ত্রয়ী পর্ব ২

0
1511

২||

-” ভাইয়া, একটু সরে বসেন না ভাইয়া।” তোয়ার কণ্ঠ শুনে ঘাড় ফিরাল সায়রা। দেখল ক্ষীণ কণ্ঠে অনুনয় করছে তোয়া। ওর গায়ের সাথে লেগে বসা ছেলেটাকে। ছেলেটা ছবি দেখছে ঠিকই তবে শরীরের ভার অনেকখানি চাপিয়ে দিয়েছে তোয়ার ওপর। সায়রার চোখ কপালে ওঠার দশা হল। ওর বাপি আর মঈন মামা দৃশ্যটা দেখলে নির্ঘাত খুন করবে ছেলেটাকে। সায়রার ভাই নেই সত্যি তবে হিরো মার্কা একটা মামা আছে। কিন্তু মামাকে তো আর এসব বলা যাবেনা। উনি জানলে এই ছেলেকে কী বলবেন সেটা পরের বিষয়। কিন্তু সায়রার কোর্ট মার্শাল হয়ে যাবে এটা নিশ্চিত। ওর আম্মুর যা রাগ।

তোয়ার অনুনয়ে সরে যাবার বদলে বিশ্রী করে হেসে ছেলেটা আরো যেন চেপে বসল ওর দিকে। এরই মধ্যে ওর বাম পাশে সাবাকে পাশের চেয়ারে পাঠিয়ে দিয়ে প্রথম কথা বলা ছেলেটা সায়রার পাশে এসে বসেছে। সে তার হাত সায়রার ঘাড়ের ওপর দিয়ে লম্বা করে এমনভাবে বসেছে যেন সে ওর কতদিনের বন্ধু । রাগে গা রি রি করে উঠলেও কিছু বলার সাহস পেল না সায়রা। ছেলেটার গা থেকে সস্তা পারফিউমের গন্ধ আসছে। মাথা ধরে যাচ্ছে ওর। বিনয়ের সাথে বলতে বাধ্য হল, ” আপনারা এরকম করছেন কেন বলুন তো ? ”
” কী করসি আমরা ? ফ্রেন্ডশিপ করতে চাইসি তোমার সাথে। ফ্রেন্ডশীপও করবানা তুমি ? এইটা তো জাস্ট ইনসাল্ট । ”
-” কেন ফ্রেন্ডশিপ করব । কী যোগ্যতা আছে আপনার আমার সাথে ফ্রেন্ডশীপ করার ?” হঠাৎ রেগে গেল সায়রা। ওকে রেগে যেতে দেখে তোয়া আপোষের সুর তুলল।
-” না, না ব্যপারটা এরকম না। আসলে আপনারা তো আমাদের সেইফ করার জন্য আছেন। নইলে আমরা পথেঘাটে চলব কীভাবে ভাইয়া, বলেন ? ”
তোয়ার কথা শুনে এপাশের ছেলেটা তার বন্ধুকে ডাকল, ” অই, রাজু। কী কয় এরা ? ফ্রেন্ডশীপ করব না মনে হয়। আমগোরে পছন্দ হয়নিক্কা ।” খিক খিক করে হেসে উঠতেই সামনের সিটে বসা এক ভদ্রলোক পেছনে তাকিয়ে গমগমে স্বরে বলে উঠলেন, ” এই তোমরা এত কথা বলছ কেন। সিনেমা দেখতে এসেছি। তোমাদের বকবক শুনতে আসিনি। যত্তসব। তোমরা হাঁটুর বয়সী ছেলেপেলে মিলে সিনেমা হলের পরিবেশটা খারাপ করে ফেরেছ। তোমাদের জ্বালায় একটা মুভি দেখারও উপায় নেই।” ভদ্রলোক বেশ রেগে গেলেন।
-” এই মিয়া, এত চিল্লান ক্যান। আপনারে তো আমরা ডিস্টাপ করিনাই। আপনের দেখার আছে আপনে দেখেন। এটা আমগো পার্সোনাল ব্যপার।” সাবার পাশের ছেলেটা বললে ওর সাথে সাথে সায়রার পাশে বসা রাজু ছেলেটাও তাল মিলাল,
” হ, হ। হাঁটুর বয়সী কারে কন মিয়া। আর হাঁটুর বয়সীরাই সিনেমা দেখে। আপনের তো মিয়া এক পাও কব্বরে তারপরেও আইছেন ফিলিম দেখবার লেগা। শখ তো কম না।”
ভদ্রলোক এবার উঠে দাঁড়িয়ে ধমকের সুরে বললেন, ” চড় মেরে বেয়াদবি ঘুচিয়ে দেব ছোকরা। মুখ সামলে কথা বল, জান আমি কে ? ”
-” আমগো জাইনা দরকার নাই। আপনে যেই হন আমরা আপনের লগে কিছু কই নি। আপনেই আইছেন হুদাকামে জোলাইতে।”
দুই পক্ষের বাকবিতন্ডার মধ্যে সাবা সায়রা আর তোয়া পরস্পরের মুখ চাইতে লাগল। সাবা বুঝল এই সুযোগ। সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ” এই যে, আপনার বাইরে গিয়ে ঝগড়া করেন। বাকিদের সিনেমা দেখতে দেন।”
তোয়া বোকার মত তাকিয়ে থাকলেও সায়রা সাবার সাথে সুর মেলাল, ” আসলেই। এদের জন্য কিচ্ছু দেখতে পারলাম না। এই চল্, বের হ। এখান থেকে। ” বলেই সায়রা পা বাড়ালে একটা ছেলে খপ করে ওর হাত ধরতেই সপাটে চড় কষিয়ে দিল সায়রা। সাবা নিজেও থতমত খেয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, ” আঙ্কেল আপনি ঠিকই বলেছেন। এরা আমাদের ছবি দেখতে দিচ্ছেনা। জোর করে আমাদের সিটে বসে আমাদের ডিস্টার্ব করছে। আমরা ভদ্র ঘরের মেয়ে আঙ্কেল। ”
হতভম্ব ভদ্রলোক ধমকের সুরে বললেন, ” মাই গড। এদেরকে তো পুলিশে দেয়া উচিত।”
-” অই মিয়া পুলিশের ডর কারে দেহান।” রাজু চেঁচাল। মুহূর্তেই লাইট জ্বলে উঠল। এদিকে হৈ চৈ টের পেয়ে সিট চেক করা লোকটা টর্চ হাতে এগিয়ে এল। সাবা বুঝতে পারছে পরিস্থিতি গরম হয়ে গেছে। এটা শান্ত হতে দেয়া যাবেনা। তার আগেই বেরোতে হবে। সে চেঁচিয়ে লোকটাকে ডাকলে ওকে সঙ্গ দিল তোয়া। আশেপাশের সিটের সবাই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে শুরু করলে সায়রা দ্রুত নিকাব টেনে চেহারা ভালভাবে ঢেকে দ্রুত বেরিয়ে এল সিটের লাইন ছেড়ে। ওকে বেরোতে দেখে তোয়া আর সাবাও সুযোগটা গ্রহন করল। ছেলেগুলো তো বটেই বাকিরাও চেয়ে চেয়ে দেখল অসম্ভব সুন্দর তিনটা মেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে হল ছেড়ে। টর্চ হাতে লোকটা তাদের চলে যাবার কারণ জানতে চাইলেও কোন জবাব দিলো না ওরা তিনজন। আপাতত এখান থেকে বেরোতে পারলেই জান বাঁচে। বলা যায়না, ছেলেগুলো পিছু নিতে পারে। হয়ত তারা নিজেরাও বুঝতে পারেনি, এত সহজে শিকার হাতছাড়া হয়ে যাবে। ঐদিকে সামনের ভদ্রলোক রীতিমত তুলকালাম বাঁধিয়ে দিয়েছেন।

প্রায় দৌড়ে বেরোল ওরা। সায়রা সবার আগে। তাকে থামানো যাচ্ছেনা। সে নেকাবের উপর দিয়েই হাতচাপা দিয়ে রেখেছে মুখটাকে। সাবা পেছন থেকে থামতে বললেও সে থামলো না। ঘোরের মধ্যেই ছুটছে সে। বাইরে চত্বরে এসেই একটা সিএনজি দাঁড় করিয়ে উঠে পড়লে সাবা আর তোয়াও উঠে বসল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় সাবা বোকার মত তাকিয়ে বলল, ” কই যাচ্ছিস তুই? ”
-” কথা কম বল আর তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি ঠিকানা বল। আরমান আছে এখানে। নির্ঘাত আমাকে দেখে ফেলেছে।”
-” আরমান কে ? ” তোয়া জিজ্ঞেস করেই সভয়ে বাইরে তাকাল। পিছু ধাওয়া করে কেউ এসেছে কী না দেখতে। সায়রা তাড়া দিল, ” তোরা একটা ঠিকানা বলবি না এখানে দাঁড়িয়েই সব শুনবি। আশ্চর্য।”
তোয়া আর সাবা দ্রুত উঠে পড়ল রিক্সায়। সায়রা সিএনজিওয়ালাকে তাগাদা দিল, ” কই, যাচ্ছেন না কেন ? ”
-” আরে, কই যাইবেন আপনেরা ? ”
তিনজনই হতভম্বের মত মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। সত্যিই তো, কোথায় যাবে সেটাই তো ঠিক করা হয়নি। পালিয়ে বাঁচার চিন্তায় বাকি সব গুলে খেয়েছে। সায়রা সাবার দিকে তাকালে সাবা কাঁধ নাচাল, ” আমি কী জানি কই যাবি। আমাদের এখানে তিনটা পর্যন্ত থাকার কথা। এখন মাত্র বাজে পৌনে একটা। ”
তোয়া হঠাৎ ঘাড়ের উপর থেকে বলল, ” সেগুন বাগিচা চলেন মামা। ”
-” সেগুন বাগিচায় কে থাকে? ” সাবা ঘাড় ফেরাল। রিক্সাওয়ালাও তখনই জানাল।
-” ঐদিকে যামুনা আফা।”
-” অন্য গাড়ি লন।”
-” প্লিজ, যান না ভাই। আপনি যা ভাড়া চান তাই দিব। আরো পঞ্চাশ টাকা বেশী দিব। প্লিজ, মামা। চলেন না। ” বলে হলের দিক থেকে রাজু আর তার সাথের ছেলেটাকে ওদের খুঁজতে দেখে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলল সায়রা।
-” দরকার হলে একশ টাকা দেব মামা। আল্লাহর দোহাই লাগে চলেন মামা ! ”
সাবা আর তোয়াও ততক্ষনে রাজু নামের ছেলেটাকে দেখতে পেয়েছে। সায়রা মুহূর্তেই নিজেকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলল। যেন ওর চেহারা ঢাকলেই পুরো পৃথিবী ঢাকা পড়ে যাবে। সাবা আর তোয়াও নিজেদের চেহারা রুমালে আড়াল করে নিল। সিএনজি ততক্ষনে টান দিয়েছে। আর একই সাথে ওদের একজন ছেলে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, ” অই রাজু। পলাইতাসে। ঐ যে….গাড়িতে।”
প্রত্যুত্তরে তোয়া ওর পায়ের স্লিপার খুলে গেট দিয়ে উঁকি ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে নাড়তেই সাবা ধমক দিয়ে ওর হাত থেকে স্যান্ডেল টেনে নিয়ে নিচে ফেলল।
-” স্যান্ডেল নিলি কেন। ঐ হারামজাদাগুলারে স্যান্ডেল পিটা করতে পারিনি বলে কী দেখাতেও পারবো না ? ” সাবা রেগে বলল।
-” দেখিয়ে লাভটা কী। যতসব ফালতু কাজ। এভাবে ওরা উল্টো আরো পিছু নেবার আগ্রহ পাবে। মামা ঠিক টাইম মত গাড়ি টান না দিলে ওরা ঠিকই পিছু নিত।” বলে ঘাড় ফিরিয়ে আবার বাইরের দিকে তাকাল। ছেলেগুলো পিছু নিয়েছে কিনা দেখার জন্য। পেছনটা ফাঁকা দেখে স্বস্তি পেয়ে ঘাড় ফেরালো। সিএনজি এখন শব্দ তুলে উল্কা বেগে ছুটে চলেছে। বাতাসে মুক্তির গন্ধ পেয়ে লম্বা করে শ্বাস টানল সাবা। আর তখনই ফোঁপানোর শব্দটা পেল। পাশের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করল, সায়রা সেই যে মুখ ঢেকেছে সে মুখ খোলেনি। ওভাবেই হাতে মুখ রেখে বসে আছে। সম্ভবত ওই ফোঁপাচ্ছে সে। কারণ তোয়া নিজেও ঝুঁকে ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে সায়রা কাঁদছে কি না। সাবা ওর কাঁধে হাত রাখল। নরম সুরে বলল, ” এ্যাই সায়রা। কাঁদছিস কেন। ছেলেগুলো তো আমাদের পেছনে নেই। তাকিয়ে দেখ আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি।”
সায়রার ফোঁপানি বন্ধ হল না তাতে। সাবা ওর কাঁধে মৃদু ঝাঁকুসি দিলেও মুখ তুলল না সে। তোয়া ইশারা করল সাবাকে। সাবাও কী ভেবে আর ঘাঁটাল না সায়রাকে। ওরা দুজনই চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল। সায়রার ফোঁপানি কমলেও সে মুখ তুলল না।

সেগুনবাগিচা এসে রিক্সাওয়ালা পথ জানতে চাইলে তোয়া হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল। একটা নীল রঙের গেট অলা বাড়ীর সামনে এসে থামল ওরা।
সায়রা ম্লান মুখে ব্যাগ হাতড়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে সিএনজি ভাড়া মেটাল। যদিও সিএনজি ওয়ালা ওদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে তবু প্রতিবাদ করার মানসিকতা নেই বলে চুপ করে রইল।
সাবা তোয়া দুজনেই দেখল সায়রার পুরো মুখ লালচে হয়ে আছে। বেচারী সারাটা পথ কেঁদেছে নিশ্চয়ই। সাবা তোয়ার দিকে তাকাল, ” এটা কার বাসা ? ”
-” আমার কাজিন কণা আপার বাসা। এই ভরদুপুরে আর কই যাবি তুই ? বাসায়ও তো যেতে পারবো না। কণা আপার বাসাই সেইফ।”
-” তোর কণা আপা বলে দেবে না বাসায় ? ” সাবা অনিশ্চয়তার সুরে বললে তোয়া হাসল।
-” কণা আপা বাসায় থাকেনা এ সময়। ”
-” কীইই…?” সাবা বলে উঠলে তোয়া দুই হাত তুলে সারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বলল, ” আস্তে বাবা আস্তে। এত চেঁচানোর মত কিছু হয় নাই। কণা আপা চাকরী করেন। এ সময় তিনি অফিসে থাকেন। তবে কণা আপার শ্বাশুড়ী আর কাজের মেয়েটা বাসায় থাকে। কণা আপার শ্বাশুড়ী খুবই আন্তরিক আর ভালো মানুষ।”
-” কিন্তু তোদের বাসায় বলে দিলে ? ”
-” দিবে না। আমি ওনাকে বলব যে আমরা এখানে বই কিনতে এসেছি। পাশেই তো সেবার অফিসটা। কণা আপা জানে আমি বই কালেক্ট করি। কাজেই এটা আলাদা করে বলার কিছু নেই। বললেও আমি এড়াতে পারব। তবে সায়রা মুখটাকে যেরকম লাল বানিয়ে রেখেছে সেটাই না জিজ্ঞেস করে বসে আন্টি।”
সায়রা দুহাতের চেটোয় চোখ মুখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল। তোয়া উদাস সুরে বলল, ” সায়রার ভাগ্যটা ভাল। একটু ফিঁচ ফিঁচ করে কাঁদল আর চেহারা লালটাল হয়ে গেল। আমি হলাম কপালপোড়া। সেদিন বাসায় আম্মুর বকা খেয়ে ভাত না খেয়ে একঘন্টা কাঁদলাম। পরে বাথরুমে আয়নার সামনে গিয়ে দেখি যেই কে সেই। বের হবার পর আম্মু কী বলল জানিস ? বলে, কেমন বেহায়া মেয়ে। এত বকলাম তবু চোখে পানি নেই। কেমন কষ্ট লাগে বল ? ”
হেঁচকি তুলে হেসে ফেলল সায়রা। বোঝাই যাচ্ছে সে প্রানপণে হাসিটা চেপে রাখতে চেয়েছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঠেলে হাসি বেরিয়ে যাওয়াতেই ঐ শব্দ। সাবাও হাসতে লাগল ওর কথা শুনে।

একটা কারুকাজ করা কাঠের দরজার সামনে এসে বেল বাজাল তোয়া। মিষ্টি সুরে টিংটং শব্দ হল। তার প্রায় সাথে সাথেই কাজের মেয়ের বাঁজখাই কণ্ঠ, ” অই কিডা? ”
-” দরজা খোলো ময়না। আমি তোয়া।” গলা চড়িয়ে জবাব দিতেই দরজা খুলে বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে থাকল ময়না। তবে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল না।
-” মামী তো বাইত্তে নাই।”
-” আল্লা কী বলো। কণা আপা বাসায় নেই ? আজ না শনিবার ? ”
-” শনিবার অইসে তো কী অইসে। মামীর ওপিস তো খুলা।”
-” আহা, আমার যে কণা আপাকে অনেক দরকার। আচ্ছা,আন্টি আছে না? ”
-” না, নানীও নাই। হের মাইয়ার বাড়ী গেছে।”
-” তুই একা বাড়ীতে ? ”
-” হ। আমি একলাওই।”
-” বলিস কী ? একা গেট খুললি কেন। যদি আমরা না হয়ে অন্য কেউ হতো ? ”
-” অন্য কেউ হইত না। আপনের গলা আমি চিনি। তবুও আমি সাবদানেই গেট খুলসি। এই দেহেন। ” বলে বাম হাতে ধরা ছোট্ট বটিটা সামনে আনলে তিনজনেই আঁতকে উঠল। ” উল্টাপুল্টা দেখলেই কল্লা নামায়া হালাইতাম।”
সাবা হাসি চেপে মৃদু স্বরে বলল, ” ডেঞ্জারাস চীজ তো।” তারপর ময়নার উদ্দেশ্যে বলল, ” কল্লা নামালে তুমিও বাঁচতেনা ময়না । পুলিশ তোমাকে ধরে নিয়ে যেত। আর ফাঁসি দিয়ে দিত !”
-” ক্যান, ফাসি দিব ক্যান। দ্যাশে কী কোন আইন নাই ? ”
-” আচ্ছা, আমরা কী ভেতরে আসতে পারব ময়না নাকি কণা আপার অনুমতি লাগবে ?” তোয়া প্রসঙ্গ বদলালে ময়না দ্রুত জিভ কাটল।
-” আরে কী যে কন আফা। আপনেরে তো আমি চিনিওই। আসেন ভিত্রে আসেন।”
-” তোমাকে বেশী বিরক্ত করব না। কিছুক্ষণ বসেই চলে যাব।” বলতে বলতে ভেতরে পা রাখল তোয়া। ড্রইংরুমে ঢোকার মুহূর্তে টের পেল কেউ একজন বেরিয়ে গেল ওদের পেছন দিয়ে। সায়রাই ব্যপারটা লক্ষ করল তবে সাথে সাথেই কিছু বলল না। তোয়া যখন ড্রইংরুমে বসে যখন সোফায় হাত পা এলিয়ে দিতে যাচ্ছিল তখন সায়রা তথ্যটা পেশ করলে সাবা লাফিয়ে উঠল, ” তুইও খেয়াল করেছিস ? আমি তো ভাবলাম হয়ত আমারই কোন ভুল হয়েছে।”
তোয়া চিন্তিত স্বরে বলল, ” আচ্ছা, তাহলে কণা আপা বাসায় না থাকলে এই কান্ড করে ময়না। অথচ ভাবখানা দ্যাখ। বটি নিয়ে দরজা খুলতে গেছে। কত্তবড় ফাজিল।”
সাবা ওকে হাতের ইশারায় গলা নামাতে বলল, ” আস্তে বল। আমার মনে হয় আমরা যে টের পেয়েছি এটা বলা উচিত হবে না। প্রয়োজন হলে বলব নয়ত কৌশলে সরাসরি কণা আপাকেই জানিয়ে দিবি। ”
-” হম, সেটাই।” সায়রা মাথা নাড়ল। আর সাথে সাথেই দীর্ঘশ্বাস পড়ল ওর। সাবা ওর কাঁধে চাঁটি মারল, ” তুই কানতেসিলি ক্যান সিএনজিতে বসে ? ”
সায়রা মুখ নামাল। তোয়া টিপ্পনী কাটল, ” মনে হয় ওর আরমান ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিল।” শুনে সাবা হেসে উঠলেও সায়রার চুপসে গেল।
-” কস কী ? ”
-” হম, আরমান ছিল ওখানে। আমাকে দেখে ফেলেছে। বড়বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।”
-” আরমানটা কে ? তখনও বললি, আরমান আছে এখানে ? ” তোয়া বলল।
-” যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। সজীব ভাইয়া যাকে ফোনে থ্রেট করেছিল ওর নামই আরমান।”
-” সেরেছে ! ” নিস্তেজ গলায় বলল তোয়া। নরম সোফায় প্রায় অর্ধেক ডুবে গেছে সে। পারলে ঘুমিয়েই যায়। সাবা নিজেও পা তুলে আরাম করে বসল। সোফার কুশনে শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে বলল, ” দেখলে দেখুক। সে তো আর এখন তোর বাসায় বলতে পারবে না। বিয়ে ক্যানসেল হয়ে গেছে যেখানে সেখানে তুই কই যাস কী করস এসবে তার কী। আর যদি বলেও সোজা বলবি, মিথ্যে কথা বলছে। বানিয়ে বলছে।”
” এত বড় মিথ্যে কথা বলব ? ”
-” তো কী সত্যি বলবি ? ” অবাক হল সাবা। সায়রা ফের কান্না শুরু করল।
-” আরমান আমাকে ঐ ছেলের সাথে দেখেছে। ছেলেটা আমার গায়ে হাত রাখছিল বারবার। তখনই আরমানকে দেখি। আরমান সব ভুলে আমাকে আর ঐ রাজু ছেলেটাকে দেখছিল।ও এবার দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিবে। ভাববে এই ছেলের জন্যই আমি বিয়ে ভেঙ্গেছি। ইস্, ছি ছি ছি….!” সায়রা মাথা নেড়ড়ে দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল। সাবা চুপ মেরে গেল এবার। তোয়াও চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইল। একটু ভেবে বলল, ” এখন কী করবি ভাবছিস। আরমানকে ফোন করে সত্য কথা বলবি ? ”
-” সত্য বলে লাভ।? ওর কী বিয়ে হবে নাকি যে সত্যবাদী সাজতে হবে? ” সাবা বলে উঠল।
-” বিয়ে না হোক। আরমানরা হয়ত আর আসবেও না আমাদের বাড়ীতে। কিন্তু ওরা যখন আগ্রহী হয়েও পিছিয়ে যাবে তখন আমার ফুপি কারণ জানতে চাইবে আরমানের প্যারেন্টসের কাছে। কেন তারা অরাজী। ফুপিই যেহেতু আমার বিয়ের কাজটা এনেছেন। তিনি আরমানের প্যারেন্টসকে এত সহজে ছাড়বেন না। তখন তো আরমান ঠিকই সব বলে দেবে বাপ-মা’কে। তখন কী হবে ? ” সায়রা আতঙ্কিত চোখে তাকাল। সাবা মাথা নেড়ে বলল, ” তারচে তুই আরমান কে সব সরাসরি বলে দে। আর এটাও বল তুই পড়াশোনা করতে চাস। পড়াশোনার জন্যই বিয়েটা করা এখন সম্ভব না। আরমান যেন এসব কথা কাউকে না বলে।”
সায়রা চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকাল সাবার দিকে, ” জানাব ওকে ? সত্যি বলছিস ? ”
-” না তো কী মিথ্যা ? ” তোয়া মাঝখান থেকে বলে উঠল।

এমন সময় ময়না একটা ট্রে তে তিনগ্লাস জুস নিয়ে এসে টেবিলে রেখে বলল, ” মামী আপনে গো ভাত খায়া যাইতে কইসে।”
-” তুমি ফোন করেছিলে কণা আপাকে ? ”
-” হ। ফুন দিসিলাম । মামী কইল, অগোরে থাকতে ক। আমি আইলে যিমুন যায়।”
অপার স্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল সাবার সমস্ত শরীর জুড়ে। যাক্, এই ভরদুপুরে অন্তত রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে না এটাই সান্ত্বনা।
-” কী রান্না করেছ ময়না ? ” তোয়া হাসলে ময়না পাল্টা জবাব দিল।
-” কিছু রান্ধিনি আপা। অহন বসামু। আপনারা রেস্ট লইতে থাকেন আমি রাইন্দা সারি। বেশীক্ষণ লাগত না গো আপা।” বলেই বেরিয়ে গেল ময়না। সাবা মুচকি হেসে নিজের ঠোঁটের উপর ইশারায় চেইন টেনে বলল, ” আমি কিছু দেখিনি গার্লস। ময়না আমাকে রেঁধে খাওয়াবে। বুঝতেই পারছ।”
সাবার এই নাটকীয় ভঙ্গিমায় তোয়া হেসে উঠল। সায়রা ততক্ষণে ওর মোবাইলে কাউকে ট্রেস করতে লেগেছে। সাবা পা চালাল ওর দিকে।
-” কারে ফোন দ্যাস ? ”
-” আরমানকে…! হ্যালো….?” হঠাৎই ত্রস্তে বলে উঠল সায়রা। “জি, আ…আমি সায়রা। মানে একটা কথা বলতে ফোন দিয়েছি…! ” বলে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে অস্ফুটে বলে উঠল, ” কীই ? ” সায়রা অবাক হয়ে বসে রইল। কান থেকে ফোন সরিয়ে সাবা আর তোয়ার দিকে তাকাল। ওরা দুজনই একসাথে মাথা নেড়ে জানতে চাইল, ” আবার কী হলো ? ”
-” আরমান আমার সাথে সরাসরি দেখা করতে চায়। দেখা না করলে সে নাকি আব্বুকে সব বলে পাঠাবে।”
-” ইশক হ্যায়….ইশক হ্যায় । হাঁ ইয়েহি ইশক হ্যায়। ” পাশ থেকে গেয়ে উঠল তোয়া। সায়রা প্রবল চড় কষাল ওর পিঠে। সাবা বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ল।
-” তারমানে আমরা চলে আসার পর ওখানে ব্যপারটা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল যে ছেলেগুলো আমাদের ট্র্যাপে ফেলে সুযোগ নিচ্ছিল। কী বলিস তোয়া? ”
-” হম, সেররকমই সম্ভাবনা ।”
-” হয়ত সে কারণেই তোর আরমান মিয়া তোরে ডাকসে। তারমানে দুই নম্বর সম্ভাবনা হল, তোর মিথ্যে কথাও ধরা পড়ে গেছে।”
-” কী মিথ্যে ? ”
-” এই যে তোর লাভার আছে আর সে আরমান মিয়ার টেংরি হাতে ধরাতে চেয়েছে।”
-” কীভাবে জানবে যে ওটা সজীব ভাই ছিল ? ”
-” প্রেমিক থাকতে কোন মেয়ে একা বান্ধবী নিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়ে অপদস্থ হয়না। গার্জেন গিরি করার জন্য হলেও তোর প্রেমিকের সেখানে থাকা উচিত ছিল। আরমান এখন কমনসেন্স খাটাবে আর সম্ভাবনাময় সব বিষয় আবিস্কার করবে। কারণ….!!”
-” কারণ…?” সায়রা তাকিয়ে রইল সাবার দিকে। সাবা চোখ টিপে বলল, ” ইশক হ্যায় ইশক হ্যায়…..হাঁ ইয়েহি ইশক হ্যায়।” ওর সাথে কোরাস তুলল তোয়া। সায়রার মুখ ফের লাল হতে শুরু করল এবার। আর তখনই ওর ফোন বেজে উঠল আঁতকে উঠে বলল, ” আরমানের ফোন।”
-” ধর, আশ্চর্য।”
-” কী বলব ? ”
-” আগে শোন কী বলে তারপর নাহয় বুদ্ধি করে জবাব দিবি।” সাবা হাত নেড়ে ইশারা করলে সায়রা কাতর ভঙ্গিতে ফোন কানে চাপল। ওর চেহারার রঙ ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেতে দেখে সাবা চিকন সুরে গান ধরল, ” ইশক হ্যায় ইশক হ্যায়..!” সায়রা ওর দিকে তাকিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বলে কোনমতে রাখি বলে ফোন কেটে দিয়ে রাগে ফেটে পড়ল দুই বন্ধুর ওপর।
-” এদিকে আমার জান যায় আর তোদের ফাজলামি কমে না।”
-” কী বলেছে সে ? ”
-” আমার সাথে সরাসরি কথা বলতে চায়।”
-” তো সমস্যা কী। বল ! কবে দেখা করবে বলেছে ? ”
-” আজকেই। এখনই।
(চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here