#ধ্রুবতারা
#পর্ব_১০
#পুষ্পিতা_প্রিমা

বিশ্বজয়ের হাসি যেন ঝুলছে রাহার ঠোঁটে। রক্ত গরম হয়ে যেন ফুটছে টগবগ করে। বাইরে তুমুল চেঁচামেচি। রাহা কান দিলোনা। যাইহোক না কেন সে মেরেই যাবে। হাতের ছুরিটা উপরে তুলে নিচে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ছেলেটার পিঠ বরাবর। বাম হাতের পিঠ দিয়ে কষে তখুনি চড় বসায় রোয়েন। হাতের চাকুটি দূরে ছিটকে পড়ে। সাথে রাহা ও। গালে হাত দিয়ে হু হু করে কেঁদে দেয়। রোয়েন মুখ ফিরে শুই। সাথেসাথে রাহার কান্না থেমে যায়। রাহা কান্না থামিয়ে দিয়ে আজগুবি বকবক করে।
‘ গোঁয়ার লোক একটা,, কুত্তার মতো ব্যবহার করে আমার সাথে। এখন এখানে এসে ঘুমাচ্ছে।
রোয়েন হাত নাড়িয়ে বলে
‘ লাইট অফ করো। ঘুম আসছেনা।
রাহা মাথা ঝাড়লো। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আসায় তাকে জ্বিনে ধরেছে। এখন কি হবে? জ্বিনটা তো তাকে ছাড়ছেই না। সে ভুলভাল দেখছে। আসতাগফিরুল্লাহ। কর্কশমার্কা গলা ভেসে আসলো।
‘ ননসেন্স লাইট অফ করো। আমার ঘুম আসছেনা। উফফ।
রাহা দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল
‘ আমি আপনার কথা শুনবো কেন? কে আপনি? দাদু বলেছিল জ্বিন মানুষের রূপ ধরে আসে। ও বাপ আমার ভয় লাগছে। আল্লাহ আমি এখন কি করব?
রোয়েন বালিশ টেনে কানের উপর দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল
‘ উফফ।
রাহা হাসলো। বলল
‘ ইচিং বিচিং তিচিং তাহ। জ্বিন ভূত তুই মরি যাহ।
রোয়েন গর্জন করল।
‘ এই মেয়ে?
রাহা তাড়াতাড়ি লাইট অফ করলো। আবার জ্বালিয়ে দিয়ে বলল
‘ আমার ভয় করে জ্বিনবাবু ।
রোয়েন উঠে বসলো
সাদা বালিশ রাহার দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল
‘ কে তুমি? উফফ। মাথা খেয়ে ফেললো।
রাহা বলল
‘ আপনার মাথা তো মাথার জায়গায় আছে। মিথ্যে বলেন কেন?
রোয়েন চোখ খুলতে চেয়ে ও পারলো না। আধখোলা চোখে খয়েরী পাড়ের হলুদ শাড়ি পড়া একটি মেয়েকে দেখলো। চোখবন্ধ অবস্থায় বলল
‘ তুমি রাহা?
রাহা চমকে উঠলো।
‘ জ্বিনটা তার নাম ও জানে? ও বাপ!
রাহা ছুরিটা কুড়িয়ে নিয়ে বলল
‘ তাড়াতাড়ি নিজের রূপে ফিরে আসো। নাহলে। নাহলে একদম এটা দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবো।
আওয়াজ করে হেসে দিল রোয়েন। ধপ করে আবার শুয়ে পড়ে বালিশ টেনে মাথার নিচে দিয়ে বলল
‘ রাহা গাধা। গাধার মা, গাধার বউ।
রাহা রেগে গেল। এদিকওদিক তাকিয়ে একটি হাতপাখা খুঁজে পেল। রোয়েনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দুম করে মেরে বলল
‘ আমি মোটেও গাধার বউ না। ডাক্তার কত্ত ট্যালেন্ট জানেন? বললেই হলো?
রোয়েন বেঘোর ঘুম। রাহা বলল
‘ এই ভূতটা এভাবে ঘুমায় কেন? ভূত আবার ঘুমায় নাকি?
রাহা মাথা ঝাঁকালো। রোয়েনের পাশে গিয়ে বসে গালে হাত দিল। রোয়েনকে আগাগোড়া দেখলো। একটু ঝুঁকে নাক টেনে বলল
‘ আরেহ এটাতো অরজিনিয়াল ডাক্তারের পারফিউমের গন্ধ। তারমানে এটা আসল ডাক্তার? এখানে কি করে এল? ওমাগো, এখন কি করব আমি? ছিঃ ডক্টর এখানে আসে ওসব করার জন্য, ছিঃ, ছিঃ। আমি বাড়ি যাই আগে, সব বলে দেব সবাইকে।
বলেই রাহা দুম করে কিল বসালো রোয়েনের পিঠে।

তারপর বেডসাইড টেবিল থেকে পানির জগ থেকে পানি নিয়ে ছিটকে মারলো রোয়েনের মুখে।
রোয়েন নড়েচড়ে উঠল। রাহা ডাকল
‘ অ্যাই ডাক্তার উঠেন। উঠেন বলছি। এখন গোসল করিয়ে দেব। উঠেন বলছি। অ্যাইই ডাক্তার।
রোয়েন উঠলো না। রাহা জগের পানি ঢালতে লাগলো রোয়েনের মুখ বরাবর। হাত নাড়িয়ে ঠেলে ফেলে দিল রোয়েন। জগটা পড়ে ঝনঝন আওয়াজ করে উঠলো। রাহা রোয়েনের চুল টেনে দিতেই রোয়েন ধরে ফেলল তার হাত। টান দিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল রাহা। রোয়েন আরও ভালো করে ঘুমাতে ঘুমাতে বলল
‘ রাহা চুপটি করে ঘুমাও। আমাকে ডিস্টার্ব করবেনা।
রাহা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকলো রোয়েনের দিকে। কিছু বলার জন্য যথেষ্ট শব্দ পেলোনা। রোয়েন রাহার দিকে মুখ করে আবারও ঘুমাতে লাগলো। রাহা বলল
‘ বেয়াদব ডাক্তার। আজকে আমার বিয়ের রাত, বাসর ঘর হওয়ার কথা। আপনার জন্য কিছু হয়নি।
রোয়েন ঘুম। রাহা উঠে বসলো। বলল
‘ বেয়াদব মানুষ। এখানে ঢং করতে আসে, এজন্যই তো আমাকে বিয়ে করতে চায়না। বেয়াদ্দব, ইতর। লুচ্চা ডাক্তার।
রাহা জোরে জোরে ডাকতে থাকে। ওদিকে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। রাহা কাঁদোকাঁদো হলো ভয়ে। রোয়েনের হাতের বাহু ছিলে গিয়েছে তা ও দেখতে পেল। শাড়ির আঁচল মুখে গুঁজে রাহা রোয়েনের গা ঝাঁকালো।
‘ রোয়েন ভাইয়া উঠুন। তাড়াতাড়ি। ওরা দরজা ধাক্কাচ্ছে। আমার ভয় লাগছে। এই ডাক্তার!
রোয়েন উঠে বসলো। ধমকে বলল
‘ উফফ শান্তি দেবে না আমায়?
রাহা রেগে গেল
‘ ওহহ এখানে শান্তির জন্য আসেন তাহলে? ওরেব্বাপ।
রোয়েন চোখ ঢলতে ঢলতে বলল
‘ তুমি আমার ঘরে কেন রাহা? যাও।
রাহা বলল
‘ এটা আপনার ঘর ও না, আমার ঘর ও না বেয়াদব ডাক্তার।
রোয়েন চোখ মেলে তাকালো। মাথা ভার এখনো। কড়াকন্ঠে জিজ্ঞেস করল রোয়েন
‘ বেয়াদব? কাকে বললে?
রাহা ভীতচোখে তাকালো। কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল
‘ বলিনি। বলিনি।
রোয়েন মাথা নিচু করে বসে রইলো। দরজার বাইরে তুমুল আওয়াজ। রোয়েন মাথা ঝাঁকিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলো। সব একে একে মনে পড়তেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। মাথার পেছনে সুপারির মতো ফুলে গেছে। ব্যাথা করছে। রাহাকে দেখে কপাল ভাঁজ করলো রোয়েন। সাথেসাথে পেট গুলিয়ে গলার কাছে এসে ঠেকলো তেঁতো পানি। দৌড়ে বেসিনের কাছে গেল রোয়েন। পানির কল ছেড়ে গড়গড় করে বমি করে দিল। রাহা ভয় পেয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে ধরলো রোয়েনকে।
‘ ঠিক আছেন? কয়মাস চলছে?
বলতে না বলতেই রোয়েন শক্ত করে ধরলো তাকে। তারপর ঘনঘন কুলি আর মুখে পানি দিয়ে বলল
‘ রাহা আমি দাঁড়াতে পারছিনা। আমাকে বেডের কাছে যেতে সাহায্য করো।
রাহা নিয়ে গেল। রোয়েন ধপ করে শুইয়ে পড়ল সাথে রাহাকে নিয়ে । রাহা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল
‘ সবসময় বেয়াদবি।
রোয়েন চোখ বন্ধ করে বলল
‘ রাহা বাইরে কি হয়েছে? ওরা এমন করছে কেন?
রাহা ব্যঙ্গ করে বলল
‘ মাল একচেঞ্জ হয়ে গিয়েছে তাই।
রোয়েন চোখ মেলে তাকালো। যতটা সম্ভব চাপা গর্জন করে বলল
‘ ছিঃ রাহা। ছিঃ।
রাহা বলল
‘ দরজা খুললে আমাকে নিয়ে যাবে। কিছু একটা করুন। আমার ভয় লাগছে।
রোয়েন বহুকষ্টে উঠে বসলো। বলল
‘ দরজা খুলে দাও। যাও।
রাহা বলল
‘ নাহ, নাহ। আমি যাব না।
রোয়েন বলল
‘ আমি আছি রাহা। যাও।
রাহা কাঁপা-কাঁপা পায়ে এগোলো। বারবার রোয়েনের দিকে ফিরে তাকালো।
দরজা খোলার সাথে সাথে রাহার গালে কষে চড় বসালো ডলি। রাহা আর্তনাদ করে উঠলো। রোয়েন দাঁড়িয়ে থাকলো। চোয়াল ফুলে উঠলো তার। ডলি রুমে ডুকে এসে বলল
‘ তোকে ওই ঘরে যেতে বলেছি ***। তুই এখানে কি করছিস?
রাহা গালে হাত দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল
‘ আমি যাব না। যাব না।
ডলি রোয়েনকে দেখিয়ে বলল
‘ শেষমেশ তোর এর সাথে রাত কাটতে ইচ্ছে হইছে। এ কোনো টাকা দেয় নাই। তোদের দুইজন আমাদের কাজ করবি শুধু।
রাহা রোয়েনের পেছনে দৌড়ে গেল। রোয়েনের পেছনের শার্ট আঁকড়ে ধরে বলল
‘ আমি যাব না রোয়েন ভাইয়া।
রোয়েন পকেটে হাত গুঁজলো। টাকাগুলো তার জায়গায় আছে। ভাগ্যিস!
ডলি তেড়ে আসলো। রাহার হাত ধরতেই রোয়েন রাহার হাত ধরলো শক্ত করে। ডলির মুখে কষে চড় বসিয়ে টাকা ছুঁড়ে মেরে বলল
‘ কিনে নিয়েছি। যাহ এবার।
ডলি টাকা পেয়ে চড়ের কথা ভুলে গেল। টাকা কুড়িয়ে নিয়ে গুনতে গুনতে চলে গেল। রাহা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো রোয়েনের দিকে। গাল দিয়ে অনবরত পানি পড়লো। থামার নামগন্ধ নেই। রোয়েন দরজায় খিল লাগিয়ে দুই আঙুল দিয়ে থুতনি ম্যাসাজ করতে করতে ভাবনায় পড়লো। তখুনি রাহার ফুঁপানি অনুসরণ করে চোখ তুললো রোয়েন। বিরক্ত হয়ে বলল
‘ কি হয়েছে রাহা?
রাহা বলল
‘ আপনি কিনে নিয়েছেন আমায়? আর কয়জনকে কিনেছেন? কত রাত কাটিয়েছেন এখানে?
রোয়েন ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো। জবাব দিল না। রাহা আর ও জোরো ফুঁপিয়ে উঠে বলল
‘ ছিহঃ।
রোয়েন রেগেমেগে তেড়ে এল। আঙুল দেখিয়ে শাঁসিয়ে বলল
‘ একদম চুপ। বেশি কথা বললে পাঠিয়ে দেব । তোমার বোকামোর জন্য সব হয়েছে। কে পালাতে বলেছে তোমাকে? আবার আমাকে সন্দেহ করছ?
রাহা গালে হাত দিয়ে বলল
‘ আমি এখানে কেন এসেছেন?
দাঁতে দাঁত পিষলো রোয়েন।
‘ তোমাকে খুঁজতে এসেছি৷ আর এসে আমি নিজে ফেঁসে গিয়েছি। তুমি সব নষ্টের মূল রাহা।
রাহা ক্ষেপে উঠলো।
‘ আমি নষ্টের মূল? আপনি বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলেন আমায়৷ আর আমি বিয়ে করে নিতাম?
‘ করতে। সমস্যা কোথায়? মিরন ভালো ছেলে।
‘ আমি ভালোবাসিনা ওই লোককে।
‘ ভালোবাসা! এই শব্দটাই জাস্ট ফালতু রাহা৷ নষ্ট করে দিয়েছে তোমায়। আরেহ বিয়ের পর ভালোবাসা যায়। এই সামান্য কথাটা তোমার মতো বোকারা বুঝেনা, আফসোস এখানেই।
রাহা ফুলেফেঁপে তাকিয়ে থাকলো। লালচে হয়ে আসা নাকের ডগা ঘষা মেরে বলল
‘ আমি চলে যাব এক্ষুণি।
রোয়েন তাকিয়ে রইলো।
রাহা দরজার কাছে গেল হনহনিয়ে। খিল খুলার জন্য পায়ের আঙুলে ভর দিল। টান মেরে খিল খুলে বাইরে বের হয়ে যায়। দরজার বাইরে বের হয়ে গালে হাত দিয়ে কেঁদে দেয়। রোয়েন ধপ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। রাহা পেছনে ফিরে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে দেখে জোরে ধাক্কা মারে। দরজায় খিল না দেওয়ায় রাহা এসে পড়ে রোয়েনের কাছে। বুকে মাথা ঠেকিয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে রাহা। দুপা পিছু চলে যায় রোয়েন। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাহা কেঁদেই যায়। শেষমেশ রোয়োনের পিঠের কাছে শার্ট টেনে নাক টেনে বলে
‘ আমি ভালোবাসিনা আপনাকে।
রোয়েন বলল
‘ গুড। কাঁদা শেষ হলে এবার ছাড়ো। এখান থেকে ছাড়া কিভাবে পাব তা নিয়ে ভাবো। ভালোবাসা, আবেগ এসবকে আপাতত সাইডে রাখো।
রাহা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় রোয়েনকে। তারপর গাল মুছে বলে
‘ আপনি চলে যান। আমি যেভাবে এসেছি সেভাবে যাব।
বিদ্রুপ করে হাসলো রোয়েন। মুখে মানুষ অনেক কিছু বলে।
রাহা বলল
‘ তো এখন কি হবে?
রোয়েন হাতের কব্জিতে থাকা ঘড়ি দেখে বলল
‘ রাত দেড়টা। মনে হচ্ছেনা ছাড়া পাব। কাল সকাল অব্ধি অপেক্ষা করতে হবে।
রাহা বলল
‘ এতক্ষণ না খেয়ে কিভাবে থাকবো? রোয়েন চিন্তায় পড়লো। রাহা বলল
‘ ওদের বলেন আমার ব্যাগটা দিতে। ওখানে খাবার আছে।
রোয়েন বলল
‘ সিউর?
‘ হ্যা, আপু প্যাক করে দিয়েছিল।
‘ সব ব্যবস্থা করেই এসেছ।
রাহা চুপ করে থাকলো। রোয়েন দরজা খুলে হাঁক ছাড়লো। একজন লোক দৌড়ে এসে বলল
‘ কি চাই?
‘ আমার কাছে যে মেয়েটা আছে, ওই মেয়ের ব্যাগটা দিতে বলো তাড়াতাড়ি।
লোকটা দৌড়ে গেল। দৌড়ে আসলো। ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বলল
‘ কাল সকালেই মেয়েটাকে দিয়ে দিতে হবে।
রোয়েন ধপ করে দরজা বন্ধ করলো।
রাহা ব্যাগ খুলে শাড়ি বের করলো। টাকাগুলো পেলনা। ফোন ও পেলনা। খাবারের বক্সটা পেল। গায়ে হলুদের জন্য করা রান্না। কয়েকটা নাশতা। তিনটা আপেল। রাহা খুশি হলো। বলল
‘ ডাক্তার আপনি খাবেন না?
‘ নাহ।
মুখ মোচড়ালো রাহা। ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়ি পাল্টালো। মুখ হাত ধুঁয়ে এসে খাবারের বক্স খুলে বলল
‘ ডাক্তার এতগুলো আমি খেতে পারবো না। আপনি ও খাবেন কেমন?
‘ এক কথা বারবার বলতে ইচ্ছে করেনা রাহা।
রাহা দু তিন লোকমা খেল। বলল
‘ ডাক্তার আমি খাইয়ে দিই? দিই?
‘ নাহ।
রাহা এগিয়ে গেল। রোয়েনের পাশে বসে ভাত মেখে রোয়েনের মুখের কাছে দিয়ে বলল
‘ আমার পেট কামড়াবে আপনি না খেলে। আপনি তো জানেন পেট কামড়ালে আমার জান যায় যায় অবস্থা।
রোয়েন বলল
‘ রাহা খাব না আমি। বুঝার চেষ্টা করো। এসব নামবেনা আমার গলা দিয়ে। চিন্তায় আছি আমি।
রাহা সেই ফাঁকে খাইয়ে দিল রোয়েনকে। হেসে বলল
‘ না খেলে ক্লান্ত লাগবে। তখন আমাকে নিয়ে পালাবেন কি করে?
‘ হাত ধুঁয়েছ?
‘ নাহ, ধুঁইনি। মাথার উঁকুন মেরেছি, চুল বেঁধেছি। তারপর সেই হাত দিয়ে আপনাকে খাওয়াচ্ছি।
নাকমুখ কুঁচকে ফেলল রোয়েন। ভাত গালে নাকমুখ কুঁচকানো চেহারাটা দেখতেই হাসি পেল রাহার। সে ঠোঁট টিপে হেসে বলল
‘ একদম না। কতবার হাত ধুঁয়েছি জানেন। শুধু সমস্যা এটাই, আমি যে হাত দিয়ে খেয়েছি ওই হাত দিয়ে আপনাকে ও খাইয়েছি।
ঢকঢক করে পানি খেয়ে দূরে সরে পড়লো রোয়েন। রাহা হাসতে হাসতে খেল। ফিল্টারের পানি দিয়ে আপেল ধুঁয়ে রোয়েনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ আপেল খান। রোয়েন আপেল নিয়ে উপরে মেরে আবার ক্যাচ ধরতে ধরতে হাঁটলো এদিকওদিক। রাহা ধপ করে বিছানায় শুয়ে হামি দিতে দিতে বলল
‘ ডাক্তার গুড নাইট।
রোয়েন হাঁটতেই থাকলো। রাহা উঠে বসে বলল
‘ আপনি কোথায় ঘুমাবেন?
রোয়েন এদিকওদিক তাকালো। একটা চেয়ার ও নেই। রাহা নেমে গেল। পাল্টানো শাড়িটা মেঝেতে বিছিয়ে বালিশ ফেলে দুম করে শুয়ে পড়লো। বলল
‘ আপনি উপরে ঘুমান।
রোয়েম কোণা চোখে তাকালো। পরক্ষণে চিন্তায় মগ্ন হলো। রাহার ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত হিসেবে নিঃশ্বাসের আওয়াজ ভেসে এল। রোয়েন এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নিল রাহাকে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজে শুইয়ে পড়লো মেঝেতে শাড়িটার উপর। সোজা হয়ে শুইয়ে হাত রাখলো কপালের উপর। সকালে ভোরের আলো ফুটতেই রাহার চোখ খুলে গেল। সে দেখলো রোয়েনের গায়ে লেপ্টে আছে তার শাড়ি। আহা! বেচারা শাড়িটা কাঁথার মতো গায়ে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। লজ্জা লাগলো রাহার। সকাল সকাল লজ্জায় মরামরা হলো রাহা। ওই ঘুমকাতুরে লোকটা কি জানে? ধুরর।

সকাল আটটা হতে না হতেই দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ ভেসে এল। রাহা নিচে নেমে ধাক্কা মারলো রোয়েনকে। রোয়েন উঠে বসলো। রাহা বলল
‘ আমাকে নিয়ে যাবে। বাঁচান আমায়।
রোয়েন বলল
‘ আমি আছি। কেঁদোনা।
শান্তি, প্রশান্তিতে ভরে গেল মনটা। ভালোলাগায় ছেয়ে গেল মনপ্রাণ। ঠোঁটের কোণায় ফুটলো মৃদু হাসির ছটা। রোয়েন বলল,
‘ শুয়ে থাকো। যাতে মনে হয় তোমার জ্ঞান নেই।
রাহা বলল
‘ পারব?
‘ পারতে হবে রাহা।
রাহা গিয়ে শুইয়ে পড়লো। মাঝেমধ্যে চোখ খুলে দেখলো রোয়েনকে।

রোয়েন দরজা খুললো।
ডলি বলল
‘ মেয়েটাকে দে।
রোয়েন বলল
‘ মেয়েটার জ্ঞান নেই।
নাক সিটকালো ডলি।
‘ একেবারেই বেহুশ বানিয়ে ফেললি?
ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসলো রোয়েনের। বলল
‘ মেয়েটার জ্ঞান ফিরুক। তারপর পাঠিয়ে দেব।
ডলি বলল
‘ খাবার চলে আসবে, খেয়ে নিবি। তুই ও যেতে পারবিনা। রাতে কাজ আছে।
রোয়েন বলল
‘ আমি এসব কেন করব?
‘ টাকা পাবি।
‘ চাইনা টাকা।
‘ তো কি চাস?
রোয়েন ঘাড় ঘুরালো। রাহাকে দেখে বলল
‘ওই মেয়েটাকে।
ডলি বলল
‘ রাতে থাকতে পারবেনা। শুধু দিনের বেলা।
রোয়েন বলল
‘ ঠিক আছে।
ডলি চলে গেল।
রোয়েন ফিরে আসতেই রাহা বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে গেল। ঝাপটে রোয়েনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেঁদে বলল
‘ নাহ নাহ আমি কোথাও যাব না। বাড়িতে নিয়ে যান আমায়।
রোয়েন রাহাকে সরিয়ে দেয়। বলে
‘ রাহা কান্না নয়। যা বলছি শুনো।
রাহা সবটা শুনলো। বলল
‘ আমি পারবো না।
রোয়েন বলল
‘ তোমাকে পারতে হবে। নাহলে আর উপায় নেই। রাহা মাথা দুলালো।
সারাটাদিন পার হয়ে আবার অন্ধকার নামলো।

হালকা পিংক কালারের শাড়ি পড়া একটি মেয়ের আগমন ঘটলো মাত্র। রোয়েন পায়চারি করছিল রুমে। রাহা মাত্রই ওয়াশরুমে ডুকেছে। ডলি এসে বলল
‘ ওই মেয়েকে দিয়ে দে।
রোয়েন বলল
‘ চলে গিয়েছে। ডলি বলল
‘ ঠিকাছে দেখছি আমি।
বলেই মেয়েটির গায়ে চাপড় মেরে চলে গেল ডলি। মেয়েটি চাপা হাসলো। রোয়েনের দিকে এগিয়ে এসে বলল
‘ বয়স কত? নাম কি?
রোয়েন দূরে সরে দাঁড়ালো৷ রাহা ওয়াশরুম থেকে বের হলো। রোয়েনের দিকে চাকু ছুৃঁড়ে মারলো৷ রোয়েন চাকু ক্যাচ ধরে এহাত থেকে ও হাতে নিয়ে বলল
‘ কি চাই?
মেয়েটি ভয় পেলনা। গায়ে জড়ানো শাড়ি একটান দিয়ে সরিয়ে ফেলল। রাহা চোখ বন্ধ করে ফেলল। রোয়েনের দৃষ্টি মেঝেতে। মেয়েটি শাড়ি খুলে দূরে ছুঁড়ে মারলো। রাহা পিটপিট করে চোখ খুলে হা করে তাকিয়ে থাকলো।

মেয়েটা হো হো করে অট্রহাসি দিল। রাহা অবাক হয়ে বলল
‘ কে আপনি?
মেয়েটি পড়নের জিন্স, আর গায়ের কোর্টটি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল
‘ বহুকষ্টে এসবের উপর শাড়ি পেঁচিয়েছি। আপনি কি ডক্টর রোয়েন? আর তুমিই কি রাহা?
রোয়েন বলল
‘ হ্যা।
মেয়েটি বেডে বসে পড়ে বলল
‘ তাহলে তো কাজ আর ও সহজ হলো। দুজনকে একসাথে পেলাম। আমাকে ঈশান স্যার পাঠিয়েছে। আমি গুপ্তচর হিসেবে এসেছি। আপনাদের সাহায্য করতে। এখান থেকে উদ্ধার করতে। এটাই আমার কাজ। আমার নাম তনুশ্রী রয়।
রাহা দৌড়ে এল। বলল
‘ আর আমরা তো কতকিছু ভেবে ফেলেছি। সরি আপু।
তনুশ্রী হাসলো। বলল
‘ এভাবে না আসলে ওরা আমাকে ধরে ফেলতো। কতরূপে সাজতে হয় গোয়েন্দাদের।
রোয়েন বলল
‘ কি করবেন এখন?
তনুশ্রী বলল
‘ জাল টাকা দিয়েছি ওদের। ধরা পড়ার আগেই পালাতে হবে। স্যাররা বাইরে অপেক্ষা করছে। আমার ইশারা ফেলেই আসবে।
রোয়েন বলল
‘ পালানোর পথ আছে?
‘ অবশ্যই আছে। মাঝরাতে। যখন এরা সবাই মাস্তিতে থাকে। নেশায় বুদ হয় তখন।
রাহা বলল
‘ আচ্ছা আচ্ছা ততক্ষণে আমরা দুজন গল্প করি। ডাক্তার আপনি বাইরে যান।
‘ জাস্ট শাটআপ রাহা।
তনুশ্রী হেসে ফেলল। বলল
‘ ইটস ওকে মিঃ রোয়েন। রাহা একটু গল্প করতে চাইছে।
রোয়েন শান্ত হলো। রাহা নাক ফুলিয়ে বিড়বিড় করে বলল
‘ এখন শান্ত? হুহ, যেন তার বউ তারে শান্ত হতে বললো?
রোয়েন বলল
‘ আমাদের চিন্তা কি করে এখান থেকে পালানো যায়? আর রাহা।
রাহা বিছানায় শুয়ে পড়লো। ঘুমানোর ভান করলো। তনুশ্রী হাসলো। রোয়েন এদিকওদিক পায়চারি করলো। তনুশ্রী রাহাকে টেনে তুলে বসিয়ে বলল
‘ গল্প করো। মিঃ রোয়েন খাটে একপাশে এসে বসতে পারেন। নো প্রবলেম।
রোয়েন কোণায় এসে বসলো। হাতের ভর দিয়ে মাথা নিচু করে বসলো। রাহার বকবকানি শুরু হলো। বিয়ে থেকে পালানোর পুরো গল্পটা তনুশ্রীকে বলে নিজে নিজেই হাসিতে ফেটে পড়লো। তনুশ্রী জিজ্ঞেস করল
‘ তোমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে? পালালে কেন?
রাহা বলল
‘ হ্যা আছে তো। একদম গোঁয়ার। খ্যাঁকখ্যাঁক করা ছাড়া কিছুই পারেনা। আমার সাথে কুত্তার মতো ব্যবহার করে। পাত্তা দেয়না। ভাব বেশি। ঢং ঢং।
রোয়েন দাঁড়িয়ে পড়লো। হাতের ঘড়ি দেখে বলল
‘ রাহা এবার চুপ করো। মাথা ব্যাথা করছে আমার।
তনুশ্রী হেসে বলল
‘ ছেলেমানুষ তো তাই ছেলেদের বদনাম সহ্য হচ্ছেনা।
রাহা বলল
‘ ঠিক ঠিক।

রাত দেড়টা কি দুইটা। শাড়ি কোনোমতে পেঁচিয়ে দরজা খুলে বের হলো তনুশ্রী। পিস্তলটি লুকোনো। দরজা পর্যন্ত গিয়ে দেখলো সবাই নেশায় বুঁদ। তনুশ্রীকে দেখে বলল
‘ এই তুই এখানে কি করছিস?
তনুশ্রী বলল
‘ ঘুরছি। লোকগুলো হেসে রসিকতা করতে লাগলো। তনুশ্রী শাড়ির আঁচল ঘুরিয়ে গেল। বলল
‘ দরজাটা একটু খুলে দিবি? অপেক্ষা করছে সে।
লোকগুলোর একজন বলল
‘ কি দিবি?
তনুশ্রী হেসে বলল
‘ অনেককিছু। লোকগুলোর একজন উঠে দরজা খুলে দিল। সাথেসাথে গালে বাঁশি বাজালো তনুশ্রী। বের হয়ে গেল রোয়েন আর রাহা। রোয়েন রাহার হাত ধরে বের হয়ে গেল। লোকগুলোর কয়েকজন হাঁক ছাড়লো। দরজা খুলে দলেদলে লোক বের হলো। বড় সাইজের ধামা নিয়ে বের হলো ডলি। হুকুম ছাড়লো।
‘ এদের ধরে শেষ করে দে। যাহ। এরা পালালে সব শেষ। যাহ।
বলতে না বলতে ধারালো ধামাটি দিয়ে এক কোঁপ বসালো নেশায় ঢলতে থাকা একটা লোকের পিঠে৷ রক্তে ভেসে গেল সাথে সাথে। তনুশ্রীকে আটক করে ফেলল। রোয়েনের পিঠে ছুরিকাঘাত করায় রাহার হাত ছুটে গেল হাত থেকে। রাহাকে টেনে ধরলো লোকগুলো। শাড়ি টেনে ধরলো। রাহা শাড়ি আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে ডাকলো আল্লাহ!
রোয়েনে পিঠের আঘাত সহ্য করে নিয়ে বলল
‘ রাহা কিচ্ছু হবেনা।
তনুশ্রী এসে রোয়েনকে ধরলো। কয়েকজনের হাতে গুলি ছুঁড়লো। শেষমেশ গুলি শেষ হয়ে এল। তাকে ও আটক করে ফেলল লোকগুলো। মাথায় জোরে আঘাত বসাতেই ঢলে পড়লো তনুশ্রী। রাহা চেঁচিয়ে কেঁদে বলল
‘ রোয়েন ভাইয়া আমাকে বাঁচান। আমাকে মেরে ফেলবে এরা।
রোয়েনের সামনে শাড়ি টানতে লাগলো মাতাল লোকগুলো। রোয়েন গর্জন করল
‘ ওকে ছাড়। তোদের শেষ,
রাহা শাড়ি টেনে ধরে থুতু মারলো লোকগুলোর মুখে। কষে চড় ও বসালো। সাথে সাথে লোহার রড দ্বারা মাথায় আঘাত করা হলো রাহাকে। রাহা পড়ে গেল সাথে সাথে। রোয়েনের সামনে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল একটি গর্তের ভেতর। তারপর উপরে টেনে দিল একটি ঢাকনা। উপরে দিয়ে দিল লতাপাতা ঝোপঝাড়। ফুলগাছের টব। যাতে বুঝা না যায়। রোয়েনের মুখের ভাষা বন্ধ হয়ে গেল। সে স্তব্ধ হয়ে পড়লো। রোয়েনের দিকে এগিয়ে গেল ডলি। বড় চকচকে ধারালো ধামা দিয়ে ঘাড়ে কোঁপ বসাতেই হাত থেকে খসে পড়ে গেল সেটি। ডলির গায়ে লাগলো গুলি। অনবরত গুলি লাগায় ঝাঁঝড়া হয়ে পড়ে গেল সে। মাতাল লোকগুলো আধমরা হয়ে পড়ে রইলো।

দলে দলে পুলিশ ডুকে এল। রোয়েন হাঁটুভেঙ্গে বসে পড়লো। ধীরেধীরে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। জায়িদ আর ঈশান এসে পড়লো। জায়িদ মাথায় হাত দিল রোয়েনকে ওভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। নাহিল এসে এদিকওদিক তাকালো। রাহাকে ডাকলো।

রোয়েনকে আর তনুশ্রীকে এম্বুল্যান্সে তোলা হলো।
নাহিল মাটি আঁকড়ে ধরে বসে রইল। পুলিশ তন্নতন্ন করে খুঁজলো রাহাকে। কোথাও পেলনা। তবে পুলিশের পাহারা দিল।

হসপিটালে মৃত্যুর সাথে লড়লো রোয়েন। তনুশ্রীর জ্ঞান ফিরলো প্রায় দুইদিনের মাথায়। সে বলতে পারলোনা রাহা কোথায়। সে তো রাহাকে সামনেই দেখেছিল। রোয়েন বলতে পারবে রাহা কোথায়। সোরা পাগল পাগল হলো প্রায়। দুই বাড়িতে নেমে আসলো অন্ধকার। সালেহা মাথা চাপড়ে। সেই তেইশবছর আগের দিনগুলো হঠাৎ যেন ভেসে আসলো চোখের সামনে। তবে মধ্যরাতেই হসপিটাল থেকে নিখোঁজ রোয়েন। এত অসুস্থ শরীরে কোথায় যেতে পারে সে? সবাই আবার রোয়েনের নিখোঁজে দিশেহারা।

চলবে,

বিশ্বজয়ের হাসি যেন ঝুলছে রাহার ঠোঁটে। রক্ত গরম হয়ে যেন ফুটছে টগবগ করে। বাইরে তুমুল চেঁচামেচি। রাহা কান দিলোনা। যাইহোক না কেন সে মেরেই যাবে। হাতের ছুরিটা উপরে তুলে নিচে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ছেলেটার পিঠ বরাবর। বাম হাতের পিঠ দিয়ে কষে তখুনি চড় বসায় রোয়েন। হাতের চাকুটি দূরে ছিটকে পড়ে। সাথে রাহা ও। গালে হাত দিয়ে হু হু করে কেঁদে দেয়। রোয়েন মুখ ফিরে শুই। সাথেসাথে রাহার কান্না থেমে যায়। রাহা কান্না থামিয়ে দিয়ে আজগুবি বকবক করে।
‘ গোঁয়ার লোক একটা,, কুত্তার মতো ব্যবহার করে আমার সাথে। এখন এখানে এসে ঘুমাচ্ছে।
রোয়েন হাত নাড়িয়ে বলে
‘ লাইট অফ করো। ঘুম আসছেনা।
রাহা মাথা ঝাড়লো। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আসায় তাকে জ্বিনে ধরেছে। এখন কি হবে? জ্বিনটা তো তাকে ছাড়ছেই না। সে ভুলভাল দেখছে। আসতাগফিরুল্লাহ। কর্কশমার্কা গলা ভেসে আসলো।
‘ ননসেন্স লাইট অফ করো। আমার ঘুম আসছেনা। উফফ।
রাহা দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল
‘ আমি আপনার কথা শুনবো কেন? কে আপনি? দাদু বলেছিল জ্বিন মানুষের রূপ ধরে আসে। ও বাপ আমার ভয় লাগছে। আল্লাহ আমি এখন কি করব?
রোয়েন বালিশ টেনে কানের উপর দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল
‘ উফফ।
রাহা হাসলো। বলল
‘ ইচিং বিচিং তিচিং তাহ। জ্বিন ভূত তুই মরি যাহ।
রোয়েন গর্জন করল।
‘ এই মেয়ে?
রাহা তাড়াতাড়ি লাইট অফ করলো। আবার জ্বালিয়ে দিয়ে বলল
‘ আমার ভয় করে জ্বিনবাবু ।
রোয়েন উঠে বসলো
সাদা বালিশ রাহার দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল
‘ কে তুমি? উফফ। মাথা খেয়ে ফেললো।
রাহা বলল
‘ আপনার মাথা তো মাথার জায়গায় আছে। মিথ্যে বলেন কেন?
রোয়েন চোখ খুলতে চেয়ে ও পারলো না। আধখোলা চোখে খয়েরী পাড়ের হলুদ শাড়ি পড়া একটি মেয়েকে দেখলো। চোখবন্ধ অবস্থায় বলল
‘ তুমি রাহা?
রাহা চমকে উঠলো।
‘ জ্বিনটা তার নাম ও জানে? ও বাপ!
রাহা ছুরিটা কুড়িয়ে নিয়ে বলল
‘ তাড়াতাড়ি নিজের রূপে ফিরে আসো। নাহলে। নাহলে একদম এটা দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবো।
আওয়াজ করে হেসে দিল রোয়েন। ধপ করে আবার শুয়ে পড়ে বালিশ টেনে মাথার নিচে দিয়ে বলল
‘ রাহা গাধা। গাধার মা, গাধার বউ।
রাহা রেগে গেল। এদিকওদিক তাকিয়ে একটি হাতপাখা খুঁজে পেল। রোয়েনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দুম করে মেরে বলল
‘ আমি মোটেও গাধার বউ না। ডাক্তার কত্ত ট্যালেন্ট জানেন? বললেই হলো?
রোয়েন বেঘোর ঘুম। রাহা বলল
‘ এই ভূতটা এভাবে ঘুমায় কেন? ভূত আবার ঘুমায় নাকি?
রাহা মাথা ঝাঁকালো। রোয়েনের পাশে গিয়ে বসে গালে হাত দিল। রোয়েনকে আগাগোড়া দেখলো। একটু ঝুঁকে নাক টেনে বলল
‘ আরেহ এটাতো অরজিনিয়াল ডাক্তারের পারফিউমের গন্ধ। তারমানে এটা আসল ডাক্তার? এখানে কি করে এল? ওমাগো, এখন কি করব আমি? ছিঃ ডক্টর এখানে আসে ওসব করার জন্য, ছিঃ, ছিঃ। আমি বাড়ি যাই আগে, সব বলে দেব সবাইকে।
বলেই রাহা দুম করে কিল বসালো রোয়েনের পিঠে।

তারপর বেডসাইড টেবিল থেকে পানির জগ থেকে পানি নিয়ে ছিটকে মারলো রোয়েনের মুখে।
রোয়েন নড়েচড়ে উঠল। রাহা ডাকল
‘ অ্যাই ডাক্তার উঠেন। উঠেন বলছি। এখন গোসল করিয়ে দেব। উঠেন বলছি। অ্যাইই ডাক্তার।
রোয়েন উঠলো না। রাহা জগের পানি ঢালতে লাগলো রোয়েনের মুখ বরাবর। হাত নাড়িয়ে ঠেলে ফেলে দিল রোয়েন। জগটা পড়ে ঝনঝন আওয়াজ করে উঠলো। রাহা রোয়েনের চুল টেনে দিতেই রোয়েন ধরে ফেলল তার হাত। টান দিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল রাহা। রোয়েন আরও ভালো করে ঘুমাতে ঘুমাতে বলল
‘ রাহা চুপটি করে ঘুমাও। আমাকে ডিস্টার্ব করবেনা।
রাহা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকলো রোয়েনের দিকে। কিছু বলার জন্য যথেষ্ট শব্দ পেলোনা। রোয়েন রাহার দিকে মুখ করে আবারও ঘুমাতে লাগলো। রাহা বলল
‘ বেয়াদব ডাক্তার। আজকে আমার বিয়ের রাত, বাসর ঘর হওয়ার কথা। আপনার জন্য কিছু হয়নি।
রোয়েন ঘুম। রাহা উঠে বসলো। বলল
‘ বেয়াদব মানুষ। এখানে ঢং করতে আসে, এজন্যই তো আমাকে বিয়ে করতে চায়না। বেয়াদ্দব, ইতর। লুচ্চা ডাক্তার।
রাহা জোরে জোরে ডাকতে থাকে। ওদিকে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। রাহা কাঁদোকাঁদো হলো ভয়ে। রোয়েনের হাতের বাহু ছিলে গিয়েছে তা ও দেখতে পেল। শাড়ির আঁচল মুখে গুঁজে রাহা রোয়েনের গা ঝাঁকালো।
‘ রোয়েন ভাইয়া উঠুন। তাড়াতাড়ি। ওরা দরজা ধাক্কাচ্ছে। আমার ভয় লাগছে। এই ডাক্তার!
রোয়েন উঠে বসলো। ধমকে বলল
‘ উফফ শান্তি দেবে না আমায়?
রাহা রেগে গেল
‘ ওহহ এখানে শান্তির জন্য আসেন তাহলে? ওরেব্বাপ।
রোয়েন চোখ ঢলতে ঢলতে বলল
‘ তুমি আমার ঘরে কেন রাহা? যাও।
রাহা বলল
‘ এটা আপনার ঘর ও না, আমার ঘর ও না বেয়াদব ডাক্তার।
রোয়েন চোখ মেলে তাকালো। মাথা ভার এখনো। কড়াকন্ঠে জিজ্ঞেস করল রোয়েন
‘ বেয়াদব? কাকে বললে?
রাহা ভীতচোখে তাকালো। কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল
‘ বলিনি। বলিনি।
রোয়েন মাথা নিচু করে বসে রইলো। দরজার বাইরে তুমুল আওয়াজ। রোয়েন মাথা ঝাঁকিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলো। সব একে একে মনে পড়তেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। মাথার পেছনে সুপারির মতো ফুলে গেছে। ব্যাথা করছে। রাহাকে দেখে কপাল ভাঁজ করলো রোয়েন। সাথেসাথে পেট গুলিয়ে গলার কাছে এসে ঠেকলো তেঁতো পানি। দৌড়ে বেসিনের কাছে গেল রোয়েন। পানির কল ছেড়ে গড়গড় করে বমি করে দিল। রাহা ভয় পেয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে ধরলো রোয়েনকে।
‘ ঠিক আছেন? কয়মাস চলছে?
বলতে না বলতেই রোয়েন শক্ত করে ধরলো তাকে। তারপর ঘনঘন কুলি আর মুখে পানি দিয়ে বলল
‘ রাহা আমি দাঁড়াতে পারছিনা। আমাকে বেডের কাছে যেতে সাহায্য করো।
রাহা নিয়ে গেল। রোয়েন ধপ করে শুইয়ে পড়ল সাথে রাহাকে নিয়ে । রাহা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল
‘ সবসময় বেয়াদবি।
রোয়েন চোখ বন্ধ করে বলল
‘ রাহা বাইরে কি হয়েছে? ওরা এমন করছে কেন?
রাহা ব্যঙ্গ করে বলল
‘ মাল একচেঞ্জ হয়ে গিয়েছে তাই।
রোয়েন চোখ মেলে তাকালো। যতটা সম্ভব চাপা গর্জন করে বলল
‘ ছিঃ রাহা। ছিঃ।
রাহা বলল
‘ দরজা খুললে আমাকে নিয়ে যাবে। কিছু একটা করুন। আমার ভয় লাগছে।
রোয়েন বহুকষ্টে উঠে বসলো। বলল
‘ দরজা খুলে দাও। যাও।
রাহা বলল
‘ নাহ, নাহ। আমি যাব না।
রোয়েন বলল
‘ আমি আছি রাহা। যাও।
রাহা কাঁপা-কাঁপা পায়ে এগোলো। বারবার রোয়েনের দিকে ফিরে তাকালো।
দরজা খোলার সাথে সাথে রাহার গালে কষে চড় বসালো ডলি। রাহা আর্তনাদ করে উঠলো। রোয়েন দাঁড়িয়ে থাকলো। চোয়াল ফুলে উঠলো তার। ডলি রুমে ডুকে এসে বলল
‘ তোকে ওই ঘরে যেতে বলেছি ***। তুই এখানে কি করছিস?
রাহা গালে হাত দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল
‘ আমি যাব না। যাব না।
ডলি রোয়েনকে দেখিয়ে বলল
‘ শেষমেশ তোর এর সাথে রাত কাটতে ইচ্ছে হইছে। এ কোনো টাকা দেয় নাই। তোদের দুইজন আমাদের কাজ করবি শুধু।
রাহা রোয়েনের পেছনে দৌড়ে গেল। রোয়েনের পেছনের শার্ট আঁকড়ে ধরে বলল
‘ আমি যাব না রোয়েন ভাইয়া।
রোয়েন পকেটে হাত গুঁজলো। টাকাগুলো তার জায়গায় আছে। ভাগ্যিস!
ডলি তেড়ে আসলো। রাহার হাত ধরতেই রোয়েন রাহার হাত ধরলো শক্ত করে। ডলির মুখে কষে চড় বসিয়ে টাকা ছুঁড়ে মেরে বলল
‘ কিনে নিয়েছি। যাহ এবার।
ডলি টাকা পেয়ে চড়ের কথা ভুলে গেল। টাকা কুড়িয়ে নিয়ে গুনতে গুনতে চলে গেল। রাহা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো রোয়েনের দিকে। গাল দিয়ে অনবরত পানি পড়লো। থামার নামগন্ধ নেই। রোয়েন দরজায় খিল লাগিয়ে দুই আঙুল দিয়ে থুতনি ম্যাসাজ করতে করতে ভাবনায় পড়লো। তখুনি রাহার ফুঁপানি অনুসরণ করে চোখ তুললো রোয়েন। বিরক্ত হয়ে বলল
‘ কি হয়েছে রাহা?
রাহা বলল
‘ আপনি কিনে নিয়েছেন আমায়? আর কয়জনকে কিনেছেন? কত রাত কাটিয়েছেন এখানে?
রোয়েন ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো। জবাব দিল না। রাহা আর ও জোরো ফুঁপিয়ে উঠে বলল
‘ ছিহঃ।
রোয়েন রেগেমেগে তেড়ে এল। আঙুল দেখিয়ে শাঁসিয়ে বলল
‘ একদম চুপ। বেশি কথা বললে পাঠিয়ে দেব । তোমার বোকামোর জন্য সব হয়েছে। কে পালাতে বলেছে তোমাকে? আবার আমাকে সন্দেহ করছ?
রাহা গালে হাত দিয়ে বলল
‘ আমি এখানে কেন এসেছেন?
দাঁতে দাঁত পিষলো রোয়েন।
‘ তোমাকে খুঁজতে এসেছি৷ আর এসে আমি নিজে ফেঁসে গিয়েছি। তুমি সব নষ্টের মূল রাহা।
রাহা ক্ষেপে উঠলো।
‘ আমি নষ্টের মূল? আপনি বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলেন আমায়৷ আর আমি বিয়ে করে নিতাম?
‘ করতে। সমস্যা কোথায়? মিরন ভালো ছেলে।
‘ আমি ভালোবাসিনা ওই লোককে।
‘ ভালোবাসা! এই শব্দটাই জাস্ট ফালতু রাহা৷ নষ্ট করে দিয়েছে তোমায়। আরেহ বিয়ের পর ভালোবাসা যায়। এই সামান্য কথাটা তোমার মতো বোকারা বুঝেনা, আফসোস এখানেই।
রাহা ফুলেফেঁপে তাকিয়ে থাকলো। লালচে হয়ে আসা নাকের ডগা ঘষা মেরে বলল
‘ আমি চলে যাব এক্ষুণি।
রোয়েন তাকিয়ে রইলো।
রাহা দরজার কাছে গেল হনহনিয়ে। খিল খুলার জন্য পায়ের আঙুলে ভর দিল। টান মেরে খিল খুলে বাইরে বের হয়ে যায়। দরজার বাইরে বের হয়ে গালে হাত দিয়ে কেঁদে দেয়। রোয়েন ধপ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। রাহা পেছনে ফিরে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে দেখে জোরে ধাক্কা মারে। দরজায় খিল না দেওয়ায় রাহা এসে পড়ে রোয়েনের কাছে। বুকে মাথা ঠেকিয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে রাহা। দুপা পিছু চলে যায় রোয়েন। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাহা কেঁদেই যায়। শেষমেশ রোয়োনের পিঠের কাছে শার্ট টেনে নাক টেনে বলে
‘ আমি ভালোবাসিনা আপনাকে।
রোয়েন বলল
‘ গুড। কাঁদা শেষ হলে এবার ছাড়ো। এখান থেকে ছাড়া কিভাবে পাব তা নিয়ে ভাবো। ভালোবাসা, আবেগ এসবকে আপাতত সাইডে রাখো।
রাহা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় রোয়েনকে। তারপর গাল মুছে বলে
‘ আপনি চলে যান। আমি যেভাবে এসেছি সেভাবে যাব।
বিদ্রুপ করে হাসলো রোয়েন। মুখে মানুষ অনেক কিছু বলে।
রাহা বলল
‘ তো এখন কি হবে?
রোয়েন হাতের কব্জিতে থাকা ঘড়ি দেখে বলল
‘ রাত দেড়টা। মনে হচ্ছেনা ছাড়া পাব। কাল সকাল অব্ধি অপেক্ষা করতে হবে।
রাহা বলল
‘ এতক্ষণ না খেয়ে কিভাবে থাকবো? রোয়েন চিন্তায় পড়লো। রাহা বলল
‘ ওদের বলেন আমার ব্যাগটা দিতে। ওখানে খাবার আছে।
রোয়েন বলল
‘ সিউর?
‘ হ্যা, আপু প্যাক করে দিয়েছিল।
‘ সব ব্যবস্থা করেই এসেছ।
রাহা চুপ করে থাকলো। রোয়েন দরজা খুলে হাঁক ছাড়লো। একজন লোক দৌড়ে এসে বলল
‘ কি চাই?
‘ আমার কাছে যে মেয়েটা আছে, ওই মেয়ের ব্যাগটা দিতে বলো তাড়াতাড়ি।
লোকটা দৌড়ে গেল। দৌড়ে আসলো। ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বলল
‘ কাল সকালেই মেয়েটাকে দিয়ে দিতে হবে।
রোয়েন ধপ করে দরজা বন্ধ করলো।
রাহা ব্যাগ খুলে শাড়ি বের করলো। টাকাগুলো পেলনা। ফোন ও পেলনা। খাবারের বক্সটা পেল। গায়ে হলুদের জন্য করা রান্না। কয়েকটা নাশতা। তিনটা আপেল। রাহা খুশি হলো। বলল
‘ ডাক্তার আপনি খাবেন না?
‘ নাহ।
মুখ মোচড়ালো রাহা। ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়ি পাল্টালো। মুখ হাত ধুঁয়ে এসে খাবারের বক্স খুলে বলল
‘ ডাক্তার এতগুলো আমি খেতে পারবো না। আপনি ও খাবেন কেমন?
‘ এক কথা বারবার বলতে ইচ্ছে করেনা রাহা।
রাহা দু তিন লোকমা খেল। বলল
‘ ডাক্তার আমি খাইয়ে দিই? দিই?
‘ নাহ।
রাহা এগিয়ে গেল। রোয়েনের পাশে বসে ভাত মেখে রোয়েনের মুখের কাছে দিয়ে বলল
‘ আমার পেট কামড়াবে আপনি না খেলে। আপনি তো জানেন পেট কামড়ালে আমার জান যায় যায় অবস্থা।
রোয়েন বলল
‘ রাহা খাব না আমি। বুঝার চেষ্টা করো। এসব নামবেনা আমার গলা দিয়ে। চিন্তায় আছি আমি।
রাহা সেই ফাঁকে খাইয়ে দিল রোয়েনকে। হেসে বলল
‘ না খেলে ক্লান্ত লাগবে। তখন আমাকে নিয়ে পালাবেন কি করে?
‘ হাত ধুঁয়েছ?
‘ নাহ, ধুঁইনি। মাথার উঁকুন মেরেছি, চুল বেঁধেছি। তারপর সেই হাত দিয়ে আপনাকে খাওয়াচ্ছি।
নাকমুখ কুঁচকে ফেলল রোয়েন। ভাত গালে নাকমুখ কুঁচকানো চেহারাটা দেখতেই হাসি পেল রাহার। সে ঠোঁট টিপে হেসে বলল
‘ একদম না। কতবার হাত ধুঁয়েছি জানেন। শুধু সমস্যা এটাই, আমি যে হাত দিয়ে খেয়েছি ওই হাত দিয়ে আপনাকে ও খাইয়েছি।
ঢকঢক করে পানি খেয়ে দূরে সরে পড়লো রোয়েন। রাহা হাসতে হাসতে খেল। ফিল্টারের পানি দিয়ে আপেল ধুঁয়ে রোয়েনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ আপেল খান। রোয়েন আপেল নিয়ে উপরে মেরে আবার ক্যাচ ধরতে ধরতে হাঁটলো এদিকওদিক। রাহা ধপ করে বিছানায় শুয়ে হামি দিতে দিতে বলল
‘ ডাক্তার গুড নাইট।
রোয়েন হাঁটতেই থাকলো। রাহা উঠে বসে বলল
‘ আপনি কোথায় ঘুমাবেন?
রোয়েন এদিকওদিক তাকালো। একটা চেয়ার ও নেই। রাহা নেমে গেল। পাল্টানো শাড়িটা মেঝেতে বিছিয়ে বালিশ ফেলে দুম করে শুয়ে পড়লো। বলল
‘ আপনি উপরে ঘুমান।
রোয়েম কোণা চোখে তাকালো। পরক্ষণে চিন্তায় মগ্ন হলো। রাহার ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত হিসেবে নিঃশ্বাসের আওয়াজ ভেসে এল। রোয়েন এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নিল রাহাকে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজে শুইয়ে পড়লো মেঝেতে শাড়িটার উপর। সোজা হয়ে শুইয়ে হাত রাখলো কপালের উপর। সকালে ভোরের আলো ফুটতেই রাহার চোখ খুলে গেল। সে দেখলো রোয়েনের গায়ে লেপ্টে আছে তার শাড়ি। আহা! বেচারা শাড়িটা কাঁথার মতো গায়ে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। লজ্জা লাগলো রাহার। সকাল সকাল লজ্জায় মরামরা হলো রাহা। ওই ঘুমকাতুরে লোকটা কি জানে? ধুরর।

সকাল আটটা হতে না হতেই দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ ভেসে এল। রাহা নিচে নেমে ধাক্কা মারলো রোয়েনকে। রোয়েন উঠে বসলো। রাহা বলল
‘ আমাকে নিয়ে যাবে। বাঁচান আমায়।
রোয়েন বলল
‘ আমি আছি। কেঁদোনা।
শান্তি, প্রশান্তিতে ভরে গেল মনটা। ভালোলাগায় ছেয়ে গেল মনপ্রাণ। ঠোঁটের কোণায় ফুটলো মৃদু হাসির ছটা। রোয়েন বলল,
‘ শুয়ে থাকো। যাতে মনে হয় তোমার জ্ঞান নেই।
রাহা বলল
‘ পারব?
‘ পারতে হবে রাহা।
রাহা গিয়ে শুইয়ে পড়লো। মাঝেমধ্যে চোখ খুলে দেখলো রোয়েনকে।

রোয়েন দরজা খুললো।
ডলি বলল
‘ মেয়েটাকে দে।
রোয়েন বলল
‘ মেয়েটার জ্ঞান নেই।
নাক সিটকালো ডলি।
‘ একেবারেই বেহুশ বানিয়ে ফেললি?
ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসলো রোয়েনের। বলল
‘ মেয়েটার জ্ঞান ফিরুক। তারপর পাঠিয়ে দেব।
ডলি বলল
‘ খাবার চলে আসবে, খেয়ে নিবি। তুই ও যেতে পারবিনা। রাতে কাজ আছে।
রোয়েন বলল
‘ আমি এসব কেন করব?
‘ টাকা পাবি।
‘ চাইনা টাকা।
‘ তো কি চাস?
রোয়েন ঘাড় ঘুরালো। রাহাকে দেখে বলল
‘ওই মেয়েটাকে।
ডলি বলল
‘ রাতে থাকতে পারবেনা। শুধু দিনের বেলা।
রোয়েন বলল
‘ ঠিক আছে।
ডলি চলে গেল।
রোয়েন ফিরে আসতেই রাহা বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে গেল। ঝাপটে রোয়েনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেঁদে বলল
‘ নাহ নাহ আমি কোথাও যাব না। বাড়িতে নিয়ে যান আমায়।
রোয়েন রাহাকে সরিয়ে দেয়। বলে
‘ রাহা কান্না নয়। যা বলছি শুনো।
রাহা সবটা শুনলো। বলল
‘ আমি পারবো না।
রোয়েন বলল
‘ তোমাকে পারতে হবে। নাহলে আর উপায় নেই। রাহা মাথা দুলালো।
সারাটাদিন পার হয়ে আবার অন্ধকার নামলো।

হালকা পিংক কালারের শাড়ি পড়া একটি মেয়ের আগমন ঘটলো মাত্র। রোয়েন পায়চারি করছিল রুমে। রাহা মাত্রই ওয়াশরুমে ডুকেছে। ডলি এসে বলল
‘ ওই মেয়েকে দিয়ে দে।
রোয়েন বলল
‘ চলে গিয়েছে। ডলি বলল
‘ ঠিকাছে দেখছি আমি।
বলেই মেয়েটির গায়ে চাপড় মেরে চলে গেল ডলি। মেয়েটি চাপা হাসলো। রোয়েনের দিকে এগিয়ে এসে বলল
‘ বয়স কত? নাম কি?
রোয়েন দূরে সরে দাঁড়ালো৷ রাহা ওয়াশরুম থেকে বের হলো। রোয়েনের দিকে চাকু ছুৃঁড়ে মারলো৷ রোয়েন চাকু ক্যাচ ধরে এহাত থেকে ও হাতে নিয়ে বলল
‘ কি চাই?
মেয়েটি ভয় পেলনা। গায়ে জড়ানো শাড়ি একটান দিয়ে সরিয়ে ফেলল। রাহা চোখ বন্ধ করে ফেলল। রোয়েনের দৃষ্টি মেঝেতে। মেয়েটি শাড়ি খুলে দূরে ছুঁড়ে মারলো। রাহা পিটপিট করে চোখ খুলে হা করে তাকিয়ে থাকলো।

মেয়েটা হো হো করে অট্রহাসি দিল। রাহা অবাক হয়ে বলল
‘ কে আপনি?
মেয়েটি পড়নের জিন্স, আর গায়ের কোর্টটি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল
‘ বহুকষ্টে এসবের উপর শাড়ি পেঁচিয়েছি। আপনি কি ডক্টর রোয়েন? আর তুমিই কি রাহা?
রোয়েন বলল
‘ হ্যা।
মেয়েটি বেডে বসে পড়ে বলল
‘ তাহলে তো কাজ আর ও সহজ হলো। দুজনকে একসাথে পেলাম। আমাকে ঈশান স্যার পাঠিয়েছে। আমি গুপ্তচর হিসেবে এসেছি। আপনাদের সাহায্য করতে। এখান থেকে উদ্ধার করতে। এটাই আমার কাজ। আমার নাম তনুশ্রী রয়।
রাহা দৌড়ে এল। বলল
‘ আর আমরা তো কতকিছু ভেবে ফেলেছি। সরি আপু।
তনুশ্রী হাসলো। বলল
‘ এভাবে না আসলে ওরা আমাকে ধরে ফেলতো। কতরূপে সাজতে হয় গোয়েন্দাদের।
রোয়েন বলল
‘ কি করবেন এখন?
তনুশ্রী বলল
‘ জাল টাকা দিয়েছি ওদের। ধরা পড়ার আগেই পালাতে হবে। স্যাররা বাইরে অপেক্ষা করছে। আমার ইশারা ফেলেই আসবে।
রোয়েন বলল
‘ পালানোর পথ আছে?
‘ অবশ্যই আছে। মাঝরাতে। যখন এরা সবাই মাস্তিতে থাকে। নেশায় বুদ হয় তখন।
রাহা বলল
‘ আচ্ছা আচ্ছা ততক্ষণে আমরা দুজন গল্প করি। ডাক্তার আপনি বাইরে যান।
‘ জাস্ট শাটআপ রাহা।
তনুশ্রী হেসে ফেলল। বলল
‘ ইটস ওকে মিঃ রোয়েন। রাহা একটু গল্প করতে চাইছে।
রোয়েন শান্ত হলো। রাহা নাক ফুলিয়ে বিড়বিড় করে বলল
‘ এখন শান্ত? হুহ, যেন তার বউ তারে শান্ত হতে বললো?
রোয়েন বলল
‘ আমাদের চিন্তা কি করে এখান থেকে পালানো যায়? আর রাহা।
রাহা বিছানায় শুয়ে পড়লো। ঘুমানোর ভান করলো। তনুশ্রী হাসলো। রোয়েন এদিকওদিক পায়চারি করলো। তনুশ্রী রাহাকে টেনে তুলে বসিয়ে বলল
‘ গল্প করো। মিঃ রোয়েন খাটে একপাশে এসে বসতে পারেন। নো প্রবলেম।
রোয়েন কোণায় এসে বসলো। হাতের ভর দিয়ে মাথা নিচু করে বসলো। রাহার বকবকানি শুরু হলো। বিয়ে থেকে পালানোর পুরো গল্পটা তনুশ্রীকে বলে নিজে নিজেই হাসিতে ফেটে পড়লো। তনুশ্রী জিজ্ঞেস করল
‘ তোমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে? পালালে কেন?
রাহা বলল
‘ হ্যা আছে তো। একদম গোঁয়ার। খ্যাঁকখ্যাঁক করা ছাড়া কিছুই পারেনা। আমার সাথে কুত্তার মতো ব্যবহার করে। পাত্তা দেয়না। ভাব বেশি। ঢং ঢং।
রোয়েন দাঁড়িয়ে পড়লো। হাতের ঘড়ি দেখে বলল
‘ রাহা এবার চুপ করো। মাথা ব্যাথা করছে আমার।
তনুশ্রী হেসে বলল
‘ ছেলেমানুষ তো তাই ছেলেদের বদনাম সহ্য হচ্ছেনা।
রাহা বলল
‘ ঠিক ঠিক।

রাত দেড়টা কি দুইটা। শাড়ি কোনোমতে পেঁচিয়ে দরজা খুলে বের হলো তনুশ্রী। পিস্তলটি লুকোনো। দরজা পর্যন্ত গিয়ে দেখলো সবাই নেশায় বুঁদ। তনুশ্রীকে দেখে বলল
‘ এই তুই এখানে কি করছিস?
তনুশ্রী বলল
‘ ঘুরছি। লোকগুলো হেসে রসিকতা করতে লাগলো। তনুশ্রী শাড়ির আঁচল ঘুরিয়ে গেল। বলল
‘ দরজাটা একটু খুলে দিবি? অপেক্ষা করছে সে।
লোকগুলোর একজন বলল
‘ কি দিবি?
তনুশ্রী হেসে বলল
‘ অনেককিছু। লোকগুলোর একজন উঠে দরজা খুলে দিল। সাথেসাথে গালে বাঁশি বাজালো তনুশ্রী। বের হয়ে গেল রোয়েন আর রাহা। রোয়েন রাহার হাত ধরে বের হয়ে গেল। লোকগুলোর কয়েকজন হাঁক ছাড়লো। দরজা খুলে দলেদলে লোক বের হলো। বড় সাইজের ধামা নিয়ে বের হলো ডলি। হুকুম ছাড়লো।
‘ এদের ধরে শেষ করে দে। যাহ। এরা পালালে সব শেষ। যাহ।
বলতে না বলতে ধারালো ধামাটি দিয়ে এক কোঁপ বসালো নেশায় ঢলতে থাকা একটা লোকের পিঠে৷ রক্তে ভেসে গেল সাথে সাথে। তনুশ্রীকে আটক করে ফেলল। রোয়েনের পিঠে ছুরিকাঘাত করায় রাহার হাত ছুটে গেল হাত থেকে। রাহাকে টেনে ধরলো লোকগুলো। শাড়ি টেনে ধরলো। রাহা শাড়ি আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে ডাকলো আল্লাহ!
রোয়েনে পিঠের আঘাত সহ্য করে নিয়ে বলল
‘ রাহা কিচ্ছু হবেনা।
তনুশ্রী এসে রোয়েনকে ধরলো। কয়েকজনের হাতে গুলি ছুঁড়লো। শেষমেশ গুলি শেষ হয়ে এল। তাকে ও আটক করে ফেলল লোকগুলো। মাথায় জোরে আঘাত বসাতেই ঢলে পড়লো তনুশ্রী। রাহা চেঁচিয়ে কেঁদে বলল
‘ রোয়েন ভাইয়া আমাকে বাঁচান। আমাকে মেরে ফেলবে এরা।
রোয়েনের সামনে শাড়ি টানতে লাগলো মাতাল লোকগুলো। রোয়েন গর্জন করল
‘ ওকে ছাড়। তোদের শেষ,
রাহা শাড়ি টেনে ধরে থুতু মারলো লোকগুলোর মুখে। কষে চড় ও বসালো। সাথে সাথে লোহার রড দ্বারা মাথায় আঘাত করা হলো রাহাকে। রাহা পড়ে গেল সাথে সাথে। রোয়েনের সামনে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল একটি গর্তের ভেতর। তারপর উপরে টেনে দিল একটি ঢাকনা। উপরে দিয়ে দিল লতাপাতা ঝোপঝাড়। ফুলগাছের টব। যাতে বুঝা না যায়। রোয়েনের মুখের ভাষা বন্ধ হয়ে গেল। সে স্তব্ধ হয়ে পড়লো। রোয়েনের দিকে এগিয়ে গেল ডলি। বড় চকচকে ধারালো ধামা দিয়ে ঘাড়ে কোঁপ বসাতেই হাত থেকে খসে পড়ে গেল সেটি। ডলির গায়ে লাগলো গুলি। অনবরত গুলি লাগায় ঝাঁঝড়া হয়ে পড়ে গেল সে। মাতাল লোকগুলো আধমরা হয়ে পড়ে রইলো।

দলে দলে পুলিশ ডুকে এল। রোয়েন হাঁটুভেঙ্গে বসে পড়লো। ধীরেধীরে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। জায়িদ আর ঈশান এসে পড়লো। জায়িদ মাথায় হাত দিল রোয়েনকে ওভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। নাহিল এসে এদিকওদিক তাকালো। রাহাকে ডাকলো।

রোয়েনকে আর তনুশ্রীকে এম্বুল্যান্সে তোলা হলো।
নাহিল মাটি আঁকড়ে ধরে বসে রইল। পুলিশ তন্নতন্ন করে খুঁজলো রাহাকে। কোথাও পেলনা। তবে পুলিশের পাহারা দিল।

হসপিটালে মৃত্যুর সাথে লড়লো রোয়েন। তনুশ্রীর জ্ঞান ফিরলো প্রায় দুইদিনের মাথায়। সে বলতে পারলোনা রাহা কোথায়। সে তো রাহাকে সামনেই দেখেছিল। রোয়েন বলতে পারবে রাহা কোথায়। সোরা পাগল পাগল হলো প্রায়। দুই বাড়িতে নেমে আসলো অন্ধকার। সালেহা মাথা চাপড়ে। সেই তেইশবছর আগের দিনগুলো হঠাৎ যেন ভেসে আসলো চোখের সামনে। তবে মধ্যরাতেই হসপিটাল থেকে নিখোঁজ রোয়েন। এত অসুস্থ শরীরে কোথায় যেতে পারে সে? সবাই আবার রোয়েনের নিখোঁজে দিশেহারা।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here