বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :১০

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :১০

বাহিরে ঘন বর্ষণ।থামার নাম নিচ্ছে না।বর্ষণের সাথে পাল্লা ধরে বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ।অন্ধকার ঘরটায় নিতান ছটফট করছে। হাত পা ভারী চেয়ারের সাথে বাঁধা । মুখে কালো কাপড় বাঁধা।হাতে কাঁটাচামচের ক্ষত থেকে টপটপ রক্ত ঝোরছে।মাঝারি সাইজের টেবিলের অন্যপাশে কেউ একজন বসে।টেবিলের উপর ল্যাম্পটা সরাসরি নিতানের মুখের দিকে ঘুরানো ।কাজেই অপর পাশের মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে না।চেয়ারের হাতলের উপর নিতানের হাতটা বাঁধা ক্ষত থেকে চুয়ে চুয়ে রক্ত চেয়ার বেয়ে নিচের দিকে পতিত হচ্ছে।শক্তিহীন জীর্ণশীর্ণ নিতান যন্ত্রণায় ছটফট করছে।চিৎকার করার মত শক্তি তার মাঝে অবশিষ্ট নেই।প্রাণ ভিক্ষা চাইবার জন্য গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না।সামনে মানুষটা ভারী স্বরে বলে,
“মেয়েদের শরীর নিয়ে খেলার খুব শখ ? ভিডিও বানানো? তোর কি মরণ ভয় নেই? ”
নিতান কাঁপতে কাঁপতে ভীতু স্বরে বলে,”ক্ষমা করে দিন আমাকে! আমি আর কোনদিন এমন করবো না। ”
“ক্ষমা? ক্ষমার যোগ্য তুই? এতোগুলো অসহায় নিষ্পাপ মেয়েদের জীবন নিয়ে খেলেছিস! তুই মানুষ না জানোয়ার ।তোর মত জানোয়ারদের একটাই শাস্তি মৃত্যু । শুধু- ই মৃত্যু! ” বলেই নিতানের হাতের পিঠে ধারালো ছুঁড়ি দিয়ে ফালাফালা করতে লাগলো।নিতান অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। সামনের মানুষটা চিৎকার করে বলে,”এই হাত দিয়ে আমার সেহেরকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিস ,তাই না? এই হাতই থাকবে! ”
সাথে সাথে হাত দুটো কব্জি থেকে আলাদা করে ফেলে।নিতান অসহনশীয় যন্ত্রণায় চিৎকার করতে লাগে। মানুষটা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে।নিতান মানুষটার মুখ দেখতেই কেঁপে উঠে আতংক স্বরে বলে,”আরহামম! ”
আরহাম রাগ চেপে ঠোঁটের কোণায় তীক্ষ্ণ হাসি ফুটিয়ে বলে,”উহু ,তোর যম।”
নিতান কেঁপে উঠে।অগোছালো কেউ।রক্তিম চোখ হিংস্রতায় ভরা।অগোছালো কপাল ছুঁই ছুঁই চুল।ঠোঁটে নিষ্ঠুর হাসি।সামনের মানুষটা আরহাম হয়েও যেন আরহাম না। আরহাম থেকে একদম ভিন্ন কেউ ।আরহাম দাঁতে দাঁত চেপে ভারী স্বরে বলে,”আমার সেহের কে বিছানায় নেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিস? তোকে জান- এ না ,তিলে তিলে মারবো ।”
বলেই নিতানের বুকে ধারালো ছুড়ির আরেকটা প্রহার করলো ।নিতান মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে।তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।বড় বড় চোখ করে থেমে থেমে শ্বাস নিচ্ছে।মৃত্যু থেকে আর কয়েক কদমের দূরত্ব । আর একটু তার পর মৃত্যু চিরকালীন ঘুমে শুয়ে পরবে।আরহাম হয়তো নিতানের কষ্টটা বুঝলো।টেবিলের উপর থেকে সাইলেন্ট পিস্তল্টা নিয়ে নিতানের কপাল বরাবর শুট করলো । সাথে সাথে নিতানের সব যন্ত্রনা ছটফটানির অবসান ঘটলো । মৃত্যুর কোলে চিরনিদ্রায় চোখ বুঝে নিলো ।
আরহাম ঠোঁটের কোণে তৃপ্তিকর হাসি নিয়ে অন্ধকার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

বিদ্যুৎ চমকানোর বিকট শব্দে পুরো শহর কেঁপে ।ঘড়িতে গভীর রাত।চারদিক বৃষ্টির ঝপঝপ শব্দে মেতে।অন্ধকারে কালো রেইনকোট গাঁয়ে কাঁদা মাখা মাটিতে বড় বড় পা ফেলে কেউ হোটেলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। হোটেলের সদর দরজার লাইটের আলো গায়ে পরতেই ,মুখখানা ভেসে উঠে। আরহাম! ,আরহাম সদর দরজা পেরিয়ে সেহেরের রুমের দিকে যাচ্ছে ।দরজা খুলতেই বাহিরের হলদে আলোর রেখা লম্বালম্বি ভাবে অন্ধকার রুমটার মেঝেতে পরে।সেহেরকে গভীর ঘুমে দেখে। আরহাম স্থির নিশ্বাস ফেলে। শব্দহীন পায়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করে।আলো ছায়ার অপরূপ খেলায় পুরো ঘর মজে।গাঁ থেকে রেইন কোট ছাড়িয়ে সেহেরের পাশে আধশোয়া হয়ে শুয়ে পরে। নেশাপ্রবণ গভীর চোখে দেখতে লাগে।চোখবন্ধ করে সেহেরের মেঘবরণ লতানো কেশের ডুব দেয়।বেশ কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে মুখের দিকে ঝুঁকে গালে হাত ছুঁয়ে ভারী মাতাল স্বরে বলে,”আরেকটা নর্দমার কীট দুনিয়া ছেড়েছে ।কঠিন শাস্তি দিয়ে মৃত্যুর কোলে শুয়িয়ে দিয়েছি ।তোমাকে ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেছে ,মৃত্যু তো তার পাওয়ারই ছিলো । তাই না? তুমি আমার,শুধুই আমার! তোমার দিকে বাড়ন্ত প্রত্যেকের পরিণতি এমন ভয়ানক হবে।প্রত্যেককে মরতে হবে! ”

রাত যত গভীর গহীন আঁধার কালো ,দিন ততই সুন্দর হবে।রাতের অন্ধকার কাটিয়ে সূর্য তার চমৎকার রশ্মিজাল চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। সেহের আড়মোড়া ভেঙে , নিভু নিভু চোখে পাশ ফিরে তাকায়।ঝাপসা চোখে কারো প্রতিচ্ছবি দেখে তড়াক করে চিৎকার দিয়ে উঠে বসে। ভীতু স্বরে বলে,”আ…আপনি আমার রুমে আমার বেডে ক..কি করছেন? ”
আরহাম বিছানায় পুরোপুরি গাঁ এলিয়ে চোখ বুঝে শীতল স্বরে বলে,”এটা তোমার রুম? রাতের নেশার রেশ এখনো কাটেনি? ”
সেহের ভ্রূ কুঁচকে ছোট ছোট চোখ করে চারদিকে চোখ বুলায়।বড় দেয়াল জুড়ে জানালা। সোনালি রঙের দামী ফার্নিচার । বিছানায় মখমলের চাদর ।সিলিং- এ দামী ভারী ঝাড়বাতি লাগানো ।সত্যি ত এটা তো তার রুম না।দেখে মনে হচ্ছে পাঁচ তারকা হোটেলের শৌখিন বিলাসবহুল কোন রুম।রাতের কথা মনে করতে চাইলে চাপ পরায় মাথা চিলিক দিয়ে উঠে।বেশ কিছ সময় সেহের আস্তে আস্তে সব মনে করে।রাতে তার করা পাগলামো গুলোর কথা মনে করে আরহামের দিকে তাকিয়ে ছোট একটা ঢোক গিলে ।বেচারার কি নাজেহালটা- ই না করেছে।কাঁচা খেয়ে ফেলবে না তো আবার?
সারারাত দুজন এক বিছানায় ছিলো ,ভাবতেই রাগে সেহেরের গাঁ জ্বলতে থাকে।আরহামকে কিছু বলতে যাবে এর পূর্বেই আরহামের ভারী স্বর ভেসে আসে। চোখ বুঝেই বলে,” টেবিলের উপর লেমন জুস রাখা আছে খেয়ে নেও,মাথা ব্যথা কেটে যাবে! ”
দ্বিতীয় কোন কথা না বলে সেহের জুসটা মুখে দেয়।গ্লাসের কোণ থেকে আড়চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে থাকে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ভীষণরকম ক্লান্ত । সারারাত কি জেগে ছিলো? হয়তো! সেহেরের মায়া হলো আর কিছু বলল না । জুসটা খাওয়ায় এখন মাথা আগের থেকে কিছুটা হালকা লাগছে।কিছুক্ষণ পর রুমের দরজায় নক পরে। সেহের প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকায়।আরহাম হয়তো বুঝল।চোখ বন্ধ করে আগের ভঙ্গীতে বলল,”ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছে । দরজা খুলো ”
এমন ভাব নিয়ে বলার কি আছে? একটু সুন্দর ভাবে বললে কি তার মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? এমন ভাব করলো যেন সে সুলতান আর সেহের তার দাসী বাদী । প্রথমে একবার ভাবলো আরহামের মুখের উপর কড়া স্বরে “না” বলবে।কিন্তু এমন করা অকৃতজ্ঞ দেখায়। তাই পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করলো।বিছানা ছেড়ে বাধ্য মেয়ের মত সেহের দরজা খুলে।দরজায় খাবার ট্রলি নিয়ে হোটেলের একজন স্টাফ দাড়িয়ে।কোন কিছু জিগ্যেস করার পূর্বে- ই লোকটা এক গাল হেসে বলল,”ম্যাম আপনাদের ব্রেকফাস্ট ”
লোকটা খাবার টলিটা ভিতরে রেখে নত মাথায় ভদ্রতার সহিত বেরিয়ে যায়।সেহের দরজা বন্ধ করে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।মিনিট দশেক পর বেরিয়ে দেখে কাঁচের জানালার কাছে মাঝারি সাইজের সোফাটায় আরহাম বসে।সামনের টেবিলটায় ব্রেকফাস্ট সাজানো।কে সাজিয়েছে? আরহাম? হয়তো ।সেহেরকে ওয়াশরুম থেকে বেরোতে দেখে আরহাম বলল,”বস ব্রেকফাস্ট করে নেও ”
সেহের মুখ মুছতে মুছতে ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলে,”আমার খিদে নেই। ”
আরহাম কিছুক্ষণ সেহেরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”নিতানের কফিতে কি জাদু ছিলো ?যে এখনো খিদে লাগেনি! ”
আরহামের ত্যাড়া ত্যাড়া কথায় সেহের ক্ষেপে যায়,”বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন বলে এভাবে কথা বলবেন?আপনাকে এখানে কে আসতে বলেছিল! আমি নিজেরটা নিজে ঠিক হ্যান্ডেল করতে পারছিলাম।”
“হ্যা দেখছিলাম ত কতটুকু পারছিলে! ”
“আপনি আমাকে খামাখা অপমান করছেন ।আ..আমি কিন্তু ,,”
“কি করবে? আবারো সুইসাইড খাবে?”
আরহামের কথায় সেহের লজ্জায় চুপ করে যায়।মুখ দিয়ে টু শব্দ বের করল না।আরহাম জুসের গ্লাসটা মুখে তুলতে তুলতে বলল,”পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করা শেষ হলে ,ব্রেকফাস্ট করতে পারো।”
সেহের বিরবির করে বলল,”আপনার বউ ্যেন তিন বেলা রুটিনবাঁধা আপনার সাথে ঝগড়া করে। চুল নিয়ে খুব ভাব তাই না? খুব তাড়াতাড়ি আপনি টাক হবেন টাক। আপনার বউ আপনার সব চুল ছিড়বে । দুনিয়ার সবচেয়ে ঝগড়াটে ডাইনি পাঁজি মেয়েটা যেন আপনার ঘাড়ে পরে।আমিন! ”
আরহাম খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিয়ে বলল ,”হ্যা সেই মেয়েটা যেন তুমিই হও! ”
“কি বললেন? “সেহের প্রশ্ন করল।আরহাম ভারী স্বরে বলল,”আমাকে অভিশাপ দেওয়া আর নিজের প্রশংসা শেষ হলে ব্রেকফাস্ট করতে পারো।এখান থেকে বেরিয়ে আমাকে একটা মিটিং জয়েন করতে হবে,সো ফাস্ট! ”
সেহের আরহামের কথার আগা মাথা বুঝলো না। এটুকু বুঝলো যে তাকে ব্রেকফাস্ট করতে বলেছে।সেহের আরহাম থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে সোফায় বসলো।আরহাম সেহেরকে নিজের কাছে টানল। কানের কাছে মুখ এনে দুষ্টু স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,”দূরে সরে কেন! আমার গায়ের ঘ্রাণ বেকাবু করে বলে? ”
সেহের নড়েচড়ে গলা ঝেরে বলে,”এমন কিছু না! আ…আমি ঠিক আছি”
“হুম দেখতে পারছি ,তাই বলেই এতো কাঁপাকাঁপি ”
সেহের ঢোক গিলে আরহামের দিকে তাকায়।আরহাম তখনো বাঁকা হেসে।
টি- টেবিলে সাজানো ব্রেকফাস্ট দেখে সেহেরের ভীষণ কান্না আসছে।ইংলিশ ব্রেকফাস্ট ।জুস,টোস্ট ,ব্লাক কফি ,সজেস ,ব্রাউনি,হাফ ভয়েল এগ,ফ্রুট’স ,বাটার।সকাল সকাল এই ছাইপাঁশ গিলতে হবে? সেহের নাক মুখ ছিটকে নেয়। কাঁদো কাঁদো চোখে আরহামের দিকে তাকাতে দেখে আরহাম বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে যেন কত মজার খাবার- ই না খাচ্ছে। খাবেই তো ইংরেজদের বংশধর কি না! প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে । পেট গুড় গুড় করছে।না খেয়ে উপায় নেই।সেহের ঠোঁট উল্টে খেতে লাগে।

চলবে…❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here