পারমিতা
Part-17
_নীলাভ্র জহির
ভালবাসায় রঙিন হবার সময় এখন। রোদ দূর থেকে আঁড়চোখে তাকিয়ে আছে। পারমিতা সোফায় বসা। দু এক পলক রোদকে দেখে আবার দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। রোদের চোখে লাজুকলতা মেশানো। উৎকণ্ঠা ও ভয়ও রয়েছে তাতে। রোদ ওর কাছাকাছি এলেই কেমন ভীতু হয়ে যায়, সেটা টের পায় পারমিতা। ও মনেমনে হাসছে। রোদকে ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছে আজ।
অনেক্ষণ পর রোদ একটা ওয়েটারকে কিসব বুঝিয়ে দিয়ে পারমিতার কাছে এলো। পারমিতা বলল, আমাকে বাসায় যেতে হবে।
– বাসায় কেন?
– বাসায় কেন মানে?
– সরি। এত তারাতাড়ি যেতে হবে কেন?
– অফিস টাইম শেষ।
– বাসায় কি বাবা বকা দেবে দেরি করে গেলে?
– আমার অন্য একটা কাজ আছে।
– ঠিক আছে। তাহলে আমরা উঠি। আমি আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
– না না, দরকার নেই। আমি একাই চলে যেতে পারবো।
ওয়েটার একটা বক্সের ভেতর কেকটা তুলে দিলো। রোদ বলল, এটা বাসায় নিয়ে যান।
– বাসায় নিয়ে যাবো কেন?
– খাবেন। খাবেন আর আমাকে মনে পড়বে।
অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে লাজুক হাসলো রোদ। পারমিতা মুখ টিপে হাসলো। এই কেক দেখলে প্রীতুল অসম্ভব খুশি হবে। পারমিতাকে এগিয়ে দিতে কেকের বাক্স হাতে নিয়ে রোদ নিচে এলো। আরেকবার অনুরোধের সুরে বলল, আমি নামিয়ে দিয়ে আসি?
– না থাক। আপনাকে আর কষ্ট দিতে হবে না। তাছাড়া আমার অন্য একটা কাজ আছে। আমি রিকশা নিয়ে চলে যাচ্ছি।
– দাঁড়ান। আমি উবার ডাকছি।
– না না, দরকার নেই।
পারমিতার কথাকে উপেক্ষা করে রোদ উবার থেকে একটা গাড়ি রিজার্ভ করলো। পারমিতাকে যখন জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন?
ডে কেয়ারের এলাকার নাম বলল পারমিতা। রোদ কিছু না ভেবে সেখানকার জন্যই গাড়ি ডাকল। পারমিতাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে তবেই নিজে গাড়িতে গিয়ে উঠলো।
পারমিতা গাড়িতে বসে ভাবছে, আমি কি রোদের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি? ওর প্রতি আমার এত দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে ও ধীরেধীরে আমার অন্তরের গভীরে প্রবেশ করছে। ও নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। কিন্তু ভালো মানুষের ভেতরেও অনেক সময় বিষ থাকে। রোদ সেরকম লোক নয় তো?
নানান রকম আজগুবি চিন্তা ভাবনায় পারমিতা বুঁদ হয়ে রইল। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন আপু?
ডে কেয়ারের ঠিকানা দিলো পারমিতা। অফিসের ফাঁকে দু তিনবার ফোন করে ওর খোঁজ নিয়েছে। মহিলাটি বলল প্রীতুল একটুও কান্নাকাটি করেনি। বরং এই জায়গাটাকে ওর নাকি ভালোই লাগছে। নতুন নতুন খেলনা ও বন্ধু পেয়ে খেলায় মেতে উঠেছে ও। বাসায় সারাক্ষণ একাই থাকে তো। নিজেকে ভারমুক্ত লাগছে পারমিতার। সামান্তা দিনের বেলা বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। বারবার জিজ্ঞেস করেছে, প্রীতুলকে নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? পারমিতা বলেছে, সে প্রীতুলকে নিয়ে শহর থেকে দূরে একটা কাজে এসেছে। সামান্তা অনেক খোঁজ রাখে ওর। বিষয়টা পারমিতাকে সামান্তার প্রতি আরও কৃতজ্ঞ করে তুললো।
প্রীতুল গাড়িতে উঠে বলল, আম্মু এটা কার গাড়ি? আমরা গাড়িতে চড়েছি! ইয়েএএ।
পারমিতা হেসে বলল, হ্যাঁ বাবু। আমরা গাড়িতে উঠেছি। তোমার গাড়িতে চড়তে ভালো লাগে?
– খুব ভালো লাগে আম্মু।
– তাহলে তোমাকে মাঝেমাঝে গাড়িতে করে বেড়াতে নিয়ে যাবো।
– ইয়েএএ, অনেক মজা হবে।
হাততালি দিলো প্রীতুল। পারমিতা প্রীতুলের জন্য কেনা খাবারগুলো ওকে দিলো। খাবার খেতে খেতে প্রীতুল বলতে লাগল কিভাবে আজকে সারাদিন ও বন্ধুদের সঙ্গে অনেক মজা করেছে। অনেক বন্ধু হয়েছে ওর। বারবার জিজ্ঞেস করছিল, আবার কবে এখানে আসবো?
পারমিতা বলল, আবার কালকেই এখানে আসবো আব্বু। কাল তো শুক্রবার, আমার অফিস ছুটি। কাল না, আমরা পরশু আসবো।
– কালকেই আসবো আম্মু।
– কালকে এখানে কেউ আসে না বাবাই। সবাই শুক্রবার ছুটিতে থাকে।
– ছুটি কি আম্মু?
– স্কুলের ঘন্টা বাজলে তোমরা বাড়িতে আসার জন্য আনন্দ পাও, সেটাই ছুটি।
প্রীতুল পুরোটা পথ অনেক হৈ হুল্লোড় করে পারমিতাকে ব্যস্ত রাখল। বাসায় পৌঁছে সামান্তাকে দেখতে না পেয়ে বুকের ভেতর ফাঁকা অনুভূত হচ্ছিল পারমিতার। চারপাশ শূন্যতায় ঢেকে আছে। প্রীতুল বারবার সামান্তাকে খুঁজছিল। খালামনি খালামনি বলে পুরো বাড়ি মাথায় তুললো।
ফোনে সামান্তার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়ার পর শান্ত হলো প্রীতুল। পারমিতা শুয়ে শুয়ে ভাবনায় হারিয়ে গেল। রোদের মুখটা বারবার ভেসে উঠতে লাগল ওর সামনে। আজকের বিকেলে কাটানো এই মুহুর্ত ওর জীবনে একটা সেরা মুহুর্ত হয়ে থাকবে। হয়ে থাকবে সেরা স্মৃতি। এমন চমৎকার সময় ওর জীবনে খুব কমই এসেছে। চারদিকে এত ঝলমলে পরিবেশ, এত অসাধারণ একটা মানুষ ওর সামনে বসা। সবকিছু মনে হচ্ছিল স্বপ্ন।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর পারমিতার মনে হচ্ছিল রোদকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে রাতে। স্বপ্নে কি ঘটেছে তা ঠিক মনে নেই। কিন্তু রোদ ছিল, এটা নিশ্চিত। এই স্বপ্নের ঘোর ওকে বিমোহিত করে রাখলো।
পারমিতা প্রীতুলকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে বের হল। শিশুপার্কে ঘুরে আইসক্রিমের দোকান থেকে আইসক্রিম নিয়ে দিলো। দুই মা ও ছেলে মিলে সারাটা দিন ঘুরে ঘুরেই কাটালো। বাসায় থাকলে বারবার রোদ ও সামান্তাকে মনে পড়ছিল। তাই সারাদিন বাইরে কাটালো পারমিতা।
সন্ধ্যার আগমুহূর্তে সামান্তার নাম্বার থেকে কল। পারমিতা বলল, কি রে? কি অবস্থা তোর?
– আমি বাসায় এসেছি। রুমে তালা দেয়া। কোথায় তুই?
পারমিতা চমকে উঠল, আমি তো বাবুকে নিয়ে বাইরে এসেছিলাম।
– কোথায়? কতক্ষণ লাগবে আসতে?
– এখন আসাদ গেটের কাছে আছি। তুই আসার আগে আমাকে জানাবি না? ছেলেপক্ষ কি বলল কিছুই জানালি না। আমি সারাদিন চিন্তায় ছিলাম।
– দেখা হলে সব বলবো। এখন তুই একটা কাজ কর। সংসদ ভবনের সামনে অপেক্ষা কর। আমি আসছি। আমার কাছে গাড়ি আছে।
পারমিত বাসে করে বাসার দিকেই ফিরছিল। ফোন কেটে দেয়ার পর বাস থেকে নেমে পড়ল। সংসদ ভবনের সামনে ফুটপাতে বকুল গাছের নিচে এসে বসল মা ও ছেলে। সামান্তা এই ভর সন্ধ্যায় বাইরে বেরিয়েছে কেন বুঝতে পারছে না। তবে কি পাত্রপক্ষ আজ আসেনি? বিয়েটা কি হবে না? সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। টেনশন হচ্ছিল পারমিতার।
সামান্তা দ্রুত চলে এলো। সঙ্গে রাকিবও আছে। কিছু বলার আগেই পারমিতাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বলল, আমার কলিজা।
প্রীতুলকে কোলে নিয়ে চুমু খেলো সামান্তা।
পারমিতা অবাক হয়ে দেখল সামান্তার পরনে শাড়ি, খোলা চুল। ঠোঁটে লাল রঙা লিপস্টিক। অপূর্ব দেখাচ্ছে ওকে।
সামান্তা খুশিতে টগবগ করছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিয়ের দিন পাকা হয়ে গেছে। ও বলল, জানিস রাকিবের আব্বা আম্মা এত ভালো মানুষ। উফফ আমার আনন্দে মরে যাইতে ইচ্ছে করছে।
রাকিব বলল এই না না। তুমি মরে গেলে আমি কাকে বিয়ে করবো?
সামান্তা বাকা চোখে তাকালো ওর দিকে। বলল, এই চুপ করো তো। তুমি যাও এখান থেকে। প্রীতুলকে নিয়ে কিছু কিনে দাও। আমি পারোর সঙ্গে কথা বলি।
রাকিব হাসতে হাসতে বললো, আপু দেখেছেন। বিয়ের দিন পাকা হতেই বউগিরি শুরু করে দিয়েছে।
তিনজনেই হেসে উঠল। রাকিব প্রীতুলকে নিয়ে ফুচকার দোকানে গেলো। সামান্তা ও পারমিতা বসলো পাশাপাশি। সামান্তা বলল, ওরা তো দুপুরের আগেই এসেছে। দুপুরের খাবার আমাদের বাসায় খেয়েছে।
– বিয়ে ঠিক হয়েছে কবে সেটা বল না?
সামান্তা উত্তেজিত হয়ে বলল, দাড়া আস্তে আস্তে বলি। প্রথমে আমি তো টেনশনে মরি। আমাকে যদি পছন্দ না হয়, কি হবে না হবে সবকিছু ভেবে অস্থির ছিলাম। সকালে তোকে ফোনে বলেছি তো। তারপর গোসল করে সাজতে বসলাম। কাজল দেই, এক চোখে বাঁকা হয়ে যায়। আইলাইনার দেই, একদিকে ট্যারা হয়ে যায়। হাত কাঁপে, গা কাঁপে। এভাবেই টেনশনে কাহিল হচ্ছি। তখন রাকিব বলল, ওরা নাকি এসে পড়েছে। সাজগোজ এটাই করেছি। চুল স্ট্রেইট দিয়েছিলাম। কিন্তু ওদের সামনে তো ঘোমটা দিয়ে গেছি। ওনারা সবাই হাসিখুশি মানুষ। আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। এমনভাবে কথা বলল যেন আমি তাদের বাড়ির বউ। আমার ব্যাপারে সব জানে। ওর আব্বা আমাকে বউমা বউমা বলে ডাকতেছে। কি লজ্জার ব্যাপার বল? তারপর খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিয়ের দিন ঠিক করলো। নেক্সট শুক্রবার। বাসাতেই হবে। নিকটস্থ আত্মীয় স্বজন আর প্রতিবেশীদের দাওয়াত করবে। উফফ কি যে এক্সাইটেড লাগতেছে।
পারমিতাকে জড়িয়ে ধরল সামান্তা। সামান্তার চোখেমুখে এই আনন্দ দেখে পারমিতার নিজেরই আনন্দ হচ্ছে। ওর চোখে পানি চলে এসেছে। রাকিব দুই প্লেট ফুচকা নিয়ে সামান্তা ও পারমিতাকে দিয়ে গেল। ফুচকা খেতে খেতে পারমিতা বলল, কয়জন এসেছিল?
– সাতজন। তোকে অনেক মিস করেছি। কাল তো তোর অফিস নেই। তুই কাল আমাদের বাসায় আয়। সকালে আসবি, সারাদিন থাকবি।
– দেখা যাক।
– দেখা যাক, টেখা যাক বললে হবে না। আসতেই হবে। আর শোন, তুই কিন্তু রবিবার অফিসে গিয়েই ছুটি নিবি। সোমবার থেকে তুই আমাদের বাড়িতে গিয়ে থাকবি। বৌভাত পর্যন্ত। আমরা সোমবার তাহলে একসঙ্গে কেনাকাটা করতে যাবো।
– স্যার ছুটি দেবে কিনা নিশ্চিত নই রে। কথা বলে দেখি
– তুই রোদ সাহেবকে বল। রোদ বললে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। রোদকেও দাওয়াত দিবো। ওর নাম্বার দিস তো আমাকে।
পারমিতা লাজুক স্বরে বললো, জানিস রোদ কি করেছে?
– কি!
অবাক চোখে জানতে চাইল সামান্তা। জন্মদিনে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা খুলে বললো পারমিতা। সামান্তা বলল, মাই গড! এতকিছু হয়ে গেছে আর তুই আমাকে বলিস নি?
– ভাবলাম সারা রাত স্বপ্নে বিভোর থাকবি। আমি আর না জ্বালাই।
– মাইর খাবি। এবার তো শিওর, রোদ তোকে ভালবাসে। ও তোকে সত্যিই ভালবাসে।
– যাহ।
লজ্জায় লাল হয়ে উঠল পারমিতা। সামান্তা বলল, শোন না। তুই রোদকে বিয়ে করে ফেল।
– না রে। আমার ওসব প্রেম বিয়ে হবে না। আর কখনো আমি ভুল করতে চাই না।
– রাখ তো। তুই রোদকে সব খুলে বল।
পারমিতা করুণ চোখে তাকালো সামান্তার দিকে। সামান্তা বলল, আগে রোদকে একটু বাজিয়ে দ্যাখ। মানে ওর সঙ্গে দু একদিন চলাফেরা কর। তাহলেই দেখবি ও তোকে প্রপোজ করবে। আর প্রপোজ করলেই তুই মুখ কালো করে সব খুলে বলবি ওকে। বিয়ে, ডিভোর্স পুরো ঘটনাই। প্রীতুলের কথাও বলবি। আর বলবি যে, আমার দ্বারা এটা সম্ভব না। তারপরও যদি রোদ তোকে ভালবাসে, তবে আর দেরি করিস না।
সামান্তার কথা শুনে পারমিতা মাথা নিচু করে ভাবলো। রোদকে আসলেই সব খুলে বলা দরকার। নয়তো দিনদিন ওর পাগলামি বেড়েই চলেছে। কিন্তু নিজে থেকে রোদকে এসব বলা যাবে না। আগে রোদ প্রপোজাল দিলে তারপর পারমিতা বলবে, এটা সম্ভব না। যখন রোদ জানতে চাইবে, কেন সম্ভব না? তখন পারমিতা সবকিছু খুলে বললে ব্যাপারটা স্বস্তিদায়ক দেখাবে। কিন্তু পারমিতার কেন যেন মনে হচ্ছে, রোদ প্রীতুলের কথা জানলেই ধীরেধীরে সরে যাবে। আর কখনো কাছে আসবে না পারমিতার। কোনোদিনও ফিরেও তাকাবে না ওর দিকে। সেটাও একদিক থেকে ভালো হবে। পারমিতা যতদিন ওই অফিসে আছে, মাথা উঁচু করে চাকরি করতে পারবে। সম্মানের সাথে কাজ করতে পারবে। আত্মবিশ্বাস ফিরে এলো পারমিতার মনে।
সামান্তা ফুচকা শেষ করে বলল, বাসায় যাবি কখন?
– এখনই যাবো।
– আমি আর রাকিব একটু দেখা করতে বের হয়েছিলাম। আসলে আনন্দটা একসঙ্গে সেলিব্রেট করতে চাইছিলাম বুঝলি।
– তাহলে তোরা থাক, সেলিব্রেট কর। আমি কাবাবে হাড্ডি হয়ে না থাকি।
– ধুর। কি যে বলিস। আম্মুকে বলে বের হয়েছি। বলেছে বেশিক্ষণ যেন দেরি না করি। আমাকে যেতে হবে এখনই।
রাকিব প্রীতুলের সঙ্গে মজা করতে করতে কাছে এসে বসলো। প্রীতুল ও রাকিব দুজনের ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। প্রীতুল পেয়ারা মাখানো খাচ্ছে। সামান্তা রাকিবকে বলল, চলো উঠি তাহলে।
পারমিতা বলল, হ্যাঁ রে। বাসায় যা। আমি একটা সিএনজি দেখি।
সামান্তা প্রীতুলকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার জান বাচ্চাটা তোকে ছাড়া থাকবো কিভাবে?
প্রীতুলও সামান্তার গলা জড়িয়ে ধরে রইলো।
সামান্তা ফিসফিস করে পারমিতাকে বলল, তুই এক কাজ কর। রোদকে কল দিয়ে আসতে বল। দেখা কর। ওর সঙ্গে কথাবার্তা বল। ও তোকে আসলেই ভালবাসে কিনা, বোঝার চেষ্টা কর।
– পাগল নাকি তুই? প্রীতুল আছে না আমার সঙ্গে? দেখলেই তো বুঝে যাবে। আমি চাই পরিস্থিতি রোদ নিজে তৈরি করুক। তারপর আমি বলবো।
সামান্তা কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে বলল, আমি প্রীতুলকে নিয়ে যাই। তুই রাতে একা থাকতে পারবি তো?
– কি?
অবাক হয়ে গেল পারমিতা।
সামান্তা বলল, আমি প্রীতুলকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাই। তুই কাল সকালেই আমার বাসায় আসবি। রাতটা প্রীতুলকে নিয়ে থাকি। ও তো আর খালামনিকে আগের মতো পাবে না। আজকে থাকুক। তুই কাল সকাল সকাল চলে আসিস। আর আজকে বাসায় যাওয়ার আগে রোদের সঙ্গে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি কর, কোথাও বসে কথা বল।
পারমিতা কিছুতেই রাজি হতে চাইছে না। সামান্তা প্রীতুলকে বলল, বাবু তুমি যাবে আমার সঙ্গে? মজার মজার খাবার কিনে দেবো। আমার বাসায় একটা ফুটবল আছে।
– হ্যাঁ খালামনি যাবো।
সামান্তা বলল, তুই একদম নিশ্চিতে থাক।
সামান্তার জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে পারমিতা প্রীতুলকে ছাড়তে হল। প্রীতুলকে নিয়ে চলে গেল সামান্তা ও রাকিব। পারমিতা ইতস্তত বোধ করছে। রোদকে কল দেবে নাকি দেবে না। যদি কিছু মনে করে?
অনেক ভাবনা শেষেও কল দেয়ার মতো সাহস পেলো না পারমিতা। গতকাল একবার ফোন করেছিল রোদ। দুটো মেসেজও পাঠিয়েছে। পারমিতা রিপ্লাই করেনি। আজকে রিপ্লাই করলে কেমন হয়?
মুহুর্তেই হাসি পেলো ওর। রোদ সেদিন সন্ধ্যায় জিজ্ঞেস করেছিল, বাসায় ভালোভাবে পৌঁছেছেন? গতকাল দিয়েছে, আজকের সকালটা ভীষণ সুন্দর। গুড মর্নিং পারমিতা।
পারমিতা মুচকি হেসে মেসেজ দিলো, আজকের সন্ধ্যাটা ভীষণ সুন্দর। রাতের আকাশে লক্ষ কোটি নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। অপার্থিব সৌন্দর্য আজকের রাত্রি। শুভ সন্ধ্যা।
মেসেজটা দিয়ে মনেমনে হাসলো পারমিতা। একা একা বসে আপন মনে হাসতেই লাগল। সংসদ ভবনের সামনের এই জায়গাটায় সন্ধ্যার পর জমে ওঠে। লোকজন আড্ডা দেয়, ঘোরাঘুরি করে। পাশেই কেউ কেউ গান গাইছে, ঝালমুড়ি খাইছে। পারমিতা অপেক্ষা করতে লাগল রিপ্লাইয়ের জন্য। রোদকে সে আসতে বলতে পারবে না কখনো। রোদ যদি নিজে থেকে আসত, ইস কত ভাল হতো!
একেই বলে ভাগ্য সুপ্রসন্ন। রোদ লিখল, এই শহরে ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে লাগানোর সুযোগ যে পায়, সে তো ভাগ্যবতী। আর লক্ষকোটি নক্ষত্র দেখার মতো আকাশ তো আমার ঘরে নেই।
পারমিতা রিপ্লাই দিলো, ঘরে কি আর আকাশ থাকে? আকাশ দেখতে হলে ঘরের বাহির হতে হয়। হাওয়া গায়ে লাগাতে চাইলে হাওয়ার দেশে যেতে হয়।
– হাওয়ার দেশটা কোথায় শুনি? আমিও তাহলে সেই ভাগ্যবান হতে চাই।
– এই শহরেই এমন কত জায়গা আছে। যেখানে দক্ষিণা হাওয়া সঙ্গে নিয়ে আসে বকুল ফুলেএ সুবাস।
– সত্যি! আমি জানতে চাই কোথায় সেই অমূল্য জায়গা?
– সংসদ ভবনের সামনে বসে আছি। হাওয়ার দোল আর গিটারের ছন্দ কানে আসে। বাতাসে ভেসে আসছে বকুল ফুলের ঘ্রাণ।
– ওয়েট, আমি এক্ষুণি আসছি।
– সিরিয়াসলি!
– সিরিয়াসলি ম্যাডাম। একটু অপেক্ষা করুন। আমি এক্ষুণি চলে আসছি।
পারমিতা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক, নিজে থেকে কিছু বলতে হলো না। রোদ আসছে। মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠল ওর। বাতাসকে সত্যিই আনন্দসাগর মনে হলো। রোদ আসছে..
চলবে..