যে শ্রাবণে এলে তুমি পর্ব:৭

0
724

যে শ্রাবণে এলে তুমি💕💕
পর্ব:7
লেখনিতে:মৌসুমী

.
.
.
.
.
গাড়ি চলছে তার নিজস্ব গতিতে।জানালার পাশে তুলতুলকে কোলে নিয়ে বসেছে নিরা।তুলতুল ঘুমের নদীতে সাঁতার কাটছে আর নিরা জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখছে ।একের পর এক বাড়ি,দোকান-হাট ,গাছের সারিগুলোকে ছাড়িয়ে গাড়ি শা শা করে ছুটে চলেছে।মনে হচ্ছে ওগুলোর সাথে গাড়িটা দৌঁড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে।আর গাড়িটা ফাস্ট হওয়ার জন্য প্রাণ-পণ লড়াই করছে।দেখতে মন্দ লাগছেনা এই প্রতিযোগিতা।বাতাসের দাপটে নিরার হিজাবটা হালকা দুলছে।আকাশটা লাল আভায় ছেয়ে গেছে,দেখতে কি যে অপরুপ লাগছে আকাশটাকেও।সূর্যি মামা ঘুমানোর জন্য পায়তারা জুড়েছে।আর বেশি দূর নেই তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে।প্রায় চলেই এসেছে।মাগরিবের নামাজটা আর কাজা হওয়ার ভয় নেই।এই ভেবে সবাই শান্ত হয়ে বসে আছে গাড়িতে।কেউ তেমন কথা বলছেনা।ফয়েজ শুধু ড্রাইভারের সাথে যা টুকটাক কথা বলছে।

গাড়ি এসে থামলো একটা ছোটখাট মোড়ের ওপর।কয়েকটা ছোটখাট দোকান রয়েছে সেখানে।পাশেই একটা সরু রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করলো আবার গাড়িটি।এবার একটা বিশাল বড় মাটির দোতলা বাড়ির সামনে গিয়ে থামলো গাড়িটি।বাড়ির দুইপাশে সারি সারি সুপারি গাছ,নারকেল গাছ লাগানো।সন্ধ্যাও হয়ে এসেছে।মাগরিবের আজানের সময় হয়ে এসেছে।সবাই একে একে নামলো গাড়ি থেকে ।গাড়ির শব্দে আগেই বাড়ি থেকে ছোট বড় কিছু মানুষ বের হয়ে এসেছে,সবাই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।আশেপাশের মানুষ ও উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে কে আসলো এই গাড়ি করে,গ্রামে বড় গাড়িতো আর সবসময় দেখা পাওয়া যাই না।,একজন বৃদ্ধা মহিলা গাড়ির আরো কাছে এগিয়ে আসলেন।তাকে দেখেই ফজিলা বেগম সালাম দিলেন সাথে মাহফুজা বেগম সহ নিহাও।নেওয়াজ সাহেবো সালাম দিলেন তাকে তারপর কুশল বিনিয়ম করলেন সবাই বৃদ্ধা মহিলার সাথে।নিহা কাছে যেতেই নিহাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদর করে দিলেন তিনি।নিহা বললো বৃদ্ধা মহিলাকে,দাদি কেমন আছো ?পেছন থেকে ফয়েজ এসে দাদিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,কি গো বুড়ি তোমার রুপতো আরো দিন দিন বাড়তেই আছে ?ব্যাপারটাকি বলতো।দাদিও হাসতে হাসতে বললেন আমার যদি এরকম নায়ক নায়ক পুতা থাকে তাহলেতো সুন্দর থাকতেই হবে।(রাজশাহীতে পুত্রের ছেলেকে পুতা বলে আর মেয়েকে পুত্নি বলে)নিহাকে দাদি বললো ভালো আছিগো বড়ভাবি,তোর কি খবর আমার পুতা কেমন আদর সোহাগ করে তোকে?পাশে তাকিয়ে নিহা শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে আর বাবা-মাকে দেখে নিলো তারা অন্যদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত তারপর দাদিকে বললো তোমার পুতা তো আমাকে সময় ই দেয় না তেমন ,সারাক্ষণ তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত তবে রাতের বেলা তারটা সে ঠিক ই আদায় করে নেয়,অভিমানী সুরে বলতে বলতে শেষে লজ্জা লজ্জা মুখে আর ঠোঁটে লজ্জার হাসি নিয়ে কথাগুলো বললো নিহা।ফয়েজ পাশে দাঁড়িয়ে তার বৌএর লজ্জামাখা মুখটা দেখছে আর মনের মধ্যে সেই প্রথম দেখে যেই ঝড়টা উঠেছিলো আবার শরীরের মধ্যেও উঠেছিলো সেটা এখন সে খুব করে অনুভব করছে।নিহার এই লজ্জামুখ দেখলে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা ফয়েজ,কাছে পাওয়ার জন্য মনটা সাথে শরীরটাও দোলা দিয়ে উঠে।দাদি বলে উঠলো থাক বড়ভাবি আর লজ্জা প্যাতে হবে না,চল সগলাই(সবাই) বাড়িত চল।বড় বৌ চলো গো সগলাই ভিতরে চলো।মাহফুজা বেগমকে বললেন চলো মা চলো।এদিকে মাগরিবের আজানো হয়্যা গেলছে চলো সগলাই নামাজ পড়ে তখন গল্প করোহনি ।কলতলায় বসে সবাই একে একে ওজু করে বারান্দায় খেজুরের পাটিতে নামাজ পড়তে শুরু করলো ।তুলতুলকে নিয়ে এসেই শুয়ে দিয়েছিলো নিরা একটা ঘরে।এখন সে ঘুম থেকে উঠে শুয়ে শুয়ে পিট পিট চোখে ঘরের প্রতিটি কোণা পরখ করে দেখছে আর হয়তো ভাবছে এটা কার রুম ,এটাতো তাদের রুম না তাহলে।ঘরটা মাটির,মাটির ঘর সাধারণত অতিরিক্ত বড় হয় না।আবার কোন কোন ঘর বড় ও থাকে।এই ঘরটা মাঝারি সাইজেরি আছে।চারিদিক দেখা শেষ হলে তুলতুল এবার উঠে বসলো বিছানার ওপর।তারপর দুইহাত দিয়ে চোখগুলো কচলালো।মাম্মাম ও মাম্মাম তুমি কুতায় আতো না আমাল ভয় কলছে,ও মাম্মাম।তুলতুল সাধারণত ঘুম থেকে উঠে কাঁদেনা কিন্তু এই ঘরটা ওর কাছে অপরিচিতো লাগছে তাই সে এবার কেঁদেই ফেললো আর মাম্মাম আতো বলে ডাকতে শুরু করলো।নিহা বারান্দাতেই নামাজ পড়ছিলো ,নামাজে সালাম ফিরিয়ে বসে দোয়া পড়ছিলো তখনি তুলতুলের কান্নার আওয়াজ কানে আসতেই দৌঁড়ে উঠে মেয়ের কাছে ছুটে গেলো সে।এইতো মা আমি এসে গেছি কেঁদো না আসো বলে কাছে নিয়ে আসলো তুলতুলকে নিহা।অনেকক্ষণ বুকে নিয়ে আদর করার পর তুলতুল চুপ করে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলো।ফয়েজ নিহাকে খুঁজতে খুঁজতে নিহারা যেই রুমে আছে সেখানে এসে পৌঁছালো।ফয়েজ গেছিলো মসজিদে নামাজ পড়তে।তাই বাড়ি এসে বৌ আর মেয়েকে দেখতে না পেয়ে ওদের খোঁজ করতেই ওর মেজো চাচী বললো ওরা এই ঘরে আছে যাও তুমি।তুলতুলের চুলে হাত দিয়ে ফয়েজ বললো, আমার আম্মুটা কি করে রে,বেড়াতে এসে মাম্মামের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে রাখলে হবে বলোতো চলো তোমাকে তোমার দাদিমার কাছে রেখে আসি চলো।তুলতুল এবার মুখটা তুললো তার বাবার দিকে।তারপর বললো ,তলো দাই আমলা, মাম্মাম তলো তলো বেলাইগা।ফয়েজ সাথে সাথে অস্থির হয়ে বললো না না মা,তোমার মাম্মাম রেস্ট করুক,কতদূর থেকে এসেছে,এই তুমি শুয়ে পড়ো বলে জোর করে নিহাকে শুয়িয়ে দিলো ফয়েজ।তুলতুল বললো,আমি মাম্মামের সাথেই তাহলে শুয়ে পলি তুমি শুয়ে পলো বাবাই,আতো আতো।ফয়েজ এবার কি করবে ভাবলো একটু নিহাকে নিয়ে ঘরের মধ্যে একান্তে সময় কাটাবে কিন্তু তার মেয়েতো বের হতেই চাচ্ছেনা।নিহা ফয়েজের ফেসটা দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।বেচারার মনটা খারাপ হয়ে গেছে মেয়েকে এখান থেকে সড়াতে পারছেনা তাই।নিহা। ফয়েজের মতলব খুব ভালোভাবেই টের পেয়েছে।
তুলতুল পেয়ারা খাবা ,লাল লাল পেয়ারা?কুতায় লাল লাল পেয়ালা বাবাই আমি খাবো বলে উঠে বসলো তুলতুল,চলো তোমার দাদিমার কাছে ,তোমার দাদিমাকে গিয়ে বললেই দিবে।এই কথা শুনে ওমনি দাঁড়িয়ে পড়লো তুলতুল তারপর লাফ দিয়ে ফয়েজের কোলে উঠে পড়লো।আর বললো তলো তলো লাল লাল পেয়ালা কাবো।ফয়েজ তুলতুলকে নিয়ে বের হতেই উৎসকে দেখতে পেলো,এই উৎস আম্মার কাছে তুলতুলকে নিয়ে যা তো,উৎস হাত বাড়িয়ে তুলতুলকে নিলো তারপর নিয়ে চলে গেলো,এদিকে ফয়েজ মহা আনন্দে রুমে এসে প্রথমেই দরজাটা লাগালো তার ঘুরে খাটেরদিকে তাকাতেই দেখলো নিহা কাঁথা জড়িয়ে মুখ টুক ঢেকে শুয়ে আছে।ফয়েজ মনে মনে আচ্ছা বলে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিহার কাছে গিয়ে নিহার শরীরের উপর নিজের ভারি শরীরটা তুলে দিলো।ওমনি নিহা মুখ বের করে বলতে যাবে এই নামো আমার উপর থেকে তা বলার আগেই ফয়েজ শক্ত করে দুই হাত দিয়ে নিহার দুই গাল চাপ দিয়ে তার ঠোঁটটা দখল করে নিলে।এদিকে নিহা উম উম করছে আর ফয়েজকে নামানোর চেষ্টা করছে।এদিকে দরজার উপর ও দুরুম দারুম পড়ছে বাইরে থেকে তুলতুল দরজায় জোরে জোরে মারছে আর মাম্মাম ,বাবাই বলে ডেকে যাচ্ছে।তুলতুলের ডাক কানে যেতেই ফয়েজ নিহার ঠোঁটদুটো ছেড়লো তারপর তুলতুলের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে দরজা খুললো।এদিকে নিহা বেচারি হাঁপাচ্ছেতো হাঁপাচ্ছেই।এতক্ষণ ওর মনে হচ্ছিলো ঠোঁটদুটোই না ফয়েজ খেয়ে ফেলে এই অবস্থা।সুযোগ পেলেই ওর ঠোঁটের ওপর হামলা করে এই ছেলে,কি পায় ঠোঁটে কে জানে।

উঠানে দড়ির খাটে বসে আছে ফজিলা বেগম,মাহফুজা বেগম,নিরা আর জমেলা বেগম(দাদি)।পাশেই রান্নাঘরে রান্না করছে নিহা মেজো শ্বাশুরী।তারা এই বাড়িতে থাকে।জমেলা বেগমের চার ছেলে এক মেয়ে ,মেয়ে বিয়ে দিয়েছে পাশের গ্রামে।জামান সাহেব থাকেন রাজশাহী শহরে,জামান সাহেবের মেজো ভাই এই বাড়িতেই থাকে আর বাকি দুই ভাই ওরা পাশেই আলাদা আলাদা বাড়ি করেছেন দু এক বছর আগে তাই এই বিশাল মাটির দোতলা বাড়িতে জামেলা বেগম আর তার মেজো ছেলে থাকে বৌ ছেলে-মেয়ে নিয়ে।ফজিলা বেগমেরা যখন গ্রামে আসেন তখন তারা থাকেন এই বাড়িতেই।এতক্ষণ জমিলা বেগমের বাকি দুই বৌমাও ছিলো এখানেই একটু আগেই চলে গেছে তারা নিজ নিজ বাড়িতে।রাজশাহীর বরেন্দ্র এলাকায় বাড়ি বলে আশে পাশে অনেক এমন দোতলা বাড়ি আছে।আর লাল মাটি চারিদিকে।এই লাল মাটি দিয়েই তারা মাটির মেঝেগুলো লেপে রেখেছে।আর দেয়ালগুলোই কিভাবে যেনো চর্তুভূজের মত করে এঁকে রেখেছে।ওভাবেই ওরা লেপে রাখে।দেখতে অনেক সুন্দর লাগে।জমেলা বেগম নিরাকে বললো কিলু সই তুই তো আরো বড় হয়্যা গেলছিস বিহ্যার (বিয়ের)বয়স তো হয়্যা গেলছে(গেছে) বর টর খুঁজবো নাকি।নিরা দাদির হাত ধরে বললো,এত তাড়াতাড়ি না দাদি ,পড়াশোনা শেষ করি আগে তারপর।জমেলা বেগম হাসতে হাসতে বললেন ,কি বলছিসরে বুবু আমহারে এখেনেতো আরো আগেই মানে ইসকুলে পড়তেই ছুড়ি পুড়ির বিহ্যা(বিয়ে)হয়্যা যাই।নিরা বললো,দাদি শহরেও হয় তবে খুব কম,অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করে তখন বিয়ে করে বুঝেছেন।হ্যা বুঝ্যাছি বলে ফোকলা দাঁতে জমিলা বেগম একটা মিষ্টি হাসি দিলেন।জমিলা বেগম এইবার ফজিলা বেগমকে বললেন,বৌমা ফারদিন কি সত্যিই আসবেনা?কিজানি মা ,আপনাকে তো আগেই ফোনে বলেছিলাম যে ফারদিন আসতে চাচ্ছেনা বলে মুখটা ভার করে নিলো ফজিলা বেগম।মন খারাপ করোনা বৌমা,তোমার ব্যাটা যদি না আসে তাহিলে তো আর জোর করে আনতে পারব্যানা তাইনা বলে জমিলা বেগম ফজিলা বেগমের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে।টিনের চালে কেমন ছন্দ হচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটায়,প্রায় একঘন্টা আগে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।খেয়ে দেয়ে সবাই আপন আপন রুমে শুয়ে পড়েছে।অনেকগুলো ঘর থাকায় সবাই আলাদা আলাদা ঘরেই আছে।গ্রামে একটু রাত হলেই সবাই শুয়ে পড়ে,এখন ঘড়িতে বাজে রাত এগারোটা।কারোরি তেমন ঘুম আসছেনা।তাই সবাই শুয়ে শুয়ে বৃষ্টিকে অনুভূব করছে।

চলবে…..

আবারো দুঃখিত দেরি করে দেওয়ার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here