ কিন্তু ভালো নয়। সে যা তা বলে দেয়। তবে মনটা ভালো। তাকে যদি একবার মানাতে পারো,তাহলে তোমার সংসার স্বর্গ হয়ে উঠবে। কিন্তু সমস্যা হলো সে তোমাকে এখন মেনে নিবে না। কারণ তো জানোই। তাই তুমি যদি একটু মানিয়ে নিয়ে মন জয় করো, তাহলে দেখবে সে তোমাকে কেমন ভালোবাসে। তোমার কাছে এখনকার কষ্ট তখন তুচ্ছ মনে হবে।কি তুমি মানিয়ে নিবে তো?
—হ্যা,মেনে নিবো।
দাদিমাকে দেখে মনে হলো তিনি খুশি হয়েছেন। তিনি পরম স্নেহের সহিত মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
—আল্লাহ যেনো তোমার সংসার খুশিতে ভরিয়ে দেন।
আমি চুপচাপ বসে রইলাম। ফুফুমনি ইশানকে নিয়ে এদিকেই আসছেন। তার চোখমুখ জুড়ে ঘুমের রেশ। মনে হচ্ছে ফুফুমনি টেনে তুলে এনেছেন। ইশানকে সোজা আমার পাশে বসিয়ে দিলেন। ইশান স্বাভাবিকভাবে আসে আছে,কিন্তু আমি অস্বাভাবিক কাঁপছি। হাত দুটো একে অপরের সাথে কচলাচ্ছি। আমাকে বিচলিত হতে দেখে দাদি বললেন,
— কি রে দাদুভাই, বউ এর মুখ দেখেছিস। কেমন এইটুকু। মনে হচ্ছে ত্যানা ত্যানা করে ছেড়েছিস।
— আমার বউ। আমার ইচ্ছা। তোমার কেনো জ্বলে?
—-বাহ। এখন আমাকে ভুলে গেছো? শুনো নাতবৌ, কয়েকদিন আগেও সে আমার পেছনে লাইন মারতো। এসব ফন্দিতে তুমি আটকে পড়ো না।
— তাই নাকি দাদী? আমি কি বলবো, কীভাবে…
—এই চুপ কর। লাজ-লজ্জা কিছুই নেই। তুই তো দিনদিন বেহায়া হয়ে যাচ্ছিস ইশান।
ইশান লাজুক হেসে বলে,
—তুমি বুঝবে না দাদু। বউয়ের আদর পেয়ে বেহায়া হয়ে যাচ্ছি।
দাদিমা উঠে ইশানের কান টেনে দিলেন। আমি কান চেপে মাঝখানে বসে আছি। লাগামহীন কথাবার্তায় আমার শরীরের লোম দাড়িয়ে যাচ্ছে। ছিঃ, এরা কি নির্লজ্জ! ঘরবর্তী মানুষজন কি চোখে পড়ছে না? সবাই কেমন তাকিয়ে হাসছে।
#চলবে…
®সোনালী আহমেদ
[ গতকাল ঝড়-বৃষ্টি আর বিদ্যুৎ না থাকার ফলে দিতে পারি নি। সেজন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। ]