ধ্রুবতারা পর্ব_২২ পুষ্পিতা_প্রিমা

ধ্রুবতারা
পর্ব_২২
পুষ্পিতা_প্রিমা

রোয়েন বেরোচ্ছে শুনে জাহেদা একপ্রকার দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে চলে এল আহম্মেদ বাড়িতে। এসে সোফায় বসলো কিছুক্ষণ। আনহা এসে ধরে ধরে রোয়েনের রুমে নিয়ে গেল। সালেহা বেগমকে দেখলেন রুমের বাইরে দরজার কাছে ছলছলে চোখে দাঁড়িয়ে আছে। জাহেদা মুখ মুছে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের ভেতর ঢুকে পড়ে ডাকল
‘ ভাই? তুই আছিস?
রোয়েন ব্যাগের ভেতর জিনিসপত্র নেওয়ায় ব্যস্ত। কান আর কাঁধের নিচে চাপা দেওয়া ফোন। কথা বলছে কারো সাথে। তাননা দাঁড়ানো ঘরের এককোনায়। জাহেদাকে দেখে ভাবান্তর ঘটলো না রোয়েনের। তবে হেঁটে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে নিল জগ থেকে। জাহেদার কাছে এসে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিল। হাতে ধরিয়ে দিল। ইশারায় বলল
‘ পানি খাও।
জাহেদা দুই ঢোক পানি খেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। রোয়েন ফোন রেখে দিল। বিছানায় বসে পায়ে মোজা পড়ায় মনোযোগ দিয়ে বলল
‘ বসো। আরেকজন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
জাহেদা শাড়ির আঁচল টেনে মুখের কাছে ধরে বলল
‘ আমাদের ছেড়ে চলে যাবি ভাই? চারটা বছর তোকে না দেখে থাকলাম, এখন আবার? অতদিন কি বাঁচব? তোর হাতের মাটি কি পাব না?
রোয়েন মোজা পড়া থামিয়ে দিল। বলল
‘ যাওয়ার সময় কান্নাকাটি করবে না নানু। তোমাদের কান্না ভালো লাগেনা। আমার কারণে কতজনের কত অসুবিধা হচ্ছে।
জাহেদা তারপরও কাঁদলো। সালেহা বেগম ধীরপায়ে রুমে ঢুকলো। রোয়েন বলল
‘ আমাকে শান্তিতে যেতে দাও প্লিজ। কান্নাকাটি করবে না। মেয়ে বিয়ে দিচ্ছ না যে কাঁদবে।
তাননা শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলো। রোয়েন মোজা পড়া শেষ করে বোনের কাছে এসে এক হাত মাথায় রেখে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল
‘ তুননু কাঁদিস না।
তাননা হাত নামিয়ে দিল। রোয়েন সালেহা বেগমের কাছে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বলল
‘ আমায় মাফ করো। আমাকে যেতেই হবে।
সালেহার কান্নার বাঁধ ভেঙে গেল। হু হু করে কেঁদে দিয়ে বলল
‘ তুই থাকলে মনে হয় আমার আশেপাশে আমার গুড্ডু থাকে। আমি তোর মাঝে আমার গুড্ডুকে দেখতো পাই ভাই। যাস না। তোর কি মন কাঁদেনা আমাদের জন্য?
রোয়েন জবাব দিল না। সবাই বলে তার মন নেই। কাঁদবে কি করে?
জাহেদাকো গিয়ে জড়িয়ে ধরলো রোয়েন। জাহেদার ঢোক তুলে কাঁদলো। রোয়েন বলল
‘ এমন করলে কি করে যাব? কি শুরু করেছ তোমরা?
জাহেদা কথা বলতে পারলো না। জাহেদার কান্নায় চোখে জল এল আনহার। তাননার, লুকিয়ে দেখা সোরা নাহিলের। রিহান আর জুনিত এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলো। মুননা ভাই থাকলে ভালো লাগে তাদের। কিন্তু চলে যাচ্ছে তাই ভীষণ খারাপ লাগছে।
রোয়েন দুজনকে ডাকল। স্যুটকেস আর ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল
‘ নিচে নিয়ে যাও। রিহান আর জুনিত তাই করলো। আনহা বলল
‘ নোহা এয়ারপোর্টে আসবে বলেছিল।
রোয়েন বলল
‘ তুমি আমার দিক থেকে অন্তত মুখ ফিরিয়ে রেখোনা। যাদের কাছে বড় হয়েছি তাদের দুজন মুখ ফিরিয়ে রেখেছে আমার কাছ থেকে। আমার দোষটা কোথায় জানিনা আমি
সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছে আর আমি তাদের কথামতো সব করেছি এখন সব দোষ আমার হয়ে গেল।
তাননা ঘনঘন চোখমুখ মুছলো। আনহা বলল
‘ তুমি বড় হয়েছ আব্বা। বোধবুদ্ধি হয়েছে তোমার। তোমার বিবেক কি বলে তা দেখ। বিবেককে প্রশ্ন করো তুমি যা করছ ঠিক করছ তো?
রোয়েন খানিক সময় চুপ থাকলো। পরক্ষনেই কপট রাগ দেখিয়ে বলল
‘ থাকব না আমি। এখানে থেকে কারো সুখের পথে বাঁধা হতে পারব না। আমি চাই না কেউ আমার জন্য খারাপ থাকুক। চাইনি, চাইব না।
আনহা কিছু বলতে চাইলো। রোয়েন বলতে দিল না। তাননা বলল
‘ মামুনি রুমে আছে। বাবাই বাইরে। কথা বলে নিস।
রোয়েন বলল
‘ বলব না। তাদের দুঃখের কারণ আমি। তাদের মেয়ের সব কষ্টের কারণ আমি, আমি চলে যাচ্ছি শুনে তাদের খুশি হওয়ার কথা। রোয়েন এখন উটকো আগাছা। তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলতে পারলেই মঙ্গল।
তাননা চোখ মুছলো আবার। রোয়েন তাননার সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ালো। মুখ তার দুহাত দিয়ে আগলে ধরে আদুরে গলায় বলল
‘ তুননু, তুই বোন আমার। রাগ পুষে থাকিস না আমার উপর। তুই জানিস তো আম্মা আব্বার কথা মনে পড়লে এই চারপাশ বিষাক্ত লাগে আমার। ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুঁড়ে আমি তাদের কাছে চলে যাই। কিন্তু সেই অন্যায় ভাবনা মনের মধ্যে বেশিক্ষণ রাখতে পারিনা কেন জানিস? কারণ তুই আছিস। তোর জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে আমার। তুই কাঁদিস না। তোর সাথে সেকেন্ডে সেকেন্ডে কথা হবে আমার। আমাদের রাখিবন্ধনের অনেক জোর তুননু। আম্মা আব্বা যে বন্ধন করে দিয়ে গেছে সেই বন্ধন কখনো ছেঁড়ার নয়। তুই ভালো থাকিস। তোর যে ছোট্ট বাচ্চাটা আছে তার জন্য ভালো থাকিস। বুঝিস তো মা বাবা না থাকলে সন্তানদের কতটা কষ্ট হয়। জুননুর মতো হস না কখনো। সে স্বামীকে ভালোবেসে গেছে শুধু। সন্তানদের কথা ভাবেনি। আমার আর তোর কথা ভাবেনি। সেই ছোট্ট ছোট্ট তাননা মুননাকে রেখে স্টার হয়ে গেছে। সেই তাননা মুননা যারা আম্মার আব্বার আদর ভালোবাসা না পেলে, আদর না পেলে চোখে ঘুম নামতো না, গলা দিয়ে ভাত নামতো না। সেই তাননা মুননা যারা রাতের পর রাত পার করে দিত বারান্দায় গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের তারাদের সাথে কথা বলে। যাদের চোখে ঘুম নামতো সেই কবরের মাটিতে মাথা রাখলে। চলে গিয়েছে তাননা। তারা কখনোই ভালোবাসেনি আমাদের। কখনোই না।
কাল কবরের কাছে গিয়েছিলাম জিয়ারত করাতে। জানিস আমাকে আর জিয়ারত করাতে যেতে দেখবেনা বলে ভীষণ রাগ করেছে দুজন। ভীষণ কষ্ট পেয়েছে । পাক না। আমি এইবার একটু প্রতিশোধ নিই। তাদের কষ্ট পেতে দেখে একটু আনন্দ পাই।

তাননা নীরবে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জল ফেললো। শেষমেশ ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ আমার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা চলে যাচ্ছে। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তুই যাস না ভাই। যাস না। তোকে দেখলে আম্মা আব্বার কথা মনো পড়লে ও কষ্ট লাগেনা। তুই না থাকলে ভীষণ কষ্ট লাগে। কেন যাচ্ছিস বোনটাকে ছেড়ে।
রোয়েন তার মুখ তুলে মুছে দিল। কপালে চুমু এঁকে বলল
‘ যেদিন তোর জন্য খুব করে মন পুড়বে সেদিন সব ছেড়েছুঁড়ে চলে আসবো আমি। আমাকে আটকায় কে?
তাননা বলল
‘ সত্যি?
রোয়েন বলল
‘ হ্যা। এখন চোখ মুছে নে। আমাকে পানি খাইয়ে দে।
তাননা গ্লাসে পানি ঢেলে ভাইয়ের মুখের কাছে দিতেই ডুকরে উঠলো। রোয়েন পানি খাওয়া থামিয়ে চেয়ে থাকলো। পরে এক ঢোক খেয়ে নিয়ে বলল
‘ আসি তুননু। ভালো থাকিস। সবাইকে আগলে রাখিস যেটা আমি পারিনি।
জায়িদ আর ঈশান নিচে অপেক্ষা করছিল গাড়ি নিয়ে। নাহিল পিছু পিছু এলেও আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকলো। রোয়েন গাড়িতে উঠার সময় পিছু তাকালো। তাকালো বাড়িটার দিকে। তাকালো আপনজনদের দিকে। ওই যে তিনজনকে দেখলো না কিংবা তাকে দেখা দিল না একারণে পা বাড়াতে মন চাইলো না। কিন্তু কি আর করার? দূরে গেলে যদি কিছু মানুষের ভালো থাকার পথ খুলে যায় সেক্ষেত্রে দূরে যাওয়ায় শ্রেয়। ভালো থাকুক আপনজন, প্রিয়জন।
সালেহা আর জাহেদা দাঁড়িয়ে রইলো উঠোনে। এই যে ভাইটা চলে যাচ্ছে, মাটির নিচে যাওয়ার আগে আর দেখবে কবে?
রোয়েন গাড়িতে উঠে বসে গাড়ির কাচ তুলে দিতেই চোখ দোতলার বারান্দায় রাখলো। হুট করে কেউ একজন সরে গেল মনে হলো।
রোয়েন কাউকে দেখলো নয়তো চোখের ভুল।

নাতাশা বেগম নাহিল আর সোরাকে গিয়ে বলল
‘ শান্তি হলি তোরা? ছেলেটাকে তো তোরাই বাধ্য করলি যেতে। এখন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছিস কেন?
সোরা দরজার কাছে দৌড়ে এসে দাঁড়ালো। ততক্ষণে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। তাননা নাহিলের কাছে দৌড়ে এসে কেঁদে দিয়ে বলল
‘ বাবাই আমি এয়ারপোর্টে যাব। মুননুকে আরেকটু দেখবো।
নাহিল বলল
‘ আচ্ছা।
সোরা মুখে চেপে ধরলো। আনহা এসে বলল
‘ মুননার উপর রাগ রাখিস না সোরা। আমাদেরই তো ছেলে। আজ জিনি থাকলে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারত না। আমি জানি তোর কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তুই দেখাচ্ছিস না। এবার তো সব ভালো ভালোই হচ্ছে। রাহাকে বিয়ে দিতে আর কোনো বাঁধা নেই। মুননা চলে গেছে।
সোরা কেঁদে উঠলো। বলল
‘ আমি এটা কখনো চাইনি আপা। আমি সবসময় চেয়েছি রাহা তার ভালোবাসার মানুষটাকে পাক। মুননা ভালোবাসুক রাহাকে। তাদের সুন্দর একটি ঘর হোক। একটি সংসার হোক। কিন্তু কি হয়ে গেল? দূরত্ব বাড়লো তাদের মধ্যে, আবার আমাদের মাঝে ও। বড়দাভাই আর ভাবিকে দেওয়া কথা আমি রাখার চেষ্টা করে গেছি দিনরাত। নিজের অতীত ভুলে আগলে রেখেছি এই বাড়িটাকে, বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে। তাননা মুননার মা হয়েছি। তাদের অভিভাবক হয়েছি। তাদের প্রত্যেকটা চাওয়া পাওয়া পূর্ণ করেছি। তাদের অসুখে নিজে অসুস্থ হয়েছি। এত ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করেছি তাদের, আজকের এই দিনটা দেখার জন্য? এই দিনটা দেখার জন্য আমি এতকিছু করেছি? কাদের জন্য এতকিছু করলাম? আমি কি কথা রাখতে পারিনি বড়দাভাইয়ের? ভাবি যে দুই বাচ্চাকে দিয়ে গেল আমাদের উপরেই তো ভরসা করে? আমরা কি সেই ভরসাস্থলের জায়গাটা নষ্ট করে ফেলেছি?
আনহা গাল মুছলো। বলল
‘ তুই নিজেকে দোষ দিস না সোরা। যা হয়েছে তা হয়ে গেছে। মুননা আর রাহাকে নিয়ে তো আর কোনোকিছু ভাবা যাবে না। তাদের নিয়ে ভেবে রাখা ঘর সংসার হওয়া সম্ভব না আর। শুধু শুধু ওসব ভাবা মানে নিজেকে কষ্ট দেওয়া। মুননা তো চলে যাচ্ছে, যাওয়ার আগে তার মামুনি আর বাবাই তার সাথে কথা বলুক একটা। একবার হলেও চায় মুননা। হয়ত মুখ ফুটে বলতে পারছেনা। চায়।

___________

এয়ারপোর্টে পৌঁছালো তাননা,সোরা, নাহিল। জাহেদা আর সালেহা বেগমকে ও আনতে হলো তাদের সাথে। পনের মিনিটের মধ্যেই ফ্লাইট। নোহা রোয়েনকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিল একপ্রকার। মিনমিনিয়ে বলল
‘ রাহাপুকে এই অবস্থায় রেখে কি করে চলে যেতে পারো তুমি?
রোয়েন বলল
‘ আমি তো তোমার রাহা আপুকে ভালো রাখার জন্যই চলে যাচ্ছি। আমি থাকায় তাকে বিয়ে দিতে কষ্ট হচ্ছে। এখন আর কোনো সমস্যা নেই । আমি আসব আবার। ততদিনে মামা হব আবার ও।
নোহা কেঁদে বলল
‘ ইননা।
রোয়েন হাসলো। বোনের মাথায় স্নেহের স্পর্শ দিয়ে বলল
‘ ভালো থেকো।

নাহিল আর সোরা হন্য হয়ে দৌড়ে দৌড়ে এল। রোয়েন তাদের দেখে ছুটে এল। কিছুদূর এসে থেমে গেল। সোরা দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলো তাকে। এলোমেলো কান্নায় ভাসিয়ে দিয়ে ডাকল
‘ এ কেমন প্রতিদান? কেমন প্রতিশোধ আব্বা? মায়ের মতো থেকে গেলাম আজও, মা হতে পারলাম না।
রোয়েন সোরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল
‘ মনে করো রোয়েন অভিশাপ তোমাদের জীবনে। তোমার মেয়ের জীবনে। উত্তর পেয়ে যাবে।
সোরা ডুকরে কেঁদে উঠলো। রোয়েন নাহিলের দিকে এগিয়ে গেল। নাহিল মাথা তুলে তাকালো। আবার মাথা নিচে নামিয়ে ফেলল। রোয়েন নিজে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। নাহিল চোখমুখ চেপে ধরলো রোয়েনের কাঁধে। রোয়েন ডাকল
‘ মুন্টু তোমাকে কাঁদা মানায় না।
নাহিল আর ও শক্ত করে ধরলো। রোয়েন বলল
‘ বাচ্চামো মুননাকে মানায়। তোমাকে নয়।
নাহিল মাথা তুললো। বলল
‘ যেওনা আব্বা। যেওনা। তোমাদের আশ্রয় যেমন আমরা। আমাদের আশ্রয় ও তো তোমরা। তাহলে কেন এমন করছ?
রোয়েন বলল
‘ আমি তো ফিরব আবার। একেবারে চলে যাচ্ছিনা। আমি তোমাদের ঢাল হয়ে থাকার জন্য আবার ফিরব। তবে কিছুসময়ের জন্য বিরতি নিচ্ছি। ভালো থেকো।

সালেহা বেগম আর জাহেদাকে দেখে দূর থেকে দাঁড়িয়ে হাসলো রোয়েন। তাননা দৌড়ে এল। ভাইকে ধরে রাখলো শক্ত করে। শেষমেশ রোয়েনের চোখে বহুক্ষণ পর দেখা দিল একটু কান্না। দৃশ্যমান না তা ও। তবে সেই জল না দেখে ও যেন দেখে নিল তার আপনজনেরা। শেষ বিদায় নিয়ে যেতে যেতে রোয়েনের হঠাৎ মনে পড়লো কেউ একজন আসেনি। ভালোই তো। ভালো।
তবে যখন ব্যারিক্যাড পার হলো তখন দেখা দিল সেই কাঙ্ক্ষিত মেয়েটি। রোয়েন ব্যারিকেডের ওপাশে দাঁড়িয়ে টলটলে চোখে চেয়ে থাকা মেয়েটিকে বলল

‘ ওহ তুমি এসেছ? ভেবেছি আসোনি। এসেছ ভালো কথা। ভাই হয় তোমার। আসা দরকার। যাইহোক এসেছ ভালো কথা। এবার যাও। বিয়ে করো। ঘর সংসার করো। স্বামী সংসার নিয়ে ভালো থাকো। বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করো। আর পারলে অতীত নামক জিনিসটা মন থেকে একেবারে মুছে ফেলার চেষ্টা করো। একজন ভালো স্ত্রী, ভালো মা হয়ে উঠো। দোয়া করে দিলাম। ভাইয়ের দোয়া কাজে লাগে।
রাহা ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে বলল

‘ আপনার কথা মেনে চলার চেষ্টা করব।

রোয়েন একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। যখন যাওয়ার ঘন্টা বেজে উঠলো হনহনিয়ে হাঁটা ধরলো, ভুলে ও পিছু ফিরে তাকালো না আর। হাতের কব্জি দিয়ে শক্ত করে চোখমুখ ঢলে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে এগোতে এগোতে বলল রোয়েন

‘ তুমি ভালো থাকবে না রাহা। তুমি ভালো থাকলে আমি ভালো থাকব না। তুমি ভালো থাকতে পারো না।

যদি পিছু ফিরতে তাহলে হয়ত ভুল ধারণা ভেঙে যেত তার। থেকে যাওয়ার মোক্ষম একটা কারণ পেয়ে যেত। যদি খুব কাছ থেকে কান পেতে শুনতো তাহলে শুনতে পেত সেই বিষবাক্য।
আপনি দোয়া করলেন আর আমি শাপ দিলাম আপনাকে। আপনি ভালো থাকবেন না। আপনি ভালো থাকলে আমি শান্তি পাব না।

হয়ত রাহার মনের ভেতর থাকা এই ক্ষুদে শাপটা কাজে লেগে গেল। সত্যি হয়ে গেল। চব্বিশ ঘন্টা পার না হতেই জানা গেল সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে মার্চ করা বিমানটি নিখোঁজ শৈত্যপ্রবাহের কুয়াশার চাদরে ঢাকা কোনো এক নাম না জানা দ্বীপে। নেটওয়ার্কের বাহিরে এই দ্বীপে কোনো মানুষের বসবাস নেই। নেই কোনো মানুষের আনাগোনা। অন্য বার যে বিমানটি নিখোঁজ হলো তার ও কোনো হদিস পাওয়া যাইনি। এইবার ও যাবে বলে কোনো আশ্বাস নেই। উদ্ধারকর্মীদের বক্তব্য সারাদেশে ছড়িয়ে গেল এই খবর। ওই বিমানে থাকা প্রত্যেকটা যাত্রীকে মৃত ঘোষণা করা হলো অবশেষে।

এই খবর কানে আসতে না আসতেই তাননা দৌড়ে দৌড়ে নিচের রুমে চলে এল। ঈশান এসে তাননাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে ফেললো। রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করে দিয়ে বলল
‘ কিচ্ছু হয়নি জিন্নাত । কিচ্ছু না। প্লিজ কাঁদবেন না।
তাননা টিভির দিকে আঙুল দেখিয়ে চিৎকার করে ডেকে উঠলো
‘ আম্মা আব্বা কি করে তাকে নিয়ে যেতে পারলো? আমি কেন থাকব আর? মুননা তারা হয়ে যেতে পারেনা। আমার ভাই। আমি ভাই ডাকবো কাকে? সে তারা হতে পারেনা।
বলতে না বলতেই ঈশানের কোলে ঢলে পড়লো তাননা।

রাহা পাগলের মতো দৌড়ে ছাঁদের কর্ণারে গিয়ে দাঁড়ালো। সকালে শুকতারা উঠে আর সন্ধ্যায় ধ্রুবতারা। আজ ও ধ্রুবতারা উঠলো। ওইতো আকাশের কোণে। একা একা জ্বলজ্বল করছে। কি সুন্দর! কি সুন্দর! কি বেঈমান! কি জঘন্য!
রাহা হাত পা কুড়িয়ে বসে থাকলো এককোণে। কাঁপা-কাঁপা হাতে মাথার চুল নিল হাতের মুঠোয়। পায়ের আঙুল মোঁচড়াতে মোঁচড়াতে ঠোঁট ভেঙে কান্না নামলো কপোল বেয়ে।

চলবে,
গল্প বোধহয় কাল শেষ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here