ধ্রুবতারা
পর্ব_১৯
পুষ্পিতা_প্রিমা
নোহার বিয়ের তারিখ পড়লো। সোরাকে ফোন করে ফেরার জন্য তাড়া দিল আনহা। বলল
‘ নোহার বিয়ে তুই আসবি না সোরা?
সোরা জবাব দিল না খানিকক্ষণ। কিন্তু পরে বলল
‘ আসব মেহেদী সন্ধ্যায়।
‘ আঙ্কেল আন্টি আর সাদিদকে ও নিয়ে আসবি।
সোরা বলল
‘ ঠিক আছে।
স্বস্তি পেল আনহা।
মেহেদী সন্ধ্যার দিন ঘনিয়ে এল। পুরো বাড়িতে সাজ সাজ রব। যেন নতুন বধূর সাথে বাড়িটা ও সেজেছে। অতিথিদের আগমনে ভরপুর পরিবেশ। নোহার জোরাজুরিতে রাহা ও শাড়ি পড়েছে। শাড়ি জিনিসটা ভীষণ বিরক্তিকর রাহার জন্য। মেহেদী সন্ধ্যায় গায়ে হলুদের শাড়ি পড়া নোহাকে দেখে জাহেদার আহাজারি বেড়ে গেল। অতীত কেন পিছু ছাড়ে না। চোখের সামনে ভেসে উঠছে নিজের মেয়ের গায়ে হলুদের শাড়ি পড়া সেই দৃশ্য। কি সুন্দর লেগেছিল সেদিন জুননুকে? আজ তার ভাইঝির গায়ে হলুদ? জুননু তো দেখেই যেতে পারলো না ভাইঝি ভাইপোকে।
গায়ে হলুদের শাড়ি গায়ে নিজের মেয়েকে ও চিনতে সময় নিল জায়িদ। নোহা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলো আব্বার দিকে। চোখের কোণায় এসে জড়ো হলো জল। আব্বার বোধহয় ফুপীর কথা মনে পড়ছে? ভাই ও এমন হয় আব্বাকে না দেখলে বুঝতো না নোহা। নিজে গিয়ে জায়িদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নোহা। জায়িদ মেয়ের মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে চুপ করে রইলো। ভাবলো
‘ জুননু আজ তোর মতো করে আমার মেয়ে সেজেছে। তুই দেখলি না বোন। তোর হাসিটা দেখার ভাগ্য হলো না আর। আমার মেয়েটা একদম তোর মতো হয়েছে। আর বরটা তোর বরের মতো।
____________
উঠোনে বিশাল আকারের স্টেজ সাজানোর কাজ চলছে। তুখোর মেজাজে রোয়েনের চেঁচানোর আওয়াজ ভেসে আসছে। তাননা ঈশান আর জায়িদ ছুটে গেল সেদিকে। রাহা ভাবলো কি হয়েছে আবার? সে ও গেল পিছুপিছু। গিয়ে জানতে পারলো স্টেজ সাজানোর লোকগুলো অতিরঞ্জিত করতে গিয়ে স্টেজটাকে যা তা বানিয়ে ফেলেছে। জায়িদ বলল
‘ সমস্যা নেই তো। কিছু হবে না এতে।
রোয়েন বলল
‘ বিয়ে একবার হচ্ছে। বারবার হবে না। কাজের প্রতি কোনো মনোযোগ নেই এদের।
তাননা গিয়ে দাঁড়ালো সেখানে। বলল
‘ তোর বিয়ের সময় সাজাস তোর মনের মতো।
রোয়েন তাননার দিকে তাকিয়ে বলল
‘ তোর সাথে কথা বলছি না আমি। মাথা খারাপ করবি না। চড় পড়তে দেরী হবে না।
তাননা বলল
‘ তুই মারলে আমি ও মারবো। তুই কি আমার বড়?
জায়িদ বলল
‘ আহা এ সময় ঝগড়া কেন? বাড়িভর্তি লোক।
রোয়েন দাঁত চেপে আমি তোর বড়। বড় ভাই ডাকবি। যাহহ।
মুখ চেপে হেসে ফেলল রাহা। আওয়াজ হলো সামান্য। সবাই তাকালো পেছনে, রোয়েন কপাল ভাঁজ করে তাকালো। এমন সময় মজা নিল কে?
রাহাকে দেখে রোয়েন তাকালো ভুরু কুঁচকে। রাহা শাড়ি আঁচল টেনে ভেতরে চলে গেল।
‘ এইদিনের পুটিমাছ! আবার নাকি বড় ভাই? টুইন টুইন।
তাননা বলল
‘ মারেম্মা বড় ভাই? মুন্ডু। ওরেহ মুননু ছোটবেলায় আমার কত মার খেয়েছিস মনে আছে তোর? লম্বা হয়েছিস বলে এখন বড় ভাই হয়ে গেলি?
রোয়েন রাগ মাথা নিয়ে সরে পড়লো। মাথায় পানি দেওয়া দরকার। হুটহাট গরম হচ্ছে।
জায়িদ বলল
‘ কেউ কারো থেকে কম না।
তাননা হাসলো। বলল
‘ রাগাতে ভালো লাগে মুননুকে। বড় হয়েছে নইলে মাটিতে গড়াগড়ি খেত। আহ মুননুকে কতদিন গড়াগড়ি খেতে দেখিনা।
জায়িদ হাসলো।
মেহেদী সন্ধ্যায় সোয়েভের সাথে আরেক দফা ঝগড়া হলো নোহার। সোয়েভের প্রশ্ন ছিল খুবই সিম্পল খানিকটা ধাঁধার মতো। নোহা ফোন কানে দিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনলো।
‘ মেয়েরা পাঁচ আঙুল দিয়ে যেভাবে চুল আঁচড়ায় সেটাকে কোন স্টাইল বলে? যেমন ইতালী? জার্মানি? ব্রিটিশ? আমেরিকান?
নোহা বলল
‘ এসব কথা আমি কি করে জানব? আমি ওসব পারিনা।
সোয়েভ বলল
‘ আরেহ আপনি তো ফেল্টুস। পারবেন কি করে?
নোহা রেগে গেল। বলল
‘ ফোন রাখুন। আপনার সাথে আমার কিসের কথা?
সোয়েভ বলল
‘ বউ হয়ে যাবেন কালকে। আবার বলে আমার সাথে কি কথা? আমার সাথে যা কথা হবে তা কি কারো সাথে হবে নাকি?
নোহা ফোন কেটে দিল। লাগামহীন মুখের কথা। যা তা বলে। এমন বেয়াদব লোকের সাথে কিভাবে সংসার করবে জানে না নোহা।
রাহা আসার সাথে সাথে নোহা বলল
‘ রাহাপু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
রাহা বলল
‘ কি প্রশ্ন?
নোহা সব বলল। রাহা বলল
‘ তোর বর হেব্বি ডেন্জারাস? এমন আজগুবি প্রশ্ন কেউ করে?
নোহা বলল
‘ হ সেই ডেন্জারাস জামাইর লগে আমারে সংসার করতে হব্বে।
রাহা হাসলো। বলল
‘ জার্মানি হতে পারে। সিউর নাহ। আন্দাজে বললাম। অন্য কাউকে বলে দেখ।
নোহা বসে থাকলো। বলল
‘ ঠিক আছে। রুমে পানি নেই। একটু পানি খাওয়াও। গলা শুকিয়ে গেছে।
রাহা বলল
‘ বোস আনছি।
রাহা বেরিয়ে গেল। নোহা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলো। রুম থেকে বের হয়ে নিচে যাচ্ছিল রোয়েন। নোহা ডাক পাড়লো
‘ ভাইয়া? ভাইয়া?
রোয়েন হেঁটে এল। চুল ভেজা। কপালের পাশ বেয়ে পানি পড়ছে। পড়নের পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে এগোতে এগোতে রোয়েন জিজ্ঞেস করল
‘ কি হয়েছে?
‘ মেয়েরা পাঁচ আঙুল ব্যবহার করে যেভাবে চুল আঁচড়ায়, তাকে কোন স্টাইল বলে? ইতালি? জার্মানি? ব্রিটিশ?আমেরিকান?
রোয়েন কপাল ভাঁজ করে থাকলো। বলল
‘ সিম্পল জিনিসটা ও পারছো না নোহা? কি শিখেছ এতদিন?
নোহা মাথা নামিয়ে ফেলল। রোয়েন বলল
‘ জার্মানি স্টাইল।
নোহা মাথা তুললো। খুশি হয়ে বলল
‘ ও আল্লাহ। রাহাপু ও এটাই বলেছে। একদম ম্যাচ।
রোয়েন বলল
‘ আচ্ছা।
রাহা পেছনে পানির জগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। রোয়েন ফিরে চলে যেতেই রাহার মুখোমুখি হলো। শাড়ি পড়া রাহাকে দেখে ভাবলো
‘ পৃথিবীতে বিচ্ছিরি রকমের কিছু থাকলে সেটাই রাহা নামক মেয়েগুলো। বিষাক্ত। বিচ্ছিরি। জঘন্য। ভয়ংকর।
আর রাহা ভাবলো।
পৃথিবীতে নাম্বার ওয়ান শিক্ষিত পাগল বলতে যদি কেউ থাকে তাহলে সেটা হবে ডক্টর রোয়েন। একেবারে মাথামোটা, গোঁয়ার, বেকুব, রগচটা,খিটখিটে, খ্যাঁকখ্যাঁক মার্কা।
অবশেষে দুজন দুদিকে হাঁটলো। নোহা রাহার পিছুপিছু এসে বলল
‘ তোমাকে সুন্দর লাগছে রাহাপু।
রাহা বলল
‘ আম্মাটা কখন যে আসবে?
নোহা রেগে বলল
‘ বলি একটা বলো আরেকটা।
সোরা এল। সাথে সাদিদ আর সামিরা সিহাব। বাকিরা আসেনি। সোরাকে দেখে দৌড়ে নিচে নামলো রাহা। কয়েকবার শাড়ির সাথে প্যাঁচ লেগে হোঁচট ও খেয়ে পড়ার মতো অবস্থা। ভাগ্য সহায় ছিল।
সোরাকে গিয়ে ঝাপটে ধরলো রাহা। শক্ত করে ধরে বলল
‘ আম্মা আর যেওনা। আমায় ক্ষমা করো। সোরা বলল
‘ ছাড়ো। এটা বিয়ে বাড়ি।
রাহা ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। সোরা চলে গেল ভেতরে। নোহার জন্য একটা লাল টকটকে জামদানী শাড়ি এনেছে সে। সেটা নোহাকে দিয়ে বলল
‘ সুখী হও। ভালো থেকো। যে ভালোবাসে তাকে ভালোবেসো। আন্টি ছোট্ট একটা জিনিস দিলাম। পড়বে, ভালো লাগবে তোমাকে।
নোহা বলল
‘ আন্টি রাহাপু ভালো নেই। তুমি অন্তত রাহাপুর সাথে অমন করো না প্লিজ।
সোরা বলল
‘ তোমার রাহা আপু নিজের কর্মদোষে কষ্টে আছে। কিছু কিছু মানুষকে ভালোবাসাটা দোষের, তাদের ভালোবাসতে নেই, তোমার রাহাপু সেটাই করেছে। আর কষ্ট পাচ্ছে। আমার কিছু করার নেই। তবে এবার আমি যা সিদ্ধান্তঃ নেব রাহাকে তাই করতে হবে। নাহিল আহম্মেদ যদি অধিকার দেখিয়ে মেয়ের হাতে ডিভোর্স পেপার তুলে দিতে পারে আমি ও আবার মেয়েকে সৎপাত্রে বিয়ে দেওয়ার অধিকার রাখি।
পেছনে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনা রাহা গড়গড়িয়ে কেঁদে দিল। যা সোরা না দেখলে ও নোহা ঠিকই দেখলো। নোহা বলল
‘ রাহা আপু ভালো থাকবে আন্টি?
সোরা বলল
‘ সে মায়ের মতো পোড়া কপাল নিয়ে জন্মেছে। নাহ ভুল কথা বলেছি। মায়ের চাইতে ও বেশি পোড়া তার কপাল। ভালো থাকবে কিনা জানিনা তবে তাকে ভালোরাখার দায়িত্ব কারো হাতে তুলে দিতে হবে। সে ভালো থাকতে না চাইলে আমি কি করে ভালো রাখব?
সোরা ফিরতেই রাহা লুকিয়ে পড়লো। সোরা চলে গেল। নোহা দৌড়ে রাহার কাছে গেল। রাহা চোখমুখ মুছে স্বাভাবিক গলায় বলল
‘ ওভাবে কি দেখছিস?
নোহা বলল
‘ যে ভালো থাকতে চায় না তাকে কেউ ভালো রাখতে পারবে না রাহাপু।
রাহা বলল
‘জানি
নোহা করে বসল অপ্রত্যাশিত একটা প্রশ্ন।
‘ তুমি রোয়েন ভাইয়াকে ভুলে যেতে পারবে?
রাহা ভীষণ চমকালো অমন প্রশ্নে। এমন প্রশ্নগুলো কেন শুনতে হয়? রাহা বলল
‘ মনে রাখার মতো কিছু করতে হয়, আর তোর রোয়েন ভাই তার ও বেশি অতিক্রম করে ফেলেছে। এত এত মহান সে। এমন মহান মানুষকে আবার ভোলা যায় নাকি? তবে ওই যে একটা কথা আছে, চোখের আড়াল হলে মানুষ মনের ও আড়াল হয়। হয়ত এটাই হবে।
নোহা চুপ করে শুনলো। বলল
‘ কথাটা তো সবার জন্য না রাহাপু। চোখের আড়াল হলে যে মনের আড়াল হয় তাকে কোনোদিন ভালোবাসোনি তুমি।
হেসে উঠলো রাহা। বলল
‘ এরকমটা হলে তো আমার চাইতে খুশি আর কেউ হবে না। আমার নিজের উপর থেকে কতবড় দোষারোপ উঠে যাবে জানিস?
আমি তখন বলতে পারবো, ভাগ্যিস এই ভুল মানুষটার সাথে আমার বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে নইলে কি যে হতো?
নোহা খানিকটা রাগ সমেত বলল
‘ এমনটা কিভাবে বলতে পারো রাহাপু? এটা ভালো নাহ।
রাহা বলল
‘ আমি বললেই কোনোকিছুই ভালো হয় না।
________
মেহেদী সন্ধ্যা গিয়ে বিয়ের দিন এল।
বারোটার দিকে নোহাকে সাজানোর জন্য পার্লারের মানুষ এসেছে। টানা দুইঘন্টা সাজগোছ করার পর আনহা এসে তাড়া দিল। ইতোমধ্যে খাওয়া দাওয়া শুরু হয়েছে। নোহা নিজেকে আয়নায় দেখে বলল
‘ আমাকে কারো চিনতে ভুল হবেনা তো রাহাপু? এমন ভূতের মতো কেউ সাজে?
পার্লারের মেয়েগুলো বলল
‘ ব্রাইডাল সাজ।
রাহা বলল
‘ নোহা বকবক করিস না তো। বউ এত কথা বলে নাকি?
নোহা বলল
‘ উফফ এসব নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে।
মেয়েগুলো বলল
‘ বাসর রাত অব্ধি।
বলেই হাসাহাসি শুরু করলো সবাই। রাহা ও হাসলো। নোহা গাল ফুলিয়ে রাখলো। ভাবলো
‘ বাসর রাত নামটা এত বিচ্ছিরি কেন? নামটা দিল কেডা? পাইলে তারে কেটে কেটে কুচি কুচি করতাম। শালা বেয়াদব।
আর ও একঘন্টা দেড়ঘন্টা পার হতে না হতেই বরসাহেব আসলো। সামিরা এসে রাহাকে বলল
‘ রাহাপু নোহা আপুর বর এসেছে।
নোহা মুখ মোঁচড়ালো। আসেনা কোনদিন? রোজ রোজ বাইক নিয়ে বাড়ির সামনে আসা যাওয়া করে? আজ বউ জয় করতে এসেছে।
রাহা হাসলো নোহার কথায়। বলল
‘ তুই ও পারিস।
ফিতা কাটার সময় রিহান আর জুনিত সেইরকম টাকা খোয়ালো। রোয়েন পেছনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। সোয়েভ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বোর হয়ে বলল
‘ ওই ডাক্তার শালা পা ব্যাথা হয়ে গেল আমার। তুই কিছু একটা কর ভাই।
রোয়েন হেসে বলল
‘ আরেহ রিল্যাক্স ভাই। জামাই মানুষ মুখে রুমাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকবি তা না করে গালিগালাজ করছিস?
অনির্বাণ বলল
‘ রোয়েন এই কালাইয়্যারে ঢলে ঢলে সাদা করছি আজ। পাউডার ক্রিম ওর বউ ও মনে হয় অতকিছু দেইনায়।
সোয়েভ রেগে গেল। বলল
‘ আমি কিছু মাখিনাই পারফিউম ছাড়া। দুলা সাজছি তাই একটু সুন্দর লাগছে। শালা উল্টাপাল্টা কথা কস?
রোয়েন হেসে ফেললো। বলল
‘ নাহ নাহ সুন্দর হ্যান্ডসাম বোনের জামাই আমার। সুন্দর না হলে কি আমার বোন তোকে দিচ্ছি? রাগ করিস কেন ভাই। রিয়েল হিরো। আমার আব্বা ও ঠিক এমন ছিল। সেরা সেরা। ঈশান ভাইয়ের সাথে ম্যাচ হবে। দুই বোনের জামাই কালাসুন্দর। তোদের দুইজনের কপাল ভালা। সুন্দর সুন্দর বউ জুটছে কপালে।
সোয়েভ বলল
‘ তুই তাহলে কালা বউ পাবি। আমরা কালা তাই সুন্দর বউ পাইছি। তুই ধলা তাই কালা বউ পাবি।
বলেই সোয়েভ গাল এলিয়ে হাসলো।
রোয়েন ভাবলো
‘ নাহ রাহা কালো নয়। এদের যুক্তিতে ভুল আছে। যাইহোক সবখানে রাহাকে আসতে দেওয়া যাবে না। অতঃপর সোয়েভের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার কথা শুনে হাসলো ঈশান। জিন্নাত তাকে সুন্দর বলে এটাই যথেষ্ট। আর কি লাগে ভাই? সোয়েভকে বলল
‘ সোয়েভ বউ সুন্দর বললে হয়ছে আর কিচ্ছু লাগবে না। কালাই তো গলার মালা।
সোয়েভ চিন্তায় পড়লো, বউ তাকে সুন্দর বলবে কিনা কে জানে? নাকি কালাইয়্যা ডাকে?
একপ্রকার হাসিঠাট্টা চললো। সোয়েভের কাছ থেকে বেশ মোটা অংকের টাকা খোয়ালো জুনিত আর রিহান।
_______
সামিরা এসে নোহাকে বলল
‘ নোহা আপু তোমার বরটা বকবক করে।
নোহা বলল
‘ শরম টরম নেই তাই।
রাহা বলল
‘ আহা তোর কত শরম? নিজে ও তো বকবক করছিস।
নোহা বলল
‘ সেগুলোতো তোমাদের সামনে। ওখানে গেলে দেখবে কবুল বলবো না একদম।
বেচারা বরবাবুকে হেব্বি টেনশনে ফালায় দিমু।
রাহা হাসলো। বলল
‘ ফাজিল!
নোহা বলল
‘ তুমি হাসো ক্যান? কাঁদো। আমি না চলে যাব?
রাহা বলল
‘ চুপ থাক।
বিয়ে পড়ালো কাজী। নোহার মুখের উপর ঘোমটা টানা। রাহা দূরে সোরার পেছনে দাঁড়ানো। নোহাকে কবুল বলতে বলল কাজী। নোহা বললো না কবুল। একে একে সবাই এসে বললো নোহাকে । নোহা শুনলো না। তব্দা মেরে বসে রইলো। শেষমেশ রাহাকে পাঠালো আনহা। রাহা গিয়ে নোহার পাশে গিয়ে বসে বলল
‘ ডাক্তার আসছে বেত নিয়ে। সেইরকম রেগে গেছে।
নোহা ফটাফট বললো। তিনবারের বদলে চারবার বলে দিল। রাহা হেসে চলে গেল। সবাই ভাবলো
‘ কি এমন বললো রাহা? রোয়েন ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো। রাহা হাসছিল আনহা আর তাননাকে বলে বলে। রোয়েনের দিকে চোখ পড়ায় মুখের হাসি নিভতে লাগলো ধীরেধীরে।
_________
সোয়েভ আর সোয়েভের মা বাবার হাতে তুলে দেওয়ার সময় নোহা জায়িদকে বলল
‘ আব্বা আজকে থেকে যাই নাহ? আজকেই যেতে হবে এমন কোনো কথা আছে?
জায়িদ হেসে ফেললো। মৃদু স্বরে বলল
‘ কে চাই রাজকন্যা রাজ্য ছেড়ে যাক?
নোহা এদিকওদিক তাকিয়ে চোখ ঢলে দিয়ে বলল
‘ আব্বা কেউ কি পেঁয়াজ বাটে? আমার চোখ জ্বলে কেন?
জায়িদ চুপ করে থাকলো। আনহা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। নোহা বলল
‘ তুমি দূরে দূরে থাকো আর আমি চলে যাই।
সবাই এমন মুহূর্তেও হেসে ফেললো। আনহা নরম পায়ে হেঁটে আসলো। জাহেদাকে নিয়ে আসলো জায়িদ। জাহেদা সোয়েভের হাতের উপর নোহার হাত রেখে বলল
‘ নাতজামাই আমার বজ্জাত নাতনিটারে ভালো রাখবা। ভালো বাসবা। ভাত কম দিবা কিন্তু আদর কম দিবা না।
আহা ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ভারী লজ্জা পেয়ে গেলেন। নোহা নাক টেনে বলল
‘ দাদু এখন কাঁদার সময়। তোমার কথায় আমার তো হাসি পাচ্ছে। এখন হাসলে সবাই বলবে বউ পাগল।
সবাই ঠোঁট টিপে হাসলো। জাহেদা বলল
‘ আহারে আমার বইন। এভাবে কাঁদিস না। কাঁদবি কেন? নাতজামাই তোরে বাইকের পেছনে শাঁ শাঁ করে নিয়ে আসবে যখন তখন।
নোহা নাক ঢললো। সোরা আর নাহিল ও আসলো। নোহাকে তুলে দিল। নোহা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিয়ে বলল
‘ ধুরর আমি আবার আসবো তো।
নাহিল বলল
‘ তো তুই কাঁদছিস কেন? আসবি ভালো কথা নিজেই তো কেঁদেকেটে সাগর বানাচ্ছিস।
নোহা ডুকরে উঠে বলল
‘ এখন সব বউ কাঁদে। না কাঁদলে সবাই বলবে বউ বিয়ের সময় কাঁদেনি।
কাঁদার বদলে হেসে ফেলল জায়িদ আর আনহা। জায়িদ হাতের কব্জি দিয়ে চোখ ঢলে বলল
‘ কেঁদোনা। হাসিখুশি থেকে সবসময়। রেখো।
বলেই চলে গেল জায়িদ। আনহা চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নোহা এদিকওদিক তাকিয়ে তাননার দিকে দৌড়ে গেল। ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। বলল
‘ আমি যাব না তোমাদের ছেড়ে।
তাননা চোখমুছে ভার গলায় বলল
‘ আমার ও তো বিয়ে হলো। আমি কি কাউকে ছেড়ে গিয়েছি। যাহ রাহার কাছে।
নোহা রাহাকে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। রাহা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। নোহা বলল
‘ তোমার সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্তকে আমি মিস করব রাহাপু। তুমি ভালো থেকো।
রাহা বলল
‘ আমি ভালো আছি। তুই ভালো থাকিস।
নোহা আবার চলে গেল। জাহেদা কেঁদে কেঁদে সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে থাকলো। জুনিত এককোণায় দাঁড়িয়ে রইলো। খুব মজামাস্তিতে ছিল সে। হঠাৎ মনে হলো বাড়িটা খালি হয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা নাই হয়ে যাচ্ছে। নোহা ডাকার সাথে সাথে দৌড়ে গেল সে। ঝাপটে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। বোনের আবদার মিটানো ছোট্ট ভাইটা আজ একটা ছোট্ট আবদার করে বসলো
‘ তুমি যেওনা আপু। আমার কষ্ট হচ্ছে।
গাড়ির কাছে গিয়ে নোহা বারবার ফিরে ফিরে তাকালো। সব চেনা মুখ। সব আপনজন। কেন মেয়েদের জীবনগুলো এমন হয়? বাবার প্রাসাদ ছেড়ে কেন অন্য কোথাও গিয়ে পরকে আপন করে নেওয়ার লড়াই?
রোয়েন দাঁড়িয়ে ছিল এককোণে। জায়িদ বলায় রোয়েন গাড়ির দিকে পা বাড়ালো। রোয়েনকে দেখে কান্নার আওয়াজ বাড়লো নোহার। রোয়েন গিয়ে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ আসো।
নোহা এলোমেলো সুরে কেঁদে দিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো ভাইকে। মায়ের জঠরের ভাই না হলে ও ভাই ভাইই হয় । মার, শাসন বকাঝকার আড়ালে স্নেহ মমতার নামই বোধহয় ভাই। রোয়েন মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
‘ বাচ্চারা এভাবে কাঁদে। নোহা বাচ্চা নয়। বড় হয়েছে। আজ তার বিয়ে।
নোহা কেঁদে কেঁদে বলল
‘ আমি বাচ্চা।
রোয়েন বলল
‘ আচ্ছা।
রোয়েন সোয়েভের হাতের উপর নোহার হাত রেখে বলল
‘ গাঁধা আমার বোনটাকে ভালো রাখিস।
নোহাকে বলল
‘ গাঁধাটাকে ভালো রেখো। ভালো থেকো সবসময়।
নোহা আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রোয়েনকে। কেঁদে উঠে বলল
‘ সবাইকে ভালো রাখতে বলো । তুমি কেন ভালো রাখতে পারো না? রাহাপু ভালো নেই। তারজন্য তুমি দায়ী ভাইয়া। রাহাপুকে ছেড়ে কোথাও যেওনা। এই বোনের ছোট্ট আবদার, অনুরোধ। রাহাপু তোমার কাছে অনেক কিছু পায়।
রোয়েন চুপ করে শুনলো।
পরিশেষে বধূ বিদায় হলো। রোয়েন পেছন ফিরে লাল সাদা কাপড় পড়া মেয়েটাকে দেখে ভাবলো
‘ আমি তোমার কাছে অনেক কিছু পাই রাহা। কই আমার পাওনার কথা তো কেউ বলেনা?
চলবে,