ধ্রুবতারা
পর্ব_১৭
পুষ্পিতা_প্রিমা
প্রায় দশদিন পর
সকাল দশটার দিকে তাননা আহম্মেদ বাড়িতে পা রাখলো। সাথে ঈশান ও এসেছে। বাড়িতে পা রাখার পর সবার থমথমে মুখ দেখে তাননা বুঝে উঠতে পারলো না কিছু। কিন্তু রাহাকে না দেখে সন্দেহ তীব্রতর হলো। সোরাকে জিজ্ঞেস করল
‘ রাহাকে কেন পাঠিয়েছ?
সোরা বলল
‘ বেড়াতে গিয়েছে।
তাননা বলল
‘ তা ঠিক আছে, কিন্তু বাবাই আমাকে এত তাড়া দিল কেন আসার জন্য। এখানে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?
সোরা বলল
‘ না কিছু হয়নি। এমনি আসতে বলেছে।
তাননা কপট রাগ দেখিয়ে বলল
‘ মুননা কোথায়? সে তো আমি মরে গেলে ও যাবে না, আবার আমি না গেলে গরম কিভাবে দেখায়! ফোন বন্ধ কেন ওর?
সোরা বলল
‘ আসার সাথে সাথে কেউ এভাবে রাগ দেখায়? মুননা এমনিতে ও কোথাও যেতে চায় না। তোমার নানুর বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কতবার ডাকতে হয়।
তাননা বলল
‘ ডাকতে হবে না। সো তো লাট সাহেব। নিজের মর্জিমতো চলবে সে। কার কথায় কি যায় আসে? বোন বলে কেউ আছে নাকি তার?
ঈশান বলল
‘ আচ্ছা এখন কি রোয়েন আছে? শুধু শুধু আন্টির উপর রাগ দেখাচ্ছেন কেন?
তাননা হনহনিয়ে চলে গেল।
রোয়েন হসপিটাল থেকে ফিরল দুপুর নাগাদ। তাননাকে দেখে সামান্য অবাক হলে তা তার চেহারায় দেখা গেল না। আঁড়চোখে একবার তাকিয়ে হেঁটে গেল। জিশানকে কোলে তুলে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ কেমন আছ মামা?
জিশান রোয়েনের কোলে মোচড়ামুচড়ি করতে করতে বলল
‘ আম্মা মামার সাথে কথা বললে মারবে বলেছে।
রোয়েন যেতে যেতে বলল
‘ আসুক দেখি কিভাবে মারে? আমি মেরে বসিয়ে রাখবো।
জিশান দাঁত দেখিয়ে হাসলো। তাননা রোয়েনের পিছু পিছু আসলো। রোয়েন সাদা এপ্রোন তাননার দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল
‘ তুননু ঝগড়া করিস না বোন। প্রচুর টায়ার্ড। একটু ফ্রেশ হতে দে আগে। তারপর ঝগড়া লাগাস।
তাননা নাক ফুলিয়ে চেয়ে রইলো। এপ্রোনটা রোয়েনের মুখে ছুঁড়ে মেরে বলল
‘ তোর বউ কোথায়?
রোয়েন কান চুলকাতে চুলকাতে বলল
‘ জেনে ও আবার প্রশ্ন করার রোগ তোদের কোনোদিন যাবে না দেখছি।
তাননা বলল
‘ একদম ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলবি না মুননা। রাহাকে নিয়ে আসছিস না কেন? তুই কি কোনোদিন ঠিক হবিনা?
রোয়েন মুখ হাত ধুঁতে চলে গেল। তাননা জিশানকে বলল
‘ তোমাকে বলেছি এই হারামির কোলে উঠবে না?
জিশান বলল
‘ মামা ভালো। চকলেট দিছে।
তাননা বলল
‘ একদম চুপ। জিশান কেঁদে দিল। রোয়েন তাড়াহুড়ো করে এসে তোয়ালে নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল
‘ তুই এত ঝগড়াটে কবে হলিরে?
তাননা নিশ্চুপ। রোয়েন জিশানকে কোলে তুলে নিয়ে শান্ত করতে করতে বলল
‘ পঁচা আম্মার সাথে কথা বলবে না ঠিক আছে?
জিশান মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ ঠিক আছে। রোয়েন মৃদু হাসলো। তাননার দিকে তাকিয়ে বলল
‘ আয়।
তাননা মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকলো। রোয়েন বলল
‘ আয় আয়। কই এসে ভাইকে একটু জড়িয়ে ধরবি তা না করে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছিস।
তাননা এসে দুম করে কিল বসালো রোয়েনের পিঠে। রোয়েন চোখমুখ কুঁচকে ফেলে বলল
‘ মেয়ে মানুষের হাঁড় এত শক্ত কেন? লেগেছে ভীষণ।
তাননা নাক ফুলালো। রোয়েন এক হাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ তুই রাগ করলে আমার হাসি পাই। তুই রাগিস না। শুধু হাসবি।
তাননা বলল
‘ কথা বলবি না আমার সাথে। তোর সাথে কথা বলব না এই ভেবে এসেছি আমি। আমাকে দেখতে যাস না একবার ও। মামা আর বাবাই ছাড়া কেউ যায় না। তুই নাহ আমার ভাই?
রোয়েন বলল
‘ যাব যাব। কাঁদিস না।
তাননা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আর ও কাঁদলো। রোয়েন বলল
‘ যেদিকে যাই সেদিকে জ্বালা। তুই আমাকে পীড়ার উপর পীড়ার দিতে এলি?
তাননা বলল
‘ হ্যা। রাহাকে নিয়ে আয়।
রোয়েন জিশানকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বলল
‘ আমি কি যেতে বলেছি? আমার কিসের দায়?
তাননা রোয়েনের পিছু পিছু দৌড়ে গিয়ে বলল
‘ তুই চাচ্ছিসটা কি?
‘ আমার চাওয়া খুবই সীমিত। আর সেখানে রাহা সম্পর্কিত কোনোকিছু নেই।
রাতে নাহিল বাসায় ফিরেছে। তাননাকে দেখে খুশি হলো। তাননা থাকলে সে জোর পায়। সাপোর্ট পায়। কিন্তু রাহাকে নিয়ে তার সিদ্ধান্ত কি ভুল না ঠিক তা সে নির্ধারণ করতে পারছেনা। তাননা কি তাকে সমর্থন করবে?
খাওয়া দাওয়া শেষে নাহিল রুমেই ডেকে আনলো তাননাকে। যাতে রোয়েনের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলে দেখে। রোয়েন এভাবে দু নৌকায় পা দিয়ে চলতে পারেনা। হয়ত রাহাকে রাখতে হবে নয়ত ছাড়তে হবে। তাননা সবটা শুনে যেন বোকাবনে গেল। নাহিলকে বলল
‘ তুমি বাবা হয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত অনায়াসে কি করে নিয়ে নিলে? রাহা মুননাকে ডিভোর্স দিতে চায়? ডিভোর্স কি সব সমস্যার সমাধান?
নাহিল বলল
‘ রাহা ও চায় ডিভোর্স হোক।
তাননা বলল
‘ আমি বিশ্বাস করি না।
নাহিল বলল
‘ তাননা,, মুননার মন নেই এই সম্পর্কে। তার উপর জোর কাটাতে পারিনা আমরা। তাছাড়া ওদের বিয়ের কথা তেমন কেউ জানেনা। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবেনা। আমি রাহাকে অন্য কোথাও বিয়ে দেব। মুননা ও রাহার চাইতে ভালো কাউকে পেলে বিয়ে করে নেবে , আপত্তি নেই আমাদের। ছেলের বউ হিসেবে ঘরে তুলবো।
আমি চাই তারা দুজনই ভালো থাকুক। শান্তিতে থাকুক। রাহাকে চাপিয়ে দিয়ে মুননার সাথে জোরদবস্তি করতে চাই না আমি। দেখা যাবে মুননা মেনে নেবে রাহাকে কিন্তু ওর আফসোস থেকে যাবে। আমি চাই না আমার মেয়ে কারো আফসোসের কারণ হোক। রোয়েন বোধহয় তার পছন্দের কথা বলতে চাইনা আমাদের, হয়ত অন্যকোথাও পছন্দ আছে। কিংবা লজ্জায় বলতে পারেনা। তাই তো রাহাকে সবার সামনে নিজের স্ত্রী স্বীকার করতে বাঁধে তার। সে যাইহোক তেমন যদি হয়ে থাকে রোয়েন সে মেয়েটার সাথে ও অন্যায় করেছে সাথে রাহার সাথে। তবে আমি চাই এতটুকুতে ও সমাধানের পথ আছে। মুননাকে সুযোগ দেওয়া দরকার। তার মর্জিমাফিক চলার অধিকার তার আছে।
তাননা মাথা নিচু করে বসে রইলো। নাক টেনে বলল
‘ আমি জানি এসব তুমি রাগ অভিমান থেকে বলছো? কেন করছ এমন? তোমরা সবাই এরকম করলে সব শেষ হয়ে যাবে। তোমার সিদ্ধান্ত ভুল। রাহা কি’বা মুননার যদি ছাড়াছাড়ি হয়ে ও যায় তাহলে তারা কি নতুন করে সব শুরু করতে পারবে? মানলাম পারবে। রাহাকে তুমি বিয়ে দিলে। রাহা ভালো মেয়ে। ভালো ছেলের হাতে যাবে ও। সংসার হবে ওর কিন্তু ওর মন পড়ে থাকবে ওই একজনের কাছে। হয়ত ভুলে যাবে ধীরেধীরে কিন্তু তা মৃত্যু যন্ত্রণার চাইতে যন্ত্রণার বাবাই। বাবাই রাগের উপর নির্ভর করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো না। ভুল তোমার সিদ্ধান্ত। রাহা হয়ত উপরে বলছে সে ডিভোর্স চায় কিন্তু ও মন থেকে কখনো চায়বেনা। আমি রাহাকে চিনি, জানি, বুঝি। হয়ত তুমি ও বুঝতে পারছো, কিন্তু না বুঝার ভান করছো।
নাহিল বলল
‘ আমি বুঝে কি হবে? তোমার ভাই ডিভোর্স পেপার রেডি করতে বলেছে। সে পিএইচডি নেবে, বলেছে তার আগে যেন সব মিটমাট করার ব্যবস্থা করি। রাহার জন্য সামান্যতম মায়া যদি ওর থাকতো তাহলে সে একথা বলতে পারতো না কখনো।
তাননার চোখ খসে জল পড়ে। এটা কিছুতেই হতে পারেনা। ভুল হচ্ছে সবার।
রোয়েনের কাছে যেতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে তাননা। রোয়েন তাকে ব্যঙ্গ করে বলল
‘ রাহার হয়ে তুই কাঁদছিস নাকি? রাহা ও তো এতটা কখনো কাঁদেনি। আরেহ বাদ দে ভুলে যাহ এসব বিয়ে টিয়ে হয়েছে। মনে কর বিয়ে ও হয়নি। ডিভোর্স ও হয়নি। সব স্বাভাবিক। ভেবে নে রাহার বিয়ে অন্যকোথাও হয়ে গিয়েছে। আমার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
তাছাড়া আমার কাছে সবকিছুর আগে আমার ক্যারিয়ার। আমি এই ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করতে পারবো না।
তাননা ক্ষেপে গিয়ে বলল
‘ আমিই তাহলে ভুল ছিলাম। পাথরে কখনো ফুল ফুটেনা এটা ভুলে গিয়েছিলাম সাময়িকের জন্য। তোর যখন চলে যাওয়ার এতই তাড়া তাহলে রাহাকে বিয়ে করেছিলি কেন? তখন ভাবিসনি যে তোকে চলে যেতে হবে?
‘ ভাবিনি। আর সেটাই আমার জীবনে সবচাইতে বড় ভুল ছিল। যাইহোক রাহার আব্বাকে গিয়ে বলে আয় সব রেডি করতে, দেরী করলে ওনারই লস। ছাড়াছাড়ি না হলে মেয়েকে বিয়ে দেবে কি করে? যাহ।
তাননা দাঁড়িয়ে থাকলো শক্ত হয়ে, রোয়েন নিজেই বের হয়ে এল। সালেহা বেগম রোয়েনের পিছু পিছু যেতে যেতে বলে।
‘ ভাই এমনটা করিস না। আল্লাহ তোরা চাচা ভাইপো কি করছিস এসব? কেন করছিস?
সোরা নাহিলের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। সোরা বলল
‘ আমি তো রাহাকে শুধু একটু দূরে রাখতে বলেছি। ছাড়াছাড়ি নয়।
নাহিল বলল
‘ দূরে রেখে কি বুঝলে? সে মর্ম বুঝল তোমার মেয়ের? সোরা পাগলামি করো না। যেখানে রাহা ফিরতে চায়না সেখানে তুমি আমি কে? রাহা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওর সাথে কথা বলেছি আমি। ও ফিরবেনা মুননার কাছে। অবহেলা অবজ্ঞা ভালোবাসা নামক জিনিসটিকে ভেঙ্গে ছুরমার করে দেয় সোরা। তুমি বুঝবে না। কারণ তুমি তো অবহেলা অবজ্ঞা এমনকি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ও আমি তোমাকে ছাড়িনি। হেলা করতে পারিনি। নির্লজ্জের মতো চেয়ে গিয়েছি তোমায়। সবাই আমার মতো না ও হতে পারে। আমার মতো সহ্যশক্তি রাহার নাও থাকতে পারে?
সোরা বিপুল বিস্ময় নিয়ে নাহিলের প্রত্যেকটা বিষবাক্য শ্রবণ করলো। শেষে বলল
‘ আপনি শাপ দিয়েছিলেন আমায় তখন? আর সেজন্য আজ আমার মেয়ের এই অবস্থা?
নাহিল হাসলো। বলল
‘ সাবাশ সোরা। কোথায় আঘাত করতে হয় ভালো করেই জানো। ” আমার মেয়ে ” কথাটা বেশ ভালো শোনায় তোমার মুখে। আমারই ভুল হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। ভুলে আমি আমার মেয়ে বলে ফেলি। এবার থেকে সাথেসাথে শুধরে দিও।
এভাবে একমাস পার হলো টানাহেঁচড়ায়।
সন্ধ্যায় কফি হাতে নিয়ে ছাদের কর্ণারে দাঁড়িয়েছিল রোয়েন। ওই বাড়ির ছাদ থেকে জাহেদা ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করল
‘ ভাই তোর বউ তো ফিটফাট। এবার ধুমধাম করে বিয়েটা সেড়ে নে ভাই। তোর বিয়েতে গান ধরবো আমি। কতদিন গাই না। জানিস আমি আমাদের পাড়ার মাস্টারের কাছে যখন অ আ শিখছিলাম তখন গান করতাম। সবাই আমার গানে প্রশংসা করতো। তোর নানাকে ও কতবার শুনিয়েছি।
রোয়েন কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল
‘ গান পারো ভালো কথা। এভাবে বলে বেড়ানোর কি আছে? তোমার গান শুনে নানাভাই নির্ঘাত সেদিন হসপিটালের কাজে বআর মন বসাতে পারেনি।
জাহেদা বলল
‘ এ কেমন কথা বললি ভাই। আমার গানের প্রশংসা করতো তোর নানা। এভাবে বলতে পারলি?
রোয়েন হেসে ফেলল। বলল
‘ রাহা আমায় শুনিয়েছিল গান একবার। বিশ্বাস করো বমি পেয়েছে আমায়। এত বাজে লিরিক্স ও হয়?
জাহেদা বলল
‘ এতে রাহার কি দোষ? লিরিক্সের দোষ।
রোয়েন বলল
‘ নাহ নাহ। রাহার দোষ। রাহা দোষী। ভীষণ।
জাহেদার সাথে একপ্রকার ঝগড়া করে নিচে নেমে এল রোয়েন। আর মাত্র কটা দিন আছে সে এখানে। যেতে ও ইচ্ছে করছেনা। তবে সন্ধ্যার দিকে কালো কোর্ট পড়া একজন লোক এল সুখবর নিয়ে। হাতের কাগজটি রোয়েনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ স্যার আপনাকে কাল সকালে কোর্টে যেতে হবে।
রোয়েন কাগজটিতে চোখ বুলিয়ে কপাল ভাঁজ করলো। বলল
‘ একটা স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য কোর্টে যাওয়ার কি দরকার? কাগজ আনবেন আমি সাইন দেব।
উকিল বলল
‘ সরি স্যার। যে লয়ার কেসটি নিয়েছেন উনি আপনাদের সামনাসামনি বসিয়ে স্বাক্ষর নিতে চাচ্ছেন। আপনাকে কাল সকালে যাওয়ার জন্য এই লেটারটি পাঠানো হয়েছে।
রোয়েন কাগজটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।
সোরা এসে পেছনে দাঁড়ালো। বলল
‘ এটা কি মুননা?
রোয়েন বলল
‘ কই না। তেমন কিছু না।
সোরা বলল
‘ আচ্ছা।
সকাল আটটায় এডভোকেট হাশিম উদ্দীনের অফিসের উদ্দেশ্যে বের হতে না হতেই তাননা এসে ঝাপিয়ে পড়ে রোয়েনকে আটকালো। বলল
‘ এত বড় ভুল করিস না ভাই। আমার কথা শোন।
রোয়েন বলল
‘ ছাড়। এসব ভালো লাগছেনা। শান্তি চাই আমার।
তাননা বলল
‘ তুই ডিভোর্স দিয়ে দিবি?
রোয়েন বলল
‘ হ্যা দেব। আর কি? কাগজে কলমের বিয়ে কাগজে কলমেই শেষ।
তাননা বলল
‘ কেয়া বলেছে আমায়। কাজী তোদের বিয়ে পড়িয়েছিল। কেন এমন করছিস?
রোয়েন গর্জে বলল
‘ পথ ছাড়।
তাননা টেবিল থেকে ফুলটব তুলে আঁছাড় মারলো ওয়ারড্রবের দিকে ছুঁড়ে মারলো। দেয়ালে টানানো ছবিটা ধপ করে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল। রোয়েন গর্জে বলল
‘ কি করেছিস এটা? আম্মা!
রোয়েন দৌড়ে গেল। ছবিটা কুড়িয়ে নিয়ে বলল
‘ এটা আমাদের চারজনের ছবি। কি করলি এটা?.
তাননা বলল
‘ বেশ ভালো করেছি।
বলেই গটগট পায়ে হেঁটে কেঁদে চলে গেল তাননা। রোয়েন ছবিটা তুলে বুকে জড়ায়। এটি আবার বাঁধাতে দিতে হবে।
কোর্টে যাওয়ার পথে বাঁধাতে দিয়ে আসতে হবে।
রোয়েন ছবিটা বাঁধাতে দিয়ে কোর্টে গেল। এডভোকেট হাশিম উদ্দিনের অফিসে গিয়ে বসে থাকলো চেয়ারে।
হাশিম উদ্দিন এসে দেখলো চেয়ারে কালো শার্ট পড়া একজন যুবক বসে আছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন
‘ ওয়েলকাম টু মাই অফিস ডক্টর রোয়েন।
রোয়েন দাঁড়ালো। কিঞ্চিৎ হেসে বলল
‘ নাম ধরে ডাকতে পারেন। আপনি আমার আব্বার বয়সী।
হাশিম উদ্দিন বললেন
‘ ইটস ওকে। চা না কফি?.
‘ কিছুনা। আমাকে বেরোতে হবে, যা করার একটু তাড়াতাড়ি করুন।
হাশিম উদ্দিন বাইরে চোখ রেখে বলল
‘ রতন ম্যাডামকে আসতে বলো।
রোয়েন ঘড়ির কাটা দেখলো। তাননা কি করছে কে জানে?
রোয়েন টের পেল পাশের চেয়ারে এসে কেউ একজন বসেছে। মহিলা হয়ত। রোয়েন ফিরে দেখার চেষ্টা করলো না।
তবে ফিরে দেখতে হলো যখন হাশিমউদ্দীন বললেন
‘ রাহা স্যারকে ঝটপট বলে ফেলো তোমাদের মাঝে কি সমস্যা?
রোয়েন সাথে সাথে পাশ ফিরে তাকালো। মাথায় সাদা ওড়না পরিহিতি রাহা ওড়না আরও একটু টেনে দিল। উসখুস করলো। হাশিমউদ্দীন বলল
‘ তোমার এত হেজিটেশন কেন রাহা? তুমি তো আমাকে চেনো। তাছাড়া তুমি ও লয়ার হবে শীঘ্রই।
রাহা খানিকটা রোয়েনের দিকে তাকাতেই রোয়েন উকিলের দিকে ফিরে ঝটপট বলল
‘ আমাদের মাঝে কোনো সমস্যা নেই।
কপাল কুঞ্চন করে চাইলো রাহা। হাশিম উদ্দীন বলল
‘ তাহলে ডিভোর্স হচ্ছে কেন?
রোয়েন বলল
‘ বিয়েটা এক্সিডেন্টলি হয়েছে তাই নামমাত্র সম্পর্কটা রেখে লাভ কি? তাড়াতাড়ি কাগজ দিন, সই করি।
হাশিমউদ্দীন বলল
‘ উপযুক্ত কারণ ছাড়া ডিভোর্স হতে পারবে না। তাছাড়া অনেক সময় যারা এখানে তাদের মাঝে এত কলহ হয় যে আমি নিজেই বিরক্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু তোমাদের মাঝে এমনটা নেই। কারণ কি?
রোয়েন সচকিত চোখে তাকালো। বলল
‘ মুক্তি চাইছি আমি। তাই এতকিছু। তাড়াতাড়ি কাগজ বের করুন। তাড়াতাড়ি করুন। বসে থাকবেন না।
হাশিমউদ্দীন বলল
‘ এত ছটফটানি মুক্তি পাওয়ার জন্য। অবশ্য মুক্তি কে না চায়?
কাগজ বের করলেন তিনি । বুক ধুকপুক করে উঠলো রাহার। চোখজোড়া জ্বলে উঠলো। রোয়েন কাগজটির দিকে চেয়ে রইলো নির্নিমেষ। কি আশ্চর্য একটি কাগজের কারণে মানুষ একে অপরের কাছে থাকার অনুমতি পায়, আবার সেই একি কাগজের কারনেই বিচ্ছেদ হয়। মানুষ একে অপরের কাছ থেকে বহুদূরে হারিয়ে যায়। এত বিচ্ছিরি নিয়ম কেন?
হাশিমউদ্দীন রাহার দিকে কলম বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ আগে তুমি দাও তাহলে। নাও। এই জায়গায় স্বাক্ষর বসাও।
রাহা কলম হাতে নিয়ে এলোমেলো ছিন্নভিন্ন শব্দমালায় নিচু স্বরে বলল
‘ আ–মি দে–ব?
হাশিমউদ্দীন বলল
‘ হ্যা। মুক্তি তো তোমার হাতেই।
রাহা মাথা নামিয়ে ফেললো। কাঁপা-কাঁপা হাতে কলম হাতে নিল। কলমের ভর দিয়ে সাইন বসিয়ে দিল। রোয়েন শুধু স্বাক্ষরটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। হাশিমউদ্দীন দেখল রাহার চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এসেছে। তারপর ধীরেধীরে অশ্রুকণা ঝড়তে লাগলো কপোল বেয়ে যা রোয়েনের চক্ষুর অগোচরে।
হাশিমউদ্দীন রোয়েনকে বললেন। রোয়েন কলম হাতে নিল। খসখস করে স্বাক্ষর বসালো ডিভোর্স লেটার কাগজটিতে। তারপর চেয়ার ঠেলে বের হয়ে গেল অফিস থেকে। নাহিল দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। রোয়েন তার সামনাসামনি গিয়ে বলল
‘ মুক্তি পেয়ে গেছি। ধন্যবাদ আপনাকে।
নাহিল ব্যাথাতুর নয়নে তাকালো। রোয়েন তা উপেক্ষা করে চলে গেল।
রাহা অফিস থেকে দৌড়ে বের হলো। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল আওয়াজ করে। নাহিল দৌড়ে আসতেই রাহা ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো নাহিলকে। বলল
‘ আব্বা আমি মুক্তি দিতে চাইনি। বিশ্বাস করো চাইনি।
উনি দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলেন। কোনো কথা বলার সুযোগ দেয়নি আমাকে। তাই মুক্তি দিয়ে দিলাম আমি। আমার হাতে কিচ্ছু ছিলনা আব্বা। আম্মাকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি আমি। যে আমার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটপট করে সে কখনোই আমাকে চায় না আব্বা। আমি কেন এখনো প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারলাম না।
নাহিল মেয়েকে ধরে রাখে বুকের সাথে।
রাহা বলল
‘ আমি বাড়িতে ফিরব না আব্বা। আম্মাকে কি বলব আমি? আমি উনাকে আর দেখতে চাই না। নাহিল বলল
‘ ঠিক আছে। নোহার সাথে থাকবে।
রোয়েন বাড়ি ফিরতেই সোরা দৌড়ে আসে হাসিমুখে। রাহার আব্বা যে বলেছিল রাহা ডিভোর্স দেবে না। তারমানে দেয়নি! রোয়েন ও এব্রোড যাবেনা। রাহাও তো তাকে ফোনে একথা বলল। কিন্তু রোয়েনের মুখ দেখে কিছু বুঝার জোঁ নেই। সোরা রোয়েনের কাছে দৌড়ে গেল। বলল
‘ রাহা কোথায় আব্বা? রাহা? তোমার বাবাই? ওরা আসেনি? সব ঝামেলা মিটিয়ে নিয়েছ তো?
রোয়েন বলল
‘ হ্যা, সব ঝামেলা চুকে গিয়েছে। আমি ও মুক্তি পেয়ে গেছি।
সোরা টলমলে চোখে তাকিয়ে থাকলো। চিল্লিয়ে বলল
‘ তাহলে আমাকে মিথ্যে বললো কেন ওরা? কেন বললো? ওরা বাপ মেয়ে মিথ্যুক। আমার সাজানো গোছানো সংসারটা এলোমেলো করে দিল ওরা।
রোয়েন বলল
‘ সব দোষ আমার।
সোরা কষে চড় বসালো রোয়েনের গালে। বসিয়ে বলল
‘ দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে। সবাই মিথ্যুক। সবাই মেতে উঠেছে আমার সাজানো সংসারটা ভেঙে দেওয়ার জন্য। যাও তুমি। আমাকে জীবনেও মামুনি বলে ডাকবে না।
চলে যাও দূরদেশে। এখানে তোমার আপন বলতে কে আছে?
গাল একপাশে ফিরিয়ে ছলছল চোখে সোরার দিকে চেয়ে রইলো রোয়েন।
সালেহা বেগম আর তাননা চেয়ে রইল অপার বিস্ময় নিয়ে।
তাননা বলল
‘ এবার শান্তি হয়েছিস? এবার যাহ, যেখানে ইচ্ছে সেখানে। রাহার চাইতে বেশি তোকে কে ভালোবাসবে তার কাছে যাহ।
তাননা রোয়েনের হাত ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে এল। তারপর মুখের উপর দরজা টেনে দিতে দিতে বলল
‘ মরে গেছে আমার ভাই। আম্মা আব্বার মতো আজ ভাইটা ও মৃত হয়ে গেল আমার। মরে গেছে মুননা।
চলবে
এই উল্টাপাল্টা গল্পটা একটু উল্টাপাল্টা কমেন্ট আশা করে আমি জানি। 😔😔😔