ত্রয়ী পর্ব ১

0
2906

ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি

১||
ফোন বাজতেই লাফিয়ে উঠল তোয়া। অথচ এত চমকানোর মত কিছুই হয়নি। তারপরেও বুকের ভেতরটা ধক ধক করছে। দ্রুত হাতে ব্যাগ হাতড়ালো। ফোনটা ব্যাগে নেই। খুব ভাল করেই মনে আছে স্কুল থেকে ফিরে ওটা ব্যাগেই রেখেছিল। অথচ এখন পাওয়া যাচ্ছেনা। ব্যস্ত হাতে বিছানায় অবহেলা ভরে পড়ে থাকা বালিশটা তুলে ফের আছড়ে ফেলল। ওটার নিচেও নেই। অথচ ফোনের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। টেবিলের ওপর বইখাতা সরিয়ে, সেল্ফের তাকগুলো হাতড়ে, খাটের নিচে উঁকি দিয়ে মোটামুটি সম্ভাব্য সবজায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেলার পরও যখন ফোনটা পেল না তখন খট করে ফ্যানের সুইচ অফ করে দিল। প্রবল বাতাসের শব্দে ফোনের শব্দ ঠাহর করতে বেগ পেতে হয়। বুদ্ধিটা কাজে দিল। মোবাইলের টানাটানা রিঙ টোন এখন স্পষ্ট। যে ফোন করেছে তার ধৈর্যও অপরিসীম। কারণ কল কেটে যাবার পর আবার কল দিয়েছে সে। আর এটাই প্রমান করে ফোনটা সায়রার। একমাত্র সায়রাই আছে যে ফোন না ধরা পর্যন্ত অনবরত কল করে যেতে থাকে। মেসেজের বেলাতেও তাই। অই তুই কই কিরে কই তুই কই ? এই জাতীয় ছোট শব্দের লম্বা একটা রেখা দ্রুত নিচের দিকে নামতে থাকে রিপ্লাই না দেয়া পর্যন্ত। তোয়া কতদিন এ নিয়ে রাগ করেছে। কিন্তু সায়রা সেকথা শুনলে তো।
শব্দটা বাথরুমের ভেতর থেকে আসছে মনে হবার সাথে সাথেই দৌড় দিল তোয়া। কারণ এখনই মনে পড়ল যে শেষবার কথা বলে বেসিনের তাকের উপর রেখেছিল ওটা। ফোনটা কানে চেপেই ধমকাল।
-” হ্যালো কী হইসে ? ”
-” কই থাকোস তুই যে সময়মত ফোন ধরস না ? ”
-” কই থাকি তুই জানোস না ? তোর বাড়ীর চার বাড়ী পরে থাকি। মালিবাগ রেললাইনের পাশের ব্লক লেন…!”
-” মোবাইলের ভিতর দিয়াই এখন লাত্থি খাবি একটা। আমার এদিকে জান যায় আর তুই আছিস রঙ তামাশা নিয়া।”
-” বয়সটাই তো রঙ তামাশার দোস্তো। বুড়া বয়সে তামাশা করলে তো লোকে হাসব।”
-” উফ্, আমার কথাটা শুনবি তুই ? ”
-” আচ্ছা, স্যরি। বল্।”
-” কাল ওরা আমাকে দেখতে আসবে। একটু আগেই এটা কনফার্ম হলো । আব্বু ওদের আসতে বলে দিয়েছে। পছন্দ হলে আংটি পড়িয়ে যাবে। ” কাঁদো কাঁদো গলায় বলল সায়রা। তোয়া চিন্তিত মুখে শব্দ তুলল।
-” খাইছে। এখনই বিয়ে ? আঙ্কেলের কী মাথা খারাপ হয়ে গেল ? ”
-” না, পেট খারাপ হইসে। আজ দুপুর থেকেই এই ঘটনা। একটু আগেও একটা ফিলমেট খাইসে। রাতের মধ্যে নরমাল না হলে এন্টিবায়োটিক খাবে। পেটের মেয়ে হয়েও মনে মনে আশা করেছিলাম আব্বুর এটা বেড়ে যাবে আর প্রোগ্রাম বানচাল হবে। এখন দেখি ঘটনা উল্টা। ”
-” যাহ্, কী বলিস না বলিস। আচ্ছা, আমাকে জরুরী তলব কেন দিলি ঐটা আগে ক ।”
-” একটু তোর সজীব ভাইয়াকে দিয়ে ছেলেকে কিছু বলে ওদের আসাটা ঠেকা না দোস্তো। সজীব ভাইয়া ঠিক পারবে। ওকে দিয়ে জাস্ট একটু টেকনিক্যালি বলাতে হবে যে আমি ওনার সাথে এনগেজড। ব্যস্ কেল্লা ফতে।” গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল সায়রা। আর তাতেই তোয়া চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ” তোর কী মাথা খারাপ হইসে ? ভাইয়ারে আমি এসব কথা বলব ? বললে ভাইয়া আমারে আস্ত রাখবে ? ”
-” আরে গাধি, এটা কী সত্যি নাকি ? তাছাড়া কে জানতে যাচ্ছে কে ফোন করেছে ? সজীব ভাইয়া বানিয়ে একটা নাম বলে দেবে আর ভাব করবে যে সে আমার লাভার। ”
-” সবই তো বুঝলাম কিন্তু ভাইয়াকে কীভাবে বলি বল তো ? ”
-” শোন্, আমি তোকে শিখিয়ে দিচ্ছি। তুই সজীব ভাইয়াকে বলবি….! আচ্ছা, এক কাজ কর। তুই ভাইয়াকে ফোন লাগিয়ে আমার সাথে কথা বলিয়ে দে। যা বলার আমি বলছি।” সায়রা যথাসম্ভব নিচু স্বরে নিজের কথা শেষ করল।
-” ওকে, ওয়েট।”

সজীবের ঘরটা বাড়ীর একেবারে শেষ মাথায় হওয়ায় কিছুটা নিরিবিলি। সজীব মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেবে বলে আদাজল খেয়ে লেগেছে। সে কারণেই বাড়ীর হৈ হুল্লোড় এড়িয়ে এক কোণে পড়ে থাকা।
ভারী পর্দা সরিয়ে ঘরে উঁকি দিল তোয়া। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকতেই সজীব ভাইয়ার লাল গেঞ্জির কোণটা চোখে পড়ল। বারান্দায় কার সাথে যেন কথা বলছে। তোয়া সামান্য উঁকি দিয়েই সরে এল ভেতরে। চট করে ভাইয়ের সেলফের সামনে এসে ওর ইংলিশ গ্রামার বইটা হাতে নিয়ে বেশ মনোযোগের সাথে নাড়াচাড়া শুরু করে দিল। পেছনে সজীবের পায়ের শব্দে সেই মনোযোগ আরো বেড়ে গেল তোয়ার।
-” কি করিস আমার টেবিলের সামনে? ” হালকা ধমকের সুরে বলল সজীব।
-” ওহ্, ভাইয়া। তুমি এসেছ। ইয়ে আমাকে ফ্রুটস অফ বাংলাদেশের উপর একটা ভালো সামারি খুঁজে দাও না। তোমার এই বইটাতে তো খুঁজলাম। পেলাম না।” হাতের মোটা গ্রামার বইটা দেখিয়ে বলল তোয়া।
-” ওটাতে পাবি না। গুগল সার্চ দিলেই তো হয়। দাঁড়া দেখছি…!”
-” তাড়াহুড়া নেই। সময়মত দেখো। আচ্ছা, ভাইয়া একটা উপকার করতে পারবে ? ”
-” আবার কী ? ”
-” না, মানে। সায়রাকে তো চেনো। আমার বান্ধবী। ওকে একটা ছেলে খুব ডিষ্টার্ব করে। ও সাহস করে বাসায় কিছু জানাতে পারছে না। তাতে ঝামেলা বেড়ে যাবে। তুমি তো জানো ওর বাবা কী পরিমান রেস্ট্রিকটেড। ঘূণাক্ষরেও যদি জানতে পারে যে সায়রাকে কেউ বিরক্ত করে জাস্ট বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দেবে। ছেলেটাকে কিছু বলে দুর করে দাওনা ভাইয়া ।”
-” কী বলিস ! আমি কী করব এখানে ? তাছাড়া বাসায় জানালে ঝামেলা বাড়বে কেন ? বাড়ীর মেয়ের এমন বিপদে তার পরিবার চুপ করে থাকবে এটা কেমন কথা ?”
-” আহা, একবার তো বললাম ওর বাবা অন্যরকম মানুষ। রয়্যাল ফ্যামিলি। মেয়ের এই জাতীয় সমস্যা হয়েছে শুনলে কাউকে কিছু বলবেন না। সোজা ওর স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেবেন। আর ধরে বিয়ে দিয়ে দেবেন। শেষে ওর লেখাপড়াই হবেনা। একটা ফুটন্ত ফুল মুকুলেই ঝড়ে যাবে। তাছাড়া ওর তো আর আমার মত বড় ভাই নেই যে গিয়ে ছেলেকে শাসিয়ে দিয়ে আসবে। এদিকে ছেলেটা সমানে সায়রাকে ডিস্টার্ব করছে।”
-” হমম….! ছেলেটা কোথায় থাকে ? মানে ওকে কোথায় পাওয়া যাবে ? আমার পরিচিত কিছু পোলাপান আছে। ওদের দিয়া সাইজ করালে আর ফোন দেবেনা। ” বীর বিক্রমে বলল সজীব। ” তুই ছেলের ফোন নম্বর দে ! ”
-” ইয়ে ভাইয়া, কাজটা খুব সাবধানে করতে হবে যেন সায়রার বাবার কানে না যায়। নইলে উনি নির্ঘাৎ সায়রার পড়াশোনা বন্ধ করে দেবেন।”
-” আচ্ছা, একটা কথা বুঝলাম না। সায়রা না বোরকা পড়ে ? ওকে ছেলেটা দেখলো কীভাবে যে ডিস্টার্ব করে ? ” তোয়া একটা বড়সড় ঢোক গিলল। তাই তো, এই প্রশ্নের উত্তর তো রেডি নেই। সজীব তাকিয়ে আছে। তোয়া দ্রুত সায়রাকে কল দিয়ে ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ” তুমি সায়রাকেই জিজ্ঞেস করো না। ” সজীব কিছু বলার আগেই ওর হাতে ফোন গুঁজে দিল তোয়া। নিজে চট করে সরে গেল সেখান থেকে।
-” হ্যালো, আস্সালামুআলাইকুম সজীব ভাইয়া। ভালো আছেন? ” ন্যাকা ন্যাকা কণ্ঠ সায়রার। সজীব সেসবের ধার দিয়ে গেল না। তার পড়তে বসতে হবে। সরাসরি প্রসঙ্গ টেনে বলল, ” তুমি তো সায়রা, তাই না? ”
-” জি, ভাইয়া।”
-” ঐ যে গ্রে কালারের বোরকা পড়ে আসো সবসময়, সে ? ”
-” জি, ভাইয়া।”
-” হম। তা ছেলেরা যে ডিস্টার্ব করে এটা তোমার বাবাকে তো জানানো উচিত। নইলে আজকাল কত রকম অকারেন্স ঘটছে। গার্জেনের কাছে কথা লুকানো উচিত না।”
-” আসলে ভাইয়া, আমার বাসা খুবই কনজারভেটিভ মাইন্ডেড ফ্যামিলি। তারা এসব শুনলে যেটা সহজ সেটাই করবে। আমার বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দেবে। আমি পরীক্ষা দিতে পারব না।”
-” যতদুর জানি তুমি বোরকা পড়ো। তার উপর গাড়ী করে আসো যাও। আজেবাজে ছেলেদের তো তোমার পেছনে লাগার কথা না। সে তোমার দেখা পেল কীভাবে ? ”
-” ইয়ে মানে…!”
-” দেখ, আমার সাথে চালবাজি করে লাভ নেই। আমি বোকাও নই। তোমার এই কথাটা তোমার বাবাকে বলে দেয়াটাই এখন আমার দায়িত্ব।
-” দেখুন, বাবাকে বলার মত হলে আমিই বলতাম। আপনাকে বড় ভাই ভেবেই কথাটা বলেছি। আমার নিজের বড় ভাই থাকলে এত কথা বলার দরকার পড়ত না। আচ্ছা থাক্, ঠিকাছে। আপনার কাউকে কিছু বলা লাগবে না। আমার লেখাপড়া আমার চিন্তা। আপনার তো আর কিছু না। আমার বদলে নিজের বোন হলে হয়ত ঠিকই বলতেন। এটাকেই বলে শেঠ আপনা পেট দেখ।”
-” দিনরাত হিন্দী সিরিয়াল দেখে দেখে ভালো পাকনামিই শিখেছ। ছেলের ফোন নম্বর দাও।”
-” জিরো ওয়ান সিক্স ফাইভ….!”
-” এক মিনিট। তুমি অন্য কোন ঝামেলা মিটাচ্ছো না তো আমাকে দিয়ে ? ”
-” আমি সেরকম মেয়ে না। তোয়ার কাছে জেনে নেবেন। আমার তেমন কোন ঝামেলাও নেই।”
-” তেমন কোন ঝামেলা নেই মানে, এমন কোন ঝামেলা আছে।”
-” না, ভাইয়া। আমি সেরকম ফ্যামিলির মেয়ে নই। ”
-” খুব ভাল। এবার নম্বরটা দাও।”

=====

আজ রবিবার। সাপ্তাহিক ছুটি শেষে ওরা আবার মিলিত হয়েছে স্কুলে। সায়রা তোয়াকে দেখেই খুশিতে জড়িয়ে ধরেছে। তোয়া নিজেও কম খুশি না প্রিয় বান্ধবীকে সাহায্য করতে পেরে। অতি উৎসাহে জানতে চাইল কাজ হয়েছিল কী না। সায়রা মহা উৎসাহে বলতে লাগল, ” কাজ হয়নি মানে ? দারুণ কাজ হয়েছে। আরমানদের বাসা থেকে জানিয়ে দিয়েছে ওরা পারিবারিক ব্যস্ততার জন্য এ সপ্তাহে আসতে পারবে না। পরে কবে আসবে সেটা ফোনে জানিয়ে দেবে। মানে বুঝেছিস ? তারা আর আসবেনা। বিয়ে করাতে রাজী না হলে পাত্র বা পাত্রীপক্ষ এই জাতীয় সান্ত্বনা বাক্য বলে পাঠায়। আহ্, কী শান্তি। তার মানে সজীব ভাইয়া খুব ভাল ভাবেই সাইজ করেছিল। আচ্ছা, আসলে কী বলেছিল তোর ভাইয়া সেটা তো বললিনা।
-” পুরো কথার সময় আমি সামনে ছিলাম না। আমি যখন ভাইয়ার রুমে ঢুকি তখন শুনলাম ভাইয়া বলছেন, ” সায়রার পেছনে লাগা বন্ধ না করলে নিজেই বিপদে পড়বি শালা। ওপাশ থেকে সম্ভবত জানতে চেয়েছিল ভাইয়া তোর কে হয়। ”
-” সজীব ভাইয়া তখন কী বলল ? আমি ওর সাঁইয়া ? ”
-” জি না, সজীব ভাইয়া এটা কোনদিনও বলবেনা। ভাইয়ার কাহিনী আছে।”
-” অহ্, তাই নাকি ? ” দমে গেল সায়রা।
-” জি। ভাইয়া তখন ফোনে ছেলেটাকে ধমক দিয়ে বলল, আমি কে সেটা জেনে তোর লাভ কী। তোরে যেন আর সায়রার আশেপাশে না দেখি। দেখলে টেংরি ভেঙে ফেলব। ”
-” ওয়াও। হোয়াট আ ডায়লগ। ”
-” হম। দেখতে হবেনা ভাইটা কার। নে, এবার ট্রিট দে।”
-‘ কিসের ট্রিট? ”
-” বাহ্, তোর যে এত বড় কাজ করে দিলাম ? ”
-” আচ্ছা, যা দিবনে। তার আগে ঐ পড়ুয়া পন্ডিতরে ফোন দে। ও না থাকলে কোন কাজই আসলে জমে না। বান্দি আসবে কবে ? ”
-” কাল ওর বাসায় ফোন করেছিলাম। ও এখনো রাজশাহী থেকে ফেরেনি।”
-” এখন ফোন করে দেখ। যদি এসে থাকে তো আমরাই ওর বাসায় যাই চল।”
-” গুড আইডিয়া।” তোয়া ফোন বের করল।

====

সাবরিনা সুলতানা সাবা। সায়রাদের সাথেই ক্লাস টেনে পড়ে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা নেই। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। ছিপছিপে শ্যামলা গড়ন। পড়াশোনায় তুখোড়। তবে গাঁটের জোর কম হওয়াতে কোচিং টিচার করতে পারেনা। একা যতটুকু পারে ততটুকুই। এ ব্যপারে সায়রা আর তোয়া ওকে দারুণ সাহায্য করে। ক্লাস ফোর থেকে ওরা একসাথে আছে। বন্ধুত্বে ফাটল তো দুর চিড়ও ধরেনি। সাবা বাড়ী ছিল না। খালাত বোনের বিয়ে উপলক্ষে রাজশাহী ছোটখালার বাসায় গিয়েছিল। আজ বিকেলেই বাড়ি ফিরেছে। খালাত ভাই বোনের সাথে জার্ণিটা বেশ ইনজয় করলেও দীর্ঘসময় বসে থাকতে গিয়ে সারা শরীরে খিঁচ ধরে গেছে ওর। আজ ওর সাথে খালাত ভাই মাহির আর ওর সমবয়সী রাইসাও ফিরেছে। মাহির কলেজে ভর্তির প্রসেসিং করবে আর রাইসা এসেছে এই সুযোগে ভাইয়ের সাথে বড়খালার বাড়ী বেড়াতে। বাড়ী ফিরে সাবা গোসল সেরে প্রথমেই একটা লম্বা ঘুম দিয়েছে। এমনকি কিছু খায়নি পর্যন্ত। টানা সন্ধ্যে পর্যন্ত আড়াই ঘন্টা ঘুমানোর পর মোবাইল ফোনের শব্দে ঘুম পাতলা হল ওর। তবে চোখ মেলল না বা বিছানা ছাড়ল না সে। এমন সময় গায়ে জোরেশোরে ধাক্কা খেয়ে চোখ মেলে প্রিয় দুই বান্ধবীকে দেখেই হেসে ফেলল।
-” হাই।”
-” তোর হাই এর খেতাপুরি। তুই যে ঢাকায় আসছোস এই তথ্যটা আমাকে আন্টির কাছ থেকে জানতে হলো কেন সেটা আগে বল। তোর কী উচিত ছিলো না আমাদেরকে ফোন করা ? ” কপট রাগে সায়রা কোমড়ে হাত রাখল।
-” ঘুম থেকে উঠেই ফোন করতাম বিশ্বাস কর। এত টায়ার্ড ছিলাম যে..!”
-” আচ্ছা, ওঠ। তোর সাথে অনেক জরুরী কথা আছে। কুইক। সন্ধ্যের আগেই বাড়ী ফিরতে হবে আমাকে।” সায়রা অধৈর্য স্বরে বললে সাবা কায়ক্লেশে বিছানা ছাড়ল। তোয়া ততক্ষণে ক্যাসেট খুঁজে নিয়ে গান চালিয়ে দিয়েছে।

চায়ের কাপ হাতে গোল হয়ে বসল তিনজন। সাবা পরপর দু’বার চুমুক দিয়ে বলল,” বাপরে, গত তিনদিনে এতোগুলো ঘটনা ঘটে গেল? আমাকে ফোন দিতে পারতি।”
-” আহা, মাইন্ড করিস ক্যান। ঘটনা তো ঘটলোই কালকে।” তোয়া জানাল।
-” তা ট্রিট হিসেবে কী পেতে যাচ্ছি আমরা? ” সাবা প্রসঙ্গ বদলালো। সে যত দ্রুত রাগ করে তত দ্রুতই আপোষ করে এটা তার স্বভাব বলে বন্ধুমহলে ওর চাহিদা বেশী। সে তুলনায় তোয়া রাগলে ওকে সহজে বাগ মানানো মুশকিল। এসবের মধ্যে সায়রা একেবারেই অন্যরকম। কখনও মেঘ কখনো বৃষ্টি।
তোয়া হঠাৎ ভিন্ন প্রসঙ্গ টানল।
-” বলাকায় যে নতুন মুভিটা আসছে ঐটা কিন্তু হেব্বি। আর্ট ফিল্ম তো, একটু অন্যরকম। কিন্তু ইয়ং জেনারেশনদের জন্যই নাকি মুভিটা। দেখতে যাবি ? ”
-” একা ? ” সাবার কথায় সায়রা ঢোক গিলল। তোয়া ঠেলা মারল।
-” তিনজন মানুষ আমরা। একা হলাম কোথায় ? চাইলে আমরা সাবার কাজিন রাইসাকে নিতে পারি। কী বলিস সাবা? ”
-” না না, ধুর। দরকার নেই। আমরা তিনজনই যাব। টিকিট কত টাকা ? ”
-” ঐটা আমার। কাজেই ঐ প্রসঙ্গ বাদ।” সায়রা বলল। সাবা চুপ মেরে গেল। তোয়া হঠাৎ বলল, ” আচ্ছা কী পড়ে যাব ? ”
-” অফকোর্স স্কুল ড্রেস। স্কুল বাঙ্ক দিয়ে কী আউট ড্রেসে যাব ? ” সায়রা জানাল।
-” স্কুল ড্রেস পড়ে গেলে আবার ঝামেলা হবে না তো । “তোয়া আশঙ্কা প্রকাশ করলে সাবা মাথা নাড়ল, ” আরে নাহ্, স্কুল ড্রেস পরবো কেন। বাসায় বলব, স্কুলে আজ প্রোগ্রাম ছিল। ব্যস্, কথা শেষ।”
-” বাহ্, তাহলে ডান। কিন্তু টিকিট ? ”
-” ঐটা আমরাই কেটে নিতে পারব। এতো ভেবে লাভ নাই। আচ্ছা শোন্, সিনেমা দেখে ফেরার আগে একটা ফাস্টফুডে ঢুকে কিছু খেয়ে নিতে হবে। কারণ স্কুলের টিফিন তো পাবোনা আমরা। বাসায় এসে ভাত খেলে সন্দেহ করবে।” সাবা বিজ্ঞের ভঙ্গিতে বলল।
-” হম, তা তো করবেই। যে আমি এতো ডায়েটিং করি সেই আমি দুইবার খাচ্ছি এটা মানবে না আম্মু। আর কেউ সন্দেহ না করলেও সজীব ভাইয়া ঠিকই সন্দেহ করবে।” তোয়া একমত প্রকাশ করল। অবশেষে সিদ্ধান্ত হল, ” কাল স্কুলের ঘন্টা পড়ার আগেই স্কুল চত্বর ছাড়বে ওরা। নয়তো গেট বন্ধ করে দিলে আর বেরুতে পারবে না।

সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা দুজন। শো শুরু হতে এখনও প্রায় আধা ঘন্টা বাকি। কিন্তু আগে না এসে উপায় নেই। এমনিতেই স্কুল থেকে বেরিয়ে গত এক ঘন্টা অযথা নিউমার্কেটে ঘোরাঘুরি করে কাটাতে হয়েছে। কিছু কেনার ছিল না তবু অনর্থক হাঁটাহাঁটি। এটা সেটা নেড়েচেড়ে দেখা আর ইভ টিজারদের টিটকারী শোনা। এরই মধ্যে এক ফাজিল সেলসম্যানের সাথে প্রায় বেঁধেই যাচ্ছিল সাবার। সায়রা ওকে টেনে না সরালে ঝগড়া বেঁধে যেত দুজনে। উপায়ান্তর না পেয়ে কয়েক প্যাকেট চিপস কিনে সিনেমা হল চত্বরে চলে এসেছে ওরা।
বিশাল পোস্টারে জলজল করছে নতুন মুভির স্টারদের রঙ বেরঙের ছবি। একবার দেখেই চোখ সরিয়ে নিল সাবা। ছবিটার ট্রেলর নেটে দেখার পরই ঠিক করেছিল এটা বড় পর্দায় দেখবে। আজ সায়রার সোর্সে সুযোগটা মিলেছে নইলে তিনজনে চাঁদা তুলেই দেখতে চলে আসত। রিয়া হাসানের কোন ছবি নাকি মিস করতে ইচ্ছে করেনা সায়রার। ও রিয়ার গ্রেট ফ্যান। ওর মতে রিয়া হল বাংলাদেশের সবচে স্মার্ট নায়িকা। ওকে নাকি বলিউডেই মানায় বেশী।

গায়ে হালকা ধাক্কা খেতেই ঘাড় ফেরাল সাবা। একটা চ্যাংড়ামত ছেলে অকারণেই ওর কাছ ঘেঁষে হাঁটাহাঁটি করছে আর অতি ব্যস্ত ভাব দেখাচ্ছে। যেন ধাক্কাটা সে ইচ্ছে করে দেয়নি। সাবা কঠিন চোখে তাকাতেই দেখল তোয়ার অবস্থা আরো বেহাল। দুটো ছেলে ওকে রীতিমত ঘিরে রেখেছে। তোয়া দেখতে অনেক ফর্সা বলেই কীনা কে জানে, ছেলেরা ওর গায়ের রঙে খুব দ্রুত মজে যায়। ঐদিকে সায়রার অবস্থাও খুব একটা ভাল অবস্থায় নেই। ওর পেছনেও দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে ওকে জরিপ করছে। সায়রা কিছুক্ষণ আগেও মুখ খোলা রেখেছিল এখন সম্ভবত ভয়েই ঢেকে রেখেছে চেহারাটা। গায়ে ফের একটা ধাক্কা খেয়ে সম্বিত ফিরল সাবার। রেগে মেগে কিছু বলতে যাবার আগেই একটা ছেলে বেশ ভদ্রভাষায় নিজের নাম পেশ করে হাত বাড়াল। অনেকটা সিনেমাটিক স্টাইলে। তার চেষ্টাকৃত গাম্ভীর্য মনের অবস্থা লুকাতে পারছে না। দেখেই মনে হচ্ছে ছেলেটা ধাপ্পাবাজ টাইপের। চুলগুলো স্পাইক কাট করায় স্মার্টনেস ধুয়ে মুছে সাফ তো হয়েছেই। বরং বখাটেদের মত লাগছে।”
-” আপনি ধাক্কা দিচ্ছেন কেন ? ” সাবা ধমকালো।
-” আমি তো তোমাকে ধাক্কা দেইনি বেইবি।”
-” সরে দাঁড়ান। ”
-” এটা পাবলিক প্লেস। সরে দাঁড়ানোর কথা বলার তুমি কে? ”
-” আমাকে তুমি বলছেন কেন ? ” সাবা রেগে গেলে তোয়া ওর হাত ধরে টানল। ইশারায় থামতে বলল। ইতোমধ্যে আরো দুটো ছেলে এসে জুটেছে। একজন আবার ওভার স্মার্ট। সে হাত বাড়িয়ে দিলো সাবার দিকে।
-” ফ্রেন্ড ? ”
-” কিসের ফ্রেন্ড ? আমি তো আপনাকে চিনি না।”
-” ফ্রেন্ডশীপ করতে চিনতে জানতে হয় না। জাস্ট হাই হ্যালোই কাফি। যাই হোক, আমার নাম নেহাল। বাপ-মায়ের একমাত্র ছেলে। বাপের বিরাট ব্যবসা। আমিই তার একমাত্র উত্তরাধিকার। এখন তো চিনলে আর সব জানলে। সো, লেট’স বি ফ্রেন্ডস।”
সাবা বিস্ময় লুকাতে পারলো না। বোবা বিস্ময়ে বান্ধবীদের দিকে তাকাতেই শুনল বেল বাজছে। দর্শকদের মধ্যে একটা তাড়া পড়ে গেল। সবাই হুড়মুড় করে ভেতরের দিকে ছুটলে ওরা তিনজনও নিজেদের হাত শক্ত করে ধরে হলে প্রবেশ করল। নিজেরাই সিট খুঁজে বসে পড়ল। মাঝে সায়রা আর ওর দু’পাশে সাবা আর তোয়া। সায়রাকে ওরা সবসময়ই মাঝখানে রাখে কারণ সায়রা ওদের দুজনের কাছেই মধ্যমনি। আড্ডা জমাতে আর গল্প বাজি করতে সায়রা যতটা ওস্তাদ ততটা ওরা দুজন নয়। সায়রা ছাড়া ওদের ত্রয়ী একেবারেই নিষ্প্রাণ।

হলের সমস্ত লাইট নিভে যেতেই তোয়া চাপা স্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলে সায়রাা ধমকালো।
-” আহা, কী শুরু করেছিস ? ”
একই সময়ে সাবাও উসখুস করে উঠল। প্রজেক্টরের ঝাপসা আলোয় সায়রা দেখল সেই ছেলেটাকে। যে বাইরে ওর সাথে কথা বলছিল। ঝট করে ঘাড় ফেরাতেই দেখল সায়রার অপর পাশেও আরেকজন। এই দলটাকেই বাইরে দেখেছে একটু আগে। তোয়ার পাশের ছেলেটা অনায়াসে তোয়ার কাঁধে হাত রেখেছে। সেই হাত ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। ছবি দেখবে কী, সায়রা ঘামতে শুরু করল। তোয়া চাপা স্বরে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তার নিজের দুর্দশার কথা জানাল। এমন সময় নেহাল নামের ছেলেটা তার বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলল, ” রাজু, তিনটারে আজকা উড়ায়া নিয়া গেলে কেমন হয় ? ”
-” জোশ হয়। তবে আগে সিনেমা দেইখা লই।”
-” ওকে, তবে মনে রাখিস। মাঝখানেরটা কিন্তু আমার।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here